ফোরকান উদ্দিন আহাম্মদ
জিলহজ মাসের প্রথম দশ দিন অত্যন্ত গুরুত্ববহ ও মর্যাদাপূর্ণ। হজের মূল অনুষ্ঠান কোরবানি এই দশ দিনের মধ্যেই সম্পন্ন করা হয়। হাজিরা জিলহজে মক্কা মোয়াজ্জমা থেকে আরাফাতের উদ্দেশে রওয়ানা করে মিনায় গিয়ে অবস্থান করেন। ৯ জিলহজ সূর্যোদয়ের পর সেখান থেকে রওয়ানা দেন আরাফাতের ময়দানের দিকে। সেখানে সূর্য হেলার পর থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত উকুফ বা অবস্থান করেন। (এটিই হজের প্রধান কাজ) সূর্যাস্তের পর সেখান থেকে পৌঁছান মুজদালাফায়। রাত্রে অবস্থান করেন সেখানে। ১০ জিলহজ সকালে সেখান থেকে রওয়ানা করে পৌঁছেন মিনা উপত্যকায়। আল্লাহ পাকের সন্তুষ্টি লাভের জন্য নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট পশু জবেহ করাকে বলা হয় কোরবানি। কোরবানির তাৎপর্য হলো ত্যাগ-তিতীক্ষা এবং প্রিয় বস্তুকে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য উৎসর্গ করা। মানব ইতিহাসের সর্বপ্রথম কোরবানি করেন আদম আ:-এর দুই পুত্র হাবিল ও কাবিল। প্রত্যেক জাতির জন্যই কোরবানির বিধান ছিল। আমরা যে কোরবানি করছি তা হজরত ইব্রাহিম আ:-এর অপূর্ব ত্যাগের ও বিস্ময়কর ঘটনার স্মারক।
মানব সৃষ্টির শুরু থেকেই কোরবানির বিধান চলে আসছে। প্রত্যেক ধর্ম মতেই কোরবানি ছিল একটি অপরিহার্য অংশ। মানব ইতিহাসের সর্বপ্রথম কোরবানি হজরত আদম আ:-এর দুই ছেলে হাবিল ও কাবিলের কোরবানি। আন্তরিকতা ও উদ্দেশের সততার কারণে হাবিলের কোরবানি কবুল হলো, কিন্তু নিষ্ঠার অভাব ও অমনোযোগিতার কারণে কাবিলের কোরবানি প্রত্যাখ্যাত হলো। কোরবানির ইতিহাসে বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন হজরত ইব্রাহিম আ: ও ইসমাইল আ:। মহান আল্লাহর জন্য হজরত ইব্রাহিম আ:-এর সর্বোৎকৃষ্ট ত্যাগ এবং হজরত ইসমাইল আ:-এর আত্মোৎসর্গ আল্লাহর কাছে এতই পছন্দ হলো যে, তিনি ইব্রাহিম আ:-কে বন্ধুরূপে গ্রহণ করলেন। শুধু তাই নয়, মহান আল্লাহ তাকে মুসলিম জাতির পিতার আসনে অভিষিক্ত করলেন এবং তার ছেলে ইসমাইল আ:-এর পবিত্র বংশ দ্বারাই সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবি হজরত মুহাম্মদ সা:-এর আবির্ভাব ঘটালেন। তিনি হজরত ইব্রাহিম আ: ও হজরত ইসমাইল আ:-এর ত্যাগের ইতিহাস চিরঞ্জীব করে রাখার জন্য সর্বকালের সব সচ্ছল মানুষের জন্য কোরবানি বাধ্যতামূলক করলেন।
