alt

উপ-সম্পাদকীয়

ডিজিটাল পুঁজিবাদের যুগে নগর বাংলাদেশের শ্রেণী কাঠামো

মতিউর রহমান

: সোমবার, ০২ জুন ২০২৫

গত কয়েক দশকে বাংলাদেশের নগর জীবনে শ্রেণী কাঠামোতে এক মৌলিক পরিবর্তন পরিলক্ষিত হচ্ছে, যা পূর্বের প্রচলিত ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করছে। এক সময় যেখানে শ্রেণী বিভাজন মূলত ভূমির মালিকানা, সরকারি চাকরি অথবা ঐতিহ্যবাহী ব্যবসার ওপর নির্ভরশীল ছিল, এখন তা দ্রুত পরিবর্তিত হচ্ছে ডিজিটাল প্রযুক্তি, ভাষাগত দক্ষতা এবং বৈশ্বিক বাজারে প্রবেশাধিকারের ওপর ভিত্তি করে। এই রূপান্তর কেবল অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ নয়, এটি নগর বাংলাদেশের সমাজ-সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রেও গভীর প্রভাব ফেলছে, যা সমাজতাত্ত্বিক বিশ্লেষণের জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র তৈরি করেছে।

ডিজিটাল পুঁজিবাদ, যার তাত্ত্বিক ভিত্তি নিক সের্নিচেক ও ক্রিশ্চিয়ান ফুকসের মতো প-িতদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ, সেই ব্যবস্থায় তথ্য, প্ল্যাটফর্ম এবং ডিজিটাল পরিকাঠামোই মূল উৎপাদন উপকরণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশের নগর এলাকায়, বিশেষত ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী এবং সিলেটের মতো শহরে এই পুঁজিবাদের প্রতিচ্ছবি স্পষ্টভাবে দৃশ্যমান।

এখন মধ্যবিত্ত কিংবা উচ্চবিত্ত শ্রেণীতে উত্তরণ হচ্ছে শুধুমাত্র জমি বা ব্যবসার ভিত্তিতে নয়, বরং ডিজিটাল ফ্রিল্যান্সিং, স্টার্টআপ সংস্কৃতি, বিদেশি ক্লায়েন্টদের সঙ্গে কাজ করা এবং ইউটিউব, ফেসবুক বা টিকটকের মতো প্ল্যাটফর্মে সক্রিয় থাকার মাধ্যমে। এই নতুন অর্থনৈতিক মডেল একটি নতুন ধরনের পুঁজিবাদের জন্ম দিচ্ছে, যেখানে ডেটা, অ্যালগরিদম এবং নেটওয়ার্কের নিয়ন্ত্রণ অর্থনৈতিক ক্ষমতা ও সামাজিক মর্যাদার মূল উৎস হয়ে দাঁড়িয়েছে।

পিয়েরে বোর্দিয়ুর তাত্ত্বিক কাঠামো অনুসারে, সামাজিক শ্রেণী গঠনে চার ধরনের পুঁজিÑঅর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, সামাজিক ও প্রতীকীÑগুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। বাংলাদেশের নগর জীবনে এখন যে শ্রেণীভেদ স্পষ্ট হচ্ছে, তা মূলত সাংস্কৃতিক পুঁজি, বিশেষ করে ইংরেজি ভাষা দক্ষতা ও ডিজিটাল সক্ষমতার ভিত্তিতে গঠিত। যারা এই পুঁজি অর্জন করতে পারছে, তারা একটি নতুন ‘ডিজিটাল ক্ষুদ্র-মধ্যবিত্ত শ্রেণী’ গঠন করছে।

