মাহরুফ চৌধুরী
পরিবার মানুষের ব্যক্তিত্ব গঠনের প্রাথমিক প্রতিষ্ঠান। মানবজীবনের মৌলিক বিষয়গুলোর হাতেখড়ি হয় এখানেই। একটি শিশু শুধু ভাষা নয়, শেখে কীভাবে মানুষ হয়ে উঠতে হয়। এটি শুধু একটি সামাজিক সংগঠনের একক নয়, বরং নৈতিকতা, মূল্যবোধ, দায়িত্ববোধ ও শৃঙ্খলার প্রাথমিক পাঠশালা। প্রাচীন গ্রিক দার্শনিক অ্যারিস্টটলের মতে, রাষ্ট্র পরিবারের সম্প্রসারিত রূপ। কাজেই একটি ন্যায়ভিত্তিক রাষ্ট্র গড়তে চাইলে আমাদের অগ্রাধিকার দিতে হবে দেশের প্রতিটি পরিবারকে এক একটি আদর্শ পরিবার হিসেবে গড়ে তোলার জন্য যাতে করে সুনাগরিক ও সুশাসক তৈরির প্রাথমিক প্রক্রিয়াটি যেন পরিবারেই শুরু হয়।
আমাদের মনে রাখতে হবে যে, পারিবারিক পরিবেশে যদি মানবিকতা, ন্যায়বোধ ও শৃঙ্খলা চর্চা করা হয়, তবে তা ব্যক্তি-মানসে গভীরভাবে প্রোথিত হয়ে বৃহত্তর সমাজ ও রাষ্ট্রে ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, যে সমাজে পরিবারভিত্তিক নৈতিক শিক্ষার ভিত্তি দৃঢ়, সেখানে সুসংগঠিত, দায়িত্বশীল এবং সুশাসনমুখী রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে উঠেছে। তাই পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে জন-আকাক্সক্ষা পূরণেও, রাজনৈতিক বা প্রশাসনিক সংস্কারের পূর্বশর্ত হিসেবে পারিবারিক শিক্ষার উন্নয়নকে একটি জরুরি ও প্রাথমিক অগ্রাধিকার হিসেবে গ্রহণ করতে হবে। বর্তমান রাজনৈতিক ও সামাজিক বাস্তবতায় পরিবারকে রাষ্ট্রের ক্ষুদ্রতম ইউনিট হিসেবে পুনর্বিবেচনার প্রয়োজনীয়তা আরও সুস্পষ্ট হয়ে উঠছে। ফরাসি সমাজতাত্ত্বিক এমিল দুর্খেইম (১৮৫৮-১৯১৭) যেমন-পরিবারকে রাষ্ট্রীয় মূল্যবোধের ভিত্তি হিসেবে দেখেছেন, ইংরেজ রাষ্ট্রবিজ্ঞানী হ্যারল্ড লাস্কিও (১৮৯৩-১৯৫০) রাষ্ট্রকে পরিবারের সংগঠিত রূপ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। বস্তুত, রাষ্ট্রীয় অব্যবস্থা, নৈতিক অধপতন বা ক্ষমতার অপব্যবহার এসব শুধু প্রশাসনিক ব্যর্থতা নয়; বরং পারিবারিক স্তরে ব্যক্তিমানুষের দ্বারা চর্চিত অন্যায়, পক্ষপাত, শৃঙ্খলাহীনতা ও অবিচারের সম্প্রসারিত রূপ।
যদি পরিবারে শিশু দায়িত্ববোধ, পরমতসহিষ্ণুতা ও ন্যায়বিচারের শিক্ষা না পায়, তবে সে নাগরিক, শাসক ও রাষ্ট্রকর্মী হিসেবেও সেই নীতিহীনতার পুনরাবৃত্ত করবে। ফলে টেকসই রাষ্ট্রসংস্কার প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে আমাদের প্রথম কাজ হওয়া উচিত পরিবারগুলোকে সংস্কার করার ব্যবস্থা করা। পরিবারে নৈতিকতা ও মানবিক মূল্যবোধের চর্চা ছাড়া রাষ্ট্রীয় কাঠামোয় কোনো দীর্ঘস্থায়ী ইতিবাচক পরিবর্তন সম্ভব নয়। রাষ্ট্র সংস্কার তাই একক কোনো প্রশাসনিক, রাজনৈতিক কিংবা আইনী কর্মসূচি নয়; এটি একটি সমাজগঠনমূলক আন্দোলন, যার সূচনা হওয়া দরকার প্রতিটি পরিবারে, দেশের প্রতিটি ঘরে।
