আনোয়ারুল হক
৬ এপ্রিল ১৯৭১ সালে বাংলার কসাই খ্যাত জেনারেল টিক্কা খানের সঙ্গে বৈঠকরত গোলাম আযম
একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় হত্যা, অপহরণ, নির্যাতনের ছয় ঘটনায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক মৃত্যুদ-প্রাপ্ত জামায়াতে ইসলামী নেতা আজহারুল ইসলাম রায় পুনর্বিবেচনার আপিল করে খালাস প্রাপ্তির পরে দলের আমির ঘোষণা করলেন সত্য বিজয়ী হয়েছে মিথ্যা পরাভূত হয়েছে। মামলার যাবতীয় দলিলপত্র ও পূর্ণাঙ্গ রায় না দেখে এবং রাষ্ট্রপক্ষের আদালতে কি ভূমিকা ছিলো তা না জেনে রায় সম্পর্কে সুস্পষ্ট কোনো মন্তব্য করা সমীচীন হবে না। তবে জামায়াতে ইসলামীর প্রতিক্রিয়া দেখে প্রশ্ন উঠতেই পারে জাতি সুবিচার পেলো কিনা।
একাত্তরে জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্র সংঘের (পরিবর্তিত নাম শিবির) নেতাকর্মীরা যে মানুষ হত্যা করেছে, মানুষের বাড়িঘর জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে দিয়েছে, সংখ্যালঘু নিধন করেছে, পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকর্তৃক বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও প্রগতিশীল রাজনীতির সমর্থকদের, মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে পারে এমন তরুণদের, দেশের সেরা বুদ্ধিজীবীদের অপহরণ ও হত্যাকা-ে এবং নারী নির্যাতনে সহযোগীর ভূমিকা পালন করেছেÑ এসব কি মিথ্যা ছিল?
২৫ মার্চ একাত্তর থেকেই শুরু করা যাক। ২৫ মার্চের সেই কালরাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ‘অপারেশন সার্চলাইট’ পরিচালনা করে ঘুমন্ত ও নিরস্ত্র মানুষের ওপর ইতিহাসের নৃশংসতম হত্যাযজ্ঞ চালায়। গণহত্যার পৈশাচিকতায় মেতে ওঠা ঘাতক পাকিস্তানি বাহিনী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, নীলক্ষেত এলাকা, রাজারবাগের পুলিশ লাইনস, পিলখানায় তৎকালীন ইপিআর সদর দপ্তরেও হামলা চালিয়ে গণহত্যা চালায়। জগন্নাথ হলে চলে নৃশংসতম হত্যাকা-ের সবচেয়ে বড় ঘটনাটি। সেখানে হত্যাযজ্ঞ চলে রাত থেকে সকাল পর্যন্ত। পাকিস্তানি হায়েনাদের কাছ থেকে রক্ষা পায়নি রোকেয়া হলের ছাত্রীরাও। ঢাকার পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন এলাকাতেও গণহত্যা শুরু করে হানাদার ঘাতকেরা।
পূর্ব পাকিস্তানের সংকট সম্পর্কে যে শ্বেতপত্র পাকিস্তান সরকার মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে প্রকাশ করেছিল তাতে বলা হয়Ñ ‘১৯৭১ সালের পহেলা মার্চ থেকে ২৫ মার্চ রাত পর্যন্ত এক লাখেরও বেশি মানুষের জীবননাশ হয়েছিল।’ ১ মার্চ থেকে ২৪ মার্চ পর্যন্ত নিহতের সংখ্যা হবে ১ থেকে ২ হাজার। তাহলে পাকিস্তানের স্বীকারোক্তি অনুযায়ীই ২৫ মার্চ শুধু একরাতেই সারা দেশে লাখো মানুষকে হত্যা করা হয়েছিলো।
যারা জুলাই অভ্যুত্থান দিয়ে ’৭১-কে ঢাকতে চান তারা কি ২৫ মার্চের এই একটি রাতের ইতিহাস জানেন? একটি রাতে এমন বর্বর গণহত্যা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। এর প্রতিক্রিয়ায় জামায়াত কী করেছিলো?
