কাজী সালমান শীশ
(গতকালের পর)
পৃথিবীর বিশাল সংখ্যক মানুষ মাদকাসক্ত। কোকেন, হেরোইন, এলএসডি, মরফিনের মতো মরণঘাতী নেশায় যারা অভ্যস্ত তাদের পরিণিতি হয় ভয়াবহ বলার অপেক্ষা রাখে না। মাদক সেবন না করলে তারা স্বাভাবিক থাকতে পারে না, আর সেবন করলে ভিন্ন জগতের বাসিন্দা হয়ে যায়। পার্থিব দুঃখ, কষ্ট, যন্ত্রণা থেকে সাময়িক দূরে থাকার জন্য মাদকদ্রব্য মারাত্মকভাবে কাজ করে। নেশা করার সময় মানুষ অদ্ভুত প্রশান্তির মধ্যে ঢুকে যায়, আর যখন এর প্রভাব কেটে যায় তখন যন্ত্রণাগুলো বহুগুণে ফিরে আসে। এভাবে করেই চলতে থাকে বছরের পর বছর, কারো জন্য সারাজীবন।
মাদক কেনার অর্থ জোগান দেয়ার জন্য সমাজে বাড়তে থাকে অপরাধ। চুরি, ছিনতাই, লুট, চোরাচালান, পতিতাবৃত্তি থেকে শুরু করে আত্মহত্যা, খুন... সকল অরাজগতা বৃদ্ধির একটা বড় কারণ মাদক। যারা নেশায় আসক্ত সহজে তাদের মুক্তি নেই। কোকেন পাউডারকে ‘গড’ বলে মানে এমন লোকের সংখ্যাও প্রচুর।
আরো অনেক মাদকদ্রব্য রয়েছে যেমন- গাঁজা, চ-ু, চরস, অ্যালকোহল ইত্যাদি। এই নেশাগুলোকে আবার সমাজ একভাবে স্বীকৃতি দিয়ে থাকে। স্বল্প পরিমাণে গাঁজা বা মদ মানুষের মতিভ্রম ঘটায় না। বহু সামাজিক মানুষ আছে যারা পরিমিত পরিমাণে সেগুলো সেবন করে এবং সুস্থ থাকে। আর অতিরিক্ত গ্রহণ করার জন্য তো সমস্যা সৃষ্টি হয়ই। পরিসংখ্যান বলে সারাবিশ্বে পরিবার ও মানুষে মানুষে অনেক বেশি গ-গোল হয় মদ্যপানের কারণে। কিছু রাষ্ট্র বাদ দিয়ে গোটা বিশ্বেই মদ বৈধ। কোকেন, হেরোইনের মত অ্যালকোহল শরীর ও মস্তিষ্কের ভীষণ ক্ষতি না করলেও একে খাটো করে দেখার উপায় নেই। ভাষায় প্রকাশের জন্য কোনোটাকে ‘হাই নেশা’, কোনোটাকে ‘নরমাল নেশা’ বলা হলেও, মাদক যে কোথা দিয়ে এসে ক্ষতি করে চলে যাবে- তা আগে থেকে কেউ জানে না। প্রতিবছর প্রচুর গাড়ি দুর্ঘটনা ঘটে অ্যালকোহলের কারণে। বিষয়টা হল নির্ভরশীলতা। মাদকদ্রব্যের ওপর নির্ভরশীল যারা তাদের মাদক গ্রহণ করতেই হয়। কোনো কিছুর ওপর নির্ভরশীল হয়ে যাওয়ার অর্থই বাঁধনে আটকে যাওয়া, আর মাদক শেষ অবধি মরণঘাতী। রক্তের সাথে মিশে একটা শঙ্খলে মাদক মানুষকে বন্দি করে ফেলে। হতে পারে সেটা সামান্য ঘুমের ওষুধ। মানুষ ছাড়া অন্য কোনো প্রাণী মাদকের নেশায় আটকা পড়ে কিনা আমার জানা নেই। হয়ত কিছু বিষাক্ত গাছের পাতা থেকে নিঃসৃত গন্ধে নেশার উদ্রেক ঘটায়। মানুষও সম্ভবত প্রথম নেশার দ্রব্য খুঁজে পায় সরাসরি প্রকৃতি থেকে। ল্যাবরোটারিতে ফুল, ফল, শস্য থেকে কৃত্রিম পদ্ধতিতে নেশাজাতদ্রব্য উৎপাদন করার প্রক্রিয়া অপেক্ষাকৃত নতুন। মানুষের জীবনে বিশৃংখলা ও অশান্তি সৃষ্টির জন্য অনেক রাষ্ট্র (আন্ডারগ্রাউন্ডে অবস্থান নিয়ে) তাদের সাধারণ জনগণের মধ্যে মাদক ছড়িয়ে দিয়ে থাকে।
জনতাকে নেশায় আচ্ছন্ন করে রাখতে পারলে রাজনীতি ও ব্যবসা দু’টির জন্যই সুবিধা। সমষ্টিগত মানুষকে মাদকে অভ্যস্ত করিয়ে সমাজকে নিয়ন্ত্রণ করে মুষ্টিমেয় ক্ষমতাধর কিছু মহল। যুগ যুগ ধরে এমনটাই হয়ে আসছে। পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থা অর্থনৈতিক লাভের জন্য সকল কিছু করতে প্রস্তুত- বিষয়টা আমাদের সকলেরই কমবেশি জানা।
