রন্টি চৌধুরী
বাংলাদেশে প্রদেশ গঠনের প্রস্তাব সাম্প্রতিক সময়ে আলোচনায় উঠে এসেছে। কিছু মহল দাবি করছেন, প্রদেশ গঠনের মাধ্যমে প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণ নিশ্চিত করা যাবে, ঢাকার ওপর চাপ কমবে এবং আঞ্চলিক উন্নয়নের পথ খুলে যাবে। তবে বাস্তবতা হলো, এই প্রস্তাবটি অপ্রয়োজনীয়, ব্যয়বহুল এবং দীর্ঘমেয়াদে জাতীয় ঐক্য ও স্থিতিশীলতার জন্য ক্ষতিকর। বাংলাদেশে ইতোমধ্যেই আটটি প্রশাসনিক বিভাগ রয়েছে। সেগুলো কার্যকরভাবে পরিচালনা করলেই প্রদেশ গঠনের মাধ্যমে যা অর্জন করা সম্ভব বলে দাবি করা হচ্ছে, তা অনেক কম খরচে এবং জটিলতা ছাড়াই অর্জন করা সম্ভব।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রদেশ বা রাজ্যভিত্তিক প্রশাসনিক কাঠামো দুটি মূল কারণে গড়ে ওঠে। প্রথমত, ভাষা, সংস্কৃতি এবং জাতিগত বৈচিত্র্যের কারণে পৃথক পরিচয় ও স্বায়ত্তশাসনের প্রয়োজন হলে প্রদেশ গঠন করা হয়। ভারতের রাজ্যগুলো তার একটি স্পষ্ট উদাহরণ। প্রতিটি রাজ্যের নিজস্ব ভাষা, সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্য রয়েছে। তামিলনাড়– তামিল সংস্কৃতির, পাঞ্জাব শিখ সংস্কৃতির, এবং গুজরাট গুজরাটি সংস্কৃতির প্রতিনিধিত্ব করে। একইভাবে, পাকিস্তানের পাঞ্জাব, সিন্ধ, বেলুচিস্তান এবং খাইবার পাখতুনখোয়া প্রদেশগুলো আলাদা জাতিগোষ্ঠী এবং ভাষার ভিত্তিতে গঠিত।
দ্বিতীয়ত, বড় ভৌগোলিক বিস্তৃতি এবং জনসংখ্যার চাপ সামলানোর জন্য প্রদেশ বা রাজ্যভিত্তিক প্রশাসনিক কাঠামো তৈরি করা হয়।
কিন্তু বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট এসব দেশের তুলনায় ভিন্ন। আমাদের দেশে সিংহভাগ মানুষ একই ভাষা, সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যের অংশ। এখানে ভৌগোলিক বিস্তৃতি সীমিত। এই বাস্তবতায় প্রদেশ গঠন করার মাধ্যমে যা অর্জন করার কথা বলা হচ্ছে, তা একটি বিভ্রান্তিকর এবং অপ্রয়োজনীয় প্রস্তাব।
প্রদেশ গঠনের অন্যতম বড় ঝুঁকি হলো জাতীয় ঐক্য এবং স্থিতিশীলতা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া। বর্তমানে বাংলাদেশ আটটি বিভাগে বিভক্ত। এই বিভাগগুলো আলাদা প্রশাসনিক কাঠামো হিসেবে কাজ করছে, যদিও সেগুলো এখনও পূর্ণ সক্ষমতার সঙ্গে পরিচালিত হচ্ছে না। যদি চারটি প্রদেশ গঠন করা হয়, তাহলে বাকি চারটি বিভাগ নিজেদের অবহেলিত এবং বৈষম্যের শিকার মনে করতে পারে। এর ফলে আঞ্চলিক প্রতিযোগিতা এবং গণ-আন্দোলনের ঝুঁকি বেড়ে যাবে। বাংলাদেশে এখনও পর্যন্ত অন্ততপক্ষে অঞ্চলভিত্তিক ধরনের রেষারেষি নেই। শুধু পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে যে সমস্যা রয়েছে সেটা নিয়ে দেশকে হিমশিম খেতে হয়। যেখানে সারাদেশের মানুষের মধ্যে এই অঞ্চলভিত্তিক সমস্যার কোন অস্তিত্ব নেই সেখানে কেন প্রদেশ গঠন করে এক একটা অঞ্চলকে আলাদা একটা ঝামেলার মধ্যে নিয়ে ফেলা? সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেটি বড় ঝামেলা হয়ে উঠতে পারে। এই ছোট্ট দেশে সবাই মিলে মিশে থাকে সেখানে অঞ্চলভিত্তিক ভেদাভেদ বাড়িয়ে দেয়ার জন্য প্রদেশে প্রদেশের ভাগ করার কোন যুক্তি হতে পারে না।
