alt

opinion » post-editorial

সংবিধান সংশোধন : আমাদের বলার আছে

শঙ্কর প্রসাদ দে

: রোববার, ১২ জানুয়ারী ২০২৫

আমাদের বলতে পার্বত্যবাসী ১২ ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীসহ সংখ্যালঘুদের বোঝাচ্ছি। মনে রাখা ভালো, ধর্মীয় পরিচয়ে সবচে বৃহৎ সংখ্যালঘুর দেশ ভারতের পরে বাংলাদেশ। এটাও বলে রাখা ভালো সভ্যতার ইতিহাসে প্রথম সবচে বৃহৎ সংখ্যালঘু উদ্বাস্তু সমস্যার সৃষ্টি হয়েছিল সাতচল্লিশে বাংলা ও পাঞ্জাবে। এরপর দ্বিতীয়বার ঘটেছে একাত্তরে। মোটামুটি ৯০ লাখের মতো হিন্দু ভারতে উদ্বাস্তু হয়েছিল। এত বিশাল সংখ্যালঘু উদ্বাস্তু, সংখ্যালঘু নিপীড়ন ও উদ্বাস্তু সংকটের দায়ভার কার? উপমহাদেশে ধর্মের ভিত্তিতে রাষ্ট্র সৃষ্টির রাজনৈতিক তত্ত্বের জনক জিন্নাহ বা গান্ধী বা শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় কতটুকু দায়ী তা ইতিহাস নির্ধারণ করবে। তবে এটা ঠিক যে মুসলমানের বা ইসলামের দেশ পাকিস্তান সৃষ্টি হওয়া মাত্রই অবধারিত হয়ে ওঠে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ। বলা হয়েছিল কম্যুনিস্টরা পাকিস্তানের শত্রু। এরা ইসলামের শত্রু। অথচ গঙ্গাধর অধিকারীর থিসিস গ্রহণ করে সিপিআই পাকিস্তান আন্দোলন সমর্থন করেছিল। একেবারে শুরুতেই পাকিস্তান তথা পূর্ব-পাকিস্তানে কমিউনিস্ট পার্টিকে নিষিদ্ধ করা হল। সেই সব দুর্বিষহ দিনের একটি লোমহর্ষক বর্ণনা দিলে ঘটনার গুরুত্ব বোঝা যাবে। যতদূর মনে পড়ে ১৯৮৫ সালের দিকে ফতেয়াবাদ খগেন্দ্র চক্রবর্ত্তীর পুকুর পাড়ে চিরনিদ্রায় শায়িত কমরেড অনঙ্গ সেনের সমাধিতে ফুল দিতে গিয়েছিলাম। বসন্ত রোগে আক্রান্ত জেলা কমিটির সম্পাদক কমরেড অনঙ্গ সেনকে ফতেয়াবাদ স্থানান্তর করা হয়। চিকিৎসা হয়েছিল তবে সব ধরনের চিকিৎসা ও শুশ্রƒষাকে পরাস্ত করে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন ১৯৬৮ সালের ১১ জানুয়ারি। তাকে দাহ করা যায়নি। কারণ চিতার অগ্নিশিখা বিদ্যুৎ গতিতে পুলিশ ও গোয়েন্দা পর্যন্ত পৌঁছে যাওয়ার সমূহ ঝুঁকি ছিল। অগত্যা স্বপনদার পুকুরপাড়ে সমাধিস্থ বা কবরস্থ করা হয়। এর পরের কাহিনী হলো পূর্ব বঙ্গের হিন্দুদের উদ্বাস্তু জীবনের মহাকাব্যিক ঘটনাপ্রবাহ। কথা ছিল পশ্চিম বঙ্গের যেসব মুসলমান পূর্ব-বাংলায় আসবে তাদের ঘরবাড়িতে গিয়ে হিন্দুরা আশ্রয় নেবে। বাস্তবে ঘটল উল্টো। ধনাঢ্য, সরকারি চাকুরে ও অভিজাত মুসলমান ছাড়া সাধারণ মুসলমানরা পূর্ব-বাংলায় আসল না; উল্টো পূর্ব-বাংলা থেকে দলে দলে হিন্দুরা ছুটে চলল ভারতের আসাম ত্রিপুরা পশ্চিম বঙ্গের দিকে। একসময় এ সংখ্যা হাজার পেরিয়ে লক্ষে পৌঁছায়। ধারণা করা হয় শতভাগ হিন্দুর এই ভূখ-ে সাতচল্লিশ থেকে অদ্যাবধি ভারতে আশ্রিত হিন্দুর সংখ্যা তিন প্রজন্ম মিলে প্রায় ১০ কোটি। ১৯৪১ সালে হিন্দু জনসংখ্যা ছিল ২৮%, ১৯৫১ সালে তা নেমে ২২% এ দাঁড়ায়। ১৯৭৪ এ অনুপাত নেমে দাঁড়ায় সাড়ে ১৩ % এ। ১৯২২ এ দাঁড়িয়েছে ৭.