জিয়াউদ্দীন আহমেদ
প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস চমৎকারভাবে গুছিয়ে কথা বলেন, তাই তার বক্তৃতা শুনে সারা পৃথিবী। তিনি ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েই সবাইকে সরকারের ভুল-ভ্রান্তি তুলে ধরতে আহ্বান জানিয়েছে। তিনি অবাধ বাক-স্বাধীনতায় বিশ্বাসী। তিনি অতীতের দলীয় সরকারের রুদ্ধদ্বার পরিবেশ থেকে দেশের মানুষকে মুক্ত করার বাসনা ব্যক্ত করেছেন। শুধু প্রধান উপদেষ্টা নন, অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকেও বিভিন্ন সময় এই প্রতিশ্রুতি বারবার পুনর্ব্যক্ত করা হয়েছে। উপরন্তু ৫ আগস্টের গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে সৃষ্ট নতুন পরিবেশের অন্যতম প্রধান প্রতিশ্রুতিই হচ্ছে মিডিয়ার স্বাধীনতা। কিন্তু বাস্তবে দেশে যে ভিন্ন চিত্র বিরাজ করছে তা প্রধান উপদেষ্টার অজ্ঞাত থাকার কথা নয়। সরকারের সমালোচনা করার উদাত্ত আহ্বান থাকা সত্ত্বে¡ও মিডিয়া প্রকৃত তথ্য প্রকাশে প্রয়োজনের তুলনায় বেশি সংযত। ‘মব জাস্টিস’ আর ‘স্বৈরাচারের দোসর’ ট্যাগের ভয়ে বিগত পনেরো বছরের মতো তোষামোদি কথা বলে মিডিয়া নিজেদের নিরাপদ অবস্থান নিশ্চিত করছেন। সম্পাদক পরিষদ তাই মনে করছে, সংবাদ-মাধ্যমের স্বাধীনতা এখনো আক্রমণের মুখে।
আওয়ামী লীগ আমলে যেমন ‘সেলফ সেন্সরশিপ’ ছিল, এখনো অধিকাংশ সাংবাদিক তাই মেনে চলছেন। কাওরানবাজারে ‘প্রথম আলো’ পত্রিকা অফিসের সম্মুখে যে গরু জবাই করে প্রথম আলোর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানো হয়েছে সেই গরুর ওপর লেখা ছিল ‘মতি গরু’। এমন পরিবেশ-পরিস্থিতি লক্ষ্য করে অনেকে বিগত পনেরো বছরের ধারা বজায় রেখে চলছেন; ‘নতুন বাংলাদেশে’ নতুন চিন্তা পরিহার করে সনাতনী তোষামোদের অভ্যাস অক্ষুণœ রেখেছেন। তাই বলে সরকারের সমালোচনা একেবারেই যে হচ্ছে না তা কিন্তু নয়। আওয়ামী লীগের আমলের মতো এখনো অনেকে দেশের বাইরে অবস্থান করে যা ইচ্ছে তাই বলে যাচ্ছেন। অন্যদিকে দেশের অভ্যন্তরে যারা সরকারের সমালোচনা করছেন তাদের প্রায় সবাই আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে নিগৃহীত হয়েছেন, অথবা তারা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকে সক্রিয়ভাবে সমর্থন করেছেন। এর বাইরের কেউ সমালোচনা করলেই বলা হয়, ‘পনেরো বছর কই ছিলেন।’