এমনকি যদি চারটি প্রদেশ হলে সমালোচনা হয় ভেবে আটটি বিভাগকে প্রদেশে রূপান্তর করার প্রস্তাবও দেয়া হয়, সেটি হবে অত্যন্ত ব্যয়বহুল এবং অপ্রয়োজনীয়। প্রতিটি প্রদেশের জন্য নতুন প্রশাসনিক কাঠামো, মন্ত্রণালয়, আইনসভা এবং কর্মকর্তাদের নিয়োগ করতে প্রচুর অর্থের প্রয়োজন হবে। নতুন প্রদেশ গঠনের মাধ্যমে সরকারের ব্যয়ের চাপ বহুগুণে বাড়বে। প্রতিটি প্রদেশের জন্য নতুন প্রশাসনিক ভবন, কর্মকর্তাদের বাসস্থান, যানবাহন এবং অন্যান্য লজিস্টিক সুবিধার প্রয়োজন হবে। প্রাদেশিক সরকার করতে হবে এবং মাথা ভারি নতুন আরেকটি প্রশাসন তৈরি হবে। দেশে একটি সরকারের জায়গায় আটটি প্রাদেশিক সরকার তৈরি হবে এবং সেই সমস্ত সরকারের সঙ্গে কেন্দ্রীয় সরকারের সমন্বয়ের একটা সমস্যা তৈরি হবে। কোন প্রদেশের কোন রাজনৈতিক দলের সরকার হবে সেগুলো নিয়ে একটা অসুস্থ প্রতিযোগিতা তৈরি হতে পারে এবং কয়েক দশক পর যদি দেখা যায় যে প্রদেশভিত্তিক রাজনৈতিক কলহ তৈরি হয়েছে সেটা হবে দেশের জন্য বিপর্যয়কর।
এই প্রদেশে প্রদেশে ভাগ করার পরিকল্পনায় একে তো বিভাজনের ঝুঁকি আরো থাকছে রাষ্ট্রীয় অর্থ অপচয়ের ঝুঁকি। এটি করে আসলে প্রাপ্তি কি হবে? কেউ কেউ বলবেন যে এটি করে রাজধানী ঢাকার ওপরে চাপ কমবে, দেশে বিকেন্দ্রীকরণ হবে। কিন্তু বিকেন্দ্রীকরণ করতে হলে নতুন করে প্রাদেশিক সিস্টেম চালু করতে হয় না, বরং বর্তমানে যে ব্যবস্থা চালু আছে সেটি কার্যকর করার মাধ্যমেই বিকেন্দ্রীকরণ করা সহজেই যায়।
ঢাকার ওপর প্রশাসনিক চাপ কমানোর জন্য বিভিন্ন মন্ত্রণালয় এবং সরকারি দপ্তরকে বিভাগীয় শহরে স্থানান্তর করা একটি কার্যকর সমাধান। বর্তমানে ঢাকায় প্রশাসনিক এবং অর্থনৈতিক কার্যক্রম কেন্দ্রীভূত হওয়ায় রাজধানী চরম জনসংখ্যা এবং যানজটের শিকার। ঢাকার চাপ কমাতে নৌপরিবহন ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে চট্টগ্রামে স্থানান্তর করা যেতে পারে। এটি দেশের প্রধান সমুদ্রবন্দর চট্টগ্রামের কার্যক্রম আরও শক্তিশালী করবে।
কৃষি মন্ত্রণালয়কে রাজশাহীতে সরিয়ে নেয়া হলে দেশের কৃষি উৎপাদনশীলতায় সরাসরি ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। খুলনায় পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় এবং মৎস্য মন্ত্রণালয় স্থাপন করা হলে সুন্দরবন ও উপকূলীয় এলাকার সুরক্ষা আরও কার্যকরভাবে নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। সিলেটে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় স্থাপন করা হলে প্রবাসী বাংলাদেশিদের সেবা পাওয়া সহজ হবে এবং পর্যটন শিল্প উন্নত হবে। ময়মনসিংহে প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় স্থাপন করলে দেশের প্রাণিসম্পদ খাতের উন্নয়ন ত্বরান্বিত হবে।
