শেখর ভট্টাচার্য
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অন্তর থেকে উদ্গীরিত গণ-মানুষের মতামতকে পৃথিবীময় ছড়িয়ে দেয়ার এক অপার সুযোগ সৃষ্টি করেছে
একটি সমাজের অন্তরলোকের ভাবনার গভীরে যেতে হলে সে সমাজের সামজিক মাধ্যমকে অবশ্যই বিশ্লেষণ করতে হবে। গত বিশ বছর আগেও বিষয়টি এরকম ছিল না, কারণ তথ্য-প্রযুক্তির এরকম অভাবনীয় উন্নয়ন বিশ বছর আগেও বর্তমান সময়ের মতো ছিল না। যে কোন দেশের সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ছবিকে চোখের সামনে নিয়ে আসতে চাইলে অসম্পাদিত সমাজমাধ্যমই ভরসা। সামাজিক মাধ্যমকে সচেতন বুদ্ধিজীবী, বিজ্ঞ যোগাযোগ বিজ্ঞানের প-িতরা অনেক সময় খুব গুরুত্ব দিতে সম্মত হন না। সম্পাদনাহীন গণমানুষের স্বতঃস্ফূর্ত ভাবাবেগকে অনেকেই তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিতে চান। কিন্তু সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম সব মতামত এবং ভৌগোলিক সীমান্তের জটিলতাকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে বিশ্ব গ্রামের ধারণাকে যেভাবে সংহত করে তুলছে, এই কারণে সামাজিকমাধ্যমকে অবজ্ঞা, অবহেলা করে এড়িয়ে যাওয়ার কোন উপায় নেই। বিভিন্ন দেশের রাজনৈতিক সামাজিক সংস্কৃতিকে এখন ইতি এবং নেতিবাচকভাবে সামজিক মাধ্যম নিয়ন্ত্রণ করছে ক্রমশ। বেলাগাম মতামত উপস্থাপনা, নিয়ন্ত্রণহীন পাল্টা মত দিয়ে যুক্তি খ-নের মাধ্যমে এক অদ্ভুত, কৃত্রিম সমাজ গড়ে উঠছে যে সমাজকে আপনি ইচ্ছে করলেও অবজ্ঞা করার উপায় নেই। আপনি পছন্দ না করলেও মানুষের কণ্ঠকে বাতিল করতে পারবেন না। এক অর্থে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম সবার কণ্ঠধ্বনি তুলে ধরে গণতন্ত্রের মৌল বাণীকে কিছুটা হলেও তুলে ধরার চেষ্টা করছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অন্তর থেকে উদ্গীরিত গণ-মানুষের মতামতকে পৃথিবীময় ছড়িয়ে দেয়ার এক অপার সুযোগ সৃষ্টি করেছে।
প্রথম সোশ্যাল মিডিয়া বা সামজিক মাধ্যম কোনটি? এ প্রশ্নের উত্তর দিতে হলে দুটি সাইটের নাম বলতে হয়; প্রথমটি জিওসিটি ও অন্যটি সিক্সডিগ্রি। তবে ১৯৯৭ সালে তৈরি করা সিক্সডিগ্রিস ডটকমকেই অধিকাংশ মানুষ প্রথম সোশ্যাল মিডিয়া হিসেবে বিবেচনা করে। সিক্সডিগ্রিস ব্যবহারকারীরা তাদের কাছের লোকেদের সাইটে নিবন্ধিত করতে পারত এবং তাদের প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় ডিগ্রিÑএভাবে বিভাজন করতে পারত। ২০০১ সালে ফ্রেন্ডস্টার আসে, যার সঙ্গে খুব অল্প দিনের মধ্যেই কয়েক মিলিয়ন ব্যবহারকারী যুক্ত হয়। ২০০২ সালে লিংকডিন প্রতিষ্ঠিত হয়, ক্যারিয়ারের প্রতি মনোযোগী পেশাদারদের এক প্ল্যাটফর্মে নিয়ে আসার উদ্দেশ্য নিয়ে। বর্তমানে এই লিংকডিনে প্রায় ৭৪০ মিলিয়ন লোক প্রতিনিয়ত চাকরি খুঁজছে, চাকরি দিচ্ছে কিংবা নিজের দক্ষতা বৃদ্ধিতে পরস্পরের সঙ্গে যোগাযোগ করছে। ২০০৩ সালে মাইস্পেস আসার পর ২০০৬ সালে এটি হয়ে ওঠে পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি ভিজিট করা সাইট। কিন্তু ২০০৪ সালে প্রতিষ্ঠা পাওয়া ফেইসবুক সব ধরনের সোশ্যাল মিডিয়াকে ছাড়িয়ে গিয়ে নিজের শক্তিশালী অবস্থান তৈরি করে নেয়।