alt

উপ-সম্পাদকীয়

শৃঙ্খলে আবদ্ধ সামাজিক মানুষ

কাজী সালমান শীশ

: সোমবার, ১৩ জানুয়ারী ২০২৫

সামাজিক মানুষ বলতে প্রথমে যে চেহারাটা মনে ভেসে ওঠে তা হলো একজন স্বাভাবিক লোক- যিনি নয়টা পাঁচটা অফিস করেন, সস্ত্রীক জন্মদিনের অনুষ্ঠানে যান, কাজ শেষে বাজার করে ঘরে ফেরেন, ছেলেকে ইংরেজি পড়ান বা পাঞ্জাবি পরে বিয়ে বাড়িতে যানÑ বিষয়টা অনেকটাই নির্ভর করে অর্থনৈতিকভাবে ব্যক্তিটি সমাজের কোন স্তরে থাকেন তার ওপর। মধ্যবিত্তের সামাজিকতার সঙ্গে উচ্চবিত্ত ও নিম্নবিত্তের সামাজিকতা পুরোপুরি মিলে না, তবু কিছু মিল শাশ্বত। সামাজিক মানুষদের লোকে ভদ্রলোক বা ভদ্রমহিলা বলে থাকেন, কারণ তারা সচরাচর ভীষণ বা চরম কিছু করেন না। দৃশ্যত অনিয়ম থেকে দূরে থাকেন। নিয়মতান্ত্রিক জীবনযাপনে এ মানুষগুলো সরলরৈখিক ধারা মেনে চলতে অভ্যস্ত।

অপরদিকে অসামাজিক মানুষজন সমাজে ভয়ংকররূপী হিসেবে বিশেষভাবে চিহ্নিত হয়ে থাকে। তারা নেতিবাচক অর্থে নিয়ম ভাঙ্গে, ধারাবাহিকভাবে কাজ করে না, অভদ্র আচরণ করে, অল্পতে রেগে যায়, ঘুমের সময় নির্দিষ্ট থাকে না, অনেক সময় বড় ধরনের অপরাধের সাথেও জড়িত থাকে। সামাজিক শৃঙ্খলের বাইরে অবস্থান করার জন্য মানুষজন তাদের পছন্দ করে না, তারাও সহজে লোকজনের সাথে মিশে না। কখনো কখনো কিছু বৈজ্ঞানিক, শিল্পী বা খেলোয়াড়দের অসামাজিক স্বভাবের হতে দেখা যায়। সাফল্য পেলে সমাজ তাদের গ্রহণ করে, না পেলে স্বাভাবিকভাবেই তাদের লাঞ্ছনা সহ্য করতে হয়। চরম অসামাজিক মানুষের মধ্যেও প্রতিভাধর মানুষ দেখা যায়, আবার প্রচ- ভদ্র মানুষদেরও দেখা যায় গোপনে ভয়ংকর অন্যায় করতে। হাজার হলেও সকলেই মানুষ। মানুষকে লেবেল দিয়ে বিচার করা যায় না, উচিতও না।

ইদানীং মধ্যবিত্ত বাঙালিদের মুখে বহুল প্রচলিত একটা টার্ম হচ্ছে ‘কর্পোরেট কালচার’। বিভিন্ন বিদেশি সংস্থা ও বড় বড় এনজিওতে (নন-গভর্নমেন্ট অর্গানাইজেশন) যারা চাকরি করেন, কোম্পানির সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখেন, তারা এই কালচারের অন্তর্গত। চাকরিজীবী হলেও এরা অপেক্ষাকৃত বেশি টাকা উপার্জন করে থাকেন ব’লে অনেকেই গর্বের সাথে নিজেদের পরিচয় দিতে স্বাচ্ছন্দ বোধ করেন। গোছানো, মার্জিত, পশ্চিমা কায়দার পোশাক পরে এরা অফিসে আসেন, কথায় কথায় ইংরেজি বাক্যে ব্যবহার করেন, কাঁটা চামুচ দিয়ে লাঞ্চ করেন, পাঁচ তারকা হোটেলে মিটিং করেন... ইত্যাদি ইত্যাদি।

মূল বিষয়টা হচ্ছে খদ্দের (ক্লায়েন্ট) ধরে কাজ করে জীবনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। খদ্দের ধরার কাজটা অনেক সময় উঁচু পর্যায় থেকে হয়ে আসে। কর্পোরেটরা বাকি কাজটা সমাধা করেন। সরল মনে চিন্তা করলে কর্পোরেট কাজের প্রয়োজন আছে নিশ্চয়ই ধনী দেশের সাথে সম্পর্ক রক্ষা করে কাজ করার জন্যে, কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে ওদের দেখলে আমার মায়া লাগে। গ-িবদ্ধ জীবন তাদের সকাল ১০টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত অফিসে সময় দিতে হয়। কোম্পানিগুলো কর্পোরেট চাকুরেদের ফরমাল ড্রেস পরিয়ে, বিদেশ সফর করিয়ে, মোটা অংকের বেতন দিয়ে যেন দাস বানিয়ে রাখে। শিক্ষিত সমাজকে নিয়ন্ত্রণ করে কাজে লাগানোর জন্য কর্পোরেট সমাজের তুলনা নেই। বছরের পর বছর তারা কাটিয়ে দেয় কোম্পানির জন্য কাজ করে। মানুষগুলো নিজের স্বাতন্ত্র্য হারিয়ে মেশিন হয়ে কোম্পানির স্বার্থ রক্ষা করে। মাসে মাসে এতগুলো টাকা দেয়, সুবিধা দেয়- সেটাকে কোম্পানি উসুল করবে না, তাই কি সম্ভব? অর্থের মত সাংঘাতিক বস্তু পৃথিবীতে দ্বিতীয়টা নেই। সেই অর্থের যোগান, বিনিময় ও বণ্টন যথেষ্ট জটিল। অর্থের চক্রাকার বৃত্তে একবার প্রবেশ করলে তা থেকে বের হয়ে আসা প্রায় অসম্ভব। বড় ইন্ডাস্ট্রিগুলো টাকার পাহাড় বানায় শ্রমিকের শ্রমে, যার ছিটেফোঁটা পায় কর্পোরেট অফিসাররা। ধনী দেশ ধনী হয় আর গরিব দেশ ধনী দেশের জন্য কাজ করে। পুঁজিবাদের চাকা এভাবেই ঘুরে। বহু সংখ্যক মানুষের মস্তিষ্ক বন্দী হয়ে থাকে কর্পোরেট কালচারের অধীনে।