বিচারব্যবস্থার ক্ষেত্রেও ঢাকার ওপর নির্ভরশীলতা কমানো অত্যন্ত জরুরি। বর্তমানে একটি মাত্র হাইকোর্ট ঢাকায় কেন্দ্রীভূত। এর ফলে সারাদেশের বিচারপ্রার্থীদের ঢাকায় এসে মামলা পরিচালনা করতে হয়, যা সময় ও অর্থের অপচয় ঘটায়। প্রতিটি বিভাগীয় শহরে হাইকোর্ট বেঞ্চ স্থাপন করা হলে বিচারপ্রার্থীদের সময় এবং অর্থ সাশ্রয় হবে। ভারতে প্রতিটি রাজ্যে হাইকোর্ট বেঞ্চ থাকার কারণে তাদের বিচারব্যবস্থা অনেক বেশি কার্যকর। বাংলাদেশেও একই ব্যবস্থা চালু করা হলে মামলার জট কমবে এবং বিচারপ্রক্রিয়া আরও সহজ হবে।
সংসদ সদস্যদের ভূমিকার ক্ষেত্রেও বড় পরিবর্তন আনা দরকার। বাংলাদেশের সংসদ সদস্যরা আইন প্রণয়নের পরিবর্তে উন্নয়ন প্রকল্পের তদারকিতে বেশি মনোযোগী হয়ে পড়েন। এতে স্থানীয় সরকার এবং প্রশাসন দুর্বল হয়ে পড়ে। সংসদ সদস্যদের মূল কাজ হলো আইন প্রণয়ন এবং জাতীয় নীতি নির্ধারণ। তাদের এই কাজের মধ্যে সীমাবদ্ধ রেখে স্থানীয় উন্নয়নের দায়িত্ব স্থানীয় সরকার এবং বিভাগীয় প্রশাসনের হাতে তুলে দেয়া উচিত।
এরশাদ শাসনামলে অনেক খারাপ কাজের মধ্যে একটি ভালো কাজ ছিল উপজেলা পদ্ধতি চালু করা। এটির মাধ্যমে স্থানীয় উন্নয়নের দায়িত্ব উপজেলা চেয়ারম্যানদের হাতে ন্যস্ত করা হয়েছিল। এই ব্যবস্থাটি প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণের একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ ছিল, যা জনগণের কাছে সেবা পৌঁছে দেয়ার লক্ষ্য নিয়ে গৃহীত হয়। তবে এরশাদের পতনের পর গণতান্ত্রিক সরকারের অধীনে, উপজেলা চেয়ারম্যানদের ক্ষমতা ক্রমশ হ্রাস করা হয়। এটি মূলত সংসদ সদস্যদের সর্বময় ক্ষমতা নিশ্চিত করার একটি কৌশল হিসেবে বাস্তবায়িত হয়।
এই পরিবর্তনের ফলে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার ওপর সংসদ সদস্যদের রাজনৈতিক প্রভাব বেড়ে যায় এবং স্থানীয় উন্নয়ন প্রকৃত বিকেন্দ্রীকরণের বাইরে চলে যায়। প্রকৃতপক্ষে, একটি গণতান্ত্রিক কাঠামো নিশ্চিত করতে হলে, জনগণের ভোটে নির্বাচিত স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের হাতে উন্নয়নের দায়িত্ব দিতে হবে। যদি সংসদ সদস্যরা আইন প্রণয়ন এবং জাতীয় নীতি নির্ধারণের বাইরে এসে স্থানীয় উন্নয়নে হস্তক্ষেপ করেন, তবে এটি দেশের উন্নয়ন প্রক্রিয়াকে স্থবির করে তুলবে। তাই স্থানীয় সরকার ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করা, এবং সংসদ সদস্যদের তাদের সাংবিধানিক দায়িত্বে সীমাবদ্ধ রাখা, দেশের সার্বিক উন্নয়নের জন্য অপরিহার্য।