ঈদুল আজহা মুসলিম দুনিয়ার সর্বত্র পালিত হয় নানা নামে। যেমন- মিসরে একে বলা হয় ঈদুল বাকারা, সৌদি আরব ও মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশে একে বলা হয় ঈদে কুরবান, বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, ইরান প্রভৃতি অঞ্চলে বকরা ঈদ, বাংলাদেশে সাধারণত একে বলা হয় কোরবানির ঈদ, তুরস্কে বলা হয় কুরবান বায়রাম, অ্যারাবিয়ান গালফ এলাকায় ইয়াওমুন নাহর। ঈদ মানে পুনরাবৃত্ত আনন্দ উৎসব। এই ঈদে পশু কোরবানি দেয়া সামর্থ্যবানদের জন্য ওয়াজিব। কোরবানিকৃত পশুর গোশত তিন ভাগ করে এক ভাগ গরিব মিসকিনদের মধ্যে বিতরণ করতে হয় যাতে তারাও এই আপ্যায়নে শরিক হতে পারে। পশু কোরবানির মাধ্যমে শয়তান প্ররোচিত পাশবিকতা দূর হয়। এর দ্বারা তাকওয়া অর্জিত হয়। আমাদের জীবন, আমাদের সম্পদ সব কিছু মহান আল্লাহর দান। মহান আল্লাহর জন্য প্রিয় বস্তুকে উৎসর্গ করতে পারাই কোরবানির গুরুত্ব। কোরবানির মাধ্যমে আল্লাহর কাছে তার প্রিয় বান্দার গোলামি প্রকাশ পায়, প্রভুর জন্য তার ভালোবাসা ও ত্যাগের মহিমা বর্ণিত হয়। আল্লাহর দান আল্লাহকে ফিরিয়ে দিতে আমরা কতটা প্রস্তুত, তার একটি ক্ষুদ্র পরীক্ষা হলো কোরবানি। ঈদুল আজহা কেবল পশু কোরবানি করা এবং আত্মীয়স্বজনদের নিয়ে আনন্দ প্রমোদকে বুঝায় না বরং ঈদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, আত্মোৎসর্গ করা। নিজের ভেতরে থাকা পশুত্বের মূলোৎপাটন এবং একমাত্র রবের সন্তুষ্টি।
ইসলাম একটি তাৎপর্যপূর্ণ ধর্ম। এর প্রতিটি আদেশ নিষেধের সঙ্গে জড়িয়ে আছে মুসলিমদের আত্মা পরিশুদ্ধ করা এবং প্রশান্ত করা। ঈদ মানে আনন্দ, ঈদ মানে খুশি এ কথাটি সবার মুখে রটে বেড়ায় কিন্তু ঈদুল ফিতর বা ঈদুল আজহার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকা শিক্ষা এবং এর মহত্ত্বের প্রতি কজনইবা গুরুত্ব দিচ্ছি! ঈদ যেমন আনন্দের বার্তা দিচ্ছে ঠিক তেমনিভাবে শিক্ষা দিচ্ছে মহান আল্লাহর আদেশ নিষেধ পালনের প্রতি নিজেকে উৎসর্গ করার। নিজের মাঝে থাকা পশুত্ব ও অমানবিক মন-মানসিকতা বিসর্জন দেয়ার। বার্তা দিচ্ছে অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ানোর। সুপথ দেখাচ্ছে ন্যায়নীতি আর নিষ্ঠার পথে চলার। শিক্ষা দিচ্ছে সুন্দর ও পবিত্র মনের অধিকারী হওয়ার। তাই আসুন ঈদুল আজহার প্রকৃত মহত্ব্য ও তাৎপর্য নিজে লালন করতে শিখি। অসুন্দর ও কলুষিত হৃদয় পবিত্র করার লক্ষ্যে ঈদুল আজহায় শিক্ষা গ্রহণ করি। যেকোন সংকটে ও মহামারীতে অসহায়দের পাশে দাঁড়াতে চেষ্টা করি। অন্য সময় দান সদাকাহ এবং সহযোগিতার পরিমাণ যেটুকু ছিল এখন সেটা আরো বাড়াতে চেষ্টা করি। সবিশেষ সবার প্রতি সর্বাত্মক সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিই। কোরবানির উদ্দেশ্য অবশ্যই সৎ হতে হবে এবং তাতে ত্যাগের বহিঃপ্রকাশ থাকতে হবে। কোরবানি প্রদর্শন ইচ্ছা