প্রকৃতপক্ষে পরিবারই হলো সকল সামষ্টিক সংকট ও সম্ভাবনার উৎস। রাষ্ট্রের বহুমাত্রিক মানবিক সংকটের অন্তরালে যে অভ্যন্তরীণ কাঠামো সক্রিয় থাকে, তার কেন্দ্রে রয়েছে পরিবার। দেশের প্রতিটি নাগরিকের ব্যক্তিত্ব বিকাশের এই প্রাথমিক প্রতিষ্ঠানেই একজন মানুষ প্রথম শিখে অন্যের প্রতি সহানুভূতি, সম্মান ও দায়িত্বশীলতা প্রদর্শন এবং ন্যায়-অন্যায়ের পার্থক্য নির্ধারণ। রাশিয়ান সাহিত্যিক লিও টলস্টয়ের (১৮২৮-১৯১০) ভাষায়, ‘সুখী পরিবারই সমাজ-রাষ্ট্রকে সুখ দেয়, আর প্রতিটি অসুখী পরিবার বহন করে সমাজিক অসুখের একেকটি বীজ’। তাই মানবিক আদর্শে ভালোবাসা, আন্তরিকতা ও পারস্পরিক দায়িত্ববোধের ভিত্তিতেই আদর্শ পরিবার গড়ে ওঠে। কিন্তু আমাদের বর্তমান আর্থ-সামাজিক বাস্তবতায় যেখানে বৈষম্য, বেকারত্ব, নৈতিক অবক্ষয় এবং রাজনৈতিক দুঃশাসন বিদ্যমান, সেখানে পরিবারেও নানা প্রতিকূলতা ও প্রতিবন্ধকতা অনুপ্রবেশ করে পরিবারগুলোকে উদ্দেশ্য সাধনে করে তুলেছে ব্যর্থ। আমাদের পরিবারগুলোর বিশাল অংশ মূলত অকার্যকর (ডিসফাংশনাল)। এর ফলে পারিবারিক বন্ধন শিথিল হয়ে পড়েছে, মানবিকতার চর্চা দুর্বল হয়ে উঠেছে এবং শিশুর বেড়ে ওঠা হচ্ছে উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা ও নিরাপত্তাহীন পরিবেশে। তখনই জন্ম নেয় দায়িত্বহীন নাগরিক ও শাসক, দুর্নীতিগ্রস্ত আমলা ও নিষ্ঠুর নীতিনির্ধারক। অতএব পরিবারের সুস্থতা কেবল ব্যক্তিগত নয় বা পারিবারিক বিষয় নয়, এটি একটি রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক জরুরি বিষয়, যা উপেক্ষা করলে রাষ্ট্রযন্ত্রের কোনো সংস্কারই টেকসই হবে না। পারিবারিক পক্ষপাত থেকে শুরু হয় রাষ্ট্রীয় দমননীতি ও ক্ষমতার প্রাতিষ্ঠানিক বিকৃতি। যখন পরিবারে ন্যায়পরায়ণতার বদলে পক্ষপাত, বৈষম্য ও সহিংসতা চর্চা হয়, তখন তার প্রত্যক্ষ প্রভাব ব্যক্তি-মানসে নানা বিকৃতি ঘটায় এবং সমাজ ও রাষ্ট্রের কল্যাণমুখী চরিত্রকেও কলুষিত করে। পরিবারের অভ্যন্তরে যদি কোনো সন্তানকে অন্ধভাবে বিশেষ সুবিধা দেয়া হয় এবং অন্যদের প্রতি নিপীড়ন করা হয়, তবে সেই শিশু বড় হয়ে রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পেলেও ন্যায়বোধ বা সাম্যচেতনা ধারণ করতে পারে না। ফলে রাষ্ট্রযন্ত্রে জন্ম নেয় পরিবারতন্ত্র, স্বার্থান্বেষী মহলের আঁতাত, ক্ষমতার অপব্যবহার এবং দমনমূলক শাসনব্যবস্থা। ইতিহাসে দেখা গেছে, মধ্যপ্রাচ্য, দক্ষিণ এশিয়া ও ল্যাটিন আমেরিকায় রাজনৈতিক পরিবারতন্ত্র প্রশাসনকে ব্যক্তিগত আনুগত্যের ভিত্তিতে গড়ে তোলে, ফলে প্রতিষ্ঠানগুলো দুর্বল হয়ে পড়ে, আর জনগণ বঞ্চিত হয় ন্যায়বিচার থেকে। গণতান্ত্রিক কাঠামো থাকা সত্ত্বেও, রাষ্ট্রে গড়ে ওঠে একটি