অরূপরতন চৌধুরী
বিশে^র এক নীরব মহামারীর নাম ‘তামাক’। তামাক ছাড়া আর এত বড় দ্বিতীয় কোন কারণ নেই, যা বছরে সারা বিশে^ ৮৭ লক্ষাধিক মানুষের প্রাণহাণির কারণ হতে পারে। আমাদের দেশেও তামাকের ভয়াবহতা উদ্বেগজনক, প্রতিদিন ৪৪৫ জন মানুষ মারা যায় তামাকের কারণে সৃষ্ট রোগে আক্রান্ত হয়ে! অথচ এ বিষয়ে তেমন কোন আলোচনা বা খবর নেই। অকালমৃত্যু প্রতিরোধে নেই যথেষ্ট প্রস্তুতি ও পরিকল্পনা।
সর্বগ্রাসী তামাকের ভয়াবহতা রুখে দিতে ১৯৮৭ সাল থেকে ৩১ মে দিনটিকে বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থার সদস্য দেশগুলোর উদ্যোগে ‘বিশ^ তামাকমুক্ত দিবস’ হিসেবে পালন করা হচ্ছে। ৯০-এর দশক থেকে বাংলাদেশেও তামাকমুক্ত দিবস পালিত হচ্ছে। জনসাধারণের মাঝে তামাক বিরোধী সচেতনতা সৃষ্টি এবং তামাকবিরোধী সামাজিক আন্দোলনটি জোরদারকরণে দিবসটির ভূমিকা অগ্রগণ্য। এক সময় বেসরকারি উদ্যোগে পালন করা হলেও এখন তামাকমুক্ত দিবসটি উদযাপনে নেতৃত্ব দিচ্ছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ সেল।
সরকারি-বেসরকারি সংস্থা-দপ্তরগুলোর সমন্বয়ে এ বছরও বিশ^ তামাকমুক্ত দিবস পালনে বিভিন্ন কর্মসূচি হাতে নেওয়া হয়েছে। বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থা এ বছর প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করেছে ‘তামাক কোম্পানির কূটকৌশল উন্মোচন করি, তামাক ও নিকোটিনমুক্ত বাংলাদেশ গড়ি।’
বর্তমান প্রেক্ষাপটে প্রতিপাদ্য অত্যন্ত সময়োপযোগী। কারণ মুনাফালোভী ধূর্ত তামাক কোম্পানিগুলো নানাবিধ অপকৌশলে তাদের মৃত্যুপণ্যের ব্যবসা সম্প্রসারণে মরিয়া হয়ে উঠেছে। এমনকি তামাক কোম্পানিগুলো রাষ্ট্রীয় আইন, বিধিমালা, নিয়ম-কানুনের তোয়াক্কা করছে না! তাদের প্রধান টার্গেট আমাদের সন্তান! শিশু-কিশোর ও তরুণদের অর্থাৎ- আগামী প্রজন্মকে তারা নেশার ফাঁদে ফেলে মুনাফার পাহাড় গড়ার নেশায় আগ্রাসী রূপ ধারণ করেছে এবং সেটা ঠিক এমন সময়ে, যখন বাংলাদেশ ‘ইয়ুথ ডিভিডেন্ট’ এর সুফল পেতে চলেছে। তামাক কোম্পানি সেটা তাদের অশুভ লক্ষ্য বাস্তবায়নে উদগ্রীব হয়ে আছে!