৯৫%। জাতিসংঘের উদ্বাস্তু বিষয়ক সংস্থার জরিপমতে ১৯৭১ শরণার্থী ক্যাম্পে মৃত্যুর সংখ্যা মোটামুটি ৮ লাখ। বাহাত্তরে সংবিধান প্রণয়নের সময় সংখ্যালঘু সমস্যার একটি স্থায়ী সমাধান খোঁজা হয়েছিল। ৬ দফা, ১১ দফা, ৭০ এর নির্বাচনী মেনিফেস্টো ও প্রক্লেমেশন অব ইন্ডিপেন্ডেন্সে ‘সেক্যুলারিজম’ শব্দটি না থাকার পরও এটি জাতীয় ৪ নীতিতে স্থান করে নিয়েছিল নিতান্ত ঐতিহাসিক প্রয়োজনে। গণ-পরিষদে ধর্মনিরপেক্ষতার ওপর তুমুল তর্ক-বিতর্ক হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত সংবিধানপ্রণেতারা স্থির সিদ্ধান্তে পৌঁছেন যে, সাম্প্রদায়িকতাকে চিরতরে বিদায় করতে হলে ধর্মনিরপেক্ষতা ছাড়া রাষ্ট্রকে পক্ষপাতহীন রাখা যাবে না। বোঝা যাচ্ছে আলী রিয়াজের প্রস্তাবনাতে যাই’ই থাকুক না কেন, পরবর্তী সংসদে সংবিধান সংশোধন হবেই, হতে বাধ্য বাধ্য এবং হওয়া দরকার। সম্ভাব্য সংশোধনীতে (সপ্তদশ) পার্বত্যবাসীসহ সংখ্যালঘুদের বলার অনেক কিছুই আছে। সংবিধানের শুরুতে বিছমিল্লাহ শব্দটি জিয়াউর রহমান সাহেব কেন স্থাপন করেছিলেন তা বোঝা মুশকিল। শুরুতে এটা থাকা বা না-থাকা খুব বেশি গুরুত্বপূর্ণ কোন ব্যাপার নয়। তবে রাষ্ট্রধর্ম সংক্রান্ত আর্টিকেল ২ সংশোধন দরকার আছে। প্রখ্যাত সাংবাদিক নুরুল কবির বলেছেন, ‘রাষ্ট্রধর্ম অন্যধর্মের ওপর অন্যায়ের সামিল’। তার সঙ্গে শতভাগ ঐকমত্য পোষণ করে বলতে চাই সম্ভাব্য সংশোধনীতে রাষ্ট্রধর্ম বাদ দেয়া সাম্প্রদায়িক সহাবস্থান, মুক্তবুদ্ধি ও প্রগতির স্বার্থেই দরকার। সরকারি চাকরি তথা পুলিশ, মিলিটারি, সিভিল সার্ভেন্ট হিসেবে প্রতিযোগিতায় সংখ্যালঘুদের জনসংখ্যা অনুপাতে কোটা সংরক্ষণ বাস্তবতার নিরিখে প্রয়োজন। এখনো সেনাবাহিনীর অফিসার পর্যায়ে সংখ্যালঘুদের উপস্থিতির হার খুবই কম, সৈনিক পর্যায়েও কম। এরকম আরও যেসব ক্ষেত্র আছে সেসবে জনসংখ্যা অনুপাতে শতকরা ৮ ভাগ কোটা (পাহাড়ি ব্যতীত) সাংবিধানিকভাবে সংরক্ষিত না হলে বাঙালি বা বাংলাদেশি জাতীয়তার প্রসঙ্গটি অর্থহীন হয়ে পড়বে। রাষ্ট্রের সবক্ষেত্রে ৮ ভাগ (পাহাড়ি ব্যতীত) সংখ্যালঘু কোটা বাধ্যতামূলক না হলে দু-তিন দশক পর ভূখ-টি প্রায় শতভাগ মুসলিম জনপদে পরিণত হবে। এর অর্থ দাঁড়াবে ধর্মীয় রক্ষণশীলতার উত্থান। সিরিয়া বা আফগানিস্তান নাটকের মঞ্চায়ন। ১৯৩৫ সনের ভারত শাসন আইনের সুবাদে ১৯৫৪ সালের সংসদে সংখ্যালঘুদের সদস্য সংখ্যা ছিল ৭২। তৎকালীন কংগ্রেস, আওয়ামী লীগ ও স্বতন্ত্র নেতৃত্বের মধ্যে সম্পাদিত হয় বিখ্যাত পঞ্চশীলা নীতি। নেতৃত্ব একমত হন যে সংখ্যালঘুদের সংরক্ষিত আসন পদ্ধতি তুলে না দিয়ে বাঙালি জাতিসত্ত্বার বিকাশ লাভ সম্ভব নয়। সেদিনের তত্ত্ব সঠিক ছিল। সত্তরের নির্বাচনে পঞ্চশীলা নীতির প্রভাব ছিল। মুক্তিযুদ্ধ হলো, দেশ স্বাধীন হলো। ২০১৮ সালের সংসদে সংখ্যালঘু প্রতিনিধি দাঁড়াল মাত্র ১৯। ভবিষ্যতে এ হার আরও কমবে। সংরক্ষিত মহিলা আসন