এক সময় ডাকাত রাতের আঁধারে ঘরে ঢুকে লুট করে নিয়ে যেত সোনা-দানা ও মূল্যবান বস্তু, এখন মানুষ নিজে গিয়ে টাকা-পয়সা, সম্পদ জমা দিয়ে আসে ব্যাংকে। আমাদের মত দুর্নীতিগ্রস্ত দেশে অনেক সময় ‘রক্ষক’ হয়ে যায় ‘ভক্ষক’, অর্থাৎ সাধারণ মানুষের সংরক্ষিত টাকা সরিয়ে ফেলে ব্যাংক স্বয়ং। তবে সেটা ঠিক স্বাভাবিক চিত্র নয়। সাধারণত ব্যাংক জমাকৃত অর্থের নিরাপত্তা ও সুরক্ষা দান করে থাকে। বিপুল সংখ্যক অর্থ ব্যাংকে জমা হয় এবং জমাদানকারীকে তা থেকে কিছু লভ্যাংশ দেয়া হয়ে থাকে। জমাকৃত টাকার অনেক বড় একটা অংশ ব্যয় হয় অন্য কোম্পানি বা ব্যক্তিকে লোন দিয়ে। সেই ধারের পয়সায় রাস্তাঘাট, বিল্ডিং, মার্কেট ইত্যাদি তৈরি হয়। আপনার অর্থ সারাজীবন আপনারই থাকবে, কিন্তু বড় বিনিয়গের জন্য কাজ করে যাবে ব্যাংক। খুব সহজ ভাষায় এটা হচ্ছে ব্যাংকের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কাজের একটি ধারা। বিভিন্ন রকম অসাধু পন্থা অবলম্বন করে সারাবিশ্বে ব্যাংক ধনী হয়, কিন্তু তারা সাধারণ মানুষদের ঘাটে না। প্রাইভেট ব্যাংকের মালিক যদি মাফিয়াও হয়, সে ডাকাতের মত অর্থ লুট করে না। সেকারণে তারা যুগের পর যুগ ধরে মানুষের আস্থা নিয়ে টিকে থাকে এবং ব্যাংকিং ব্যবসা চলতে থাকে। বিদেশে যুদ্ধাস্ত্র কেনার জন্য মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার ধার দিতে পারে, কিন্তু নিজেদের কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে অর্থ আত্মসাৎ করে (সম্ভবত) ভিন্নদেশে পাচার করতে পারে না। দৃশ্যত অন্তত তাই আমরা জানি।

ব্যক্তিগত বহুসংখ্যক লোককে অর্থের নিরাপত্তা দিয়ে ফুলে ফেঁপে ওঠে ব্যাংক। পুঁজিবাজারের প্রচ- শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান ব্যাংকের নিয়ম চলে অংকে, মানবিকতায় নয়। এখানে ধনীরা অবশ্যই বেশি সুবিধা পাবে কারণ এর জন্মই হয়েছে ধনীদের সহায়তা করার জন্য। ব্যাংক যুদ্ধজাহাজ কিনতে বিনিয়গ করলো, নাকি গাছ কেটে অট্টালিকা বানালো– সেই বিষয়ে ব্যক্তিগত বিনিয়গকারীরা জানতে পারে না। ‘টাকায় টাকা আনে’ এই বাক্যের যথাযথ উদাহরণ হচ্ছে ব্যাংকিং পদ্ধতি। অর্থনৈতিক অবকাঠামো নিয়ন্ত্রণেও ব্যাংকের তুলনা হয় না। মানুষ, সমাজ, এমনকি দেশ পরিচালনার সাথে ব্যাংক জড়িত। অনেকটা বিশাল চক্রাকার মাকড়সার জালের মতো আবদ্ধ এই ব্যাংকিং ব্যবস্থা। এর শঙ্খলের বলয়ে মানুষ আটকে থাকতে বাধ্য।

