মতিউর রহমান
সময় বদলানোর সাথে সাথে মানুষের সম্পর্কগুলোও অস্থির, ক্ষণস্থায়ী ও অগভীর হয়ে পড়েছে। ডিজিটাল ডেটিংয়ের আবির্ভাব এবং এর ব্যাপক গ্রহণ প্রেম, ঘনিষ্ঠতা ও সংযুক্তির ধারণাকে আজ আমূল বদলে দিয়েছে। এই পরিবর্তন বিশ্লেষণে আমরা ফিরে যেতে পারি বিখ্যাত সমাজতাত্ত্বিক জিগমুন্ট বাউমানের ‘লিকুইড মডার্নিটি’ বা ‘তরল আধুনিকতা’ তত্ত্বে। বাউমান মনে করতেন, আধুনিক জীবনে মানুষ এক অনিশ্চিত, স্বল্পস্থায়ী ও ভঙ্গুর বাস্তবতার মধ্যে বসবাস করছে, যেখানে সম্পর্কও তরল হয়ে উঠেছেÑসহজে গড়ে ওঠে, আবার সহজেই ভেঙে যায়। বর্তমান সময়ে সারা বিশে^, বিশেষ করে বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার সামাজিক প্রেক্ষাপটে, তরুণ সমাজের মধ্যে ডিজিটাল প্রেম ও হুকআপ সংস্কৃতির বিস্তারে বাউমানের ‘তরল প্রেম’ ধারণাটি আরও বেশি বাস্তব হয়ে উঠেছে। আজকের দিনে টিন্ডার, বাম্বল, ও দক্ষিণ এশিয়ার স্থানীয় কিছু অ্যাপ ব্যবহার করে মানুষ খুব সহজেই একে অপরের সাথে পরিচিত হচ্ছে, কথাবার্তা বলছে এবং সম্পর্ক গড়ে তুলছে। কিন্তু এই সম্পর্কগুলো যেমন দ্রুত তৈরি হয় এবং ততটাই দ্রুত ভেঙেও যায়। এই অ্যাপগুলো সম্পর্ককে যেন পণ্যে রূপান্তর করেছেÑযেখানে মানুষকে একের পর এক প্রোফাইলে দেখে পছন্দ বা অপছন্দ করা যায়। এটি একটি উপভোগ্য সংস্কৃতির অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে, যেখানে বন্ধনের চেয়ে মুহূর্তিক আনন্দ বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
বাউমানের ভাষায়, এই ধরনের সম্পর্ক সংযুক্তি ছাড়া সংযোগ, অর্থাৎ মানুষদের মাঝে সংযোগ থাকলেও সেই সংযোগে গভীরতা বা দায়িত্ববোধের স্থান নেই। বাউমান বিশ্বাস করতেন, আধুনিক মানুষ তার স্বাধীনতা রক্ষা করতে গিয়ে দীর্ঘমেয়াদি সম্পর্কের দায় এড়িয়ে চলে। ডিজিটাল ডেটিং এই মানসিকতাকে আরও দৃঢ় করে তোলে। একজন ব্যবহারকারী চাইলে মুহূর্তেই নতুন কাউকে খুঁজে পেতে পারে, আবার ইচ্ছা করলে হঠাৎ করেইÑকোনো ব্যাখ্যা না দিয়েই সম্পর্ক থেকে সরে যায়। আগে সম্পর্ক ভাঙলে তা মানসিক চাপ, সামাজিক ব্যাখ্যা, ও পারিবারিক বোঝাপড়ার মধ্য দিয়ে যেত। এখন এটি এক ক্লিকেই মুছে ফেলা যায়। এই সুবিধা যেখানে ব্যক্তি-স্বাধীনতার এক নতুন দিগন্ত খুলে দেয়, সেখানে এটি এক গভীর নিঃসঙ্গতা ও অবসাদের জন্মও দেয়।