হয়তো তুলে দেয়া হবে। তুলে দিলেও তেমন কোন মৌলিক পরিবর্তন হবে না। কিন্তু সংখ্যালঘুদের বিষয়টির ওপর কোটি মানুষের অস্তিত্ব, নিরাপত্তা ও ক্ষমতায়নের প্রশ্ন জড়িত। সম্ভাব্য সংশোধনীতে রাজনৈতিক দলগুলো যেন শতকরা ন্যূনতম ৮ ভাগ (পাহাড়ি ব্যতীত) সংখ্যালঘু মনোয়ন নিশ্চিত করে তার বিধান রাখা উচিত। কোটা পদ্ধতি ছিল বলেই পার্বত্যবাসীরা জীবনের বহু ক্ষেত্রে আজ মূল জনস্রোতে একাকার। হিন্দু মেয়েদের উত্তরাধিকার না থাকা এক বড় ধরনের মানবিক সমস্যা। বিগত সরকারের নারীনীতি কার্যকর করা যায়নি, হিন্দু ও মুসলিম ধর্মীয় নেতৃত্বের বিরোধীতার কারণে। এখন সময় এসেছে সম্পত্তি সংক্রান্তে অভিন্ন সিভিল কোড প্রণয়ন। এরপরও যদি মুসলিম সম্প্রদায় অভিন্ন সিভিল কোডে না আসতে চান অসুবিধা নেই। হিন্দুদের পক্ষ থেকে দাবি করছি ছেলে মেয়ে মা ও স্ত্রীনির্বিশেষে প্রত্যেক উত্তরাধিকারী সমান উত্তরাধিকার নিশ্চিত করা হোক। ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা পরিষদ, জেলা পরিষদ, বার কাউন্সিলসহ সব ধরনের বেসরকারি ক্লাব, বার অ্যাসোসিয়েশন, চেম্বার অব কমার্স জাতীয় প্রতিষ্ঠানগুলোতে ১০ ভাগ প্রতিনিধিত্ব থাকতে হবে। নির্বাচনী প্রক্রিয়াতেই প্রতিদ্বন্দ্বী দল, গ্রুপ মনোনয়নের সময় এই হার রক্ষা করতে বাধ্য থাকতে হবে। এই প্রস্তাব নিতান্ত সম্প্রদায়গত দৃষ্টিতে মর্মে ভাবা ভুল হবে। অসম প্রতিযোগিতার মুখোমুখি সংল্যালঘুদের সাংবিধানিকভাবে রক্ষা করা না গেলে ইতোমধ্যে সৃষ্টি হওয়া অবস্থার সংকট আরও বাড়বে। সংখ্যালঘুরা চোখের জলে নিজ জন্মভূমি ছেড়ে আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, ইউরোপ, ভারতে পাড়ি জমাবে। নিতান্ত ঘুম পেট আর ইজ্জতের তাগিদে। খোলাখুলি বলা ভালো মধ্যপ্রাচ্য আর উত্তর আফ্রিকার মুসলিম জনমিতি এমনভাবে বেড়েছে যে ওইসব দেশের আদিবাসী বারবাররা শতকরা এক ভাগের নিচে চলে এসেছে। শতভাগ হিন্দুর দেশ আফগানিস্তান আজ প্রায় হিন্দুশূন্য। বহু সম্প্রদায়, বহু জাত, বহু চিন্তার সমাবেশ না থাকলে একটি রাষ্ট্র স্থিতিশীল হয় না। বিজ্ঞানমুখী হয় না। প্রগতিশীল হয় না। আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া ও ইউরোপের প্রকৃষ্ট প্রমাণ। ধর্মনিরপেক্ষতা কোন অবস্থাতেই সংবিধান থেকে তোলা যাবে না। এই একটি স্তম্ভের কারণে সংখ্যালঘুরা এই রাষ্ট্রের আধুনিকতা নিয়ে আস্থাশীল। বহুবার গর্ব করে বলেছি পৃথিবীর যে কোনো প্রগতিশীল সংবিধানের সঙ্গে বাংলাদেশ সংবিধান তুলনীয় ও সমমর্যাদার। কেউ স্বীকার করল অথবা কেউ করল নাÑ তাতে কী, বাঙালি জাতিসত্ত্বার বিকাশ ঘটেছে অন্তত এক হাজার বছর ধরে, এর পরিণতি এসেছে বঙ্গবন্ধুর হাত ধরে। বাঙালি জাতিয়তা এর পরিচয়। এই পরিচয়ের মাঝেই স্থিতি আছে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা। সম্ভাব্য সংশোধনে যেন কোনো অবস্থাতেই ধর্মনিরপেক্ষতা ও বাঙালি জাতীয়তাবোধের যেন বিপর্যয় না ঘটে।

