alt

উপ-সম্পাদকীয়

‘ভিলেজ পলিটিক্স’ ও সাধারণ গ্রামবাসী

সামসুল আলম

: শনিবার, ২৫ জানুয়ারী ২০২৫

দেশের সিংহভাগ মানুষ গ্রামে বসবাস করে। গ্রামের মানুষ যুগ থেকে যুগান্তরে একে অপরের সঙ্গে মেলবন্ধন আর সহমর্মিতা নিয়ে মিলেমিশে সহাবস্থান করে, যা সর্বমহলে প্রশংসিত। এ মেলবন্ধনের সুন্দর সেতুবন্দর তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে গ্রামের সম্মানীয় মাতব্বর শ্রেণী। তবে বর্তমান বাস্তবতায় এই মাতব্বর শ্রেণীর ভূমিকা কি গ্রামীণ সহজ-সরল মানুষের সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় আনুষঙ্গ হয়ে বিচারকার্য পরিচালনা করে সমাজের ভারসাম্য রক্ষা করছে?

বিভিন্ন বাস্তবতায় এ প্রশ্নের সহজ উত্তর হলো অতীতে এদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকলেও আজকের দিনে মোটেও ইতিবাচক

ভূমিকা পালন করছে না বরং আজকাল এই সম্মানীয় মাতব্বর শ্রেণী গ্রামের মানুষের কাছে এক কুৎসিত শ্রেণীতে রূপান্তরিত হয়েছে। বিশেষ করে বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমল থেকে গ্রাম্য রাজনীতি বা ভিলেজ পলিটিক্সের নেতিবাচক দিকগুলো আরো শক্তভাবে দেখা দিয়েছে যার ধারাবাহিকতা এখনো চলমান রয়েছে।

গ্রামীণ সমাজের নিকৃষ্ট থেকে নিকৃষ্টতর এক বাজ ওয়ার্ড হচ্ছে ‘ভিলেজ পলিটিক্স’ যার সূত্রপাত হয়েছে গ্রামের মাতব্বর শ্রেণী থেকে, যারা সালিশি ব্যবস্থার মাধ্যমে বিচারকার্য পরিচালনা করে থাকে। তাই ভিলেজ পলিটিক্স আর গ্রামীণ সালিশি ব্যবস্থা একে অন্যের পরিপূরক হিসেবে পরিগণিত। প্রতিনিয়ত এ ভিলেজ পলিটিক্সের শিকার হচ্ছেন গ্রামে বসবাসকারী সাধারণ নিম্ন, নিম্ন-মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্তসহ কখনো কখনো বিত্তবান শ্রেণীও। মাতব্বর শ্রেণী বলতে মূলত গ্রামের চেয়ারম্যান-মেম্বার-মাতব্বর-সর্দার টাইটেলধারী মোড়লদের বোঝানো হয়েছে যারা এই ভিলেজ পলিটিক্সের মূলহোতা। তাদের মূল অস্ত্র হচ্ছে গ্রাম-মহল্লা এমনকি একটি ছোট বাড়ি যেখানে তারা নিছক কোনো ঘটনাকে কেন্দ্র করে সমস্যার সুন্দর সমাধানের পরিবর্তে তাদের নিজেদের ফায়দা হাসিল করা অর্থাৎ নিজেদের দল ভারি করা বা অবৈধভাবে অর্থ উপার্জন করা বা বিরোধী দলকে ঘায়েল করা অথবা অপছন্দের ব্যক্তিদের শাস্তি প্রদানের প্রয়াসে পক্ষপাতমূলক বিচার করা। এভাবে এসব গ্রাম-মহল্লা বা বাড়িগুলো একাধিক দল বা উপদলে পরিণত হচ্ছে যদিও ক্ষেত্রবিশেষে ভালো সমাধানও পাওয়া যায় তবে সংখ্যার বিচারে তা একেবারেই নগণ্য। তাদের মতলববাজ চালবাজি বুঝতে না পারায় গ্রামীণ সহজ-সরল মানুষগুলো এমন ফাঁদে পা বাড়ায় যেখান থেকে সহজে পরিত্রাণ মেলা ভার। এভাবে তারা মহাবিপদের সম্মুখীন হয় আর প্রচলিত গ্রামীণ পরিবেশের চিরচেনা মানুষে মানুষে যে আত্মার টানের সম্পর্ক তা বাধাপ্রাপ্ত হয়ে কালে কালে সম্পর্কগুলো বিলীন হওয়ার উপক্রম হয়েছে। এছাড়াও কাছের মানুষগুলোর সঙ্গে বিদ্বেষমূলক সম্পর্ক সৃষ্টি, চারদিকে শত্রুতার আবহ তৈরির মতো বসবাস অনুপযোগী পরিবেশ সৃষ্টি হচ্ছে প্রতিনিয়ত। বিশেষ করে এদের সূক্ষ্ম মারপ্যাচ বুঝতে অক্ষম অতি সরল ও বিপরীত দল অপেক্ষা নীতিবান মানুষরা তাদের টার্গেটে পরিণত হয়। তারপর যা হওয়ার তা-ই হয়, অর্থাৎ এ মাতব্বরশ্রেণী, সমাজে তাদের একঘরে করে রাখার মতো বড় বড় শাস্তি ছাড়াও অবহেলা, অসম্মান, অন্যায়ভাবে সম্পদ কুক্ষিগত করার মতো ফৌজদারি অপরাধ পর্যন্ত ঘটাচ্ছে অহরহ।