ব্যক্তিকেন্দ্রিক স্বৈরতান্ত্রিক রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক সংস্কৃতি। রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা থেকে এই অপসংস্কৃতির চক্র ভাঙতে হলে পরিবার থেকেই শুরু করতে হবে গণতান্ত্রিক চর্চা, মতামতের স্বাধীনতা, দায়িত্ব ভাগাভাগি এবং নৈতিক শিক্ষার ভিত্তি নির্মাণ। পরিবারকে হতে হবে ন্যায়, সহমর্মিতা ও সমতার প্রথম পাঠশালা, যেখানে শিশুরা শিখবে ন্যায়-অন্যায়ের ধারণা, ভিন্নমতের প্রতি শ্রদ্ধা এবং অংশগ্রহণমূলক সিদ্ধান্ত গ্রহণের মূল্য। কেবল তখনই একটি ন্যায়ভিত্তিক, গণতান্ত্রিক ও কল্যাণমুখী রাষ্ট্রের ভিত্তি রচনা সম্ভব। আর পিতামাতাই হলেন নৈতিক রাষ্ট্রের প্রথম স্বপ্নদ্রষ্টা ও নির্মাতা। শিশুর চোখে তারাই জীবনের প্রথম শিক্ষক, যাদের আচার-আচরণ, ভাষা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়াই হবে শেখার প্রধান মাধ্যম। কিন্তু যদি তারাই মানবিকতা, যুক্তিবোধ, শৃঙ্খলা ও নৈতিকতার অনুশীলনে গাফিলতি করেন, তবে সন্তানের মধ্যেও সেই অনাচারই বিকশিত হবে। তাই ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে রাষ্ট্রীয় প্রয়োজনেই ছেলেমেয়েদের যথাযথভাবে লালন-পালন এবং মূল্যবোধ ও নীতিনৈতিকতা শিক্ষা প্রদানে পিতামাতাদের সুশিক্ষিত, সচেতন ও প্রশিক্ষিত করা অপরিহার্য।
রাশিয়ান বংশোদ্ভূত আমেরিকান মনোবিজ্ঞানী ও সমাজতাত্ত্বিক ইউরি ব্রনফেনব্রেনারের (১৯১৭-২০০৫) ‘পরিবেশগত সিস্টেম তত্ত্ব’ (ইকোলজিক্যাল সিস্টেম থিওরি) অনুযায়ী, শিশুর বিকাশে পরিবারের প্রভাব সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ, ব্যাপক ও গভীর। এই তত্ত্বে পরিবার হলো সেই ‘ছোট সিস্টেম’ (মাইক্রোসিস্টেম), যা শিশুর মানসিক, সামাজিক ও নৈতিক বিকাশের প্রধান পরিবেশ। এই পরিবেশ বিকৃত হলে ‘বড় সিস্টেম’ (ম্যাক্রোসিস্টেম) হিসেবে রাষ্ট্র ব্যবস্থার ওপরও তার প্রভাব পড়ে। একই ভাবে বিপরীত দিক থেকেও সেটা হতে পারে। অর্থাৎ রাষ্ট্রের প্রভাবও পরিবার তথা ব্যক্তির ওপর পড়তে পারে। তাই নৈতিক রাষ্ট্র গঠনের জন্য পিতামাতাদের প্রশিক্ষণ কেবল পারিবারিক দায় নয়, এটি একটি রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব। পরিবারের বড়দের, বিশেষ করে পিতামাতাদের শেখাতে হবে কীভাবে সন্তানের মধ্যে সহানুভূতি, সহাবস্থান, সমতা ও ন্যায়বোধের বীজ বপন করা যায়; কীভাবে হীনমন্যতা বা রাগ নয়, যুক্তিবাদ ও মানবিক আচরণের চর্চা গড়ে তোলা যায়। এই উদ্দেশ্যে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে ‘পারিবারিক মূল্যবোধ ও অভিভাবকত্ব’ বিষয়ক কর্মশালা, সচেতনতা কার্যক্রম এবং প্রশিক্ষণ প্রবর্তন করা যেতে পারে। দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান ও ফিনল্যান্ডের মতো দেশগুলোতে ‘বাচ্চা লালন পালনের কার্যক্রম’ চালু রয়েছে, যা পরিবারকে একটি জ্ঞানভিত্তিক ও মানবিক কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলতে সহায়তা করছে। বাংলাদেশেও একই ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করা জরুরি। রাষ্ট্রকে বুঝতে হবে, পিতামাতার দক্ষতা বৃদ্ধি কেবল পারিবারিক শান্তি নয়, এটি রাষ্ট্রীয় স্থিতিশীলতা ও উন্নয়নের জন্যও অপরিহার্য। রাষ্ট্র কোনো যান্ত্রিক কাঠামো নয়; এটি জীবন্ত মানুষদের যৌথচেতনা, নৈতিকতা ও সম্পর্কের এক সজীব সমাহার যেখানে রাষ্ট্রকে নিজ প্রয়োজনে সুনাগরিক ও সুশাসক তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে হয়। আর সুপরিকল্পিত শিক্ষার মাধ্যমেই রাষ্ট্রকে মূলত সে কাজটা করতে হয়। আর দেশের নাগরিকদের এই নৈতিক ভিত্তি, আচরণ ও চেতনার প্রাথমিক পাঠ হয় পরিবারে। তাই রাষ্ট্র সংস্কারের জন্য পরিবার সংস্কার কোনো হাস্যকর বিষয় বা বিলাসিতা নয়, এটি এক অনিবার্য বাস্তবভিত্তিক কার্যকর প্রক্রিয়া প্রতিষ্ঠার প্রায়োগিক দাবি। যে রাষ্ট্র তার পরিবারগুলোকে অবহেলা করে, সে নিজেই তার ভিত্তিকে দুর্বল করে। আর যে সমাজ পরিবারে ন্যায়, মানবিকতা ও গণতন্ত্রের বীজ বপন করে, সে একটি ন্যায়ভিত্তিক, কল্যাণমুখী ও মানবিক রাষ্ট্র গঠনের পথকে প্রশস্ত করে। সন্তানের ভেতরে মূল্যবোধ, সহনশীলতা ও যুক্তিবোধ গড়ে তুলতে না পারলে ভবিষ্যতের রাষ্ট্রনেতা, আমলা কিংবা নাগরিক হবে নীতিহীন, স্বার্থপর, কর্তৃত্বপরায়ণ ও আত্মকেন্দ্রিক। এই আত্মঘাতী প্রবণতা রোধ করতে চাই পরিকল্পিত, বিজ্ঞানসম্মত ও মানবিক পারিবারিক শিক্ষা এবং রাষ্ট্রীয় নীতিমালায় তার যথাযথ স্থান নির্ধারণ। কারণ একটি শিশুর চোখে যেমন পরিবারই প্রথম বিশ্ব, তেমনি রাষ্ট্রের চোখেও পরিবারই হওয়া উচিত নাগরিকদের ন্যায়-অন্যায়ের ধারণার হাতেখড়ির প্রথম পাঠশালা। এজন্য প্রয়োজন রাষ্ট্র ও সমাজের যৌথ উদ্যোগে এক নতুন মানবিক চুক্তি যেখানে পরিবার হবে ন্যায়পরায়ণ রাষ্ট্রের বীজতলা, আর রাষ্ট্র হবে পরিবারের মর্যাদা ও নিরাপত্তার নিশ্চয়তা প্রদানকারী। বাংলাদেশে এমন একটি মানবিক, ন্যায়কেন্দ্রিক কল্যাণমুখী রাষ্ট্র গড়ার স্বপ্ন দেখতে হলে আমাদের শুরু করতে হবে নিজের ঘর থেকে, নিজের পরিবারের ভিতর থেকে। রাষ্ট্রব্যবস্থা পরিবর্তনের জন্য আসুন আমরা নিজেরাই আগে পরিবর্তিত হই এবং আপনজনদের পরিবর্তিত হতে সহায়তা করি। তবেই সম্ভব হবে মানবিক ও কল্যাণমুখী রাষ্ট্র বির্নিমাণের এক নতুন ইতিহাস রচনা করা যেখানে পরিবার নামক প্রতিষ্ঠানটিই হবে রাষ্ট্রসংস্কারের অনন্য চালিকাশক্তি, আর পারিবারিক মূল্যবোধ ও শিক্ষাই হবে আমাদের আগামী রাষ্ট্রচিন্তার দিকনির্দেশনা।
[লেখক : ভিজিটিং ফ্যাকাল্টি, ইউনিভার্সিটি অব রোহ্যাম্পটন, যুক্তরাজ্য]
মাহরুফ চৌধুরী
