বশীর আহমেদ
সম্প্রতি বাংলাদেশে নতুন রাজনৈতিক পটবিন্যাসের পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ বিভিন্ন প্রচার-প্রচারণায় একটি চিহ্নিত মহল মুক্তিযুদ্ধ এবং মুক্তিযোদ্ধাদের সম্পর্কে লক্ষণীয়ভাবে নেতিবাচক অপপ্রচার চালাচ্ছে। বিশেষ করে ওই মহলটি একাত্তরে এই ভূখ-ে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হাতে নির্মম গণহত্যার শিকার ৩০ লাখ শহীদের সংখ্যাটি নিয়ে কূটতর্ক বেশ জোরদার করেছে। অর্থাৎ সামগ্রীক বিষয়টির উদ্দেশ্য, মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সংখ্যা নিয়ে গণসমাজে ব্যাপক আকারে বিভ্রান্তি উসকে দেয়া। ওই চিহ্নিত মহলটির দাবি, মুক্তিযুদ্ধে গণহত্যার ভিকটিম ছিল ৩ লাখ। হতে পারে, তারা ভেবেছে যে, এই বিভ্রান্তি প্রতিষ্ঠা করা গেলে তাতে করে একাত্তরে পাকিস্তানিদের এদেশীয় সহযোগী মুক্তিযুদ্ধবিরোধীদের কৃত অপরাধের মাত্রা হালকা করা যাবে। এর আগে মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সংখ্যা নিয়ে এমন বিকারগ্রস্ততা আর কখনো এভাবে দেখা যায়নি।
বাঙালির রক্তঝরা মুক্তিযুদ্ধে দখলদার পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হাতে বাংলাদেশে বাছবিচারহীন গণহত্যার কথা দেশে-বিদেশে এক আলোচিত প্রসঙ্গ। সেই গণহত্যায় ৩০ লাখ শহীদের সংখ্যাটিও এক প্রতিষ্ঠিত সত্য। তথাপি এখন প্রশ্ন তোলা হচ্ছে এবং তা অবিশ্বাস্য জিঘাংসার সঙ্গে, বেশ জোরালোভাবেই।
সে যাই হোক, মুক্তিযুদ্ধকালে পাকিস্তানি সেনাদের নির্বিচার গণহত্যার শিকার শহীদের সংখ্যা নিশ্চিতভাবে অনুমাননির্ভর; যদিও তা ছিল মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে সম্পর্কিত ব্যক্তি এবং সংস্থাগুলোর নিবিড় পর্যবেক্ষণের ফসল। এই দাবি তাৎক্ষণিকভাবে উত্থাপিত হয়েছিল, তবে তা হঠাৎ আবিষ্কৃত কোন তথ্য নয় মোটেই। পরবর্তী সময়ে নানা তথ্যপ্রমাণ এবং গবেষণার উপাত্ত বিশ্লেষণে এর সত্যাসত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, যা নিয়ে কখনো কাউকে প্রশ্ন তুলতে দেখা যায়নি। দেশের শিক্ষায়তনগুলোতে বিগত ৫৩ বছরব্যাপী শিক্ষার্থীদের এ সংখ্যাই শেখানো হয়ে এসেছে। আশ্চর্যের বিষয় হলো, একাত্তরে গণহত্যার শিকার শহীদের সংখ্যা নিয়ে বিতর্ক তোলার সমান্তরালে এই বছর নতুন করে ছাপা স্কুল পাঠ্যবইতেও সংখ্যাটি প্রথমবারের মতো অনির্দিষ্টভাবে ‘লাখো শহীদ’ উল্লেখ করা হয়েছে। এর আগে সংখ্যাটি সুনির্দিষ্টভাবে ৩০ লাখ উল্লিখিত হয়ে আসছিল। এটা নিছক কাকতালীয় কিনা, তা বলতে পারবেন পাঠ্যপুস্তক প্রণয়নের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা। এ পরিপ্রেক্ষিতে প্রশ্ন ওঠা খুবই স্বাভাবিক যে, প্রমাণিত কোন সেই তথ্যের জেরে একটি সুপ্রতিষ্ঠিত, স্পর্শকাতর এবং গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক উপাদান বদলানো হলো; কেন হলো?