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে সহজ করে কীভাবে উপস্থাপন করা যায়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম হলো এমন একটি প্লাটফর্ম যেখানে মানুষ কম্পিউটার, স্মার্টফোন ইত্যাদি যন্ত্রের মাধ্যমে ইন্টারনেটের সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে ভার্চুয়াল কমিউনিটি তৈরি করে এবং ছবি-ভিডিও ও বিভিন্ন তথ্য ভাগ করে নেয়। এছাড়া এসব মাধ্যমগুলোতে স্বাধীনভাবে মতামতও প্রকাশ করার অবারিত সুযোগ থাকে। অতীতে সামাজিক যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম ছিল চিঠি, যার কারণে বিশ্ব সাহিত্যের বড় একটা অংশ দখল করে আছে পত্র সাহিত্য। কিন্তু বর্তমানে সামাজিক যোগাযোগের জন্য বিশ্বগ্রামের নাগরিকরা ব্যবহার করে ফেইসবুক, টুইটারসহ অসংখ্য সোশ্যাল মিডিয়া ওয়েবসাইট। বিশ্বগ্রামের সব নাগরিকের সামাজিক যোগাযোগের সফল মাধ্যম হলো ইন্টারনেট যুক্ত একটি কম্পিউটার, মুঠোফোন।
সামাজিক মাধ্যমকে বিদ্বান মানুষরা খুব গুরুত্বপূর্ণ যোগাযোগমাধ্যম হিসেবে স্বীকৃতি দিতে চান না। দায়িত্বহীন অনেক কথা সামজিক মাধ্যমে আবেগে পরিপূর্ণ হয়ে প্রকাশিত হয় বলে তাদের কাছে এই মাধ্যমটির গুরুত্ব খুব বেশি নেই। সব শ্রেণী, পেশা, বর্ণ, ধর্ম, উদার, রক্ষণশীল, মৌলবাদী, মানবতাবাদীসহ পৃথিবীর সব ধরনের মানুষের মতামত আপনি পাবেন সামাজিক মাধ্যমে। মনে রাখতে হবে প্রতিটি মানুষ অনন্য। এই যে এত মানুষের মতামত স্বতঃস্ফূর্তভাবে সামাজিক মাধ্যমে প্রকাশিত হয়, যেখানে শুধু আবেগ থাকে না, যুক্তি ও ভালোবাসা দিয়ে অনেকে আন্তরিকভাবে তাদের মনোভাব প্রকাশ করে থাকেন। মূল ধারার মাধ্যম থেকে সংখ্যায় বেশি সৃজনশীল লেখা সামজিক মাধ্যমে প্রকাশিত হয়ে থাকে। তবে সৃজনশীলতার মান বিবেচনা দুরূহ।
নীতিবিদ্যায় একটি কথা আছে, একটি ধারাল চাকু যখন একজন দক্ষ শৈল চিকিৎসকের হাতে পড়ে তখন সেই চাকু দিয়ে মানুষের জীবন রক্ষা করা হয়। ওই চাকুটি যখন অসৎ ছিনতাইকারী কিংবা হিংস্র মানুষের হাতে পড়ে তখন চাকুটি জীবন এবং সম্পদের জন্য হুমকি হয়ে পড়ে। চাকুটি দিয়ে জীবন রক্ষার কাজ নীতিবিদ্যার ধারণা অনুযায়ী “নৈতিক” এবং দ্বিতীয় কাজটি নীতিবিদ্যার আলোকে সম্পূর্ণ “অনৈতিক”। সামজিক মাধ্যমকে যদি আমরা এভাবে বিবেচনা করি তাহলে সেটি নির্দোষ চাকুটির মতো। মানুষের নৈতিক, অনৈতিক মানসিক চিন্তার প্রতিফলনের স্থান হিসেবে ব্যবহৃত হয় মাধ্যমটি, মাধ্যমের নিজস্ব কোন উদ্দেশ্যের প্রতিফলন ঘটে না উপস্থাপিত কোন বিষয়ে।
সামাজিক মাধ্যমের প্রতি আমরা যতই নাক-সিঁটকাই না কেনো, যে কোন সমাজ চিন্তকের জন্য সামাজিক মাধ্যম হলো সমাজ বিশ্লেষণের একটি উর্বর ও যথাযথ ক্ষেত্র। মূল ধারার মাধ্যমগুলো এখন কোন না কোনভাবে পক্ষপাতদুষ্টু হয়ে পড়েছে। অর্থাৎ মূলধারার মাধ্যমগুলোর বিষয় বা কন্টেন্ট বিশ্লেষণ করে যুক্তিসংগত উপসংহারে পৌঁছা অসম্ভব নয় তবে বেশ কঠিন। তবে কোন সমাজবিজ্ঞানী যদি সমাজের মানুষের অকৃত্রিম চিন্তা-চেতনার স্বরূপ অন্বেষণ করতে চান তাহলে সামাজিক মাধ্যমকে নিজস্ব প্রক্রিয়ায় বিশ্লেষণ করে উপসংহারে পৌঁছাতে পারবেন বলে সবাই মনে করেন।