[লেখক: আইনজীবী, আপিল বিভাগ]

চা-জনগোষ্ঠীর দণ্ডপূজা ও উপেক্ষিত অধিকার

মেরিটোক্রেসি: সমাজ ও রাজনীতির প্রাসঙ্গিকতা

রম্যগদ্য: হাতের মুঠোয় বিশ্ব

শারদীয় পূজার দিনলিপি

ঋণের জন্য আত্মহত্যা, ঋণ নিয়েই চল্লিশা

জাকসু নির্বাচন ও হট্টগোল: আমাদের জন্য শিক্ষণীয় কী?

নরসুন্দর পেশার গুরুত্ব ও সামাজিক অবস্থার উন্নয়ন

বিভাগভিত্তিক এমপিআর নির্বাচন পদ্ধতি

প্ল্যাটফর্ম সমাজে বাংলাদেশ: জ্ঞানের ভবিষ্যৎ কার হাতে?

আনন্দবেদনার হাসপাতাল: সরকারি ও বেসরকারি চিকিৎসা ব্যবস্থার বাস্তবতা

ছবি

ভিন্ন ধরনের নির্বাচন, ভিন্ন ধরনের ফল

বেসরকারি খাতে সিআইবি’র যাত্রা: ঋণ ব্যবস্থার নতুন দিগন্ত

স্বাস্থ্যসেবায় মানবিকতা প্রতিষ্ঠা হোক

ছবি

নেপালে সরকার পতন ও বামপন্থীদের ভবিষ্যৎ

ডাকসু নির্বাচন ও সংস্কারপ্রয়াস: রাজনৈতিক চিন্তার নতুন দিগন্ত

নির্বাচন কি সব সমস্যার সমাধান

জিতিয়া উৎসব

ছবি

অলির পর নেপাল কোন পথে?