একাত্তরের ভয়াল দিনগুলোতে শত্রুকবলিত দেশের ভেতর ভয়ার্ত দেশবাসী সুদীর্ঘ নয়টি মাস অবরুদ্ধ জীবন অতিবাহিত করেছিলেন। পাকিস্তানি সেনারা তাদের এদেশীয় সহযোগীদের নিয়ে গ্রামের পর গ্রাম, নগরে জনপদে হামলে পড়েছিল। তারা জনমনে ভীতি সঞ্চারের উদ্দেশ্যে বাছবিচারহীনভাবে গণত্যার মতো নৃশংসতা চালিয়েছিল। সেই নির্মম পৈশাচিকতার জ্বলজ্যান্ত দলিলÑ গণহত্যার অসহায় শিকার শহীদের সংখ্যা; যা মুক্তিযুদ্ধের সবচাইতে স্পর্শকাতর এবং ঐতিহাসিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। এটা মোটেই হেলাফলার কিছু নয়, এবং কারো ইচ্ছা পূরণ অথবা ভালো লাগা, মন্দ লাগারও বিষয় হতে পারে না।
একাত্তরে গণহত্যায় নিহত শহীদের সংখ্যার ধারণা সম্পর্কে নিশ্চিতির স্বার্থে এবং সম্প্রতি উত্থাপিত অপপ্রচার ও তথ্য বিকৃতির মুখে এ সম্পর্কিত কিছু তথ্য-উপাত্ত নিয়ে আলোচনা করা যেতে পারে। এই অবস্থায়, প্রথমেই দেখা দরকার ১৯৭০ সালে পাকিস্তানে প্রথমবার আয়োজিত সাধারণ নির্বাচন পরবর্তী তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক পরিস্থিতি কেমন ছিল। অতঃপর তা সমাধানের নামে সামরিক বাহিনী ব্যবহার তথা নিজের একটি ভূখ- দখলের সিদ্ধান্ত নেয়া পাকিস্তানের সামরিক সরকারের মনস্তত্ব এবং পরিকল্পনা। ২৫ মার্চ রাতে অপারেশন সার্চলাইটের নির্দেশদাতা কুখ্যাত প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান সবুজ-শ্যামল বাংলাদেশ ‘লাল’ করে দেয়ার হুকুম দিয়েছিল। এটা ছিল একাত্তরের বাছবিচারহীন গণহত্যার সুস্পষ্ট সংকেত বার্তা। এই বিষয়ে সবচাইতে সুবিস্তৃত তথ্যের ভা-ার বলা যায় পাকিস্তানি সাংবাদিক অ্যান্থনি ম্যাসকারেনহাসের ভয়াবহ রিপোর্ট ‘জনোসাইড’; যা সচিত্র আকারে প্রকাশিত হয়েছিল ১৩ জুন, ১৯৭১; লন্ডনের সাপ্তাহিক সানডে টাইমস পত্রিকায়। তখনকার পূর্ব পাকিস্তানে যে নারকীয় নির্মমতায় গণহত্যা চলছিল তার ওপর পূর্ণ দুই পৃষ্ঠাব্যাপী (১৬ কলাম) রোমহর্ষক প্রতিবেদন হলো ম্যাসকারেনহাসের সেই বিখ্যাত রিপোর্টÑ জেনোসাইড।
অ্যান্থনি ম্যাসকারেনহাস পূর্ব পাকিস্তানে সেনাবাহিনী পরিচালিত অপারেশনগুলো দেখার জন্য একাত্তরে এপ্রিল মাসের শেষ দিকে একদল পাকিস্তানি সাংবাদিকের সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তান সফরে আমন্ত্রিত হয়েছিলেন। তখনকার অবরুদ্ধ পূর্ব পাকিস্তানের ভেতর থেকে উদ্ঘাটিত সেই রক্ত হিম করা সরেজমিন তথ্য এবং বিভৎস ছবিগুলো প্রথমবারের মতো দুনিয়া কাঁপিয়েছিল। ম্যাসকারেনহাস লিখেছিলেন, ‘জেনারেল ইয়াহিয়া খানের সামরিক সরকার পূর্ব পাকিস্তান সমস্যার এক নিজস্ব চূড়ান্ত সমাধানের লক্ষ্য নিয়ে ক্রমশঃ এগিয়ে চলেছেন। আমরা পূর্ব পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্নতার হুমকি থেকে এবার পরিশুদ্ধ করতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ, এমনকি এর অর্থ যদি হয় ২০ লাখ লোক হত্যা এবং প্রদেশটি টানা ৩০ বছর উপনিবেশ হিসেবে কঠোর হাতে শাসন করা’Ñ ঢাকা ও কুমিল্লাতে উচ্চপদস্থ বহু সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তা আমাকে ক্রমাগতভাবে এই ব্যাখ্যা করে যাচ্ছিলেন।
তিনি লিখেছিলেন, ‘এখন পূর্ব বাংলায় যেন তারই ভয়ংকর ধারাবাহিকতায় পশ্চিম পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ঠিক সেটাই করে চলেছে; যা ছিল তাদের মনস্তাত্ত্বিক অভিযোগের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।’