আমাদের সংবিধানের তৃতীয় ভাগের ৩৯ নম্বর অনুচ্ছেদে রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, বিদেশি রাষ্ট্রসমূহের সহিত বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, জনশৃঙ্খলা, শালীনতা ও নৈতিকতার স্বার্থে কিংবা আদালত-অবমাননা, মানহানি বা অপরাধ-সংঘটনে প্ররোচনা সম্পর্কে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধানিষেধ সাপেক্ষে প্রত্যেক নাগরিকের বাক ও ভাব প্রকাশের এবং সংবাদক্ষেত্রের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দান করা হয়েছে। উল্লেখিত অনুচ্ছেদের শিরোনাম হচ্ছে- ‘চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা এবং বাকস্বাধীনতা’।
সংবিধান মোতাবেক বাকস্বাধীনতা খর্ব করার জন্য সরকারের হাতে প্রচুর ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। যে কোন লেখার বিশ্লেষণ বিভিন্ন আঙ্গিকে বিভিন্ন রকম হতে পারে এবং সব সময় তাই হয়ে আসছে, কিন্তু সরকার এমন ব্যাখ্যা উপস্থাপন করে যাতে যে কোন উসিলায় রাষ্ট্রবিরোধী মামলা রুজু করা সম্ভব হয়। এখন পতাকার অবমাননায় রাষ্ট্রদ্রোহী মামলা হচ্ছে। অথচ আমেরিকায় নিজের অধীনে থাকা জাতীয় পতাকাও রাস্তায় নেমে জনসম্মুখে দুমড়ে-মুচড়ে ছিন্নভিন্ন করা রাষ্ট্রবিরোধী কাজ হিসেবে গণ্য করা হয় না। জাতীয় পতাকার ডিজাইনে ব্রা ও বিকিনি পরা পশ্চিমা জগতে রাষ্ট্রবিরোধী কোন কাজ নয়। আমাদের দেশে আইন দ্বারা আরোপিত বিধিনিষেধ সুনির্দিষ্ট নয় বলেই সরকার তার যথেচ্ছ ব্যবহারের সুযোগ পায়।
কোন কর্তৃপক্ষের অনুমোদন গ্রহণ ব্যতিরেকে নিজের মত প্রকাশ করার নামই বাকস্বাধীনতা। এর অর্থ হচ্ছে মতপ্রকাশের স্বাধীনতায় কেউ অযাচিত হস্তক্ষেপ করবে না। প্রত্যেকের অধিকার আছে নিজের মতামত এবং অভিব্যক্তি প্রকাশ করার। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন অনুযায়ী স্বাধীনভাবে কোনো বাধা ব্যতীত মতপ্রকাশ করা, বিশ্বের যে কোনো মাধ্যম থেকে যে কোনো তথ্য সংগ্রহ করা এবং সেই তথ্য মৌখিক, লিখিত, চিত্রকলা অথবা অন্য কোনো মাধ্যমে জ্ঞাপন করার অধিকারই বাকস্বাধীনতা। তবে বাকস্বাধীনতার অধিকার প্রয়োগের ক্ষেত্রে জাগ্রত দায়িত্ব বোধ প্রত্যাশিত। বাকস্বাধীনতার অবাধ প্রয়োগে কখনো কখনো তৃতীয় ব্যক্তির মর্যাদাহানি বা সম্মানে আঘাত লাগার সম্ভাবনাও থাকে। কুৎসা রটানো, গুজব ছড়ানো, অশ্লীল বা আক্রমণাত্মক শব্দ দ্বারা কাউকে আক্রমণ করা থেকে বিরত রাখার জন্যই বাকস্বাধীনতা আইন দ্বারা সীমাবদ্ধ করা হয়। একজনের বাকস্বাধীনতা যখন অন্য আরেকজনের বাকস্বাধীনতার সঙ্গে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করে, সংঘর্ষ তৈরি করে তখন বাকস্বাধীনতা রুদ্ধ করা জরুরি হয়ে পড়ে।