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এই প্রবণতা এক অনন্য দোলাচলের জন্ম দিয়েছে। এই সমাজে এখনো পরিবার, ধর্মীয় মূল্যবোধ ও সামাজিক রীতিনীতি প্রেম এবং বিয়েকে নিয়ন্ত্রণ করে; কিন্তু শহুরে তরুণ প্রজন্ম, বিশেষ করে ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট কিংবা অন্যান্য জেলা শহরের শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণি, এই সামাজিক নিয়মের বাইরে বেরিয়ে ডিজিটাল মাধ্যমে প্রেম এবং সম্পর্কের পথে হাঁটছে। এই প্রযুক্তিনির্ভর প্রেম যেন একধরনের নিঃশব্দ বিদ্রোহÑপরিবার ও সমাজের নজর এড়িয়ে নিজস্ব জীবন বেছে নেওয়ার চেষ্টা; কিন্তু এই সম্পর্কগুলো দীর্ঘস্থায়ী না হওয়ায় জন্ম নিচ্ছে ভয়, অনিশ্চয়তা ও আত্মবিশ্বাসের সংকট।
এই তরল সম্পর্কের এক বিরূপ দিক হলোÑলিঙ্গভিত্তিক বৈষম্য। বাংলাদেশের সমাজ এখনো পিতৃতান্ত্রিক কাঠামোর মধ্যেই আবদ্ধ। যেখানে পুরুষেরা একাধিক সংক্ষিপ্ত সম্পর্ক বা হুকআপে জড়ালে তা প্রায়ই প্রশংসনীয় বলে বিবেচিত হয়, সেখানে নারীদের ক্ষেত্রে একই আচরণ সামাজিক অসম্মান ও অপমানের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ফলে, নারীরা ডিজিটাল ডেটিং অ্যাপে থাকলেও, তারা একধরনের মানসিক চাপ, ভয় ও গোপনীয়তার মধ্যে থেকেই সম্পর্ক তৈরি করে। এই বৈষম্য তরল ভালোবাসার ধারণাটিকে আরও বিষাক্ত করে তোলেÑকারণ এই প্রেম যেন শুধু ক্ষণিকের আনন্দে পুরুষতান্ত্রিক ফায়দা তোলার সুযোগ হয়ে দাঁড়ায়।
বিশ্বব্যাপী রিলেশনশিপ ফ্যাটিগ বা সম্পর্ক ক্লান্তি নামক একটি মানসিক অবস্থা খুব সাধারণ হয়ে উঠেছে। একের পর এক সংযোগ, বার্তা, দেখা, বিচ্ছেদÑএই চক্রের মধ্যে মানুষ হারিয়ে ফেলছে আন্তরিকতা ও সম্পর্কের গভীরতা। মানুষ বলছেÑতারা অনেকের সাথে কথা বলে, কিন্তু কাউকেই আসলভাবে চিনতে পারে না বা কাউকে নিয়ে ভবিষ্যৎ ভাবতে পারে না। বাউমান বলতেন, তরল আধুনিকতায় ভালোবাসা হয় ক্ষণস্থায়ী, অগভীর, এবং এক ধরনের নিষ্পত্তি এড়ানো সংযোগ। আমরা যত বেশি সংযুক্ত হচ্ছি, ততটাই যেন একাকী হয়ে পড়ছি।
বাংলাদেশের তরুণদের মধ্যেও এই ক্লান্তির চিহ্ন স্পষ্ট। সম্পর্ক তৈরি হওয়ার সাথে সাথেই শুরু হয় অনাস্থা, অনিশ্চয়তা ও সন্দেহ। সামাজিক রীতি-নীতির কারণে সম্পর্ক গোপন রাখতে গিয়ে মানসিক চাপ আরও বেড়ে যায়। অথচ এই তরুণরাই এক সময় বিয়ে কিংবা স্থায়ী সম্পর্কের জন্য পারিবারিক চাপে পড়ে সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়, যা অনেক সময়ে আত্মবিরোধী ও অস্থায়ী সম্পর্কের জন্ম দেয়। তবে ডিজিটাল ডেটিং শুধু ভয় বা বিভ্রান্তির জন্ম দেয় না; এটি কিছু ক্ষেত্রে মুক্তির দিকও উন্মুক্ত করে। বিশেষ করে বাংলাদেশের বিশেষ কোনো সম্প্রদায়ের মানুষদের জন্য এই অ্যাপগুলো একধরনের নিরাপদ প্ল্যাটফর্ম হয়ে উঠেছে। যেখানে তারা সামাজিক চোখরাঙানি বা হুমকি ছাড়াই নিজেদের মতো করে সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারে। এই অর্থে, তরল ভালোবাসা কখনো কখনো এক আশ্রয়স্থলও হতে পারে, যদিও এই সম্পর্কগুলিও একইরকম ক্ষণস্থায়ী ও অনিশ্চিত।