সেই রিপোর্টে ম্যাসকারেনহাস লিখেছিলেন, ‘পাকিস্তানিরা ধরেই নিয়েছে, এখানকার সবাই হিন্দু হয়ে গেছে। পাকিস্তানি সেনারা এখন রেজিম চেঞ্জ পদ্ধতির ভেতর দিয়ে আবার তাদের মুসলমান বানাবে। এই দেশে দীর্ঘ দখলদারিত্ব বজায় রেখে সেনাবাহিনী একটি মিশ্র এবং সংকর জাতি উৎপাদনে অগ্রসর হবে।’
কাজেই বিভ্রান্তির কোন অবকাশ থাকতে পারে না যে, একাত্তরের অবরুদ্ধ দিনে বাঙালির বিরুদ্ধে পাকিস্তানি সেনাদের সুচিন্তিত পদক্ষেপ ছিলÑ লক্ষ্য অর্জন না হওয়া পর্যন্ত ‘হেট ক্যাম্পেইন’ চালিয়ে যাওয়া এবং বাছবিচারহীন নারী ধর্ষণের মধ্য দিয়ে বাঙালির পরিবার প্রথা বিনষ্ট, জাতীয় মর্যাদা ‘ডি-গ্রেডেশন’ এবং ‘জাতিগত শুদ্ধিসমর’ অব্যাহত রাখা। একাত্তরে সেটাই ছিল বাঙালির ওপর চাপিয়ে দেয়া নির্বিচার গণহত্যা এবং বাছবিচারহীন পাশবিকতার প্রধানতম অনুঘটক, যাতে প্রাণ হারিয়েছিলেন প্রায় ৩০ লাখ নিরপরাধ বাঙালি।
দ্বিতীয়ত, সরকারি নথিপত্রের তথ্য; যা থেকে জনসংখ্যার হিসাব পর্যালোচনা করা যায়। বলাবাহুল্য, এর মধ্যেই লুকিয়ে আছে গণহত্যার শিকার শহীদের সংখ্যা সম্পর্কে একটি বাস্তবসম্মত ধারণা পাওয়ার চাবিকাঠি। ১৯৬৯ সালের জুন মাসে পাকিস্তানে আদমশুমারি অনুষ্ঠিত হয়েছিল। সেই শুমারিতে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের জনসংখ্যা ছিল ৬ কোটি ৯৮ লাখ। এর পরের আদমশুমারি অনুষ্ঠিত হয় ১৯৭৪ সালে। ’৬৯ সালের আদমশুমারিতে জনসংখ্যা বৃদ্ধির যে হার ছিল, তার ভিত্তিতে ’৭৪ সালে বাংলাদেশে জনসংখ্যা থাকার কথা ৮ কোটি ১০ লাখ। কিন্তু ’৭৪ এর শুমারিতে জনসংখ্যা পাওয়া গিয়েছিল ৭ কোটি ৭৪ লাখ। অর্থাৎ বাস্তবতার চাইতে ঘাটতি জনসংখ্যা ছিল প্রায় ৩৭ লাখ। আদমশুমারিতে পাওয়া হিসাবের এই বিপুল বিশাল ঘাটতি জনসংখ্যা তাহলে কোথায় হারিয়ে গিয়েছিলেন? সুতরাং, একাত্তরের ৯ মাসব্যাপী পশ্চিম পাকিস্তানি নরপশুদের হাতে নির্মম গণহত্যার শিকার ৩০ লাখ শহীদের সংখ্যাটি যে অমূলক নয়; বরং বাস্তবতার নিরীখে যুক্তিসংগত, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
তৃতীয়ত, এই বিষয়ে আরেকটি জোরালো ‘প্রমাণক’ দাঁড়িয়েছে খোদ পাকিস্তানের ভেতর থেকেই। সেটা হলো, ২৬ ডিসেম্বর ’৭১ পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জুলফিকার আলী ভুট্টোর নির্দেশে পূর্ব পাকিস্তানে সামরিক বিপর্যয়ের কারণ খতিয়ে দেখতে বিচার বিভাগীয় তদন্তের জন্য হামুদুর রহমান কমিশন গঠন। কমিশন ‘নৃশংসতা এবং ’৭১ সালে যুদ্ধের পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতির সম্পূর্ণ বিবরণ’ উদ্ঘাটন করে। এর সাক্ষ্য নেয়া হয় ’৭৪ সালে পাকিস্তানি যুদ্ধবন্দিরা স্বদেশে ফিরে গেলে। কমিশনের চূড়ান্ত রিপোর্ট সুদীর্ঘ ছিল। ব্যাপক সাক্ষাৎকার এবং সাক্ষ্যের ভিত্তিতে একটি বিশ্লেষণ তাতে প্রদান করা হয়েছিল। রিপোর্টের সামরিক ইস্যুসম্পর্কিত মূল অংশটি শ্রেণীবদ্ধ এবং ‘টপ সিক্রেট’ হিসেবে চিহ্নিত রাখা হলেও ২০০০ সালে তার কিছু অংশ ভারত ও পাকিস্তানি সংবাদপত্রে ফাঁস হয়ে যায়। শোনা যায়, বাংলাদেশ সেই রিপোর্টের একটি অনুলিপি চেয়েছিল। অবশেষে ২০০০ সালের ডিসেম্বরে, তদন্ত শেষ হওয়ার ২৯ বছর পর, প্রেসিডেন্ট পারভেজ মোশাররফ রিপোর্ট প্রকাশের অনুমতি দেন।