অল্প বয়সেই ছেলে-মেয়েরা কৌতূহুলবশত অথবা প্ররোচনায় ধূমপান ও ভয়াবহ মাদকের নেশায় জড়িয়ে পড়ে। ধূমপান, মাদকের নেশায় একবার কেউ আসক্ত হলে ফেরানো অত্যন্ত কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। অনৈতিকভাবে ঠিক এই সুযোগেরই অপব্যবহার করছে তামাক কোম্পানিগুলো। নিত্যনতুন কৌশলে আমাদের সন্তানদের নেশার জালে আটকাতে মরিয়া হয়ে প্রচারণা, প্রলুব্ধ করছে।
ইদানীং দেখা যায়, কিশোর-তরুণদের যাতায়াত বেশি এমন বিভিন্ন রেস্টুরেন্টে ‘ধূমপানের স্থান’ তৈরি করছে সিগারেট কোম্পানিগুলো। যেখানে ধূমপান থেকে শুরু করে বিভিন্ন মাদকও সেবন করা হয়। স্কুল-কলেজসহ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও জনবহুল স্থান ও আশপাশে সিগারেটের দোকান, ভ্রাম্যমাণ দোকান বেশি। সিগারেট ও সেগুলোর কৌশলী বিজ্ঞাপন সব বাচ্চাদের চোখ সমান্তরালে প্রদর্শন করা হচ্ছে। অথচ তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনে তামাকের সব ধরনের বিজ্ঞাপন, প্রচারণা, পৃষ্ঠপোষকতা নিষিদ্ধ। স্থানীয় সরকার বিভাগের তামাক নিয়ন্ত্রণ নির্দেশিকায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ১০০ মিটারের মধ্যে তামাকজাত দ্রব্যের বিক্রয় কেন্দ্র নিষিদ্ধ করা হয়েছে। তবুও তামাক কোম্পানি ব্যবসায়িক স্বার্থ চরিতার্থ করার হিংস্র নেশায় আমাদের শিশু-কিশোর, তরুণদেরই বলির পাঁঠা বানাচ্ছে। ফলে কিশোর-তরুণ পথভ্রষ্ট হয়ে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের বোঝা হয়ে পড়ছে। সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি, সামাজিক অপরাধ, বেকারত্বের হার বাড়ছে। ‘কিশোর গ্যাং’ অপসংস্কৃতির উদ্ভব ঘটছে।
বাংলাদেশে বর্তমানে ৩৫.৩% (৩ কোটি ৭৮ লাখ) প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ ধূমপান, তামাক সেবন করে। শিশু-কিশোরদের মধ্যেও এই বদঅভ্যাস রয়েছে, যা অত্যন্ত মারাত্মক ও অশনিসংকেত! বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থা পরিচালিত গবেষণায় দেখা যায়, বাংলাদেশে ১৩-১৫ বছর বয়সি শিশু-কিশোরদের মধ্যে তামাক ব্যবহার করে ৯ দশমিক ২ শতাংশ। বিশ্বে এই সংখ্যা ৩ কোটি ৮০ লাখ (বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ২০২১)! শিশু-কিশোর ও তরুণদের মধ্যে ধূমপানের হার বাড়ছে আশঙ্কাজনক হারে। খেয়াল করবেন, স্কুল-কলেজের শিশু, কিশোরদের ইউনিফর্ম পরিহিত অবস্থায় ভয়-ডরহীনভাবে হিরোদের মতো প্রকাশ্যে সিগারেট ও ফ্যাশন হিসেবে ই-সিসারেট সেবন করতে দেখা যায়। তাদের বয়সে আমরা বয়োজেষ্ঠ্যদের সম্মানে ধূমপান তো দুরের কথা, জোরে কথাও বলতে বারণ ছিলো! সুতরাং, সচেতনতা বাড়ানো ও আইন বাস্তবায়নে দায়িত্বপ্রাপ্তদের আরো সক্রিয় হতে হবে।