৭
গত শতাব্দীর খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা যন্ত্র ছিল রেডিও। মানুষ বিভিন্ন বার্তা, খবর ও সমসাময়িক তথ্য পেত রেডিওর মাধ্যমে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় রেডিও-র ইতিবাচক ও নেতিবাচক ভূমিকা বলে শেষ করার নয়। সতর্কবাণী, নির্দেশনা, বিবৃতি, গণসঙ্গীত থেকে শুরু করে বিনোদনমূলক অনুষ্ঠান, অর্থাৎ যা শ্রবণ করা যায় এমন বহুকিছু মানুষের কাছে পৌঁছাত রেডিওর মাধ্যমে। এরপর আসলো টেলিভিশন- যেখানে মানুষ পেল ছবি ও শব্দ একসাথে। বর্তমান সময়ে এসকল কিছু দখল করে নিয়েছে ইন্টারনেট। কম্পিউটার বা মোবাইল দিয়ে মানুষ ঢুকে গেল স্যাটেলাইটে সংগ্রহ করা তথ্যের ভা-ারে। প্রাথমিকভাবে মনে হতে পারে যে ‘বিশ্ব আজ আমাদের হাতের মুঠোয়’, কিন্তু বিষয়গুলোকে এত সহজ করে দেখার জায়গা নেই।
ইন্টারনেটের হাজারো ব্যবহারের কথা বাদ দিয়ে শুধু একে খবর/তথ্য সংগ্রহ ও যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে ধরা যাক। ইন্টারনেটের লাখ লাখ লাইব্রেরির মধ্যে কিছু সংখ্যক ওয়েবসাইটের তথ্য মোটামুটি নিরপেক্ষ। নির্ভরযোগ্য সাইটগুলো সম্পর্কে জানতেও একটা পর্যায়ের শিক্ষিত ও অভিজ্ঞ হতে হয়, সুতরাং ধরে নেয়া যায় তা সর্বসাধারণের জন্য নয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে সংবাদকে আকর্ষণীয় করার জন্য সেগুলোর মধ্যে ঢুকিয়ে দেয়া হয় নানা মুখরোচক উপাদান। ফলে তা সত্যের জায়গা থেকে সরে আসে এবং বিকৃত বার্তা বহন করে। সাধারণ জনমন ধীরে ধীরে সেসব অতিরঞ্জিত খবরে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। রাজনৈতিক আদর্শ, ধর্ম, সংস্কৃতি ও জাতিগোষ্ঠী সম্পর্কে অপপ্রচার ছড়িয়ে পড়ছে ব্যাপক আকারে, দ্রুতগতিতে। মিথ্যা ব্যাপারগুলোর টেকসই কম হওয়ায় মানবীয় মূল্যবোধগুলো স্বাভাবিকভাবেই ঠুনকো হয়ে পড়ছে। চোখের সামনে দেখা যাচ্ছে নতুন প্রজন্মকে ক্ষয়ে যেতে, অথচ কিছুই করা যাচ্ছে না। শিশু-কিশোর-যুবকদের বিকৃত রুচির মানুষে পরিণত করছে প্রবাহমান প্রযুক্তি ও আধুনিক যন্ত্রাদী।
ইন্টারনেটের মাধ্যমে পৃথিবীর যে কোনো প্রান্ত থেকে মানুষ একে-অপরের সাথে যোগাযোগ করতে পারছে। ভাবের আদান-প্রদান যে সফটওয়ার বা অ্যাপের মাধ্যমে হচ্ছে, সেই সকল কোম্পানিকে মানুষ (আমরা) অবলীলায় নিজেদের চিন্তা, চেতনা, রুচি ও জ্ঞানের অংশগুলো শেয়ার করে রাখছে। কোম্পানির ডিভাইসে জমা থাকছে সকল তথ্য। ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলতেও মোবাইল নাম্বার ও ইমেইল অ্যাড্রেসের প্রয়োজন পড়ে। সুতরাং আর্থিক হিসাব সংক্রান্ত তথ্যগুলোও জানা থাকছে নির্দিষ্ট ইমেইল কোম্পানির কাছে। মানুষ কোথায় যাচ্ছে, কি করছে, কার কত টাকা আছে, কে কাকে ভালোবাসে, কিসে বিশ্বাস করে- সমস্ত কিছুই ইন্টারনেটের চেইনের কাছে বাঁধা। দাসদের মত শিকল দিয়ে বেঁধে না রাখলেও, আমাদের মস্তিষ্ক বন্দী উন্নত প্রযুক্তির একাধিক কোম্পানির কাছে।
৮