জামায়াতে ইসলামী দেশের অখ-তা রক্ষায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর এই গণহত্যাকে সমর্থন করে দেশের অখ-তা রক্ষা পাওয়ায় শুকরিয়া আদায় করে। জামায়াতে ইসলামীর তৎকালীন আমির ’৭১ সালের ৬ এপ্রিল জেনারেল টিক্কা খানের সাথে সাক্ষাৎ করে পাকিস্তান রক্ষাকল্পে হানাদার বাহিনীর বর্বরোচিত হত্যাকা-ের পক্ষে সমর্থন জানান। আর সাংবাদিকদের বলেন, ‘তার দল পূর্ব পাকিস্তানে দুষ্কৃতকারীদের তৎপরতা দমন করার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘জামায়াত কর্মীরা দেশের প্রতিরক্ষায় বাধ্য। কেননা তারা জানে ইসলাম ও মুসলমানদের জন্য বাংলাদেশ কোনো স্থান হতে পারে না। জামায়াত কর্মীরা শহিদ হতে পারে কিন্তু পরিবর্তিত হতে পারে না।’ আর তাই স্বাধীনতাকামী বাংলাদেশের মানুষের বিরুদ্ধে তাদের ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘের মাধ্যমে গড়ে তোলা হয় পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে সহায়তা দানকারী আধা-সামরিক বাহিনী আলবদর, আল শামস ও রাজাকার বাহিনী। এসব কাহিনী তো জামায়াতের মুখপত্র ‘দৈনিক সংগ্রামের’ ওই সময়ের পাতায় পাতায় উল্লেখ রয়েছে। সংগ্রামে প্রকাশিত ওই সময়ের ছবি, রিপোর্ট, সম্পাদকীয়, উপসম্পাদকীয় তো মিথ্যা নয়।
৭ সেপ্টেম্বর ১৯৭১ পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় অর্ডিন্যান্স জারি করে রাজাকার, আল বদর, আল শামসকে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর অন্তর্ভুক্ত করে নেয় এবং তাদের মাসিক বেতন, রেশন এবং ইউনিফর্ম দেয়া হয়। রাজাকার, আলবদর, আল শামস পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর অন্তর্ভুক্ত হয়ে সামরিক বাহিনীর কমান্ডের অধীনে চলে যায়। যুদ্ধকালীন অভিন্ন সামরিক কমান্ডে সামরিক বাহিনী এবং জামাতের বাহিনীগুলো (রাজাকার, আল বদর, আল সামস) পরিচালিত হতো। ৭ সেপ্টেম্বরের অর্ডিন্যান্স অনুসারে নিজামী এবং মুজাহিদসহ জামায়াতের যারাই রাজাকার, আলবদর ও আলশামস বাহিনীর নেতৃত্বে বা কমান্ডে ছিলেন তারা পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর কর্তা ব্যক্তিতে পরিণত হন এবং ইতিহাসের বর্বরতম গণহত্যার সাথে জড়িত হন এবং আজ পর্যন্ত জামায়াত এ নিয়ে ক্ষমা প্রার্থনা বা অনুশোচনা প্রকাশ করেনি। এমনকি গ্রেফতার হওয়ার ২৯ দিন আগেও জামায়াতের আমির গোলাম আযম বলেছিলেন ‘আমি বা জামায়াত এমন কিছু করেনি যার জন্য ক্ষমা চাইতে হবে।’
এসব কিছু জানার পরেও সবথেকে ‘চমকপ্রদ’ বক্তব্য দিয়েছেন আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল। আজাহারুলের খালাস পাওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, ‘এই ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সুযোগ সৃষ্টির কৃতিত্ব জুলাই গণ-আন্দোলনের অকুতোভয় নেতৃত্বের।’ তিনি জুলাই গণ-অভ্যুত্থানকে ’৭১-এর যুদ্ধাপরাধের বিচারের প্রতিপক্ষ হিসেবে অনেকটাই দাঁড় করিয়ে ফেললেন। তাও ভালো। তিনি তো আবেগী মানুষ। আনন্দে, আবেগে যে বলে ফেলেননিÑ এই কৃতিত্ব আইন ও বিচার মন্ত্রণালয়ের!