রম্যগদ্য: “মরেও বাঁচবি নারে পাগলা...”

অপরিকল্পিত নগরায়ন ও শ্রীপুর পৌরসভা

ভূরিভোজ, উচ্ছেদ এবং আদিবাসী পাহাড়িয়া

অনলাইন সংস্কৃতিতে হাস্যরসের সমাজবিজ্ঞান

মামলাজট নিরসনে দেওয়ানি কার্যবিধির সংস্কার

বাস্তব মস্কো বনাম বিভ্রান্ত ইউরোপ

ছাত্রসংসদ নির্বাচন ও ভবিষ্যৎ ছাত্ররাজনীতির গতিপ্রকৃতি

সড়ক দুর্ঘটনা: কারও মৃত্যু সাধারণ, কারও মৃত্যু বিশেষ

ঐকমত্য ছাড়াও কিছু সংস্কার সম্ভব

আবার বাড়ছে নিত্যপণ্যের দাম : সংকটে সাধারণ মানুষ

ডায়াবেটিস রোগীর সেবা ও জনসচেতনতা

ভিন্ন ধরনের ডাকসু নির্বাচন

ডাকসু নির্বাচন : পেছনে ফেলে আসি

প্রসঙ্গ : এলডিসি তালিকা থেকে বাংলাদেশের উত্তরণ

“কোপা চাটিগাঁ...”