অপরাধী অন্যায়ের চরমে পৌঁছে ধরা পরলে রাষ্ট্রের আইন অনুযায়ী তাদের কারাগারে পাঠানো হয়। আইন ভাঙ্গার দায়ে ব্যক্তি বিশেষের শাস্তি হয়। হত্যা, রেপ, ডাকাতি, চুরি, চোরাচালানের মত বহু অপরাধে অপরাধীর কারাদ- হয়ে থাকে। অপরাধের ধরন ও প্রকোপের ওপর নির্ভর করে কারো হয় ফাঁসি, যাবজ্জীবন বা খ-কালীন জেল। ব্যক্তি পর্যায়ে অপরাধে শাস্তিগুলো দৃশ্যমান, কিন্তু লোকটা কেন অন্যায় করছে কিংবা কোনো বৃহৎ শক্তি কাজটা পরোক্ষভাবে করাচ্ছে কিনা- সেই বিষয়গুলো অস্পষ্টই থেকে যায়। গৃহযুদ্ধে যেই বালক চোখের সামনে তার বাবা-মা, ভাই, বোনকে প্রাণ বিসর্জন দিতে দেখেছে, স্বাভাবিকভাবেই তার ভেতর প্রতিশোধ স্পৃহা জাগবে। সেই ছেলে যদি বিশ বছর পরে যুবক হয়ে এর প্রতিশোধ নিতে মানুষ হত্যা করে এবং ধরা পড়ে, তখন তার বিচার হবে হত্যার দায়ে। কেন ছেলেটি এমন বিকৃত মানসিকতার মানুষ হয়ে উঠেছে- সেই ব্যাপারটা বিবেচনা করা হয় না; সেটা বিবেচনার সহজ রাস্তাও নেই। বহু বড় অপরাধের ক্ষেত্র সৃষ্টি করে শক্তিশালী চক্র, ভীনদেশি রাষ্ট্র বা নিজ দেশের সমাজ ব্যবস্থা। যদিও শাস্তি পায় অপরাধের সাথে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত সর্বশেষ ব্যক্তিটি। ক্ষমতার বিচারে অপেক্ষাকৃত দুর্বল ব্যক্তির শাস্তি ভোগ করার সম্ভাবনা বেশি থাকে। এভাবেই চলে আসছে যুগ যুগ ধরে।

কারাগার সাদৃশ্য আরেকটা প্রতিষ্ঠান হচ্ছে পাগলাগারদ। মানসিক ভারসাম্যহীন, সমাজে থাকার অনুপযোগী মানুষদের পাঠানো হয় পাগলাগারদে। সেখানে বিভিন্ন ধরনের মানসিকভাবে অসুস্থ মানুষরা থাকে, খায়, চিকিৎসা নেয়, কিছু কিছু কাজ করে এবং পর্যায়ক্রমে বহু সেশনের মাধ্যমে তাদের সুস্থ করে তোলার চেষ্টা করা হয়ে থাকে। সুস্থ করে তোলার প্রক্রিয়া অনুন্নত দেশে খুবই অবহেলিত অবস্থায় থাকে বলাই বাহুল্য। পশ্চিমা ধনী দেশগুলোতে রুগীরা উৎকৃষ্ট চিকিৎসা ও কাউন্সিলিং পায়। সে যাক, বিষয় হল পাগলকে পাগল নির্ধারণ করে কে বা কারা? উত্তরে প্রথমেই আসবে পরিবারের কথা। পরিবার, পাড়া, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, কর্মস্থল ও রাস্তাঘাটে মানুষের সাথে কোনো ব্যক্তি যদি নিয়মিত অসংলগ্ন আচরণ করতে থাকে, তখন মানুষই উক্ত ব্যক্তিকে ‘পাগল’ উপাধি দিয়ে থাকে। অবস্থা চরমে চলে গেলে তাকে পাঠানো হয় পাগলাগারদে। কে কেন পাগল তার জবাব উত্তর-আধুনিক দার্শনিকরাও যথার্থভাবে দিয়ে যেতে পারেননি। মানুষের মস্তিষ্কের কোটি কোটি নিউরোনের মধ্যে কোনটা কিভাবে কাজ করে, কোনটা কেন বাধা প্রাপ্ত হয়- তার ব্যাপ্তি এত বৃহৎ যে সুপার কম্পিউটার তো দূরের কথা, ঈশ্বর ব্যতীত কেউ এর উত্তর জানে বলে মনে হয় না।

দৃশ্যত পাগল হয়- জন্মগতভাবে, মানসিক আঘাত পেয়ে, মাদকাসক্ত হয়ে ও বিষণœতাকে লালন করে। ধরে নিচ্ছি সুস্থ, স্বাভাবিক, ভীতু মানুষদের থেকে ভারসাম্যহীন লোকটি আলাদা। সমস্যা হয় সে যখন অন্যদের জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। বারবার একই রকম আচরণ করা থেকে শুরু করে চিৎকার, মারামারি, ভয় দেখানোর কারণে সামাজিকভাবে তাদের প্রত্যাখ্যান করা হয়। অন্ধকার মধ্যযুগের মতো যেহেতু পাগলটিকে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করা যাচ্ছে না, তাই পাগলাগারদে তুলে দিলে বোঝাটা ঘাড় থেকে সরে যায়। বাকিটুকু প্রতিষ্ঠান পাগলাগারদ সামলায়। পৃথিবীর প্রত্যেকটা মানুষের মধ্যে কমবেশি অসংলগ্নতা বা অপ্রকৃতিস্থতা রয়েছে জন্মগতভাবেই। তবুও পাগলকে চিহ্নিত করা হয় বিশেষ মানুষ হিসেবে। সমাজের সিদ্ধান্তে, স্বাধীনতা হারিয়ে গারদে যায় এই বিশেষ শ্রেণীর মানুষ। আধুনিক ব্যবস্থা মনে হলেও আসলে ব্যাপারটা মধ্যযুগীয়। পাগলের রাজ্যে কে পাগল, আর সুস্থ মানুষের পরিম-লে কে সুস্থÑ কে জানে? কারাগার ও পাগলাগারদ দুইটি প্রতিষ্ঠানেই মানুষের স্বাধীনতা হরণ হয়। মানুষগুলোকে ইচ্ছার বিরুদ্ধে থাকতে হয় খাঁচায় বন্দি।

