alt

উপ-সম্পাদকীয়

চোখের নজর কম হলে আর কাজল দিয়ে কী হবে

আনোয়ারুল হক

: বুধবার, ১১ জুন ২০২৫

ষাটের দশকে কিশোর কুমার-মধুবালার ‘চলতি কা নাম গাড়ি’ ছবির সুপারহিট গানের একটা লাইন ‘যাতে থে জাপান, পহোচ গয়ে চীন ...। ’ আমার কথা ছবির কাহিনী নিয়ে নয়। জনপ্রিয় গানটির এই লাইন নিয়ে। দেশে চলছে সংস্কার, বিচার আর নির্বাচন নিয়ে আলোচনা, সমালোচনা, পদত্যাগের আগ্রহ, আবার পদত্যাগ নয় জনতাকে নিয়ে মোকাবিলা ইত্যাদি। এর মধ্যে মুক্তিযুদ্ধ আর মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞা নির্ধারনের অর্ডিন্যান্স দেখে তো টাসকি খাওয়ার উপক্রম। দেশে আবার ‘মুজিবনগর সরকার’ কায়েম হ’ল কিনা! সম্বিত ফিরে পেতেই মনে পড়ল প্রধান উপদেষ্টার বাক্যবিলাসী প্রেস সচিবের কথা-‘আমাদের সব কিছু করার ম্যান্ডেট রয়েছে।’ যখন চাহে এমন যা! ছিলাম সংস্কার, বিচার আর নির্বাচন নিয়ে। এখন মনে পড়েছে সংজ্ঞা নির্ধারণই এই মুহূর্তের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ। এত গুরুত্বপূর্ণ যে ‘মধ্যরাতের অশ্বারোহী’ হয়ে গভীর রাতে সরকারকে অর্ডিন্যান্স জারি করতে হ’ল। কি আর করা, ‘যাতে থে জাপান, পহোচ গয়ে চীন’!

গত ৩ মে ২৫ তারিখে জারি করা জামুকা অধ্যাদেশের গেজেটে উল্লেখ করা হয়েছে, “মুক্তিযুদ্ধ’ অর্থ ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ২৬ মার্চ হইতে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত... একটি স্বাধীন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আকাক্সক্ষায় হানাদার ও দখলদার পাকিস্তানি সশস্ত্র বাহিনী এবং তাহাদের সহযোগী রাজাকার, আলবদর, আলশামস, তৎকালীন(!) মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলামী, নেজামে ইসলাম এবং দালাল ও শান্তি কমিটির বিরুদ্ধে যুদ্ধ।” ‘তৎকালীনের’ মারপ্যাঁচ দিয়ে জামায়াত ও তার সহযোগীদের আইনি সুরক্ষা দেওয়ার প্রচেষ্টা হলেও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ছিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের সহযোগী জামায়াতে ইসলামসহ দালাল রাজনৈতিক দল এবং রাজাকার, আলবদর, আলশামস ও তথাকথিত শান্তি কমিটির বিরুদ্ধে যুদ্ধ। জামায়াতের মুক্তিযুদ্ধ বিরোধিতা এবং পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সঙ্গে হত্যাযজ্ঞে শামিল হওয়া ছিল উদার গণতান্ত্রিক রাজনীতির বিপরীতে উগ্রবাদী ধর্মান্ধ রাজনীতির ফলাফল, যে রাজনীতি তারা আগেও ধারণ করত এবং এখনও করে। তাদের নীতি ও বক্তব্য সব সময় সংখ্যালঘু গোষ্ঠীদের প্রতি বৈষম্যমূলক। তাই সেই সময়ে তারা নির্বিচার সংখ্যালঘু নিধনযজ্ঞে শামিল হয়েছিল। ১৯৭১-এ জামায়াত ইসলামের আমির ছিলেন গোলাম আজম এবং তৎকালীন আর বর্তমানকে এক করে স্বাধীন বাংলাদেশে জামায়াতে ইসলামীর আমির তিনিই ছিলেন। ‘তৎকালীন’র দায় নেবো না বললেই বিষয়টা খারিজ হয়ে যায় না। এটা একক দায়ের বিষয় নয়। দলগত দায়। জুলাই গণ-আন্দোলনে ১৪০০ হত্যাকা-ের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে দল হিসাবে আওয়ামী লীগের বিচার প্রক্রিয়া শুরু হবে।