ই-কমার্স হতে পারে প্রবৃদ্ধির ইঞ্জিন

ভারত-চীনের নতুন সমীকরণ

সাইবার যুগে মানুষের মর্যাদা ও নিরাপত্তা

tab

opinion » post-editorial

সংবিধান সংশোধন : আমাদের বলার আছে

শঙ্কর প্রসাদ দে

রোববার, ১২ জানুয়ারী ২০২৫

আমাদের বলতে পার্বত্যবাসী ১২ ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীসহ সংখ্যালঘুদের বোঝাচ্ছি। মনে রাখা ভালো, ধর্মীয় পরিচয়ে সবচে বৃহৎ সংখ্যালঘুর দেশ ভারতের পরে বাংলাদেশ। এটাও বলে রাখা ভালো সভ্যতার ইতিহাসে প্রথম সবচে বৃহৎ সংখ্যালঘু উদ্বাস্তু সমস্যার সৃষ্টি হয়েছিল সাতচল্লিশে বাংলা ও পাঞ্জাবে। এরপর দ্বিতীয়বার ঘটেছে একাত্তরে। মোটামুটি ৯০ লাখের মতো হিন্দু ভারতে উদ্বাস্তু হয়েছিল। এত বিশাল সংখ্যালঘু উদ্বাস্তু, সংখ্যালঘু নিপীড়ন ও উদ্বাস্তু সংকটের দায়ভার কার? উপমহাদেশে ধর্মের ভিত্তিতে রাষ্ট্র সৃষ্টির রাজনৈতিক তত্ত্বের জনক জিন্নাহ বা গান্ধী বা শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় কতটুকু দায়ী তা ইতিহাস নির্ধারণ করবে। তবে এটা ঠিক যে মুসলমানের বা ইসলামের দেশ পাকিস্তান সৃষ্টি হওয়া মাত্রই অবধারিত হয়ে ওঠে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ। বলা হয়েছিল কম্যুনিস্টরা পাকিস্তানের শত্রু। এরা ইসলামের শত্রু। অথচ গঙ্গাধর অধিকারীর থিসিস গ্রহণ করে সিপিআই পাকিস্তান আন্দোলন সমর্থন করেছিল। একেবারে শুরুতেই পাকিস্তান তথা পূর্ব-পাকিস্তানে কমিউনিস্ট পার্টিকে নিষিদ্ধ করা হল। সেই সব দুর্বিষহ দিনের একটি লোমহর্ষক বর্ণনা দিলে ঘটনার গুরুত্ব বোঝা যাবে। যতদূর মনে পড়ে ১৯৮৫ সালের দিকে ফতেয়াবাদ খগেন্দ্র চক্রবর্ত্তীর পুকুর পাড়ে চিরনিদ্রায় শায়িত কমরেড অনঙ্গ সেনের সমাধিতে ফুল দিতে গিয়েছিলাম। বসন্ত রোগে আক্রান্ত জেলা কমিটির সম্পাদক কমরেড অনঙ্গ সেনকে ফতেয়াবাদ স্থানান্তর করা হয়। চিকিৎসা হয়েছিল তবে সব ধরনের চিকিৎসা ও শুশ্রƒষাকে পরাস্ত করে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন ১৯৬৮ সালের ১১ জানুয়ারি। তাকে দাহ করা যায়নি। কারণ চিতার অগ্নিশিখা বিদ্যুৎ গতিতে পুলিশ ও গোয়েন্দা পর্যন্ত পৌঁছে যাওয়ার সমূহ ঝুঁকি ছিল। অগত্যা স্বপনদার পুকুরপাড়ে সমাধিস্থ বা কবরস্থ করা হয়। এর পরের কাহিনী হলো পূর্ব বঙ্গের হিন্দুদের উদ্বাস্তু জীবনের মহাকাব্যিক ঘটনাপ্রবাহ। কথা ছিল পশ্চিম বঙ্গের যেসব মুসলমান পূর্ব-বাংলায় আসবে তাদের ঘরবাড়িতে গিয়ে হিন্দুরা আশ্রয় নেবে। বাস্তবে ঘটল উল্টো। ধনাঢ্য, সরকারি চাকুরে ও অভিজাত মুসলমান ছাড়া সাধারণ মুসলমানরা পূর্ব-বাংলায় আসল না; উল্টো পূর্ব-বাংলা থেকে দলে দলে হিন্দুরা ছুটে চলল ভারতের আসাম ত্রিপুরা পশ্চিম বঙ্গের দিকে। একসময় এ সংখ্যা হাজার পেরিয়ে লক্ষে পৌঁছায়। ধারণা করা হয় শতভাগ হিন্দুর এই ভূখ-ে সাতচল্লিশ থেকে অদ্যাবধি ভারতে আশ্রিত হিন্দুর সংখ্যা তিন প্রজন্ম মিলে প্রায় ১০ কোটি। ১৯৪১ সালে হিন্দু জনসংখ্যা ছিল ২৮%, ১৯৫১ সালে তা নেমে ২২% এ দাঁড়ায়। ১৯৭৪ এ অনুপাত নেমে দাঁড়ায় সাড়ে ১৩ % এ। ১৯২২ এ দাঁড়িয়েছে ৭.