ও অহংকারমুক্ত হতে হবে। অনেকেই বাহবা পাওয়ার জন্য ও নাম জাহির করার লক্ষ্যে লক্ষাধিক টাকার পশু কিনে লাল ফিতা বেঁধে রাস্তায় রাস্তায় প্রদর্শিত করে থাকেন এটা যেমন ঠিক নয়, তেমনি কোনো সামর্থ্যবান ব্যক্তির জন্য কম দামি দুর্বল পশু কোরবানিও অনুচিত। পশুটি কত বড় ও কত দামের সেটা আল্লাহর কাছে কোনো বিবেচ্য বিষয় নয়। পশুর গোশত আল্লাহর কাছে পৌঁছাবে না বরং তাকওয়া আল্লাহ কবুল করে থাকেন। ভোগ নয়, ত্যাগেই আনন্দÑএটি কোরবানির অন্যতম শিক্ষা। কোরবানির গোশত গরিবদের মাঝে বিতরণ করে তাদের মুখে হাসি ফোটানো কোরবানির অন্যতম লক্ষ্য। রাসূল সা: কোরবানির তিন ভাগের এক ভাগ গোশত গরিবদের মাঝে বিতরণ করাকে মুস্তাহাব করেছেন। এমনকি সবটা দান করাও বৈধ। কোরবানির গোশত খাওয়া ও সংরক্ষণ বৈধ তবে গরিবদের মাঝে বিতরণের যে উদ্দেশ্য তা থেকে বিচ্যুত হওয়া যাবে না। শুধু পশু নয়, নিজের অন্তরের পশুত্ব কোরবানি করাও কোরবানির অন্যতম উদ্দেশ্য। পশুর রক্ত প্রবাহিত করার সাথে আমাদের ভেতরের পশুত্বকেও কোরবানি করতে হবে। মহান আল্লাহর তাওহিদ বা একত্ববাদ বিশ্বের বুকে প্রতিষ্ঠা করা কোরবানির অন্যতম শিক্ষা। কারণ, একমাত্র বিশ্বজাহানের মালিক মহান আল্লাহর উদ্দেশে, তার নামেই পশু কোরবানি দেয়া হয়। কোরবানির গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা, আল্লাহর প্রতি পূর্ণ আত্মসমর্পণ। আল্লাহর সব আদেশের সামনে বিনা প্রশ্নে মাথানত করে দেয়াই হলো পূর্ণ আত্মসমর্পণের সমুজ্জ্বল বহিঃপ্রকাশ।
এ কোরবানি কেবল যে পশু কোরবানি নয়, তা মানুষের ভেতরের অহংকারি পশুর, মানুষের ভেতরের রক্তাক্ত অমানুষের বিনাশের প্রতীকী ত্যাগ। এর সঙ্গে সঙ্গে এ বিশাল ত্যাগের মাধ্যমে মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের একটি অন্যতম প্রয়াস এই কোরবানি। এতে ব্যক্তির দেহের ও মনের ঋণাত্মক যত ভাবনা, অমানবিক যত চেতনা, মানবিকতার পরিপন্থি যত উপলব্ধি ও অহংকার এবং মানুষের মনের অন্তর্গত হিংস্র পশুত্বের যে অপচ্ছায়া তা অপসারিত হয়। এটাই নজরুলের কবিতায় উঠে আসা কোরবানির মর্মগাথা। এ ধারায় নজরুলের ‘বকরি ঈদ’ (সওগাত, ১৩৩৪) কবিতাটিও বিষয়-প্রাসঙ্গিকতায় অভিন্ন। এ কবিতাটি উপলব্ধির অন্তঃপুরে ত্যাগের মহিমাকে শোভান্বিত করে তুলেছে। এ কবিতায় নজরুল কোরবানির ঈদ মানবিক চেতনায় মহিমান্বিত করার প্রয়াস পেয়েছেন। তিনি নির্দ্বিধায় উচ্চারণ করেছেন, ‘শহীদানের ঈদ এলো বকরীদ।...তাহারাই শুধু বকরীদ করে জানমাল কোরবানে।’