মাতব্বররা সাধারণত নিজেদের অনুসারীদের নিয়ে দল তৈরি করে থাকে। যখন গ্রামে জমিজমা বা অন্য কোনো বিষয়কে কেন্দ্র করে কোন্দল দেখা দেয় স্বাভাবিকভাবেই এসব কোন্দল সমাধানের জন্য মাতব্বরদের স্মরণাপন্ন হতে হয়। এমতাবস্থায় বিচারকার্য

চলাকালে দলীয় বিবেচনাকে মাতব্বররা অধিকতর গুরুত্ব দিয়ে থাকে। স্বভাবতই অধিকাংশ ক্ষেত্রে ভুলভাবে সমস্যা সমাধানের য়সালা হয় যার বলি হয় গ্রামের অধিকতর অর্থ-সম্পদ ও লোকবল দ্বারা দুর্বল শ্রেণীর মানুষরা। ফলে তাদের মধ্যে এক অদ্ভুত জুজুর ভয় কাজ করে। ফলশ্রুতিতে এই শ্রেণীর মানুষদের এক বড় অংশের দিন কাটে দুর্বিষহ দুশ্চিন্তা ও ভয়ংকর আশঙ্কার মধ্য দিয়ে। এদের বিরুদ্ধে ভুক্তভোগীরা থানায় গিয়ে অভিযোগ পর্যন্ত করতে ভয় পায়, অন্যদিকে অভিযোগ করলেও অনেক সময় তা আমলে নেয়া হয় না অথবা তারা তাদের স্থানীয় প্রভাব খাটিয়ে পার পেয়ে যায়। মুষ্টিমেয় সচেতন অধিবাসী ব্যতীত অধিকাংশ ভুক্তভোগীরাই এমন অপ্রত্যাশিত অন্যায়ের বেড়াজাল থেকে বের হতে অপারগ হয়ে উপরওয়ালার বিচারের অপেক্ষায় প্রহর গুনতে থাকে, যার শেষ সমাধান হয়তো বিধাতাই ভালো জানেন। দৃষ্টান্তস্বরূপ সাম্প্রতিক কিছু ঘটনার উল্লেখ করা যায়। ২ জানুয়ারি ২০২৫ তারিখে মাদারীপুরের শিবচরে গ্রাম্য সালিশে পক্ষপাতমূলকভাবে বিচারে এক কিশোরীকে মিথ্যা অপবাদ দেয়া হলে ওই কিশোরী তা সইতে না পেরে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। ২১ অক্টোবর ২০২৪ তারিখে গোপালগঞ্জের কাশিয়ানিতে বৈদ্যুতিক মোটর চুরিকে কেন্দ্র করে সালিশে সন্দেহভাজন দুজন ছেলেকে জরিমানা করা হয়। এদের মধ্য থেকে একজনের দরিদ্র বাবা ক্ষোভে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। অন্যদিকে, ২১ আগস্ট ২০২৩ তারিখে দিনাজপুরের চিরিরবন্দরে গ্রাম্য সালিশ শেষে লজ্জায় পুত্রবধূ আত্মহনন করেন। এছাড়া, ১২ এপ্রিল ২০২৩ তারিখে নীলফামারীর কিশোরগঞ্জে সুপারি চুরিকে কেন্দ্র করে সালিশে সন্দেহবশত এক বৃদ্ধকে পা ধরে ক্ষমা চাইতে বলায় তিনি লজ্জা, ক্ষোভ আর অপমানে ঘটনাস্থলেই বিষপান করে আত্মহত্যা করেন। একইভাবে, ২৬ আগস্ট ২০২০ তারিখে নরসিংদির মাধবদীতে প্রভাব খাটিয়ে স্থানীয় ছাত্রলীগের সভাপতি ও মাতব্বরদের একতরফাভাবে চাপিয়ে দেয়া বিচারের গ্লানি সহ্য করতে না পেরে এক গৃহবধূ আত্মহত্যা করেন। এমনই নিত্য নতুন শত-সহস্র ঘটনা অহরহ ঘটে চলেছে যেখানে ভিলেজ পলিটিক্সের অন্যতম উপশাখা শালিসি ব্যবস্থার মাধ্যমে ভুলভাল বিচারের বলি হচ্ছে সাধারণ গ্রামবাসী যার হদিস মিডিয়াতেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে পাওয়া যায় না। এহেন অবস্থায় উপর্যুক্ত গ্রাম্য মোড়লদের অবৈধ অর্থ লেনদেনের মাধ্যমে বিচারকার্য পরিচালনা থেকে শুরু করে যেকোনো বিষয়ে তাদের অযাচিত হস্তক্ষেপ থেকে বিরত থাকার ব্যবস্থা করাসহ তাদের বেআইনি কর্মকা-কে আইনের আওতায় এনে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করা অতিব জরুরি হয়ে পড়েছে। তবে সবার আগে প্রয়োজন ন্যায় ও ন্যায্যতার চর্চা সমাজে প্রতিষ্ঠা করা। গ্রামবাসীর মধ্যে এ দুয়ের সমন্বয় অটুট থাকলে ভিলেজ পলিটিক্স নামক নেতিবাচক শব্দগুচ্ছের বিলুপ্তি ঘটবে, মানুষে মানুষে সুসম্পর্ক বৃদ্ধি পাবে, পারস্পরিক সম্মান ও ভালোবাসার মেলবন্ধনে একে অপরের উৎকৃষ্ট প্রতিবেশীরূপে সৌহার্দ ও সহাবস্থান নিয়ে হাজার বছর ধরে বিরাজমান বাঙালি সংস্কৃতি টিকিয়ে রাখতে সক্ষম হবে এবং একই সঙ্গে অন্যায়-অবিচার ও জুলুমের হাত থেকে পরিত্রাণ পাবে এদেশের কোটি জনতা।

