রেজাউল করিম খোকন
২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটকে অনেকেই বলেছেন গতানুগতিক, চমকহীন। কেউ কেউ জিজ্ঞেস করছেন, এই বাজেটে বৈষম্য কমানোর কোনো স্পষ্ট প্রতিফলন আছে কিনা।
অন্তর্বর্তী সরকার হঠাৎ এক বছর বা দেড় বছরের জন্য এসেছে। এই সীমিত সময়েই চেষ্টা করা হয়েছে অর্থনীতিকে স্থিতিশীল করার। মূল চ্যালেঞ্জ ছিল মূল্যস্ফীতি ও মুদ্রাবাজার। অর্থ উপদেষ্টার দাবি, মূল্যস্ফীতি কমতে শুরু করেছে এবং সেপ্টেম্বর নাগাদ তা ৭ শতাংশে নামতে পারে। ডলারের বিনিময় হার ৭-৮ মাস ধরে ১২২-১২৩ টাকার মধ্যে স্থির রয়েছে, যা কিছুটা স্বস্তির ইঙ্গিত দেয়।
তবে বাজেটে গড় মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা ৬.৫ শতাংশ ধরা হলেও, বাস্তবতা অনুযায়ী আরও কম হওয়া উচিত ছিল। খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১৪.৫ শতাংশ থেকে ৮.৫ শতাংশে এবং খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি ১১.৫ শতাংশ থেকে ৯ শতাংশের আশেপাশে নেমে এসেছে। বিশ্ববাজারে জ্বালানি ও খাদ্যপণ্যের দাম কমছে, রপ্তানি সক্ষমতা বাড়ছে এবং মুদ্রানীতি এখনো সংকোচনমুখী। এসবই মূল্যস্ফীতি কমাতে সাহায্য করতে পারে।
অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, এবারের বাজেট অপচয় ও অসংগতি কমানোর প্রয়াসে রচিত। চাঁদাবাজি রোধে পুলিশের সহায়তায় সড়ক খাতে পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের ঘটনায় মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করে জরিমানা আদায় হয়েছে। জনগণকে স্বস্তি দিতে বিদ্যুৎ, এলপিজি ও জ্বালানি তেলের দাম কমানো হয়েছে, যার ফলে পরিবহন ভাড়া হ্রাস পাবে।
অর্থ পাচার রোধ ও পাচার হওয়া অর্থ ফিরিয়ে আনার প্রক্রিয়া চলছে, তবে এটি সময়সাপেক্ষ। এ বিষয়ে গভর্নরের নেতৃত্বে কাজ শুরু হয়েছে, যদিও এতে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়নি। অর্থ ফেরত আসলে বাজেট সহায়তা কম প্রয়োজন হতো, এমনকি আইএমএফের দ্বারস্থও হতে হতো না।
অর্থ উপদেষ্টা স্বীকার করেছেন, বাজেট বড় ধরনের পরিবর্তন আনেনি। তার ভাষায়, ‘চট করে বিপ্লবী বাজেট দেয়া সম্ভব নয়। ’ চলতি অর্থবছরের তুলনায় বাজেটের আকার ছোট, তাই বাস্তবায়ন তুলনামূলক সহজ হবে বলে তিনি মনে করেন। তার দাবি, দেশের অর্থনীতি এক সময় আইসিইউতে ছিল, এখন একটি স্থিতিশীল অবস্থায় আছে।
তবে এই বাজেট উচ্চ মূল্যস্ফীতি, ব্যাংক ও জ্বালানি খাতে দুরবস্থা এবং রাজস্ব আদায়ের দুর্বলতাÑএই তিনটি বড় সমস্যার মধ্যে তৈরি করতে হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, বৈশ্বিক বাজারের অনিশ্চয়তা, ব্যাংক খাতের ঝুঁকিÑসবকিছুর মধ্যেই কাজ চলছে।
তিনি প্রশ্ন রেখেছেন, এতদিন প্রবৃদ্ধির গল্প বলা হলেও তার সুফল কে পেয়েছে? এবারের বাজেট প্রবৃদ্ধির চেয়ে জীবিকার বাস্তবতা, মানুষের জীবনমান ও ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধির ওপর জোর দিয়েছে। তবে সমালোচনাও আছে।
