alt

উপ-সম্পাদকীয়

নারীর ভূমি ও কৃষি অধিকার : ন্যায়বিচারের পথে কতদূর?

সানজিদা খান রিপা

: রোববার, ০৯ মার্চ ২০২৫

বাংলাদেশে সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ নারীর ভূমি ও কৃষি অধিকার বিষয়টি রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে দীর্ঘদিন ধরে উপেক্ষিত। যার কারণে, নারীসমাজ থেকে উত্থাপিত ভূমি ও কৃষি অধিকারের দাবিটি এখনো কাক্সিক্ষত জায়গায় পৌঁছায়নি। যদিও সংবিধান নারীর সমানাধিকারের নিশ্চয়তা দেয়, কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন চিত্র তুলে ধরে। পারিবারিক আইন, সামাজিক রীতি, নীতিগত সীমাবদ্ধতা এবং আইনি ও প্রশাসনিক জটিলতা নারীদের ভূমি ও কৃষি অধিকার থেকে বঞ্চিত করছে। পিতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা নারীদের ভূমির মালিকানা থেকে দূরে রাখছে, যা তাদের অর্থনৈতিক স্বাবলম্বিতা, সামাজিক মর্যাদা এবং রাজনৈতিক ক্ষমতায়নকে বাধাগ্রস্ত করছে।

আইনি ও সামাজিক প্রতিবন্ধকতা

বাংলাদেশের বিদ্যমান উত্তরাধিকার আইন ধর্মভিত্তিক হওয়ায় নারীরা সমান অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। মুসলিম উত্তরাধিকার আইনে নারীরা পুরুষের তুলনায় অর্ধেক সম্পত্তির ভাগ পান, আর

হিন্দু নারীদের ক্ষেত্রে উত্তরাধিকারের সুযোগই নেই। পাহাড় ও সমতলে বসবাসরত আদিবাসী নারীরাও আইনি জটিলতার কারণে সম্পত্তির অধিকার পান না। যদিও খাসজমি বরাদ্দ নীতিতে নারীদের অগ্রাধিকার দেয়ার কথা বলা হয়েছে, কিন্তু বাস্তবে তারা খুব কমই এই সুবিধা পান। সমাজের প্রচলিত ধ্যান-ধারণা নারীকে সম্পদের মালিক নয়, বরং ভোক্তা হিসেবে দেখে। অধিকাংশ পরিবারেই নারীদের নামে জমি নিবন্ধন করা হয় না। ভূমি ব্যবস্থাপনা প্রক্রিয়ায় জটিলতা এবং ব্যয়বহুল আইনি ও প্রশাসনিক কাঠামোর কারণে দরিদ্র ও প্রান্তিক নারীরা ভূমি অধিকার থেকে বঞ্চিত হন। তদুপরি, নারীদের ভূমি অধিকার সম্পর্কে সচেতনতার অভাব এবং ভূমি অফিসে তাদের কম উপস্থিতিও এই সমস্যাকে দীর্ঘস্থায়ী করছে।