এজন্য দরকার জুলুমের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া, ভিলেজ পলিটিক্সকে না বলা। আধুনিক সভ্যতার ছোঁয়ায় যখন আমরা উন্নয়নশীল জাতিতে পরিণত হতে যাচ্ছি তখন এই গ্রাম্য শালিসি বা পঞ্চায়েত ব্যবস্থার আদৌ প্রয়োজন আছে কিনা তা এখনই ভাবার বিষয়। তবে, সরকার এ ব্যাপারে সুদৃষ্টি না দিলে সাম্যতার নতুন বাংলাদেশের এই বিশাল জনগোষ্ঠী অনবরত নিপীড়নের বলি হবে, যা অনাকাক্সিক্ষত। এহেন অবস্থা সমাজে বাস্তবায়নের জন্য দরকার একটি সুন্দর, নিরপেক্ষ বিচার ব্যবস্থা যেখানে মানুষ নির্দ্বিধায় ন্যায়বিচার প্রত্যাশা করতে পারে কেননা সমাজে একত্রে বসবাস করলে সময়ে সময়ে সমস্যা তৈরি হবে যার সমাধানের উপযুক্ত ব্যবস্থা থাকা অতি জরুরি। সেই সঙ্গে পুলিশকে হতে হবে জনবান্ধব ও সত্যিকারের বন্ধু যাদের ওপর ভরসা করা যায়। একই সঙ্গে পুলিশকে যাবতীয় ঘুষ-দুর্নীতি থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত হওয়া একান্ত কর্তব্য। সরকার যদি আইন ব্যবস্থাকে পুনর্বিন্যাস করে ঘুষ-দুর্নীতি মুক্ত স্বাধীন স্বত্তা হিসেবে গড়ে তুলতে সক্ষম হয় তাহলে এ ব্যবস্থার অবলোপন অবশ্যম্ভাবী। অন্যথায় জনগণই এদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহে ঝাঁপিয়ে পড়বে। যখন ২৪ এর জুলাই গণঅভ্যুত্থানে সাধারণ মানুষ অন্যায়-অবিচার আর বৈষম্যের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছে, তখন এটা প্রত্যাশা করাই যায় যে, আমার লেখার গুরুত্বপূর্ণ আনুষঙ্গ মজলুম গ্রামবাসীও এ অনিয়ম আর অনাচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হবে এবং ভিলেজ পলিটিক্স নামক এক বিভিষিকাময় ও জ্বালাময়ী ব্যবস্থার মূল উৎপাটন করতে সক্ষম হবে। ক্ষেত্রবিশেষে ছোটখাটো দৈনন্দিন সমস্যা সমাধানে মাতব্বর শ্রেণীর বিচারকের ভূমিকা পালন করার এখতিয়ার থাকতে পারে। তবে মতব্বরদের এটা মাথায় রাখা উচিত যে, নেতৃত্বগুণ বিধাতা প্রদত্ত, সবাই এ সুযোগ পায় না। ইসলাম ধর্মের পবিত্র বাণী থেকে পাওয়া যায়, তিন শ্রেণীর মানুষ বিনা হিসেবে স্বর্গে প্রবেশ করবেÑ তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ন্যায়বিচারক ব্যক্তি; অন্যদিকে তার বিপরীতটি ঘটবে অন্যায়ভাবে বিচারকার্য পরিচালনাকারীর ক্ষেত্রে। অন্য সব ধর্মেও ন্যায়বিচার করাকে অধিকতর গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। তাছাড়া, সভ্য সমাজে ভিলেজ পলিটিক্স নামক ঘৃণ্য রাজনীতি ও বিচারকার্য দেখা মেলা দুরূহ। সুতরাং একটি সাবলীল গ্রামীণ সমাজ ব্যবস্থার স্বার্থেই ভিলেজ পলিটিক্সকে নির্মূল করা এখন সময়ের সেরা দাবি। তাহলেই গ্রাম্য সাধুদের অর্থাৎ মাতব্বর শ্রেণীকে সাবধান করা সম্ভব হবে, বাংলার বুকে উপহার দেয়া যাবে একটি আদর্শ গ্রামীণ জীবন ব্যবস্থা।