তাদের শ্রেণীগত অবস্থান পারিবারিক সম্পদের ওপর নয়, বরং ডিজিটাল দুনিয়ায় দক্ষতা ও বিশ্ববাজারে প্রবেশ করতে পারার সক্ষমতার ওপর নির্ভর করছে। এই শ্রেণীর সদস্যরা প্রায়শই শিক্ষাগত যোগ্যতা, প্রযুক্তিগত জ্ঞান এবং বৈশ্বিক সংস্কৃতির সঙ্গে নিজেদের খাপ খাইয়ে নেওয়ার ক্ষমতার দ্বারা নিজেদের পরিচিত করে। এটি ঐতিহ্যবাহী শ্রেণী কাঠামোর বাইরে গিয়ে নতুন সামাজিক গতিশীলতা তৈরি করছে, যেখানে ব্যক্তিগত দক্ষতা ও প্রযুক্তির ব্যবহার অর্থনৈতিক সাফল্যের চাবিকাঠি।

এ পরিস্থিতিতে এক নতুন ধরনের ডিজিটাল বিভাজন তৈরি হচ্ছে, যা কেবল প্রযুক্তিগত নয় বরং স্পষ্টভাবে শ্রেণীভিত্তিক। যারা যথাযথ শিক্ষা, উচ্চগুণমানের ইন্টারনেট সংযোগ অথবা ভাষাগত সুবিধা থেকে বঞ্চিত, তারা থেকে যাচ্ছে ডিজিটাল অর্থনীতির বাইরেই। একই শহরে বসবাস করেও একদিকে কেউ ডলার আয় করছে অনলাইনে, অন্যদিকে কেউ এখনো রিকশা চালাচ্ছে বা অস্থায়ী শ্রমজীবী হিসেবে কাজ করছে।

এই বৈপরীত্য ডেভিড হারভের ‘স্পাসিয়াল ফিক্স’ ও ‘অসামঞ্জস্যপূর্ণ ভৌগোলিক উন্নয়ন’ ধারণার সাথে মিল খায়। পুঁজি এখন আর স্থাননির্ভর নয়; এটি তথ্যপ্রবাহের মাধ্যমে এক শহরের মধ্যেও বৈষম্য সৃষ্টি করছে। ম্যানুয়েল কাস্তেলসের ‘নেটওয়ার্ক সমাজ’ তত্ত্বও এখানে প্রাসঙ্গিক। তার মতে, সামাজিক অন্তর্ভুক্তি এখন নির্ভর করে তথ্য ও প্রযুক্তি সংযুক্ততার ওপর।

বাংলাদেশের শহরে এই সংযুক্তি শুধু ইন্টারনেট কানেকশনের বিষয় নয়, এটি ইংরেজি ভাষা জ্ঞান, আন্তর্জাতিক সংস্কৃতিতে দখল ও প্রযুক্তি ব্যবহারের সক্ষমতার বিষয়। ফলে একই নগরবাসী হওয়া সত্ত্বেও কেউ হচ্ছে ডিজিটাল অর্থনীতির সুবিধাভোগী, আর কেউ হচ্ছে প্রযুক্তির বাইরের শ্রেণীর প্রতিনিধি। এই বিভাজন কেবল অর্থনৈতিক নয়, এটি সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রেও স্পষ্ট হয়ে উঠছে, যেখানে ডিজিটাল দক্ষতাসম্পন্নরা এক ধরনের নতুন সামাজিক মর্যাদা ও স্বীকৃতি লাভ করছে।

রাষ্ট্র এবং শিক্ষাব্যবস্থাও এই নতুন শ্রেণী গঠনের প্রক্রিয়ায় ভূমিকা রাখছে। ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ নীতিমালার ফলে ইন্টারনেট ব্যবহারে বিস্তার ঘটলেও, সরকারি স্কুল ও মাদ্রাসাগুলোর অধিকাংশই ডিজিটাল শিক্ষা প্রদানে সক্ষম নয়। ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের শিক্ষার্থীরা ডিজিটাল অর্থনীতিতে ঢোকার জন্য অনেক বেশি প্রস্তুত। এর ফলে শিক্ষাব্যবস্থা একটি শ্রেণীভিত্তিক পুঁজির প্রজননস্থলে পরিণত হয়েছে, যেমনটি বোর্দিয়ু তার শিক্ষাতাত্ত্বিক বিশ্লেষণে ব্যাখ্যা করেছেন। শিক্ষাব্যবস্থা অসম সুযোগ তৈরি করে, যা বিদ্যমান সামাজিক বৈষম্যকে আরও তীব্র করে।