বিভাগগুলোর কার্যক্রম উন্নত করার জন্য প্রতিটি বিভাগে আধুনিক অবকাঠামো গড়ে তোলা, মানসম্মত হাসপাতাল এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করা এবং শিল্পায়নের উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন। যেগুলো এখনই বিভিন্ন বিভাগে তৈরি করা হয়ে গেছে। সেগুলোকে আরও উন্নত করতে হবে যাতে সেগুলো ঢাকা থেকে সেবা পাওয়া যায় ঠিক একই রকম সেবা দিতে পারে। প্রতিটি বিভাগে বিশেষ অর্থনৈতিক জোন গড়ে তোলা হলে স্থানীয় কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পাবে। রেল এবং সড়ক যোগাযোগ উন্নয়নের মাধ্যমে বিভাগীয় শহরগুলোর সঙ্গে ঢাকার সরাসরি সংযোগ নিশ্চিত করা যেতে পারে।
জাতীয় ঐক্য বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় শক্তি। বিভাজনমূলক প্রস্তাব বা অপ্রয়োজনীয় প্রশাসনিক কাঠামো পরিবর্তনের উদ্যোগ এই ঐক্যকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। এর পরিবর্তে, একীভূত উন্নয়নের দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করা উচিত, যা সারা দেশের মানুষের জন্য সুষম উন্নয়নের পথ খুলে দেবে। সঠিক পরিকল্পনা এবং কার্যকর প্রশাসনিক কাঠামোর মাধ্যমে বাংলাদেশ তার সম্ভাবনার সর্বোচ্চ সীমায় পৌঁছাতে সক্ষম হবে। এটি শুধু আমাদের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে ত্বরান্বিত করবে না, বরং একটি সমৃদ্ধ, স্থিতিশীল এবং ঐক্যবদ্ধ জাতি গঠনে সহায়ক হবে।
[লেখক: প্রতিষ্ঠাতা সদস্য, পলিসি ওয়াচ বাংলাদেশ]
রন্টি চৌধুরী
শনিবার, ২৫ জানুয়ারী ২০২৫
বাংলাদেশে প্রদেশ গঠনের প্রস্তাব সাম্প্রতিক সময়ে আলোচনায় উঠে এসেছে। কিছু মহল দাবি করছেন, প্রদেশ গঠনের মাধ্যমে প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণ নিশ্চিত করা যাবে, ঢাকার ওপর চাপ কমবে এবং আঞ্চলিক উন্নয়নের পথ খুলে যাবে। তবে বাস্তবতা হলো, এই প্রস্তাবটি অপ্রয়োজনীয়, ব্যয়বহুল এবং দীর্ঘমেয়াদে জাতীয় ঐক্য ও স্থিতিশীলতার জন্য ক্ষতিকর। বাংলাদেশে ইতোমধ্যেই আটটি প্রশাসনিক বিভাগ রয়েছে। সেগুলো কার্যকরভাবে পরিচালনা করলেই প্রদেশ গঠনের মাধ্যমে যা অর্জন করা সম্ভব বলে দাবি করা হচ্ছে, তা অনেক কম খরচে এবং জটিলতা ছাড়াই অর্জন করা সম্ভব।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রদেশ বা রাজ্যভিত্তিক প্রশাসনিক কাঠামো দুটি মূল কারণে গড়ে ওঠে। প্রথমত, ভাষা, সংস্কৃতি এবং জাতিগত বৈচিত্র্যের কারণে পৃথক পরিচয় ও স্বায়ত্তশাসনের প্রয়োজন হলে প্রদেশ গঠন করা হয়। ভারতের রাজ্যগুলো তার একটি স্পষ্ট উদাহরণ। প্রতিটি রাজ্যের নিজস্ব ভাষা, সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্য রয়েছে। তামিলনাড়– তামিল সংস্কৃতির, পাঞ্জাব শিখ সংস্কৃতির, এবং গুজরাট গুজরাটি সংস্কৃতির প্রতিনিধিত্ব করে। একইভাবে, পাকিস্তানের পাঞ্জাব, সিন্ধ, বেলুচিস্তান এবং খাইবার পাখতুনখোয়া প্রদেশগুলো আলাদা জাতিগোষ্ঠী এবং ভাষার ভিত্তিতে গঠিত।