জিগমুন্ট বাউমান তার গবেষণায় বারবার বলেছেনÑআধুনিক পুঁজিবাদী সমাজ সম্পর্ককেও এক ধরনের পণ্যে পরিণত করেছে। টিন্ডার বা বাম্বলের মতো অ্যাপগুলো ব্যবহারের পেছনে কাজ করে একপ্রকার#৩৯;ফিয়ার অফ বেটার অপশন#৩৯;Ñমানে, কেউ ভালোবাসা পেয়েও নিশ্চিত হতে পারে না যে, এর চেয়ে ভালো কিছু আর নেই। সবসময় মনে হয়, পরবর্তী প্রোফাইলটিই হতে পারে পারফেক্ট ম্যাচ। এই মানসিকতা প্রেমকে একধরনের প্রতিযোগিতামূলক পণ্যে পরিণত করেছে। বাংলাদেশে যেখানে বয়স, বেতন, গায়ের রঙ, পারিবারিক অবস্থান এখনো সম্পর্ক নির্ধারণে বড় ভূমিকা রাখে, সেখানে এই অ্যাপগুলো সেই সামাজিক পছন্দের কাঠামোকে আরও দৃঢ় করে তুলছে।
তরুণ সমাজ এখন প্রেমের নতুন সংজ্ঞা খুঁজছে। তারা প্রযুক্তির সুবিধা নিচ্ছে, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে বিষণœতা ও অনাস্থার মধ্যেও ডুবে যাচ্ছে। কেউ কেউ আবার ফিরে যেতে চাইছে সেই চিঠির প্রেম, অপেক্ষার রোমান্স ও আত্মিক সংযোগের দিনগুলোতে। এই ডিজিটাল নস্টালজিয়া প্রমাণ করে, সম্পর্কের তরলতায় মানুষ আর স্থায়িত্বহীনতায় তৃপ্ত নয়। বাংলাদেশে, যেখানে সম্পর্ক একসময় পারিবারিক ও সামাজিক কাঠামোর ওপর নির্ভরশীল ছিল, এখন তার জায়গায় এসেছে একাকীত্ব, ক্লান্তি ও নিঃসঙ্গতা।
বাউমান হয়তো এই হাইপার-ডিজিটাল যুগটি দেখে যেতে পারেননি, কিন্তু তার বিশ্লেষণ আজকের প্রেক্ষাপটে আরও প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। আমরা এমন এক পৃথিবীতে বাস করছি, যেখানে সবকিছুই পরিবর্তনশীলÑচাকরি, পরিচয়, স্বপ্ন, বন্ধন। সেই পরিবর্তনের মাঝে প্রেমও এখন তরল, অনিশ্চিত, এবং ক্ষণস্থায়ী। বাংলাদেশের মতো সমাজে এই তরলতা শুধুই প্রযুক্তিগত পরিবর্তন নয়, এটি এক সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও মানসিক বিবর্তনের প্রতিফলন।
এই তরল জগতে প্রেমের যে সংকট তৈরি হয়েছে, তার সমাধান শুধুমাত্র প্রযুক্তিকে দোষারোপ করে সম্ভব নয়। আমাদের দরকার এক নতুন ধরনের ঘনিষ্ঠতার ধারণাÑযেখানে স্বাধীনতা থাকবে, আবার সঙ্গে থাকবে আন্তরিকতা ও মানবিকতা। হয়তো প্রেম আবারও কঠিন হবে, ধৈর্যের হবে, কিন্তু সেই প্রেম হবে সত্যিকারের, নিখাদ এবং মানবিক। তরল আধুনিকতার এই অনিশ্চিত জগতে ভালোবাসার জন্য আমাদের সেই দৃঢ় জমিটুকু আবার খুঁজে বের করতে হবে। সেই জমি হয়তো কোনো অ্যাপে নয়, বরং আমাদের মনোজগতে, আত্মিক বন্ধনে এবং একে অপরকে বুঝে নেওয়ার চেষ্টায় লুকিয়ে আছে।
[লেখক : গবেষক ও উন্নয়নকর্মী]
মতিউর রহমান
বৃহস্পতিবার, ১২ জুন ২০২৫
সময় বদলানোর সাথে সাথে মানুষের সম্পর্কগুলোও অস্থির, ক্ষণস্থায়ী ও অগভীর হয়ে পড়েছে। ডিজিটাল ডেটিংয়ের আবির্ভাব এবং এর ব্যাপক গ্রহণ প্রেম, ঘনিষ্ঠতা ও সংযুক্তির ধারণাকে আজ আমূল বদলে দিয়েছে। এই পরিবর্তন বিশ্লেষণে আমরা ফিরে যেতে পারি বিখ্যাত সমাজতাত্ত্বিক জিগমুন্ট বাউমানের ‘লিকুইড মডার্নিটি’ বা ‘তরল আধুনিকতা’ তত্ত্বে। বাউমান মনে করতেন, আধুনিক জীবনে মানুষ এক অনিশ্চিত, স্বল্পস্থায়ী ও ভঙ্গুর বাস্তবতার মধ্যে বসবাস করছে, যেখানে সম্পর্কও তরল হয়ে উঠেছেÑসহজে গড়ে ওঠে, আবার সহজেই ভেঙে যায়। বর্তমান সময়ে সারা বিশে^, বিশেষ করে বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার সামাজিক প্রেক্ষাপটে, তরুণ সমাজের মধ্যে ডিজিটাল প্রেম ও হুকআপ সংস্কৃতির বিস্তারে বাউমানের ‘তরল প্রেম’ ধারণাটি আরও বেশি বাস্তব হয়ে উঠেছে। আজকের দিনে টিন্ডার, বাম্বল, ও দক্ষিণ এশিয়ার স্থানীয় কিছু অ্যাপ ব্যবহার করে মানুষ খুব সহজেই একে অপরের সাথে পরিচিত হচ্ছে, কথাবার্তা বলছে এবং সম্পর্ক গড়ে তুলছে। কিন্তু এই সম্পর্কগুলো যেমন দ্রুত তৈরি হয় এবং ততটাই দ্রুত ভেঙেও যায়। এই অ্যাপগুলো সম্পর্ককে যেন পণ্যে রূপান্তর করেছেÑযেখানে মানুষকে একের পর এক প্রোফাইলে দেখে পছন্দ বা অপছন্দ করা যায়। এটি একটি উপভোগ্য সংস্কৃতির অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে, যেখানে বন্ধনের চেয়ে মুহূর্তিক আনন্দ বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
বাউমানের ভাষায়, এই ধরনের সম্পর্ক সংযুক্তি ছাড়া সংযোগ, অর্থাৎ মানুষদের মাঝে সংযোগ থাকলেও সেই সংযোগে গভীরতা বা দায়িত্ববোধের স্থান নেই। বাউমান বিশ্বাস করতেন, আধুনিক মানুষ তার স্বাধীনতা রক্ষা করতে গিয়ে দীর্ঘমেয়াদি সম্পর্কের দায় এড়িয়ে চলে। ডিজিটাল ডেটিং এই মানসিকতাকে আরও দৃঢ় করে তোলে। একজন ব্যবহারকারী চাইলে মুহূর্তেই নতুন কাউকে খুঁজে পেতে পারে, আবার ইচ্ছা করলে হঠাৎ করেইÑকোনো ব্যাখ্যা না দিয়েই সম্পর্ক থেকে সরে যায়। আগে সম্পর্ক ভাঙলে তা মানসিক চাপ, সামাজিক ব্যাখ্যা, ও পারিবারিক বোঝাপড়ার মধ্য দিয়ে যেত। এখন এটি এক ক্লিকেই মুছে ফেলা যায়। এই সুবিধা যেখানে ব্যক্তি-স্বাধীনতার এক নতুন দিগন্ত খুলে দেয়, সেখানে এটি এক গভীর নিঃসঙ্গতা ও অবসাদের জন্মও দেয়।