ডিজিটাল উদ্যোক্তা হওয়া অনেকের কাছে মুক্তির পথ বলে মনে হলেও বাস্তবে এটি নতুন ধরনের শ্রেণী প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে। একজন তরুণকে একটি সফল অনলাইন ব্যবসা শুরু করতে হলে তাকে ভালো মোবাইল, বিদ্যুৎ, ইন্টারনেট, প্রাথমিক মূলধন ও সামাজিক যোগাযোগের ক্ষমতা থাকতে হয়; যা নগরের উচ্চ বা মধ্যবিত্তদের কাছেই বেশি প্রবেশযোগ্য। ফলে ডিজিটাল পুঁজিবাদ এমন এক অর্থনৈতিক বাস্তবতা তৈরি করছে, যেখানে শ্রেণীর সীমারেখা প্রযুক্তির ব্যবহারে নির্ধারিত হয়। রাষ্ট্রীয় নীতি যদি অন্তর্ভুক্তিমূলক না হয়, তবে ডিজিটাল বিভাজন আরও প্রকট হবে।

বাংলাদেশে এখন এক ধরনের নতুন ‘টেক এলিট’ শ্রেণী’ গঠিত হচ্ছে; যাদের মধ্যে রয়েছে সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার, ডিজিটাল মার্কেটার, ইউটিউবার ও তথ্যপ্রযুক্তি উদ্যোক্তা। এদের জীবনধারা, ভোগ-প্রবণতা ও সাংস্কৃতিক রুচি অনেকাংশেই পশ্চিমা আদর্শে প্রভাবিত।

তারা সন্তানদের ইংরেজি মাধ্যমে পড়ান, পশ্চিমা ফ্যাশনে অভ্যস্ত হন, ওয়েস্টার্ন মিডিয়া কনটেন্ট উপভোগ করেন এবং বৈশ্বিক সংস্কৃতিতে নিজেদের সংযুক্ত রাখেন। এর মধ্য দিয়ে তারা প্রতীকী পুঁজি অর্জন করছেন, যা তাদের শ্রেণীগত অবস্থান দৃঢ় করছে। এই শ্রেণী নিজেদের জন্য এক ধরনের বিশ্বজনীন পরিচয় তৈরি করছে, যা স্থানীয় প্রেক্ষাপটে তাদের স্বতন্ত্রতা তুলে ধরে।

এই নতুন শ্রেণী কাঠামোর মধ্যে সামাজিক গতিশীলতাও নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত হচ্ছে। আগে যেখানে সামাজিক গতিশীলতা নির্ভর করত বিদেশে কাজ করতে যাওয়া বা সরকারি চাকরির ওপর, এখন তা নির্ভর করছে ভার্চুয়াল গতিশীলতার ওপর। তবে বাস্তবে, এই গতিশীলতার পথ সহজ নয়।

ইংরেজি জানার সুযোগ, প্রযুক্তিগত দক্ষতা ও সাংস্কৃতিক পুঁজি যাদের নেই, তারা এই অর্থনীতির বাইরে থাকেন। ডিজিটাল অর্থনীতির কথিত মেধাতন্ত্র আসলে বিদ্যমান শ্রেণী কাঠামোর প্রতিফলন, যেখানে অধিকাংশ মানুষ বঞ্চিতই থেকে যায়। যারা প্রযুক্তিগত সুবিধা থেকে বঞ্চিত, তাদের জন্য এই নতুন শ্রেণী কাঠামোতে প্রবেশ করা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে, ফলে সামাজিক গতিশীলতা সীমিত হয় এবং বৈষম্য বাড়তে থাকে।