দেশের অর্থনীতির সঙ্গে কোরবানির এক নিবিড় সম্পর্ক আছে। জিলহজ মাসের ১০ তারিখে মুসলমানদের অন্যতম একটি উৎসব ঈদুল আজহা পালিত হবে। প্রতি বছর এ সময়ের আগেই বাংলাদেশে গরু-ছাগল কেনাবেচা বেশ জমজমাট হয়ে ওঠে। ভারত থেকে অবৈধ পথে গরু আসা অনেকটা কমে যাওয়ার পর বাংলাদেশ জুড়ে বহু ছোট-ছোট খামার গড়ে উঠেছে, যার মূল লক্ষ্য থাকে কোরবানির পশুর হাট। গ্রামাঞ্চলে বহু পরিবার শুধু কোরবানির ঈদে বিক্রির জন্য গরু-ছাগল লালনপালন করে। করোনা মহামারীর পরবর্তীতে গত কয়েক বছরে কোরবানির পশুর চামড়ার অত্যন্ত নি¤œমুখী যা চামড়া ব্যবসায়ীদের জন্য এক বিরাট হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। চামড়া শিল্প এক মহাসংকটের সম্মুখীন। জাতি আজ এই চামড়া শিল্পের অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখার এক মহা চ্যালেঞ্জে পড়েছে। চামড়ার বাজারকে উর্ধ্বমুখী করার জন্য সরকারকে বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে অন্যথায় চামড়া শিল্পের পতনে স্বাভাবিক পরিবেশ বিপর্যস্থ হয়ে পড়তে পারে। নিঃসন্দেহে চামড়া দর পতনের কারনে চামড়া ব্যবসায়ী ও উদ্যোতা গোষ্ঠীকে চরম ভোগান্তিতে পড়তে হবে। গত কয়েক বছরে চামড়ার মূল্যের পতন জনিত কারণে উদ্যোগতা এবং শিল্প শ্রমিকরা এ ব্যবসা গুটিয়ে নেয়ার চিন্তা ভাবনা শুরু করে দিয়েছে।
[লেখক : সাবেক উপ-মহাপরিচালক, বাংলাদেশ আনসার ও ভিডিপি]
ফোরকান উদ্দিন আহাম্মদ
বুধবার, ০৪ জুন ২০২৫
জিলহজ মাসের প্রথম দশ দিন অত্যন্ত গুরুত্ববহ ও মর্যাদাপূর্ণ। হজের মূল অনুষ্ঠান কোরবানি এই দশ দিনের মধ্যেই সম্পন্ন করা হয়। হাজিরা জিলহজে মক্কা মোয়াজ্জমা থেকে আরাফাতের উদ্দেশে রওয়ানা করে মিনায় গিয়ে অবস্থান করেন। ৯ জিলহজ সূর্যোদয়ের পর সেখান থেকে রওয়ানা দেন আরাফাতের ময়দানের দিকে। সেখানে সূর্য হেলার পর থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত উকুফ বা অবস্থান করেন। (এটিই হজের প্রধান কাজ) সূর্যাস্তের পর সেখান থেকে পৌঁছান মুজদালাফায়। রাত্রে অবস্থান করেন সেখানে। ১০ জিলহজ সকালে সেখান থেকে রওয়ানা করে পৌঁছেন মিনা উপত্যকায়। আল্লাহ পাকের সন্তুষ্টি লাভের জন্য নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট পশু জবেহ করাকে বলা হয় কোরবানি। কোরবানির তাৎপর্য হলো ত্যাগ-তিতীক্ষা এবং প্রিয় বস্তুকে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য উৎসর্গ করা। মানব ইতিহাসের সর্বপ্রথম কোরবানি করেন আদম আ:-এর দুই পুত্র হাবিল ও কাবিল। প্রত্যেক জাতির জন্যই কোরবানির বিধান ছিল। আমরা যে কোরবানি করছি তা হজরত ইব্রাহিম আ:-এর অপূর্ব ত্যাগের ও বিস্ময়কর ঘটনার স্মারক।