একই সঙ্গে গোটা ’৭১ সালজুড়ে লক্ষ লক্ষ হত্যাকা-ের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে দল হিসাবে জামায়াতের নিবন্ধন ও কার্যক্রম স্থগিত রেখে অপরাধের বিচার প্রক্রিয়াও একই সঙ্গে শুরু করলে সরকারের নিরপেক্ষতা নিশ্চিত হবে। জুলাই অভ্যুত্থান যদি আওয়ামী শাসনামলের বিচ্যুতে থেকে মুক্তিযুদ্ধের ধারা পুনঃপ্রতিষ্ঠা এবং সব অপরাধ, অবিচার ও বৈষম্য অবসানের লড়াই হয়ে থাকে, যা তৎকালীন ছাত্র নেতৃত্ব দাবি করেছিলেন, তবে এ ব্যবস্থাইতো যৌক্তিক ও নিরপেক্ষ প্রশাসনিক ব্যবস্থা।

গোলাম আজম ১৯৭১-এ মুক্তিযুদ্ধের সময় ঘোষণা করেছিলেন, “পবিত্র আদর্শভিত্তিক পাকিস্তানকে রক্ষার জন্য সর্বপ্রকার ত্যাগ স্বীকার করতে হবে। তিনি বলেন, শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে পূর্ব পাকিস্তানের হিন্দুরা স্বাধীনতার আন্দোলন করছে; জামায়াত কর্মীরা রাজাকারে ভর্তি হয়ে দেশের প্রতিরক্ষায় বাধ্য। এখন দেশে দুইটিই দেশপ্রেমিক শক্তিÑএকটি জামায়াত, অন্যটি পাক সেনাবাহিনী। বাকিরা সব গাদ্দার, ইসলামের শত্রু এবং কাফের।” জামায়াত কর্মীরা জানে ইসলাম ও মুসলমানদের জন্য বাংলাদেশ কোনো স্থান হতে পারে না। জামায়াত কর্মীরা শহীদ হতে পারে কিন্তু পরিবর্তিত হতে পারে না। তাই ’৭১-এর অপরাধকে ‘তৎকালীন’ বলে বর্তমানকে পরিবর্তিত বলার সুযোগ নেই। কারণ জামায়াত পরিবর্তিত হতে জানে না। ইসলামী ছাত্র শিবিরের সভাপতি তো বুক চিতিয়ে গর্বভরে বলছেন, তারাই জুলাই আন্দোলনের সময়ে তাদের সংগঠনের লোকজন নিয়ে সেøাগান তুলেছিলেন ‘তুমি কে আমি কে, রাজাকার রাজাকার।’ অর্থাৎ তারা পরিবর্তিত হয়নি।

সাধারণ ছাত্রছাত্রীরা অবশ্য তাদের উদ্দেশ্য বুঝতে পেরে, ‘কে বলেছে কে বলেছে স্বৈরাচার স্বৈরাচার’ লাইনটি যোগ করে আন্দোলনের গতিমুখকে ঠিক রাখে। অন্তর্বর্তী সরকার মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞায় অযাচিতভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে এত বছর পরে একটা বিভাজনের প্রচেষ্টা করলেও সেখানেও কিন্তু একই কথা পুনর্ব্যক্ত করা হয়েছে যে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে হানাদার বাহিনী এবং তার সহযোগী জামায়াত, রাজাকার, আলবদর, আলশামস প্রভৃতি শক্তির বিরুদ্ধে যারা সশস্ত্র যুদ্ধ করেছেন তারা মুক্তিযোদ্ধা। মুক্তিযোদ্ধারা ‘অপরিবর্তিত’ এই স্বাধীনতাবিরোধী শক্তিকে মুক্তিযুদ্ধের শক্র হিসেবেই দেখে। এই শক্তি কৌশলে ধর্মের লেবাস পরে এবং তাদের দলীয় সমর্থকদের সহযোগিতায় প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে ‘গরুর হাট’ আর শিবিরের মেজবানির কমিউনিটি সেন্টার বানানোর প্রচেষ্টায় লিপ্ত। এর আগে এই ধর্মান্ধ শক্তি টিএসসি-তে গণবিবাহ কেন্দ্র ও কাজী অফিস প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিয়েছিল। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সূতিকাগারকে পরিবর্তিত চেহারা দিয়ে তারা দেশটাকে পরিবর্তিত করতে চায়। আর সেই পন্থায় তারা মুক্তিযুদ্ধে তাদের পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে মরিয়া।

