বাবুল রবিদাস
যুক্তরাষ্ট্রে ফসভেল নিষিদ্ধ হওয়ার কিছুদিন পর ভেল সিকল কোম্পানির একজন কর্মকর্তা ঘোষণা দেন যে, এখন থেকে তারা ফসভেল বিদেশে রপ্তানি করবেন। তিনি বলেন, যারা খাদ্যের অভাবে ভুগছে, তাদের জন্য খাদ্যের ব্যবস্থা করায় দোষ কী থাকতে পারে? অধিক খাদ্য উৎপাদনের জন্য কীটনাশকের প্রয়োজনীয়তা কেউ অস্বীকার করতে পারবে না। তবে যে কোনো জিনিসের ব্যবহারে একটি ক্ষতিকর দিক থাকতেই পারে। তাই কীটনাশকের ব্যবহারকে দুর্ভিক্ষ থেকে মুক্তির উপায় হিসেবে গ্রহণ করলে এর ক্ষতিকর দিকটিও মেনে নিতে হবে। এই কর্মকর্তার যুক্তি অনেকের কাছে অকাট্য মনে হতে পারে এবং অনেকে এর সঙ্গে একমতও হতে পারেন। একই ধরনের বক্তব্য দেন রোহ্ম অ্যান্ড হাস কোম্পানির কর্মকর্তারাও। তাদের মতে, ফসভেলের মতো কীটনাশক পোকামাকড় ধ্বংসে ব্যবহারে বিপদ হলেও হতে পারে, কিন্তু তাই বলে অনাহারে মানুষের মৃত্যু মেনে নেওয়া যায় না।০
উন্নয়নশীল দেশগুলোতে ব্যবহৃত কীটনাশকের অর্ধেক, এমনকি অনেক ক্ষেত্রে ৭০ শতাংশ, রপ্তানিযোগ্য ফসল উৎপাদনে ব্যবহৃত হয়। এর বেশিরভাগই যায় ইউরোপ, আমেরিকা ও জাপানে। অভুক্ত ও অর্ধভুক্ত দরিদ্র শ্রমিকরা এই ক্ষেত্রে কীটনাশক ছিটিয়ে বিষাক্ত পদার্থে হাত-পা ও শরীর নোংরা করে বিষক্রিয়ার শিকার হন। ভালো ফলনের জন্য তারা এ দুর্ভোগ সহ্য করেন, কিন্তু সেই ফসলের খাবার তাদের ভাগ্যে কখনো জোটে না। উল্লেখযোগ্য রপ্তানি পণ্যের মধ্যে মধ্য আমেরিকার দিকে তাকালে এমন অনেক ঘটনা চোখে পড়ে। সেখানে বহু মানুষ ক্ষুধা ও অপুষ্টিতে ভুগছেন, অথচ উৎপন্ন কৃষিপণ্যের ৭০ শতাংশ বিদেশে রপ্তানি হয়ে যায়। এর মধ্যে রয়েছে কফি, কোকো ও তুলার মতো পণ্য।
কীটনাশক ব্যবহার হয় এ অঞ্চলের তুলাখেতে। পৃথিবীতে ব্যবহৃত মোট প্যারাথিওনের পাঁচ ভাগের এক ভাগ শুধু এল সালভাদরের মতো ছোট্ট একটি দেশে তুলা উৎপাদনে ব্যবহৃত হয়। প্রতি বর্গমাইল তুলাখেতে বছরে প্রায় ২,১০০ পাউন্ড কীটনাশক ছিটানো হয়, কিন্তু এই তুলা থেকে মানুষের উপযোগী খাদ্য তৈরি হয় না; বরং তা পশুখাদ্যে রূপান্তরিত হয়। এই পশুখাদ্যের বেশিরভাগ ল্যাটিন আমেরিকার বড় বড় পশুপালন খামারে ব্যবহৃত হয়, যার মাংস ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি হয়। বাকি অংশ স্থানীয় ধনী ও মধ্যবিত্তদের ভোগে লাগে। দরিদ্র ও অনাহারীদের ভাগ্যে এর কিছুই জোটে না। অথচ এই কীটনাশকের বিষক্রিয়ায় জন্ম নেয় বিকলাঙ্গ শিশু, ঘটে গর্ভপাত এবং শরীরে দেখা দেয় বিভিন্ন চর্মরোগ।
ইন্দোনেশিয়ার দিকে তাকালে দেখা যায়, সেখানকার রপ্তানিমুখী বৃহৎ কৃষিখামারে প্রচুর পরিমাণে কীটনাশক ব্যবহৃত হয়, যা স্থানীয় বাজারের জন্য উৎপন্ন ছোটখাটো ফসলের খেতে ব্যবহৃত কীটনাশকের তুলনায় প্রায় ২০ গুণ বেশি। অথচ তুলনামূলকভাবে এই ছোট খামারগুলোর একরপ্রতি উৎপাদন বড় খামারের তুলনায় ৭ গুণ বেশি। কেউ কেউ বলতে পারেন, রপ্তানির জন্য উৎপন্ন ফসল গরিবদের ভাগ্যে না জুটলেও, বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের মাধ্যমে তারা নিশ্চয়ই উপকৃত হচ্ছে; কিন্তু তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়ন কর্মকা- বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, এই বৈদেশিক মুদ্রা দরিদ্র কৃষক ও শ্রমিকদের ভাগ্যোন্নয়নে কোনো কাজে আসে না। এতে তাদের দৈনন্দিন আয় বাড়ে না, বাসস্থান, সুচিকিৎসা বা শিক্ষার সুযোগও তৈরি হয় না। বরং এই অর্থ ব্যয় হয় শহরের বিত্তবানদের ভোগবিলাস ও আরাম-আয়েশে।
ল্যাটিন আমেরিকায় বড় বড় জঙ্গল সাফ করে গোচারণভূমি তৈরি করা হচ্ছে। এই কাজে ব্যবহৃত হয় ২, ৪, ৫-টি ও ২, ৪-ডি-এর মতো আগাছা ধ্বংসকারী কেমিক্যাল, যা ‘এজেন্ট অরেঞ্জ’ নামে কুখ্যাত। এর ফলে মাটি ও পানিতে ডাই-অক্সিন নামক অতি তীব্র বিষ তৈরি হয়, যা মানবসৃষ্ট বিষের মধ্যে অন্যতম।
দেশের পত্রপত্রিকার তথ্য অনুযায়ী, দলিত-বঞ্চিত, মজদুর, কৃষক ও শ্রমিকরা কৃষিজমিতে সুরক্ষা সামগ্রী ছাড়াই কীটনাশক প্রয়োগ করেন। ফলে বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হন। এছাড়া কীটনাশক সহজলভ্য হওয়ায় অনেকে তা খেয়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নেন। তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে দৈনিক ১৭৫ জন বিষক্রিয়ায় হাসপাতালে যান, বছরে ৬৪ হাজার রোগী ভর্তি হন, যার মধ্যে উপজেলা হাসপাতালে ২৩ হাজারের বেশি। এটি মোট ভর্তি রোগীর ২ শতাংশ। বিশ্বের অনেক দেশে নিষিদ্ধ এই কীটনাশক বাংলাদেশে এখনো ব্যবহৃত হচ্ছে।
ধনাঢ্যরা খেতে-খামারে কাজ না করায় বিষক্রিয়ার ঝুঁকি থেকে মুক্ত থাকেন; কিন্তু দিনমজুর, দলিত-বঞ্চিত, শ্রমিক ও দরিদ্র কৃষকরা কীটনাশক প্রয়োগের ফলে বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হলে তাদের পূর্ণাঙ্গ চিকিৎসা, ক্ষতিপূরণ ও বিষ প্রতিরোধে প্রয়োজনীয় সুরক্ষা সামগ্রীর জন্য সহযোগিতার দাবি জানাচ্ছেন।
[লেখক : আইনজীবী, জজ কোর্ট, জয়পুরহাট]
বাবুল রবিদাস
বৃহস্পতিবার, ১০ এপ্রিল ২০২৫
যুক্তরাষ্ট্রে ফসভেল নিষিদ্ধ হওয়ার কিছুদিন পর ভেল সিকল কোম্পানির একজন কর্মকর্তা ঘোষণা দেন যে, এখন থেকে তারা ফসভেল বিদেশে রপ্তানি করবেন। তিনি বলেন, যারা খাদ্যের অভাবে ভুগছে, তাদের জন্য খাদ্যের ব্যবস্থা করায় দোষ কী থাকতে পারে? অধিক খাদ্য উৎপাদনের জন্য কীটনাশকের প্রয়োজনীয়তা কেউ অস্বীকার করতে পারবে না। তবে যে কোনো জিনিসের ব্যবহারে একটি ক্ষতিকর দিক থাকতেই পারে। তাই কীটনাশকের ব্যবহারকে দুর্ভিক্ষ থেকে মুক্তির উপায় হিসেবে গ্রহণ করলে এর ক্ষতিকর দিকটিও মেনে নিতে হবে। এই কর্মকর্তার যুক্তি অনেকের কাছে অকাট্য মনে হতে পারে এবং অনেকে এর সঙ্গে একমতও হতে পারেন। একই ধরনের বক্তব্য দেন রোহ্ম অ্যান্ড হাস কোম্পানির কর্মকর্তারাও। তাদের মতে, ফসভেলের মতো কীটনাশক পোকামাকড় ধ্বংসে ব্যবহারে বিপদ হলেও হতে পারে, কিন্তু তাই বলে অনাহারে মানুষের মৃত্যু মেনে নেওয়া যায় না।০
উন্নয়নশীল দেশগুলোতে ব্যবহৃত কীটনাশকের অর্ধেক, এমনকি অনেক ক্ষেত্রে ৭০ শতাংশ, রপ্তানিযোগ্য ফসল উৎপাদনে ব্যবহৃত হয়। এর বেশিরভাগই যায় ইউরোপ, আমেরিকা ও জাপানে। অভুক্ত ও অর্ধভুক্ত দরিদ্র শ্রমিকরা এই ক্ষেত্রে কীটনাশক ছিটিয়ে বিষাক্ত পদার্থে হাত-পা ও শরীর নোংরা করে বিষক্রিয়ার শিকার হন। ভালো ফলনের জন্য তারা এ দুর্ভোগ সহ্য করেন, কিন্তু সেই ফসলের খাবার তাদের ভাগ্যে কখনো জোটে না। উল্লেখযোগ্য রপ্তানি পণ্যের মধ্যে মধ্য আমেরিকার দিকে তাকালে এমন অনেক ঘটনা চোখে পড়ে। সেখানে বহু মানুষ ক্ষুধা ও অপুষ্টিতে ভুগছেন, অথচ উৎপন্ন কৃষিপণ্যের ৭০ শতাংশ বিদেশে রপ্তানি হয়ে যায়। এর মধ্যে রয়েছে কফি, কোকো ও তুলার মতো পণ্য।
কীটনাশক ব্যবহার হয় এ অঞ্চলের তুলাখেতে। পৃথিবীতে ব্যবহৃত মোট প্যারাথিওনের পাঁচ ভাগের এক ভাগ শুধু এল সালভাদরের মতো ছোট্ট একটি দেশে তুলা উৎপাদনে ব্যবহৃত হয়। প্রতি বর্গমাইল তুলাখেতে বছরে প্রায় ২,১০০ পাউন্ড কীটনাশক ছিটানো হয়, কিন্তু এই তুলা থেকে মানুষের উপযোগী খাদ্য তৈরি হয় না; বরং তা পশুখাদ্যে রূপান্তরিত হয়। এই পশুখাদ্যের বেশিরভাগ ল্যাটিন আমেরিকার বড় বড় পশুপালন খামারে ব্যবহৃত হয়, যার মাংস ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি হয়। বাকি অংশ স্থানীয় ধনী ও মধ্যবিত্তদের ভোগে লাগে। দরিদ্র ও অনাহারীদের ভাগ্যে এর কিছুই জোটে না। অথচ এই কীটনাশকের বিষক্রিয়ায় জন্ম নেয় বিকলাঙ্গ শিশু, ঘটে গর্ভপাত এবং শরীরে দেখা দেয় বিভিন্ন চর্মরোগ।