বর্তমানে সোশ্যাল মিডিয়ার অপব্যবহার তরুণদের বিপথগামী করছে। এখানে বিনোদন মাধ্যমের কথা বলতেই হয়। বাংলাদেশের চলচ্চিত্র, নাটক এবং ওয়েবসিরিজে নায়ক, নায়িকা ও ভিলেন দ্বারা অবাধে ধূমপান, মাদক, অ্যালকোহল সেবনের দৃশ্য ফোকাস করে চিত্রায়িত করা হচ্ছে। মানস এর পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, এ বছর ঈদুল ফিতরে মুক্তিপ্রাপ্ত একটি ব্যবসা সফল চলচ্চিত্র ‘বরবাদ’ এ ১২১ বার ধূমপানের দৃশ্য ছিলো যার মধ্যে নায়ককে ৮৩টি দৃশ্যে ধূমপান করতে দেখা গেছে। ১৯ বার নিষিদ্ধ মাদকদ্রব্য সেবনের দৃশ্য ছিলো। উপরন্তু ভাষা, ভিনদেশি সংস্কৃতির মিশেল, খুন-হত্যার দৃশ্যে উগ্রতা এবং সতর্কতা না দেয়া বিষয়গুলো যে কোন সচেতন মানুষকে ভাবাতে বাধ্য। আরেকটি চলচ্চিত্র ‘জংলি’তেও ৫৭ বার ধূমপানের দৃশ্য ছিলো। ‘কাহিনীর প্রয়োজন’ নাম করে এগুলো তামাক কোম্পানির লালসা চরিতার্থের ‘হিডেন এজেন্ডা’ হিসেবে সু-কৌশলে ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে। আরো যুক্ত হয়েছে হালের ওয়েবসিরিজ। এগুলোর কন্টেন্ট এ ধূমপান, মাদক, ভাষার অপব্যবহার যেন কোন ব্যাপরই নয়! শিশু, কিশোর-তরুণরা অনুসরণ ও অনুকরণ প্রিয়। বিনোদনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গন চলচ্চিত্র। সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে এবং ভবিষ্যত প্রজন্মের স্বার্থ চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্ট শিল্পী, প্রযোজক-পরিচালকরা এমন কিছু করতে পারেন না, যা সামাজিক সমস্যার কারণ হতে পারে।
উদ্বেগের বিষয় হলো- তামাক কোম্পানিগুলোর অপ্রচারে মানুষ বিভ্রান্ত হচ্ছে। নিরাপদ মনে করে অনেকে ই-সিগারেটের দিকে ঝুঁকছে। গ্রামাঞ্চলেও ই-সিগারেট বিপণন, ব্যবহার বাড়ছে। কারণ ই-সিগারেট পণ্যগুলো অত্যন্ত আকর্ষণীয় এবং এর মধ্যে বিভিন্ন ফ্লেভার ব্যবহার করে থাকে, যা তরুণ ও উঠতি বয়সিদের আর্কষণের মূল কারণ। ফ্যাশন হিসেবেও নিয়ে উঠতি বয়সিদের মধ্যে ই-সিগারেট ব্যবহার বাড়ছে। ই-সিগারেট-কে ‘ধূমপান ত্যাগে সহায়ক’ বলে অপপ্রচার চালানোর কারণে অনেকে প্রচলতি সিগারেটের বিকল্প ভাবছেন! আবার অনলাইন প্ল্যাটফর্মগুলোতে সেগুলো বেচা-কেনা চলছে নিয়ন্ত্রণহীনভাবে। নাটক-সিনেমায় এবং সোস্যাল মিডিয়ায় জনপ্রিয় তারকাদের দ্বারা সেগুলোর প্রচার-প্রচারণা চালাচ্ছে। প্রকৃত সত্য হলোÑ ই-সিগারেট সাধারণ সিগারেটের চেয়ে দশগুণ বেশি ক্ষতিকর! ভেপ, ই-সিগারেট ব্যবহারকারীরা স্ট্রোক, হার্টঅ্যাটাক, সাডেন কার্ডিয়াক ডেথের শিকার হতে পারেন। ক্ষতিকর বিবেচনায় নিয়ে ভারত, ভুটান, নেপাল, শ্রীলংকা, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ডসহ বিশ্বের প্রায় ৪০টি দেশ ই-সিগারেট নিষিদ্ধ করেছে।
২০২৪ সালের অক্টোবরে স্বাস্থ্য উপদেষ্টাকে এক সাক্ষাতের সময় বিষয়টি উপস্থাপন করি। আগামী প্রজন্মের সুরক্ষার বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের আমদানি নীতি আদেশে এ ই-সিগারেট (ইলেকট্রনিক নিকোটিন ডেলিভারি সিস্টেম) আমদানি নিষিদ্ধ করেছে। নিঃসন্দেহে জনস্বাস্থ্য সুরক্ষা এবং আগামী প্রজন্মের প্রতিনিধিদের তামাকের নতুন মরণফাঁদ থেকে রক্ষায় এটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। দীর্ঘমেয়াদের সুফল আমরা নিশ্চয়ই পাব। তবে ই-সিগারেট নামক নতুন এ আপদ সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ করতে হবে। শিশু, কিশোর-তরুণদের নিকোটিনের ফাঁদ থেকে বাঁচাতে হবে।
একসময় তরুণরা কর্মক্ষমতা হারাবে। এই বিপুল জনগণকে সুস্থ রাখতে হলে তরুণ বয়সে নানাবিধ কু-অভ্যাস, অস্বাস্থ্যকর ও অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন থেকে দূরে রাখা প্রয়োজন। দেশে অসংক্রামক রোগের আগ্রাসন বাড়ছে। বর্তমানে ৬৭% মৃত্যু হয় অসংক্রামক রোগে আক্রান্ত হয়ে। রোগ-ব্যাধি ও সেগুলোর চিকিৎসায় অর্থনীতির ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ে। সামগ্রিক উন্নয়নও এর সাথে সংশ্লিষ্ট। সুতরাং এমন পরিস্থিতিতে দীর্ঘমেয়াদে পদক্ষেপ হিসেবে তরুণদের সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে হবে। তারুণ্যকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে নীতি-নির্ধারণ ও বাস্তবায়নে তাদের সার্বিক সম্পৃক্ততা ও সুফল নিশ্চিত করতে হবে যেন, বহুজাতিক তামাক কোম্পানিগুলো আমাদের সন্তানদের দিকে হাত বাড়ানোর সাহস না পায়। কারণ দেশে প্রায় ১ কোটি মানুষ মাদকাসক্ত রয়েছে; যাদের মধ্যে প্রায় ৯০% তরুণ-কিশোর। এ সংখ্যা আরো বাড়–কÑ আমরা এটা কখনও চাই না।
আমাদের এটাও মনে রাখা প্রয়োজন যে, সিগারেটের ধোঁয়ায় থাকা ৭ হাজারের বেশি বিষাক্ত রাসায়নিক আছে। এর মধ্যে ৭০টি ক্যান্সার সৃষ্টি করে। সুতরাং তামাকের পরোক্ষ ক্ষতি থেকেও অধূমপায়ী বিশেষ করে- শিশু, নারীদের রক্ষা করতে হবে। বাংলাদেশে ১৫ বছরের কমবয়সি শিশুর মধ্যে ৪ লাখ ৩৫ হাজারের বেশি শিশু তামাকজনিত বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়, যার মধ্যে ৬১ হাজারের অধিক শিশু বাড়িতে পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হয়। পরোক্ষ ধূমপানে বাংলাদেশে প্রায় ২৬ হাজার অধূমপায়ী মারা যায়, এদের অধিকাংশ শিশু ও নারী।