সরকার সংবিধান মোতাবেক জাতীয় নিরাপত্তা ও জনশৃঙ্খলা বিনষ্টকারীর বিরুদ্ধে আইন প্রণয়ন এবং ব্যাপক অর্থে তা প্রয়োগও করতে পারে এবং করছেও। রাস্তায় মিছিল করা বা ওয়াজ করাও জনশৃঙ্খলা বিরোধী, কারণ রাস্তা বন্ধ করে মিছিল, সভা বা ওয়াজ করা হলে অন্য নাগরিকদের অবাধ চলাচলে বাধার সৃষ্টি হয়। অন্যের অধিকার হরণ করার এই নীতি বাংলাদেশে হরহামেশাই প্রয়োগ করা হয়। বিরোধী দল হরতাল, মিছিল, রাস্তা অবরোধ সব অধিকার চায়, কিন্তু ক্ষমতায় গিয়ে এই সব কর্মকা-কে অপরাধ মনে করে।
১৯৭৪ সালে প্রণীত ‘বিশেষ ক্ষমতা আইন’ নিয়ে ৫০ বছর যাবত বিরোধী দল বিরূপ সমালোচনা করে আসছে, কিন্তু ক্ষমতায় গিয়ে কেউ তা বাতিল করেনি। তদ্রƒপ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়েও বিরোধী দল সোচ্চার। এই আইনের অপপ্রয়োগ হলেও তা বাতিল হবে বলে মনে হয় না। কারণ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিরোধী পক্ষকে হেয় করার জন্য পতিতালয়ের রুচিহীন ও অশ্লীল ভাষা ব্যবহৃত হয়। এছাড়াও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যক্তিগত আক্রমণ, হুমকি, অসত্য কথন, ভুল তথ্য, গুজবের ছড়াছড়ির কারণে মানুষ বিভ্রান্ত হয়, সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়, মানুষ হানাহানিতে লিপ্ত হয়। তাই অশ্লীল ভাষা, গুজব আর মিথ্যা কথন রোধ করার জন্যই ডিজিটাল আইন প্রয়োজন।
অন্যের স্বাধীনতা খর্ব না করা পর্যন্ত মিডিয়ার স্বাধীনতা স্বীকার্য। কোন ব্যক্তির মানহানি করা শাস্তিযোগ্য অপরাধ- এটা মেনেই বাকস্বাধীনতা ভোগ করতে হয়। তবে সময় ও ক্ষেত্র ভিন্ন হলে মিডিয়ার স্বাধীনতার মাত্রায় ভিন্নতা আসে। এই ক্ষেত্রে পশ্চিমা জগত অনেকটা উদার, সরকার প্রধানকে ব্যাঙ বা শূকরের চেহারায় চিত্রায়ন করে মিডিয়ায় প্রকাশ করলেও প্রধানমন্ত্রী বা রাষ্ট্রপতির অপমান হয় না, মান যায় না। কিন্তু আমাদের দেশে সরকার প্রধানকে এভাবে ব্যঙ্গ করা হলে জেল-জরিমানা হবেই। তবে বিদ্বেষমূলক বক্তব্য সব দেশে রোধ করা হলেও ভারতীয় উপমহাদেশে হয় না। কারণ ধর্মীয় বক্তব্য যতই বিদ্বেষমূলক হোক না কেন তা অনেক ক্ষেত্রে ধর্মগ্রন্থ দ্বারা সমর্থিত। ইহজগতের কোন আইন দ্বারা ধর্ম প্রচারে বাধা সৃষ্টি করা প্রায় অসম্ভব। যারা আমাদের দেশে অবাধ বাকস্বাধীনতার ওকালতি করেন, তারাও কিন্তু ধর্মীয় ক্ষেত্রে বাকস্বাধীনতা রুদ্ধ করার পক্ষে। ধর্মীয় বিশ্বাসের বিরুদ্ধে বিজ্ঞানের আবিষ্কারকে রুদ্ধ করতে এক সময় রাষ্ট্র এবং ধর্ম একযোগে কাজ করেছে। এমন বহু ব্যক্তি আছেন যারা ডিজিটাল আইনের বিরুদ্ধে, কিন্তু ব্লাসফেমি আইনের পক্ষে।