দ্বিতীয়ত, বড় ভৌগোলিক বিস্তৃতি এবং জনসংখ্যার চাপ সামলানোর জন্য প্রদেশ বা রাজ্যভিত্তিক প্রশাসনিক কাঠামো তৈরি করা হয়।
কিন্তু বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট এসব দেশের তুলনায় ভিন্ন। আমাদের দেশে সিংহভাগ মানুষ একই ভাষা, সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যের অংশ। এখানে ভৌগোলিক বিস্তৃতি সীমিত। এই বাস্তবতায় প্রদেশ গঠন করার মাধ্যমে যা অর্জন করার কথা বলা হচ্ছে, তা একটি বিভ্রান্তিকর এবং অপ্রয়োজনীয় প্রস্তাব।
প্রদেশ গঠনের অন্যতম বড় ঝুঁকি হলো জাতীয় ঐক্য এবং স্থিতিশীলতা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া। বর্তমানে বাংলাদেশ আটটি বিভাগে বিভক্ত। এই বিভাগগুলো আলাদা প্রশাসনিক কাঠামো হিসেবে কাজ করছে, যদিও সেগুলো এখনও পূর্ণ সক্ষমতার সঙ্গে পরিচালিত হচ্ছে না। যদি চারটি প্রদেশ গঠন করা হয়, তাহলে বাকি চারটি বিভাগ নিজেদের অবহেলিত এবং বৈষম্যের শিকার মনে করতে পারে। এর ফলে আঞ্চলিক প্রতিযোগিতা এবং গণ-আন্দোলনের ঝুঁকি বেড়ে যাবে। বাংলাদেশে এখনও পর্যন্ত অন্ততপক্ষে অঞ্চলভিত্তিক ধরনের রেষারেষি নেই। শুধু পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে যে সমস্যা রয়েছে সেটা নিয়ে দেশকে হিমশিম খেতে হয়। যেখানে সারাদেশের মানুষের মধ্যে এই অঞ্চলভিত্তিক সমস্যার কোন অস্তিত্ব নেই সেখানে কেন প্রদেশ গঠন করে এক একটা অঞ্চলকে আলাদা একটা ঝামেলার মধ্যে নিয়ে ফেলা? সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেটি বড় ঝামেলা হয়ে উঠতে পারে। এই ছোট্ট দেশে সবাই মিলে মিশে থাকে সেখানে অঞ্চলভিত্তিক ভেদাভেদ বাড়িয়ে দেয়ার জন্য প্রদেশে প্রদেশের ভাগ করার কোন যুক্তি হতে পারে না।
এমনকি যদি চারটি প্রদেশ হলে সমালোচনা হয় ভেবে আটটি বিভাগকে প্রদেশে রূপান্তর করার প্রস্তাবও দেয়া হয়, সেটি হবে অত্যন্ত ব্যয়বহুল এবং অপ্রয়োজনীয়। প্রতিটি প্রদেশের জন্য নতুন প্রশাসনিক কাঠামো, মন্ত্রণালয়, আইনসভা এবং কর্মকর্তাদের নিয়োগ করতে প্রচুর অর্থের প্রয়োজন হবে। নতুন প্রদেশ গঠনের মাধ্যমে সরকারের ব্যয়ের চাপ বহুগুণে বাড়বে। প্রতিটি প্রদেশের জন্য নতুন প্রশাসনিক ভবন, কর্মকর্তাদের বাসস্থান, যানবাহন এবং অন্যান্য লজিস্টিক সুবিধার প্রয়োজন হবে। প্রাদেশিক সরকার করতে হবে এবং মাথা ভারি নতুন আরেকটি প্রশাসন তৈরি হবে। দেশে একটি সরকারের জায়গায় আটটি প্রাদেশিক সরকার তৈরি হবে এবং সেই সমস্ত সরকারের সঙ্গে কেন্দ্রীয় সরকারের সমন্বয়ের একটা সমস্যা তৈরি হবে। কোন প্রদেশের কোন রাজনৈতিক দলের সরকার হবে সেগুলো নিয়ে একটা অসুস্থ প্রতিযোগিতা তৈরি হতে পারে এবং কয়েক দশক পর যদি দেখা যায় যে প্রদেশভিত্তিক রাজনৈতিক কলহ তৈরি হয়েছে সেটা হবে দেশের জন্য বিপর্যয়কর।
