কামরুজ্জামান
সমস্যা এদেশে কম নয়। এই দেশ যতবার মাথা তুলে দাঁড়াতে চেয়েছে, ততবারই গোঁড়া থেকে টেনে ধরা হয়েছে। নানা কারণে উন্নয়নের ধারা ব্যাহত হয়েছে, যার মধ্যে রাজনৈতিক অস্থিরতা ও প্রতিহিংসার রাজনীতি অন্যতম। মতাদর্শের ভিন্নতা স্বাভাবিক হলেও, দেশের স্বার্থে সব দলের মধ্যে ন্যূনতম ঐক্য থাকা উচিত ছিলÑযা আমরা আজও পাইনি।
রাষ্ট্র পরিচালনায় দক্ষ নেতৃত্বের অভাব একটি পুরনো আলোচনা। দলমত নির্বিশেষে নেতৃত্বকে গ্রহণ করার সংস্কৃতি গড়ে ওঠেনি। টেকসই গণতন্ত্রের অভাব রাজনৈতিক দল ও সাধারণ মানুষের মধ্যে আস্থার সংকট তৈরি করেছে, যার ফলে গণতন্ত্র বারবার হুমকির মুখে পড়েছে।
এ দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে প্রতিহিংসার চিত্র অত্যন্ত প্রকট। ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় একরকম, ক্ষমতার বাইরে গেলে অন্যরকম আচরণÑএটাই যেন হয়ে দাঁড়িয়েছে চিরাচরিত নিয়ম। বিরোধীদলের প্রতি সহনশীলতা এবং ভিন্নমতের প্রতি শ্রদ্ধা না থাকায় গণতন্ত্রের ভিত্তিই দুর্বল হয়ে গেছে। অথচ অর্ধশতাধিক রাজনৈতিক দল দেশে সক্রিয়, যারা মুখে দেশের উন্নয়নের কথা বললেও বাস্তবে তা অধরাই থেকে যাচ্ছে।
বাংলাদেশের অন্যতম দুর্বল দিক ঘুষ ও দুর্নীতি। ব্যক্তি ও প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে কোটি কোটি টাকার দুর্নীতির চিত্র এখন গা-সওয়া হয়ে গেছে। ভূমি অফিস, উন্নয়ন প্রকল্প, বনভূমিÑকোনো কিছুই এর বাইরে নয়। দুর্নীতির ফলে শুধু সম্পদ নয়, নষ্ট হচ্ছে মানুষের আস্থাও। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রতি সাধারণ মানুষের একসময় আশাবাদ ছিল যে হয়তো দুর্নীতির লাগাম টানা যাবে। কিন্তু বাস্তবতা বলছেÑনৈতিক অবক্ষয়ের এই দীর্ঘস্থায়ী জট এত সহজে ছিন্ন করার নয়।
স্বাধীনতার ৫৪ বছর পরও একটি যুগোপযোগী, টেকসই ও গুণগত শিক্ষা কারিকুলাম গড়ে তোলা সম্ভব হয়নি। শিক্ষাব্যবস্থায় এখনও পরীক্ষা-নির্ভরতা ও প্রয়োগমূলক কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলমান, যা আদতে শিক্ষার মান উন্নয়নে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। পাঠ্যক্রম রচনায় মেধাবীদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত না করে গৃহীত পরিবর্তন ফলপ্রসূ হয় না। পাশাপাশি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো রাজনৈতিক হস্তক্ষেপমুক্ত না হলে গবেষণা ও শিক্ষার মান উন্নয়ন অসম্ভব।
শিক্ষা ও গবেষণা খাত বরাবরই অবহেলিত। বাজেট বরাদ্দ যেমন কম, তেমনি মেধাবীদের প্রাপ্য মর্যাদাও নিশ্চিত নয়। অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকরা গবেষণার চেয়ে রাজনীতিতে বেশি সক্রিয়। যার ফলে প্রকৃত গবেষকরা অবমূল্যায়নের শিকার হন, আর দেশ হারায় উন্নয়নের সম্ভাবনা।
ছাত্রদের রাজনৈতিক ভূমিকা ইতিহাসে গৌরবোজ্জ্বল হলেও বর্তমানে ছাত্র রাজনীতির অবস্থা ভিন্ন। এখনকার ছাত্র রাজনীতি অনেক সময় দলীয় স্বার্থে পরিচালিত হয়, শিক্ষার্থীদের কল্যাণ ও শিক্ষার গুণগত মান নিশ্চিত করার বদলে জড়িয়ে পড়ে ক্ষমতার দ্বন্দ্বে। ফলে উচ্চশিক্ষার পরিবেশ ব্যাহত হয়।
উন্নয়ন প্রকল্পে দুর্নীতি, কমিশন বাণিজ্য ও চাঁদাবাজি বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রকল্পের মানহীন বাস্তবায়নের ফলে কাক্সিক্ষত উন্নয়ন ব্যাহত হয়। বছরের পর বছর দুর্নীতির অভিযোগ শোনা গেলেও কার্যকর প্রতিকার খুব একটা দেখা যায় না।
পরিবহন খাতে নৈরাজ্য এবং সড়ক-মহাসড়কে বিশৃঙ্খল অবস্থাও দেশের সার্বিক উন্নয়নকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলেছে। ঢাকা ও বড় শহরগুলোতে তীব্র যানজট শুধু মানুষের কর্মঘণ্টা নয়, দেশের অর্থনীতিকেও বিপর্যস্ত করে। উন্নত যোগাযোগব্যবস্থা ছাড়া উন্নয়ন টেকসই হয় না।
১৮ কোটি মানুষের খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হলে কৃষিকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। শিল্প, ব্যবসা-বাণিজ্য ও চাকরির প্রসার প্রয়োজন, কিন্তু কৃষির আধুনিকায়ন ও উৎপাদন বাড়ানো আরও বেশি জরুরি। টেকসই উন্নয়নের ভিত্তি হতে পারে একটি সবল ও সমৃদ্ধ কৃষি খাত।
বাংলাদেশ কৃষিনির্ভর দেশ হলেও কর্মসংস্থানের জন্য শিল্পায়ন অপরিহার্য। তৈরি পোশাক খাত রপ্তানিতে বড় ভূমিকা রাখলেও, শিল্পায়ন এখনও পর্যাপ্ত নয়। তারওপর গড়ে ওঠা শিল্পকারখানাগুলোর অধিকাংশই অপরিকল্পিত, পরিবেশবান্ধব নয়। টেকসই উন্নয়নের জন্য পরিকল্পিত ও সবুজ শিল্পায়ন প্রয়োজন।
আরেকটি গুরুতর সমস্যা হচ্ছে মেধা পাচার। দেশে সুযোগ-সুবিধার অভাবে মেধাবীরা বিদেশমুখী হচ্ছে। এই প্রবণতা বন্ধ করতে হলে রাজনৈতিক সদিচ্ছা এবং মেধাবীদের জন্য সহায়ক পরিবেশ নিশ্চিত করা জরুরি।
সবশেষে, উন্নত রাষ্ট্র গঠনের পূর্বশর্ত হচ্ছে শিক্ষিত, দক্ষ, গবেষণাভিত্তিক ও নৈতিক জনগোষ্ঠী। প্রয়োজন নেতৃত্বে দূরদৃষ্টি ও দেশপ্রেম। স্বাধীনতার ৫৪ বছরে এসে আমাদের প্রত্যাশাÑবাংলাদেশ যেন কেবল উন্নয়নশীল নয়, সত্যিকারের উন্নত ও মানবিক রাষ্ট্রে পরিণত হয়।
[লেখক : সহকারী অধ্যাপক, ভূগোল বিভাগ, মুক্তিযোদ্ধা কলেজ, গাজীপুর]
কামরুজ্জামান
মঙ্গলবার, ২৭ মে ২০২৫
সমস্যা এদেশে কম নয়। এই দেশ যতবার মাথা তুলে দাঁড়াতে চেয়েছে, ততবারই গোঁড়া থেকে টেনে ধরা হয়েছে। নানা কারণে উন্নয়নের ধারা ব্যাহত হয়েছে, যার মধ্যে রাজনৈতিক অস্থিরতা ও প্রতিহিংসার রাজনীতি অন্যতম। মতাদর্শের ভিন্নতা স্বাভাবিক হলেও, দেশের স্বার্থে সব দলের মধ্যে ন্যূনতম ঐক্য থাকা উচিত ছিলÑযা আমরা আজও পাইনি।
রাষ্ট্র পরিচালনায় দক্ষ নেতৃত্বের অভাব একটি পুরনো আলোচনা। দলমত নির্বিশেষে নেতৃত্বকে গ্রহণ করার সংস্কৃতি গড়ে ওঠেনি। টেকসই গণতন্ত্রের অভাব রাজনৈতিক দল ও সাধারণ মানুষের মধ্যে আস্থার সংকট তৈরি করেছে, যার ফলে গণতন্ত্র বারবার হুমকির মুখে পড়েছে।
এ দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে প্রতিহিংসার চিত্র অত্যন্ত প্রকট। ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় একরকম, ক্ষমতার বাইরে গেলে অন্যরকম আচরণÑএটাই যেন হয়ে দাঁড়িয়েছে চিরাচরিত নিয়ম। বিরোধীদলের প্রতি সহনশীলতা এবং ভিন্নমতের প্রতি শ্রদ্ধা না থাকায় গণতন্ত্রের ভিত্তিই দুর্বল হয়ে গেছে। অথচ অর্ধশতাধিক রাজনৈতিক দল দেশে সক্রিয়, যারা মুখে দেশের উন্নয়নের কথা বললেও বাস্তবে তা অধরাই থেকে যাচ্ছে।
বাংলাদেশের অন্যতম দুর্বল দিক ঘুষ ও দুর্নীতি। ব্যক্তি ও প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে কোটি কোটি টাকার দুর্নীতির চিত্র এখন গা-সওয়া হয়ে গেছে। ভূমি অফিস, উন্নয়ন প্রকল্প, বনভূমিÑকোনো কিছুই এর বাইরে নয়। দুর্নীতির ফলে শুধু সম্পদ নয়, নষ্ট হচ্ছে মানুষের আস্থাও। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রতি সাধারণ মানুষের একসময় আশাবাদ ছিল যে হয়তো দুর্নীতির লাগাম টানা যাবে। কিন্তু বাস্তবতা বলছেÑনৈতিক অবক্ষয়ের এই দীর্ঘস্থায়ী জট এত সহজে ছিন্ন করার নয়।
স্বাধীনতার ৫৪ বছর পরও একটি যুগোপযোগী, টেকসই ও গুণগত শিক্ষা কারিকুলাম গড়ে তোলা সম্ভব হয়নি। শিক্ষাব্যবস্থায় এখনও পরীক্ষা-নির্ভরতা ও প্রয়োগমূলক কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলমান, যা আদতে শিক্ষার মান উন্নয়নে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। পাঠ্যক্রম রচনায় মেধাবীদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত না করে গৃহীত পরিবর্তন ফলপ্রসূ হয় না। পাশাপাশি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো রাজনৈতিক হস্তক্ষেপমুক্ত না হলে গবেষণা ও শিক্ষার মান উন্নয়ন অসম্ভব।
শিক্ষা ও গবেষণা খাত বরাবরই অবহেলিত। বাজেট বরাদ্দ যেমন কম, তেমনি মেধাবীদের প্রাপ্য মর্যাদাও নিশ্চিত নয়। অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকরা গবেষণার চেয়ে রাজনীতিতে বেশি সক্রিয়। যার ফলে প্রকৃত গবেষকরা অবমূল্যায়নের শিকার হন, আর দেশ হারায় উন্নয়নের সম্ভাবনা।
ছাত্রদের রাজনৈতিক ভূমিকা ইতিহাসে গৌরবোজ্জ্বল হলেও বর্তমানে ছাত্র রাজনীতির অবস্থা ভিন্ন। এখনকার ছাত্র রাজনীতি অনেক সময় দলীয় স্বার্থে পরিচালিত হয়, শিক্ষার্থীদের কল্যাণ ও শিক্ষার গুণগত মান নিশ্চিত করার বদলে জড়িয়ে পড়ে ক্ষমতার দ্বন্দ্বে। ফলে উচ্চশিক্ষার পরিবেশ ব্যাহত হয়।
উন্নয়ন প্রকল্পে দুর্নীতি, কমিশন বাণিজ্য ও চাঁদাবাজি বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রকল্পের মানহীন বাস্তবায়নের ফলে কাক্সিক্ষত উন্নয়ন ব্যাহত হয়। বছরের পর বছর দুর্নীতির অভিযোগ শোনা গেলেও কার্যকর প্রতিকার খুব একটা দেখা যায় না।
পরিবহন খাতে নৈরাজ্য এবং সড়ক-মহাসড়কে বিশৃঙ্খল অবস্থাও দেশের সার্বিক উন্নয়নকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলেছে। ঢাকা ও বড় শহরগুলোতে তীব্র যানজট শুধু মানুষের কর্মঘণ্টা নয়, দেশের অর্থনীতিকেও বিপর্যস্ত করে। উন্নত যোগাযোগব্যবস্থা ছাড়া উন্নয়ন টেকসই হয় না।
১৮ কোটি মানুষের খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হলে কৃষিকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। শিল্প, ব্যবসা-বাণিজ্য ও চাকরির প্রসার প্রয়োজন, কিন্তু কৃষির আধুনিকায়ন ও উৎপাদন বাড়ানো আরও বেশি জরুরি। টেকসই উন্নয়নের ভিত্তি হতে পারে একটি সবল ও সমৃদ্ধ কৃষি খাত।
বাংলাদেশ কৃষিনির্ভর দেশ হলেও কর্মসংস্থানের জন্য শিল্পায়ন অপরিহার্য। তৈরি পোশাক খাত রপ্তানিতে বড় ভূমিকা রাখলেও, শিল্পায়ন এখনও পর্যাপ্ত নয়। তারওপর গড়ে ওঠা শিল্পকারখানাগুলোর অধিকাংশই অপরিকল্পিত, পরিবেশবান্ধব নয়। টেকসই উন্নয়নের জন্য পরিকল্পিত ও সবুজ শিল্পায়ন প্রয়োজন।
আরেকটি গুরুতর সমস্যা হচ্ছে মেধা পাচার। দেশে সুযোগ-সুবিধার অভাবে মেধাবীরা বিদেশমুখী হচ্ছে। এই প্রবণতা বন্ধ করতে হলে রাজনৈতিক সদিচ্ছা এবং মেধাবীদের জন্য সহায়ক পরিবেশ নিশ্চিত করা জরুরি।
সবশেষে, উন্নত রাষ্ট্র গঠনের পূর্বশর্ত হচ্ছে শিক্ষিত, দক্ষ, গবেষণাভিত্তিক ও নৈতিক জনগোষ্ঠী। প্রয়োজন নেতৃত্বে দূরদৃষ্টি ও দেশপ্রেম। স্বাধীনতার ৫৪ বছরে এসে আমাদের প্রত্যাশাÑবাংলাদেশ যেন কেবল উন্নয়নশীল নয়, সত্যিকারের উন্নত ও মানবিক রাষ্ট্রে পরিণত হয়।
[লেখক : সহকারী অধ্যাপক, ভূগোল বিভাগ, মুক্তিযোদ্ধা কলেজ, গাজীপুর]