বিশ্লেষকদের মতে, বাজেটে বৈষম্য কমানোর কথা বলা হলেও, বরাদ্দ বা নীতিমালায় তার প্রতিফলন নেই। বরং কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দিয়ে নৈতিকভাবে বিতর্কিত সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে, যা গত জুলাইয়ের গণআন্দোলনের চেতনার পরিপন্থী।
প্রস্তাবিত বাজেটে উচ্চাশার বহিঃপ্রকাশ থাকলেও বাস্তবায়ন কঠিন হবে। রাজস্ব আদায়ের প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে ৮.৯ শতাংশ, যা বড় একটি চ্যালেঞ্জ। রাজনৈতিক সরকারের দায়িত্ব নেয়ার পর তারা চাইলেই কৌশলগতভাবে প্রকল্প বাছাই করতে পারবে। এই বাজেট একটি ভিত্তি তৈরি করেছে, যার ওপর ভবিষ্যতের সংস্কার নির্ভর করছে।
এ বাজেটে সর্বোচ্চ ব্যয় হচ্ছে ঋণ ও সুদ পরিশোধে। জাতীয় সঞ্চয়ের ভিত্তিতে বাজেট প্রণয়নের যে কল্পনা, তা এখনো বাস্তব থেকে দূরে। আগের সরকারের নেয়া ১৩০০ প্রকল্পের মধ্যে মাত্র ২০-৩০টি নতুন। বাজেটের একটি লক্ষ্য হচ্ছে ঋণের দুষ্টচক্র থেকে বেরিয়ে আসা এবং পুরনো অকার্যকর প্রকল্পগুলোর জঞ্জাল পরিষ্কার করা।
কালোটাকা বিষয়ে বিশেষ সুযোগও দেয়া হয়েছে। কেউ নিজের জমিতে অপ্রদর্শিত অর্থে বাড়ি তৈরি করলে দ্বিগুণ কর দিয়ে তা বৈধ করতে পারবে। ফ্ল্যাট কিনলে পাঁচগুণ কর দিতে হবে। যদিও বলা হচ্ছে, এসব সুবিধা আর্থিকভাবে কার্যকর হবে, সমালোচকেরা বলছেন এতে সৎ করদাতার প্রতি অবিচার হচ্ছে।
পূর্বের মতো কোনো নির্দিষ্ট গোষ্ঠীকে সুবিধা দেয়ার রাজস্বনীতি এবার অনুসরণ করা হয়নিÑএটিকে ইতিবাচক পরিবর্তন বলা হচ্ছে।
তবে বড় উদ্বেগের জায়গা হলো কাঠামোগত সংস্কারের অনুপস্থিতি। কর প্রশাসন সংস্কার, ঋণ ব্যবস্থাপনার টেকসই কাঠামো, সরকারি ব্যয়ের দক্ষতা বৃদ্ধি, খেলাপি ঋণ এবং সুদহারজনিত সমস্যার কার্যকর সমাধানÑএসবের বিষয়ে দিকনির্দেশনার ঘাটতি রয়েছে।
বেসরকারি খাত, বিশেষ করে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তা, রপ্তানিকারক ও স্টার্টআপদের জন্য কার্যকর প্রণোদনার অভাব রয়েছে। গবেষণা, কারিগরি প্রশিক্ষণ, ডিজিটাল রূপান্তর এবং সামাজিক সুরক্ষার খাতে উল্লেখযোগ্য বরাদ্দ নেই। করনীতি ও রাজস্ব আদায়ে ডিজিটাল স্বচ্ছতা নিশ্চিত না হলে বাজেটের লক্ষ্য অর্জন কঠিন হবে।
এই বাজেট একদিকে যেমন অন্তর্বর্তী সরকারের সীমিত সময় ও ক্ষমতায় একটি বাস্তবমুখী প্রয়াস, অন্যদিকে কাঠামোগত দুর্বলতা এবং সামাজিক ন্যায়ের অভাবÑএই দুই বিপরীতধর্মী বাস্তবতার প্রতিফলন। বাজেটের ভাষ্য যতটা আশাবাদী, তার কাঠামোগত ভিত্তি ততটা শক্ত নয়। ফলে এটি বৈষম্য হ্রাসের পরিবর্তে বৈষম্যের পুনরুৎপাদনের ঝুঁকিই বহন করছে।
[লেখক : অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার ]
রেজাউল করিম খোকন