সোমবার, ০২ জুন ২০২৫
পরিবার মানুষের ব্যক্তিত্ব গঠনের প্রাথমিক প্রতিষ্ঠান। মানবজীবনের মৌলিক বিষয়গুলোর হাতেখড়ি হয় এখানেই। একটি শিশু শুধু ভাষা নয়, শেখে কীভাবে মানুষ হয়ে উঠতে হয়। এটি শুধু একটি সামাজিক সংগঠনের একক নয়, বরং নৈতিকতা, মূল্যবোধ, দায়িত্ববোধ ও শৃঙ্খলার প্রাথমিক পাঠশালা। প্রাচীন গ্রিক দার্শনিক অ্যারিস্টটলের মতে, রাষ্ট্র পরিবারের সম্প্রসারিত রূপ। কাজেই একটি ন্যায়ভিত্তিক রাষ্ট্র গড়তে চাইলে আমাদের অগ্রাধিকার দিতে হবে দেশের প্রতিটি পরিবারকে এক একটি আদর্শ পরিবার হিসেবে গড়ে তোলার জন্য যাতে করে সুনাগরিক ও সুশাসক তৈরির প্রাথমিক প্রক্রিয়াটি যেন পরিবারেই শুরু হয়।
আমাদের মনে রাখতে হবে যে, পারিবারিক পরিবেশে যদি মানবিকতা, ন্যায়বোধ ও শৃঙ্খলা চর্চা করা হয়, তবে তা ব্যক্তি-মানসে গভীরভাবে প্রোথিত হয়ে বৃহত্তর সমাজ ও রাষ্ট্রে ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, যে সমাজে পরিবারভিত্তিক নৈতিক শিক্ষার ভিত্তি দৃঢ়, সেখানে সুসংগঠিত, দায়িত্বশীল এবং সুশাসনমুখী রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে উঠেছে। তাই পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে জন-আকাক্সক্ষা পূরণেও, রাজনৈতিক বা প্রশাসনিক সংস্কারের পূর্বশর্ত হিসেবে পারিবারিক শিক্ষার উন্নয়নকে একটি জরুরি ও প্রাথমিক অগ্রাধিকার হিসেবে গ্রহণ করতে হবে। বর্তমান রাজনৈতিক ও সামাজিক বাস্তবতায় পরিবারকে রাষ্ট্রের ক্ষুদ্রতম ইউনিট হিসেবে পুনর্বিবেচনার প্রয়োজনীয়তা আরও সুস্পষ্ট হয়ে উঠছে। ফরাসি সমাজতাত্ত্বিক এমিল দুর্খেইম (১৮৫৮-১৯১৭) যেমন-পরিবারকে রাষ্ট্রীয় মূল্যবোধের ভিত্তি হিসেবে দেখেছেন, ইংরেজ রাষ্ট্রবিজ্ঞানী হ্যারল্ড লাস্কিও (১৮৯৩-১৯৫০) রাষ্ট্রকে পরিবারের সংগঠিত রূপ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। বস্তুত, রাষ্ট্রীয় অব্যবস্থা, নৈতিক অধপতন বা ক্ষমতার অপব্যবহার এসব শুধু প্রশাসনিক ব্যর্থতা নয়; বরং পারিবারিক স্তরে ব্যক্তিমানুষের দ্বারা চর্চিত অন্যায়, পক্ষপাত, শৃঙ্খলাহীনতা ও অবিচারের সম্প্রসারিত রূপ।
যদি পরিবারে শিশু দায়িত্ববোধ, পরমতসহিষ্ণুতা ও ন্যায়বিচারের শিক্ষা না পায়, তবে সে নাগরিক, শাসক ও রাষ্ট্রকর্মী হিসেবেও সেই নীতিহীনতার পুনরাবৃত্ত করবে। ফলে টেকসই রাষ্ট্রসংস্কার প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে আমাদের প্রথম কাজ হওয়া উচিত পরিবারগুলোকে সংস্কার করার ব্যবস্থা করা। পরিবারে নৈতিকতা ও মানবিক মূল্যবোধের চর্চা ছাড়া রাষ্ট্রীয় কাঠামোয় কোনো দীর্ঘস্থায়ী ইতিবাচক পরিবর্তন সম্ভব নয়। রাষ্ট্র সংস্কার তাই একক কোনো প্রশাসনিক, রাজনৈতিক কিংবা আইনী কর্মসূচি নয়; এটি একটি সমাজগঠনমূলক আন্দোলন, যার সূচনা হওয়া দরকার প্রতিটি পরিবারে, দেশের প্রতিটি ঘরে।