বাকস্বাধীনতার সঙ্গে সত্যাসত্যের প্রশ্ন জড়িত। সবার জন্য গ্রহণযোগ্য কোন সত্য প্রতিষ্ঠা করা কঠিন। বাবরি মসজিদ ভেঙে ফেলা কিংবা নাসিরনগরে মন্দিরে হামলা নিশ্চয় সবার জন্য গ্রহণযোগ্য ঘটনা নয়। পৃথিবীর কোন ধর্মই সবার জন্য গ্রহণযোগ্য হয়নি, তাই ৪২০০ ধর্মের রাজত্বে পৃথিবীর ৮০০ কোটি লোক বাস করছে। কোন একক মত যখন শ্রেষ্ঠ অভিধায় সবার উপর চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হয় তখনি শুরু হয় দ্বন্দ্ব আর সংঘর্ষ। স্মতর্ব্য যে, কোন ধর্ম সর্বজনীন না হলেও ব্রুনো বা কোপারনিকাসের আবিষ্কৃত সত্য আজ সবাই গ্রহণ করেছে। দার্শনিক সক্রেটিসকে প্রদত্ত বিষপানে মৃত্যুদ- বা যিশুখ্রিস্টকে ক্রুশবিদ্ধ করে হত্যার রায় তখনকার রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষের বিচারের মাধ্যমে হয়েছিল; অন্যদিকে মহানবী হজরত মোহাম্মদ (সা.)-কে হিজরতের আগে হত্যার যে সিদ্ধান্ত কোরাইশ নেতারা নিয়েছিল তাও ছিল তাদের এক ধরনের বিচারিক সিদ্ধান্ত। তাই ‘মব জাস্টিজ’ বা আধুনিক বিচারিক সিদ্ধান্তের ‘রিমান্ড’-এর সঙ্গে সক্রেটিস বা যিশুখ্রিস্টের মৃত্যদ- প্রদানের চিন্তা-চেতনার মধ্যে খুব বেশি পার্থক্য নেই। অন্তর্বর্তী সরকার বিষয়টি যখনই অনুধাবন করবে তখনই মিডিয়া জগত প্রধান উপদেষ্টার আহ্বানে সাড়া দেবে।
[লেখক : সাবেক নির্বাহী পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক ]
জিয়াউদ্দীন আহমেদ
রোববার, ১২ জানুয়ারী ২০২৫
প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস চমৎকারভাবে গুছিয়ে কথা বলেন, তাই তার বক্তৃতা শুনে সারা পৃথিবী। তিনি ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েই সবাইকে সরকারের ভুল-ভ্রান্তি তুলে ধরতে আহ্বান জানিয়েছে। তিনি অবাধ বাক-স্বাধীনতায় বিশ্বাসী। তিনি অতীতের দলীয় সরকারের রুদ্ধদ্বার পরিবেশ থেকে দেশের মানুষকে মুক্ত করার বাসনা ব্যক্ত করেছেন। শুধু প্রধান উপদেষ্টা নন, অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকেও বিভিন্ন সময় এই প্রতিশ্রুতি বারবার পুনর্ব্যক্ত করা হয়েছে। উপরন্তু ৫ আগস্টের গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে সৃষ্ট নতুন পরিবেশের অন্যতম প্রধান প্রতিশ্রুতিই হচ্ছে মিডিয়ার স্বাধীনতা। কিন্তু বাস্তবে দেশে যে ভিন্ন চিত্র বিরাজ করছে তা প্রধান উপদেষ্টার অজ্ঞাত থাকার কথা নয়। সরকারের সমালোচনা করার উদাত্ত আহ্বান থাকা সত্ত্বে¡ও মিডিয়া প্রকৃত তথ্য প্রকাশে প্রয়োজনের তুলনায় বেশি সংযত। ‘মব জাস্টিস’ আর ‘স্বৈরাচারের দোসর’ ট্যাগের ভয়ে বিগত পনেরো বছরের মতো তোষামোদি কথা বলে মিডিয়া নিজেদের নিরাপদ অবস্থান নিশ্চিত করছেন। সম্পাদক পরিষদ তাই মনে করছে, সংবাদ-মাধ্যমের স্বাধীনতা এখনো আক্রমণের মুখে।