সেই কমিশনের কাছে ব্যক্তিগত সাক্ষ্য দিতে গিয়ে নিয়াজি নিজেই জানিয়েছিল, তার ধারণায় একাত্তরে সামরিক বাহিনীর হাতে নিহতের সংখ্যা ১২ থেকে ১৫ লাখ হতে পারে। স্বাভাবিকভাবেই বলা যায়, এই তথ্যের মূল্য অপরিসীম; যেখানে একাত্তরে নিয়োজিত পাকিস্তান ইস্টার্ন কমান্ডের জিওসি ইন চিফ তদন্ত কমিশনের কাছে নিজে সাক্ষ্য দিয়ে গণহত্যা সম্পর্কে তার নিজের ধারণার কথা জানিয়েছে। এই সংখ্যাটি নিয়াজি ইচ্ছা করে বাড়িয়ে নাকি সঙ্গত কারণে কমিয়ে বলেছিল, সেটাও এক গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন বটে। বাস্তব কারণে নিয়াজির বলা সংখ্যাটি কম হওয়াই স্বাভাবিক। এই তথ্য পরিষ্কার করে দেয়, একাত্তরে বাংলাদেশে পরিচালিত গণহত্যার প্রকৃত পরিধি বাস্তবে কত ভয়াবহ ছিল।
চতুর্থ প্রমাণক, রাশিয়ার রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত পত্রিকা প্রাভদা। ৪ জানুয়ারি ’৭২, প্রাভদার খবরে বলা হয়েছিল যে, তাদের নিজস্ব সোর্স থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী সমগ্র বাংলাদেশে দখলদার পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নৃশংস গণহত্যায় অন্ততপক্ষে ৩১ লাখ বাঙালি নিহত হয়েছেন।
এই বিষয়ে প্রমাণক হিসেবে প্রাসঙ্গিক হওয়ায় আরেকটি ভাষ্য তুলে ধরা যেতে পারে। বিশ্বজুড়ে যুদ্ধ-সংঘাতের নৃশংসতা নিয়ে গবেষণাকর্মের অন্যতম এক গবেষক হলেন সুসান ব্রাউনমিলার। সুসান লেখক, সাংবাদিক; যিনি ১৯৭৫ সালে তার লেখা বই ‘এগেইনস্ট আওয়ার উইল: মেন, উইমেন অ্যান্ড রেপ’ এর জন্য সবচেয়ে বেশি পরিচিত, যেটিকে নিউইয়র্ক পাবলিক লাইব্রেরি কুড়ি শতকের ১শ বইয়ের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি হিসেবে নির্বাচিত করেছিল। এতে তিনি লিখেছিলেন, ‘নয় মাসের বিরামহীন সন্ত্রাসের সময়, ভারতের দুই সপ্তাহর সশস্ত্র হস্তক্ষেপের মাধ্যমে সমাপ্ত এবং সম্ভাব্য ৩০ লাখ মানুষ প্রাণ হারিয়েছিল; অনুমিত প্রায় ১০ মিলিয়ন মানুষ সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে পালিয়ে গিয়েছিল, আর অনূন্যপক্ষে ৪ লাখ নারী হয়েছিল ধর্ষিতা।’ তিনি আরও উল্লেখ করেন, ‘সংঘাতপূর্ণ সময়ে ধারণা করা যায়, প্রতিদিন গড়ে প্রায় ৮ থেকে ১২ হাজার মানুষ নিহত হয়েছে।’
মুক্তিযুদ্ধের ৩০ বছর পর মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠা হলে এ পর্যন্ত সারাদেশে সম্ভবত শদেড়েক বৃহত্তর বধ্যভূমি চিহ্নিত করা গেছে। এর বাইরে রয়েছে আরও কত শত, হাজার, কে তার শুমার করবে? মুক্তিযুদ্ধের পরক্ষণে এগুলো চিহ্নিত এবং সংরক্ষণ করা উচিত ছিল। তখন নিদর্শনগুলো ছিল সতেজ। এখন হয়েছে বন্ধ্যা, অশ্রুত-বিশ্রুত। একাত্তরে চট্রগ্রামের ফ’য়স লেক, সাতক্ষীরার চুকনগর, পাবনার ডেমরা, নগরবাড়ী ঘাট, সুজানগরসহ ২৩টি স্পটে, রংপুরের পলাশবাড়ী, কুষ্টিয়ার বিত্তিপাড়া, নরসিংদীর ভৈরব বাজার, ঢাকার শিয়ালবাড়ী, জানা-অজানা এমন আরও কত হাজারো বধ্যভূমিতে কত মানুষের জীবন প্রদীপ নিভে গেছে কেউ তার হিসাব করেনি। একাত্তরের বাংলাদেশে দীর্ঘ নয় মাস নদ-নদীতে ভেসে গেছে লাশের মিছিল বিরামহীনভাবে। কিছু অকৃতজ্ঞ অমানুষের আত্ম-সন্তুষ্টির জন্য তা-ও কি অস্বীকার করতে হবে? ভাবতে অবাক লাগে, শহীদদের আত্মত্যাগের উপকারভোগী এই দেশের কিছু অমানুষ তাদের সংখ্যা নিয়েও বিতর্ক তুলছে। সংখ্যাটা ৩ লাখ বা ৩০ লাখ হলে কার কি সুবিধা অথবা অসুবিধা হয়? আর সেজন্য ইতিহাসের প্রমাণিত সত্য অস্বীকার করতে হবে? এখন স্কুলের পাঠ্যবইতেও একাত্তরের শহীদরা হলেন সংখ্যায় অনির্ধারিত, যেন এলিয়েন দঙ্গল! এইটা আসলে কোন দেশ, কাদের দেশ?