নব্বইয়ের দশকে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে শহিদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে যখন এক অভিনব আন্দোলন শুরু হয়, সেই সময় সাপ্তাহিক বিচিত্রায় রিপোর্টার হিসেবে কাজ করতেন আসিফ নজরুল। সাংবাদিক থেকে তিনি হয়ে ওঠেন যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পক্ষের একজন প্রবল অ্যাক্টিভিস্ট। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের লক্ষ্যে আন্দোলন গড়ে তুলতে ১০১ সদস্যবিশিষ্ট যে নাগরিক কমিটি গঠিত হয় সেই কমিটিতে এবং গণ-আদালতের যুগ্ম আহ্বায়ক হিসেবে আসিফ নজরুলও ছিলেন। তিনিই প্রথম ‘সাঈদী সমাচার, একজন ধর্ম ব্যবসায়ীর উত্থান’ শিরোনামে দেলোয়ার হোসেন সাঈদীর যুদ্ধাপরাধের তথ্য জনসমক্ষে নিয়ে আসেন। জাহানারা ইমামসহ গণ-আদালতের সঙ্গে সম্পৃক্ত যে ২৪ জন ব্যক্তির বিরুদ্ধে সেই সময়ের সরকার রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা করেছিল আসিফ নজরুলও সেই ২৪ আসামির মধ্যে একজন।
পল্টি খাওয়ার এই দেশে আসিফ নজরুলও পল্টি খেয়েছেন এবং কেবলা বদল করেছেন অনেক আগেই; কিন্তু তিনি তো খুব ভালোভাবেই জানেন যুদ্ধাপরাধের বিচারের জন্য যথেষ্ট তথ্য প্রমাণ ওই নাগরিক কমিটি সংগ্রহ করেছিল। তাই আওয়ামী লীগ আমলে বিচার প্রক্রিয়ায় যদি কোন অসঙ্গতি থেকেও থাকে তবে রায়কে অভিনন্দন জানানো তার মন্ত্রণালয়ের কাজ নয়। বরং বিচারিক প্রক্রিয়ার অসঙ্গতিকে দূর করে যথাযথ দলিল প্রমাণসহ নতুন করে এবং আইনসঙ্গতভাবে কিভাবে এ অপরাধের বিচার কিভাবে সম্পন্ন করা যায় সেদিকে মনোযোগ দেওয়া তার দায়িত্ব।
এটা তো মিথ্যা নয় যে, আজাহার আলী ১৯৭১ সালে ইসলামী ছাত্রসংঘের রংপুর ইউনিটের সভাপতি ছিলেন এবং একই সাথে আলবদর বাহিনীর কমান্ডার ছিলেন।
এটাও মিথ্যা নয় যে, ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল রংপুরের ঝাড়–য়ার বিলের হিন্দু অধ্যুষিত গ্রামগুলোতে আলবদর বাহিনী পরিকল্পিত হামলা চালায়। এতে প্রায় ১ হাজার ২০০ জন নিহত এবং আরও ২০০ জনেরও বেশি মানুষকে অপহরণ ও হত্যা করা হয়। এটাও তো মিথ্যা নয় যে, আলবদর বাহিনী ১৯৭১ সালের ৩০ এপ্রিল রংপুর কারমাইকেল কলেজ থেকে চারজন হিন্দু অধ্যাপক ও একজন অধ্যাপকের স্ত্রীকে অপহরণ করেন। পরে তাদের হত্যা করা হয়। এটাও তো মিথ্যা নয় যে, রংপুর টাউন হলে আলবদর বাহিনী ক্যাম্প করে ও অপহৃতদের সেখানে আটক করে রাখা হতো। এমনকি ওই সময়ে ধর্ষণ ক্যাম্প হিসেবে তা ব্যবহৃত হতো।
জামায়াতের দাবি অনুযায়ী সত্য বিজয়ী হয়ে থাকলে রংপুরের আলবদর বাহিনী কর্তৃক উপরে উল্লেখিত অপরাধসমূহ করা ন্যায়সঙ্গত ছিলো! বিচার প্রক্রিয়ায় ত্রুটি থাকতে পারে, কিন্তু এ অপরাধগুলো তো সংঘটিত হয়েছিলো। সে বিষয়ে উচ্চ আদালতের কোন পর্যবেক্ষণ বা তার প্রতিকার বিষয়ে কোনো নির্দেশনা আছে কিনা পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ হলে হয়তো বা জানা যাবে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে যে হারে মামলার সকল আসামিই খালাসের রায় পাচ্ছেন তাতে করে মনে প্রশ্ন জাগছে ২০০৮-এর পূর্বে এ দেশে কি কোন অপরাধ সংঘটিত হয়নি? বিশেষত জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন অবৈধ ঘোষণা করে হাইকোর্টের দেওয়া রায় আপিল বিভাগ বাতিল ঘোষণা করার পর মনে এ প্রশ্ন জাগা কি অস্বাভাবিক