বিদ্যমান পিতৃতান্ত্রিক সমাজে নারীর ভূমি অধিকার নিশ্চিত করার চেয়ে ভূমিহীন রাখা যেন অনেকটাই স্বাভাবিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। পিতৃতন্ত্রের মূল বৈশিষ্ট্যই হলো, নারীর ওপর নিয়ন্ত্রণ কায়েম রাখা। পুরুষ যা পারে, নারী তা পারে না- এই বিশ্বাস থেকেই নারীদের ভূমির মতো গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ থেকে দূরে রাখা হয়। অধিকাংশ নারী গৃহস্থালির পরিচর্যামূলক কাজে এতটাই ব্যস্ত থাকেন যে, তারা ভূমির মালিকানা বা নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ভাবারও সুযোগ পান না। নারীর কৃষি অধিকার ও অবমূল্যায়ন বাংলাদেশের অর্থনীতিতে নারীদের কৃষিতে বিশাল অবদান থাকলেও তাদের আইনগতভাবে কৃষক হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয় না। ফলে তারা সরকারি কৃষি প্রণোদনা, সহজ শর্তে ঋণ ও প্রশিক্ষণ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হন। কৃষিক্ষেত্রে নারীর শ্রম অবমূল্যায়িত, এবং তারা পুরুষদের তুলনায় কম মজুরি পান। ফসলের বাজারজাতকরণেও নারীরা পিছিয়ে থাকেন, কারণ তাদের সামাজিক ও কাঠামোগত প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করতে হয়। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) এর ‘স্ট্যাটাস অব উইমেন ইন এগ্রিকালচার সিস্টেম- ২০২৩ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের কৃষিতে নারীদের অংশগ্রহণ দ্রুতগতিতে বৃদ্ধি পাচ্ছে। ২০০৫ সালে যেখানে কৃষিক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ ছিল ৩৬.২ শতাংশ; ২০১৯ সালে তা বৃদ্ধি পেয়ে ৪৫.৩ শতাংশে পৌঁছেছে, যা বিশ্বে সর্বোচ্চ বৃদ্ধির হার। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০২২ সালের সমীক্ষা

অনুযায়ী, দেশের মোট শ্রমশক্তিতে নারীর অংশগ্রহণ ৪২.৬৮ শতাংশ, যেখানে পাঁচ বছর আগে এটি ছিল ৩৬.৩ শতাংশ। এবং কৃষি শ্রমশক্তির ৫৮ শতাংশই নারী এবং মোট নারী শ্রমশক্তির সিংহভাগই (৭৪%) কৃষিতে নিয়োজিত।

যদিও নারীরা কৃষিতে বিশাল ভূমিকা রাখছেন, অথচ তারা এখনো ভূমির মালিকানা, প্রযুক্তি, আর্থিক সুবিধা এবং অন্যান্য কৃষি সম্পদ থেকে বঞ্চিত। পিতৃতান্ত্রিক ধ্যান-ধারণা এবং সামাজিক রীতিনীতির কারণে নারীরা কৃষিক্ষেত্রে সমান সুযোগ পান না এবং নীতি নির্ধারণ প্রক্রিয়ায় তাদের অংশগ্রহণ কম।

এক সময় গ্রামীণ নারীরা কৃষিতে বীজ সংরক্ষণ, নির্বাচন, শুকানো ও বিনিময়ের পুরো প্রক্রিয়াটি পরিচালনা করতেন। কিন্তু তথাকথিত সবুজ বিপ্লবের পর বহুজাতিক কর্পোরেশনগুলো যেমন মনসান্তো, সিনজেন্টা, ডুপন্ট ইত্যাদি বাংলাদেশের কৃষিতে আধিপত্য বিস্তার করেছে।

যা নারী কৃষকদের বীজের ওপর থেকে নিয়ন্ত্রণ কেড়ে নিয়েছে। অতীতে যে নারীরা কৃষিক্ষেত্রে বীজ সংরক্ষণের নেতৃত্ব দিতেন, আজ তারা কর্পোরেট গার্মেন্টস কারখানায় শ্রমিক হিসেবে কাজ করতে বাধ্য হচ্ছেন।

নারীর ভূমি অধিকার, সামাজিক মর্যাদা ও রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন নারীর ভূমি ও কৃষি অধিকার শুধু অর্থনৈতিক বিষয় নয়, এটি রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের সঙ্গেও ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ভূমির মালিকানাহীন একজন নারী সমাজে দুর্বল এবং সহিংসতার শিকার

হওয়ার ঝুঁকিতে থাকেন। বরং যে নারীদের ভূমি বা সম্পত্তির মালিকানা রয়েছে, তাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা বেশি থাকে। ভূমি ও সম্পদের মালিকানা নারীর সামাজিক মর্যাদা ও নিরাপত্তা

বৃদ্ধি করে এবং তাদের আত্মনির্ভরশীল হতে সহায়তা করে। পরিবারের ভিতরেও নারীর ভূমি মালিকানা তার মতামতকে গুরুত্ব দেওয়ার পথ তৈরি করে এবং পারিবারিক সম্পদ ব্যবস্থাপনায় তার ভূমিকা সুদৃঢ় করে।

নারীর ভূমি ও কৃষি অধিকার নিশ্চিত করতে বিদ্যমান আইনের সংস্কার অপরিহার্য। উত্তরাধিকার আইনকে নারীবান্ধব করে সমান অধিকারের নিশ্চয়তা প্রদান করতে হবে। নারীদের নামে জমি নিবন্ধনের হার বাড়াতে সরকারকে উদ্যোগ নিতে হবে এবং নিবন্ধন ব্যয় কমাতে হবে, যাতে দরিদ্র ও প্রান্তিক নারীরা এই সুযোগ গ্রহণ করতে পারেন। কৃষিক্ষেত্রে নারীদের শ্রমের স্বীকৃতি দিয়ে সরকারি নীতিমালায় তাদের অন্তর্ভূক্ত করতে হবে এবং কৃষি প্রণোদনা, সহজ ঋণ সুবিধা ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। শ্রম বাজারে নারী-পুরুষের সমমজুরি নিশ্চিত করতে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা দরকার। পাশাপাশি, নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা প্রতিরোধে ভূমি অধিকারকে একটি কার্যকর হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে, কারণ সম্পত্তির মালিকানা নারীদের আর্থিকভাবে স্বাধীন করে এবং তাদের ওপর নির্যাতনের হার হ্রাস করে।

নারীর ভূমি ও কৃষি অধিকার নিশ্চিত করা কেবল তাদের জন্য নয়, এটি একটি সামগ্রিক অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের বিষয়ও। নারীরা যদি ভূমির মালিকানা পান, তবে তা তাদের আর্থিক নিরাপত্তা, সামাজিক মর্যাদা এবং রাজনৈতিক ক্ষমতায়নকে শক্তিশালী করবে। সরকারের সদিচ্ছা, আইনগত সংস্কার, এবং সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনই পারে নারীদের ন্যায্য অধিকার ফিরিয়ে দিতে। আমরা কি প্রস্তুত নারীদের সমান অধিকারের পথে একধাপ এগিয়ে যেতে?

[ লেখক : উন্নয়ন ও মানবাধিকার কর্মী ]

শুভ-অশুভ বলে কিছু কি আছে

পহেলা বৈশাখের সঙ্গে মিশে আছে কৃষি ও কৃষক

বাংলাদেশে ঘটনা অঘটন: প্রায় সবক্ষেত্রেই ইস্যু নির্বাচন

ছবি

নববর্ষ বাঙালি সংস্কৃতির বৈচিত্র্য ও বহুত্ববাদ

বৈসাবি : সম্মিলনের জাতীয় উৎসব

সংকট ও সংক্রান্তির শক্তি

ছবি

গাজার অশ্রু : ইসরায়েলের বর্বরতা ও বিশ্বের নীরবতা

দেশের কৃষি অর্থনীতির নীরব নায়িকারা

বহুমাত্রিক দ্বন্দ্বের ফেরে বিএনপি ও এনসিপি

ফৌজদারি মামলায় অপরাধের আলামত উদ্ধারে আইন মানতে বাধা কোথায়?

জলবায়ুর নতুন ছকে বদলে যাচ্ছে কৃষির ভবিষ্যৎ

ভারতে ওয়াকফ সংশোধনী আইন নিয়ে বিতর্ক

কীটনাশকের বিষচক্র : উন্নয়নের নামে শোষণ ও বিপর্যয়

বোরো ধান উৎপাদনে প্রধান অন্তরায় বিদ্যুৎ-বিভ্রাট

ঢাকার বাসিন্দাদের নিঃশ্বাসে এক বিপন্নতা

‘রিফাইন্ড’ আওয়ামী লীগ হলে ‘ওয়াশিং মেশিন পার্টি’ বেকার হয়ে পড়বে না তো!

গণঅভ্যুত্থান-উত্তর বাংলাদেশে সংক্ষুব্ধ ‘আমরা’ কারা?

বাসন্তী পূজা

বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস : বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবার চিত্র

মার্কিন নীতির পরিবর্তনে ইউক্রেনের পরিণতি

গাজা : ক্রমবর্ধমান মানবিক ও রাজনৈতিক সংকট

নিষিদ্ধ পলিথিনে বিপন্ন প্রকৃতি

রাজনৈতিক রূপান্তরের এক সতর্কবার্তা

ধর্ষণের বিরুদ্ধে লড়াই : আইনের শক্তি ও সমাজের দুর্বলতা

বৈষম্যমুক্ত সমাজ বিনির্মাণে গণমুখী শিক্ষা

ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে ভারতকে বাঁচাতে বাম উদ্যোগ

ছবি

পিরোজপুরের ডিসিকে হারিয়ে দিলেন লালমনিরহাটের ডিসি!

জমি-জমার রেকর্ড সংশোধনে নতুন পরিপত্র ও প্রাসঙ্গিক আইন

র্অথনতৈকি উন্নয়নে জাকাতরে ভূমকিা

কবে মিলবে নতুন নোট

আইনস্টাইনের দেশে

আওয়ামী লীগ থেকে অন্য দলগুলো কি শিক্ষা গ্রহণ করবে?

আজি নূতন রতনে ভূষণে যতনে...

ঈদে বাড়ি ফেরা নিরাপদ হোক

পেঁয়াজের আদ্যোপান্ত

রঙ্গব্যঙ্গ : ‘প্রতিধ্বনি শুনি আমি, প্রতিধ্বনি শুনি...’

tab

উপ-সম্পাদকীয়

নারীর ভূমি ও কৃষি অধিকার : ন্যায়বিচারের পথে কতদূর?

সানজিদা খান রিপা

রোববার, ০৯ মার্চ ২০২৫

বাংলাদেশে সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ নারীর ভূমি ও কৃষি অধিকার বিষয়টি রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে দীর্ঘদিন ধরে উপেক্ষিত। যার কারণে, নারীসমাজ থেকে উত্থাপিত ভূমি ও কৃষি অধিকারের দাবিটি এখনো কাক্সিক্ষত জায়গায় পৌঁছায়নি। যদিও সংবিধান নারীর সমানাধিকারের নিশ্চয়তা দেয়, কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন চিত্র তুলে ধরে। পারিবারিক আইন, সামাজিক রীতি, নীতিগত সীমাবদ্ধতা এবং আইনি ও প্রশাসনিক জটিলতা নারীদের ভূমি ও কৃষি অধিকার থেকে বঞ্চিত করছে। পিতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা নারীদের ভূমির মালিকানা থেকে দূরে রাখছে, যা তাদের অর্থনৈতিক স্বাবলম্বিতা, সামাজিক মর্যাদা এবং রাজনৈতিক ক্ষমতায়নকে বাধাগ্রস্ত করছে।

আইনি ও সামাজিক প্রতিবন্ধকতা

বাংলাদেশের বিদ্যমান উত্তরাধিকার আইন ধর্মভিত্তিক হওয়ায় নারীরা সমান অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। মুসলিম উত্তরাধিকার আইনে নারীরা পুরুষের তুলনায় অর্ধেক সম্পত্তির ভাগ পান, আর

হিন্দু নারীদের ক্ষেত্রে উত্তরাধিকারের সুযোগই নেই। পাহাড় ও সমতলে বসবাসরত আদিবাসী নারীরাও আইনি জটিলতার কারণে সম্পত্তির অধিকার পান না। যদিও খাসজমি বরাদ্দ নীতিতে নারীদের অগ্রাধিকার দেয়ার কথা বলা হয়েছে, কিন্তু বাস্তবে তারা খুব কমই এই সুবিধা পান। সমাজের প্রচলিত ধ্যান-ধারণা নারীকে সম্পদের মালিক নয়, বরং ভোক্তা হিসেবে দেখে। অধিকাংশ পরিবারেই নারীদের নামে জমি নিবন্ধন করা হয় না। ভূমি ব্যবস্থাপনা প্রক্রিয়ায় জটিলতা এবং ব্যয়বহুল আইনি ও প্রশাসনিক কাঠামোর কারণে দরিদ্র ও প্রান্তিক নারীরা ভূমি অধিকার থেকে বঞ্চিত হন। তদুপরি, নারীদের ভূমি অধিকার সম্পর্কে সচেতনতার অভাব এবং ভূমি অফিসে তাদের কম উপস্থিতিও এই সমস্যাকে দীর্ঘস্থায়ী করছে।

বিদ্যমান পিতৃতান্ত্রিক সমাজে নারীর ভূমি অধিকার নিশ্চিত করার চেয়ে ভূমিহীন রাখা যেন অনেকটাই স্বাভাবিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। পিতৃতন্ত্রের মূল বৈশিষ্ট্যই হলো, নারীর ওপর নিয়ন্ত্রণ কায়েম রাখা। পুরুষ যা পারে, নারী তা পারে না- এই বিশ্বাস থেকেই নারীদের ভূমির মতো গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ থেকে দূরে রাখা হয়। অধিকাংশ নারী গৃহস্থালির পরিচর্যামূলক কাজে এতটাই ব্যস্ত থাকেন যে, তারা ভূমির মালিকানা বা নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ভাবারও সুযোগ পান না। নারীর কৃষি অধিকার ও অবমূল্যায়ন বাংলাদেশের অর্থনীতিতে নারীদের কৃষিতে বিশাল অবদান থাকলেও তাদের আইনগতভাবে কৃষক হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয় না। ফলে তারা সরকারি কৃষি প্রণোদনা, সহজ শর্তে ঋণ ও প্রশিক্ষণ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হন। কৃষিক্ষেত্রে নারীর শ্রম অবমূল্যায়িত, এবং তারা পুরুষদের তুলনায় কম মজুরি পান। ফসলের বাজারজাতকরণেও নারীরা পিছিয়ে থাকেন, কারণ তাদের সামাজিক ও কাঠামোগত প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করতে হয়। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) এর ‘স্ট্যাটাস অব উইমেন ইন এগ্রিকালচার সিস্টেম- ২০২৩ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের কৃষিতে নারীদের অংশগ্রহণ দ্রুতগতিতে বৃদ্ধি পাচ্ছে। ২০০৫ সালে যেখানে কৃষিক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ ছিল ৩৬.২ শতাংশ; ২০১৯ সালে তা বৃদ্ধি পেয়ে ৪৫.৩ শতাংশে পৌঁছেছে, যা বিশ্বে সর্বোচ্চ বৃদ্ধির হার। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০২২ সালের সমীক্ষা

অনুযায়ী, দেশের মোট শ্রমশক্তিতে নারীর অংশগ্রহণ ৪২.৬৮ শতাংশ, যেখানে পাঁচ বছর আগে এটি ছিল ৩৬.৩ শতাংশ। এবং কৃষি শ্রমশক্তির ৫৮ শতাংশই নারী এবং মোট নারী শ্রমশক্তির সিংহভাগই (৭৪%) কৃষিতে নিয়োজিত।

যদিও নারীরা কৃষিতে বিশাল ভূমিকা রাখছেন, অথচ তারা এখনো ভূমির মালিকানা, প্রযুক্তি, আর্থিক সুবিধা এবং অন্যান্য কৃষি সম্পদ থেকে বঞ্চিত। পিতৃতান্ত্রিক ধ্যান-ধারণা এবং সামাজিক রীতিনীতির কারণে নারীরা কৃষিক্ষেত্রে সমান সুযোগ পান না এবং নীতি নির্ধারণ প্রক্রিয়ায় তাদের অংশগ্রহণ কম।