আরও পেছনে তাকালেও আমরা জামায়াতের একই চেহারা দেখতে পাই। জামায়াতে ইসলামীর প্রতিষ্ঠাতা নেতা মওদুদীর তো ১৯৫৩ সালে পাকিস্তানে এক কারবালা সৃষ্টি করেছিলেন। তার নেতৃত্বে কাদিয়ানীদের কাফের ঘোষণা করে জামায়ত পাকিস্তানে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা লাগিয়েছিল। পাঞ্জাব প্রদেশজুড়ে সেই দাঙ্গায় দশ হাজারের ওপর কাদিয়ানী মুসলিমদের হত্যা করা হয়। সেই হত্যাকা-ের মূল নায়ক মওদুদীকে পাকিস্তানের আদালত অভিযুক্ত করে এবং তাকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যার নির্দেশ দেন। কয়েকটি মধ্যপ্রাচ্যের দেশের দূতিয়ালিতে ধুরন্ধর মওদুদী তৎকালীন পাকিস্তানের সামরিক শাসকের কাছে আত্মসমর্পণ করে এবং প্রাণ ভিক্ষা চায়। আর তা মঞ্জুরও হয়।

অন্তর্বর্তী সরকারেরই গেজেট দ্বারা ঘোষিত স্বাধীনতার শত্রুদের সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকার এবং নবগঠিত দল এনসিপির একটি অংশের সঙ্গে এত সখ্য কেন? গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে আমাদের স্বপ্ন দেখানো হলো কি, আর এখন দেখছি কী! স্বাধীনতার শত্রুরা আদালত চত্বরে আর নির্বাচন কমিশন ভবনের সম্মুখে দাঁড়িয়ে তাদের ভাষায় ঘোষণা করছে মিথ্যা (মুক্তিযুদ্ধ) পরাভূত, সত্য (পাক বাহিনীর সহযোগিতা) বিজয়ী। এতদিন একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে তাদের দলের বা মুরব্বিদের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠলে তারা প্রশ্ন এড়িয়ে বলত, ‘আমরা তখন ছোট ছিলাম।’ আর এখন বুক চিতিয়ে বলছে, ‘মিথ্যা পরাভূত’। তাহলে কি জুলাই অভ্যুত্থান ‘যাতে থে জাপান, পহোচ গয়ে চীন’!

ড. মুহাম্মদ ইউনূস দেশ-বিদেশ সবখানেই অতিথিদের এবারের গণ-অভ্যুত্থানে তরুণ-তরুণী, ছাত্রছাত্রীদের আঁকা গ্রাফিতির ছাপা নমুনা উপহার দেন। কিন্তু যে ছাত্রছাত্রীরা দেওয়ালে দেওয়ালে গণতন্ত্র, অসাম্প্রদায়িকতা ও সাম্যের সমাজের স্বপ্ন এঁকেছিল তারা তো ক্যাম্পাসে, ক্লাসরুমে ফিরে গেছে। ড. ইউনূসকে এখন যারা ঘিরে আছেন, তাদের অধিকাংশই ক্ষমতালিপ্সু, মব কালচার ও ঘৃণা-বিদ্বেষ ছড়াতে অভ্যস্ত, প্রতিহিংসাপরায়ন এবং একটা অংশ দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েছে। উপদেষ্টাদের পিএস, এপিসরা অনেকেই শেখ হাসিনার ১৫ বছরের এপিএসকে ১০ মাসেই টেক্কা দিচ্ছে। আরও বিপজ্জনক একটি দিক হলো ছাত্র উপদেষ্টাসহ ড. ইউনূসকে ঘিরে থাকা তরুণদের একটা অংশ এক সময়ে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী সংগঠনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন। সেখান থেকে বেরিয়ে এলেও চিন্তাচেতনায় তাদের কিশোরকাল প্রভাব রাখছে। তাদের বেড়ে ওঠার পরিবেশ দিয়ে তারা পরিচালিত হচ্ছেন।