আওয়ামী লীগ আমলে যেমন ‘সেলফ সেন্সরশিপ’ ছিল, এখনো অধিকাংশ সাংবাদিক তাই মেনে চলছেন। কাওরানবাজারে ‘প্রথম আলো’ পত্রিকা অফিসের সম্মুখে যে গরু জবাই করে প্রথম আলোর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানো হয়েছে সেই গরুর ওপর লেখা ছিল ‘মতি গরু’। এমন পরিবেশ-পরিস্থিতি লক্ষ্য করে অনেকে বিগত পনেরো বছরের ধারা বজায় রেখে চলছেন; ‘নতুন বাংলাদেশে’ নতুন চিন্তা পরিহার করে সনাতনী তোষামোদের অভ্যাস অক্ষুণœ রেখেছেন। তাই বলে সরকারের সমালোচনা একেবারেই যে হচ্ছে না তা কিন্তু নয়। আওয়ামী লীগের আমলের মতো এখনো অনেকে দেশের বাইরে অবস্থান করে যা ইচ্ছে তাই বলে যাচ্ছেন। অন্যদিকে দেশের অভ্যন্তরে যারা সরকারের সমালোচনা করছেন তাদের প্রায় সবাই আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে নিগৃহীত হয়েছেন, অথবা তারা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকে সক্রিয়ভাবে সমর্থন করেছেন। এর বাইরের কেউ সমালোচনা করলেই বলা হয়, ‘পনেরো বছর কই ছিলেন।’
আমাদের সংবিধানের তৃতীয় ভাগের ৩৯ নম্বর অনুচ্ছেদে রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, বিদেশি রাষ্ট্রসমূহের সহিত বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, জনশৃঙ্খলা, শালীনতা ও নৈতিকতার স্বার্থে কিংবা আদালত-অবমাননা, মানহানি বা অপরাধ-সংঘটনে প্ররোচনা সম্পর্কে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধানিষেধ সাপেক্ষে প্রত্যেক নাগরিকের বাক ও ভাব প্রকাশের এবং সংবাদক্ষেত্রের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দান করা হয়েছে। উল্লেখিত অনুচ্ছেদের শিরোনাম হচ্ছে- ‘চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা এবং বাকস্বাধীনতা’।
সংবিধান মোতাবেক বাকস্বাধীনতা খর্ব করার জন্য সরকারের হাতে প্রচুর ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। যে কোন লেখার বিশ্লেষণ বিভিন্ন আঙ্গিকে বিভিন্ন রকম হতে পারে এবং সব সময় তাই হয়ে আসছে, কিন্তু সরকার এমন ব্যাখ্যা উপস্থাপন করে যাতে যে কোন উসিলায় রাষ্ট্রবিরোধী মামলা রুজু করা সম্ভব হয়। এখন পতাকার অবমাননায় রাষ্ট্রদ্রোহী মামলা হচ্ছে। অথচ আমেরিকায় নিজের অধীনে থাকা জাতীয় পতাকাও রাস্তায় নেমে জনসম্মুখে দুমড়ে-মুচড়ে ছিন্নভিন্ন করা রাষ্ট্রবিরোধী কাজ হিসেবে গণ্য করা হয় না। জাতীয় পতাকার ডিজাইনে ব্রা ও বিকিনি পরা পশ্চিমা জগতে রাষ্ট্রবিরোধী কোন কাজ নয়। আমাদের দেশে আইন দ্বারা আরোপিত বিধিনিষেধ সুনির্দিষ্ট নয় বলেই সরকার তার যথেচ্ছ ব্যবহারের সুযোগ পায়।
