alt

উপ-সম্পাদকীয়

ও আমার স্বপ্ন ঝরা আকুল করা জন্মভূমি

শেখর ভট্টাচার্য

: মঙ্গলবার, ০৭ জানুয়ারী ২০২৫
image

সিলেটের জলাবন ‘রাতারগুল’

‘ও আমার স্বপ্ন ঝরা আকুল করা জন্মভূমি’ জহির রায়হানের বিখ্যাত ‘জীবন থেকে নেয়া’ চলচ্চিত্রে খান আতার লেখা এই গানটি ব্যবহার করা হয়েছিল। সম্প্রতি সিলেটের অপরূপ সৌন্দর্যম-িত কয়েকটি স্থান ভ্রমণকালে এই অসাধারণ গানটি মনে এবং প্রাণে অবিরত বাজতে থাকে। সিলেটকে প্রকৃতি তার রূপ, রং, রস, দিয়ে অকাতরে সাজিয়ে তুলেছে বিচিত্রভাবে। বৃহত্তর সিলেটের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য যে কোনো প্রকৃতিপ্রেমী মানুষের হৃদয়ে দোলা দিয়ে যায়। কী নেই প্রকৃতিকন্যা সিলেটের কোণে, কোণে? মেঘালয়ে যেমন মেঘেরা খেলা করে, পাহাড়ের গায়ে, গায়ে, রবীন্দ্রনাথের শ্রীভূমিতেও পাহাড়ে টিলায় মেঘেরা ঘুরে বেড়ায় নান্দনিক সৌন্দর্যের অপরূপ বহর নিয়ে। বাংলাদেশে বসে আমাজনের অতুলনীয় সৌন্দর্য উপভোগের অপার সুযোগ আছে সিলেটে। আমাজনের মতো ‘জলাবন’ দেখার বিরল সুযোগ বাংলাদেশে আর কোথাও আছে ?

বাংলাদেশ গর্ব করতে পারে সিলেটের জলাবন ‘রাতারগুল’কে নিয়ে। মেঘালয়ের পাহাড় থেকে নূপুরের ছন্দে নেমে আসা টলটলে স্বচ্ছ জলরাশি, বাংলাদেশে এসে স্রোতস্বীনি গোয়াইন নদী। চোখ ধাঁধানো সুন্দর এই গোয়াইন নদীর দক্ষিণে বিশাল হাওর। এই হাওর আর নদীর মধ্যে রহস্য, ভালোবাসা আর বৈচিত্র্য নিয়ে অপূর্বভাবে দাঁড়িয়ে আছে জলাবন ‘রাতারগুল’। বিশ্বজুড়ে জলাবনের সংখ্যা কিন্তু খুব বেশি নেই। সারা বিশ্বে স্বাদু পানিতে জলাবন আছে মাত্র বাইশটি, এর একটি হলো রাতারগুল। দক্ষিণ এশিয়ায় জলাবন আছে মাত্র দুটিÑ একটি শ্রীলঙ্কায়, আরেকটি আমাদের সিলেটের গোয়াইনঘাট উপজেলায়। রাতারগুলের সৌন্দর্যের সঙ্গে বিশ্বে শুধু আরেকটি বনের সৌন্দর্যের তুলনা চলে, সেটি হলো পৃথিবীর বৃহত্তম স্বাদু পানির জলাবন আমাজন। রাতারগুলকে তাই অনেকেই বাংলাদেশের আমাজন নামে আখ্যায়িত করে থাকেন। এই জলাভূমির ফাঁকে ফাঁকে হাজার রকমের বৃক্ষ লতা, কীটপতঙ্গ সঙ্গে নিয়ে নৌভ্রমণ হৃদয়ে অনন্য প্রশান্তি নিয়ে আসার এক অসাধারণ মাধ্যম।