যে, ১৯৭১-এ জামায়াতই তাহলে ন্যায়ের পথে ছিলো। অপরাধী ছিলো মুক্তিযোদ্ধারা, অপরাধী ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকরা। তাদেরই বরং পাকিস্তান ভাঙার অপরাধে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো উচিত। যারা ১৯৭১-এর অপরাধের জন্য পাকিস্তানকে ক্ষমা চাইতে বলে, জামায়াতকে অনুশোচনা করতে বলে তাদেরই বরং পাকিস্তান ভাঙার অপরাধে ক্ষমা চাওয়া উচিত! এদেশে মুক্তিযুদ্ধের সময় কেউ পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সহযোগী ছিলো না, কেউই রাজাকার, আলবদর, আল শামস বাহিনীতে থেকে কোন অপরাধমূলক কাজ করেনি। এ দেশে ১৯৭১ সালে কেউ মুনীর চৌধুরী, আনোয়ার পাশা, গোবিন্দ চন্দ্র দেব, মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতাকে হত্যাকা-ে সহযোগিতা করেনি। এ দেশে কেউ শহীদুল্লাহ কায়সার, জহির রায়হানকে হত্যা করেনি। ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’-র সুরকার আলতাফ মাহমুদকে এ দেশে কেউ হত্যা করেনি।
[লেখক : সাবেক ছাত্র নেতা]
আনোয়ারুল হক
৬ এপ্রিল ১৯৭১ সালে বাংলার কসাই খ্যাত জেনারেল টিক্কা খানের সঙ্গে বৈঠকরত গোলাম আযম
রোববার, ০১ জুন ২০২৫
একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় হত্যা, অপহরণ, নির্যাতনের ছয় ঘটনায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক মৃত্যুদ-প্রাপ্ত জামায়াতে ইসলামী নেতা আজহারুল ইসলাম রায় পুনর্বিবেচনার আপিল করে খালাস প্রাপ্তির পরে দলের আমির ঘোষণা করলেন সত্য বিজয়ী হয়েছে মিথ্যা পরাভূত হয়েছে। মামলার যাবতীয় দলিলপত্র ও পূর্ণাঙ্গ রায় না দেখে এবং রাষ্ট্রপক্ষের আদালতে কি ভূমিকা ছিলো তা না জেনে রায় সম্পর্কে সুস্পষ্ট কোনো মন্তব্য করা সমীচীন হবে না। তবে জামায়াতে ইসলামীর প্রতিক্রিয়া দেখে প্রশ্ন উঠতেই পারে জাতি সুবিচার পেলো কিনা।
একাত্তরে জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্র সংঘের (পরিবর্তিত নাম শিবির) নেতাকর্মীরা যে মানুষ হত্যা করেছে, মানুষের বাড়িঘর জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে দিয়েছে, সংখ্যালঘু নিধন করেছে, পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকর্তৃক বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও প্রগতিশীল রাজনীতির সমর্থকদের, মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে পারে এমন তরুণদের, দেশের সেরা বুদ্ধিজীবীদের অপহরণ ও হত্যাকা-ে এবং নারী নির্যাতনে সহযোগীর ভূমিকা পালন করেছেÑ এসব কি মিথ্যা ছিল?