কিছুটা দূরে অবস্থান করলেও দেশের আইনশৃঙ্খলা কর্মী-পুলিশ ও মিলিটারি সমাজকে অনেকটা নিয়ন্ত্রণে করে। মোটাদাগে তাদের দায়িত্ব যথাক্রমে রাষ্ট্রের নিয়ম মেনে মানুষকে বিশৃঙ্খলা থেকে দূরে রাখা এবং অন্য জাতির আক্রমণ থেকে দেশকে রক্ষা করা। নিয়ন্ত্রণ করার জন্য কখনো কখনো পুলিশকে কঠোর হতে হয়, রাষ্ট্রযন্ত্রের কথা মানতে হয়, ইচ্ছা বা অনিচ্ছায় অপ্রিয় কাজ করতে হয়, যে কারণে সমাজের বেশিরভাগ মানুষ তাদের অপছন্দ করে। ‘দুর্নীতিবাজ’ বলে আখ্যা দিয়ে পুলিশকে সমালোচনা করা আমাদের এই তল্লাটের মানুষের মধ্যে খুব প্রচলিত একটা বিষয়, যদিও কোনো দেশে শুধুমাত্র একটি পেশার মানুষ দুর্নীতিগ্রস্ত হয় না। সে যাই হোক, শহরের বা গ্রামের মানুষকে অপরাধ করতে বাধা দেয়া এবং সঠিক রাস্তা চেনানোর জন্য সার্টিফিকেটধারী পুলিশ যুগ যুগ ধরে কাজ করে আসছে, আবার ঘুষের বিনিময় অপরাধীকে ছেড়ে দেয়া এবং নিরপরাধ লোককে শাস্তি দেয়ার নজিরও অগণিত।

মিলিটারি বা আর্মি প্রয়োজনে দেশের জন্য যুদ্ধ নেমে ভূখ-কে রক্ষা করে এবং সীমান্ত এলাকার নিরাপত্তা দেয়। স্থল, জল ও আকাশ তিন পথেই লড়াই করার জন্য ভিন্ন ভিন্ন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সৈনিক কাজ করে থাকে। রাজনীতি ও কূটনীতির সঙ্গে তাদের সরাসরি যোগাযোগ থাকার কথা নয়, তবুও আফ্রিকা, এশিয়া, দক্ষিণ আমেরিকা থেকে শুরু করে পৃথিবীর বহু দেশের সরকার চালনায় মুখ্য ভূমিকা পালন করে মিলিটারি। নিয়ম ভেঙ্গে যখন মিলিটারি প্রশাসনিক বিষয়ে সরাসরি হস্তক্ষেপ করে, তখন এর পরিণাম হয় ভয়ংকর নির্মম। শীর্ষ ধনী কিছু দেশ এদের নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করে। দেখা গেল দারিদ্র্যসীমার নিচে অবস্থিত আফ্রিকার কোথাও তেলের খনি পাওয়া গেল। লুটেরা কোনো

শক্তিধর রাষ্ট্র সেই দেশে কূটনৈতিক গ-োগোল বাঁধিয়ে দিয়ে সিংহাসনে বসালো সামরিক শাসককে।

আর্মির উচ্চপদস্থ কিছু অফিসারকে রাতারাতি কোটিপতি বানিয়ে দিয়ে নিজেরা হাতিয়ে নিল সেই দেশের খনিজ তেল। এরকম অনেক ঘটনা রয়েছে ইতিহাসে। এছাড়া সীমান্ত এলাকা দিয়ে অবৈধ অস্ত্র ও ড্রাগসের অনুপ্রবেশের সঙ্গেও বহু দেশের আর্মি জড়িত থাকে। মিলিটারির অধীনে গোপনে কী কী কাজ হয় তা জনগণ বা সাংবাদিকরা খুব স্পষ্টভাবে জানতে পারে না, তাই দুর্নীতি চলে অবাধে। তবে মানবসৃষ্ট এই সমাজ ব্যবস্থায় মিলিটারির নিশ্চয়ই প্রয়োজন রয়েছে। একেবারেই প্রয়োজন না- থাকলে এর অস্তিত্ব থাকতো না। সুতরাং সামরিক বাহিনীর নেতিবাচক ও ইতিবাচক দুইটি ভূমিকায় রয়েছে। বিশ্বময় লাখ লাখ সৈনিকের জীবন যেন লোহার গারদে আটকে থাকে। তাদের কাজও জনগোষ্ঠীকে শৃঙ্খলার বেষ্টনীতে আবদ্ধ রাখা।

(চলবে)

[লেখক : চিত্রকর ও চলচ্চিত্র শিক্ষক]

মকর সংক্রান্তি : বাঙালির উৎসব ও ঐতিহ্যের ধারক

শৃঙ্খলে আবদ্ধ সামাজিক মানুষ

দাবি আদায়ে জনদুর্ভোগ : অপসংস্কৃতি ও নৈতিক প্রশ্ন

মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সংখ্যা নিয়ে কূটতর্ক

রজিনাদের বেঁচে থাকার লড়াই

মানব পাচার প্রতিরোধে প্রয়োজন সচেতনতা

সংবিধান সংশোধন : আমাদের বলার আছে

চিন্তা ও ভাব প্রকাশের স্বাধীনতা

গ্রাম উন্নয়নে যুব সমাজের ভূমিকা

‘দেশজ নাট্যশৈলী’র কেন্দ্রীয় নাট্যআঙ্গিক ও রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি

ভ্যাট বাড়ানোর সিদ্ধান্ত ও কিছু প্রশ্ন

রাখাইন পরিস্থিতি : বাংলাদেশের পররাষ্ট্র নীতির বড় পরীক্ষা

রাজনীতিতে নারীর অংশগ্রহণ ও নেতৃত্ব

রম্যগদ্য : নিশুতিরাতের আগন্তুক

গুরু রবিদাস জির কথা

গোবিন্দগঞ্জের সাঁওতালদের জন্য অশনিসংকেত

নতুন বছরের প্রত্যাশা

নৈতিকতা, শিক্ষা ও উন্নয়ন: আমাদের মুক্তির পথ

কোথায় নাই কোটা?