মানব সৃষ্টির শুরু থেকেই কোরবানির বিধান চলে আসছে। প্রত্যেক ধর্ম মতেই কোরবানি ছিল একটি অপরিহার্য অংশ। মানব ইতিহাসের সর্বপ্রথম কোরবানি হজরত আদম আ:-এর দুই ছেলে হাবিল ও কাবিলের কোরবানি। আন্তরিকতা ও উদ্দেশের সততার কারণে হাবিলের কোরবানি কবুল হলো, কিন্তু নিষ্ঠার অভাব ও অমনোযোগিতার কারণে কাবিলের কোরবানি প্রত্যাখ্যাত হলো। কোরবানির ইতিহাসে বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন হজরত ইব্রাহিম আ: ও ইসমাইল আ:। মহান আল্লাহর জন্য হজরত ইব্রাহিম আ:-এর সর্বোৎকৃষ্ট ত্যাগ এবং হজরত ইসমাইল আ:-এর আত্মোৎসর্গ আল্লাহর কাছে এতই পছন্দ হলো যে, তিনি ইব্রাহিম আ:-কে বন্ধুরূপে গ্রহণ করলেন। শুধু তাই নয়, মহান আল্লাহ তাকে মুসলিম জাতির পিতার আসনে অভিষিক্ত করলেন এবং তার ছেলে ইসমাইল আ:-এর পবিত্র বংশ দ্বারাই সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবি হজরত মুহাম্মদ সা:-এর আবির্ভাব ঘটালেন। তিনি হজরত ইব্রাহিম আ: ও হজরত ইসমাইল আ:-এর ত্যাগের ইতিহাস চিরঞ্জীব করে রাখার জন্য সর্বকালের সব সচ্ছল মানুষের জন্য কোরবানি বাধ্যতামূলক করলেন।
ঈদুল আজহা মুসলিম দুনিয়ার সর্বত্র পালিত হয় নানা নামে। যেমন- মিসরে একে বলা হয় ঈদুল বাকারা, সৌদি আরব ও মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশে একে বলা হয় ঈদে কুরবান, বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, ইরান প্রভৃতি অঞ্চলে বকরা ঈদ, বাংলাদেশে সাধারণত একে বলা হয় কোরবানির ঈদ, তুরস্কে বলা হয় কুরবান বায়রাম, অ্যারাবিয়ান গালফ এলাকায় ইয়াওমুন নাহর। ঈদ মানে পুনরাবৃত্ত আনন্দ উৎসব। এই ঈদে পশু কোরবানি দেয়া সামর্থ্যবানদের জন্য ওয়াজিব। কোরবানিকৃত পশুর গোশত তিন ভাগ করে এক ভাগ গরিব মিসকিনদের মধ্যে বিতরণ করতে হয় যাতে তারাও এই আপ্যায়নে শরিক হতে পারে। পশু কোরবানির মাধ্যমে শয়তান প্ররোচিত পাশবিকতা দূর হয়। এর দ্বারা তাকওয়া অর্জিত হয়। আমাদের জীবন, আমাদের সম্পদ সব কিছু মহান আল্লাহর দান। মহান আল্লাহর জন্য প্রিয় বস্তুকে উৎসর্গ করতে পারাই কোরবানির গুরুত্ব। কোরবানির মাধ্যমে আল্লাহর কাছে তার প্রিয় বান্দার গোলামি প্রকাশ পায়, প্রভুর জন্য তার ভালোবাসা ও ত্যাগের মহিমা বর্ণিত হয়। আল্লাহর দান আল্লাহকে ফিরিয়ে দিতে আমরা কতটা প্রস্তুত, তার একটি ক্ষুদ্র পরীক্ষা হলো কোরবানি। ঈদুল আজহা কেবল পশু কোরবানি করা এবং আত্মীয়স্বজনদের নিয়ে আনন্দ প্রমোদকে বুঝায় না বরং ঈদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, আত্মোৎসর্গ করা। নিজের ভেতরে থাকা পশুত্বের মূলোৎপাটন এবং একমাত্র রবের সন্তুষ্টি।