২৫ মার্চ একাত্তর থেকেই শুরু করা যাক। ২৫ মার্চের সেই কালরাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ‘অপারেশন সার্চলাইট’ পরিচালনা করে ঘুমন্ত ও নিরস্ত্র মানুষের ওপর ইতিহাসের নৃশংসতম হত্যাযজ্ঞ চালায়। গণহত্যার পৈশাচিকতায় মেতে ওঠা ঘাতক পাকিস্তানি বাহিনী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, নীলক্ষেত এলাকা, রাজারবাগের পুলিশ লাইনস, পিলখানায় তৎকালীন ইপিআর সদর দপ্তরেও হামলা চালিয়ে গণহত্যা চালায়। জগন্নাথ হলে চলে নৃশংসতম হত্যাকা-ের সবচেয়ে বড় ঘটনাটি। সেখানে হত্যাযজ্ঞ চলে রাত থেকে সকাল পর্যন্ত। পাকিস্তানি হায়েনাদের কাছ থেকে রক্ষা পায়নি রোকেয়া হলের ছাত্রীরাও। ঢাকার পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন এলাকাতেও গণহত্যা শুরু করে হানাদার ঘাতকেরা।
পূর্ব পাকিস্তানের সংকট সম্পর্কে যে শ্বেতপত্র পাকিস্তান সরকার মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে প্রকাশ করেছিল তাতে বলা হয়Ñ ‘১৯৭১ সালের পহেলা মার্চ থেকে ২৫ মার্চ রাত পর্যন্ত এক লাখেরও বেশি মানুষের জীবননাশ হয়েছিল।’ ১ মার্চ থেকে ২৪ মার্চ পর্যন্ত নিহতের সংখ্যা হবে ১ থেকে ২ হাজার। তাহলে পাকিস্তানের স্বীকারোক্তি অনুযায়ীই ২৫ মার্চ শুধু একরাতেই সারা দেশে লাখো মানুষকে হত্যা করা হয়েছিলো।
যারা জুলাই অভ্যুত্থান দিয়ে ’৭১-কে ঢাকতে চান তারা কি ২৫ মার্চের এই একটি রাতের ইতিহাস জানেন? একটি রাতে এমন বর্বর গণহত্যা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। এর প্রতিক্রিয়ায় জামায়াত কী করেছিলো?
জামায়াতে ইসলামী দেশের অখ-তা রক্ষায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর এই গণহত্যাকে সমর্থন করে দেশের অখ-তা রক্ষা পাওয়ায় শুকরিয়া আদায় করে। জামায়াতে ইসলামীর তৎকালীন আমির ’৭১ সালের ৬ এপ্রিল জেনারেল টিক্কা খানের সাথে সাক্ষাৎ করে পাকিস্তান রক্ষাকল্পে হানাদার বাহিনীর বর্বরোচিত হত্যাকা-ের পক্ষে সমর্থন জানান। আর সাংবাদিকদের বলেন, ‘তার দল পূর্ব পাকিস্তানে দুষ্কৃতকারীদের তৎপরতা দমন করার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘জামায়াত কর্মীরা দেশের প্রতিরক্ষায় বাধ্য। কেননা তারা জানে ইসলাম ও মুসলমানদের জন্য বাংলাদেশ কোনো স্থান হতে পারে না। জামায়াত কর্মীরা শহিদ হতে পারে কিন্তু পরিবর্তিত হতে পারে না।’ আর তাই স্বাধীনতাকামী বাংলাদেশের মানুষের বিরুদ্ধে তাদের ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘের মাধ্যমে গড়ে তোলা হয় পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে সহায়তা দানকারী আধা-সামরিক বাহিনী আলবদর, আল শামস ও রাজাকার বাহিনী। এসব কাহিনী তো জামায়াতের মুখপত্র ‘দৈনিক সংগ্রামের’ ওই সময়ের পাতায় পাতায় উল্লেখ রয়েছে। সংগ্রামে প্রকাশিত ওই সময়ের ছবি, রিপোর্ট, সম্পাদকীয়, উপসম্পাদকীয় তো মিথ্যা নয়।