ছবি

ও আমার স্বপ্ন ঝরা আকুল করা জন্মভূমি

ব্রেন রট: বর্তমান সময়ের এক মারাত্মক ব্যাধি

যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলুক দেশের গবেষণা

নির্মোহ ইতিহাস চর্চা ও রাষ্ট্র সংস্কার প্রয়াসে শিক্ষা

জলবায়ুর পরিবর্তন ও দেশের ভবিষ্যৎ

প্রসঙ্গ : থিয়েটার ফর থেরাপির তাত্ত্বিক ও প্রায়োগিক পাঠ

শ্বেতপত্রে নতুন কী আছে?

ছবি

ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান ও জুনো ভাইয়ের স্মৃতি

পরিবেশ সুরক্ষায় সার্কুলার ইকোনমি

বাজার নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না কেন

ভাড়া ‘নির্ধারণ’ কিংবা ‘নিয়ন্ত্রণ’ করবে কে?

ব্যাংক ও আর্থিক খাতের জন্য কেমন ছিল ২০২৪ সাল?

স্বৈরাচারের শেষ নেই...

ছবি

স্মরণ : বাংলা সাহিত্যের অমর কথাশিল্পী

দোষারোপের রাজনীতি আর কত

জ্ঞান, দক্ষতা ও সৃজনশীলতার বিকাশে চাই বিকেন্দ্রিক শিক্ষাব্যবস্থা

যৌন নিপীড়ন প্রসঙ্গে

tab

উপ-সম্পাদকীয়

শৃঙ্খলে আবদ্ধ সামাজিক মানুষ

কাজী সালমান শীশ

সোমবার, ১৩ জানুয়ারী ২০২৫

সামাজিক মানুষ বলতে প্রথমে যে চেহারাটা মনে ভেসে ওঠে তা হলো একজন স্বাভাবিক লোক- যিনি নয়টা পাঁচটা অফিস করেন, সস্ত্রীক জন্মদিনের অনুষ্ঠানে যান, কাজ শেষে বাজার করে ঘরে ফেরেন, ছেলেকে ইংরেজি পড়ান বা পাঞ্জাবি পরে বিয়ে বাড়িতে যানÑ বিষয়টা অনেকটাই নির্ভর করে অর্থনৈতিকভাবে ব্যক্তিটি সমাজের কোন স্তরে থাকেন তার ওপর। মধ্যবিত্তের সামাজিকতার সঙ্গে উচ্চবিত্ত ও নিম্নবিত্তের সামাজিকতা পুরোপুরি মিলে না, তবু কিছু মিল শাশ্বত। সামাজিক মানুষদের লোকে ভদ্রলোক বা ভদ্রমহিলা বলে থাকেন, কারণ তারা সচরাচর ভীষণ বা চরম কিছু করেন না। দৃশ্যত অনিয়ম থেকে দূরে থাকেন। নিয়মতান্ত্রিক জীবনযাপনে এ মানুষগুলো সরলরৈখিক ধারা মেনে চলতে অভ্যস্ত।

অপরদিকে অসামাজিক মানুষজন সমাজে ভয়ংকররূপী হিসেবে বিশেষভাবে চিহ্নিত হয়ে থাকে। তারা নেতিবাচক অর্থে নিয়ম ভাঙ্গে, ধারাবাহিকভাবে কাজ করে না, অভদ্র আচরণ করে, অল্পতে রেগে যায়, ঘুমের সময় নির্দিষ্ট থাকে না, অনেক সময় বড় ধরনের অপরাধের সাথেও জড়িত থাকে। সামাজিক শৃঙ্খলের বাইরে অবস্থান করার জন্য মানুষজন তাদের পছন্দ করে না, তারাও সহজে লোকজনের সাথে মিশে না। কখনো কখনো কিছু বৈজ্ঞানিক, শিল্পী বা খেলোয়াড়দের অসামাজিক স্বভাবের হতে দেখা যায়। সাফল্য পেলে সমাজ তাদের গ্রহণ করে, না পেলে স্বাভাবিকভাবেই তাদের লাঞ্ছনা সহ্য করতে হয়। চরম অসামাজিক মানুষের মধ্যেও প্রতিভাধর মানুষ দেখা যায়, আবার প্রচ- ভদ্র মানুষদেরও দেখা যায় গোপনে ভয়ংকর অন্যায় করতে। হাজার হলেও সকলেই মানুষ। মানুষকে লেবেল দিয়ে বিচার করা যায় না, উচিতও না।

ইদানীং মধ্যবিত্ত বাঙালিদের মুখে বহুল প্রচলিত একটা টার্ম হচ্ছে ‘কর্পোরেট কালচার’। বিভিন্ন বিদেশি সংস্থা ও বড় বড় এনজিওতে (নন-গভর্নমেন্ট অর্গানাইজেশন) যারা চাকরি করেন, কোম্পানির সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখেন, তারা এই কালচারের অন্তর্গত। চাকরিজীবী হলেও এরা অপেক্ষাকৃত বেশি টাকা উপার্জন করে থাকেন ব’লে অনেকেই গর্বের সাথে নিজেদের পরিচয় দিতে স্বাচ্ছন্দ বোধ করেন। গোছানো, মার্জিত, পশ্চিমা কায়দার পোশাক পরে এরা অফিসে আসেন, কথায় কথায় ইংরেজি বাক্যে ব্যবহার করেন, কাঁটা চামুচ দিয়ে লাঞ্চ করেন, পাঁচ তারকা হোটেলে মিটিং করেন... ইত্যাদি ইত্যাদি।