এতটুকু লেখার পর হঠাৎ করে আমার এক বিদেশি বান্ধবীর কথা মনে এলো। এই বান্ধবী যিনি আমার সহকর্মী, এসেছিলেন বাহামা থেকে। আমি এবং এই সহকর্মী এক সঙ্গে স্পিডবোটে করে কিশোরগঞ্জ থেকে ভরা বর্ষায় অষ্টগ্রাম উপজেলায় অফিসের কাজে যাচ্ছিলাম। হাওরের এই মন ভোলানো সৌন্দর্য দেখে তিনি অভিভূত হয়ে পড়েছিলেন। হাওর নিয়ে অনেক কথা শোনার পর তিনি তার দেশ বাহামার সৌন্দর্যের বর্ণনা দিলেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডা ও কিউবার মাঝামাঝি স্থানে সাতশটি বড়, বড় দ্বীপ ও হাজারখানেক ক্ষুদ্র বালুকাময় দ্বীপ নিয়ে একটি অপুর্ব সুন্দর দেশ বাহামা। দ্বীপগুলোর পাশ দিয়ে ছোট, ছোট সমুদ্রসৈকত দেশটিকে সারা পৃথিবীর মানুষের কাছে একটি আকর্ষণীয় পর্যটন ভূমি হিসেবে পরিচিতি দিয়েছে। বাহামার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের টানে সারা বছর হাজার হাজার মানুষ সেখানে ভিড় করে থাকেন।

আমার বান্ধবী কথার শেষ পর্যায়ে একটি কথা বলছিলেন, বাহামার মানুষ মনে করে বাহামা এতই সুন্দর যে, ‘পৃথিবীতে যদি ঈশ্বর বসবাস করার সিদ্বান্ত গ্রহণ করে থাকেন, তিনি নিশ্চয়ই বাহামাকে বেছে নেবেন।’ কথাটি নিছক দেশপ্রেম থেকে বলা। আমি তাকে বৃহত্তর সিলেটের বর্ণনা দিয়ে বলেছিলাম দেখো, আমি বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে বলতে পারি আমার জন্ম যে জেলায়, সে জেলার সৌন্দর্যও এত হৃদয়হরণ করা যে তোমাদের দেশের মতো আমিও বলতে পারি ঈশ্বর যদি সত্যিই এরকম সিদ্বান্ত নিয়ে থাকেন তাহলে তিনি সিলেট ছাড়া আর অন্য কোনো জনপদকে বেছে নেয়ার চিন্তাও করবেন না। দুজনই কথাটি বলে হেসে উঠেছিলাম, দেশপ্রেমের আতিশয্যে বলা এই কথাটির অতিরঞ্জন অনুভব করে।

প্রকৃতি কী তার কন্যা শ্রীভূমিকে শুধু রাতারগুল উপহার দিয়েছে? সবুজ ঢেউয়ের মতো ছোট ছোট টিলা, পাহাড়, প্রাকৃতিক ঝর্ণা, সমুদ্রের মতো বিশাল জলরাশির হাওর, যে হাওর তার বিশালত্ব দিয়ে আপনাকে উদাস, ঘরছাড়া বাউল হওয়ার আহ্বান জানায়। হাওরের ঢেউ এবং বিশালতার দর্শন যে কোনো মানুষকে পৃথিবীর জটিলতা, সার্থান্ধতা, হিংসা, দ্বেষ ভুলিয়ে ভালোবাসায় ভুবন জয়ের কথা বলবে। এই নশ্বর পৃথিবীর বিলাস ব্যসন ভুলিয়ে হাছন রাজার মতো মনকে বাউল করে দেবে মুহূর্তে। পৃথিবীর অসারতা উপলব্ধি করে হৃদয়ে বেজে উঠবে সেই গান, ‘কী ঘর বানাইলাম আমি, শূন্যেরও মাঝার... লোকে বলে, বলে রে ঘর বাড়ি বালা নায় আমার।’

সিলেটের সৌন্দর্যের বৈচিত্র্য অপরিসীম। একদিকে যেমন পাহাড়, টিলা দাঁড়িয়ে আছে সবুজ নদীর ঢেউ হয়ে অন্যদিকে বিচিত্র সৌন্দর্যের নদী মালার মতো জড়িয়ে আছে সিলেটের বিস্তীর্ণ প্রান্তরে। আমাকে সব চেয়ে বেশি টানে সিলেটের পাহাড়ি নদনদীগুলো। গোয়াইন, পিয়াইন, সারি, পুরকচি, কাপনা, ডাকসা, জাদুকাটা আরো কত কত নদী। পাহাড়ি নদীগুলো কখনো খরস্রোতা আর কখনো বা কিশোরী মেয়ের মতো চপল আর কখনো শান্ত সুবোধ বালক। পাহাড়ি পাথর বালি, নদীর জলকে পরিশ্রুত করে এত স্বচ্ছ করে তোলে যে, যে কোনো মানুষ নদীর উপর থেকে নদীর গভীরের তলদেশ সরাসরি দেখতে পারেন।