[লেখক: মুক্তিযোদ্ধা, প্রবন্ধকার]
বশীর আহমেদ
সোমবার, ১৩ জানুয়ারী ২০২৫
সম্প্রতি বাংলাদেশে নতুন রাজনৈতিক পটবিন্যাসের পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ বিভিন্ন প্রচার-প্রচারণায় একটি চিহ্নিত মহল মুক্তিযুদ্ধ এবং মুক্তিযোদ্ধাদের সম্পর্কে লক্ষণীয়ভাবে নেতিবাচক অপপ্রচার চালাচ্ছে। বিশেষ করে ওই মহলটি একাত্তরে এই ভূখ-ে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হাতে নির্মম গণহত্যার শিকার ৩০ লাখ শহীদের সংখ্যাটি নিয়ে কূটতর্ক বেশ জোরদার করেছে। অর্থাৎ সামগ্রীক বিষয়টির উদ্দেশ্য, মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সংখ্যা নিয়ে গণসমাজে ব্যাপক আকারে বিভ্রান্তি উসকে দেয়া। ওই চিহ্নিত মহলটির দাবি, মুক্তিযুদ্ধে গণহত্যার ভিকটিম ছিল ৩ লাখ। হতে পারে, তারা ভেবেছে যে, এই বিভ্রান্তি প্রতিষ্ঠা করা গেলে তাতে করে একাত্তরে পাকিস্তানিদের এদেশীয় সহযোগী মুক্তিযুদ্ধবিরোধীদের কৃত অপরাধের মাত্রা হালকা করা যাবে। এর আগে মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সংখ্যা নিয়ে এমন বিকারগ্রস্ততা আর কখনো এভাবে দেখা যায়নি।
বাঙালির রক্তঝরা মুক্তিযুদ্ধে দখলদার পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হাতে বাংলাদেশে বাছবিচারহীন গণহত্যার কথা দেশে-বিদেশে এক আলোচিত প্রসঙ্গ। সেই গণহত্যায় ৩০ লাখ শহীদের সংখ্যাটিও এক প্রতিষ্ঠিত সত্য। তথাপি এখন প্রশ্ন তোলা হচ্ছে এবং তা অবিশ্বাস্য জিঘাংসার সঙ্গে, বেশ জোরালোভাবেই।
সে যাই হোক, মুক্তিযুদ্ধকালে পাকিস্তানি সেনাদের নির্বিচার গণহত্যার শিকার শহীদের সংখ্যা নিশ্চিতভাবে অনুমাননির্ভর; যদিও তা ছিল মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে সম্পর্কিত ব্যক্তি এবং সংস্থাগুলোর নিবিড় পর্যবেক্ষণের ফসল। এই দাবি তাৎক্ষণিকভাবে উত্থাপিত হয়েছিল, তবে তা হঠাৎ আবিষ্কৃত কোন তথ্য নয় মোটেই। পরবর্তী সময়ে নানা তথ্যপ্রমাণ এবং গবেষণার উপাত্ত বিশ্লেষণে এর সত্যাসত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, যা নিয়ে কখনো কাউকে প্রশ্ন তুলতে দেখা যায়নি। দেশের শিক্ষায়তনগুলোতে বিগত ৫৩ বছরব্যাপী শিক্ষার্থীদের এ সংখ্যাই শেখানো হয়ে এসেছে। আশ্চর্যের বিষয় হলো, একাত্তরে গণহত্যার শিকার শহীদের সংখ্যা নিয়ে বিতর্ক তোলার সমান্তরালে এই বছর নতুন করে ছাপা স্কুল পাঠ্যবইতেও সংখ্যাটি প্রথমবারের মতো অনির্দিষ্টভাবে ‘লাখো শহীদ’ উল্লেখ করা হয়েছে। এর আগে সংখ্যাটি সুনির্দিষ্টভাবে ৩০ লাখ উল্লিখিত হয়ে আসছিল। এটা নিছক কাকতালীয় কিনা, তা বলতে পারবেন পাঠ্যপুস্তক প্রণয়নের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা। এ পরিপ্রেক্ষিতে প্রশ্ন ওঠা খুবই স্বাভাবিক যে, প্রমাণিত কোন সেই তথ্যের জেরে একটি সুপ্রতিষ্ঠিত, স্পর্শকাতর এবং গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক উপাদান বদলানো হলো; কেন হলো?