কোন কর্তৃপক্ষের অনুমোদন গ্রহণ ব্যতিরেকে নিজের মত প্রকাশ করার নামই বাকস্বাধীনতা। এর অর্থ হচ্ছে মতপ্রকাশের স্বাধীনতায় কেউ অযাচিত হস্তক্ষেপ করবে না। প্রত্যেকের অধিকার আছে নিজের মতামত এবং অভিব্যক্তি প্রকাশ করার। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন অনুযায়ী স্বাধীনভাবে কোনো বাধা ব্যতীত মতপ্রকাশ করা, বিশ্বের যে কোনো মাধ্যম থেকে যে কোনো তথ্য সংগ্রহ করা এবং সেই তথ্য মৌখিক, লিখিত, চিত্রকলা অথবা অন্য কোনো মাধ্যমে জ্ঞাপন করার অধিকারই বাকস্বাধীনতা। তবে বাকস্বাধীনতার অধিকার প্রয়োগের ক্ষেত্রে জাগ্রত দায়িত্ব বোধ প্রত্যাশিত। বাকস্বাধীনতার অবাধ প্রয়োগে কখনো কখনো তৃতীয় ব্যক্তির মর্যাদাহানি বা সম্মানে আঘাত লাগার সম্ভাবনাও থাকে। কুৎসা রটানো, গুজব ছড়ানো, অশ্লীল বা আক্রমণাত্মক শব্দ দ্বারা কাউকে আক্রমণ করা থেকে বিরত রাখার জন্যই বাকস্বাধীনতা আইন দ্বারা সীমাবদ্ধ করা হয়। একজনের বাকস্বাধীনতা যখন অন্য আরেকজনের বাকস্বাধীনতার সঙ্গে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করে, সংঘর্ষ তৈরি করে তখন বাকস্বাধীনতা রুদ্ধ করা জরুরি হয়ে পড়ে।
সরকার সংবিধান মোতাবেক জাতীয় নিরাপত্তা ও জনশৃঙ্খলা বিনষ্টকারীর বিরুদ্ধে আইন প্রণয়ন এবং ব্যাপক অর্থে তা প্রয়োগও করতে পারে এবং করছেও। রাস্তায় মিছিল করা বা ওয়াজ করাও জনশৃঙ্খলা বিরোধী, কারণ রাস্তা বন্ধ করে মিছিল, সভা বা ওয়াজ করা হলে অন্য নাগরিকদের অবাধ চলাচলে বাধার সৃষ্টি হয়। অন্যের অধিকার হরণ করার এই নীতি বাংলাদেশে হরহামেশাই প্রয়োগ করা হয়। বিরোধী দল হরতাল, মিছিল, রাস্তা অবরোধ সব অধিকার চায়, কিন্তু ক্ষমতায় গিয়ে এই সব কর্মকা-কে অপরাধ মনে করে।
১৯৭৪ সালে প্রণীত ‘বিশেষ ক্ষমতা আইন’ নিয়ে ৫০ বছর যাবত বিরোধী দল বিরূপ সমালোচনা করে আসছে, কিন্তু ক্ষমতায় গিয়ে কেউ তা বাতিল করেনি। তদ্রƒপ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়েও বিরোধী দল সোচ্চার। এই আইনের অপপ্রয়োগ হলেও তা বাতিল হবে বলে মনে হয় না। কারণ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিরোধী পক্ষকে হেয় করার জন্য পতিতালয়ের রুচিহীন ও অশ্লীল ভাষা ব্যবহৃত হয়। এছাড়াও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যক্তিগত আক্রমণ, হুমকি, অসত্য কথন, ভুল তথ্য, গুজবের ছড়াছড়ির কারণে মানুষ বিভ্রান্ত হয়, সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়, মানুষ হানাহানিতে লিপ্ত হয়। তাই অশ্লীল ভাষা, গুজব আর মিথ্যা কথন রোধ করার জন্যই ডিজিটাল আইন প্রয়োজন।