আপনি জাদুকাটা নদী দিয়ে তাহিরপুরকে পাশে রেখে চলে যেতে পারেন, মেঘালয়ের পাহাড়ের কাছে যেখান থেকে নদীটি তার পথচলা শুরু করেছে। ভারতের মেঘালয় থেকে নেমে আসা জাদুকাটা নদীটি তাহিরপুর উপজেলার উত্তর-পূর্ব প্রান্ত দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। আহা কী অপূর্ব সেই পাহাড়। মেঘেরা পাহাড়কে জড়াজড়ি করে নৃত্য করছে। কখনো একটু খানি সোনা রোদের দেখা পেলে মেঘের সঙ্গে রোদের খেলা, সে এক অপার্থিব দৃশ্য। আর পাহাড়? সবুজ পাহাড়ি চাদর গায়ের খরস্রোতা নদীর ঢেউয়ের মতো পাহাড় যেন, মনের আনন্দে ঘুমিয়ে থাকে আকাশে হেলান দিয়ে। নজরুলের সেই বিখ্যাত গানের মতো, ‘আকাশে হেলান দিয়ে পাহাড় ঘুমায় ওই’। পাহাড়কে আকাশের কোলে মাথা রাখার অপরূপ দৃশ্য আছে সুনামগঞ্জের তাহিরপুরের সেই পাহাড়গুলোতে। জাদুকাটা নদী দিয়ে গেলে দেখতে পাবেন আকাশ, পাহাড়, নদীর মিথষ্ক্রিয়ার এক অনিন্দ্য সুন্দর খেলা।

পাহাড়ি নদীগুলোর সব কটির সৌন্দর্যের ভিন্ন ভিন্ন রূপ রয়েছে। প্রতিটি নদীই আপনার মনের সৌন্দর্য ক্ষুধা ও চোখের দৃষ্টি ক্ষুধা মেটাবে। এতগুলো নদীর মধ্যে আর একটি নদীর কথা না বললেই নয়, সেটি হলো লালাখাল নদী। লালা খালের নীল জল রাশি যারা দেখেননি, তারা নদীর সৌন্দর্য যে কী, তা উপলব্ধি করতে পারবেন না। ভারতের চেরাপুঞ্জি, যেখানে পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি বৃষ্টি হয় ঠিক তার নিচেই এই অপূর্ব নদী। চেরাপুঞ্জি পাহাড় থেকে এই পাহাড়ি মেয়ে নেমে এসেছে কবিতা, সংগীত আর নৃত্যের ছন্দে। বাংলাদেশের এই ‘নীল নদ’ আপনাকে অবাক করবে, আপনার সৌন্দর্য পিপাসাকে আকণ্ঠ মিটিয়ে দেবে। এ নদীর জলের রং যেমন মানুষের মনকে দোলা দিয়ে যায়, নদীটির আরেকটি বৈশিষ্ট যে কোনো ভ্রমণপিপাসুর হৃদয়ে সাড়া জাগিয়ে যায়, সেটি হলো লালাখাল নদীর অসংখ্য বাঁক। ছবির মতো সুন্দর এই বাঁকগুলো দিয়ে যখন আপনি নৌবিহার করবেন মনে হবে, এই ‘নীল নদ’ পৃথিবীর সুন্দরতম নদগুলোর মধ্যে একটি।