মূল বিষয়টা হচ্ছে খদ্দের (ক্লায়েন্ট) ধরে কাজ করে জীবনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। খদ্দের ধরার কাজটা অনেক সময় উঁচু পর্যায় থেকে হয়ে আসে। কর্পোরেটরা বাকি কাজটা সমাধা করেন। সরল মনে চিন্তা করলে কর্পোরেট কাজের প্রয়োজন আছে নিশ্চয়ই ধনী দেশের সাথে সম্পর্ক রক্ষা করে কাজ করার জন্যে, কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে ওদের দেখলে আমার মায়া লাগে। গ-িবদ্ধ জীবন তাদের সকাল ১০টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত অফিসে সময় দিতে হয়। কোম্পানিগুলো কর্পোরেট চাকুরেদের ফরমাল ড্রেস পরিয়ে, বিদেশ সফর করিয়ে, মোটা অংকের বেতন দিয়ে যেন দাস বানিয়ে রাখে। শিক্ষিত সমাজকে নিয়ন্ত্রণ করে কাজে লাগানোর জন্য কর্পোরেট সমাজের তুলনা নেই। বছরের পর বছর তারা কাটিয়ে দেয় কোম্পানির জন্য কাজ করে। মানুষগুলো নিজের স্বাতন্ত্র্য হারিয়ে মেশিন হয়ে কোম্পানির স্বার্থ রক্ষা করে। মাসে মাসে এতগুলো টাকা দেয়, সুবিধা দেয়- সেটাকে কোম্পানি উসুল করবে না, তাই কি সম্ভব? অর্থের মত সাংঘাতিক বস্তু পৃথিবীতে দ্বিতীয়টা নেই। সেই অর্থের যোগান, বিনিময় ও বণ্টন যথেষ্ট জটিল। অর্থের চক্রাকার বৃত্তে একবার প্রবেশ করলে তা থেকে বের হয়ে আসা প্রায় অসম্ভব। বড় ইন্ডাস্ট্রিগুলো টাকার পাহাড় বানায় শ্রমিকের শ্রমে, যার ছিটেফোঁটা পায় কর্পোরেট অফিসাররা। ধনী দেশ ধনী হয় আর গরিব দেশ ধনী দেশের জন্য কাজ করে। পুঁজিবাদের চাকা এভাবেই ঘুরে। বহু সংখ্যক মানুষের মস্তিষ্ক বন্দী হয়ে থাকে কর্পোরেট কালচারের অধীনে।

এক সময় ডাকাত রাতের আঁধারে ঘরে ঢুকে লুট করে নিয়ে যেত সোনা-দানা ও মূল্যবান বস্তু, এখন মানুষ নিজে গিয়ে টাকা-পয়সা, সম্পদ জমা দিয়ে আসে ব্যাংকে। আমাদের মত দুর্নীতিগ্রস্ত দেশে অনেক সময় ‘রক্ষক’ হয়ে যায় ‘ভক্ষক’, অর্থাৎ সাধারণ মানুষের সংরক্ষিত টাকা সরিয়ে ফেলে ব্যাংক স্বয়ং। তবে সেটা ঠিক স্বাভাবিক চিত্র নয়। সাধারণত ব্যাংক জমাকৃত অর্থের নিরাপত্তা ও সুরক্ষা দান করে থাকে। বিপুল সংখ্যক অর্থ ব্যাংকে জমা হয় এবং জমাদানকারীকে তা থেকে কিছু লভ্যাংশ দেয়া হয়ে থাকে। জমাকৃত টাকার অনেক বড় একটা অংশ ব্যয় হয় অন্য কোম্পানি বা ব্যক্তিকে লোন দিয়ে। সেই ধারের পয়সায় রাস্তাঘাট, বিল্ডিং, মার্কেট ইত্যাদি তৈরি হয়। আপনার অর্থ সারাজীবন আপনারই থাকবে, কিন্তু বড় বিনিয়গের জন্য কাজ করে যাবে ব্যাংক। খুব সহজ ভাষায় এটা হচ্ছে ব্যাংকের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কাজের একটি ধারা। বিভিন্ন রকম অসাধু পন্থা অবলম্বন করে সারাবিশ্বে ব্যাংক ধনী হয়, কিন্তু তারা সাধারণ মানুষদের ঘাটে না। প্রাইভেট ব্যাংকের মালিক যদি মাফিয়াও হয়, সে ডাকাতের মত অর্থ লুট করে না। সেকারণে তারা যুগের পর যুগ ধরে মানুষের আস্থা নিয়ে টিকে থাকে এবং ব্যাংকিং ব্যবসা চলতে থাকে। বিদেশে যুদ্ধাস্ত্র কেনার জন্য মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার ধার দিতে পারে, কিন্তু নিজেদের কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে অর্থ আত্মসাৎ করে (সম্ভবত) ভিন্নদেশে পাচার করতে পারে না। দৃশ্যত অন্তত তাই আমরা জানি।

ব্যক্তিগত বহুসংখ্যক লোককে অর্থের নিরাপত্তা দিয়ে ফুলে ফেঁপে ওঠে ব্যাংক। পুঁজিবাজারের প্রচ- শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান ব্যাংকের নিয়ম চলে অংকে, মানবিকতায় নয়। এখানে ধনীরা অবশ্যই বেশি সুবিধা পাবে কারণ এর জন্মই হয়েছে ধনীদের সহায়তা করার জন্য। ব্যাংক যুদ্ধজাহাজ কিনতে বিনিয়গ করলো, নাকি গাছ কেটে অট্টালিকা বানালো– সেই বিষয়ে ব্যক্তিগত বিনিয়গকারীরা জানতে পারে না। ‘টাকায় টাকা আনে’ এই বাক্যের যথাযথ উদাহরণ হচ্ছে ব্যাংকিং পদ্ধতি। অর্থনৈতিক অবকাঠামো নিয়ন্ত্রণেও ব্যাংকের তুলনা হয় না। মানুষ, সমাজ, এমনকি দেশ পরিচালনার সাথে ব্যাংক জড়িত। অনেকটা বিশাল চক্রাকার মাকড়সার জালের মতো আবদ্ধ এই ব্যাংকিং ব্যবস্থা। এর শঙ্খলের বলয়ে মানুষ আটকে থাকতে বাধ্য।