প্রকৃতপক্ষে পরিবারই হলো সকল সামষ্টিক সংকট ও সম্ভাবনার উৎস। রাষ্ট্রের বহুমাত্রিক মানবিক সংকটের অন্তরালে যে অভ্যন্তরীণ কাঠামো সক্রিয় থাকে, তার কেন্দ্রে রয়েছে পরিবার। দেশের প্রতিটি নাগরিকের ব্যক্তিত্ব বিকাশের এই প্রাথমিক প্রতিষ্ঠানেই একজন মানুষ প্রথম শিখে অন্যের প্রতি সহানুভূতি, সম্মান ও দায়িত্বশীলতা প্রদর্শন এবং ন্যায়-অন্যায়ের পার্থক্য নির্ধারণ। রাশিয়ান সাহিত্যিক লিও টলস্টয়ের (১৮২৮-১৯১০) ভাষায়, ‘সুখী পরিবারই সমাজ-রাষ্ট্রকে সুখ দেয়, আর প্রতিটি অসুখী পরিবার বহন করে সমাজিক অসুখের একেকটি বীজ’। তাই মানবিক আদর্শে ভালোবাসা, আন্তরিকতা ও পারস্পরিক দায়িত্ববোধের ভিত্তিতেই আদর্শ পরিবার গড়ে ওঠে। কিন্তু আমাদের বর্তমান আর্থ-সামাজিক বাস্তবতায় যেখানে বৈষম্য, বেকারত্ব, নৈতিক অবক্ষয় এবং রাজনৈতিক দুঃশাসন বিদ্যমান, সেখানে পরিবারেও নানা প্রতিকূলতা ও প্রতিবন্ধকতা অনুপ্রবেশ করে পরিবারগুলোকে উদ্দেশ্য সাধনে করে তুলেছে ব্যর্থ। আমাদের পরিবারগুলোর বিশাল অংশ মূলত অকার্যকর (ডিসফাংশনাল)। এর ফলে পারিবারিক বন্ধন শিথিল হয়ে পড়েছে, মানবিকতার চর্চা দুর্বল হয়ে উঠেছে এবং শিশুর বেড়ে ওঠা হচ্ছে উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা ও নিরাপত্তাহীন পরিবেশে। তখনই জন্ম নেয় দায়িত্বহীন নাগরিক ও শাসক, দুর্নীতিগ্রস্ত আমলা ও নিষ্ঠুর নীতিনির্ধারক। অতএব পরিবারের সুস্থতা কেবল ব্যক্তিগত নয় বা পারিবারিক বিষয় নয়, এটি একটি রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক জরুরি বিষয়, যা উপেক্ষা করলে রাষ্ট্রযন্ত্রের কোনো সংস্কারই টেকসই হবে না। পারিবারিক পক্ষপাত থেকে শুরু হয় রাষ্ট্রীয় দমননীতি ও ক্ষমতার প্রাতিষ্ঠানিক বিকৃতি। যখন পরিবারে ন্যায়পরায়ণতার বদলে পক্ষপাত, বৈষম্য ও সহিংসতা চর্চা হয়, তখন তার প্রত্যক্ষ প্রভাব ব্যক্তি-মানসে নানা বিকৃতি ঘটায় এবং সমাজ ও রাষ্ট্রের কল্যাণমুখী চরিত্রকেও কলুষিত করে। পরিবারের অভ্যন্তরে যদি কোনো সন্তানকে অন্ধভাবে বিশেষ সুবিধা দেয়া হয় এবং অন্যদের প্রতি নিপীড়ন করা হয়, তবে সেই শিশু বড় হয়ে রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পেলেও ন্যায়বোধ বা সাম্যচেতনা ধারণ করতে পারে না। ফলে রাষ্ট্রযন্ত্রে জন্ম নেয় পরিবারতন্ত্র, স্বার্থান্বেষী মহলের আঁতাত, ক্ষমতার অপব্যবহার এবং দমনমূলক শাসনব্যবস্থা। ইতিহাসে দেখা গেছে, মধ্যপ্রাচ্য, দক্ষিণ এশিয়া ও ল্যাটিন আমেরিকায় রাজনৈতিক পরিবারতন্ত্র প্রশাসনকে ব্যক্তিগত আনুগত্যের ভিত্তিতে গড়ে তোলে, ফলে প্রতিষ্ঠানগুলো দুর্বল হয়ে পড়ে, আর জনগণ বঞ্চিত হয় ন্যায়বিচার থেকে। গণতান্ত্রিক কাঠামো থাকা সত্ত্বেও, রাষ্ট্রে গড়ে ওঠে