৭ সেপ্টেম্বর ১৯৭১ পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় অর্ডিন্যান্স জারি করে রাজাকার, আল বদর, আল শামসকে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর অন্তর্ভুক্ত করে নেয় এবং তাদের মাসিক বেতন, রেশন এবং ইউনিফর্ম দেয়া হয়। রাজাকার, আলবদর, আল শামস পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর অন্তর্ভুক্ত হয়ে সামরিক বাহিনীর কমান্ডের অধীনে চলে যায়। যুদ্ধকালীন অভিন্ন সামরিক কমান্ডে সামরিক বাহিনী এবং জামাতের বাহিনীগুলো (রাজাকার, আল বদর, আল সামস) পরিচালিত হতো। ৭ সেপ্টেম্বরের অর্ডিন্যান্স অনুসারে নিজামী এবং মুজাহিদসহ জামায়াতের যারাই রাজাকার, আলবদর ও আলশামস বাহিনীর নেতৃত্বে বা কমান্ডে ছিলেন তারা পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর কর্তা ব্যক্তিতে পরিণত হন এবং ইতিহাসের বর্বরতম গণহত্যার সাথে জড়িত হন এবং আজ পর্যন্ত জামায়াত এ নিয়ে ক্ষমা প্রার্থনা বা অনুশোচনা প্রকাশ করেনি। এমনকি গ্রেফতার হওয়ার ২৯ দিন আগেও জামায়াতের আমির গোলাম আযম বলেছিলেন ‘আমি বা জামায়াত এমন কিছু করেনি যার জন্য ক্ষমা চাইতে হবে।’
এসব কিছু জানার পরেও সবথেকে ‘চমকপ্রদ’ বক্তব্য দিয়েছেন আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল। আজাহারুলের খালাস পাওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, ‘এই ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সুযোগ সৃষ্টির কৃতিত্ব জুলাই গণ-আন্দোলনের অকুতোভয় নেতৃত্বের।’ তিনি জুলাই গণ-অভ্যুত্থানকে ’৭১-এর যুদ্ধাপরাধের বিচারের প্রতিপক্ষ হিসেবে অনেকটাই দাঁড় করিয়ে ফেললেন। তাও ভালো। তিনি তো আবেগী মানুষ। আনন্দে, আবেগে যে বলে ফেলেননিÑ এই কৃতিত্ব আইন ও বিচার মন্ত্রণালয়ের!
নব্বইয়ের দশকে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে শহিদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে যখন এক অভিনব আন্দোলন শুরু হয়, সেই সময় সাপ্তাহিক বিচিত্রায় রিপোর্টার হিসেবে কাজ করতেন আসিফ নজরুল। সাংবাদিক থেকে তিনি হয়ে ওঠেন যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পক্ষের একজন প্রবল অ্যাক্টিভিস্ট। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের লক্ষ্যে আন্দোলন গড়ে তুলতে ১০১ সদস্যবিশিষ্ট যে নাগরিক কমিটি গঠিত হয় সেই কমিটিতে এবং গণ-আদালতের যুগ্ম আহ্বায়ক হিসেবে আসিফ নজরুলও ছিলেন। তিনিই প্রথম ‘সাঈদী সমাচার, একজন ধর্ম ব্যবসায়ীর উত্থান’ শিরোনামে দেলোয়ার হোসেন সাঈদীর যুদ্ধাপরাধের তথ্য জনসমক্ষে নিয়ে আসেন। জাহানারা ইমামসহ গণ-আদালতের সঙ্গে সম্পৃক্ত যে ২৪ জন ব্যক্তির বিরুদ্ধে সেই সময়ের সরকার রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা করেছিল আসিফ নজরুলও সেই ২৪ আসামির মধ্যে একজন।
পল্টি খাওয়ার এই দেশে আসিফ নজরুলও পল্টি খেয়েছেন এবং কেবলা বদল করেছেন অনেক আগেই; কিন্তু তিনি তো খুব ভালোভাবেই জানেন যুদ্ধাপরাধের বিচারের জন্য যথেষ্ট তথ্য প্রমাণ ওই নাগরিক কমিটি সংগ্রহ করেছিল। তাই আওয়ামী লীগ আমলে বিচার প্রক্রিয়ায় যদি কোন অসঙ্গতি থেকেও থাকে তবে রায়কে অভিনন্দন জানানো তার মন্ত্রণালয়ের কাজ নয়। বরং বিচারিক প্রক্রিয়ার অসঙ্গতিকে দূর করে যথাযথ দলিল প্রমাণসহ নতুন করে এবং আইনসঙ্গতভাবে কিভাবে এ অপরাধের বিচার কিভাবে সম্পন্ন করা যায় সেদিকে মনোযোগ দেওয়া তার দায়িত্ব।