অন্যের স্বাধীনতা খর্ব না করা পর্যন্ত মিডিয়ার স্বাধীনতা স্বীকার্য। কোন ব্যক্তির মানহানি করা শাস্তিযোগ্য অপরাধ- এটা মেনেই বাকস্বাধীনতা ভোগ করতে হয়। তবে সময় ও ক্ষেত্র ভিন্ন হলে মিডিয়ার স্বাধীনতার মাত্রায় ভিন্নতা আসে। এই ক্ষেত্রে পশ্চিমা জগত অনেকটা উদার, সরকার প্রধানকে ব্যাঙ বা শূকরের চেহারায় চিত্রায়ন করে মিডিয়ায় প্রকাশ করলেও প্রধানমন্ত্রী বা রাষ্ট্রপতির অপমান হয় না, মান যায় না। কিন্তু আমাদের দেশে সরকার প্রধানকে এভাবে ব্যঙ্গ করা হলে জেল-জরিমানা হবেই। তবে বিদ্বেষমূলক বক্তব্য সব দেশে রোধ করা হলেও ভারতীয় উপমহাদেশে হয় না। কারণ ধর্মীয় বক্তব্য যতই বিদ্বেষমূলক হোক না কেন তা অনেক ক্ষেত্রে ধর্মগ্রন্থ দ্বারা সমর্থিত। ইহজগতের কোন আইন দ্বারা ধর্ম প্রচারে বাধা সৃষ্টি করা প্রায় অসম্ভব। যারা আমাদের দেশে অবাধ বাকস্বাধীনতার ওকালতি করেন, তারাও কিন্তু ধর্মীয় ক্ষেত্রে বাকস্বাধীনতা রুদ্ধ করার পক্ষে। ধর্মীয় বিশ্বাসের বিরুদ্ধে বিজ্ঞানের আবিষ্কারকে রুদ্ধ করতে এক সময় রাষ্ট্র এবং ধর্ম একযোগে কাজ করেছে। এমন বহু ব্যক্তি আছেন যারা ডিজিটাল আইনের বিরুদ্ধে, কিন্তু ব্লাসফেমি আইনের পক্ষে।
বাকস্বাধীনতার সঙ্গে সত্যাসত্যের প্রশ্ন জড়িত। সবার জন্য গ্রহণযোগ্য কোন সত্য প্রতিষ্ঠা করা কঠিন। বাবরি মসজিদ ভেঙে ফেলা কিংবা নাসিরনগরে মন্দিরে হামলা নিশ্চয় সবার জন্য গ্রহণযোগ্য ঘটনা নয়। পৃথিবীর কোন ধর্মই সবার জন্য গ্রহণযোগ্য হয়নি, তাই ৪২০০ ধর্মের রাজত্বে পৃথিবীর ৮০০ কোটি লোক বাস করছে। কোন একক মত যখন শ্রেষ্ঠ অভিধায় সবার উপর চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হয় তখনি শুরু হয় দ্বন্দ্ব আর সংঘর্ষ। স্মতর্ব্য যে, কোন ধর্ম সর্বজনীন না হলেও ব্রুনো বা কোপারনিকাসের আবিষ্কৃত সত্য আজ সবাই গ্রহণ করেছে। দার্শনিক সক্রেটিসকে প্রদত্ত বিষপানে মৃত্যুদ- বা যিশুখ্রিস্টকে ক্রুশবিদ্ধ করে হত্যার রায় তখনকার রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষের বিচারের মাধ্যমে হয়েছিল; অন্যদিকে মহানবী হজরত মোহাম্মদ (সা.)-কে হিজরতের আগে হত্যার যে সিদ্ধান্ত কোরাইশ নেতারা নিয়েছিল তাও ছিল তাদের এক ধরনের বিচারিক সিদ্ধান্ত। তাই ‘মব জাস্টিজ’ বা আধুনিক বিচারিক সিদ্ধান্তের ‘রিমান্ড’-এর সঙ্গে সক্রেটিস বা যিশুখ্রিস্টের মৃত্যদ- প্রদানের চিন্তা-চেতনার মধ্যে খুব বেশি পার্থক্য নেই। অন্তর্বর্তী সরকার বিষয়টি যখনই অনুধাবন করবে তখনই মিডিয়া জগত প্রধান উপদেষ্টার আহ্বানে সাড়া দেবে।
[লেখক : সাবেক নির্বাহী পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক ]