alt

উপ-সম্পাদকীয়

বদলাচ্ছে সমাজ, বদলাচ্ছে অর্জনের গল্প

মতিউর রহমান

: মঙ্গলবার, ২৭ মে ২০২৫

সাফল্য মানেই কি শুধু অনেক টাকা আর বড় চাকরি? আগে হয়তো এমনটাই ভাবা হতো। কিন্তু এখন দুনিয়া বদলাচ্ছে, আর তাই বদলাচ্ছে সফলতার মানেও। বিশ্বায়নের এই যুগে দেশগুলো কাছাকাছি আসছে, ইন্টারনেট সবকিছু সহজ করে দিয়েছে, আর আমাদের পুরনো ধ্যানধারণাগুলোও পাল্টাচ্ছে। সমাজই আসলে ঠিক করে দেয় কোনটা সাফল্য, কোনটা নয়। আর এই ভাবনাটা একেক জায়গায় একেকরকম। আমাদের বাংলাদেশও এখন অনেক বদলাচ্ছে- অর্থনীতি, মানুষজন, সংস্কৃতিÑতাই এখানেও সফলতার ধারণাটা বদলে যাচ্ছে।

আমাদের দেশে বা আরও অনেক জায়গায় আগে সাফল্য বলতে বোঝাতো সংসার চালানো, পরিবারের মুখে খাবার তুলে দেয়া আর সমাজে একটু মাথা উঁচু করে বাঁচা। যাদের জমি ছিল, গবাদিপশু ছিল বা সরকারি চাকরি ছিল, তাদেরই লোকে সফল বলত। এগুলো ছিল চোখে দেখা জিনিস, যা দিয়ে জীবন চালানো যেত। পরিবারের বড়দের কথা, ধর্মের নিয়ম আর ছেলেদের বেশি গুরুত্ব দেয়ার চলÑএসবই ঠিক করে দিত কী অর্জন করলে লোকে বাহবা দেবে। ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার বা সরকারি বড় কর্তা হওয়াটা শুধু টাকার জন্যই নয়, সম্মানের জন্যও খুব দরকারি ছিল।

কিন্তু বিশ্বায়ন সবকিছুকে অনেক বড় করে দিয়েছে। এখন টিভি, ইন্টারনেট, ফেইসবুক আর বিদেশে যাওয়া-আসা মানুষের সামনে নতুন নতুন রাস্তা খুলে দিয়েছে। বাংলাদেশের তরুণরা এখন দুনিয়ার খবর রাখছে, আর তারা দেখছে শুধু টাকা থাকলেই সফল হওয়া যায় না। এখন অনেকেই নিজের শখ পূরণ করা, সমাজে কিছু করা, সবার কাছে পরিচিত হওয়া আর নিজের মতো করে বাঁচার মধ্যেই সফলতা খুঁজে নিচ্ছে।

ফেইসবুক, ইনস্টাগ্রাম, ইউটিউব, টিকটকÑএসব প্ল্যাটফর্ম সাফল্যের ধারণা পাল্টে দিয়েছে। এখন অনেকেই অনলাইনে জনপ্রিয় হয়ে, ইনফ্লুয়েন্সার হয়ে বা নতুন টেক কোম্পানি বানিয়ে সফল হচ্ছে। আগে যারা হয়তো সুযোগ পেত না, তারাও এখন এই প্ল্যাটফর্মগুলোর মাধ্যমে টাকা কামাচ্ছে আর পরিচিতি পাচ্ছে। তবে এখানেও সমস্যা আছে, অনেক সময় শুধু দেখানোর জন্যই লোকে সফল সাজার চেষ্টা করে, আর রাতারাতি বিখ্যাত হওয়াটা সবসময় টিকে থাকে না।

বাংলাদেশের অর্থনীতিও অনেক বদলেছে। পোশাক কারখানা হয়েছে, বিদেশ থেকে আমাদের লোকেরা টাকা পাঠাচ্ছে, আর অনেকেই ছোটখাটো ব্যবসা বা এনজিওর সাহায্যে নিজের পায়ে দাঁড়াচ্ছে। নারীরা এখন কারখানায় কাজ করছে, গ্রামের অনেক মেয়ে এনজিওর কাছ থেকে ঋণ নিয়ে ব্যবসা করে সংসারে সাহায্য করছে। এতে তাদের নিজেদের পায়ে দাঁড়ানোর ক্ষমতা বাড়ছে, আর সাফল্য মানে যে শুধু ঘর সামলানো নয়, এটাও সবাই বুঝতে পারছে।

তবে সবকিছুর পরেও বৈষম্য কিন্তু থেকেই যাচ্ছে, বরং নতুন রূপে দেখা দিচ্ছে। নতুন ধরনের সাফল্য পাওয়ার সুযোগ সবার জন্য সমান নয়। এটা নির্ভর করে কে কোন পরিবারে জন্মেছে, কোথায় থাকে, ছেলে না মেয়ে এবং কে কতটুকু পড়াশোনা করেছে তার ওপর। গ্রামের ছেলে হয়তো বিদেশে গিয়ে টাকা পাঠানোকেই বড় সাফল্য মনে করে। আবার শহরের ধনী পরিবারের ছেলেমেয়েরা হয়তো বিদেশ থেকে পড়ে এসে বড় কোম্পানিতে যোগ দেওয়া বা নতুন ব্যবসা শুরু করাকে সাফল্য ভাবে। তাই একেকজনের কাছে সাফল্যের মানে একেকরকম, আর এর ঝুঁকিও আলাদা।

পড়াশোনাকে এখনো অনেক গুরুত্ব দেয়া হয়, কিন্তু এর মানেও আগের মতো নেই। এখন অনেক প্রাাইভেট ইউনিভার্সিটি হয়েছে, কোচিং সেন্টার আর নতুন নতুন কারিকুলাম এসেছে। ভালো রেজাল্ট করার চাপ অনেক বেশি, কিন্তু অনেকেই ভাবছে এত পড়াশোনা করেও ভালো চাকরি পাওয়া যাচ্ছে না। অনেক শিক্ষিত তরুণ বেকার থাকছে, আর তাই লোকে ভাবছে শুধু ভালো ডিগ্রি থাকলেই লাভ নেই, দরকারি কিছু শিখতে হবে।

এই পরিবর্তনের কারণে পরিবারেও সমস্যা হচ্ছে। বাবা-মা হয়তো এখনো চান ছেলেমেয়ে সরকারি চাকরি করুক বা তাড়াতাড়ি বিয়ে করুক। কিন্তু নতুন প্রজন্ম হয়তো শিল্পী হতে চায়, অনলাইনে বিখ্যাত হতে চায় বা সমাজের জন্য কিছু করতে চায়। আগের আর এখনকার প্রজন্মের চিন্তাভাবনার এই পার্থক্য সমাজে একটা টানাপোড়েন তৈরি করছে।

ধর্ম আর নীতিবোধ এখনো আমাদের সমাজে সফলতার সংজ্ঞায় প্রভাব ফেলে। কেউ কেউ মনে করে টাকা থাকলেই বুঝি আল্লাহ খুশি থাকেন বা সে খুব ভালো লোক। আবার অনেকে মনে করে শুধু টাকা আর নাম কামানোর পেছনে ছোটাটা ঠিক নয়। ইসলাম ধর্মে বিনয়, সমাজে প্রতি দায়িত্ব আর মনের শান্তিকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়, যা পশ্চিমা দেশের শুধু নিজের জন্য সফল হওয়ার ধারণার চেয়ে আলাদা। ধর্মের গুরুরাও এসব নিয়ে কথা বলেন এবং কোনটা ঠিক আর কোনটা ভুল, সে বিষয়ে মানুষের ধারণা গড়ে তোলেন।