এটা তো মিথ্যা নয় যে, আজাহার আলী ১৯৭১ সালে ইসলামী ছাত্রসংঘের রংপুর ইউনিটের সভাপতি ছিলেন এবং একই সাথে আলবদর বাহিনীর কমান্ডার ছিলেন।
এটাও মিথ্যা নয় যে, ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল রংপুরের ঝাড়–য়ার বিলের হিন্দু অধ্যুষিত গ্রামগুলোতে আলবদর বাহিনী পরিকল্পিত হামলা চালায়। এতে প্রায় ১ হাজার ২০০ জন নিহত এবং আরও ২০০ জনেরও বেশি মানুষকে অপহরণ ও হত্যা করা হয়। এটাও তো মিথ্যা নয় যে, আলবদর বাহিনী ১৯৭১ সালের ৩০ এপ্রিল রংপুর কারমাইকেল কলেজ থেকে চারজন হিন্দু অধ্যাপক ও একজন অধ্যাপকের স্ত্রীকে অপহরণ করেন। পরে তাদের হত্যা করা হয়। এটাও তো মিথ্যা নয় যে, রংপুর টাউন হলে আলবদর বাহিনী ক্যাম্প করে ও অপহৃতদের সেখানে আটক করে রাখা হতো। এমনকি ওই সময়ে ধর্ষণ ক্যাম্প হিসেবে তা ব্যবহৃত হতো।
জামায়াতের দাবি অনুযায়ী সত্য বিজয়ী হয়ে থাকলে রংপুরের আলবদর বাহিনী কর্তৃক উপরে উল্লেখিত অপরাধসমূহ করা ন্যায়সঙ্গত ছিলো! বিচার প্রক্রিয়ায় ত্রুটি থাকতে পারে, কিন্তু এ অপরাধগুলো তো সংঘটিত হয়েছিলো। সে বিষয়ে উচ্চ আদালতের কোন পর্যবেক্ষণ বা তার প্রতিকার বিষয়ে কোনো নির্দেশনা আছে কিনা পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ হলে হয়তো বা জানা যাবে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে যে হারে মামলার সকল আসামিই খালাসের রায় পাচ্ছেন তাতে করে মনে প্রশ্ন জাগছে ২০০৮-এর পূর্বে এ দেশে কি কোন অপরাধ সংঘটিত হয়নি? বিশেষত জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন অবৈধ ঘোষণা করে হাইকোর্টের দেওয়া রায় আপিল বিভাগ বাতিল ঘোষণা করার পর মনে এ প্রশ্ন জাগা কি অস্বাভাবিক
যে, ১৯৭১-এ জামায়াতই তাহলে ন্যায়ের পথে ছিলো। অপরাধী ছিলো মুক্তিযোদ্ধারা, অপরাধী ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকরা। তাদেরই বরং পাকিস্তান ভাঙার অপরাধে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো উচিত। যারা ১৯৭১-এর অপরাধের জন্য পাকিস্তানকে ক্ষমা চাইতে বলে, জামায়াতকে অনুশোচনা করতে বলে তাদেরই বরং পাকিস্তান ভাঙার অপরাধে ক্ষমা চাওয়া উচিত! এদেশে মুক্তিযুদ্ধের সময় কেউ পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সহযোগী ছিলো না, কেউই রাজাকার, আলবদর, আল শামস বাহিনীতে থেকে কোন অপরাধমূলক কাজ করেনি। এ দেশে ১৯৭১ সালে কেউ মুনীর চৌধুরী, আনোয়ার পাশা, গোবিন্দ চন্দ্র দেব, মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতাকে হত্যাকা-ে সহযোগিতা করেনি। এ দেশে কেউ শহীদুল্লাহ কায়সার, জহির রায়হানকে হত্যা করেনি। ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’-র সুরকার আলতাফ মাহমুদকে এ দেশে কেউ হত্যা করেনি।
[লেখক : সাবেক ছাত্র নেতা]