[লেখক: সহকারী অধ্যাপক, ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেমস্ বিভাগ বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়]

দক্ষ মানবসম্পদ ও সমৃদ্ধ গ্রন্থাগার

আফ্রিকায় হঠাৎ কেন যুক্তরাষ্ট্রের ঝোঁক?

ঢাকা মহানগর ও বুড়িগঙ্গা

জামাই মেলা : উৎসব, ঐতিহ্য ও কৃষ্টির রঙিন চিত্রপট

হারিয়ে যাওয়া ক্লাস, কঠোর মূল্যায়ন আর প্রশ্নের জটিলতায় নুয়ে পড়া এক প্রজন্ম

বৈষম্য দূর করে নতুন বাংলাদেশ গড়ে তুলুন

চিকিৎসা যেন বাণিজ্যের হাতিয়ারে পরিণত না হয়

পথশিশু ও বাংলাদেশে সামাজিক চুক্তির ব্যর্থতা

মেগা প্রকল্প : প্রশ্ন হওয়া উচিত স্বচ্ছতা নিয়ে

আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া জরুরি

স্মার্ট দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা : উপগ্রহ চিত্র ও ওয়েবসাইটের অপরিহার্যতা

ক্ষমতা ও জনপ্রশাসন : আমলাতন্ত্রের ছায়াতলে আমজনতা

জনসংখ্যা : সম্পদ না সংকট?