সিলেটের চারপাশে, সিলেটের সব কোনে, ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে এত নদী, এত বন, এত ঝর্ণা, এত হাওর, এত চা-বাগান, এতসব স্বর্গীয় সৌন্দর্যম-িত এলাকা, ক্ষুদ্র পরিসরে এই স্বর্গীয় সৌন্দর্যকে তুলে ধরা কষ্টকর। আশা করি বিচিত্র এসব প্রাকৃতিক সৌন্দর্যকে ধীরে ধীরে উন্মোচন করার চেষ্টা করব পাঠকদের সামনে কোনো একসময়। কিন্তু এই মুহূর্তের সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হলোÑ এই প্রাকৃতিক সৌন্দর্যম-িত পাহাড় , নদী, ঝর্ণাকে কি আমরা সঠিকভাবে সংরক্ষণ করছি। সিলেটের নদী, সিলেটের পাহাড়, সিলেটের প্রাকৃতিক সম্পদকে রক্ষা করার জন্য আমাদের প্রকৃতি বিজ্ঞানী, খনিজসম্পদ নিয়ে যারা কাজ করেন, পরিবেশবিষয়ক বিশেষজ্ঞ যারা তাদের কথা, তাদের উপদেশ কি আমরা শুনছি? খনিজসম্পদ ব্যুরো প্রাকৃতিক সম্পদ পাথরকে রক্ষা করার জন্য এ বছর কোন পাথর কোয়ারি লিজ দেননি । কিন্তু এসব রীতি নীতি কি আমরা মেনে চলছি? পরিবেশ, প্রতিবেশকে ধ্বংস করার জন্য বোমা মেশিন’ নামের যন্ত্র ব্যবহার করে অনিয়ন্ত্রিত মাত্রায় পাথর তোলা হচ্ছে বহু বছর ধরে। প্রকৃতির দান আমাদের এই প্রাকৃতিক সৌন্দর্যকে রক্ষা করতে হবে সবাই মিলে, আবার প্রাকৃতিক সম্পদকেও বিজ্ঞানীদের দেখানো পথ অনুসরণ করে ব্যবহার করতে হবে।

আশা করব, সুন্দরকে আমরা লালন করব। কুৎসিত, অসুন্দর, লোভী মানুষের লোভের কাছে সুন্দরকে হারাতে দিলে চলবে না, এটি অনেকটা নিজেদের জীবনকে, নিজেদের সাজানো ঘরকে ধ্বংস করে দিয়ে নিয়তির অথৈ জলে ভেসে থাকার মতো অপরিনামদর্শী কাজ হয়ে যাবে। প্রকৃতিকে যদি আমরা ভালোবাসি, প্রকৃতির সৌন্দর্যকে নিয়ে যদি আমরা গর্ব বোধ করি, তাহলে, সব অংশীজনের সম্মিলিত উদ্যোগ প্রয়োজন খুব দ্রুত। সময়ের সতর্কসংকেত কি আমরা শুনতে পাচ্ছি। সময় দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে।

[লেখক : প্রাবন্ধিক ও উন্নয়ন গবেষক]

কোথায় নাই কোটা?

ব্রেন রট: বর্তমান সময়ের এক মারাত্মক ব্যাধি

যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলুক দেশের গবেষণা

নির্মোহ ইতিহাস চর্চা ও রাষ্ট্র সংস্কার প্রয়াসে শিক্ষা

জলবায়ুর পরিবর্তন ও দেশের ভবিষ্যৎ

প্রসঙ্গ : থিয়েটার ফর থেরাপির তাত্ত্বিক ও প্রায়োগিক পাঠ

শ্বেতপত্রে নতুন কী আছে?

ছবি

ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান ও জুনো ভাইয়ের স্মৃতি

পরিবেশ সুরক্ষায় সার্কুলার ইকোনমি

বাজার নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না কেন

ভাড়া ‘নির্ধারণ’ কিংবা ‘নিয়ন্ত্রণ’ করবে কে?

ব্যাংক ও আর্থিক খাতের জন্য কেমন ছিল ২০২৪ সাল?

স্বৈরাচারের শেষ নেই...

ছবি

স্মরণ : বাংলা সাহিত্যের অমর কথাশিল্পী

দোষারোপের রাজনীতি আর কত

জ্ঞান, দক্ষতা ও সৃজনশীলতার বিকাশে চাই বিকেন্দ্রিক শিক্ষাব্যবস্থা

যৌন নিপীড়ন প্রসঙ্গে

চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কতটা সফল হবে?