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টাকে আমরা সেই কবে থেকে একজন উদার, অসাম্প্রদায়িক ও মানবিক দৃষ্টিভঙ্গির মানুষ হিসেবে জেনে এসেছি। তিনি সেই কবে থেকে নারী স্বাধীনতা ও নারী ক্ষমতায়ন নিয়ে কাজ করছেন। শুধু তিনি নন, তার পরিবারের বিশেষ করে ভাইদেরও চিনি। তারাও সবাই অসাম্প্রদায়িক ও প্রগতিশীল মানুষ হিসেবে সমাজে পরিচিত ছিলেন বা আছেন।

আজ কি কারণে তিনি সাম্প্রদায়িক, নারীবিদ্বেষী ও মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তিকে কাছে টেনে নিচ্ছেন? তা হলে কি পতিত স্বৈরাচার তার প্রতি যে অবিচার করেছিল তার প্রতিশোধ নেয়ার জন্য মরিয়া প্রচেষ্টায় জামায়াত বাহিনী তার বিশ্বস্ত মিত্র? আর তাই তাদের সঙ্গে এত সখ্য।

জামায়াতি চিফ প্রসিকিউটর দিয়ে যে বিচার কাজ অগ্রসর করা হচ্ছে তা কি দেশবাসী ও বিশ্ববাসীর কাছে নিরপেক্ষ ও ন্যায়বিচারের স্বীকৃতি পাবে? প্রতিহিংসা ন্যায়বিচারের পথে সবচেয়ে বড় বাধা। জাতি ন্যায়বিচারের অপেক্ষায়। ক্রোধ আর প্রতিহিংসা কিন্তু দৃষ্টিশক্তি হ্রাস করে। দৃষ্টিশক্তি বা চোখের নজর কম হলে আর কাজল দিয়ে কী হবে!

[লেখক : সাবেক ছাত্রনেতা ]

রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের হতাশা ও উপজেলা পর্যায়ের অদক্ষতা : কে নেবে দায়িত্ব?

তরল সম্পর্কের গোলকধাঁধা

পরিবার থেকে রাষ্ট্র : ন্যায়ভিত্তিক সমাজ বিনির্মাণের উপায়

বাজেটে বৈষম্য কমানোর কোনো স্পষ্ট প্রতিফলন আছে কি

রম্যগদ্য : ‘নির্বাচন, না নীর-বচন...’

প্লাস্টিক দূষণ নয়, প্রকৃতির পাশে দাঁড়ান

কোরবানির পর বর্জ্য ব্যবস্থাপনা

ত্যাগের মহিমায় ঈদুল আজহা

নাম ও মর্যাদা : অর্থবহ নামকরণে বৈষম্য রোধের আহ্বান

ডিজিটাল পুঁজিবাদের যুগে নগর বাংলাদেশের শ্রেণী কাঠামো

পারিবারিক শিক্ষা ও রাষ্ট্রসংস্কার : ন্যায়ভিত্তিক সমাজ গঠনের পথরেখা

প্রসঙ্গ : রাজধানীর যানজট

নবায়নযোগ্য জ্বালানি : চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা

ছবি

তাহলে একাত্তরে হয়নিকো কোনো অপরাধ!

ঈদযাত্রা হোক নিরাপদ

আমেরিকার মধ্যপ্রাচ্য কৌশলে বাস্তববাদী বাঁক

রম্যগদ্য : ‘জনগণের ভালোবাসা কি আমার ব্যাংক-ব্যালেন্স বাড়াইবো?’