বুধবার, ১১ জুন ২০২৫
২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটকে অনেকেই বলেছেন গতানুগতিক, চমকহীন। কেউ কেউ জিজ্ঞেস করছেন, এই বাজেটে বৈষম্য কমানোর কোনো স্পষ্ট প্রতিফলন আছে কিনা।
অন্তর্বর্তী সরকার হঠাৎ এক বছর বা দেড় বছরের জন্য এসেছে। এই সীমিত সময়েই চেষ্টা করা হয়েছে অর্থনীতিকে স্থিতিশীল করার। মূল চ্যালেঞ্জ ছিল মূল্যস্ফীতি ও মুদ্রাবাজার। অর্থ উপদেষ্টার দাবি, মূল্যস্ফীতি কমতে শুরু করেছে এবং সেপ্টেম্বর নাগাদ তা ৭ শতাংশে নামতে পারে। ডলারের বিনিময় হার ৭-৮ মাস ধরে ১২২-১২৩ টাকার মধ্যে স্থির রয়েছে, যা কিছুটা স্বস্তির ইঙ্গিত দেয়।
তবে বাজেটে গড় মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা ৬.৫ শতাংশ ধরা হলেও, বাস্তবতা অনুযায়ী আরও কম হওয়া উচিত ছিল। খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১৪.৫ শতাংশ থেকে ৮.৫ শতাংশে এবং খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি ১১.৫ শতাংশ থেকে ৯ শতাংশের আশেপাশে নেমে এসেছে। বিশ্ববাজারে জ্বালানি ও খাদ্যপণ্যের দাম কমছে, রপ্তানি সক্ষমতা বাড়ছে এবং মুদ্রানীতি এখনো সংকোচনমুখী। এসবই মূল্যস্ফীতি কমাতে সাহায্য করতে পারে।
অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, এবারের বাজেট অপচয় ও অসংগতি কমানোর প্রয়াসে রচিত। চাঁদাবাজি রোধে পুলিশের সহায়তায় সড়ক খাতে পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের ঘটনায় মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করে জরিমানা আদায় হয়েছে। জনগণকে স্বস্তি দিতে বিদ্যুৎ, এলপিজি ও জ্বালানি তেলের দাম কমানো হয়েছে, যার ফলে পরিবহন ভাড়া হ্রাস পাবে।
অর্থ পাচার রোধ ও পাচার হওয়া অর্থ ফিরিয়ে আনার প্রক্রিয়া চলছে, তবে এটি সময়সাপেক্ষ। এ বিষয়ে গভর্নরের নেতৃত্বে কাজ শুরু হয়েছে, যদিও এতে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়নি। অর্থ ফেরত আসলে বাজেট সহায়তা কম প্রয়োজন হতো, এমনকি আইএমএফের দ্বারস্থও হতে হতো না।
অর্থ উপদেষ্টা স্বীকার করেছেন, বাজেট বড় ধরনের পরিবর্তন আনেনি। তার ভাষায়, ‘চট করে বিপ্লবী বাজেট দেয়া সম্ভব নয়। ’ চলতি অর্থবছরের তুলনায় বাজেটের আকার ছোট, তাই বাস্তবায়ন তুলনামূলক সহজ হবে বলে তিনি মনে করেন। তার দাবি, দেশের অর্থনীতি এক সময় আইসিইউতে ছিল, এখন একটি স্থিতিশীল অবস্থায় আছে।
তবে এই বাজেট উচ্চ মূল্যস্ফীতি, ব্যাংক ও জ্বালানি খাতে দুরবস্থা এবং রাজস্ব আদায়ের দুর্বলতাÑএই তিনটি বড় সমস্যার মধ্যে তৈরি করতে হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, বৈশ্বিক বাজারের অনিশ্চয়তা, ব্যাংক খাতের ঝুঁকিÑসবকিছুর মধ্যেই কাজ চলছে।