একটি ব্যক্তিকেন্দ্রিক স্বৈরতান্ত্রিক রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক সংস্কৃতি। রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা থেকে এই অপসংস্কৃতির চক্র ভাঙতে হলে পরিবার থেকেই শুরু করতে হবে গণতান্ত্রিক চর্চা, মতামতের স্বাধীনতা, দায়িত্ব ভাগাভাগি এবং নৈতিক শিক্ষার ভিত্তি নির্মাণ। পরিবারকে হতে হবে ন্যায়, সহমর্মিতা ও সমতার প্রথম পাঠশালা, যেখানে শিশুরা শিখবে ন্যায়-অন্যায়ের ধারণা, ভিন্নমতের প্রতি শ্রদ্ধা এবং অংশগ্রহণমূলক সিদ্ধান্ত গ্রহণের মূল্য। কেবল তখনই একটি ন্যায়ভিত্তিক, গণতান্ত্রিক ও কল্যাণমুখী রাষ্ট্রের ভিত্তি রচনা সম্ভব। আর পিতামাতাই হলেন নৈতিক রাষ্ট্রের প্রথম স্বপ্নদ্রষ্টা ও নির্মাতা। শিশুর চোখে তারাই জীবনের প্রথম শিক্ষক, যাদের আচার-আচরণ, ভাষা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়াই হবে শেখার প্রধান মাধ্যম। কিন্তু যদি তারাই মানবিকতা, যুক্তিবোধ, শৃঙ্খলা ও নৈতিকতার অনুশীলনে গাফিলতি করেন, তবে সন্তানের মধ্যেও সেই অনাচারই বিকশিত হবে। তাই ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে রাষ্ট্রীয় প্রয়োজনেই ছেলেমেয়েদের যথাযথভাবে লালন-পালন এবং মূল্যবোধ ও নীতিনৈতিকতা শিক্ষা প্রদানে পিতামাতাদের সুশিক্ষিত, সচেতন ও প্রশিক্ষিত করা অপরিহার্য।
রাশিয়ান বংশোদ্ভূত আমেরিকান মনোবিজ্ঞানী ও সমাজতাত্ত্বিক ইউরি ব্রনফেনব্রেনারের (১৯১৭-২০০৫) ‘পরিবেশগত সিস্টেম তত্ত্ব’ (ইকোলজিক্যাল সিস্টেম থিওরি) অনুযায়ী, শিশুর বিকাশে পরিবারের প্রভাব সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ, ব্যাপক ও গভীর। এই তত্ত্বে পরিবার হলো সেই ‘ছোট সিস্টেম’ (মাইক্রোসিস্টেম), যা শিশুর মানসিক, সামাজিক ও নৈতিক বিকাশের প্রধান পরিবেশ। এই পরিবেশ বিকৃত হলে ‘বড় সিস্টেম’ (ম্যাক্রোসিস্টেম) হিসেবে রাষ্ট্র ব্যবস্থার ওপরও তার প্রভাব পড়ে। একই ভাবে বিপরীত দিক থেকেও সেটা হতে পারে। অর্থাৎ রাষ্ট্রের প্রভাবও পরিবার তথা ব্যক্তির ওপর পড়তে পারে। তাই নৈতিক রাষ্ট্র গঠনের জন্য পিতামাতাদের প্রশিক্ষণ কেবল পারিবারিক দায় নয়, এটি একটি রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব। পরিবারের বড়দের, বিশেষ করে পিতামাতাদের শেখাতে হবে কীভাবে সন্তানের মধ্যে সহানুভূতি, সহাবস্থান, সমতা ও ন্যায়বোধের বীজ বপন করা যায়; কীভাবে হীনমন্যতা বা রাগ নয়, যুক্তিবাদ ও মানবিক আচরণের চর্চা গড়ে তোলা যায়। এই উদ্দেশ্যে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে ‘পারিবারিক মূল্যবোধ ও অভিভাবকত্ব’ বিষয়ক কর্মশালা, সচেতনতা কার্যক্রম এবং প্রশিক্ষণ প্রবর্তন করা যেতে পারে। দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান ও ফিনল্যান্ডের