ভালো থাকার কঠিন কলা : কিছু সরল সত্য

নীরব ঘাতক তামাক

পরিবেশবান্ধব নগর গঠনে রাজনীতিবিদদের ভূমিকা

নিয়ন্ত্রণহীন নেটজগৎ ও ফেইসবুক : সমাজে বিভ্রান্তির ডিজিটাল উৎপত্তি

বস্তিবাসী নারী : অদৃশ্য শক্তির আখ্যান

চট্টগ্রাম বন্দরের টার্মিনাল : বিতর্ক, নিরাপত্তা ও জাতীয় স্বার্থের প্রশ্ন

সংস্কারের ভবিষ্যত কী?

বজ্রপাত, ঘূর্ণিঝড় চায় না তো কেউ, প্রকৃতির নিয়মে আসে কিন্তু তাই!

কেন থমকে আছে কাক্সিক্ষত অগ্রগতি

বদলাচ্ছে সমাজ, বদলাচ্ছে অর্জনের গল্প

বাজেট কি গণমুখী হবে

টেকসই কৃষিতে মৌমাছি পালন

জনগণের বিশ্বাস ভেঙে নির্মিত নিষ্ক্রিয়তার সাম্রাজ্য

সাইবার ঝুঁকির চক্রে বাংলাদেশ

ছবি

কীভাবে পাকিস্তান ভারতের রাফায়েলকে পরাস্ত করল

ছবি

নজরুলের দ্রোহ চেতনার স্বরূপ সন্ধানে

পিতৃতন্ত্রের মনস্তত্ত্ব ও নারীর গ-িবদ্ধতা

চিরতন ও কালীচরণ : শতবর্ষ আগে যারা আইনের মঞ্চে উঠেছিলেন

রম্যগদ্য : প্লিজ স্যার... প্লিজ, ইকটু রেহাই দ্যান...

tab

উপ-সম্পাদকীয়

চোখের নজর কম হলে আর কাজল দিয়ে কী হবে

আনোয়ারুল হক

বুধবার, ১১ জুন ২০২৫

ষাটের দশকে কিশোর কুমার-মধুবালার ‘চলতি কা নাম গাড়ি’ ছবির সুপারহিট গানের একটা লাইন ‘যাতে থে জাপান, পহোচ গয়ে চীন ...। ’ আমার কথা ছবির কাহিনী নিয়ে নয়। জনপ্রিয় গানটির এই লাইন নিয়ে। দেশে চলছে সংস্কার, বিচার আর নির্বাচন নিয়ে আলোচনা, সমালোচনা, পদত্যাগের আগ্রহ, আবার পদত্যাগ নয় জনতাকে নিয়ে মোকাবিলা ইত্যাদি। এর মধ্যে মুক্তিযুদ্ধ আর মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞা নির্ধারনের অর্ডিন্যান্স দেখে তো টাসকি খাওয়ার উপক্রম। দেশে আবার ‘মুজিবনগর সরকার’ কায়েম হ’ল কিনা! সম্বিত ফিরে পেতেই মনে পড়ল প্রধান উপদেষ্টার বাক্যবিলাসী প্রেস সচিবের কথা-‘আমাদের সব কিছু করার ম্যান্ডেট রয়েছে।’ যখন চাহে এমন যা! ছিলাম সংস্কার, বিচার আর নির্বাচন নিয়ে। এখন মনে পড়েছে সংজ্ঞা নির্ধারণই এই মুহূর্তের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ। এত গুরুত্বপূর্ণ যে ‘মধ্যরাতের অশ্বারোহী’ হয়ে গভীর রাতে সরকারকে অর্ডিন্যান্স জারি করতে হ’ল। কি আর করা, ‘যাতে থে জাপান, পহোচ গয়ে চীন’!