ইসলাম একটি তাৎপর্যপূর্ণ ধর্ম। এর প্রতিটি আদেশ নিষেধের সঙ্গে জড়িয়ে আছে মুসলিমদের আত্মা পরিশুদ্ধ করা এবং প্রশান্ত করা। ঈদ মানে আনন্দ, ঈদ মানে খুশি এ কথাটি সবার মুখে রটে বেড়ায় কিন্তু ঈদুল ফিতর বা ঈদুল আজহার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকা শিক্ষা এবং এর মহত্ত্বের প্রতি কজনইবা গুরুত্ব দিচ্ছি! ঈদ যেমন আনন্দের বার্তা দিচ্ছে ঠিক তেমনিভাবে শিক্ষা দিচ্ছে মহান আল্লাহর আদেশ নিষেধ পালনের প্রতি নিজেকে উৎসর্গ করার। নিজের মাঝে থাকা পশুত্ব ও অমানবিক মন-মানসিকতা বিসর্জন দেয়ার। বার্তা দিচ্ছে অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ানোর। সুপথ দেখাচ্ছে ন্যায়নীতি আর নিষ্ঠার পথে চলার। শিক্ষা দিচ্ছে সুন্দর ও পবিত্র মনের অধিকারী হওয়ার। তাই আসুন ঈদুল আজহার প্রকৃত মহত্ব্য ও তাৎপর্য নিজে লালন করতে শিখি। অসুন্দর ও কলুষিত হৃদয় পবিত্র করার লক্ষ্যে ঈদুল আজহায় শিক্ষা গ্রহণ করি। যেকোন সংকটে ও মহামারীতে অসহায়দের পাশে দাঁড়াতে চেষ্টা করি। অন্য সময় দান সদাকাহ এবং সহযোগিতার পরিমাণ যেটুকু ছিল এখন সেটা আরো বাড়াতে চেষ্টা করি। সবিশেষ সবার প্রতি সর্বাত্মক সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিই। কোরবানির উদ্দেশ্য অবশ্যই সৎ হতে হবে এবং তাতে ত্যাগের বহিঃপ্রকাশ থাকতে হবে। কোরবানি প্রদর্শন ইচ্ছা ও অহংকারমুক্ত হতে হবে। অনেকেই বাহবা পাওয়ার জন্য ও নাম জাহির করার লক্ষ্যে লক্ষাধিক টাকার পশু কিনে লাল ফিতা বেঁধে রাস্তায় রাস্তায় প্রদর্শিত করে থাকেন এটা যেমন ঠিক নয়, তেমনি কোনো সামর্থ্যবান ব্যক্তির জন্য কম দামি দুর্বল পশু কোরবানিও অনুচিত। পশুটি কত বড় ও কত দামের সেটা আল্লাহর কাছে কোনো বিবেচ্য বিষয় নয়। পশুর গোশত আল্লাহর কাছে পৌঁছাবে না বরং তাকওয়া আল্লাহ কবুল করে থাকেন। ভোগ নয়, ত্যাগেই আনন্দÑএটি কোরবানির অন্যতম শিক্ষা। কোরবানির গোশত গরিবদের মাঝে বিতরণ করে তাদের মুখে হাসি ফোটানো কোরবানির অন্যতম লক্ষ্য। রাসূল সা: কোরবানির তিন ভাগের এক ভাগ গোশত গরিবদের মাঝে বিতরণ করাকে মুস্তাহাব করেছেন। এমনকি সবটা দান করাও বৈধ। কোরবানির গোশত খাওয়া ও সংরক্ষণ বৈধ তবে গরিবদের মাঝে বিতরণের যে উদ্দেশ্য তা থেকে বিচ্যুত হওয়া যাবে না। শুধু পশু নয়, নিজের অন্তরের পশুত্ব কোরবানি করাও কোরবানির অন্যতম উদ্দেশ্য। পশুর রক্ত প্রবাহিত করার সাথে আমাদের ভেতরের পশুত্বকেও কোরবানি করতে হবে। মহান আল্লাহর তাওহিদ বা একত্ববাদ বিশ্বের বুকে প্রতিষ্ঠা করা কোরবানির অন্যতম শিক্ষা। কারণ, একমাত্র বিশ্বজাহানের মালিক মহান আল্লাহর উদ্দেশে, তার নামেই পশু কোরবানি দেয়া হয়। কোরবানির গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা, আল্লাহর প্রতি পূর্ণ আত্মসমর্পণ। আল্লাহর সব আদেশের সামনে বিনা প্রশ্নে মাথানত করে দেয়াই হলো পূর্ণ আত্মসমর্পণের সমুজ্জ্বল বহিঃপ্রকাশ।
এ কোরবানি কেবল যে পশু কোরবানি নয়, তা মানুষের ভেতরের অহংকারি পশুর, মানুষের ভেতরের রক্তাক্ত অমানুষের বিনাশের প্রতীকী ত্যাগ। এর সঙ্গে সঙ্গে এ বিশাল ত্যাগের মাধ্যমে মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের একটি অন্যতম প্রয়াস এই কোরবানি। এতে ব্যক্তির দেহের ও মনের ঋণাত্মক যত ভাবনা, অমানবিক যত চেতনা, মানবিকতার পরিপন্থি যত উপলব্ধি ও অহংকার এবং মানুষের মনের অন্তর্গত হিংস্র পশুত্বের যে অপচ্ছায়া তা অপসারিত হয়। এটাই নজরুলের কবিতায় উঠে আসা কোরবানির মর্মগাথা। এ ধারায় নজরুলের ‘বকরি ঈদ’ (সওগাত, ১৩৩৪) কবিতাটিও বিষয়-প্রাসঙ্গিকতায় অভিন্ন। এ কবিতাটি উপলব্ধির অন্তঃপুরে ত্যাগের মহিমাকে শোভান্বিত করে তুলেছে। এ কবিতায় নজরুল কোরবানির ঈদ মানবিক চেতনায় মহিমান্বিত করার প্রয়াস পেয়েছেন। তিনি নির্দ্বিধায় উচ্চারণ করেছেন, ‘শহীদানের ঈদ এলো বকরীদ।...তাহারাই শুধু বকরীদ করে জানমাল কোরবানে।’
দেশের অর্থনীতির সঙ্গে কোরবানির এক নিবিড় সম্পর্ক আছে। জিলহজ মাসের ১০ তারিখে মুসলমানদের অন্যতম একটি উৎসব ঈদুল আজহা পালিত হবে। প্রতি বছর এ সময়ের আগেই বাংলাদেশে গরু-ছাগল কেনাবেচা বেশ জমজমাট হয়ে ওঠে। ভারত থেকে অবৈধ পথে গরু আসা অনেকটা কমে যাওয়ার পর বাংলাদেশ জুড়ে বহু ছোট-ছোট খামার গড়ে উঠেছে, যার মূল লক্ষ্য থাকে কোরবানির পশুর হাট। গ্রামাঞ্চলে বহু পরিবার শুধু কোরবানির ঈদে বিক্রির জন্য গরু-ছাগল লালনপালন করে। করোনা মহামারীর পরবর্তীতে গত কয়েক বছরে কোরবানির পশুর চামড়ার অত্যন্ত নি¤œমুখী যা চামড়া ব্যবসায়ীদের জন্য এক বিরাট হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। চামড়া শিল্প এক মহাসংকটের সম্মুখীন। জাতি আজ এই চামড়া শিল্পের অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখার এক মহা চ্যালেঞ্জে পড়েছে। চামড়ার বাজারকে উর্ধ্বমুখী করার জন্য সরকারকে বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে অন্যথায় চামড়া শিল্পের পতনে স্বাভাবিক পরিবেশ বিপর্যস্থ হয়ে পড়তে পারে। নিঃসন্দেহে চামড়া দর পতনের কারনে চামড়া ব্যবসায়ী ও উদ্যোতা গোষ্ঠীকে চরম ভোগান্তিতে পড়তে হবে। গত কয়েক বছরে চামড়ার মূল্যের পতন জনিত কারণে উদ্যোগতা এবং শিল্প শ্রমিকরা এ ব্যবসা গুটিয়ে নেয়ার চিন্তা ভাবনা শুরু করে দিয়েছে।
[লেখক : সাবেক উপ-মহাপরিচালক, বাংলাদেশ আনসার ও ভিডিপি]