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এই প্রবণতা এক অনন্য দোলাচলের জন্ম দিয়েছে। এই সমাজে এখনো পরিবার, ধর্মীয় মূল্যবোধ ও সামাজিক রীতিনীতি প্রেম এবং বিয়েকে নিয়ন্ত্রণ করে; কিন্তু শহুরে তরুণ প্রজন্ম, বিশেষ করে ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট কিংবা অন্যান্য জেলা শহরের শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণি, এই সামাজিক নিয়মের বাইরে বেরিয়ে ডিজিটাল মাধ্যমে প্রেম এবং সম্পর্কের পথে হাঁটছে। এই প্রযুক্তিনির্ভর প্রেম যেন একধরনের নিঃশব্দ বিদ্রোহÑপরিবার ও সমাজের নজর এড়িয়ে নিজস্ব জীবন বেছে নেওয়ার চেষ্টা; কিন্তু এই সম্পর্কগুলো দীর্ঘস্থায়ী না হওয়ায় জন্ম নিচ্ছে ভয়, অনিশ্চয়তা ও আত্মবিশ্বাসের সংকট।
এই তরল সম্পর্কের এক বিরূপ দিক হলোÑলিঙ্গভিত্তিক বৈষম্য। বাংলাদেশের সমাজ এখনো পিতৃতান্ত্রিক কাঠামোর মধ্যেই আবদ্ধ। যেখানে পুরুষেরা একাধিক সংক্ষিপ্ত সম্পর্ক বা হুকআপে জড়ালে তা প্রায়ই প্রশংসনীয় বলে বিবেচিত হয়, সেখানে নারীদের ক্ষেত্রে একই আচরণ সামাজিক অসম্মান ও অপমানের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ফলে, নারীরা ডিজিটাল ডেটিং অ্যাপে থাকলেও, তারা একধরনের মানসিক চাপ, ভয় ও গোপনীয়তার মধ্যে থেকেই সম্পর্ক তৈরি করে। এই বৈষম্য তরল ভালোবাসার ধারণাটিকে আরও বিষাক্ত করে তোলেÑকারণ এই প্রেম যেন শুধু ক্ষণিকের আনন্দে পুরুষতান্ত্রিক ফায়দা তোলার সুযোগ হয়ে দাঁড়ায়।
বিশ্বব্যাপী রিলেশনশিপ ফ্যাটিগ বা সম্পর্ক ক্লান্তি নামক একটি মানসিক অবস্থা খুব সাধারণ হয়ে উঠেছে। একের পর এক সংযোগ, বার্তা, দেখা, বিচ্ছেদÑএই চক্রের মধ্যে মানুষ হারিয়ে ফেলছে আন্তরিকতা ও সম্পর্কের গভীরতা। মানুষ বলছেÑতারা অনেকের সাথে কথা বলে, কিন্তু কাউকেই আসলভাবে চিনতে পারে না বা কাউকে নিয়ে ভবিষ্যৎ ভাবতে পারে না। বাউমান বলতেন, তরল আধুনিকতায় ভালোবাসা হয় ক্ষণস্থায়ী, অগভীর, এবং এক ধরনের নিষ্পত্তি এড়ানো সংযোগ। আমরা যত বেশি সংযুক্ত হচ্ছি, ততটাই যেন একাকী হয়ে পড়ছি।
বাংলাদেশের তরুণদের মধ্যেও এই ক্লান্তির চিহ্ন স্পষ্ট। সম্পর্ক তৈরি হওয়ার সাথে সাথেই শুরু হয় অনাস্থা, অনিশ্চয়তা ও সন্দেহ। সামাজিক রীতি-নীতির কারণে সম্পর্ক গোপন রাখতে গিয়ে মানসিক চাপ আরও বেড়ে যায়। অথচ এই তরুণরাই এক সময় বিয়ে কিংবা স্থায়ী সম্পর্কের জন্য পারিবারিক চাপে পড়ে সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়, যা অনেক সময়ে আত্মবিরোধী ও অস্থায়ী সম্পর্কের জন্ম দেয়। তবে ডিজিটাল ডেটিং শুধু ভয় বা বিভ্রান্তির জন্ম দেয় না; এটি কিছু ক্ষেত্রে মুক্তির দিকও উন্মুক্ত করে। বিশেষ করে বাংলাদেশের বিশেষ কোনো সম্প্রদায়ের মানুষদের জন্য এই অ্যাপগুলো একধরনের নিরাপদ প্ল্যাটফর্ম হয়ে উঠেছে। যেখানে তারা সামাজিক চোখরাঙানি বা হুমকি ছাড়াই নিজেদের মতো করে সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারে। এই অর্থে, তরল ভালোবাসা কখনো কখনো এক আশ্রয়স্থলও হতে পারে, যদিও এই সম্পর্কগুলিও একইরকম ক্ষণস্থায়ী ও অনিশ্চিত।