একাত্তরের ভয়াল দিনগুলোতে শত্রুকবলিত দেশের ভেতর ভয়ার্ত দেশবাসী সুদীর্ঘ নয়টি মাস অবরুদ্ধ জীবন অতিবাহিত করেছিলেন। পাকিস্তানি সেনারা তাদের এদেশীয় সহযোগীদের নিয়ে গ্রামের পর গ্রাম, নগরে জনপদে হামলে পড়েছিল। তারা জনমনে ভীতি সঞ্চারের উদ্দেশ্যে বাছবিচারহীনভাবে গণত্যার মতো নৃশংসতা চালিয়েছিল। সেই নির্মম পৈশাচিকতার জ্বলজ্যান্ত দলিলÑ গণহত্যার অসহায় শিকার শহীদের সংখ্যা; যা মুক্তিযুদ্ধের সবচাইতে স্পর্শকাতর এবং ঐতিহাসিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। এটা মোটেই হেলাফলার কিছু নয়, এবং কারো ইচ্ছা পূরণ অথবা ভালো লাগা, মন্দ লাগারও বিষয় হতে পারে না।
একাত্তরে গণহত্যায় নিহত শহীদের সংখ্যার ধারণা সম্পর্কে নিশ্চিতির স্বার্থে এবং সম্প্রতি উত্থাপিত অপপ্রচার ও তথ্য বিকৃতির মুখে এ সম্পর্কিত কিছু তথ্য-উপাত্ত নিয়ে আলোচনা করা যেতে পারে। এই অবস্থায়, প্রথমেই দেখা দরকার ১৯৭০ সালে পাকিস্তানে প্রথমবার আয়োজিত সাধারণ নির্বাচন পরবর্তী তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক পরিস্থিতি কেমন ছিল। অতঃপর তা সমাধানের নামে সামরিক বাহিনী ব্যবহার তথা নিজের একটি ভূখ- দখলের সিদ্ধান্ত নেয়া পাকিস্তানের সামরিক সরকারের মনস্তত্ব এবং পরিকল্পনা। ২৫ মার্চ রাতে অপারেশন সার্চলাইটের নির্দেশদাতা কুখ্যাত প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান সবুজ-শ্যামল বাংলাদেশ ‘লাল’ করে দেয়ার হুকুম দিয়েছিল। এটা ছিল একাত্তরের বাছবিচারহীন গণহত্যার সুস্পষ্ট সংকেত বার্তা। এই বিষয়ে সবচাইতে সুবিস্তৃত তথ্যের ভা-ার বলা যায় পাকিস্তানি সাংবাদিক অ্যান্থনি ম্যাসকারেনহাসের ভয়াবহ রিপোর্ট ‘জনোসাইড’; যা সচিত্র আকারে প্রকাশিত হয়েছিল ১৩ জুন, ১৯৭১; লন্ডনের সাপ্তাহিক সানডে টাইমস পত্রিকায়। তখনকার পূর্ব পাকিস্তানে যে নারকীয় নির্মমতায় গণহত্যা চলছিল তার ওপর পূর্ণ দুই পৃষ্ঠাব্যাপী (১৬ কলাম) রোমহর্ষক প্রতিবেদন হলো ম্যাসকারেনহাসের সেই বিখ্যাত রিপোর্টÑ জেনোসাইড।
অ্যান্থনি ম্যাসকারেনহাস পূর্ব পাকিস্তানে সেনাবাহিনী পরিচালিত অপারেশনগুলো দেখার জন্য একাত্তরে এপ্রিল মাসের শেষ দিকে একদল পাকিস্তানি সাংবাদিকের সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তান সফরে আমন্ত্রিত হয়েছিলেন। তখনকার অবরুদ্ধ পূর্ব পাকিস্তানের ভেতর থেকে উদ্ঘাটিত সেই রক্ত হিম করা সরেজমিন তথ্য এবং বিভৎস ছবিগুলো প্রথমবারের মতো দুনিয়া কাঁপিয়েছিল। ম্যাসকারেনহাস লিখেছিলেন, ‘জেনারেল ইয়াহিয়া খানের সামরিক সরকার পূর্ব পাকিস্তান সমস্যার এক নিজস্ব চূড়ান্ত সমাধানের লক্ষ্য নিয়ে ক্রমশঃ এগিয়ে চলেছেন। আমরা পূর্ব পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্নতার হুমকি থেকে এবার পরিশুদ্ধ করতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ, এমনকি এর অর্থ যদি হয় ২০ লাখ লোক হত্যা এবং প্রদেশটি টানা ৩০ বছর উপনিবেশ হিসেবে কঠোর হাতে শাসন করা’Ñ ঢাকা ও কুমিল্লাতে উচ্চপদস্থ বহু সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তা আমাকে ক্রমাগতভাবে এই ব্যাখ্যা করে যাচ্ছিলেন।
তিনি লিখেছিলেন, ‘এখন পূর্ব বাংলায় যেন তারই ভয়ংকর ধারাবাহিকতায় পশ্চিম পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ঠিক সেটাই করে চলেছে; যা ছিল তাদের মনস্তাত্ত্বিক অভিযোগের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।’