এই ডিজিটাল শ্রেণী বিভাজনের বিরুদ্ধে কিছু সীমিত প্রতিরোধ গড়ে উঠছে। কিছু বেসরকারি সংস্থা ও এনজিও পিছিয়ে পড়া তরুণদের প্রযুক্তিগত প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। তবে শিক্ষা ব্যবস্থার সংস্কার, ডিজিটাল পরিকাঠামোতে সমতা ও ভাষাগত অন্তর্ভুক্তি ছাড়া এই প্রচেষ্টা স্থায়ী প্রভাব ফেলতে পারবে না। ডিজিটাল পুঁজিবাদ যদিও কিছু নাগরিকের জন্য সুযোগ তৈরি করছে, তা অধিকাংশের জন্য বৈষম্য ও বিচ্ছিন্নতা সৃষ্টি করছে।

সার্বিকভাবে বলা যায়, নগর বাংলাদেশের শ্রেণী কাঠামোতে এক মৌলিক রূপান্তর ঘটছে ডিজিটাল পুঁজিবাদের ফলে। বোর্দিয়ু, হারভে ও কাস্তেলসের মতো তাত্ত্বিকদের ধারণা ব্যবহার করে আমরা বুঝতে পারি যে প্রযুক্তি, ভাষা ও বৈশ্বিক বাজারের সংযোগ কিভাবে এক নতুন শ্রেণী ব্যবস্থা গড়ে তুলছেÑযা একদিকে পুরোনো কাঠামোকে টিকিয়ে রাখছে, অন্যদিকে তার ওপর এক নতুন বৈষম্যের স্তর চাপিয়ে দিচ্ছে।

ডিজিটাল অর্থনীতির স্বপ্ন তখনই বাস্তবতা হতে পারে, যখন তা সত্যিকার অর্থে অন্তর্ভুক্তিমূলক হবে, না হলে তা একটি নতুন শ্রেণী দমনমূলক কাঠামোতেই পরিণত হবে। এই পরিবর্তনগুলোকে গভীরভাবে বোঝা এবং সে অনুযায়ী নীতি প্রণয়ন করা জরুরি, যাতে বাংলাদেশের নগরজীবন একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক ও ন্যায়ভিত্তিক সমাজে রূপান্তরিত হয়।

[লেখক : গবেষক ও উন্নয়নকর্মী]

দেশি মাছ রক্ষায় অভয়াশ্রম

আলুর বাজার বিপর্যয় : কৃষকের ভাগ্যে লোকসান

ছবি

নীল নদের পানি নীল নয়

বিশ্ব বাঘ দিবস

ঢাকার কি রিস্ক এনালাইসিস করা আছে?

ছবি

সোনার হরফে লেখা অনন্য শিক্ষকের নাম

পরীক্ষার পর পরীক্ষা, কিন্তু কোথায় মূল্যায়ন ও মূল্যবোধের ভিত্তি?

বৃত্তি পরীক্ষায় কিন্ডারগার্টেন বাদ কেন?

সময়ের স্বৈরতন্ত্র : প্রতীক্ষা, ক্ষমতা ও জীবনের অসমতা

জলবায়ু পরিবর্তন মডেলে গণিতের ব্যবহার

দুর্ঘটনাজনিত দুর্যোগ-পরবর্তী করণীয় কী?

ডেঙ্গু, জিকা আর চিকুনগুনিয়া : একই উৎস, ত্রিমুখী সংকট

কেন থাইল্যান্ড-কম্বোডিয়ার ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি?

দুর্নীতি নির্মূল করা কি সম্ভব?

দরকার মানসম্মত শিক্ষা

ইসরায়েলের যুদ্ধনীতি ও বিশ্ব নিরাপত্তার সংকট

রম্যগদ্য : ‘বেইমান রাইট ব্রাদার্স’

মানসিক স্বাস্থ্যসেবা : আইনি কাঠামো, সংকট ও সম্ভাবনার দিক

ছবি

বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক উজ্জ্বল নক্ষত্র

দুর্যোগে অবিবেচকদেরকে কি দায়িত্বশীল ভাবা যায়?