ব্রিকসে নতুন ভূ-রাজনৈতিক ব্যবস্থার উত্থান

রম্যগদ্য : ‘ল্যাংড়া-লুলা, আতুড়-পাতুড়’

আষাঢ়ী পূর্ণিমা : আত্মশুদ্ধির সাধনায় বুদ্ধের অনন্ত আলো

বদলে যাওয়া মাটিতে সাহসী বীজ : জলবায়ুর বিপরীতে বাংলাদেশের কৃষির অভিযোজনগাথা

ছবি

জুলাই অভ্যুত্থান-গাথা : ‘শিকলে নাহি দিব ধরা’

প্রাচীন যৌধেয় জাতি ও তাদের সাম্যবাদী শাসন

গণঅভ্যুত্থান-উত্তর ন্যায়ভিত্তিক রাষ্ট্র বিনির্মাণের স্বপ্ন

টেকসই উন্নয়নের স্বপ্নপূরণে উপগ্রহ চিত্রই চাবিকাঠি

রাবার শিল্প : সংকট, করণীয় ও উত্তরণের দিশা

রম্যগদ্য : দুধ, দই, কলা...

ছবি

কোপার্নিকাস : আলো হয়ে জন্ম নেওয়া বৈপ্লবিক মতবাদের প্রবর্তক

জলবায়ু সংকটে মানবসভ্যতা

টেকসই অর্থনীতির জন্য চাই টেকসই ব্যাংকিং

ডিজিটাল দাসত্ব : মনোযোগ অর্থনীতি ও জ্ঞান পুঁজিবাদে তরুণ প্রজন্মের মননশীলতার অবক্ষয়

অন্তর্বর্তীকালীন সরকার : আস্থা ভঙ্গ ও জবাবদিহিতার সংকট

আসামি এখন নির্বাচন কমিশন

কোথায় হারাল একান্নবর্তী পরিবার?

এই শান্তি কি মহাঝড়ের পূর্বলক্ষণ?

মেগাসিটি : দারিদ্র্য যখন ‘অবাঞ্ছিত বর্জ্য’

ফলের রাজ্য পার্বত্য চট্টগ্রাম

ছবি

তৃতীয় শক্তির জন্য জায়গা খালি : বামপন্থীরা কি ঘুরে দাঁড়াতে পারে না

জমি আপনার, দখল অন্যের?

সিধু-কানু : ধ্বংসস্তূপের নিচেও জেগে আছে সাহস

tab

উপ-সম্পাদকীয়

‘ভিলেজ পলিটিক্স’ ও সাধারণ গ্রামবাসী

সামসুল আলম

শনিবার, ২৫ জানুয়ারী ২০২৫

দেশের সিংহভাগ মানুষ গ্রামে বসবাস করে। গ্রামের মানুষ যুগ থেকে যুগান্তরে একে অপরের সঙ্গে মেলবন্ধন আর সহমর্মিতা নিয়ে মিলেমিশে সহাবস্থান করে, যা সর্বমহলে প্রশংসিত। এ মেলবন্ধনের সুন্দর সেতুবন্দর তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে গ্রামের সম্মানীয় মাতব্বর শ্রেণী। তবে বর্তমান বাস্তবতায় এই মাতব্বর শ্রেণীর ভূমিকা কি গ্রামীণ সহজ-সরল মানুষের সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় আনুষঙ্গ হয়ে বিচারকার্য পরিচালনা করে সমাজের ভারসাম্য রক্ষা করছে?

বিভিন্ন বাস্তবতায় এ প্রশ্নের সহজ উত্তর হলো অতীতে এদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকলেও আজকের দিনে মোটেও ইতিবাচক

ভূমিকা পালন করছে না বরং আজকাল এই সম্মানীয় মাতব্বর শ্রেণী গ্রামের মানুষের কাছে এক কুৎসিত শ্রেণীতে রূপান্তরিত হয়েছে। বিশেষ করে বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমল থেকে গ্রাম্য রাজনীতি বা ভিলেজ পলিটিক্সের নেতিবাচক দিকগুলো আরো শক্তভাবে দেখা দিয়েছে যার ধারাবাহিকতা এখনো চলমান রয়েছে।