ইন্দোনেশিয়ার দিকে তাকালে দেখা যায়, সেখানকার রপ্তানিমুখী বৃহৎ কৃষিখামারে প্রচুর পরিমাণে কীটনাশক ব্যবহৃত হয়, যা স্থানীয় বাজারের জন্য উৎপন্ন ছোটখাটো ফসলের খেতে ব্যবহৃত কীটনাশকের তুলনায় প্রায় ২০ গুণ বেশি। অথচ তুলনামূলকভাবে এই ছোট খামারগুলোর একরপ্রতি উৎপাদন বড় খামারের তুলনায় ৭ গুণ বেশি। কেউ কেউ বলতে পারেন, রপ্তানির জন্য উৎপন্ন ফসল গরিবদের ভাগ্যে না জুটলেও, বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের মাধ্যমে তারা নিশ্চয়ই উপকৃত হচ্ছে; কিন্তু তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়ন কর্মকা- বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, এই বৈদেশিক মুদ্রা দরিদ্র কৃষক ও শ্রমিকদের ভাগ্যোন্নয়নে কোনো কাজে আসে না। এতে তাদের দৈনন্দিন আয় বাড়ে না, বাসস্থান, সুচিকিৎসা বা শিক্ষার সুযোগও তৈরি হয় না। বরং এই অর্থ ব্যয় হয় শহরের বিত্তবানদের ভোগবিলাস ও আরাম-আয়েশে।
ল্যাটিন আমেরিকায় বড় বড় জঙ্গল সাফ করে গোচারণভূমি তৈরি করা হচ্ছে। এই কাজে ব্যবহৃত হয় ২, ৪, ৫-টি ও ২, ৪-ডি-এর মতো আগাছা ধ্বংসকারী কেমিক্যাল, যা ‘এজেন্ট অরেঞ্জ’ নামে কুখ্যাত। এর ফলে মাটি ও পানিতে ডাই-অক্সিন নামক অতি তীব্র বিষ তৈরি হয়, যা মানবসৃষ্ট বিষের মধ্যে অন্যতম।
দেশের পত্রপত্রিকার তথ্য অনুযায়ী, দলিত-বঞ্চিত, মজদুর, কৃষক ও শ্রমিকরা কৃষিজমিতে সুরক্ষা সামগ্রী ছাড়াই কীটনাশক প্রয়োগ করেন। ফলে বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হন। এছাড়া কীটনাশক সহজলভ্য হওয়ায় অনেকে তা খেয়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নেন। তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে দৈনিক ১৭৫ জন বিষক্রিয়ায় হাসপাতালে যান, বছরে ৬৪ হাজার রোগী ভর্তি হন, যার মধ্যে উপজেলা হাসপাতালে ২৩ হাজারের বেশি। এটি মোট ভর্তি রোগীর ২ শতাংশ। বিশ্বের অনেক দেশে নিষিদ্ধ এই কীটনাশক বাংলাদেশে এখনো ব্যবহৃত হচ্ছে।
ধনাঢ্যরা খেতে-খামারে কাজ না করায় বিষক্রিয়ার ঝুঁকি থেকে মুক্ত থাকেন; কিন্তু দিনমজুর, দলিত-বঞ্চিত, শ্রমিক ও দরিদ্র কৃষকরা কীটনাশক প্রয়োগের ফলে বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হলে তাদের পূর্ণাঙ্গ চিকিৎসা, ক্ষতিপূরণ ও বিষ প্রতিরোধে প্রয়োজনীয় সুরক্ষা সামগ্রীর জন্য সহযোগিতার দাবি জানাচ্ছেন।
[লেখক : আইনজীবী, জজ কোর্ট, জয়পুরহাট]