গত ৩ মে ২৫ তারিখে জারি করা জামুকা অধ্যাদেশের গেজেটে উল্লেখ করা হয়েছে, “মুক্তিযুদ্ধ’ অর্থ ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ২৬ মার্চ হইতে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত... একটি স্বাধীন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আকাক্সক্ষায় হানাদার ও দখলদার পাকিস্তানি সশস্ত্র বাহিনী এবং তাহাদের সহযোগী রাজাকার, আলবদর, আলশামস, তৎকালীন(!) মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলামী, নেজামে ইসলাম এবং দালাল ও শান্তি কমিটির বিরুদ্ধে যুদ্ধ।” ‘তৎকালীনের’ মারপ্যাঁচ দিয়ে জামায়াত ও তার সহযোগীদের আইনি সুরক্ষা দেওয়ার প্রচেষ্টা হলেও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ছিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের সহযোগী জামায়াতে ইসলামসহ দালাল রাজনৈতিক দল এবং রাজাকার, আলবদর, আলশামস ও তথাকথিত শান্তি কমিটির বিরুদ্ধে যুদ্ধ। জামায়াতের মুক্তিযুদ্ধ বিরোধিতা এবং পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সঙ্গে হত্যাযজ্ঞে শামিল হওয়া ছিল উদার গণতান্ত্রিক রাজনীতির বিপরীতে উগ্রবাদী ধর্মান্ধ রাজনীতির ফলাফল, যে রাজনীতি তারা আগেও ধারণ করত এবং এখনও করে। তাদের নীতি ও বক্তব্য সব সময় সংখ্যালঘু গোষ্ঠীদের প্রতি বৈষম্যমূলক। তাই সেই সময়ে তারা নির্বিচার সংখ্যালঘু নিধনযজ্ঞে শামিল হয়েছিল। ১৯৭১-এ জামায়াত ইসলামের আমির ছিলেন গোলাম আজম এবং তৎকালীন আর বর্তমানকে এক করে স্বাধীন বাংলাদেশে জামায়াতে ইসলামীর আমির তিনিই ছিলেন। ‘তৎকালীন’র দায় নেবো না বললেই বিষয়টা খারিজ হয়ে যায় না। এটা একক দায়ের বিষয় নয়। দলগত দায়। জুলাই গণ-আন্দোলনে ১৪০০ হত্যাকা-ের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে দল হিসাবে আওয়ামী লীগের বিচার প্রক্রিয়া শুরু হবে।

একই সঙ্গে গোটা ’৭১ সালজুড়ে লক্ষ লক্ষ হত্যাকা-ের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে দল হিসাবে জামায়াতের নিবন্ধন ও কার্যক্রম স্থগিত রেখে অপরাধের বিচার প্রক্রিয়াও একই সঙ্গে শুরু করলে সরকারের নিরপেক্ষতা নিশ্চিত হবে। জুলাই অভ্যুত্থান যদি আওয়ামী শাসনামলের বিচ্যুতে থেকে মুক্তিযুদ্ধের ধারা পুনঃপ্রতিষ্ঠা এবং সব অপরাধ, অবিচার ও বৈষম্য অবসানের লড়াই হয়ে থাকে, যা তৎকালীন ছাত্র নেতৃত্ব দাবি করেছিলেন, তবে এ ব্যবস্থাইতো যৌক্তিক ও নিরপেক্ষ প্রশাসনিক ব্যবস্থা।

গোলাম আজম ১৯৭১-এ মুক্তিযুদ্ধের সময় ঘোষণা করেছিলেন, “পবিত্র আদর্শভিত্তিক পাকিস্তানকে রক্ষার জন্য সর্বপ্রকার ত্যাগ স্বীকার করতে হবে। তিনি বলেন, শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে পূর্ব পাকিস্তানের হিন্দুরা স্বাধীনতার আন্দোলন করছে; জামায়াত কর্মীরা রাজাকারে ভর্তি হয়ে দেশের প্রতিরক্ষায় বাধ্য। এখন দেশে দুইটিই দেশপ্রেমিক শক্তিÑএকটি জামায়াত, অন্যটি পাক সেনাবাহিনী। বাকিরা সব গাদ্দার, ইসলামের শত্রু এবং কাফের।” জামায়াত কর্মীরা জানে ইসলাম ও মুসলমানদের জন্য বাংলাদেশ কোনো স্থান হতে পারে না। জামায়াত কর্মীরা শহীদ হতে পারে কিন্তু পরিবর্তিত হতে পারে না। তাই ’৭১-এর অপরাধকে ‘তৎকালীন’ বলে বর্তমানকে পরিবর্তিত বলার সুযোগ নেই। কারণ জামায়াত পরিবর্তিত হতে জানে না। ইসলামী ছাত্র শিবিরের সভাপতি তো বুক চিতিয়ে গর্বভরে বলছেন, তারাই জুলাই আন্দোলনের সময়ে তাদের সংগঠনের লোকজন নিয়ে সেøাগান তুলেছিলেন ‘তুমি কে আমি কে, রাজাকার রাজাকার।’ অর্থাৎ তারা পরিবর্তিত হয়নি।