ওয়াসার পদ্মা ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট : এক জীবন্ত বোটানিক্যাল গার্ডেন

রেলপথের দুর্দশা : সমন্বিত পরিকল্পনা না হলে বিপর্যয় অনিবার্য

বিশ্ববিদ্যালয় জ্ঞানচর্চার কেন্দ্র নাকি ক্ষমতার অভ্যন্তরীণ উপনিবেশ?

পিরোজপুরের স্কুলটির ফলাফল বিপর্যয় এবং আচরণগত অর্থনীতির দৃষ্টিকোণ

কোনো শাসকই অপরাজেয় নয়

পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি : বাঙালিকে রুচির দৈন্যে টেনে নামানো হচ্ছে

জনসংখ্যা ও যুবশক্তির চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা

রাষ্ট্রের কাছে স্বাভাবিক মৃত্যুর নিশ্চয়তা চাই

পার্বত্য চট্টগ্রাম : প্রাকৃতিক সম্পদ ও অর্থনৈতিক সম্ভাবনা

ইউরেশিয়ায় তৃতীয় বিকল্প গালফ কূটনীতি

‘বিপ্লবী সংস্কার’ কি সম্ভব

রম্যগদ্য : ‘ব্যাংক, ব্যাংক নয়’

মবতন্ত্রের জয়

ডিজিটাল ক্লান্তি ও ‘সর্বক্ষণ সক্রিয়’ সংস্কৃতির শ্রেণীগত রাজনীতি

ছবি

বোধের স্ফূরণ, না ‘মেটিকুলাস ডিজাইন’?

এসএসসিতে গণিত বিষয়ে ফল বিপর্যয় : কারণ ও উত্তরণের উপায়

tab

উপ-সম্পাদকীয়

ডিজিটাল পুঁজিবাদের যুগে নগর বাংলাদেশের শ্রেণী কাঠামো

মতিউর রহমান

সোমবার, ০২ জুন ২০২৫

গত কয়েক দশকে বাংলাদেশের নগর জীবনে শ্রেণী কাঠামোতে এক মৌলিক পরিবর্তন পরিলক্ষিত হচ্ছে, যা পূর্বের প্রচলিত ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করছে। এক সময় যেখানে শ্রেণী বিভাজন মূলত ভূমির মালিকানা, সরকারি চাকরি অথবা ঐতিহ্যবাহী ব্যবসার ওপর নির্ভরশীল ছিল, এখন তা দ্রুত পরিবর্তিত হচ্ছে ডিজিটাল প্রযুক্তি, ভাষাগত দক্ষতা এবং বৈশ্বিক বাজারে প্রবেশাধিকারের ওপর ভিত্তি করে। এই রূপান্তর কেবল অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ নয়, এটি নগর বাংলাদেশের সমাজ-সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রেও গভীর প্রভাব ফেলছে, যা সমাজতাত্ত্বিক বিশ্লেষণের জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র তৈরি করেছে।

ডিজিটাল পুঁজিবাদ, যার তাত্ত্বিক ভিত্তি নিক সের্নিচেক ও ক্রিশ্চিয়ান ফুকসের মতো প-িতদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ, সেই ব্যবস্থায় তথ্য, প্ল্যাটফর্ম এবং ডিজিটাল পরিকাঠামোই মূল উৎপাদন উপকরণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশের নগর এলাকায়, বিশেষত ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী এবং সিলেটের মতো শহরে এই পুঁজিবাদের প্রতিচ্ছবি স্পষ্টভাবে দৃশ্যমান।