গ্রামীণ সমাজের নিকৃষ্ট থেকে নিকৃষ্টতর এক বাজ ওয়ার্ড হচ্ছে ‘ভিলেজ পলিটিক্স’ যার সূত্রপাত হয়েছে গ্রামের মাতব্বর শ্রেণী থেকে, যারা সালিশি ব্যবস্থার মাধ্যমে বিচারকার্য পরিচালনা করে থাকে। তাই ভিলেজ পলিটিক্স আর গ্রামীণ সালিশি ব্যবস্থা একে অন্যের পরিপূরক হিসেবে পরিগণিত। প্রতিনিয়ত এ ভিলেজ পলিটিক্সের শিকার হচ্ছেন গ্রামে বসবাসকারী সাধারণ নিম্ন, নিম্ন-মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্তসহ কখনো কখনো বিত্তবান শ্রেণীও। মাতব্বর শ্রেণী বলতে মূলত গ্রামের চেয়ারম্যান-মেম্বার-মাতব্বর-সর্দার টাইটেলধারী মোড়লদের বোঝানো হয়েছে যারা এই ভিলেজ পলিটিক্সের মূলহোতা। তাদের মূল অস্ত্র হচ্ছে গ্রাম-মহল্লা এমনকি একটি ছোট বাড়ি যেখানে তারা নিছক কোনো ঘটনাকে কেন্দ্র করে সমস্যার সুন্দর সমাধানের পরিবর্তে তাদের নিজেদের ফায়দা হাসিল করা অর্থাৎ নিজেদের দল ভারি করা বা অবৈধভাবে অর্থ উপার্জন করা বা বিরোধী দলকে ঘায়েল করা অথবা অপছন্দের ব্যক্তিদের শাস্তি প্রদানের প্রয়াসে পক্ষপাতমূলক বিচার করা। এভাবে এসব গ্রাম-মহল্লা বা বাড়িগুলো একাধিক দল বা উপদলে পরিণত হচ্ছে যদিও ক্ষেত্রবিশেষে ভালো সমাধানও পাওয়া যায় তবে সংখ্যার বিচারে তা একেবারেই নগণ্য। তাদের মতলববাজ চালবাজি বুঝতে না পারায় গ্রামীণ সহজ-সরল মানুষগুলো এমন ফাঁদে পা বাড়ায় যেখান থেকে সহজে পরিত্রাণ মেলা ভার। এভাবে তারা মহাবিপদের সম্মুখীন হয় আর প্রচলিত গ্রামীণ পরিবেশের চিরচেনা মানুষে মানুষে যে আত্মার টানের সম্পর্ক তা বাধাপ্রাপ্ত হয়ে কালে কালে সম্পর্কগুলো বিলীন হওয়ার উপক্রম হয়েছে। এছাড়াও কাছের মানুষগুলোর সঙ্গে বিদ্বেষমূলক সম্পর্ক সৃষ্টি, চারদিকে শত্রুতার আবহ তৈরির মতো বসবাস অনুপযোগী পরিবেশ সৃষ্টি হচ্ছে প্রতিনিয়ত। বিশেষ করে এদের সূক্ষ্ম মারপ্যাচ বুঝতে অক্ষম অতি সরল ও বিপরীত দল অপেক্ষা নীতিবান মানুষরা তাদের টার্গেটে পরিণত হয়। তারপর যা হওয়ার তা-ই হয়, অর্থাৎ এ মাতব্বরশ্রেণী, সমাজে তাদের একঘরে করে রাখার মতো বড় বড় শাস্তি ছাড়াও অবহেলা, অসম্মান, অন্যায়ভাবে সম্পদ কুক্ষিগত করার মতো ফৌজদারি অপরাধ পর্যন্ত ঘটাচ্ছে অহরহ।

মাতব্বররা সাধারণত নিজেদের অনুসারীদের নিয়ে দল তৈরি করে থাকে। যখন গ্রামে জমিজমা বা অন্য কোনো বিষয়কে কেন্দ্র করে কোন্দল দেখা দেয় স্বাভাবিকভাবেই এসব কোন্দল সমাধানের জন্য মাতব্বরদের স্মরণাপন্ন হতে হয়। এমতাবস্থায় বিচারকার্য