এক সময় গ্রামীণ নারীরা কৃষিতে বীজ সংরক্ষণ, নির্বাচন, শুকানো ও বিনিময়ের পুরো প্রক্রিয়াটি পরিচালনা করতেন। কিন্তু তথাকথিত সবুজ বিপ্লবের পর বহুজাতিক কর্পোরেশনগুলো যেমন মনসান্তো, সিনজেন্টা, ডুপন্ট ইত্যাদি বাংলাদেশের কৃষিতে আধিপত্য বিস্তার করেছে।

যা নারী কৃষকদের বীজের ওপর থেকে নিয়ন্ত্রণ কেড়ে নিয়েছে। অতীতে যে নারীরা কৃষিক্ষেত্রে বীজ সংরক্ষণের নেতৃত্ব দিতেন, আজ তারা কর্পোরেট গার্মেন্টস কারখানায় শ্রমিক হিসেবে কাজ করতে বাধ্য হচ্ছেন।

নারীর ভূমি অধিকার, সামাজিক মর্যাদা ও রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন নারীর ভূমি ও কৃষি অধিকার শুধু অর্থনৈতিক বিষয় নয়, এটি রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের সঙ্গেও ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ভূমির মালিকানাহীন একজন নারী সমাজে দুর্বল এবং সহিংসতার শিকার

হওয়ার ঝুঁকিতে থাকেন। বরং যে নারীদের ভূমি বা সম্পত্তির মালিকানা রয়েছে, তাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা বেশি থাকে। ভূমি ও সম্পদের মালিকানা নারীর সামাজিক মর্যাদা ও নিরাপত্তা

বৃদ্ধি করে এবং তাদের আত্মনির্ভরশীল হতে সহায়তা করে। পরিবারের ভিতরেও নারীর ভূমি মালিকানা তার মতামতকে গুরুত্ব দেওয়ার পথ তৈরি করে এবং পারিবারিক সম্পদ ব্যবস্থাপনায় তার ভূমিকা সুদৃঢ় করে।

নারীর ভূমি ও কৃষি অধিকার নিশ্চিত করতে বিদ্যমান আইনের সংস্কার অপরিহার্য। উত্তরাধিকার আইনকে নারীবান্ধব করে সমান অধিকারের নিশ্চয়তা প্রদান করতে হবে। নারীদের নামে জমি নিবন্ধনের হার বাড়াতে সরকারকে উদ্যোগ নিতে হবে এবং নিবন্ধন ব্যয় কমাতে হবে, যাতে দরিদ্র ও প্রান্তিক নারীরা এই সুযোগ গ্রহণ করতে পারেন। কৃষিক্ষেত্রে নারীদের শ্রমের স্বীকৃতি দিয়ে সরকারি নীতিমালায় তাদের অন্তর্ভূক্ত করতে হবে এবং কৃষি প্রণোদনা, সহজ ঋণ সুবিধা ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। শ্রম বাজারে নারী-পুরুষের সমমজুরি নিশ্চিত করতে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা দরকার। পাশাপাশি, নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা প্রতিরোধে ভূমি অধিকারকে একটি কার্যকর হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে, কারণ সম্পত্তির মালিকানা নারীদের আর্থিকভাবে স্বাধীন করে এবং তাদের ওপর নির্যাতনের হার হ্রাস করে।

নারীর ভূমি ও কৃষি অধিকার নিশ্চিত করা কেবল তাদের জন্য নয়, এটি একটি সামগ্রিক অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের বিষয়ও। নারীরা যদি ভূমির মালিকানা পান, তবে তা তাদের আর্থিক নিরাপত্তা, সামাজিক মর্যাদা এবং রাজনৈতিক ক্ষমতায়নকে শক্তিশালী করবে। সরকারের সদিচ্ছা, আইনগত সংস্কার, এবং সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনই পারে নারীদের ন্যায্য অধিকার ফিরিয়ে দিতে। আমরা কি প্রস্তুত নারীদের সমান অধিকারের পথে একধাপ এগিয়ে যেতে?

[ লেখক : উন্নয়ন ও মানবাধিকার কর্মী ]

back to top