সেই রিপোর্টে ম্যাসকারেনহাস লিখেছিলেন, ‘পাকিস্তানিরা ধরেই নিয়েছে, এখানকার সবাই হিন্দু হয়ে গেছে। পাকিস্তানি সেনারা এখন রেজিম চেঞ্জ পদ্ধতির ভেতর দিয়ে আবার তাদের মুসলমান বানাবে। এই দেশে দীর্ঘ দখলদারিত্ব বজায় রেখে সেনাবাহিনী একটি মিশ্র এবং সংকর জাতি উৎপাদনে অগ্রসর হবে।’
কাজেই বিভ্রান্তির কোন অবকাশ থাকতে পারে না যে, একাত্তরের অবরুদ্ধ দিনে বাঙালির বিরুদ্ধে পাকিস্তানি সেনাদের সুচিন্তিত পদক্ষেপ ছিলÑ লক্ষ্য অর্জন না হওয়া পর্যন্ত ‘হেট ক্যাম্পেইন’ চালিয়ে যাওয়া এবং বাছবিচারহীন নারী ধর্ষণের মধ্য দিয়ে বাঙালির পরিবার প্রথা বিনষ্ট, জাতীয় মর্যাদা ‘ডি-গ্রেডেশন’ এবং ‘জাতিগত শুদ্ধিসমর’ অব্যাহত রাখা। একাত্তরে সেটাই ছিল বাঙালির ওপর চাপিয়ে দেয়া নির্বিচার গণহত্যা এবং বাছবিচারহীন পাশবিকতার প্রধানতম অনুঘটক, যাতে প্রাণ হারিয়েছিলেন প্রায় ৩০ লাখ নিরপরাধ বাঙালি।
দ্বিতীয়ত, সরকারি নথিপত্রের তথ্য; যা থেকে জনসংখ্যার হিসাব পর্যালোচনা করা যায়। বলাবাহুল্য, এর মধ্যেই লুকিয়ে আছে গণহত্যার শিকার শহীদের সংখ্যা সম্পর্কে একটি বাস্তবসম্মত ধারণা পাওয়ার চাবিকাঠি। ১৯৬৯ সালের জুন মাসে পাকিস্তানে আদমশুমারি অনুষ্ঠিত হয়েছিল। সেই শুমারিতে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের জনসংখ্যা ছিল ৬ কোটি ৯৮ লাখ। এর পরের আদমশুমারি অনুষ্ঠিত হয় ১৯৭৪ সালে। ’৬৯ সালের আদমশুমারিতে জনসংখ্যা বৃদ্ধির যে হার ছিল, তার ভিত্তিতে ’৭৪ সালে বাংলাদেশে জনসংখ্যা থাকার কথা ৮ কোটি ১০ লাখ। কিন্তু ’৭৪ এর শুমারিতে জনসংখ্যা পাওয়া গিয়েছিল ৭ কোটি ৭৪ লাখ। অর্থাৎ বাস্তবতার চাইতে ঘাটতি জনসংখ্যা ছিল প্রায় ৩৭ লাখ। আদমশুমারিতে পাওয়া হিসাবের এই বিপুল বিশাল ঘাটতি জনসংখ্যা তাহলে কোথায় হারিয়ে গিয়েছিলেন? সুতরাং, একাত্তরের ৯ মাসব্যাপী পশ্চিম পাকিস্তানি নরপশুদের হাতে নির্মম গণহত্যার শিকার ৩০ লাখ শহীদের সংখ্যাটি যে অমূলক নয়; বরং বাস্তবতার নিরীখে যুক্তিসংগত, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
তৃতীয়ত, এই বিষয়ে আরেকটি জোরালো ‘প্রমাণক’ দাঁড়িয়েছে খোদ পাকিস্তানের ভেতর থেকেই। সেটা হলো, ২৬ ডিসেম্বর ’৭১ পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জুলফিকার আলী ভুট্টোর নির্দেশে পূর্ব পাকিস্তানে সামরিক বিপর্যয়ের কারণ খতিয়ে দেখতে বিচার বিভাগীয় তদন্তের জন্য হামুদুর রহমান কমিশন গঠন। কমিশন ‘নৃশংসতা এবং ’৭১ সালে যুদ্ধের পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতির সম্পূর্ণ বিবরণ’ উদ্ঘাটন করে। এর সাক্ষ্য নেয়া হয় ’৭৪ সালে পাকিস্তানি যুদ্ধবন্দিরা স্বদেশে ফিরে গেলে। কমিশনের চূড়ান্ত রিপোর্ট সুদীর্ঘ ছিল। ব্যাপক সাক্ষাৎকার এবং সাক্ষ্যের ভিত্তিতে একটি বিশ্লেষণ তাতে প্রদান করা হয়েছিল। রিপোর্টের সামরিক ইস্যুসম্পর্কিত মূল অংশটি শ্রেণীবদ্ধ এবং ‘টপ সিক্রেট’ হিসেবে চিহ্নিত রাখা হলেও ২০০০ সালে তার কিছু অংশ ভারত ও পাকিস্তানি সংবাদপত্রে ফাঁস হয়ে যায়। শোনা যায়, বাংলাদেশ সেই রিপোর্টের একটি অনুলিপি চেয়েছিল। অবশেষে ২০০০ সালের ডিসেম্বরে, তদন্ত শেষ হওয়ার ২৯ বছর পর, প্রেসিডেন্ট পারভেজ মোশাররফ রিপোর্ট প্রকাশের অনুমতি দেন।