জিগমুন্ট বাউমান তার গবেষণায় বারবার বলেছেনÑআধুনিক পুঁজিবাদী সমাজ সম্পর্ককেও এক ধরনের পণ্যে পরিণত করেছে। টিন্ডার বা বাম্বলের মতো অ্যাপগুলো ব্যবহারের পেছনে কাজ করে একপ্রকার#৩৯;ফিয়ার অফ বেটার অপশন#৩৯;Ñমানে, কেউ ভালোবাসা পেয়েও নিশ্চিত হতে পারে না যে, এর চেয়ে ভালো কিছু আর নেই। সবসময় মনে হয়, পরবর্তী প্রোফাইলটিই হতে পারে পারফেক্ট ম্যাচ। এই মানসিকতা প্রেমকে একধরনের প্রতিযোগিতামূলক পণ্যে পরিণত করেছে। বাংলাদেশে যেখানে বয়স, বেতন, গায়ের রঙ, পারিবারিক অবস্থান এখনো সম্পর্ক নির্ধারণে বড় ভূমিকা রাখে, সেখানে এই অ্যাপগুলো সেই সামাজিক পছন্দের কাঠামোকে আরও দৃঢ় করে তুলছে।
তরুণ সমাজ এখন প্রেমের নতুন সংজ্ঞা খুঁজছে। তারা প্রযুক্তির সুবিধা নিচ্ছে, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে বিষণœতা ও অনাস্থার মধ্যেও ডুবে যাচ্ছে। কেউ কেউ আবার ফিরে যেতে চাইছে সেই চিঠির প্রেম, অপেক্ষার রোমান্স ও আত্মিক সংযোগের দিনগুলোতে। এই ডিজিটাল নস্টালজিয়া প্রমাণ করে, সম্পর্কের তরলতায় মানুষ আর স্থায়িত্বহীনতায় তৃপ্ত নয়। বাংলাদেশে, যেখানে সম্পর্ক একসময় পারিবারিক ও সামাজিক কাঠামোর ওপর নির্ভরশীল ছিল, এখন তার জায়গায় এসেছে একাকীত্ব, ক্লান্তি ও নিঃসঙ্গতা।
বাউমান হয়তো এই হাইপার-ডিজিটাল যুগটি দেখে যেতে পারেননি, কিন্তু তার বিশ্লেষণ আজকের প্রেক্ষাপটে আরও প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। আমরা এমন এক পৃথিবীতে বাস করছি, যেখানে সবকিছুই পরিবর্তনশীলÑচাকরি, পরিচয়, স্বপ্ন, বন্ধন। সেই পরিবর্তনের মাঝে প্রেমও এখন তরল, অনিশ্চিত, এবং ক্ষণস্থায়ী। বাংলাদেশের মতো সমাজে এই তরলতা শুধুই প্রযুক্তিগত পরিবর্তন নয়, এটি এক সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও মানসিক বিবর্তনের প্রতিফলন।
এই তরল জগতে প্রেমের যে সংকট তৈরি হয়েছে, তার সমাধান শুধুমাত্র প্রযুক্তিকে দোষারোপ করে সম্ভব নয়। আমাদের দরকার এক নতুন ধরনের ঘনিষ্ঠতার ধারণাÑযেখানে স্বাধীনতা থাকবে, আবার সঙ্গে থাকবে আন্তরিকতা ও মানবিকতা। হয়তো প্রেম আবারও কঠিন হবে, ধৈর্যের হবে, কিন্তু সেই প্রেম হবে সত্যিকারের, নিখাদ এবং মানবিক। তরল আধুনিকতার এই অনিশ্চিত জগতে ভালোবাসার জন্য আমাদের সেই দৃঢ় জমিটুকু আবার খুঁজে বের করতে হবে। সেই জমি হয়তো কোনো অ্যাপে নয়, বরং আমাদের মনোজগতে, আত্মিক বন্ধনে এবং একে অপরকে বুঝে নেওয়ার চেষ্টায় লুকিয়ে আছে।
[লেখক : গবেষক ও উন্নয়নকর্মী]