টিভি, সিনেমা, বিজ্ঞাপনÑএগুলোও সাফল্যের গল্প শোনায়। গ্রামের ছেলে শহরে এসে বড় চাকরি পেল, গ্রামের মেয়ে বড় শিল্পী হলো, বা রিকশাওয়ালার ছেলে বিসিএস ক্যাডার হলোÑএমন গল্পগুলো আমাদের দেখায় যে চেষ্টা করলে আর প্রতিভা থাকলে যে কেউ জীবনে উন্নতি করতে পারে। কিন্তু এর আড়ালে যে কত বাধা আছে, সেটা অনেক সময় দেখানো হয় না।

এখন অনেকেই বিদেশে থাকছে বা দেশের বাইরে গিয়ে কাজ করছে। তারা শুধু দেশেই নয়, দেশের বাইরেও নিজেদের প্রমাণ করতে চায়। যারা বিদেশে থাকে, তারা একদিকে দেশের সংস্কৃতি ধরে রাখতে চায়, আবার অন্যদিকে নতুন দেশের সঙ্গেও মানিয়ে নিতে চায়। যারা কাজের জন্য বিদেশে যায়, তাদের জন্য সাফল্য মানে পরিবারকে টাকা পাঠানো আর নতুন জায়গায় টিকে থাকা।

সরকার আর বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানও সফলতার নতুন নতুন ধারণা তৈরি করছে। ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়া, তরুণদের ব্যবসা করার সুযোগ দেয়া বা নারীদের স্বাবলম্বী করার প্রকল্পগুলো আসলে সাফল্যের নতুন পথ খুলে দিচ্ছে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থাও ক্ষমতায়ন বা উন্নয়নের কথা বলে আমাদের সমাজের লক্ষ্য ঠিক করে দিতে সাহায্য করছে।

গত কয়েক বছরে যারা সমাজ পরিবর্তনের জন্য কাজ করছে, পরিবেশ বাঁচানোর চেষ্টা করছে বা নারী-পুরুষের সমতার জন্য লড়ছেÑতারাও নতুন একধরনের সাফল্য দেখাচ্ছে। তারা হয়তো অনেক টাকা কামাচ্ছে না, কিন্তু সমাজের ভালোর জন্য তাদের কাজকে লোকে এখন সম্মান জানাচ্ছে। এখানে সাফল্য মাপা হচ্ছে কে কতটা সমাজকে দিতে পারলো, পরিবেশের জন্য কী করলো বা কতটুকু সৎ থাকতে পারল, তার ওপর ভিত্তি করে।

তবে দামি জিনিস কেনার আর লোক দেখানোর চল এখনো কমেনি। পুঁজিবাদী সমাজে বাজারই সবকিছুর নিয়ম ঠিক করে দেয়, আর সাফল্য মানে অনেক সময় ভালো পোশাক পরা, দামি গাড়ি কেনা বা বড় বাড়িতে থাকা। এতে অনেকেই চাপে পড়ে যায়, অনেক কষ্ট করে হলেও লোকজনকে দেখাতে চায় যে সে সফল।

সাফল্যের এই বদলে যাওয়া ধারণাগুলো আমাদের মনেও প্রভাব ফেলছে। যখন সমাজ বারবার সফলতার মানদ- বদলায়, তখন সফল হওয়ার চাপও বাড়ে। ব্যর্থ হওয়ার ভয়, পিছিয়ে পড়ার চিন্তা আর অন্যদের কাছে ভালো সাজার আকাক্সক্ষা আমাদের অস্থির করে তোলে। বিশেষ করে তরুণদের মধ্যে মানসিক চাপ বাড়ছে, যা প্রমাণ করে সফলতার পেছনে ছুটতে গিয়ে আমাদের কতটা মানসিক ধকল পোহাতে হচ্ছে।

মোটকথা, বিশ্বায়নের যুগে সাফল্যের সামাজিক সংজ্ঞাটা সবসময় বদলাচ্ছে এবং এটা নিয়ে অনেক আলোচনা হচ্ছে। এটা একদিকে আমাদের ঐতিহ্য আর আধুনিকতার মধ্যেকার টানাপোড়েন, অন্যদিকে নিজের ভালো চাওয়া আর সবার ভালোর কথা ভাবার মধ্যেকার পার্থক্য, এবং স্থানীয় জীবন আর বিশ্ব দুনিয়ার স্বপ্নের প্রতিফলন। বাংলাদেশে এই সবকিছু ঘটছে এক নতুন শক্তি, সৃষ্টিশীলতা আর আকাক্সক্ষার মধ্যে দিয়ে। সাফল্য এখন আর একটা নির্দিষ্ট পথ নয়, এটা অনেকগুলো সম্ভাবনার সমষ্টি, যা নির্ভর করে কে কোথায় আছে, তার চারপাশের মানুষজন কেমন এবং সে নিজে কী ভাবছে তার ওপর।

সমাজ যত এগোবে, সাফল্যের ধারণাও তত বদলাবে। আমাদের চেষ্টা করতে হবে যাতে এই ধারণাগুলো সবার জন্য ভালো হয়, মানুষ হিসেবে আমাদের মূল্য দেয় এবং ন্যায্যতার ওপর ভিত্তি করে তৈরি হয়। সবার জন্য একই রকম সফলতার সংজ্ঞা ঠিক না করে, বরং যার যার পথকে সম্মান জানানো উচিত, বিভিন্ন ধরনের অবদানকে মূল্য দেয়া উচিত এবং এমন পরিবেশ তৈরি করা উচিত যেখানে সবাই নিজের মতো করে, নিজের স্বপ্ন পূরণ করতে পারে। এভাবেই বাংলাদেশ এবং পুরো পৃথিবীÑ আসলে সফল হওয়ার আরও মানবিক আর সুন্দর মানে খুঁজে পাবে।

[লেখক : গবেষক ও উন্নয়নকর্মী]

কেন থমকে আছে কাক্সিক্ষত অগ্রগতি

বাজেট কি গণমুখী হবে

টেকসই কৃষিতে মৌমাছি পালন

জনগণের বিশ্বাস ভেঙে নির্মিত নিষ্ক্রিয়তার সাম্রাজ্য

সাইবার ঝুঁকির চক্রে বাংলাদেশ

ছবি

কীভাবে পাকিস্তান ভারতের রাফায়েলকে পরাস্ত করল

ছবি

নজরুলের দ্রোহ চেতনার স্বরূপ সন্ধানে

পিতৃতন্ত্রের মনস্তত্ত্ব ও নারীর গ-িবদ্ধতা

চিরতন ও কালীচরণ : শতবর্ষ আগে যারা আইনের মঞ্চে উঠেছিলেন

রম্যগদ্য : প্লিজ স্যার... প্লিজ, ইকটু রেহাই দ্যান...

জমি, সম্মান ও প্রতিহিংসার নির্মম রাজনীতি

জানি তিনি মোড়ল বটে, আমাদের কেন তা হতে হবে

ভূমি মালিকানা ও ব্যবস্থাপনায় যুগোপযোগী আমূল সংস্কার জরুরি

বরেন্দ্রর মাটিতে আমের বিপ্লব : সম্ভাবনা ও সতর্কবার্তা

অবশেষে ‘হাসিনা’ গ্রেফতার

স্ক্যাবিস সংক্রমণের কারণ ও প্রতিরোধে করণীয়

বাস্তবমুখী বাজেটের প্রত্যাশা : বৈষম্যহীন অর্থনীতির পথে কতটা অগ্রগতি?

কৌশল নয়, এবার প্রযুক্তিতে সৌদি-মার্কিন জোট

সিউল : স্বর্গ নেমেছে ধরায়

নাচোল বিদ্রোহ ও ইলা মিত্র সংগ্রহশালা : সাঁওতাল স্মৃতি কেন উপেক্ষিত?

ছবি

অন্ধকার সত্য, শেষ সত্য নয়!

বিয়েতে মিতব্যয়িতা

এমপিওভুক্ত শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের বঞ্চনার কথা

রোহিঙ্গা সমস্যা : বাহবা, ব্যর্থতা ও ভবিষ্যতের ভয়

ডেঙ্গু প্রতিরোধে করণীয়

প্রযুক্তির ফাঁদে শৈশব : স্ক্রিন টাইম গিলে খাচ্ছে খেলার মাঠ

রমগদ্য : সিরাজগঞ্জে ‘ব্রিটিশ প্রেতাত্মা’

বামপন্থা : নীতির সঙ্গে নেতৃত্বের ভূমিকা

দাবি আদায়ে জনদুর্ভোগ : জনশিক্ষা ও সুশাসনের পথ

ইমাম রইস উদ্দিন হত্যাকাণ্ড : সুবিচার নিশ্চিত করা সরকারের দায়িত্ব

কারাগার, সংশোধনাগার ও ভবঘুরে কেন্দ্রগুলোর সংস্কার কি হবে

জ্বালানির বদল, জীবিকার ঝুঁকি

প্রসঙ্গ : রেলওয়ে নিরাপত্তা বাহিনী ও চট্টগ্রামে এস্কর্ট ডিউটি

দেশটা কারো বাপের নয়!

বুদ্ধের বাণীতে বিশ্বশান্তির প্রার্থনা

আর কত ধর্ষণের খবর শুনতে হবে?

tab

উপ-সম্পাদকীয়

বদলাচ্ছে সমাজ, বদলাচ্ছে অর্জনের গল্প

মতিউর রহমান

মঙ্গলবার, ২৭ মে ২০২৫

সাফল্য মানেই কি শুধু অনেক টাকা আর বড় চাকরি? আগে হয়তো এমনটাই ভাবা হতো। কিন্তু এখন দুনিয়া বদলাচ্ছে, আর তাই বদলাচ্ছে সফলতার মানেও। বিশ্বায়নের এই যুগে দেশগুলো কাছাকাছি আসছে, ইন্টারনেট সবকিছু সহজ করে দিয়েছে, আর আমাদের পুরনো ধ্যানধারণাগুলোও পাল্টাচ্ছে। সমাজই আসলে ঠিক করে দেয় কোনটা সাফল্য, কোনটা নয়। আর এই ভাবনাটা একেক জায়গায় একেকরকম। আমাদের বাংলাদেশও এখন অনেক বদলাচ্ছে- অর্থনীতি, মানুষজন, সংস্কৃতিÑতাই এখানেও সফলতার ধারণাটা বদলে যাচ্ছে।

আমাদের দেশে বা আরও অনেক জায়গায় আগে সাফল্য বলতে বোঝাতো সংসার চালানো, পরিবারের মুখে খাবার তুলে দেয়া আর সমাজে একটু মাথা উঁচু করে বাঁচা। যাদের জমি ছিল, গবাদিপশু ছিল বা সরকারি চাকরি ছিল, তাদেরই লোকে সফল বলত। এগুলো ছিল চোখে দেখা জিনিস, যা দিয়ে জীবন চালানো যেত। পরিবারের বড়দের কথা, ধর্মের নিয়ম আর ছেলেদের বেশি গুরুত্ব দেয়ার চলÑএসবই ঠিক করে দিত কী অর্জন করলে লোকে বাহবা দেবে। ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার বা সরকারি বড় কর্তা হওয়াটা শুধু টাকার জন্যই নয়, সম্মানের জন্যও খুব দরকারি ছিল।

কিন্তু বিশ্বায়ন সবকিছুকে অনেক বড় করে দিয়েছে। এখন টিভি, ইন্টারনেট, ফেইসবুক আর বিদেশে যাওয়া-আসা মানুষের সামনে নতুন নতুন রাস্তা খুলে দিয়েছে। বাংলাদেশের তরুণরা এখন দুনিয়ার খবর রাখছে, আর তারা দেখছে শুধু টাকা থাকলেই সফল হওয়া যায় না। এখন অনেকেই নিজের শখ পূরণ করা, সমাজে কিছু করা, সবার কাছে পরিচিত হওয়া আর নিজের মতো করে বাঁচার মধ্যেই সফলতা খুঁজে নিচ্ছে।

ফেইসবুক, ইনস্টাগ্রাম, ইউটিউব, টিকটকÑএসব প্ল্যাটফর্ম সাফল্যের ধারণা পাল্টে দিয়েছে। এখন অনেকেই অনলাইনে জনপ্রিয় হয়ে, ইনফ্লুয়েন্সার হয়ে বা নতুন টেক কোম্পানি বানিয়ে সফল হচ্ছে। আগে যারা হয়তো সুযোগ পেত না, তারাও এখন এই প্ল্যাটফর্মগুলোর মাধ্যমে টাকা কামাচ্ছে আর পরিচিতি পাচ্ছে। তবে এখানেও সমস্যা আছে, অনেক সময় শুধু দেখানোর জন্যই লোকে সফল সাজার চেষ্টা করে, আর রাতারাতি বিখ্যাত হওয়াটা সবসময় টিকে থাকে না।

বাংলাদেশের অর্থনীতিও অনেক বদলেছে। পোশাক কারখানা হয়েছে, বিদেশ থেকে আমাদের লোকেরা টাকা পাঠাচ্ছে, আর অনেকেই ছোটখাটো ব্যবসা বা এনজিওর সাহায্যে নিজের পায়ে দাঁড়াচ্ছে। নারীরা এখন কারখানায় কাজ করছে, গ্রামের অনেক মেয়ে এনজিওর কাছ থেকে ঋণ নিয়ে ব্যবসা করে সংসারে সাহায্য করছে। এতে তাদের নিজেদের পায়ে দাঁড়ানোর ক্ষমতা বাড়ছে, আর সাফল্য মানে যে শুধু ঘর সামলানো নয়, এটাও সবাই বুঝতে পারছে।

তবে সবকিছুর পরেও বৈষম্য কিন্তু থেকেই যাচ্ছে, বরং নতুন রূপে দেখা দিচ্ছে। নতুন ধরনের সাফল্য পাওয়ার সুযোগ সবার জন্য সমান নয়। এটা নির্ভর করে কে কোন পরিবারে জন্মেছে, কোথায় থাকে, ছেলে না মেয়ে এবং কে কতটুকু পড়াশোনা করেছে তার ওপর। গ্রামের ছেলে হয়তো বিদেশে গিয়ে টাকা পাঠানোকেই বড় সাফল্য মনে করে। আবার শহরের ধনী পরিবারের ছেলেমেয়েরা হয়তো বিদেশ থেকে পড়ে এসে বড় কোম্পানিতে যোগ দেওয়া বা নতুন ব্যবসা শুরু করাকে সাফল্য ভাবে। তাই একেকজনের কাছে সাফল্যের মানে একেকরকম, আর এর ঝুঁকিও আলাদা।

পড়াশোনাকে এখনো অনেক গুরুত্ব দেয়া হয়, কিন্তু এর মানেও আগের মতো নেই। এখন অনেক প্রাাইভেট ইউনিভার্সিটি হয়েছে, কোচিং সেন্টার আর নতুন নতুন কারিকুলাম এসেছে। ভালো রেজাল্ট করার চাপ অনেক বেশি, কিন্তু অনেকেই ভাবছে এত পড়াশোনা করেও ভালো চাকরি পাওয়া যাচ্ছে না। অনেক শিক্ষিত তরুণ বেকার থাকছে, আর তাই লোকে ভাবছে শুধু ভালো ডিগ্রি থাকলেই লাভ নেই, দরকারি কিছু শিখতে হবে।

এই পরিবর্তনের কারণে পরিবারেও সমস্যা হচ্ছে। বাবা-মা হয়তো এখনো চান ছেলেমেয়ে সরকারি চাকরি করুক বা তাড়াতাড়ি বিয়ে করুক। কিন্তু নতুন প্রজন্ম হয়তো শিল্পী হতে চায়, অনলাইনে বিখ্যাত হতে চায় বা সমাজের জন্য কিছু করতে চায়। আগের আর এখনকার প্রজন্মের চিন্তাভাবনার এই পার্থক্য সমাজে একটা টানাপোড়েন তৈরি করছে।

ধর্ম আর নীতিবোধ এখনো আমাদের সমাজে সফলতার সংজ্ঞায় প্রভাব ফেলে। কেউ কেউ মনে করে টাকা থাকলেই বুঝি আল্লাহ খুশি থাকেন বা সে খুব ভালো লোক। আবার অনেকে মনে করে শুধু টাকা আর নাম কামানোর পেছনে ছোটাটা ঠিক নয়। ইসলাম ধর্মে বিনয়, সমাজে প্রতি দায়িত্ব আর মনের শান্তিকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়, যা পশ্চিমা দেশের শুধু নিজের জন্য সফল হওয়ার ধারণার চেয়ে আলাদা। ধর্মের গুরুরাও এসব নিয়ে কথা বলেন এবং কোনটা ঠিক আর কোনটা ভুল, সে বিষয়ে মানুষের ধারণা গড়ে তোলেন।

টিভি, সিনেমা, বিজ্ঞাপনÑএগুলোও সাফল্যের গল্প শোনায়। গ্রামের ছেলে শহরে এসে বড় চাকরি পেল, গ্রামের মেয়ে বড় শিল্পী হলো, বা রিকশাওয়ালার ছেলে বিসিএস ক্যাডার হলোÑএমন গল্পগুলো আমাদের দেখায় যে চেষ্টা করলে আর প্রতিভা থাকলে যে কেউ জীবনে উন্নতি করতে পারে। কিন্তু এর আড়ালে যে কত বাধা আছে, সেটা অনেক সময় দেখানো হয় না।

এখন অনেকেই বিদেশে থাকছে বা দেশের বাইরে গিয়ে কাজ করছে। তারা শুধু দেশেই নয়, দেশের বাইরেও নিজেদের প্রমাণ করতে চায়। যারা বিদেশে থাকে, তারা একদিকে দেশের সংস্কৃতি ধরে রাখতে চায়, আবার অন্যদিকে নতুন দেশের সঙ্গেও মানিয়ে নিতে চায়। যারা কাজের জন্য বিদেশে যায়, তাদের জন্য সাফল্য মানে পরিবারকে টাকা পাঠানো আর নতুন জায়গায় টিকে থাকা।

সরকার আর বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানও সফলতার নতুন নতুন ধারণা তৈরি করছে। ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়া, তরুণদের ব্যবসা করার সুযোগ দেয়া বা নারীদের স্বাবলম্বী করার প্রকল্পগুলো আসলে সাফল্যের নতুন পথ খুলে দিচ্ছে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থাও ক্ষমতায়ন বা উন্নয়নের কথা বলে আমাদের সমাজের লক্ষ্য ঠিক করে দিতে সাহায্য করছে।