সংসার মানুষকে শৃঙ্খলে আবদ্ধ রাখে। ভালোবাসা, মমতা, মায়া, আনন্দ, বেদনা, তিক্ততা ও ঘৃণা সবকিছুই থাকে সংসার জীবনে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই একজন মানব ও একজন মানবীর মধ্যে বিবাহসূত্রে সংসারের গোড়াপত্তন হয়। এরপর সংসারে আসে এক বা একাধিক সন্তান। সারাজীবন এদের দায়িত্ব নিয়ে বেঁচে থাকে একক পরিবারের মানুষেরা। পাশাপাশি আদিযুগে থেকে এখন পর্যন্ত যৌথ পরিবারও টিকে আছে। যৌথ পরিবারে স্বামী, স্ত্রী, পুত্র, কন্যার বাইরেও থাকে তাদের বাবা-মা, দাদা-দাদি, নানা-নানি, অবিবাহিত চাচা, বেকার মামা এরকম বেশকিছু সদস্য। ভৌগোলিক অবস্থান, জাতি ও কাল ভেদে আরো বহুরকম বিবাহপ্রথা ও বিচ্ছেদরীতি রয়েছে, তবে সেসমস্ত বিষয় এই লেখার আলোচ্য বিষয় নয়।
সংসারের মূল অর্থই হল নির্ভরশীলতা। একে অপরের প্রতি নির্ভরশীল হলে স্বাধীনতা খর্ব হবেই। মানুষ খুবই বুদ্ধিমান এবং বিচিত্র প্রাণী। পাত্র ও পাত্রী দুইজনেরই পৃথক ব্যক্তিত্ব, রুচি, কামনা থাকে। মানবীয় সম্পর্ক গাণিতিক হিসাবে চলে না, তাই ছেলেমেয়ে দুইজনকেই আপস করতে হয়। এই ত্যাগ বা আপসের মধ্যেও রোমান্টিসিজম রয়েছে। একজন আরেকজনের চিন্তায় গভীরভাবে প্রভাব বিস্তার করে এবং একসাথে থাকে। দীর্ঘদিনের বসবাস ও সহবাসের পর একজন আরেকজনের চেতনা ও ভাবনা বেশ খানিকটা বুঝতে পারে এবং জীবনকে এগিয়ে নিয়ে যায়। বন্ধনের বিষয়টা জেনেই মানুষ সন্তান গ্রহণ করে, যদিও বাস্তবে সংসারে প্রবেশ করার আগ পর্যন্ত তা ভালো বোঝা যায় না। অনেক লোহার মত শক্ত পুরুষ বা নারী বিয়ের পর যেমন নরম হয়ে যায়, আবার অতিদুর্বল মানুষকেও দেখা যায় শক্ত হাতে জীবন সামলাতে। গোত্র বেঁধে আলাদা সংসার করার তথ্য কিছু কিছু পাখি, মাছ ও স্তন্যপায়ী প্রাণীর মধ্যেও দেখা গেলেও তা মানুষের মত অবশ্যই নয়। জৈবিক ও অন্যান্য মৌলিক চাহিদা পূরণ ব্যতীতও বহু খুঁটিনাটি মানবিক বিষয় থাকে সংসারে- যা মানুষের মত জটিল প্রাণী ছাড়া অন্যদের মধ্যে থাকা সম্ভবপর না। কি জানি হয়ত সম্ভব! আমাদের ক্ষুদ্র জ্ঞান আর কতটুকু জানে।
প্রত্যেকটা মানুষের কিছু জন্মগত চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য রয়েছে। সমাজে টিকে থাকার জন্য স্বভাবে কিছু কিছু পরিবর্তন আনতেই হয়। কর্মস্থলে ভালো না লাগলেও মানুষকে হাসিমুখে কথা বলতে হয় পেটের দায়ে বা সামাজিক মর্যাদা অক্ষুণœ রাখতে। সব কাজ শেষ করে একসময় সাংসারিক মানুষ ঘরে ফিরে আসে, বাচ্চাদের খাওয়ায়, ঘুম পাড়ায়, নিজেদের মধ্যে শারীরিক সম্পর্ক করে, ঘুমাতে যায়... মোটকথা এই বৃত্তেই চলতে থাকে জীবন। একেকটা সমস্যা আসে, সেগুলোকে মোকাবেলা করে আবার এগিয়ে যেতে হয়। অনেক ক্ষেত্রে সেই সংসার ভাঙ্গে, আবার নতুন করে গড়ে... রয়ে যায় স্মৃতি, গ্লানি ও বংশধর। প্রাচীন এই মানব-বন্ধন প্রক্রিয়া এখনো টিকে আছে কারণ এর বিকল্প ভালো কোনো পদ্ধতি বের হয়নি। সংসার মানে ঘর। সেই ঘরে মানুষ তার আশ্রয় খুঁজে পায়, নিরাপদ অনুভব করে। অবিবাহিত হোক আর বিবাহিত– মানুষের সঙ্গী লাগেই। পুরোপুরি একক, নিঃসঙ্গ ও স্বাধীন প্রাণী হলে বহু আগেই মানুষ নিশ্চিহ্ন হয়ে যেত। সীমারেখা টেনে, শঙ্খলে আবদ্ধ হয়ে সংসারধর্ম পালন করা মানুষের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার স্বার্থেই জরুরি।