চলাকালে দলীয় বিবেচনাকে মাতব্বররা অধিকতর গুরুত্ব দিয়ে থাকে। স্বভাবতই অধিকাংশ ক্ষেত্রে ভুলভাবে সমস্যা সমাধানের য়সালা হয় যার বলি হয় গ্রামের অধিকতর অর্থ-সম্পদ ও লোকবল দ্বারা দুর্বল শ্রেণীর মানুষরা। ফলে তাদের মধ্যে এক অদ্ভুত জুজুর ভয় কাজ করে। ফলশ্রুতিতে এই শ্রেণীর মানুষদের এক বড় অংশের দিন কাটে দুর্বিষহ দুশ্চিন্তা ও ভয়ংকর আশঙ্কার মধ্য দিয়ে। এদের বিরুদ্ধে ভুক্তভোগীরা থানায় গিয়ে অভিযোগ পর্যন্ত করতে ভয় পায়, অন্যদিকে অভিযোগ করলেও অনেক সময় তা আমলে নেয়া হয় না অথবা তারা তাদের স্থানীয় প্রভাব খাটিয়ে পার পেয়ে যায়। মুষ্টিমেয় সচেতন অধিবাসী ব্যতীত অধিকাংশ ভুক্তভোগীরাই এমন অপ্রত্যাশিত অন্যায়ের বেড়াজাল থেকে বের হতে অপারগ হয়ে উপরওয়ালার বিচারের অপেক্ষায় প্রহর গুনতে থাকে, যার শেষ সমাধান হয়তো বিধাতাই ভালো জানেন। দৃষ্টান্তস্বরূপ সাম্প্রতিক কিছু ঘটনার উল্লেখ করা যায়। ২ জানুয়ারি ২০২৫ তারিখে মাদারীপুরের শিবচরে গ্রাম্য সালিশে পক্ষপাতমূলকভাবে বিচারে এক কিশোরীকে মিথ্যা অপবাদ দেয়া হলে ওই কিশোরী তা সইতে না পেরে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। ২১ অক্টোবর ২০২৪ তারিখে গোপালগঞ্জের কাশিয়ানিতে বৈদ্যুতিক মোটর চুরিকে কেন্দ্র করে সালিশে সন্দেহভাজন দুজন ছেলেকে জরিমানা করা হয়। এদের মধ্য থেকে একজনের দরিদ্র বাবা ক্ষোভে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। অন্যদিকে, ২১ আগস্ট ২০২৩ তারিখে দিনাজপুরের চিরিরবন্দরে গ্রাম্য সালিশ শেষে লজ্জায় পুত্রবধূ আত্মহনন করেন। এছাড়া, ১২ এপ্রিল ২০২৩ তারিখে নীলফামারীর কিশোরগঞ্জে সুপারি চুরিকে কেন্দ্র করে সালিশে সন্দেহবশত এক বৃদ্ধকে পা ধরে ক্ষমা চাইতে বলায় তিনি লজ্জা, ক্ষোভ আর অপমানে ঘটনাস্থলেই বিষপান করে আত্মহত্যা করেন। একইভাবে, ২৬ আগস্ট ২০২০ তারিখে নরসিংদির মাধবদীতে প্রভাব খাটিয়ে স্থানীয় ছাত্রলীগের সভাপতি ও মাতব্বরদের একতরফাভাবে চাপিয়ে দেয়া বিচারের গ্লানি সহ্য করতে না পেরে এক গৃহবধূ আত্মহত্যা করেন। এমনই নিত্য নতুন শত-সহস্র ঘটনা অহরহ ঘটে চলেছে যেখানে ভিলেজ পলিটিক্সের অন্যতম উপশাখা শালিসি ব্যবস্থার মাধ্যমে ভুলভাল বিচারের বলি হচ্ছে সাধারণ গ্রামবাসী যার হদিস মিডিয়াতেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে পাওয়া যায় না। এহেন অবস্থায় উপর্যুক্ত গ্রাম্য মোড়লদের অবৈধ অর্থ লেনদেনের মাধ্যমে বিচারকার্য পরিচালনা থেকে শুরু করে যেকোনো বিষয়ে তাদের অযাচিত হস্তক্ষেপ থেকে বিরত থাকার ব্যবস্থা করাসহ তাদের বেআইনি কর্মকা-কে আইনের আওতায় এনে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করা অতিব জরুরি হয়ে পড়েছে। তবে সবার আগে প্রয়োজন ন্যায় ও ন্যায্যতার চর্চা সমাজে প্রতিষ্ঠা করা। গ্রামবাসীর মধ্যে এ দুয়ের সমন্বয় অটুট থাকলে ভিলেজ পলিটিক্স নামক নেতিবাচক শব্দগুচ্ছের বিলুপ্তি ঘটবে, মানুষে মানুষে সুসম্পর্ক বৃদ্ধি পাবে, পারস্পরিক সম্মান ও ভালোবাসার মেলবন্ধনে একে অপরের উৎকৃষ্ট প্রতিবেশীরূপে সৌহার্দ ও সহাবস্থান নিয়ে হাজার বছর ধরে বিরাজমান বাঙালি সংস্কৃতি টিকিয়ে রাখতে সক্ষম হবে এবং একই সঙ্গে অন্যায়-অবিচার ও জুলুমের হাত থেকে পরিত্রাণ পাবে এদেশের কোটি জনতা।