নতুন বছরের প্রত্যাশা

ছবি

মানবিক বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়ে জেগে উঠি নতুন বছরে

দোষারোপের রাজনীতি আর কত

প্রশাসনিক সংকট ও ভবিষ্যতের করণীয়

ছবি

বিপ্লবী রাজনীতির কাণ্ডারি : কমরেড মণি সিংহ

স্বাস্ব্য সংস্কার : কী কী বিষয়ে গুরুত্ব দেয়া জরুরি

জনশিক্ষা, গণশিক্ষা ও পারিবারিক শিক্ষা : রাষ্ট্রসংস্কারের মৌলিক ভিত্তি

জাহাজ ভাঙা শিল্প ও পরিবেশ বিপর্যয়

ছিন্নমূল মানুষের ‘শীত-জীবন’

বিভাজিত তাবলিগ জামাতের দ্বন্দ্ব

কোন পথে দেশ?

অহেতুক মুক্তিযুদ্ধকে প্রতিপক্ষ বানিয়ে কি লাভ হচ্ছে?

রম্যগদ্য : ‘অন্ডুল নাস্তি...’

অনিরাপদ সড়ক, সমাধান কোথায়?

চাই দৃশ্যমান পরিবর্তন

বিজ্ঞান, প্রযুক্তি এবং পরিবেশ নিয়ে ভাবনা

সুন্দর সমাজ বিনির্মাণের স্বপ্ন

ধনিক শ্রেণীর চলমান সংকট

tab

উপ-সম্পাদকীয়

ও আমার স্বপ্ন ঝরা আকুল করা জন্মভূমি

শেখর ভট্টাচার্য

image

সিলেটের জলাবন ‘রাতারগুল’

মঙ্গলবার, ০৭ জানুয়ারী ২০২৫

‘ও আমার স্বপ্ন ঝরা আকুল করা জন্মভূমি’ জহির রায়হানের বিখ্যাত ‘জীবন থেকে নেয়া’ চলচ্চিত্রে খান আতার লেখা এই গানটি ব্যবহার করা হয়েছিল। সম্প্রতি সিলেটের অপরূপ সৌন্দর্যম-িত কয়েকটি স্থান ভ্রমণকালে এই অসাধারণ গানটি মনে এবং প্রাণে অবিরত বাজতে থাকে। সিলেটকে প্রকৃতি তার রূপ, রং, রস, দিয়ে অকাতরে সাজিয়ে তুলেছে বিচিত্রভাবে। বৃহত্তর সিলেটের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য যে কোনো প্রকৃতিপ্রেমী মানুষের হৃদয়ে দোলা দিয়ে যায়। কী নেই প্রকৃতিকন্যা সিলেটের কোণে, কোণে? মেঘালয়ে যেমন মেঘেরা খেলা করে, পাহাড়ের গায়ে, গায়ে, রবীন্দ্রনাথের শ্রীভূমিতেও পাহাড়ে টিলায় মেঘেরা ঘুরে বেড়ায় নান্দনিক সৌন্দর্যের অপরূপ বহর নিয়ে। বাংলাদেশে বসে আমাজনের অতুলনীয় সৌন্দর্য উপভোগের অপার সুযোগ আছে সিলেটে। আমাজনের মতো ‘জলাবন’ দেখার বিরল সুযোগ বাংলাদেশে আর কোথাও আছে ?