সাধারণ ছাত্রছাত্রীরা অবশ্য তাদের উদ্দেশ্য বুঝতে পেরে, ‘কে বলেছে কে বলেছে স্বৈরাচার স্বৈরাচার’ লাইনটি যোগ করে আন্দোলনের গতিমুখকে ঠিক রাখে। অন্তর্বর্তী সরকার মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞায় অযাচিতভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে এত বছর পরে একটা বিভাজনের প্রচেষ্টা করলেও সেখানেও কিন্তু একই কথা পুনর্ব্যক্ত করা হয়েছে যে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে হানাদার বাহিনী এবং তার সহযোগী জামায়াত, রাজাকার, আলবদর, আলশামস প্রভৃতি শক্তির বিরুদ্ধে যারা সশস্ত্র যুদ্ধ করেছেন তারা মুক্তিযোদ্ধা। মুক্তিযোদ্ধারা ‘অপরিবর্তিত’ এই স্বাধীনতাবিরোধী শক্তিকে মুক্তিযুদ্ধের শক্র হিসেবেই দেখে। এই শক্তি কৌশলে ধর্মের লেবাস পরে এবং তাদের দলীয় সমর্থকদের সহযোগিতায় প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে ‘গরুর হাট’ আর শিবিরের মেজবানির কমিউনিটি সেন্টার বানানোর প্রচেষ্টায় লিপ্ত। এর আগে এই ধর্মান্ধ শক্তি টিএসসি-তে গণবিবাহ কেন্দ্র ও কাজী অফিস প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিয়েছিল। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সূতিকাগারকে পরিবর্তিত চেহারা দিয়ে তারা দেশটাকে পরিবর্তিত করতে চায়। আর সেই পন্থায় তারা মুক্তিযুদ্ধে তাদের পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে মরিয়া।

আরও পেছনে তাকালেও আমরা জামায়াতের একই চেহারা দেখতে পাই। জামায়াতে ইসলামীর প্রতিষ্ঠাতা নেতা মওদুদীর তো ১৯৫৩ সালে পাকিস্তানে এক কারবালা সৃষ্টি করেছিলেন। তার নেতৃত্বে কাদিয়ানীদের কাফের ঘোষণা করে জামায়ত পাকিস্তানে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা লাগিয়েছিল। পাঞ্জাব প্রদেশজুড়ে সেই দাঙ্গায় দশ হাজারের ওপর কাদিয়ানী মুসলিমদের হত্যা করা হয়। সেই হত্যাকা-ের মূল নায়ক মওদুদীকে পাকিস্তানের আদালত অভিযুক্ত করে এবং তাকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যার নির্দেশ দেন। কয়েকটি মধ্যপ্রাচ্যের দেশের দূতিয়ালিতে ধুরন্ধর মওদুদী তৎকালীন পাকিস্তানের সামরিক শাসকের কাছে আত্মসমর্পণ করে এবং প্রাণ ভিক্ষা চায়। আর তা মঞ্জুরও হয়।

অন্তর্বর্তী সরকারেরই গেজেট দ্বারা ঘোষিত স্বাধীনতার শত্রুদের সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকার এবং নবগঠিত দল এনসিপির একটি অংশের সঙ্গে এত সখ্য কেন? গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে আমাদের স্বপ্ন দেখানো হলো কি, আর এখন দেখছি কী! স্বাধীনতার শত্রুরা আদালত চত্বরে আর নির্বাচন কমিশন ভবনের সম্মুখে দাঁড়িয়ে তাদের ভাষায় ঘোষণা করছে মিথ্যা (মুক্তিযুদ্ধ) পরাভূত, সত্য (পাক বাহিনীর সহযোগিতা) বিজয়ী। এতদিন একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে তাদের দলের বা মুরব্বিদের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠলে তারা প্রশ্ন এড়িয়ে বলত, ‘আমরা তখন ছোট ছিলাম।’ আর এখন বুক চিতিয়ে বলছে, ‘মিথ্যা পরাভূত’। তাহলে কি জুলাই অভ্যুত্থান ‘যাতে থে জাপান, পহোচ গয়ে চীন’!

ড. মুহাম্মদ ইউনূস দেশ-বিদেশ সবখানেই অতিথিদের এবারের গণ-অভ্যুত্থানে তরুণ-তরুণী, ছাত্রছাত্রীদের আঁকা গ্রাফিতির ছাপা নমুনা উপহার দেন। কিন্তু যে ছাত্রছাত্রীরা দেওয়ালে দেওয়ালে গণতন্ত্র, অসাম্প্রদায়িকতা ও সাম্যের সমাজের স্বপ্ন এঁকেছিল তারা তো ক্যাম্পাসে, ক্লাসরুমে ফিরে গেছে। ড. ইউনূসকে এখন যারা ঘিরে আছেন, তাদের অধিকাংশই ক্ষমতালিপ্সু, মব কালচার ও ঘৃণা-বিদ্বেষ ছড়াতে অভ্যস্ত, প্রতিহিংসাপরায়ন এবং একটা অংশ দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েছে। উপদেষ্টাদের পিএস, এপিসরা অনেকেই শেখ হাসিনার ১৫ বছরের এপিএসকে ১০ মাসেই টেক্কা দিচ্ছে। আরও বিপজ্জনক একটি দিক হলো ছাত্র উপদেষ্টাসহ ড. ইউনূসকে ঘিরে থাকা তরুণদের একটা অংশ এক সময়ে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী সংগঠনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন। সেখান থেকে বেরিয়ে এলেও চিন্তাচেতনায় তাদের কিশোরকাল প্রভাব রাখছে। তাদের বেড়ে ওঠার পরিবেশ দিয়ে তারা পরিচালিত হচ্ছেন।

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টাকে আমরা সেই কবে থেকে একজন উদার, অসাম্প্রদায়িক ও মানবিক দৃষ্টিভঙ্গির মানুষ হিসেবে জেনে এসেছি। তিনি সেই কবে থেকে নারী স্বাধীনতা ও নারী ক্ষমতায়ন নিয়ে কাজ করছেন। শুধু তিনি নন, তার পরিবারের বিশেষ করে ভাইদেরও চিনি। তারাও সবাই অসাম্প্রদায়িক ও প্রগতিশীল মানুষ হিসেবে সমাজে পরিচিত ছিলেন বা আছেন।

আজ কি কারণে তিনি সাম্প্রদায়িক, নারীবিদ্বেষী ও মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তিকে কাছে টেনে নিচ্ছেন? তা হলে কি পতিত স্বৈরাচার তার প্রতি যে অবিচার করেছিল তার প্রতিশোধ নেয়ার জন্য মরিয়া প্রচেষ্টায় জামায়াত বাহিনী তার বিশ্বস্ত মিত্র? আর তাই তাদের সঙ্গে এত সখ্য।

জামায়াতি চিফ প্রসিকিউটর দিয়ে যে বিচার কাজ অগ্রসর করা হচ্ছে তা কি দেশবাসী ও বিশ্ববাসীর কাছে নিরপেক্ষ ও ন্যায়বিচারের স্বীকৃতি পাবে? প্রতিহিংসা ন্যায়বিচারের পথে সবচেয়ে বড় বাধা। জাতি ন্যায়বিচারের অপেক্ষায়। ক্রোধ আর প্রতিহিংসা কিন্তু দৃষ্টিশক্তি হ্রাস করে। দৃষ্টিশক্তি বা চোখের নজর কম হলে আর কাজল দিয়ে কী হবে!

[লেখক : সাবেক ছাত্রনেতা ]

back to top