মতো দেশগুলোতে ‘বাচ্চা লালন পালনের কার্যক্রম’ চালু রয়েছে, যা পরিবারকে একটি জ্ঞানভিত্তিক ও মানবিক কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলতে সহায়তা করছে। বাংলাদেশেও একই ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করা জরুরি। রাষ্ট্রকে বুঝতে হবে, পিতামাতার দক্ষতা বৃদ্ধি কেবল পারিবারিক শান্তি নয়, এটি রাষ্ট্রীয় স্থিতিশীলতা ও উন্নয়নের জন্যও অপরিহার্য। রাষ্ট্র কোনো যান্ত্রিক কাঠামো নয়; এটি জীবন্ত মানুষদের যৌথচেতনা, নৈতিকতা ও সম্পর্কের এক সজীব সমাহার যেখানে রাষ্ট্রকে নিজ প্রয়োজনে সুনাগরিক ও সুশাসক তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে হয়। আর সুপরিকল্পিত শিক্ষার মাধ্যমেই রাষ্ট্রকে মূলত সে কাজটা করতে হয়। আর দেশের নাগরিকদের এই নৈতিক ভিত্তি, আচরণ ও চেতনার প্রাথমিক পাঠ হয় পরিবারে। তাই রাষ্ট্র সংস্কারের জন্য পরিবার সংস্কার কোনো হাস্যকর বিষয় বা বিলাসিতা নয়, এটি এক অনিবার্য বাস্তবভিত্তিক কার্যকর প্রক্রিয়া প্রতিষ্ঠার প্রায়োগিক দাবি। যে রাষ্ট্র তার পরিবারগুলোকে অবহেলা করে, সে নিজেই তার ভিত্তিকে দুর্বল করে। আর যে সমাজ পরিবারে ন্যায়, মানবিকতা ও গণতন্ত্রের বীজ বপন করে, সে একটি ন্যায়ভিত্তিক, কল্যাণমুখী ও মানবিক রাষ্ট্র গঠনের পথকে প্রশস্ত করে। সন্তানের ভেতরে মূল্যবোধ, সহনশীলতা ও যুক্তিবোধ গড়ে তুলতে না পারলে ভবিষ্যতের রাষ্ট্রনেতা, আমলা কিংবা নাগরিক হবে নীতিহীন, স্বার্থপর, কর্তৃত্বপরায়ণ ও আত্মকেন্দ্রিক। এই আত্মঘাতী প্রবণতা রোধ করতে চাই পরিকল্পিত, বিজ্ঞানসম্মত ও মানবিক পারিবারিক শিক্ষা এবং রাষ্ট্রীয় নীতিমালায় তার যথাযথ স্থান নির্ধারণ। কারণ একটি শিশুর চোখে যেমন পরিবারই প্রথম বিশ্ব, তেমনি রাষ্ট্রের চোখেও পরিবারই হওয়া উচিত নাগরিকদের ন্যায়-অন্যায়ের ধারণার হাতেখড়ির প্রথম পাঠশালা। এজন্য প্রয়োজন রাষ্ট্র ও সমাজের যৌথ উদ্যোগে এক নতুন মানবিক চুক্তি যেখানে পরিবার হবে ন্যায়পরায়ণ রাষ্ট্রের বীজতলা, আর রাষ্ট্র হবে পরিবারের মর্যাদা ও নিরাপত্তার নিশ্চয়তা প্রদানকারী। বাংলাদেশে এমন একটি মানবিক, ন্যায়কেন্দ্রিক কল্যাণমুখী রাষ্ট্র গড়ার স্বপ্ন দেখতে হলে আমাদের শুরু করতে হবে নিজের ঘর থেকে, নিজের পরিবারের ভিতর থেকে। রাষ্ট্রব্যবস্থা পরিবর্তনের জন্য আসুন আমরা নিজেরাই আগে পরিবর্তিত হই এবং আপনজনদের পরিবর্তিত হতে সহায়তা করি। তবেই সম্ভব হবে মানবিক ও কল্যাণমুখী রাষ্ট্র বির্নিমাণের এক নতুন ইতিহাস রচনা করা যেখানে পরিবার নামক প্রতিষ্ঠানটিই হবে রাষ্ট্রসংস্কারের অনন্য চালিকাশক্তি, আর পারিবারিক মূল্যবোধ ও শিক্ষাই হবে আমাদের আগামী রাষ্ট্রচিন্তার দিকনির্দেশনা।
[লেখক : ভিজিটিং ফ্যাকাল্টি, ইউনিভার্সিটি অব রোহ্যাম্পটন, যুক্তরাজ্য]