বাংলাদেশ গর্ব করতে পারে সিলেটের জলাবন ‘রাতারগুল’কে নিয়ে। মেঘালয়ের পাহাড় থেকে নূপুরের ছন্দে নেমে আসা টলটলে স্বচ্ছ জলরাশি, বাংলাদেশে এসে স্রোতস্বীনি গোয়াইন নদী। চোখ ধাঁধানো সুন্দর এই গোয়াইন নদীর দক্ষিণে বিশাল হাওর। এই হাওর আর নদীর মধ্যে রহস্য, ভালোবাসা আর বৈচিত্র্য নিয়ে অপূর্বভাবে দাঁড়িয়ে আছে জলাবন ‘রাতারগুল’। বিশ্বজুড়ে জলাবনের সংখ্যা কিন্তু খুব বেশি নেই। সারা বিশ্বে স্বাদু পানিতে জলাবন আছে মাত্র বাইশটি, এর একটি হলো রাতারগুল। দক্ষিণ এশিয়ায় জলাবন আছে মাত্র দুটিÑ একটি শ্রীলঙ্কায়, আরেকটি আমাদের সিলেটের গোয়াইনঘাট উপজেলায়। রাতারগুলের সৌন্দর্যের সঙ্গে বিশ্বে শুধু আরেকটি বনের সৌন্দর্যের তুলনা চলে, সেটি হলো পৃথিবীর বৃহত্তম স্বাদু পানির জলাবন আমাজন। রাতারগুলকে তাই অনেকেই বাংলাদেশের আমাজন নামে আখ্যায়িত করে থাকেন। এই জলাভূমির ফাঁকে ফাঁকে হাজার রকমের বৃক্ষ লতা, কীটপতঙ্গ সঙ্গে নিয়ে নৌভ্রমণ হৃদয়ে অনন্য প্রশান্তি নিয়ে আসার এক অসাধারণ মাধ্যম।

এতটুকু লেখার পর হঠাৎ করে আমার এক বিদেশি বান্ধবীর কথা মনে এলো। এই বান্ধবী যিনি আমার সহকর্মী, এসেছিলেন বাহামা থেকে। আমি এবং এই সহকর্মী এক সঙ্গে স্পিডবোটে করে কিশোরগঞ্জ থেকে ভরা বর্ষায় অষ্টগ্রাম উপজেলায় অফিসের কাজে যাচ্ছিলাম। হাওরের এই মন ভোলানো সৌন্দর্য দেখে তিনি অভিভূত হয়ে পড়েছিলেন। হাওর নিয়ে অনেক কথা শোনার পর তিনি তার দেশ বাহামার সৌন্দর্যের বর্ণনা দিলেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডা ও কিউবার মাঝামাঝি স্থানে সাতশটি বড়, বড় দ্বীপ ও হাজারখানেক ক্ষুদ্র বালুকাময় দ্বীপ নিয়ে একটি অপুর্ব সুন্দর দেশ বাহামা। দ্বীপগুলোর পাশ দিয়ে ছোট, ছোট সমুদ্রসৈকত দেশটিকে সারা পৃথিবীর মানুষের কাছে একটি আকর্ষণীয় পর্যটন ভূমি হিসেবে পরিচিতি দিয়েছে। বাহামার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের টানে সারা বছর হাজার হাজার মানুষ সেখানে ভিড় করে থাকেন।

আমার বান্ধবী কথার শেষ পর্যায়ে একটি কথা বলছিলেন, বাহামার মানুষ মনে করে বাহামা এতই সুন্দর যে, ‘পৃথিবীতে যদি ঈশ্বর বসবাস করার সিদ্বান্ত গ্রহণ করে থাকেন, তিনি নিশ্চয়ই বাহামাকে বেছে নেবেন।’ কথাটি নিছক দেশপ্রেম থেকে বলা। আমি তাকে বৃহত্তর সিলেটের বর্ণনা দিয়ে বলেছিলাম দেখো, আমি বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে বলতে পারি আমার জন্ম যে জেলায়, সে জেলার সৌন্দর্যও এত হৃদয়হরণ করা যে তোমাদের দেশের মতো আমিও বলতে পারি ঈশ্বর যদি সত্যিই এরকম সিদ্বান্ত নিয়ে থাকেন তাহলে তিনি সিলেট ছাড়া আর অন্য কোনো জনপদকে বেছে নেয়ার চিন্তাও করবেন না। দুজনই কথাটি বলে হেসে উঠেছিলাম, দেশপ্রেমের আতিশয্যে বলা এই কথাটির অতিরঞ্জন অনুভব করে।

প্রকৃতি কী তার কন্যা শ্রীভূমিকে শুধু রাতারগুল উপহার দিয়েছে? সবুজ ঢেউয়ের মতো ছোট ছোট টিলা, পাহাড়, প্রাকৃতিক ঝর্ণা, সমুদ্রের মতো বিশাল জলরাশির হাওর, যে হাওর তার বিশালত্ব দিয়ে আপনাকে উদাস, ঘরছাড়া বাউল হওয়ার আহ্বান জানায়। হাওরের ঢেউ এবং বিশালতার দর্শন যে কোনো মানুষকে পৃথিবীর জটিলতা, সার্থান্ধতা, হিংসা, দ্বেষ ভুলিয়ে ভালোবাসায় ভুবন জয়ের কথা বলবে। এই নশ্বর পৃথিবীর বিলাস ব্যসন ভুলিয়ে হাছন রাজার মতো মনকে বাউল করে দেবে মুহূর্তে। পৃথিবীর অসারতা উপলব্ধি করে হৃদয়ে বেজে উঠবে সেই গান, ‘কী ঘর বানাইলাম আমি, শূন্যেরও মাঝার... লোকে বলে, বলে রে ঘর বাড়ি বালা নায় আমার।’

সিলেটের সৌন্দর্যের বৈচিত্র্য অপরিসীম। একদিকে যেমন পাহাড়, টিলা দাঁড়িয়ে আছে সবুজ নদীর ঢেউ হয়ে অন্যদিকে বিচিত্র সৌন্দর্যের নদী মালার মতো জড়িয়ে আছে সিলেটের বিস্তীর্ণ প্রান্তরে। আমাকে সব চেয়ে বেশি টানে সিলেটের পাহাড়ি নদনদীগুলো। গোয়াইন, পিয়াইন, সারি, পুরকচি, কাপনা, ডাকসা, জাদুকাটা আরো কত কত নদী। পাহাড়ি নদীগুলো কখনো খরস্রোতা আর কখনো বা কিশোরী মেয়ের মতো চপল আর কখনো শান্ত সুবোধ বালক। পাহাড়ি পাথর বালি, নদীর জলকে পরিশ্রুত করে এত স্বচ্ছ করে তোলে যে, যে কোনো মানুষ নদীর উপর থেকে নদীর গভীরের তলদেশ সরাসরি দেখতে পারেন।

আপনি জাদুকাটা নদী দিয়ে তাহিরপুরকে পাশে রেখে চলে যেতে পারেন, মেঘালয়ের পাহাড়ের কাছে যেখান থেকে নদীটি তার পথচলা শুরু করেছে। ভারতের মেঘালয় থেকে নেমে আসা জাদুকাটা নদীটি তাহিরপুর উপজেলার উত্তর-পূর্ব প্রান্ত দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। আহা কী অপূর্ব সেই পাহাড়। মেঘেরা পাহাড়কে জড়াজড়ি করে নৃত্য করছে। কখনো একটু খানি সোনা রোদের দেখা পেলে মেঘের সঙ্গে রোদের খেলা, সে এক অপার্থিব দৃশ্য। আর পাহাড়? সবুজ পাহাড়ি চাদর গায়ের খরস্রোতা নদীর ঢেউয়ের মতো পাহাড় যেন, মনের আনন্দে ঘুমিয়ে থাকে আকাশে হেলান দিয়ে। নজরুলের সেই বিখ্যাত গানের মতো, ‘আকাশে হেলান দিয়ে পাহাড় ঘুমায় ওই’। পাহাড়কে আকাশের কোলে মাথা রাখার অপরূপ দৃশ্য আছে সুনামগঞ্জের তাহিরপুরের সেই পাহাড়গুলোতে। জাদুকাটা নদী দিয়ে গেলে দেখতে পাবেন আকাশ, পাহাড়, নদীর মিথষ্ক্রিয়ার এক অনিন্দ্য সুন্দর খেলা।

পাহাড়ি নদীগুলোর সব কটির সৌন্দর্যের ভিন্ন ভিন্ন রূপ রয়েছে। প্রতিটি নদীই আপনার মনের সৌন্দর্য ক্ষুধা ও চোখের দৃষ্টি ক্ষুধা মেটাবে। এতগুলো নদীর মধ্যে আর একটি নদীর কথা না বললেই নয়, সেটি হলো লালাখাল নদী। লালা খালের নীল জল রাশি যারা দেখেননি, তারা নদীর সৌন্দর্য যে কী, তা উপলব্ধি করতে পারবেন না। ভারতের চেরাপুঞ্জি, যেখানে পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি বৃষ্টি হয় ঠিক তার নিচেই এই অপূর্ব নদী। চেরাপুঞ্জি পাহাড় থেকে এই পাহাড়ি মেয়ে নেমে এসেছে কবিতা, সংগীত আর নৃত্যের ছন্দে। বাংলাদেশের এই ‘নীল নদ’ আপনাকে অবাক করবে, আপনার সৌন্দর্য পিপাসাকে আকণ্ঠ মিটিয়ে দেবে। এ নদীর জলের রং যেমন মানুষের মনকে দোলা দিয়ে যায়, নদীটির আরেকটি বৈশিষ্ট যে কোনো ভ্রমণপিপাসুর হৃদয়ে সাড়া জাগিয়ে যায়, সেটি হলো লালাখাল নদীর অসংখ্য বাঁক। ছবির মতো সুন্দর এই বাঁকগুলো দিয়ে যখন আপনি নৌবিহার করবেন মনে হবে, এই ‘নীল নদ’ পৃথিবীর সুন্দরতম নদগুলোর মধ্যে একটি।

সিলেটের চারপাশে, সিলেটের সব কোনে, ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে এত নদী, এত বন, এত ঝর্ণা, এত হাওর, এত চা-বাগান, এতসব স্বর্গীয় সৌন্দর্যম-িত এলাকা, ক্ষুদ্র পরিসরে এই স্বর্গীয় সৌন্দর্যকে তুলে ধরা কষ্টকর। আশা করি বিচিত্র এসব প্রাকৃতিক সৌন্দর্যকে ধীরে ধীরে উন্মোচন করার চেষ্টা করব পাঠকদের সামনে কোনো একসময়। কিন্তু এই মুহূর্তের সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হলোÑ এই প্রাকৃতিক সৌন্দর্যম-িত পাহাড় , নদী, ঝর্ণাকে কি আমরা সঠিকভাবে সংরক্ষণ করছি। সিলেটের নদী, সিলেটের পাহাড়, সিলেটের প্রাকৃতিক সম্পদকে রক্ষা করার জন্য আমাদের প্রকৃতি বিজ্ঞানী, খনিজসম্পদ নিয়ে যারা কাজ করেন, পরিবেশবিষয়ক বিশেষজ্ঞ যারা তাদের কথা, তাদের উপদেশ কি আমরা শুনছি? খনিজসম্পদ ব্যুরো প্রাকৃতিক সম্পদ পাথরকে রক্ষা করার জন্য এ বছর কোন পাথর কোয়ারি লিজ দেননি । কিন্তু এসব রীতি নীতি কি আমরা মেনে চলছি? পরিবেশ, প্রতিবেশকে ধ্বংস করার জন্য বোমা মেশিন’ নামের যন্ত্র ব্যবহার করে অনিয়ন্ত্রিত মাত্রায় পাথর তোলা হচ্ছে বহু বছর ধরে। প্রকৃতির দান আমাদের এই প্রাকৃতিক সৌন্দর্যকে রক্ষা করতে হবে সবাই মিলে, আবার প্রাকৃতিক সম্পদকেও বিজ্ঞানীদের দেখানো পথ অনুসরণ করে ব্যবহার করতে হবে।

আশা করব, সুন্দরকে আমরা লালন করব। কুৎসিত, অসুন্দর, লোভী মানুষের লোভের কাছে সুন্দরকে হারাতে দিলে চলবে না, এটি অনেকটা নিজেদের জীবনকে, নিজেদের সাজানো ঘরকে ধ্বংস করে দিয়ে নিয়তির অথৈ জলে ভেসে থাকার মতো অপরিনামদর্শী কাজ হয়ে যাবে। প্রকৃতিকে যদি আমরা ভালোবাসি, প্রকৃতির সৌন্দর্যকে নিয়ে যদি আমরা গর্ব বোধ করি, তাহলে, সব অংশীজনের সম্মিলিত উদ্যোগ প্রয়োজন খুব দ্রুত। সময়ের সতর্কসংকেত কি আমরা শুনতে পাচ্ছি। সময় দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে।

[লেখক : প্রাবন্ধিক ও উন্নয়ন গবেষক]

back to top