সুতরাং তামাকের বিষাক্ত ছোবল থেকে নিজেকে রক্ষা করুন এবং প্রিয়জনদের ও আপনার আশপাশে সবার সুরক্ষা নিশ্চিত করুন। সবার ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্ঠায় বছরে ১ লাখ ৬১ হাজারের অধিক মানুষের অকালমৃত্যু, ১২ লাখ মানুষ অসুস্থতা ও ৪ লাখ মানুষের পঙ্গুত্ব প্রতিরোধ করা সম্ভব হবে। জনসাধারণের মধ্যে সচেতনতা ও আইনের যথাযথ বাস্তবায়নই পারে তামাকমুক্ত সমাজ ও তামাকমুক্ত দেশ গড়তে। ৩১ মে বিশ^ তামাকমুক্ত দিবসের আহ্বান সফল হোক।
[লেখক : ভিজিটিং প্রফেসর, ডিপার্টমেন্ট অব ডেন্টাল সার্জারি, বারডেম; অধ্যাপক, ইব্রাহিম মেডিকেল কলেজ]
অরূপরতন চৌধুরী
শনিবার, ৩১ মে ২০২৫
বিশে^র এক নীরব মহামারীর নাম ‘তামাক’। তামাক ছাড়া আর এত বড় দ্বিতীয় কোন কারণ নেই, যা বছরে সারা বিশে^ ৮৭ লক্ষাধিক মানুষের প্রাণহাণির কারণ হতে পারে। আমাদের দেশেও তামাকের ভয়াবহতা উদ্বেগজনক, প্রতিদিন ৪৪৫ জন মানুষ মারা যায় তামাকের কারণে সৃষ্ট রোগে আক্রান্ত হয়ে! অথচ এ বিষয়ে তেমন কোন আলোচনা বা খবর নেই। অকালমৃত্যু প্রতিরোধে নেই যথেষ্ট প্রস্তুতি ও পরিকল্পনা।
সর্বগ্রাসী তামাকের ভয়াবহতা রুখে দিতে ১৯৮৭ সাল থেকে ৩১ মে দিনটিকে বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থার সদস্য দেশগুলোর উদ্যোগে ‘বিশ^ তামাকমুক্ত দিবস’ হিসেবে পালন করা হচ্ছে। ৯০-এর দশক থেকে বাংলাদেশেও তামাকমুক্ত দিবস পালিত হচ্ছে। জনসাধারণের মাঝে তামাক বিরোধী সচেতনতা সৃষ্টি এবং তামাকবিরোধী সামাজিক আন্দোলনটি জোরদারকরণে দিবসটির ভূমিকা অগ্রগণ্য। এক সময় বেসরকারি উদ্যোগে পালন করা হলেও এখন তামাকমুক্ত দিবসটি উদযাপনে নেতৃত্ব দিচ্ছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ সেল।
সরকারি-বেসরকারি সংস্থা-দপ্তরগুলোর সমন্বয়ে এ বছরও বিশ^ তামাকমুক্ত দিবস পালনে বিভিন্ন কর্মসূচি হাতে নেওয়া হয়েছে। বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থা এ বছর প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করেছে ‘তামাক কোম্পানির কূটকৌশল উন্মোচন করি, তামাক ও নিকোটিনমুক্ত বাংলাদেশ গড়ি।’
বর্তমান প্রেক্ষাপটে প্রতিপাদ্য অত্যন্ত সময়োপযোগী। কারণ মুনাফালোভী ধূর্ত তামাক কোম্পানিগুলো নানাবিধ অপকৌশলে তাদের মৃত্যুপণ্যের ব্যবসা সম্প্রসারণে মরিয়া হয়ে উঠেছে। এমনকি তামাক কোম্পানিগুলো রাষ্ট্রীয় আইন, বিধিমালা, নিয়ম-কানুনের তোয়াক্কা করছে না! তাদের প্রধান টার্গেট আমাদের সন্তান! শিশু-কিশোর ও তরুণদের অর্থাৎ- আগামী প্রজন্মকে তারা নেশার ফাঁদে ফেলে মুনাফার পাহাড় গড়ার নেশায় আগ্রাসী রূপ ধারণ করেছে এবং সেটা ঠিক এমন সময়ে, যখন বাংলাদেশ ‘ইয়ুথ ডিভিডেন্ট’ এর সুফল পেতে চলেছে। তামাক কোম্পানি সেটা তাদের অশুভ লক্ষ্য বাস্তবায়নে উদগ্রীব হয়ে আছে!
অল্প বয়সেই ছেলে-মেয়েরা কৌতূহুলবশত অথবা প্ররোচনায় ধূমপান ও ভয়াবহ মাদকের নেশায় জড়িয়ে পড়ে। ধূমপান, মাদকের নেশায় একবার কেউ আসক্ত হলে ফেরানো অত্যন্ত কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। অনৈতিকভাবে ঠিক এই সুযোগেরই অপব্যবহার করছে তামাক কোম্পানিগুলো। নিত্যনতুন কৌশলে আমাদের সন্তানদের নেশার জালে আটকাতে মরিয়া হয়ে প্রচারণা, প্রলুব্ধ করছে।
ইদানীং দেখা যায়, কিশোর-তরুণদের যাতায়াত বেশি এমন বিভিন্ন রেস্টুরেন্টে ‘ধূমপানের স্থান’ তৈরি করছে সিগারেট কোম্পানিগুলো। যেখানে ধূমপান থেকে শুরু করে বিভিন্ন মাদকও সেবন করা হয়। স্কুল-কলেজসহ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও জনবহুল স্থান ও আশপাশে সিগারেটের দোকান, ভ্রাম্যমাণ দোকান বেশি। সিগারেট ও সেগুলোর কৌশলী বিজ্ঞাপন সব বাচ্চাদের চোখ সমান্তরালে প্রদর্শন করা হচ্ছে। অথচ তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনে তামাকের সব ধরনের বিজ্ঞাপন, প্রচারণা, পৃষ্ঠপোষকতা নিষিদ্ধ। স্থানীয় সরকার বিভাগের তামাক নিয়ন্ত্রণ নির্দেশিকায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ১০০ মিটারের মধ্যে তামাকজাত দ্রব্যের বিক্রয় কেন্দ্র নিষিদ্ধ করা হয়েছে। তবুও তামাক কোম্পানি ব্যবসায়িক স্বার্থ চরিতার্থ করার হিংস্র নেশায় আমাদের শিশু-কিশোর, তরুণদেরই বলির পাঁঠা বানাচ্ছে। ফলে কিশোর-তরুণ পথভ্রষ্ট হয়ে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের বোঝা হয়ে পড়ছে। সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি, সামাজিক অপরাধ, বেকারত্বের হার বাড়ছে। ‘কিশোর গ্যাং’ অপসংস্কৃতির উদ্ভব ঘটছে।
বাংলাদেশে বর্তমানে ৩৫.৩% (৩ কোটি ৭৮ লাখ) প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ ধূমপান, তামাক সেবন করে। শিশু-কিশোরদের মধ্যেও এই বদঅভ্যাস রয়েছে, যা অত্যন্ত মারাত্মক ও অশনিসংকেত! বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থা পরিচালিত গবেষণায় দেখা যায়, বাংলাদেশে ১৩-১৫ বছর বয়সি শিশু-কিশোরদের মধ্যে তামাক ব্যবহার করে ৯ দশমিক ২ শতাংশ। বিশ্বে এই সংখ্যা ৩ কোটি ৮০ লাখ (বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ২০২১)! শিশু-কিশোর ও তরুণদের মধ্যে ধূমপানের হার বাড়ছে আশঙ্কাজনক হারে। খেয়াল করবেন, স্কুল-কলেজের শিশু, কিশোরদের ইউনিফর্ম পরিহিত অবস্থায় ভয়-ডরহীনভাবে হিরোদের মতো প্রকাশ্যে সিগারেট ও ফ্যাশন হিসেবে ই-সিসারেট সেবন করতে দেখা যায়। তাদের বয়সে আমরা বয়োজেষ্ঠ্যদের সম্মানে ধূমপান তো দুরের কথা, জোরে কথাও বলতে বারণ ছিলো! সুতরাং, সচেতনতা বাড়ানো ও আইন বাস্তবায়নে দায়িত্বপ্রাপ্তদের আরো সক্রিয় হতে হবে।
বর্তমানে সোশ্যাল মিডিয়ার অপব্যবহার তরুণদের বিপথগামী করছে। এখানে বিনোদন মাধ্যমের কথা বলতেই হয়। বাংলাদেশের চলচ্চিত্র, নাটক এবং ওয়েবসিরিজে নায়ক, নায়িকা ও ভিলেন দ্বারা অবাধে ধূমপান, মাদক, অ্যালকোহল সেবনের দৃশ্য ফোকাস করে চিত্রায়িত করা হচ্ছে। মানস এর পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, এ বছর ঈদুল ফিতরে মুক্তিপ্রাপ্ত একটি ব্যবসা সফল চলচ্চিত্র ‘বরবাদ’ এ ১২১ বার ধূমপানের দৃশ্য ছিলো যার মধ্যে নায়ককে ৮৩টি দৃশ্যে ধূমপান করতে দেখা গেছে। ১৯ বার নিষিদ্ধ মাদকদ্রব্য সেবনের দৃশ্য ছিলো। উপরন্তু ভাষা, ভিনদেশি সংস্কৃতির মিশেল, খুন-হত্যার দৃশ্যে উগ্রতা এবং সতর্কতা না দেয়া বিষয়গুলো যে কোন সচেতন মানুষকে ভাবাতে বাধ্য। আরেকটি চলচ্চিত্র ‘জংলি’তেও ৫৭ বার ধূমপানের দৃশ্য ছিলো। ‘কাহিনীর প্রয়োজন’ নাম করে এগুলো তামাক কোম্পানির লালসা চরিতার্থের ‘হিডেন এজেন্ডা’ হিসেবে সু-কৌশলে ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে। আরো যুক্ত হয়েছে হালের ওয়েবসিরিজ। এগুলোর কন্টেন্ট এ ধূমপান, মাদক, ভাষার অপব্যবহার যেন কোন ব্যাপরই নয়! শিশু, কিশোর-তরুণরা অনুসরণ ও অনুকরণ প্রিয়। বিনোদনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গন চলচ্চিত্র। সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে এবং ভবিষ্যত প্রজন্মের স্বার্থ চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্ট শিল্পী, প্রযোজক-পরিচালকরা এমন কিছু করতে পারেন না, যা সামাজিক সমস্যার কারণ হতে পারে।
উদ্বেগের বিষয় হলো- তামাক কোম্পানিগুলোর অপ্রচারে মানুষ বিভ্রান্ত হচ্ছে। নিরাপদ মনে করে অনেকে ই-সিগারেটের দিকে ঝুঁকছে। গ্রামাঞ্চলেও ই-সিগারেট বিপণন, ব্যবহার বাড়ছে। কারণ ই-সিগারেট পণ্যগুলো অত্যন্ত আকর্ষণীয় এবং এর মধ্যে বিভিন্ন ফ্লেভার ব্যবহার করে থাকে, যা তরুণ ও উঠতি বয়সিদের আর্কষণের মূল কারণ। ফ্যাশন হিসেবেও নিয়ে উঠতি বয়সিদের মধ্যে ই-সিগারেট ব্যবহার বাড়ছে। ই-সিগারেট-কে ‘ধূমপান ত্যাগে সহায়ক’ বলে অপপ্রচার চালানোর কারণে অনেকে প্রচলতি সিগারেটের বিকল্প ভাবছেন! আবার অনলাইন প্ল্যাটফর্মগুলোতে সেগুলো বেচা-কেনা চলছে নিয়ন্ত্রণহীনভাবে। নাটক-সিনেমায় এবং সোস্যাল মিডিয়ায় জনপ্রিয় তারকাদের দ্বারা সেগুলোর প্রচার-প্রচারণা চালাচ্ছে। প্রকৃত সত্য হলোÑ ই-সিগারেট সাধারণ সিগারেটের চেয়ে দশগুণ বেশি ক্ষতিকর! ভেপ, ই-সিগারেট ব্যবহারকারীরা স্ট্রোক, হার্টঅ্যাটাক, সাডেন কার্ডিয়াক ডেথের শিকার হতে পারেন। ক্ষতিকর বিবেচনায় নিয়ে ভারত, ভুটান, নেপাল, শ্রীলংকা, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ডসহ বিশ্বের প্রায় ৪০টি দেশ ই-সিগারেট নিষিদ্ধ করেছে।
২০২৪ সালের অক্টোবরে স্বাস্থ্য উপদেষ্টাকে এক সাক্ষাতের সময় বিষয়টি উপস্থাপন করি। আগামী প্রজন্মের সুরক্ষার বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের আমদানি নীতি আদেশে এ ই-সিগারেট (ইলেকট্রনিক নিকোটিন ডেলিভারি সিস্টেম) আমদানি নিষিদ্ধ করেছে। নিঃসন্দেহে জনস্বাস্থ্য সুরক্ষা এবং আগামী প্রজন্মের প্রতিনিধিদের তামাকের নতুন মরণফাঁদ থেকে রক্ষায় এটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। দীর্ঘমেয়াদের সুফল আমরা নিশ্চয়ই পাব। তবে ই-সিগারেট নামক নতুন এ আপদ সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ করতে হবে। শিশু, কিশোর-তরুণদের নিকোটিনের ফাঁদ থেকে বাঁচাতে হবে।
একসময় তরুণরা কর্মক্ষমতা হারাবে। এই বিপুল জনগণকে সুস্থ রাখতে হলে তরুণ বয়সে নানাবিধ কু-অভ্যাস, অস্বাস্থ্যকর ও অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন থেকে দূরে রাখা প্রয়োজন। দেশে অসংক্রামক রোগের আগ্রাসন বাড়ছে। বর্তমানে ৬৭% মৃত্যু হয় অসংক্রামক রোগে আক্রান্ত হয়ে। রোগ-ব্যাধি ও সেগুলোর চিকিৎসায় অর্থনীতির ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ে। সামগ্রিক উন্নয়নও এর সাথে সংশ্লিষ্ট। সুতরাং এমন পরিস্থিতিতে দীর্ঘমেয়াদে পদক্ষেপ হিসেবে তরুণদের সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে হবে। তারুণ্যকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে নীতি-নির্ধারণ ও বাস্তবায়নে তাদের সার্বিক সম্পৃক্ততা ও সুফল নিশ্চিত করতে হবে যেন, বহুজাতিক তামাক কোম্পানিগুলো আমাদের সন্তানদের দিকে হাত বাড়ানোর সাহস না পায়। কারণ দেশে প্রায় ১ কোটি মানুষ মাদকাসক্ত রয়েছে; যাদের মধ্যে প্রায় ৯০% তরুণ-কিশোর। এ সংখ্যা আরো বাড়–কÑ আমরা এটা কখনও চাই না।
আমাদের এটাও মনে রাখা প্রয়োজন যে, সিগারেটের ধোঁয়ায় থাকা ৭ হাজারের বেশি বিষাক্ত রাসায়নিক আছে। এর মধ্যে ৭০টি ক্যান্সার সৃষ্টি করে। সুতরাং তামাকের পরোক্ষ ক্ষতি থেকেও অধূমপায়ী বিশেষ করে- শিশু, নারীদের রক্ষা করতে হবে। বাংলাদেশে ১৫ বছরের কমবয়সি শিশুর মধ্যে ৪ লাখ ৩৫ হাজারের বেশি শিশু তামাকজনিত বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়, যার মধ্যে ৬১ হাজারের অধিক শিশু বাড়িতে পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হয়। পরোক্ষ ধূমপানে বাংলাদেশে প্রায় ২৬ হাজার অধূমপায়ী মারা যায়, এদের অধিকাংশ শিশু ও নারী।
সুতরাং তামাকের বিষাক্ত ছোবল থেকে নিজেকে রক্ষা করুন এবং প্রিয়জনদের ও আপনার আশপাশে সবার সুরক্ষা নিশ্চিত করুন। সবার ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্ঠায় বছরে ১ লাখ ৬১ হাজারের অধিক মানুষের অকালমৃত্যু, ১২ লাখ মানুষ অসুস্থতা ও ৪ লাখ মানুষের পঙ্গুত্ব প্রতিরোধ করা সম্ভব হবে। জনসাধারণের মধ্যে সচেতনতা ও আইনের যথাযথ বাস্তবায়নই পারে তামাকমুক্ত সমাজ ও তামাকমুক্ত দেশ গড়তে। ৩১ মে বিশ^ তামাকমুক্ত দিবসের আহ্বান সফল হোক।
[লেখক : ভিজিটিং প্রফেসর, ডিপার্টমেন্ট অব ডেন্টাল সার্জারি, বারডেম; অধ্যাপক, ইব্রাহিম মেডিকেল কলেজ]