এই প্রদেশে প্রদেশে ভাগ করার পরিকল্পনায় একে তো বিভাজনের ঝুঁকি আরো থাকছে রাষ্ট্রীয় অর্থ অপচয়ের ঝুঁকি। এটি করে আসলে প্রাপ্তি কি হবে? কেউ কেউ বলবেন যে এটি করে রাজধানী ঢাকার ওপরে চাপ কমবে, দেশে বিকেন্দ্রীকরণ হবে। কিন্তু বিকেন্দ্রীকরণ করতে হলে নতুন করে প্রাদেশিক সিস্টেম চালু করতে হয় না, বরং বর্তমানে যে ব্যবস্থা চালু আছে সেটি কার্যকর করার মাধ্যমেই বিকেন্দ্রীকরণ করা সহজেই যায়।
ঢাকার ওপর প্রশাসনিক চাপ কমানোর জন্য বিভিন্ন মন্ত্রণালয় এবং সরকারি দপ্তরকে বিভাগীয় শহরে স্থানান্তর করা একটি কার্যকর সমাধান। বর্তমানে ঢাকায় প্রশাসনিক এবং অর্থনৈতিক কার্যক্রম কেন্দ্রীভূত হওয়ায় রাজধানী চরম জনসংখ্যা এবং যানজটের শিকার। ঢাকার চাপ কমাতে নৌপরিবহন ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে চট্টগ্রামে স্থানান্তর করা যেতে পারে। এটি দেশের প্রধান সমুদ্রবন্দর চট্টগ্রামের কার্যক্রম আরও শক্তিশালী করবে।
কৃষি মন্ত্রণালয়কে রাজশাহীতে সরিয়ে নেয়া হলে দেশের কৃষি উৎপাদনশীলতায় সরাসরি ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। খুলনায় পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় এবং মৎস্য মন্ত্রণালয় স্থাপন করা হলে সুন্দরবন ও উপকূলীয় এলাকার সুরক্ষা আরও কার্যকরভাবে নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। সিলেটে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় স্থাপন করা হলে প্রবাসী বাংলাদেশিদের সেবা পাওয়া সহজ হবে এবং পর্যটন শিল্প উন্নত হবে। ময়মনসিংহে প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় স্থাপন করলে দেশের প্রাণিসম্পদ খাতের উন্নয়ন ত্বরান্বিত হবে।
বিচারব্যবস্থার ক্ষেত্রেও ঢাকার ওপর নির্ভরশীলতা কমানো অত্যন্ত জরুরি। বর্তমানে একটি মাত্র হাইকোর্ট ঢাকায় কেন্দ্রীভূত। এর ফলে সারাদেশের বিচারপ্রার্থীদের ঢাকায় এসে মামলা পরিচালনা করতে হয়, যা সময় ও অর্থের অপচয় ঘটায়। প্রতিটি বিভাগীয় শহরে হাইকোর্ট বেঞ্চ স্থাপন করা হলে বিচারপ্রার্থীদের সময় এবং অর্থ সাশ্রয় হবে। ভারতে প্রতিটি রাজ্যে হাইকোর্ট বেঞ্চ থাকার কারণে তাদের বিচারব্যবস্থা অনেক বেশি কার্যকর। বাংলাদেশেও একই ব্যবস্থা চালু করা হলে মামলার জট কমবে এবং বিচারপ্রক্রিয়া আরও সহজ হবে।
সংসদ সদস্যদের ভূমিকার ক্ষেত্রেও বড় পরিবর্তন আনা দরকার। বাংলাদেশের সংসদ সদস্যরা আইন প্রণয়নের পরিবর্তে উন্নয়ন প্রকল্পের তদারকিতে বেশি মনোযোগী হয়ে পড়েন। এতে স্থানীয় সরকার এবং প্রশাসন দুর্বল হয়ে পড়ে। সংসদ সদস্যদের মূল কাজ হলো আইন প্রণয়ন এবং জাতীয় নীতি নির্ধারণ। তাদের এই কাজের মধ্যে সীমাবদ্ধ রেখে স্থানীয় উন্নয়নের দায়িত্ব স্থানীয় সরকার এবং বিভাগীয় প্রশাসনের হাতে তুলে দেয়া উচিত।
এরশাদ শাসনামলে অনেক খারাপ কাজের মধ্যে একটি ভালো কাজ ছিল উপজেলা পদ্ধতি চালু করা। এটির মাধ্যমে স্থানীয় উন্নয়নের দায়িত্ব উপজেলা চেয়ারম্যানদের হাতে ন্যস্ত করা হয়েছিল। এই ব্যবস্থাটি প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণের একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ ছিল, যা জনগণের কাছে সেবা পৌঁছে দেয়ার লক্ষ্য নিয়ে গৃহীত হয়। তবে এরশাদের পতনের পর গণতান্ত্রিক সরকারের অধীনে, উপজেলা চেয়ারম্যানদের ক্ষমতা ক্রমশ হ্রাস করা হয়। এটি মূলত সংসদ সদস্যদের সর্বময় ক্ষমতা নিশ্চিত করার একটি কৌশল হিসেবে বাস্তবায়িত হয়।
এই পরিবর্তনের ফলে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার ওপর সংসদ সদস্যদের রাজনৈতিক প্রভাব বেড়ে যায় এবং স্থানীয় উন্নয়ন প্রকৃত বিকেন্দ্রীকরণের বাইরে চলে যায়। প্রকৃতপক্ষে, একটি গণতান্ত্রিক কাঠামো নিশ্চিত করতে হলে, জনগণের ভোটে নির্বাচিত স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের হাতে উন্নয়নের দায়িত্ব দিতে হবে। যদি সংসদ সদস্যরা আইন প্রণয়ন এবং জাতীয় নীতি নির্ধারণের বাইরে এসে স্থানীয় উন্নয়নে হস্তক্ষেপ করেন, তবে এটি দেশের উন্নয়ন প্রক্রিয়াকে স্থবির করে তুলবে। তাই স্থানীয় সরকার ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করা, এবং সংসদ সদস্যদের তাদের সাংবিধানিক দায়িত্বে সীমাবদ্ধ রাখা, দেশের সার্বিক উন্নয়নের জন্য অপরিহার্য।
বিভাগগুলোর কার্যক্রম উন্নত করার জন্য প্রতিটি বিভাগে আধুনিক অবকাঠামো গড়ে তোলা, মানসম্মত হাসপাতাল এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করা এবং শিল্পায়নের উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন। যেগুলো এখনই বিভিন্ন বিভাগে তৈরি করা হয়ে গেছে। সেগুলোকে আরও উন্নত করতে হবে যাতে সেগুলো ঢাকা থেকে সেবা পাওয়া যায় ঠিক একই রকম সেবা দিতে পারে। প্রতিটি বিভাগে বিশেষ অর্থনৈতিক জোন গড়ে তোলা হলে স্থানীয় কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পাবে। রেল এবং সড়ক যোগাযোগ উন্নয়নের মাধ্যমে বিভাগীয় শহরগুলোর সঙ্গে ঢাকার সরাসরি সংযোগ নিশ্চিত করা যেতে পারে।
জাতীয় ঐক্য বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় শক্তি। বিভাজনমূলক প্রস্তাব বা অপ্রয়োজনীয় প্রশাসনিক কাঠামো পরিবর্তনের উদ্যোগ এই ঐক্যকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। এর পরিবর্তে, একীভূত উন্নয়নের দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করা উচিত, যা সারা দেশের মানুষের জন্য সুষম উন্নয়নের পথ খুলে দেবে। সঠিক পরিকল্পনা এবং কার্যকর প্রশাসনিক কাঠামোর মাধ্যমে বাংলাদেশ তার সম্ভাবনার সর্বোচ্চ সীমায় পৌঁছাতে সক্ষম হবে। এটি শুধু আমাদের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে ত্বরান্বিত করবে না, বরং একটি সমৃদ্ধ, স্থিতিশীল এবং ঐক্যবদ্ধ জাতি গঠনে সহায়ক হবে।
[লেখক: প্রতিষ্ঠাতা সদস্য, পলিসি ওয়াচ বাংলাদেশ]