এখন মধ্যবিত্ত কিংবা উচ্চবিত্ত শ্রেণীতে উত্তরণ হচ্ছে শুধুমাত্র জমি বা ব্যবসার ভিত্তিতে নয়, বরং ডিজিটাল ফ্রিল্যান্সিং, স্টার্টআপ সংস্কৃতি, বিদেশি ক্লায়েন্টদের সঙ্গে কাজ করা এবং ইউটিউব, ফেসবুক বা টিকটকের মতো প্ল্যাটফর্মে সক্রিয় থাকার মাধ্যমে। এই নতুন অর্থনৈতিক মডেল একটি নতুন ধরনের পুঁজিবাদের জন্ম দিচ্ছে, যেখানে ডেটা, অ্যালগরিদম এবং নেটওয়ার্কের নিয়ন্ত্রণ অর্থনৈতিক ক্ষমতা ও সামাজিক মর্যাদার মূল উৎস হয়ে দাঁড়িয়েছে।

পিয়েরে বোর্দিয়ুর তাত্ত্বিক কাঠামো অনুসারে, সামাজিক শ্রেণী গঠনে চার ধরনের পুঁজিÑঅর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, সামাজিক ও প্রতীকীÑগুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। বাংলাদেশের নগর জীবনে এখন যে শ্রেণীভেদ স্পষ্ট হচ্ছে, তা মূলত সাংস্কৃতিক পুঁজি, বিশেষ করে ইংরেজি ভাষা দক্ষতা ও ডিজিটাল সক্ষমতার ভিত্তিতে গঠিত। যারা এই পুঁজি অর্জন করতে পারছে, তারা একটি নতুন ‘ডিজিটাল ক্ষুদ্র-মধ্যবিত্ত শ্রেণী’ গঠন করছে।

তাদের শ্রেণীগত অবস্থান পারিবারিক সম্পদের ওপর নয়, বরং ডিজিটাল দুনিয়ায় দক্ষতা ও বিশ্ববাজারে প্রবেশ করতে পারার সক্ষমতার ওপর নির্ভর করছে। এই শ্রেণীর সদস্যরা প্রায়শই শিক্ষাগত যোগ্যতা, প্রযুক্তিগত জ্ঞান এবং বৈশ্বিক সংস্কৃতির সঙ্গে নিজেদের খাপ খাইয়ে নেওয়ার ক্ষমতার দ্বারা নিজেদের পরিচিত করে। এটি ঐতিহ্যবাহী শ্রেণী কাঠামোর বাইরে গিয়ে নতুন সামাজিক গতিশীলতা তৈরি করছে, যেখানে ব্যক্তিগত দক্ষতা ও প্রযুক্তির ব্যবহার অর্থনৈতিক সাফল্যের চাবিকাঠি।

এ পরিস্থিতিতে এক নতুন ধরনের ডিজিটাল বিভাজন তৈরি হচ্ছে, যা কেবল প্রযুক্তিগত নয় বরং স্পষ্টভাবে শ্রেণীভিত্তিক। যারা যথাযথ শিক্ষা, উচ্চগুণমানের ইন্টারনেট সংযোগ অথবা ভাষাগত সুবিধা থেকে বঞ্চিত, তারা থেকে যাচ্ছে ডিজিটাল অর্থনীতির বাইরেই। একই শহরে বসবাস করেও একদিকে কেউ ডলার আয় করছে অনলাইনে, অন্যদিকে কেউ এখনো রিকশা চালাচ্ছে বা অস্থায়ী শ্রমজীবী হিসেবে কাজ করছে।

এই বৈপরীত্য ডেভিড হারভের ‘স্পাসিয়াল ফিক্স’ ও ‘অসামঞ্জস্যপূর্ণ ভৌগোলিক উন্নয়ন’ ধারণার সাথে মিল খায়। পুঁজি এখন আর স্থাননির্ভর নয়; এটি তথ্যপ্রবাহের মাধ্যমে এক শহরের মধ্যেও বৈষম্য সৃষ্টি করছে। ম্যানুয়েল কাস্তেলসের ‘নেটওয়ার্ক সমাজ’ তত্ত্বও এখানে প্রাসঙ্গিক। তার মতে, সামাজিক অন্তর্ভুক্তি এখন নির্ভর করে তথ্য ও প্রযুক্তি সংযুক্ততার ওপর।

বাংলাদেশের শহরে এই সংযুক্তি শুধু ইন্টারনেট কানেকশনের বিষয় নয়, এটি ইংরেজি ভাষা জ্ঞান, আন্তর্জাতিক সংস্কৃতিতে দখল ও প্রযুক্তি ব্যবহারের সক্ষমতার বিষয়। ফলে একই নগরবাসী হওয়া সত্ত্বেও কেউ হচ্ছে ডিজিটাল অর্থনীতির সুবিধাভোগী, আর কেউ হচ্ছে প্রযুক্তির বাইরের শ্রেণীর প্রতিনিধি। এই বিভাজন কেবল অর্থনৈতিক নয়, এটি সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রেও স্পষ্ট হয়ে উঠছে, যেখানে ডিজিটাল দক্ষতাসম্পন্নরা এক ধরনের নতুন সামাজিক মর্যাদা ও স্বীকৃতি লাভ করছে।

রাষ্ট্র এবং শিক্ষাব্যবস্থাও এই নতুন শ্রেণী গঠনের প্রক্রিয়ায় ভূমিকা রাখছে। ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ নীতিমালার ফলে ইন্টারনেট ব্যবহারে বিস্তার ঘটলেও, সরকারি স্কুল ও মাদ্রাসাগুলোর অধিকাংশই ডিজিটাল শিক্ষা প্রদানে সক্ষম নয়। ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের শিক্ষার্থীরা ডিজিটাল অর্থনীতিতে ঢোকার জন্য অনেক বেশি প্রস্তুত। এর ফলে শিক্ষাব্যবস্থা একটি শ্রেণীভিত্তিক পুঁজির প্রজননস্থলে পরিণত হয়েছে, যেমনটি বোর্দিয়ু তার শিক্ষাতাত্ত্বিক বিশ্লেষণে ব্যাখ্যা করেছেন। শিক্ষাব্যবস্থা অসম সুযোগ তৈরি করে, যা বিদ্যমান সামাজিক বৈষম্যকে আরও তীব্র করে।

ডিজিটাল উদ্যোক্তা হওয়া অনেকের কাছে মুক্তির পথ বলে মনে হলেও বাস্তবে এটি নতুন ধরনের শ্রেণী প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে। একজন তরুণকে একটি সফল অনলাইন ব্যবসা শুরু করতে হলে তাকে ভালো মোবাইল, বিদ্যুৎ, ইন্টারনেট, প্রাথমিক মূলধন ও সামাজিক যোগাযোগের ক্ষমতা থাকতে হয়; যা নগরের উচ্চ বা মধ্যবিত্তদের কাছেই বেশি প্রবেশযোগ্য। ফলে ডিজিটাল পুঁজিবাদ এমন এক অর্থনৈতিক বাস্তবতা তৈরি করছে, যেখানে শ্রেণীর সীমারেখা প্রযুক্তির ব্যবহারে নির্ধারিত হয়। রাষ্ট্রীয় নীতি যদি অন্তর্ভুক্তিমূলক না হয়, তবে ডিজিটাল বিভাজন আরও প্রকট হবে।

বাংলাদেশে এখন এক ধরনের নতুন ‘টেক এলিট’ শ্রেণী’ গঠিত হচ্ছে; যাদের মধ্যে রয়েছে সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার, ডিজিটাল মার্কেটার, ইউটিউবার ও তথ্যপ্রযুক্তি উদ্যোক্তা। এদের জীবনধারা, ভোগ-প্রবণতা ও সাংস্কৃতিক রুচি অনেকাংশেই পশ্চিমা আদর্শে প্রভাবিত।

তারা সন্তানদের ইংরেজি মাধ্যমে পড়ান, পশ্চিমা ফ্যাশনে অভ্যস্ত হন, ওয়েস্টার্ন মিডিয়া কনটেন্ট উপভোগ করেন এবং বৈশ্বিক সংস্কৃতিতে নিজেদের সংযুক্ত রাখেন। এর মধ্য দিয়ে তারা প্রতীকী পুঁজি অর্জন করছেন, যা তাদের শ্রেণীগত অবস্থান দৃঢ় করছে। এই শ্রেণী নিজেদের জন্য এক ধরনের বিশ্বজনীন পরিচয় তৈরি করছে, যা স্থানীয় প্রেক্ষাপটে তাদের স্বতন্ত্রতা তুলে ধরে।