তিনি প্রশ্ন রেখেছেন, এতদিন প্রবৃদ্ধির গল্প বলা হলেও তার সুফল কে পেয়েছে? এবারের বাজেট প্রবৃদ্ধির চেয়ে জীবিকার বাস্তবতা, মানুষের জীবনমান ও ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধির ওপর জোর দিয়েছে। তবে সমালোচনাও আছে।
বিশ্লেষকদের মতে, বাজেটে বৈষম্য কমানোর কথা বলা হলেও, বরাদ্দ বা নীতিমালায় তার প্রতিফলন নেই। বরং কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দিয়ে নৈতিকভাবে বিতর্কিত সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে, যা গত জুলাইয়ের গণআন্দোলনের চেতনার পরিপন্থী।
প্রস্তাবিত বাজেটে উচ্চাশার বহিঃপ্রকাশ থাকলেও বাস্তবায়ন কঠিন হবে। রাজস্ব আদায়ের প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে ৮.৯ শতাংশ, যা বড় একটি চ্যালেঞ্জ। রাজনৈতিক সরকারের দায়িত্ব নেয়ার পর তারা চাইলেই কৌশলগতভাবে প্রকল্প বাছাই করতে পারবে। এই বাজেট একটি ভিত্তি তৈরি করেছে, যার ওপর ভবিষ্যতের সংস্কার নির্ভর করছে।
এ বাজেটে সর্বোচ্চ ব্যয় হচ্ছে ঋণ ও সুদ পরিশোধে। জাতীয় সঞ্চয়ের ভিত্তিতে বাজেট প্রণয়নের যে কল্পনা, তা এখনো বাস্তব থেকে দূরে। আগের সরকারের নেয়া ১৩০০ প্রকল্পের মধ্যে মাত্র ২০-৩০টি নতুন। বাজেটের একটি লক্ষ্য হচ্ছে ঋণের দুষ্টচক্র থেকে বেরিয়ে আসা এবং পুরনো অকার্যকর প্রকল্পগুলোর জঞ্জাল পরিষ্কার করা।
কালোটাকা বিষয়ে বিশেষ সুযোগও দেয়া হয়েছে। কেউ নিজের জমিতে অপ্রদর্শিত অর্থে বাড়ি তৈরি করলে দ্বিগুণ কর দিয়ে তা বৈধ করতে পারবে। ফ্ল্যাট কিনলে পাঁচগুণ কর দিতে হবে। যদিও বলা হচ্ছে, এসব সুবিধা আর্থিকভাবে কার্যকর হবে, সমালোচকেরা বলছেন এতে সৎ করদাতার প্রতি অবিচার হচ্ছে।
পূর্বের মতো কোনো নির্দিষ্ট গোষ্ঠীকে সুবিধা দেয়ার রাজস্বনীতি এবার অনুসরণ করা হয়নিÑএটিকে ইতিবাচক পরিবর্তন বলা হচ্ছে।
তবে বড় উদ্বেগের জায়গা হলো কাঠামোগত সংস্কারের অনুপস্থিতি। কর প্রশাসন সংস্কার, ঋণ ব্যবস্থাপনার টেকসই কাঠামো, সরকারি ব্যয়ের দক্ষতা বৃদ্ধি, খেলাপি ঋণ এবং সুদহারজনিত সমস্যার কার্যকর সমাধানÑএসবের বিষয়ে দিকনির্দেশনার ঘাটতি রয়েছে।
বেসরকারি খাত, বিশেষ করে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তা, রপ্তানিকারক ও স্টার্টআপদের জন্য কার্যকর প্রণোদনার অভাব রয়েছে। গবেষণা, কারিগরি প্রশিক্ষণ, ডিজিটাল রূপান্তর এবং সামাজিক সুরক্ষার খাতে উল্লেখযোগ্য বরাদ্দ নেই। করনীতি ও রাজস্ব আদায়ে ডিজিটাল স্বচ্ছতা নিশ্চিত না হলে বাজেটের লক্ষ্য অর্জন কঠিন হবে।
এই বাজেট একদিকে যেমন অন্তর্বর্তী সরকারের সীমিত সময় ও ক্ষমতায় একটি বাস্তবমুখী প্রয়াস, অন্যদিকে কাঠামোগত দুর্বলতা এবং সামাজিক ন্যায়ের অভাবÑএই দুই বিপরীতধর্মী বাস্তবতার প্রতিফলন। বাজেটের ভাষ্য যতটা আশাবাদী, তার কাঠামোগত ভিত্তি ততটা শক্ত নয়। ফলে এটি বৈষম্য হ্রাসের পরিবর্তে বৈষম্যের পুনরুৎপাদনের ঝুঁকিই বহন করছে।
[লেখক : অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার ]