alt

উপ-সম্পাদকীয়

নিয়ন্ত্রণহীন নেটজগৎ ও ফেইসবুক : সমাজে বিভ্রান্তির ডিজিটাল উৎপত্তি

শাহ মো. জিয়াউদ্দিন

: শনিবার, ৩১ মে ২০২৫

বর্তমান যুগে তথ্য জানার প্রধান উৎস হয়ে উঠেছে ইন্টারনেট। যে কোনো বিষয়ে জানতে এখন মানুষ চোখ রাখে মোবাইল স্ক্রিনে; আঙুল ছোঁয়ায় সার্চ হয় গুগলে। তবে এই নির্ভরতা যেমন মানুষকে তথ্যের দোরগোড়ায় নিয়ে যাচ্ছে, তেমনি একে কেন্দ্র করে গড়ে উঠছে গুজব, অপপ্রচার এবং তথ্যবিকৃতির এক ভয়াবহ সাম্রাজ্য। অনেক সময় এমন কিছু খবর ভাইরাল হয়, যা পড়ে চোখ কপালে ওঠে। এগুলো শুধু গুজব নয়, বরং উদ্দেশ্যমূলকভাবে ছড়ানো হয় বিভ্রান্তি তৈরির জন্য। একে নিছক ‘ইয়েলো জার্নালিজম’ বললে ভুল হবে; বরং একে বলা উচিত ‘ডিজিটাল অপপ্রচার যন্ত্র’।

প্রশ্ন জাগেÑএই নেটজগৎ বা ডিজিটাল মিডিয়া আসলে কে নিয়ন্ত্রণ করে? যদি বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) সত্যিকার অর্থেই কার্যকর নিয়ন্ত্রক হতো, তাহলে দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি কিংবা ধর্মসংক্রান্ত সংবেদনশীল ইস্যু নিয়ে এমন অবাধ ও নোংরা অপপ্রচার চলতে পারত না। বিশেষ করে ফেইসবুক নামের সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মটি সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে অসামাজিকতার বীজ বপন করছে।

ফেইসবুকের কুপ্রভাব সবচেয়ে ভয়াবহভাবে পড়ছে উঠতি বয়সের কিশোর-কিশোরীদের ওপর। তারা দিনরাত এই প্ল্যাটফর্মে সময় কাটিয়ে আসক্ত হয়ে পড়ছে অশ্লীলতা, পর্নোগ্রাফি এবং সহিংস কনটেন্টে। অপরাধমূলক কর্মকা-কে রীতিমতো রোমাঞ্চকর হিসেবে তুলে ধরা ‘রিল’গুলো দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে তারা জড়িয়ে পড়ছে কিশোর গ্যাং নামক ভয়ানক সামাজিক ব্যাধিতে।

রাজনৈতিকভাবে বিরোধী মত দমনে ব্যবহৃত হচ্ছে এসব মিডিয়া। ফেইসবুকে সরকারের শীর্ষ নেতৃত্বের পক্ষে বিপক্ষে নানা ধরনের ‘রিল’ এবং ভিডিও বানানো হয়। অনেক রিলে সরকারপ্রধানের প্রশংসা থাকলেও, অন্য অনেক রিলে থাকে চরম অশ্লীলতা, অপমান, এমনকি নারী অবমাননার উপাদান, যা এক ধরনের ডিজিটাল সহিংসতার শামিল। রাজনৈতিক রম্য বা ব্যঙ্গচিত্র যদি শৈল্পিক এবং শিক্ষণীয় হয়, তা গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির অংশ হতে পারে। কিন্তু বর্তমানে যে ধরনের ভিডিও বা কনটেন্ট তৈরি হচ্ছে, তা সমাজে বিভ্রান্তি ছড়ানো এবং ঘৃণা উসকে দেয়ার অন্যতম মাধ্যম হয়ে উঠছে।

দেশের অনেক মানুষ এখন ফেইসবুকনির্ভর তথ্যে বিশ্বাস স্থাপন করছে। কে কোথায় কী বলল, কী ঘটলÑসবই তারা যাচাই না করেই ধরে নিচ্ছে সত্যি বলে। এ থেকেই জন্ম নিচ্ছে অকারণ তর্ক-বিতর্ক, এমনকি শারীরিক সংঘর্ষ পর্যন্ত। যেমন- একজন ব্যক্তি বলছিলেন, ‘ড. ইউনূসকে ঘিরে ফেলেছে সশস্ত্র বাহিনী, গ্রেপ্তার হবে যে কোনো সময়!’ তথ্যের উৎস জানতে চাইলে বলেনÑ‘নেটে পড়েছি, ভারতের এক মিডিয়ায় এসেছে।’ পরে দেখা গেল সেটি নিছক গুজব ছিল।

একজন এমপিওভুক্ত শিক্ষক সারাদিন ফেইসবুক থেকে পাওয়া তথ্যে রাজনীতি চর্চা করেন। আশপাশের মানুষকেও তিনি শেখান সেই তথ্যÑযার উৎস বা ভিত্তি কিছুই যাচাই করা নয়। আবার অনেকে বিশ্ব রাজনীতি কিংবা অর্থনীতির জটিল বিষয়েও মতামত দিচ্ছেন ফেইসবুক সূত্রে প্রাপ্ত অর্ধসত্য তথ্যের ওপর ভিত্তি করে। যেমন, বন্দর লিজ প্রসঙ্গে এক ব্যক্তি বললেন, ‘বিশ্বের সব বড় বড় দেশ বন্দর লিজ দেয়, না দিলে সরকার চলে না।’ অথচ তিনি জানেন না, লিজের শর্ত ও কাঠামো দেশভেদে ভিন্ন হয়। শুধু ফেইসবুক দেখে এমন বক্তব্য দেয়া মানেই হলো তথ্যবিকৃতি ছড়ানো।

আরেকটি মারাত্মক দিক হলো ধর্মীয় বিদ্বেষ ও মৌলবাদ। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ফেইসবুকে দেয়া স্ট্যাটাস কেন্দ্র করে দেশে বেশ কয়েকবার সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ছড়িয়েছে। ধর্মের নানা উপাখ্যান বিকৃত করে প্রচার করা হয়, যার প্রভাবে হিন্দু-মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে বিভেদ বাড়ে। কেউ যদি নারী স্বাধীনতা বা ধর্মনিরপেক্ষতার পক্ষে কথা বলে, তাকে ‘নাস্তিক’ তকমা দেয়া হয়। একজন তো ফেইসবুকে টাকার নোটে মন্দিরের ছবি দেখে বললেন, ‘এটা পকেটে নিয়ে নামাজ পড়া যাবে না।’ অথচ আগের নোটে বঙ্গবন্ধুর মুখ ছিল, অন্য দেশের মুদ্রাতেও থাকে মানুষের ছবিÑসেগুলোর কথা ভুলে গিয়ে আজ ধর্মকে ইস্যু বানিয়ে তৈরি করা হয় অপ্রয়োজনীয় বিতর্ক।

রাজনীতিতেও এখন ফেইসবুককেন্দ্রিক গুজব ছড়ানো হচ্ছে। যেমন- ‘ড. ইউনূস হবেন রাষ্ট্রপতি, তারেক রহমান হবেন প্রধানমন্ত্রী, জামাতের আমির হবেন উপ-প্রধানমন্ত্রী’Ñএই ধরনের হাস্যকর গুজবও বিশ্বাস করছে মানুষ। একজন অটোচালক বলছেন, ‘নেটে এসেছে, কোরবানির ঈদ হবে মঙ্গলবার।’ যতই বলুনÑএই তথ্য কর্তৃপক্ষ জানায়নি, তিনি বিশ্বাস করতে নারাজ। কারণ ‘নেট বলেছে’।

এই অবস্থার ফলে সমাজে একটি ভয়াবহ ডিজিটাল অজ্ঞতার সংস্কৃতি গড়ে উঠছে। তথ্য যাচাইয়ের সংস্কৃতি নেই, আছে শুধু ফেইসবুকনির্ভর আবেগ ও বিশ্বাস। যদিও স্বীকার করতে হবেÑসব তথ্য যে মিথ্যা, তা নয়। কিন্তু সামগ্রিক বিবেচনায় দেখা যাচ্ছে, ফেইসবুকে প্রচারিত অন্তত ৮০% খবরই হয় গুজব বা বিকৃত।

দেশের শিক্ষিত সমাজের বড় অংশও এই সংকটে আক্রান্ত। অনেক বিশ্ববিদ্যালয় ডিগ্রিধারীও যাচাই-বাছাই না করেই ফেইসবুকের তথ্য প্রচার করছেন। একারণেই এখন সামাজিক ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা রক্ষায় ফেইসবুক এবং অনলাইন কনটেন্টের কার্যকর নিয়ন্ত্রণ অত্যন্ত জরুরি হয়ে উঠেছে।

গণমাধ্যমের প্রতি মানুষের আস্থা ফিরিয়ে আনতে হলে, এই গুজবমুখর ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মগুলোকে কঠোর নজরদারির আওতায় আনতে হবে। রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকদের উচিত হবেÑএকদিকে ডিজিটাল শিক্ষার প্রসার ঘটানো, অন্যদিকে নীতিনির্ধারিত তথ্য যাচাইয়ের কেন্দ্র গড়ে তোলা, যেন ফেইসবুকনির্ভর গুজব-নির্ভরতা হ্রাস পায়।

একটি দায়িত্বশীল সামাজিক মাধ্যম হতে হলে, ফেইসবুককেই সর্বাগ্রে হতে হবে স্বচ্ছ ও নিয়ন্ত্রিত। অন্যথায়, এই মাধ্যম এক সময় সমাজে চরম বিশৃঙ্খলার কারণ হয়ে দাঁড়াবে, যার দায় সমাজ ও রাষ্ট্র দু’কেই বহন করতে হবে।

[লেখক : উন্নয়নকর্মী]

দেশি মাছ রক্ষায় অভয়াশ্রম

আলুর বাজার বিপর্যয় : কৃষকের ভাগ্যে লোকসান

ছবি

নীল নদের পানি নীল নয়

বিশ্ব বাঘ দিবস

ঢাকার কি রিস্ক এনালাইসিস করা আছে?

ছবি

সোনার হরফে লেখা অনন্য শিক্ষকের নাম

পরীক্ষার পর পরীক্ষা, কিন্তু কোথায় মূল্যায়ন ও মূল্যবোধের ভিত্তি?

বৃত্তি পরীক্ষায় কিন্ডারগার্টেন বাদ কেন?

সময়ের স্বৈরতন্ত্র : প্রতীক্ষা, ক্ষমতা ও জীবনের অসমতা

জলবায়ু পরিবর্তন মডেলে গণিতের ব্যবহার

দুর্ঘটনাজনিত দুর্যোগ-পরবর্তী করণীয় কী?

ডেঙ্গু, জিকা আর চিকুনগুনিয়া : একই উৎস, ত্রিমুখী সংকট

কেন থাইল্যান্ড-কম্বোডিয়ার ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি?

দুর্নীতি নির্মূল করা কি সম্ভব?

দরকার মানসম্মত শিক্ষা

ইসরায়েলের যুদ্ধনীতি ও বিশ্ব নিরাপত্তার সংকট

রম্যগদ্য : ‘বেইমান রাইট ব্রাদার্স’

মানসিক স্বাস্থ্যসেবা : আইনি কাঠামো, সংকট ও সম্ভাবনার দিক

ছবি

বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক উজ্জ্বল নক্ষত্র

দুর্যোগে অবিবেচকদেরকে কি দায়িত্বশীল ভাবা যায়?

ওয়াসার পদ্মা ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট : এক জীবন্ত বোটানিক্যাল গার্ডেন

রেলপথের দুর্দশা : সমন্বিত পরিকল্পনা না হলে বিপর্যয় অনিবার্য

বিশ্ববিদ্যালয় জ্ঞানচর্চার কেন্দ্র নাকি ক্ষমতার অভ্যন্তরীণ উপনিবেশ?

পিরোজপুরের স্কুলটির ফলাফল বিপর্যয় এবং আচরণগত অর্থনীতির দৃষ্টিকোণ

কোনো শাসকই অপরাজেয় নয়

পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি : বাঙালিকে রুচির দৈন্যে টেনে নামানো হচ্ছে

জনসংখ্যা ও যুবশক্তির চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা

রাষ্ট্রের কাছে স্বাভাবিক মৃত্যুর নিশ্চয়তা চাই

পার্বত্য চট্টগ্রাম : প্রাকৃতিক সম্পদ ও অর্থনৈতিক সম্ভাবনা

ইউরেশিয়ায় তৃতীয় বিকল্প গালফ কূটনীতি

‘বিপ্লবী সংস্কার’ কি সম্ভব

রম্যগদ্য : ‘ব্যাংক, ব্যাংক নয়’

মবতন্ত্রের জয়

ডিজিটাল ক্লান্তি ও ‘সর্বক্ষণ সক্রিয়’ সংস্কৃতির শ্রেণীগত রাজনীতি

ছবি

বোধের স্ফূরণ, না ‘মেটিকুলাস ডিজাইন’?

এসএসসিতে গণিত বিষয়ে ফল বিপর্যয় : কারণ ও উত্তরণের উপায়

tab

উপ-সম্পাদকীয়

নিয়ন্ত্রণহীন নেটজগৎ ও ফেইসবুক : সমাজে বিভ্রান্তির ডিজিটাল উৎপত্তি

শাহ মো. জিয়াউদ্দিন

শনিবার, ৩১ মে ২০২৫

বর্তমান যুগে তথ্য জানার প্রধান উৎস হয়ে উঠেছে ইন্টারনেট। যে কোনো বিষয়ে জানতে এখন মানুষ চোখ রাখে মোবাইল স্ক্রিনে; আঙুল ছোঁয়ায় সার্চ হয় গুগলে। তবে এই নির্ভরতা যেমন মানুষকে তথ্যের দোরগোড়ায় নিয়ে যাচ্ছে, তেমনি একে কেন্দ্র করে গড়ে উঠছে গুজব, অপপ্রচার এবং তথ্যবিকৃতির এক ভয়াবহ সাম্রাজ্য। অনেক সময় এমন কিছু খবর ভাইরাল হয়, যা পড়ে চোখ কপালে ওঠে। এগুলো শুধু গুজব নয়, বরং উদ্দেশ্যমূলকভাবে ছড়ানো হয় বিভ্রান্তি তৈরির জন্য। একে নিছক ‘ইয়েলো জার্নালিজম’ বললে ভুল হবে; বরং একে বলা উচিত ‘ডিজিটাল অপপ্রচার যন্ত্র’।

প্রশ্ন জাগেÑএই নেটজগৎ বা ডিজিটাল মিডিয়া আসলে কে নিয়ন্ত্রণ করে? যদি বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) সত্যিকার অর্থেই কার্যকর নিয়ন্ত্রক হতো, তাহলে দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি কিংবা ধর্মসংক্রান্ত সংবেদনশীল ইস্যু নিয়ে এমন অবাধ ও নোংরা অপপ্রচার চলতে পারত না। বিশেষ করে ফেইসবুক নামের সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মটি সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে অসামাজিকতার বীজ বপন করছে।

ফেইসবুকের কুপ্রভাব সবচেয়ে ভয়াবহভাবে পড়ছে উঠতি বয়সের কিশোর-কিশোরীদের ওপর। তারা দিনরাত এই প্ল্যাটফর্মে সময় কাটিয়ে আসক্ত হয়ে পড়ছে অশ্লীলতা, পর্নোগ্রাফি এবং সহিংস কনটেন্টে। অপরাধমূলক কর্মকা-কে রীতিমতো রোমাঞ্চকর হিসেবে তুলে ধরা ‘রিল’গুলো দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে তারা জড়িয়ে পড়ছে কিশোর গ্যাং নামক ভয়ানক সামাজিক ব্যাধিতে।

রাজনৈতিকভাবে বিরোধী মত দমনে ব্যবহৃত হচ্ছে এসব মিডিয়া। ফেইসবুকে সরকারের শীর্ষ নেতৃত্বের পক্ষে বিপক্ষে নানা ধরনের ‘রিল’ এবং ভিডিও বানানো হয়। অনেক রিলে সরকারপ্রধানের প্রশংসা থাকলেও, অন্য অনেক রিলে থাকে চরম অশ্লীলতা, অপমান, এমনকি নারী অবমাননার উপাদান, যা এক ধরনের ডিজিটাল সহিংসতার শামিল। রাজনৈতিক রম্য বা ব্যঙ্গচিত্র যদি শৈল্পিক এবং শিক্ষণীয় হয়, তা গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির অংশ হতে পারে। কিন্তু বর্তমানে যে ধরনের ভিডিও বা কনটেন্ট তৈরি হচ্ছে, তা সমাজে বিভ্রান্তি ছড়ানো এবং ঘৃণা উসকে দেয়ার অন্যতম মাধ্যম হয়ে উঠছে।

দেশের অনেক মানুষ এখন ফেইসবুকনির্ভর তথ্যে বিশ্বাস স্থাপন করছে। কে কোথায় কী বলল, কী ঘটলÑসবই তারা যাচাই না করেই ধরে নিচ্ছে সত্যি বলে। এ থেকেই জন্ম নিচ্ছে অকারণ তর্ক-বিতর্ক, এমনকি শারীরিক সংঘর্ষ পর্যন্ত। যেমন- একজন ব্যক্তি বলছিলেন, ‘ড. ইউনূসকে ঘিরে ফেলেছে সশস্ত্র বাহিনী, গ্রেপ্তার হবে যে কোনো সময়!’ তথ্যের উৎস জানতে চাইলে বলেনÑ‘নেটে পড়েছি, ভারতের এক মিডিয়ায় এসেছে।’ পরে দেখা গেল সেটি নিছক গুজব ছিল।

একজন এমপিওভুক্ত শিক্ষক সারাদিন ফেইসবুক থেকে পাওয়া তথ্যে রাজনীতি চর্চা করেন। আশপাশের মানুষকেও তিনি শেখান সেই তথ্যÑযার উৎস বা ভিত্তি কিছুই যাচাই করা নয়। আবার অনেকে বিশ্ব রাজনীতি কিংবা অর্থনীতির জটিল বিষয়েও মতামত দিচ্ছেন ফেইসবুক সূত্রে প্রাপ্ত অর্ধসত্য তথ্যের ওপর ভিত্তি করে। যেমন, বন্দর লিজ প্রসঙ্গে এক ব্যক্তি বললেন, ‘বিশ্বের সব বড় বড় দেশ বন্দর লিজ দেয়, না দিলে সরকার চলে না।’ অথচ তিনি জানেন না, লিজের শর্ত ও কাঠামো দেশভেদে ভিন্ন হয়। শুধু ফেইসবুক দেখে এমন বক্তব্য দেয়া মানেই হলো তথ্যবিকৃতি ছড়ানো।

আরেকটি মারাত্মক দিক হলো ধর্মীয় বিদ্বেষ ও মৌলবাদ। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ফেইসবুকে দেয়া স্ট্যাটাস কেন্দ্র করে দেশে বেশ কয়েকবার সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ছড়িয়েছে। ধর্মের নানা উপাখ্যান বিকৃত করে প্রচার করা হয়, যার প্রভাবে হিন্দু-মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে বিভেদ বাড়ে। কেউ যদি নারী স্বাধীনতা বা ধর্মনিরপেক্ষতার পক্ষে কথা বলে, তাকে ‘নাস্তিক’ তকমা দেয়া হয়। একজন তো ফেইসবুকে টাকার নোটে মন্দিরের ছবি দেখে বললেন, ‘এটা পকেটে নিয়ে নামাজ পড়া যাবে না।’ অথচ আগের নোটে বঙ্গবন্ধুর মুখ ছিল, অন্য দেশের মুদ্রাতেও থাকে মানুষের ছবিÑসেগুলোর কথা ভুলে গিয়ে আজ ধর্মকে ইস্যু বানিয়ে তৈরি করা হয় অপ্রয়োজনীয় বিতর্ক।

রাজনীতিতেও এখন ফেইসবুককেন্দ্রিক গুজব ছড়ানো হচ্ছে। যেমন- ‘ড. ইউনূস হবেন রাষ্ট্রপতি, তারেক রহমান হবেন প্রধানমন্ত্রী, জামাতের আমির হবেন উপ-প্রধানমন্ত্রী’Ñএই ধরনের হাস্যকর গুজবও বিশ্বাস করছে মানুষ। একজন অটোচালক বলছেন, ‘নেটে এসেছে, কোরবানির ঈদ হবে মঙ্গলবার।’ যতই বলুনÑএই তথ্য কর্তৃপক্ষ জানায়নি, তিনি বিশ্বাস করতে নারাজ। কারণ ‘নেট বলেছে’।

এই অবস্থার ফলে সমাজে একটি ভয়াবহ ডিজিটাল অজ্ঞতার সংস্কৃতি গড়ে উঠছে। তথ্য যাচাইয়ের সংস্কৃতি নেই, আছে শুধু ফেইসবুকনির্ভর আবেগ ও বিশ্বাস। যদিও স্বীকার করতে হবেÑসব তথ্য যে মিথ্যা, তা নয়। কিন্তু সামগ্রিক বিবেচনায় দেখা যাচ্ছে, ফেইসবুকে প্রচারিত অন্তত ৮০% খবরই হয় গুজব বা বিকৃত।

দেশের শিক্ষিত সমাজের বড় অংশও এই সংকটে আক্রান্ত। অনেক বিশ্ববিদ্যালয় ডিগ্রিধারীও যাচাই-বাছাই না করেই ফেইসবুকের তথ্য প্রচার করছেন। একারণেই এখন সামাজিক ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা রক্ষায় ফেইসবুক এবং অনলাইন কনটেন্টের কার্যকর নিয়ন্ত্রণ অত্যন্ত জরুরি হয়ে উঠেছে।

গণমাধ্যমের প্রতি মানুষের আস্থা ফিরিয়ে আনতে হলে, এই গুজবমুখর ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মগুলোকে কঠোর নজরদারির আওতায় আনতে হবে। রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকদের উচিত হবেÑএকদিকে ডিজিটাল শিক্ষার প্রসার ঘটানো, অন্যদিকে নীতিনির্ধারিত তথ্য যাচাইয়ের কেন্দ্র গড়ে তোলা, যেন ফেইসবুকনির্ভর গুজব-নির্ভরতা হ্রাস পায়।

একটি দায়িত্বশীল সামাজিক মাধ্যম হতে হলে, ফেইসবুককেই সর্বাগ্রে হতে হবে স্বচ্ছ ও নিয়ন্ত্রিত। অন্যথায়, এই মাধ্যম এক সময় সমাজে চরম বিশৃঙ্খলার কারণ হয়ে দাঁড়াবে, যার দায় সমাজ ও রাষ্ট্র দু’কেই বহন করতে হবে।

[লেখক : উন্নয়নকর্মী]

back to top