৯৫%। জাতিসংঘের উদ্বাস্তু বিষয়ক সংস্থার জরিপমতে ১৯৭১ শরণার্থী ক্যাম্পে মৃত্যুর সংখ্যা মোটামুটি ৮ লাখ। বাহাত্তরে সংবিধান প্রণয়নের সময় সংখ্যালঘু সমস্যার একটি স্থায়ী সমাধান খোঁজা হয়েছিল। ৬ দফা, ১১ দফা, ৭০ এর নির্বাচনী মেনিফেস্টো ও প্রক্লেমেশন অব ইন্ডিপেন্ডেন্সে ‘সেক্যুলারিজম’ শব্দটি না থাকার পরও এটি জাতীয় ৪ নীতিতে স্থান করে নিয়েছিল নিতান্ত ঐতিহাসিক প্রয়োজনে। গণ-পরিষদে ধর্মনিরপেক্ষতার ওপর তুমুল তর্ক-বিতর্ক হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত সংবিধানপ্রণেতারা স্থির সিদ্ধান্তে পৌঁছেন যে, সাম্প্রদায়িকতাকে চিরতরে বিদায় করতে হলে ধর্মনিরপেক্ষতা ছাড়া রাষ্ট্রকে পক্ষপাতহীন রাখা যাবে না। বোঝা যাচ্ছে আলী রিয়াজের প্রস্তাবনাতে যাই’ই থাকুক না কেন, পরবর্তী সংসদে সংবিধান সংশোধন হবেই, হতে বাধ্য বাধ্য এবং হওয়া দরকার। সম্ভাব্য সংশোধনীতে (সপ্তদশ) পার্বত্যবাসীসহ সংখ্যালঘুদের বলার অনেক কিছুই আছে। সংবিধানের শুরুতে বিছমিল্লাহ শব্দটি জিয়াউর রহমান সাহেব কেন স্থাপন করেছিলেন তা বোঝা মুশকিল। শুরুতে এটা থাকা বা না-থাকা খুব বেশি গুরুত্বপূর্ণ কোন ব্যাপার নয়। তবে রাষ্ট্রধর্ম সংক্রান্ত আর্টিকেল ২ সংশোধন দরকার আছে। প্রখ্যাত সাংবাদিক নুরুল কবির বলেছেন, ‘রাষ্ট্রধর্ম অন্যধর্মের ওপর অন্যায়ের সামিল’। তার সঙ্গে শতভাগ ঐকমত্য পোষণ করে বলতে চাই সম্ভাব্য সংশোধনীতে রাষ্ট্রধর্ম বাদ দেয়া সাম্প্রদায়িক সহাবস্থান, মুক্তবুদ্ধি ও প্রগতির স্বার্থেই দরকার। সরকারি চাকরি তথা পুলিশ, মিলিটারি, সিভিল সার্ভেন্ট হিসেবে প্রতিযোগিতায় সংখ্যালঘুদের জনসংখ্যা অনুপাতে কোটা সংরক্ষণ বাস্তবতার নিরিখে প্রয়োজন। এখনো সেনাবাহিনীর অফিসার পর্যায়ে সংখ্যালঘুদের উপস্থিতির হার খুবই কম, সৈনিক পর্যায়েও কম। এরকম আরও যেসব ক্ষেত্র আছে সেসবে জনসংখ্যা অনুপাতে শতকরা ৮ ভাগ কোটা (পাহাড়ি ব্যতীত) সাংবিধানিকভাবে সংরক্ষিত না হলে বাঙালি বা বাংলাদেশি জাতীয়তার প্রসঙ্গটি অর্থহীন হয়ে পড়বে। রাষ্ট্রের সবক্ষেত্রে ৮ ভাগ (পাহাড়ি ব্যতীত) সংখ্যালঘু কোটা বাধ্যতামূলক না হলে দু-তিন দশক পর ভূখ-টি প্রায় শতভাগ মুসলিম জনপদে পরিণত হবে। এর অর্থ দাঁড়াবে ধর্মীয় রক্ষণশীলতার উত্থান। সিরিয়া বা আফগানিস্তান নাটকের মঞ্চায়ন। ১৯৩৫ সনের ভারত শাসন আইনের সুবাদে ১৯৫৪ সালের সংসদে সংখ্যালঘুদের সদস্য সংখ্যা ছিল ৭২। তৎকালীন কংগ্রেস, আওয়ামী লীগ ও স্বতন্ত্র নেতৃত্বের মধ্যে সম্পাদিত হয় বিখ্যাত পঞ্চশীলা নীতি। নেতৃত্ব একমত হন যে সংখ্যালঘুদের সংরক্ষিত আসন পদ্ধতি তুলে না দিয়ে বাঙালি জাতিসত্ত্বার বিকাশ লাভ সম্ভব নয়। সেদিনের তত্ত্ব সঠিক ছিল। সত্তরের নির্বাচনে পঞ্চশীলা নীতির প্রভাব ছিল। মুক্তিযুদ্ধ হলো, দেশ স্বাধীন হলো। ২০১৮ সালের সংসদে সংখ্যালঘু প্রতিনিধি দাঁড়াল মাত্র ১৯। ভবিষ্যতে এ হার আরও কমবে। সংরক্ষিত মহিলা