৯
সমাজ, সভ্যতা, পরিবার এককথায় মানুষের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য যৌন সম্পর্কের বিকল্প নেই। তবে সন্তান উৎপাদনই যৌনতার একমাত্র কাজ নয়। মানব-মানবী সঙ্গম করে স্বর্গীয় আনন্দ পায়- সৃষ্টির শুরু থেকে আজ পর্যন্ত। অন্যান্য প্রাণীরাও নিশ্চয়ই পায়, তবে তাদের যৌনতার সাথে মানুষের মানসিক ও সামাজিক পার্থক্য বিপুল। বিপরীত বা সমলিঙ্গের একে অপরকে কামনা করার ব্যাপার যেহেতু রয়েছে, সেকারণে মানুষে মানুষে হিংসা, বিদ্বেষ, রাগ ও আত্মসম্মানের মতো জটিল মানসিক ক্রিয়া কামবাসনার সাথে জড়িত। অন্যান্য প্রাণীদের মত ঘুরে ঘুরে, সংসার না করে, ধর্ম না মেনে যৌন সম্পর্ক অধিকাংশ সমাজ মেনে নেয় না। ফলে আবেগের নেতিবাচক দিকগুলো নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য মানুষকে যেতে হয় বিভিন্ন বিধিনিষেধের মধ্য দিয়ে। বিয়ে করে অধিকাংশ মানুষ লিখিতভাবে একসাথে থাকার স্বীকৃতি পায়। অনেকে লিভ-টুগেদার করে একসাথে থাকে, তবে সেখানেও মৌখিক কিছু বোঝাপড়া থাকেই। পাশাপাশি রয়েছে অভিসার। বিবাহিত বা অবিবাহিত নারী-পুরুষ অনেক ক্ষেত্রেই অভিসারের আশ্রয় নেয়, অর্থাৎ তারা পরিবার ও সমাজের কাছ থেকে লুকিয়ে, নিজেদের মত করে একসাথে থাকে। বৈধতা দিয়েই হোক বা না হোক যৌনতার কারণে সৃষ্ট দায়বদ্ধতা এড়ানোর কোনো রাস্তা নেই।
বিশ্বে সমকামী মানসিকতার নারী-পুরুষ উভয়ের সংখ্যাই প্রচুর, যদিও খুব কম সংখ্যক সমাজেই এর স্বীকৃতি রয়েছে। প্রাতিষ্ঠানিক পুস্তক, সামাজিক বয়ান ও ধর্মশিক্ষা থেকে শিশুরা মনে করে- সমকামিতা এক প্রকার অন্যায় কাজ ও অস্বাভাবিকতার লক্ষণ। বেশিরভাগ মানুষই জানে না যে তারা সমলিঙ্গের প্রতি আদৌ আকর্ষণ বোধ করে, নাকি করে না! অস্পষ্ট এই নিষিদ্ধতা ভেঙ্গে অনেকেই বন্ধুর মতো থাকে, সহবাস করে, তবে তারা সমাজে স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারে না। অথচ জৈবিকভাবে সকলের মধ্যেই সমলিঙ্গের প্রতি সামান্য হলেও আকর্ষণ থাকার কথা। বৃহন্নলা (উভলিঙ্গ) হলে তো কথাই নেই। তৃতীয় বিশ্বের অধিকাংশ দেশে বৃহন্নলারা গোত্র বেঁধে থাকে, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা সেভাবে নিতে পারে না, ভালো কোনো কাজ পায় না, এমনকি মারা যাওয়ার পর সমাধিস্থ করতেও লোকজন ঘৃণা পোষণ করে। যে সকল বাবা-মায়ের ঘরে বৃহন্নলা জন্মায় তাদের জীবন অভিশপ্ত হয়ে ওঠে। মানুষ হয়ে জন্মেও আমরা অন্য মানুষকে ঘৃণা করি! বৃহন্নলাদের সাথে অনেকেই বিকৃত যৌনাচার ও বিভিন্ন রকম অনাচার করে থাকে। বৃহন্নলা জন্মায় শারীরিক সীমাবদ্ধতা নিয়ে, তার ওপর নোংরামীর প্রলেপ ঢেলে আরো সংকীর্ণ অবস্থায় নিয়ে যায় সমাজের কিছু মানুষ। কতটা নিকৃষ্ট ও সীমাবদ্ধ মানসিকতা থাকলে মানুষ তার স্বজাতির দুর্বল দিক নিয়ে উপহাস করতে পারে! বর্বর আচরণ করতে পারে!
পরিশেষ : শৃঙ্খলে আবদ্ধ সামাজিক মানুষ নিয়ে আমার আর বিশেষ কিছু ব্যক্ত করার নেই। এই দীর্ঘ, শ্লথ ও সাদামাটা লেখাটা মানুষের বন্দীত্ব ঘোচাতে সরাসরি কোনো কাজে আসবে না নিশ্চিত, তবে কেউ যদি
বিষয়গুলো নিয়ে চিন্তা করে, আরো গভীরে ঢুকে, তাহলে হয়ত প্রকৃত মুক্তির পথে কিছুটা হলেও এগিয়ে যেতে পারবে। মনকে শৃঙ্খল মুক্ত রেখে, চিন্তার খোরাক ধরিয়ে দেয়াই খ- খ- রচনাটির প্রধান উদ্দেশ্য। অন্ধকারে ঢেকে থাকা লেখাটির বিভিন্ন অংশ ভেদ করলে হয়ত দেখা মিলতে পারে ক্ষুদ্র কিছু আলোকিত দর্শনের।
[লেখক : চিত্রকর ও চলচ্চিত্র শিক্ষক]
কাজী সালমান শীশ
মঙ্গলবার, ১৪ জানুয়ারী ২০২৫
(গতকালের পর)
পৃথিবীর বিশাল সংখ্যক মানুষ মাদকাসক্ত। কোকেন, হেরোইন, এলএসডি, মরফিনের মতো মরণঘাতী নেশায় যারা অভ্যস্ত তাদের পরিণিতি হয় ভয়াবহ বলার অপেক্ষা রাখে না। মাদক সেবন না করলে তারা স্বাভাবিক থাকতে পারে না, আর সেবন করলে ভিন্ন জগতের বাসিন্দা হয়ে যায়। পার্থিব দুঃখ, কষ্ট, যন্ত্রণা থেকে সাময়িক দূরে থাকার জন্য মাদকদ্রব্য মারাত্মকভাবে কাজ করে। নেশা করার সময় মানুষ অদ্ভুত প্রশান্তির মধ্যে ঢুকে যায়, আর যখন এর প্রভাব কেটে যায় তখন যন্ত্রণাগুলো বহুগুণে ফিরে আসে। এভাবে করেই চলতে থাকে বছরের পর বছর, কারো জন্য সারাজীবন।
মাদক কেনার অর্থ জোগান দেয়ার জন্য সমাজে বাড়তে থাকে অপরাধ। চুরি, ছিনতাই, লুট, চোরাচালান, পতিতাবৃত্তি থেকে শুরু করে আত্মহত্যা, খুন... সকল অরাজগতা বৃদ্ধির একটা বড় কারণ মাদক। যারা নেশায় আসক্ত সহজে তাদের মুক্তি নেই। কোকেন পাউডারকে ‘গড’ বলে মানে এমন লোকের সংখ্যাও প্রচুর।
আরো অনেক মাদকদ্রব্য রয়েছে যেমন- গাঁজা, চ-ু, চরস, অ্যালকোহল ইত্যাদি। এই নেশাগুলোকে আবার সমাজ একভাবে স্বীকৃতি দিয়ে থাকে। স্বল্প পরিমাণে গাঁজা বা মদ মানুষের মতিভ্রম ঘটায় না। বহু সামাজিক মানুষ আছে যারা পরিমিত পরিমাণে সেগুলো সেবন করে এবং সুস্থ থাকে। আর অতিরিক্ত গ্রহণ করার জন্য তো সমস্যা সৃষ্টি হয়ই। পরিসংখ্যান বলে সারাবিশ্বে পরিবার ও মানুষে মানুষে অনেক বেশি গ-গোল হয় মদ্যপানের কারণে। কিছু রাষ্ট্র বাদ দিয়ে গোটা বিশ্বেই মদ বৈধ। কোকেন, হেরোইনের মত অ্যালকোহল শরীর ও মস্তিষ্কের ভীষণ ক্ষতি না করলেও একে খাটো করে দেখার উপায় নেই। ভাষায় প্রকাশের জন্য কোনোটাকে ‘হাই নেশা’, কোনোটাকে ‘নরমাল নেশা’ বলা হলেও, মাদক যে কোথা দিয়ে এসে ক্ষতি করে চলে যাবে- তা আগে থেকে কেউ জানে না। প্রতিবছর প্রচুর গাড়ি দুর্ঘটনা ঘটে অ্যালকোহলের কারণে। বিষয়টা হল নির্ভরশীলতা। মাদকদ্রব্যের ওপর নির্ভরশীল যারা তাদের মাদক গ্রহণ করতেই হয়। কোনো কিছুর ওপর নির্ভরশীল হয়ে যাওয়ার অর্থই বাঁধনে আটকে যাওয়া, আর মাদক শেষ অবধি মরণঘাতী। রক্তের সাথে মিশে একটা শঙ্খলে মাদক মানুষকে বন্দি করে ফেলে। হতে পারে সেটা সামান্য ঘুমের ওষুধ। মানুষ ছাড়া অন্য কোনো প্রাণী মাদকের নেশায় আটকা পড়ে কিনা আমার জানা নেই। হয়ত কিছু বিষাক্ত গাছের পাতা থেকে নিঃসৃত গন্ধে নেশার উদ্রেক ঘটায়। মানুষও সম্ভবত প্রথম নেশার দ্রব্য খুঁজে পায় সরাসরি প্রকৃতি থেকে। ল্যাবরোটারিতে ফুল, ফল, শস্য থেকে কৃত্রিম পদ্ধতিতে নেশাজাতদ্রব্য উৎপাদন করার প্রক্রিয়া অপেক্ষাকৃত নতুন। মানুষের জীবনে বিশৃংখলা ও অশান্তি সৃষ্টির জন্য অনেক রাষ্ট্র (আন্ডারগ্রাউন্ডে অবস্থান নিয়ে) তাদের সাধারণ জনগণের মধ্যে মাদক ছড়িয়ে দিয়ে থাকে।
জনতাকে নেশায় আচ্ছন্ন করে রাখতে পারলে রাজনীতি ও ব্যবসা দু’টির জন্যই সুবিধা। সমষ্টিগত মানুষকে মাদকে অভ্যস্ত করিয়ে সমাজকে নিয়ন্ত্রণ করে মুষ্টিমেয় ক্ষমতাধর কিছু মহল। যুগ যুগ ধরে এমনটাই হয়ে আসছে। পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থা অর্থনৈতিক লাভের জন্য সকল কিছু করতে প্রস্তুত- বিষয়টা আমাদের সকলেরই কমবেশি জানা।
৭
গত শতাব্দীর খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা যন্ত্র ছিল রেডিও। মানুষ বিভিন্ন বার্তা, খবর ও সমসাময়িক তথ্য পেত রেডিওর মাধ্যমে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় রেডিও-র ইতিবাচক ও নেতিবাচক ভূমিকা বলে শেষ করার নয়। সতর্কবাণী, নির্দেশনা, বিবৃতি, গণসঙ্গীত থেকে শুরু করে বিনোদনমূলক অনুষ্ঠান, অর্থাৎ যা শ্রবণ করা যায় এমন বহুকিছু মানুষের কাছে পৌঁছাত রেডিওর মাধ্যমে। এরপর আসলো টেলিভিশন- যেখানে মানুষ পেল ছবি ও শব্দ একসাথে। বর্তমান সময়ে এসকল কিছু দখল করে নিয়েছে ইন্টারনেট। কম্পিউটার বা মোবাইল দিয়ে মানুষ ঢুকে গেল স্যাটেলাইটে সংগ্রহ করা তথ্যের ভা-ারে। প্রাথমিকভাবে মনে হতে পারে যে ‘বিশ্ব আজ আমাদের হাতের মুঠোয়’, কিন্তু বিষয়গুলোকে এত সহজ করে দেখার জায়গা নেই।
ইন্টারনেটের হাজারো ব্যবহারের কথা বাদ দিয়ে শুধু একে খবর/তথ্য সংগ্রহ ও যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে ধরা যাক। ইন্টারনেটের লাখ লাখ লাইব্রেরির মধ্যে কিছু সংখ্যক ওয়েবসাইটের তথ্য মোটামুটি নিরপেক্ষ। নির্ভরযোগ্য সাইটগুলো সম্পর্কে জানতেও একটা পর্যায়ের শিক্ষিত ও অভিজ্ঞ হতে হয়, সুতরাং ধরে নেয়া যায় তা সর্বসাধারণের জন্য নয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে সংবাদকে আকর্ষণীয় করার জন্য সেগুলোর মধ্যে ঢুকিয়ে দেয়া হয় নানা মুখরোচক উপাদান। ফলে তা সত্যের জায়গা থেকে সরে আসে এবং বিকৃত বার্তা বহন করে। সাধারণ জনমন ধীরে ধীরে সেসব অতিরঞ্জিত খবরে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। রাজনৈতিক আদর্শ, ধর্ম, সংস্কৃতি ও জাতিগোষ্ঠী সম্পর্কে অপপ্রচার ছড়িয়ে পড়ছে ব্যাপক আকারে, দ্রুতগতিতে। মিথ্যা ব্যাপারগুলোর টেকসই কম হওয়ায় মানবীয় মূল্যবোধগুলো স্বাভাবিকভাবেই ঠুনকো হয়ে পড়ছে। চোখের সামনে দেখা যাচ্ছে নতুন প্রজন্মকে ক্ষয়ে যেতে, অথচ কিছুই করা যাচ্ছে না। শিশু-কিশোর-যুবকদের বিকৃত রুচির মানুষে পরিণত করছে প্রবাহমান প্রযুক্তি ও আধুনিক যন্ত্রাদী।
ইন্টারনেটের মাধ্যমে পৃথিবীর যে কোনো প্রান্ত থেকে মানুষ একে-অপরের সাথে যোগাযোগ করতে পারছে। ভাবের আদান-প্রদান যে সফটওয়ার বা অ্যাপের মাধ্যমে হচ্ছে, সেই সকল কোম্পানিকে মানুষ (আমরা) অবলীলায় নিজেদের চিন্তা, চেতনা, রুচি ও জ্ঞানের অংশগুলো শেয়ার করে রাখছে। কোম্পানির ডিভাইসে জমা থাকছে সকল তথ্য। ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলতেও মোবাইল নাম্বার ও ইমেইল অ্যাড্রেসের প্রয়োজন পড়ে। সুতরাং আর্থিক হিসাব সংক্রান্ত তথ্যগুলোও জানা থাকছে নির্দিষ্ট ইমেইল কোম্পানির কাছে। মানুষ কোথায় যাচ্ছে, কি করছে, কার কত টাকা আছে, কে কাকে ভালোবাসে, কিসে বিশ্বাস করে- সমস্ত কিছুই ইন্টারনেটের চেইনের কাছে বাঁধা। দাসদের মত শিকল দিয়ে বেঁধে না রাখলেও, আমাদের মস্তিষ্ক বন্দী উন্নত প্রযুক্তির একাধিক কোম্পানির কাছে।