এই নতুন শ্রেণী কাঠামোর মধ্যে সামাজিক গতিশীলতাও নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত হচ্ছে। আগে যেখানে সামাজিক গতিশীলতা নির্ভর করত বিদেশে কাজ করতে যাওয়া বা সরকারি চাকরির ওপর, এখন তা নির্ভর করছে ভার্চুয়াল গতিশীলতার ওপর। তবে বাস্তবে, এই গতিশীলতার পথ সহজ নয়।

ইংরেজি জানার সুযোগ, প্রযুক্তিগত দক্ষতা ও সাংস্কৃতিক পুঁজি যাদের নেই, তারা এই অর্থনীতির বাইরে থাকেন। ডিজিটাল অর্থনীতির কথিত মেধাতন্ত্র আসলে বিদ্যমান শ্রেণী কাঠামোর প্রতিফলন, যেখানে অধিকাংশ মানুষ বঞ্চিতই থেকে যায়। যারা প্রযুক্তিগত সুবিধা থেকে বঞ্চিত, তাদের জন্য এই নতুন শ্রেণী কাঠামোতে প্রবেশ করা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে, ফলে সামাজিক গতিশীলতা সীমিত হয় এবং বৈষম্য বাড়তে থাকে।

এই ডিজিটাল শ্রেণী বিভাজনের বিরুদ্ধে কিছু সীমিত প্রতিরোধ গড়ে উঠছে। কিছু বেসরকারি সংস্থা ও এনজিও পিছিয়ে পড়া তরুণদের প্রযুক্তিগত প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। তবে শিক্ষা ব্যবস্থার সংস্কার, ডিজিটাল পরিকাঠামোতে সমতা ও ভাষাগত অন্তর্ভুক্তি ছাড়া এই প্রচেষ্টা স্থায়ী প্রভাব ফেলতে পারবে না। ডিজিটাল পুঁজিবাদ যদিও কিছু নাগরিকের জন্য সুযোগ তৈরি করছে, তা অধিকাংশের জন্য বৈষম্য ও বিচ্ছিন্নতা সৃষ্টি করছে।

সার্বিকভাবে বলা যায়, নগর বাংলাদেশের শ্রেণী কাঠামোতে এক মৌলিক রূপান্তর ঘটছে ডিজিটাল পুঁজিবাদের ফলে। বোর্দিয়ু, হারভে ও কাস্তেলসের মতো তাত্ত্বিকদের ধারণা ব্যবহার করে আমরা বুঝতে পারি যে প্রযুক্তি, ভাষা ও বৈশ্বিক বাজারের সংযোগ কিভাবে এক নতুন শ্রেণী ব্যবস্থা গড়ে তুলছেÑযা একদিকে পুরোনো কাঠামোকে টিকিয়ে রাখছে, অন্যদিকে তার ওপর এক নতুন বৈষম্যের স্তর চাপিয়ে দিচ্ছে।

ডিজিটাল অর্থনীতির স্বপ্ন তখনই বাস্তবতা হতে পারে, যখন তা সত্যিকার অর্থে অন্তর্ভুক্তিমূলক হবে, না হলে তা একটি নতুন শ্রেণী দমনমূলক কাঠামোতেই পরিণত হবে। এই পরিবর্তনগুলোকে গভীরভাবে বোঝা এবং সে অনুযায়ী নীতি প্রণয়ন করা জরুরি, যাতে বাংলাদেশের নগরজীবন একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক ও ন্যায়ভিত্তিক সমাজে রূপান্তরিত হয়।

[লেখক : গবেষক ও উন্নয়নকর্মী]

back to top