আসন হয়তো তুলে দেয়া হবে। তুলে দিলেও তেমন কোন মৌলিক পরিবর্তন হবে না। কিন্তু সংখ্যালঘুদের বিষয়টির ওপর কোটি মানুষের অস্তিত্ব, নিরাপত্তা ও ক্ষমতায়নের প্রশ্ন জড়িত। সম্ভাব্য সংশোধনীতে রাজনৈতিক দলগুলো যেন শতকরা ন্যূনতম ৮ ভাগ (পাহাড়ি ব্যতীত) সংখ্যালঘু মনোয়ন নিশ্চিত করে তার বিধান রাখা উচিত। কোটা পদ্ধতি ছিল বলেই পার্বত্যবাসীরা জীবনের বহু ক্ষেত্রে আজ মূল জনস্রোতে একাকার। হিন্দু মেয়েদের উত্তরাধিকার না থাকা এক বড় ধরনের মানবিক সমস্যা। বিগত সরকারের নারীনীতি কার্যকর করা যায়নি, হিন্দু ও মুসলিম ধর্মীয় নেতৃত্বের বিরোধীতার কারণে। এখন সময় এসেছে সম্পত্তি সংক্রান্তে অভিন্ন সিভিল কোড প্রণয়ন। এরপরও যদি মুসলিম সম্প্রদায় অভিন্ন সিভিল কোডে না আসতে চান অসুবিধা নেই। হিন্দুদের পক্ষ থেকে দাবি করছি ছেলে মেয়ে মা ও স্ত্রীনির্বিশেষে প্রত্যেক উত্তরাধিকারী সমান উত্তরাধিকার নিশ্চিত করা হোক। ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা পরিষদ, জেলা পরিষদ, বার কাউন্সিলসহ সব ধরনের বেসরকারি ক্লাব, বার অ্যাসোসিয়েশন, চেম্বার অব কমার্স জাতীয় প্রতিষ্ঠানগুলোতে ১০ ভাগ প্রতিনিধিত্ব থাকতে হবে। নির্বাচনী প্রক্রিয়াতেই প্রতিদ্বন্দ্বী দল, গ্রুপ মনোনয়নের সময় এই হার রক্ষা করতে বাধ্য থাকতে হবে। এই প্রস্তাব নিতান্ত সম্প্রদায়গত দৃষ্টিতে মর্মে ভাবা ভুল হবে। অসম প্রতিযোগিতার মুখোমুখি সংল্যালঘুদের সাংবিধানিকভাবে রক্ষা করা না গেলে ইতোমধ্যে সৃষ্টি হওয়া অবস্থার সংকট আরও বাড়বে। সংখ্যালঘুরা চোখের জলে নিজ জন্মভূমি ছেড়ে আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, ইউরোপ, ভারতে পাড়ি জমাবে। নিতান্ত ঘুম পেট আর ইজ্জতের তাগিদে। খোলাখুলি বলা ভালো মধ্যপ্রাচ্য আর উত্তর আফ্রিকার মুসলিম জনমিতি এমনভাবে বেড়েছে যে ওইসব দেশের আদিবাসী বারবাররা শতকরা এক ভাগের নিচে চলে এসেছে। শতভাগ হিন্দুর দেশ আফগানিস্তান আজ প্রায় হিন্দুশূন্য। বহু সম্প্রদায়, বহু জাত, বহু চিন্তার সমাবেশ না থাকলে একটি রাষ্ট্র স্থিতিশীল হয় না। বিজ্ঞানমুখী হয় না। প্রগতিশীল হয় না। আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া ও ইউরোপের প্রকৃষ্ট প্রমাণ। ধর্মনিরপেক্ষতা কোন অবস্থাতেই সংবিধান থেকে তোলা যাবে না। এই একটি স্তম্ভের কারণে সংখ্যালঘুরা এই রাষ্ট্রের আধুনিকতা নিয়ে আস্থাশীল। বহুবার গর্ব করে বলেছি পৃথিবীর যে কোনো প্রগতিশীল সংবিধানের সঙ্গে বাংলাদেশ সংবিধান তুলনীয় ও সমমর্যাদার। কেউ স্বীকার করল অথবা কেউ করল নাÑ তাতে কী, বাঙালি জাতিসত্ত্বার বিকাশ ঘটেছে অন্তত এক হাজার বছর ধরে, এর পরিণতি এসেছে বঙ্গবন্ধুর হাত ধরে। বাঙালি জাতিয়তা এর পরিচয়। এই পরিচয়ের মাঝেই স্থিতি আছে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা। সম্ভাব্য সংশোধনে যেন কোনো অবস্থাতেই ধর্মনিরপেক্ষতা ও বাঙালি জাতীয়তাবোধের যেন বিপর্যয় না ঘটে।

[লেখক: আইনজীবী, আপিল বিভাগ]

back to top