সেই কমিশনের কাছে ব্যক্তিগত সাক্ষ্য দিতে গিয়ে নিয়াজি নিজেই জানিয়েছিল, তার ধারণায় একাত্তরে সামরিক বাহিনীর হাতে নিহতের সংখ্যা ১২ থেকে ১৫ লাখ হতে পারে। স্বাভাবিকভাবেই বলা যায়, এই তথ্যের মূল্য অপরিসীম; যেখানে একাত্তরে নিয়োজিত পাকিস্তান ইস্টার্ন কমান্ডের জিওসি ইন চিফ তদন্ত কমিশনের কাছে নিজে সাক্ষ্য দিয়ে গণহত্যা সম্পর্কে তার নিজের ধারণার কথা জানিয়েছে। এই সংখ্যাটি নিয়াজি ইচ্ছা করে বাড়িয়ে নাকি সঙ্গত কারণে কমিয়ে বলেছিল, সেটাও এক গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন বটে। বাস্তব কারণে নিয়াজির বলা সংখ্যাটি কম হওয়াই স্বাভাবিক। এই তথ্য পরিষ্কার করে দেয়, একাত্তরে বাংলাদেশে পরিচালিত গণহত্যার প্রকৃত পরিধি বাস্তবে কত ভয়াবহ ছিল।
চতুর্থ প্রমাণক, রাশিয়ার রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত পত্রিকা প্রাভদা। ৪ জানুয়ারি ’৭২, প্রাভদার খবরে বলা হয়েছিল যে, তাদের নিজস্ব সোর্স থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী সমগ্র বাংলাদেশে দখলদার পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নৃশংস গণহত্যায় অন্ততপক্ষে ৩১ লাখ বাঙালি নিহত হয়েছেন।
এই বিষয়ে প্রমাণক হিসেবে প্রাসঙ্গিক হওয়ায় আরেকটি ভাষ্য তুলে ধরা যেতে পারে। বিশ্বজুড়ে যুদ্ধ-সংঘাতের নৃশংসতা নিয়ে গবেষণাকর্মের অন্যতম এক গবেষক হলেন সুসান ব্রাউনমিলার। সুসান লেখক, সাংবাদিক; যিনি ১৯৭৫ সালে তার লেখা বই ‘এগেইনস্ট আওয়ার উইল: মেন, উইমেন অ্যান্ড রেপ’ এর জন্য সবচেয়ে বেশি পরিচিত, যেটিকে নিউইয়র্ক পাবলিক লাইব্রেরি কুড়ি শতকের ১শ বইয়ের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি হিসেবে নির্বাচিত করেছিল। এতে তিনি লিখেছিলেন, ‘নয় মাসের বিরামহীন সন্ত্রাসের সময়, ভারতের দুই সপ্তাহর সশস্ত্র হস্তক্ষেপের মাধ্যমে সমাপ্ত এবং সম্ভাব্য ৩০ লাখ মানুষ প্রাণ হারিয়েছিল; অনুমিত প্রায় ১০ মিলিয়ন মানুষ সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে পালিয়ে গিয়েছিল, আর অনূন্যপক্ষে ৪ লাখ নারী হয়েছিল ধর্ষিতা।’ তিনি আরও উল্লেখ করেন, ‘সংঘাতপূর্ণ সময়ে ধারণা করা যায়, প্রতিদিন গড়ে প্রায় ৮ থেকে ১২ হাজার মানুষ নিহত হয়েছে।’
মুক্তিযুদ্ধের ৩০ বছর পর মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠা হলে এ পর্যন্ত সারাদেশে সম্ভবত শদেড়েক বৃহত্তর বধ্যভূমি চিহ্নিত করা গেছে। এর বাইরে রয়েছে আরও কত শত, হাজার, কে তার শুমার করবে? মুক্তিযুদ্ধের পরক্ষণে এগুলো চিহ্নিত এবং সংরক্ষণ করা উচিত ছিল। তখন নিদর্শনগুলো ছিল সতেজ। এখন হয়েছে বন্ধ্যা, অশ্রুত-বিশ্রুত। একাত্তরে চট্রগ্রামের ফ’য়স লেক, সাতক্ষীরার চুকনগর, পাবনার ডেমরা, নগরবাড়ী ঘাট, সুজানগরসহ ২৩টি স্পটে, রংপুরের পলাশবাড়ী, কুষ্টিয়ার বিত্তিপাড়া, নরসিংদীর ভৈরব বাজার, ঢাকার শিয়ালবাড়ী, জানা-অজানা এমন আরও কত হাজারো বধ্যভূমিতে কত মানুষের জীবন প্রদীপ নিভে গেছে কেউ তার হিসাব করেনি। একাত্তরের বাংলাদেশে দীর্ঘ নয় মাস নদ-নদীতে ভেসে গেছে লাশের মিছিল বিরামহীনভাবে। কিছু অকৃতজ্ঞ অমানুষের আত্ম-সন্তুষ্টির জন্য তা-ও কি অস্বীকার করতে হবে? ভাবতে অবাক লাগে, শহীদদের আত্মত্যাগের উপকারভোগী এই দেশের কিছু অমানুষ তাদের সংখ্যা নিয়েও বিতর্ক তুলছে। সংখ্যাটা ৩ লাখ বা ৩০ লাখ হলে কার কি সুবিধা অথবা অসুবিধা হয়? আর সেজন্য ইতিহাসের প্রমাণিত সত্য অস্বীকার করতে হবে? এখন স্কুলের পাঠ্যবইতেও একাত্তরের শহীদরা হলেন সংখ্যায় অনির্ধারিত, যেন এলিয়েন দঙ্গল! এইটা আসলে কোন দেশ, কাদের দেশ?
[লেখক: মুক্তিযোদ্ধা, প্রবন্ধকার]