৮
সংসার মানুষকে শৃঙ্খলে আবদ্ধ রাখে। ভালোবাসা, মমতা, মায়া, আনন্দ, বেদনা, তিক্ততা ও ঘৃণা সবকিছুই থাকে সংসার জীবনে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই একজন মানব ও একজন মানবীর মধ্যে বিবাহসূত্রে সংসারের গোড়াপত্তন হয়। এরপর সংসারে আসে এক বা একাধিক সন্তান। সারাজীবন এদের দায়িত্ব নিয়ে বেঁচে থাকে একক পরিবারের মানুষেরা। পাশাপাশি আদিযুগে থেকে এখন পর্যন্ত যৌথ পরিবারও টিকে আছে। যৌথ পরিবারে স্বামী, স্ত্রী, পুত্র, কন্যার বাইরেও থাকে তাদের বাবা-মা, দাদা-দাদি, নানা-নানি, অবিবাহিত চাচা, বেকার মামা এরকম বেশকিছু সদস্য। ভৌগোলিক অবস্থান, জাতি ও কাল ভেদে আরো বহুরকম বিবাহপ্রথা ও বিচ্ছেদরীতি রয়েছে, তবে সেসমস্ত বিষয় এই লেখার আলোচ্য বিষয় নয়।
সংসারের মূল অর্থই হল নির্ভরশীলতা। একে অপরের প্রতি নির্ভরশীল হলে স্বাধীনতা খর্ব হবেই। মানুষ খুবই বুদ্ধিমান এবং বিচিত্র প্রাণী। পাত্র ও পাত্রী দুইজনেরই পৃথক ব্যক্তিত্ব, রুচি, কামনা থাকে। মানবীয় সম্পর্ক গাণিতিক হিসাবে চলে না, তাই ছেলেমেয়ে দুইজনকেই আপস করতে হয়। এই ত্যাগ বা আপসের মধ্যেও রোমান্টিসিজম রয়েছে। একজন আরেকজনের চিন্তায় গভীরভাবে প্রভাব বিস্তার করে এবং একসাথে থাকে। দীর্ঘদিনের বসবাস ও সহবাসের পর একজন আরেকজনের চেতনা ও ভাবনা বেশ খানিকটা বুঝতে পারে এবং জীবনকে এগিয়ে নিয়ে যায়। বন্ধনের বিষয়টা জেনেই মানুষ সন্তান গ্রহণ করে, যদিও বাস্তবে সংসারে প্রবেশ করার আগ পর্যন্ত তা ভালো বোঝা যায় না। অনেক লোহার মত শক্ত পুরুষ বা নারী বিয়ের পর যেমন নরম হয়ে যায়, আবার অতিদুর্বল মানুষকেও দেখা যায় শক্ত হাতে জীবন সামলাতে। গোত্র বেঁধে আলাদা সংসার করার তথ্য কিছু কিছু পাখি, মাছ ও স্তন্যপায়ী প্রাণীর মধ্যেও দেখা গেলেও তা মানুষের মত অবশ্যই নয়। জৈবিক ও অন্যান্য মৌলিক চাহিদা পূরণ ব্যতীতও বহু খুঁটিনাটি মানবিক বিষয় থাকে সংসারে- যা মানুষের মত জটিল প্রাণী ছাড়া অন্যদের মধ্যে থাকা সম্ভবপর না। কি জানি হয়ত সম্ভব! আমাদের ক্ষুদ্র জ্ঞান আর কতটুকু জানে।
প্রত্যেকটা মানুষের কিছু জন্মগত চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য রয়েছে। সমাজে টিকে থাকার জন্য স্বভাবে কিছু কিছু পরিবর্তন আনতেই হয়। কর্মস্থলে ভালো না লাগলেও মানুষকে হাসিমুখে কথা বলতে হয় পেটের দায়ে বা সামাজিক মর্যাদা অক্ষুণœ রাখতে। সব কাজ শেষ করে একসময় সাংসারিক মানুষ ঘরে ফিরে আসে, বাচ্চাদের খাওয়ায়, ঘুম পাড়ায়, নিজেদের মধ্যে শারীরিক সম্পর্ক করে, ঘুমাতে যায়... মোটকথা এই বৃত্তেই চলতে থাকে জীবন। একেকটা সমস্যা আসে, সেগুলোকে মোকাবেলা করে আবার এগিয়ে যেতে হয়। অনেক ক্ষেত্রে সেই সংসার ভাঙ্গে, আবার নতুন করে গড়ে... রয়ে যায় স্মৃতি, গ্লানি ও বংশধর। প্রাচীন এই মানব-বন্ধন প্রক্রিয়া এখনো টিকে আছে কারণ এর বিকল্প ভালো কোনো পদ্ধতি বের হয়নি। সংসার মানে ঘর। সেই ঘরে মানুষ তার আশ্রয় খুঁজে পায়, নিরাপদ অনুভব করে। অবিবাহিত হোক আর বিবাহিত– মানুষের সঙ্গী লাগেই। পুরোপুরি একক, নিঃসঙ্গ ও স্বাধীন প্রাণী হলে বহু আগেই মানুষ নিশ্চিহ্ন হয়ে যেত। সীমারেখা টেনে, শঙ্খলে আবদ্ধ হয়ে সংসারধর্ম পালন করা মানুষের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার স্বার্থেই জরুরি।
৯