এজন্য দরকার জুলুমের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া, ভিলেজ পলিটিক্সকে না বলা। আধুনিক সভ্যতার ছোঁয়ায় যখন আমরা উন্নয়নশীল জাতিতে পরিণত হতে যাচ্ছি তখন এই গ্রাম্য শালিসি বা পঞ্চায়েত ব্যবস্থার আদৌ প্রয়োজন আছে কিনা তা এখনই ভাবার বিষয়। তবে, সরকার এ ব্যাপারে সুদৃষ্টি না দিলে সাম্যতার নতুন বাংলাদেশের এই বিশাল জনগোষ্ঠী অনবরত নিপীড়নের বলি হবে, যা অনাকাক্সিক্ষত। এহেন অবস্থা সমাজে বাস্তবায়নের জন্য দরকার একটি সুন্দর, নিরপেক্ষ বিচার ব্যবস্থা যেখানে মানুষ নির্দ্বিধায় ন্যায়বিচার প্রত্যাশা করতে পারে কেননা সমাজে একত্রে বসবাস করলে সময়ে সময়ে সমস্যা তৈরি হবে যার সমাধানের উপযুক্ত ব্যবস্থা থাকা অতি জরুরি। সেই সঙ্গে পুলিশকে হতে হবে জনবান্ধব ও সত্যিকারের বন্ধু যাদের ওপর ভরসা করা যায়। একই সঙ্গে পুলিশকে যাবতীয় ঘুষ-দুর্নীতি থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত হওয়া একান্ত কর্তব্য। সরকার যদি আইন ব্যবস্থাকে পুনর্বিন্যাস করে ঘুষ-দুর্নীতি মুক্ত স্বাধীন স্বত্তা হিসেবে গড়ে তুলতে সক্ষম হয় তাহলে এ ব্যবস্থার অবলোপন অবশ্যম্ভাবী। অন্যথায় জনগণই এদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহে ঝাঁপিয়ে পড়বে। যখন ২৪ এর জুলাই গণঅভ্যুত্থানে সাধারণ মানুষ অন্যায়-অবিচার আর বৈষম্যের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছে, তখন এটা প্রত্যাশা করাই যায় যে, আমার লেখার গুরুত্বপূর্ণ আনুষঙ্গ মজলুম গ্রামবাসীও এ অনিয়ম আর অনাচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হবে এবং ভিলেজ পলিটিক্স নামক এক বিভিষিকাময় ও জ্বালাময়ী ব্যবস্থার মূল উৎপাটন করতে সক্ষম হবে। ক্ষেত্রবিশেষে ছোটখাটো দৈনন্দিন সমস্যা সমাধানে মাতব্বর শ্রেণীর বিচারকের ভূমিকা পালন করার এখতিয়ার থাকতে পারে। তবে মতব্বরদের এটা মাথায় রাখা উচিত যে, নেতৃত্বগুণ বিধাতা প্রদত্ত, সবাই এ সুযোগ পায় না। ইসলাম ধর্মের পবিত্র বাণী থেকে পাওয়া যায়, তিন শ্রেণীর মানুষ বিনা হিসেবে স্বর্গে প্রবেশ করবেÑ তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ন্যায়বিচারক ব্যক্তি; অন্যদিকে তার বিপরীতটি ঘটবে অন্যায়ভাবে বিচারকার্য পরিচালনাকারীর ক্ষেত্রে। অন্য সব ধর্মেও ন্যায়বিচার করাকে অধিকতর গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। তাছাড়া, সভ্য সমাজে ভিলেজ পলিটিক্স নামক ঘৃণ্য রাজনীতি ও বিচারকার্য দেখা মেলা দুরূহ। সুতরাং একটি সাবলীল গ্রামীণ সমাজ ব্যবস্থার স্বার্থেই ভিলেজ পলিটিক্সকে নির্মূল করা এখন সময়ের সেরা দাবি। তাহলেই গ্রাম্য সাধুদের অর্থাৎ মাতব্বর শ্রেণীকে সাবধান করা সম্ভব হবে, বাংলার বুকে উপহার দেয়া যাবে একটি আদর্শ গ্রামীণ জীবন ব্যবস্থা।

[লেখক: সহকারী অধ্যাপক, ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেমস্ বিভাগ বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়]

back to top