গত কয়েক বছরে যারা সমাজ পরিবর্তনের জন্য কাজ করছে, পরিবেশ বাঁচানোর চেষ্টা করছে বা নারী-পুরুষের সমতার জন্য লড়ছেÑতারাও নতুন একধরনের সাফল্য দেখাচ্ছে। তারা হয়তো অনেক টাকা কামাচ্ছে না, কিন্তু সমাজের ভালোর জন্য তাদের কাজকে লোকে এখন সম্মান জানাচ্ছে। এখানে সাফল্য মাপা হচ্ছে কে কতটা সমাজকে দিতে পারলো, পরিবেশের জন্য কী করলো বা কতটুকু সৎ থাকতে পারল, তার ওপর ভিত্তি করে।

তবে দামি জিনিস কেনার আর লোক দেখানোর চল এখনো কমেনি। পুঁজিবাদী সমাজে বাজারই সবকিছুর নিয়ম ঠিক করে দেয়, আর সাফল্য মানে অনেক সময় ভালো পোশাক পরা, দামি গাড়ি কেনা বা বড় বাড়িতে থাকা। এতে অনেকেই চাপে পড়ে যায়, অনেক কষ্ট করে হলেও লোকজনকে দেখাতে চায় যে সে সফল।

সাফল্যের এই বদলে যাওয়া ধারণাগুলো আমাদের মনেও প্রভাব ফেলছে। যখন সমাজ বারবার সফলতার মানদ- বদলায়, তখন সফল হওয়ার চাপও বাড়ে। ব্যর্থ হওয়ার ভয়, পিছিয়ে পড়ার চিন্তা আর অন্যদের কাছে ভালো সাজার আকাক্সক্ষা আমাদের অস্থির করে তোলে। বিশেষ করে তরুণদের মধ্যে মানসিক চাপ বাড়ছে, যা প্রমাণ করে সফলতার পেছনে ছুটতে গিয়ে আমাদের কতটা মানসিক ধকল পোহাতে হচ্ছে।

মোটকথা, বিশ্বায়নের যুগে সাফল্যের সামাজিক সংজ্ঞাটা সবসময় বদলাচ্ছে এবং এটা নিয়ে অনেক আলোচনা হচ্ছে। এটা একদিকে আমাদের ঐতিহ্য আর আধুনিকতার মধ্যেকার টানাপোড়েন, অন্যদিকে নিজের ভালো চাওয়া আর সবার ভালোর কথা ভাবার মধ্যেকার পার্থক্য, এবং স্থানীয় জীবন আর বিশ্ব দুনিয়ার স্বপ্নের প্রতিফলন। বাংলাদেশে এই সবকিছু ঘটছে এক নতুন শক্তি, সৃষ্টিশীলতা আর আকাক্সক্ষার মধ্যে দিয়ে। সাফল্য এখন আর একটা নির্দিষ্ট পথ নয়, এটা অনেকগুলো সম্ভাবনার সমষ্টি, যা নির্ভর করে কে কোথায় আছে, তার চারপাশের মানুষজন কেমন এবং সে নিজে কী ভাবছে তার ওপর।

সমাজ যত এগোবে, সাফল্যের ধারণাও তত বদলাবে। আমাদের চেষ্টা করতে হবে যাতে এই ধারণাগুলো সবার জন্য ভালো হয়, মানুষ হিসেবে আমাদের মূল্য দেয় এবং ন্যায্যতার ওপর ভিত্তি করে তৈরি হয়। সবার জন্য একই রকম সফলতার সংজ্ঞা ঠিক না করে, বরং যার যার পথকে সম্মান জানানো উচিত, বিভিন্ন ধরনের অবদানকে মূল্য দেয়া উচিত এবং এমন পরিবেশ তৈরি করা উচিত যেখানে সবাই নিজের মতো করে, নিজের স্বপ্ন পূরণ করতে পারে। এভাবেই বাংলাদেশ এবং পুরো পৃথিবীÑ আসলে সফল হওয়ার আরও মানবিক আর সুন্দর মানে খুঁজে পাবে।

[লেখক : গবেষক ও উন্নয়নকর্মী]

back to top