সমাজ, সভ্যতা, পরিবার এককথায় মানুষের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য যৌন সম্পর্কের বিকল্প নেই। তবে সন্তান উৎপাদনই যৌনতার একমাত্র কাজ নয়। মানব-মানবী সঙ্গম করে স্বর্গীয় আনন্দ পায়- সৃষ্টির শুরু থেকে আজ পর্যন্ত। অন্যান্য প্রাণীরাও নিশ্চয়ই পায়, তবে তাদের যৌনতার সাথে মানুষের মানসিক ও সামাজিক পার্থক্য বিপুল। বিপরীত বা সমলিঙ্গের একে অপরকে কামনা করার ব্যাপার যেহেতু রয়েছে, সেকারণে মানুষে মানুষে হিংসা, বিদ্বেষ, রাগ ও আত্মসম্মানের মতো জটিল মানসিক ক্রিয়া কামবাসনার সাথে জড়িত। অন্যান্য প্রাণীদের মত ঘুরে ঘুরে, সংসার না করে, ধর্ম না মেনে যৌন সম্পর্ক অধিকাংশ সমাজ মেনে নেয় না। ফলে আবেগের নেতিবাচক দিকগুলো নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য মানুষকে যেতে হয় বিভিন্ন বিধিনিষেধের মধ্য দিয়ে। বিয়ে করে অধিকাংশ মানুষ লিখিতভাবে একসাথে থাকার স্বীকৃতি পায়। অনেকে লিভ-টুগেদার করে একসাথে থাকে, তবে সেখানেও মৌখিক কিছু বোঝাপড়া থাকেই। পাশাপাশি রয়েছে অভিসার। বিবাহিত বা অবিবাহিত নারী-পুরুষ অনেক ক্ষেত্রেই অভিসারের আশ্রয় নেয়, অর্থাৎ তারা পরিবার ও সমাজের কাছ থেকে লুকিয়ে, নিজেদের মত করে একসাথে থাকে। বৈধতা দিয়েই হোক বা না হোক যৌনতার কারণে সৃষ্ট দায়বদ্ধতা এড়ানোর কোনো রাস্তা নেই।
বিশ্বে সমকামী মানসিকতার নারী-পুরুষ উভয়ের সংখ্যাই প্রচুর, যদিও খুব কম সংখ্যক সমাজেই এর স্বীকৃতি রয়েছে। প্রাতিষ্ঠানিক পুস্তক, সামাজিক বয়ান ও ধর্মশিক্ষা থেকে শিশুরা মনে করে- সমকামিতা এক প্রকার অন্যায় কাজ ও অস্বাভাবিকতার লক্ষণ। বেশিরভাগ মানুষই জানে না যে তারা সমলিঙ্গের প্রতি আদৌ আকর্ষণ বোধ করে, নাকি করে না! অস্পষ্ট এই নিষিদ্ধতা ভেঙ্গে অনেকেই বন্ধুর মতো থাকে, সহবাস করে, তবে তারা সমাজে স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারে না। অথচ জৈবিকভাবে সকলের মধ্যেই সমলিঙ্গের প্রতি সামান্য হলেও আকর্ষণ থাকার কথা। বৃহন্নলা (উভলিঙ্গ) হলে তো কথাই নেই। তৃতীয় বিশ্বের অধিকাংশ দেশে বৃহন্নলারা গোত্র বেঁধে থাকে, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা সেভাবে নিতে পারে না, ভালো কোনো কাজ পায় না, এমনকি মারা যাওয়ার পর সমাধিস্থ করতেও লোকজন ঘৃণা পোষণ করে। যে সকল বাবা-মায়ের ঘরে বৃহন্নলা জন্মায় তাদের জীবন অভিশপ্ত হয়ে ওঠে। মানুষ হয়ে জন্মেও আমরা অন্য মানুষকে ঘৃণা করি! বৃহন্নলাদের সাথে অনেকেই বিকৃত যৌনাচার ও বিভিন্ন রকম অনাচার করে থাকে। বৃহন্নলা জন্মায় শারীরিক সীমাবদ্ধতা নিয়ে, তার ওপর নোংরামীর প্রলেপ ঢেলে আরো সংকীর্ণ অবস্থায় নিয়ে যায় সমাজের কিছু মানুষ। কতটা নিকৃষ্ট ও সীমাবদ্ধ মানসিকতা থাকলে মানুষ তার স্বজাতির দুর্বল দিক নিয়ে উপহাস করতে পারে! বর্বর আচরণ করতে পারে!
পরিশেষ : শৃঙ্খলে আবদ্ধ সামাজিক মানুষ নিয়ে আমার আর বিশেষ কিছু ব্যক্ত করার নেই। এই দীর্ঘ, শ্লথ ও সাদামাটা লেখাটা মানুষের বন্দীত্ব ঘোচাতে সরাসরি কোনো কাজে আসবে না নিশ্চিত, তবে কেউ যদি
বিষয়গুলো নিয়ে চিন্তা করে, আরো গভীরে ঢুকে, তাহলে হয়ত প্রকৃত মুক্তির পথে কিছুটা হলেও এগিয়ে যেতে পারবে। মনকে শৃঙ্খল মুক্ত রেখে, চিন্তার খোরাক ধরিয়ে দেয়াই খ- খ- রচনাটির প্রধান উদ্দেশ্য। অন্ধকারে ঢেকে থাকা লেখাটির বিভিন্ন অংশ ভেদ করলে হয়ত দেখা মিলতে পারে ক্ষুদ্র কিছু আলোকিত দর্শনের।
[লেখক : চিত্রকর ও চলচ্চিত্র শিক্ষক]