অপরাধী অন্যায়ের চরমে পৌঁছে ধরা পরলে রাষ্ট্রের আইন অনুযায়ী তাদের কারাগারে পাঠানো হয়। আইন ভাঙ্গার দায়ে ব্যক্তি বিশেষের শাস্তি হয়। হত্যা, রেপ, ডাকাতি, চুরি, চোরাচালানের মত বহু অপরাধে অপরাধীর কারাদ- হয়ে থাকে। অপরাধের ধরন ও প্রকোপের ওপর নির্ভর করে কারো হয় ফাঁসি, যাবজ্জীবন বা খ-কালীন জেল। ব্যক্তি পর্যায়ে অপরাধে শাস্তিগুলো দৃশ্যমান, কিন্তু লোকটা কেন অন্যায় করছে কিংবা কোনো বৃহৎ শক্তি কাজটা পরোক্ষভাবে করাচ্ছে কিনা- সেই বিষয়গুলো অস্পষ্টই থেকে যায়। গৃহযুদ্ধে যেই বালক চোখের সামনে তার বাবা-মা, ভাই, বোনকে প্রাণ বিসর্জন দিতে দেখেছে, স্বাভাবিকভাবেই তার ভেতর প্রতিশোধ স্পৃহা জাগবে। সেই ছেলে যদি বিশ বছর পরে যুবক হয়ে এর প্রতিশোধ নিতে মানুষ হত্যা করে এবং ধরা পড়ে, তখন তার বিচার হবে হত্যার দায়ে। কেন ছেলেটি এমন বিকৃত মানসিকতার মানুষ হয়ে উঠেছে- সেই ব্যাপারটা বিবেচনা করা হয় না; সেটা বিবেচনার সহজ রাস্তাও নেই। বহু বড় অপরাধের ক্ষেত্র সৃষ্টি করে শক্তিশালী চক্র, ভীনদেশি রাষ্ট্র বা নিজ দেশের সমাজ ব্যবস্থা। যদিও শাস্তি পায় অপরাধের সাথে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত সর্বশেষ ব্যক্তিটি। ক্ষমতার বিচারে অপেক্ষাকৃত দুর্বল ব্যক্তির শাস্তি ভোগ করার সম্ভাবনা বেশি থাকে। এভাবেই চলে আসছে যুগ যুগ ধরে।

কারাগার সাদৃশ্য আরেকটা প্রতিষ্ঠান হচ্ছে পাগলাগারদ। মানসিক ভারসাম্যহীন, সমাজে থাকার অনুপযোগী মানুষদের পাঠানো হয় পাগলাগারদে। সেখানে বিভিন্ন ধরনের মানসিকভাবে অসুস্থ মানুষরা থাকে, খায়, চিকিৎসা নেয়, কিছু কিছু কাজ করে এবং পর্যায়ক্রমে বহু সেশনের মাধ্যমে তাদের সুস্থ করে তোলার চেষ্টা করা হয়ে থাকে। সুস্থ করে তোলার প্রক্রিয়া অনুন্নত দেশে খুবই অবহেলিত অবস্থায় থাকে বলাই বাহুল্য। পশ্চিমা ধনী দেশগুলোতে রুগীরা উৎকৃষ্ট চিকিৎসা ও কাউন্সিলিং পায়। সে যাক, বিষয় হল পাগলকে পাগল নির্ধারণ করে কে বা কারা? উত্তরে প্রথমেই আসবে পরিবারের কথা। পরিবার, পাড়া, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, কর্মস্থল ও রাস্তাঘাটে মানুষের সাথে কোনো ব্যক্তি যদি নিয়মিত অসংলগ্ন আচরণ করতে থাকে, তখন মানুষই উক্ত ব্যক্তিকে ‘পাগল’ উপাধি দিয়ে থাকে। অবস্থা চরমে চলে গেলে তাকে পাঠানো হয় পাগলাগারদে। কে কেন পাগল তার জবাব উত্তর-আধুনিক দার্শনিকরাও যথার্থভাবে দিয়ে যেতে পারেননি। মানুষের মস্তিষ্কের কোটি কোটি নিউরোনের মধ্যে কোনটা কিভাবে কাজ করে, কোনটা কেন বাধা প্রাপ্ত হয়- তার ব্যাপ্তি এত বৃহৎ যে সুপার কম্পিউটার তো দূরের কথা, ঈশ্বর ব্যতীত কেউ এর উত্তর জানে বলে মনে হয় না।

দৃশ্যত পাগল হয়- জন্মগতভাবে, মানসিক আঘাত পেয়ে, মাদকাসক্ত হয়ে ও বিষণœতাকে লালন করে। ধরে নিচ্ছি সুস্থ, স্বাভাবিক, ভীতু মানুষদের থেকে ভারসাম্যহীন লোকটি আলাদা। সমস্যা হয় সে যখন অন্যদের জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। বারবার একই রকম আচরণ করা থেকে শুরু করে চিৎকার, মারামারি, ভয় দেখানোর কারণে সামাজিকভাবে তাদের প্রত্যাখ্যান করা হয়। অন্ধকার মধ্যযুগের মতো যেহেতু পাগলটিকে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করা যাচ্ছে না, তাই পাগলাগারদে তুলে দিলে বোঝাটা ঘাড় থেকে সরে যায়। বাকিটুকু প্রতিষ্ঠান পাগলাগারদ সামলায়। পৃথিবীর প্রত্যেকটা মানুষের মধ্যে কমবেশি অসংলগ্নতা বা অপ্রকৃতিস্থতা রয়েছে জন্মগতভাবেই। তবুও পাগলকে চিহ্নিত করা হয় বিশেষ মানুষ হিসেবে। সমাজের সিদ্ধান্তে, স্বাধীনতা হারিয়ে গারদে যায় এই বিশেষ শ্রেণীর মানুষ। আধুনিক ব্যবস্থা মনে হলেও আসলে ব্যাপারটা মধ্যযুগীয়। পাগলের রাজ্যে কে পাগল, আর সুস্থ মানুষের পরিম-লে কে সুস্থÑ কে জানে? কারাগার ও পাগলাগারদ দুইটি প্রতিষ্ঠানেই মানুষের স্বাধীনতা হরণ হয়। মানুষগুলোকে ইচ্ছার বিরুদ্ধে থাকতে হয় খাঁচায় বন্দি।

কিছুটা দূরে অবস্থান করলেও দেশের আইনশৃঙ্খলা কর্মী-পুলিশ ও মিলিটারি সমাজকে অনেকটা নিয়ন্ত্রণে করে। মোটাদাগে তাদের দায়িত্ব যথাক্রমে রাষ্ট্রের নিয়ম মেনে মানুষকে বিশৃঙ্খলা থেকে দূরে রাখা এবং অন্য জাতির আক্রমণ থেকে দেশকে রক্ষা করা। নিয়ন্ত্রণ করার জন্য কখনো কখনো পুলিশকে কঠোর হতে হয়, রাষ্ট্রযন্ত্রের কথা মানতে হয়, ইচ্ছা বা অনিচ্ছায় অপ্রিয় কাজ করতে হয়, যে কারণে সমাজের বেশিরভাগ মানুষ তাদের অপছন্দ করে। ‘দুর্নীতিবাজ’ বলে আখ্যা দিয়ে পুলিশকে সমালোচনা করা আমাদের এই তল্লাটের মানুষের মধ্যে খুব প্রচলিত একটা বিষয়, যদিও কোনো দেশে শুধুমাত্র একটি পেশার মানুষ দুর্নীতিগ্রস্ত হয় না। সে যাই হোক, শহরের বা গ্রামের মানুষকে অপরাধ করতে বাধা দেয়া এবং সঠিক রাস্তা চেনানোর জন্য সার্টিফিকেটধারী পুলিশ যুগ যুগ ধরে কাজ করে আসছে, আবার ঘুষের বিনিময় অপরাধীকে ছেড়ে দেয়া এবং নিরপরাধ লোককে শাস্তি দেয়ার নজিরও অগণিত।

মিলিটারি বা আর্মি প্রয়োজনে দেশের জন্য যুদ্ধ নেমে ভূখ-কে রক্ষা করে এবং সীমান্ত এলাকার নিরাপত্তা দেয়। স্থল, জল ও আকাশ তিন পথেই লড়াই করার জন্য ভিন্ন ভিন্ন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সৈনিক কাজ করে থাকে। রাজনীতি ও কূটনীতির সঙ্গে তাদের সরাসরি যোগাযোগ থাকার কথা নয়, তবুও আফ্রিকা, এশিয়া, দক্ষিণ আমেরিকা থেকে শুরু করে পৃথিবীর বহু দেশের সরকার চালনায় মুখ্য ভূমিকা পালন করে মিলিটারি। নিয়ম ভেঙ্গে যখন মিলিটারি প্রশাসনিক বিষয়ে সরাসরি হস্তক্ষেপ করে, তখন এর পরিণাম হয় ভয়ংকর নির্মম। শীর্ষ ধনী কিছু দেশ এদের নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করে। দেখা গেল দারিদ্র্যসীমার নিচে অবস্থিত আফ্রিকার কোথাও তেলের খনি পাওয়া গেল। লুটেরা কোনো

শক্তিধর রাষ্ট্র সেই দেশে কূটনৈতিক গ-োগোল বাঁধিয়ে দিয়ে সিংহাসনে বসালো সামরিক শাসককে।

আর্মির উচ্চপদস্থ কিছু অফিসারকে রাতারাতি কোটিপতি বানিয়ে দিয়ে নিজেরা হাতিয়ে নিল সেই দেশের খনিজ তেল। এরকম অনেক ঘটনা রয়েছে ইতিহাসে। এছাড়া সীমান্ত এলাকা দিয়ে অবৈধ অস্ত্র ও ড্রাগসের অনুপ্রবেশের সঙ্গেও বহু দেশের আর্মি জড়িত থাকে। মিলিটারির অধীনে গোপনে কী কী কাজ হয় তা জনগণ বা সাংবাদিকরা খুব স্পষ্টভাবে জানতে পারে না, তাই দুর্নীতি চলে অবাধে। তবে মানবসৃষ্ট এই সমাজ ব্যবস্থায় মিলিটারির নিশ্চয়ই প্রয়োজন রয়েছে। একেবারেই প্রয়োজন না- থাকলে এর অস্তিত্ব থাকতো না। সুতরাং সামরিক বাহিনীর নেতিবাচক ও ইতিবাচক দুইটি ভূমিকায় রয়েছে। বিশ্বময় লাখ লাখ সৈনিকের জীবন যেন লোহার গারদে আটকে থাকে। তাদের কাজও জনগোষ্ঠীকে শৃঙ্খলার বেষ্টনীতে আবদ্ধ রাখা।

(চলবে)

[লেখক : চিত্রকর ও চলচ্চিত্র শিক্ষক]

back to top