বাংলাদেশের মানুষের সামজিক এবং রাজনৈতিক সংস্কৃতির মান নির্ণয় করতে হলে সামজিক মাধ্যমে বিশেষ করে ফেইসবুকে মনোযোগ দিয়ে ডুব দিতে পারলে কিছুটা ধারণা পাওয়া সম্ভব। মূলধারার সংবাদপত্রে কিংবা ইলেক্ট্রনিক চ্যানেলে সাধারণ পাঠকদের মনোভাব প্রকাশের স্থান সীমিত থাকার কারণে হাতের মুঠের ভেতরে থাকা স্বাধীন সামাজিক মাধ্যমে মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে তাদের মনোভাবকে প্রকাশ করে থাকেন। যে কোন বিষয়ে সাধারণ মানুষের মতামত সম্পর্কে অনেকটা ধারণা পাওয়া যায় সামাজিক মাধ্যমে। ওই যে “চাকু”র ব্যবহারের কথা বলা হলো এর মতোই সারা পৃথিবীকে সামাজিক মাধ্যম যেমন বন্ধন সৃষ্টির চেষ্টা করে যাচ্ছে একইভাবে সামাজিক মাধ্যম ঘৃণা, বিদ্বেষ ছড়িয়ে একধরনের তথ্য বিভ্রান্তিরও জন্ম দিচ্ছে।
সামাজিক মাধ্যমের অপার স্বাধীনতার সুযোগ নিয়ে সারা বিশ্বের মতো আমাদের দেশেও গুজব এবং হিংসা সৃষ্টির চেষ্টা চলছে। সহজ, সরল সাধারণ মানুষ এসব গুজবকে বিশ্বাস করে নিজেদের মধ্যে হিংস্র প্রতিদ্বন্দ্বিতায় লিপ্ত হচ্ছেন। এসব গুজব হিংসা সৃষ্টিকারী বার্তা সমাজকে ভারসাম্যহীন এবং অমানবিক করতে সাহয্য করছে। যে কোন বিষয়ের অন্তর্নিহিত কারণ না জেনে মানুষ নিজেদের মতো করে সিদ্ধান্তে পৌঁছে যাচ্ছে। সমাজে মানুষ এক ধরনের বিভ্রম, বিভ্রান্তিতে বসবাস করে সেই পরিবেশকে সঠিক বলে মনে করছে। দড়িকে সাপ ভেবে মানুষ যেমন বিভ্রান্ত হয় একই ভাবে নিরপরাধ মানুষকে অপরাধী ভেবে ভেতরে বিদ্বেষ পুষে রাখে। এরকম বিদ্বেষ কখনো কখনো প্রতিবেশীকে শত্রু হিসেবে বিবেচনা করে। বাংলাদেশে সামজিক মাধ্যমে বিভ্রান্তি ছড়িয়ে মানুষে মানুষে সংঘাত তৈরির মতো পরিবেশও তৈরি করা হচ্ছে ক্রমাগত।
গণতন্ত্রে মতভিন্নতা থাকা খুব স্বাভাবিক। ভিন্ন মতকে গণতন্ত্রের সৌন্দর্য বলে বিবেচনা করা হয়। গণতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেলে একটি সমাজে বসবাসরত মানুষের সহিষ্ণুতা বেড়ে যায়। আমাদেরকে প্রযুক্তি ব্যবহার করতে হবে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গী নিয়ে। সমাজের অভিভাবকরা যদি সামজিক মাধ্যমকে অবজ্ঞা করে, চোখ বন্ধ করে রাখেন তাহলে কিন্তু প্রলয়ের কাছাকাছি গিয়ে সজীব জীবনে ফেরত আসা সম্ভব হবেনা। সামজিক মাধ্যম যেনো সমাজের জঞ্জাল দূর করার হাতিয়ারে পরিণত হয়; এজন্য শুধু সরকার নয় আমাদের নাগরিক সমাজকেও বিচক্ষণতার সঙ্গে এগিয়ে আসতে হবে। সামাজিক মাধ্যম ব্যবহার করে জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চার নিরঙ্কুশ ব্যবহারের মধ্য দিয়ে আমরা যেনো কুসংস্কার থেকে মুক্ত হতে পারি সে চেষ্টায় ব্রতী হতে হবে। আমাদের তরুণ সমাজের ভেতর বাঙালির চিরায়ত মূল্যবোধকে জাগ্রত করা কঠিন কোন কাজ নয়, সামাজিক মাধ্যম ব্যবহার করে সে লক্ষ্য পূরণ করা সম্ভব। জাতীয় ভাবে মানুষের স্বাধীনতা হরণ না করে আমাদের একটি সামগ্রিক পরিকল্পনা প্রণয়ন খুব প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। এই প্রয়োজনীয় কাজটি খুব দ্রুত করা উচিত। শুভস্য শীঘ্রম।
[লেখক : প্রাবন্ধিক ও উন্নয়ন গবেষক]
শেখর ভট্টাচার্য
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অন্তর থেকে উদ্গীরিত গণ-মানুষের মতামতকে পৃথিবীময় ছড়িয়ে দেয়ার এক অপার সুযোগ সৃষ্টি করেছে
শনিবার, ১৪ জুন ২০২৫
একটি সমাজের অন্তরলোকের ভাবনার গভীরে যেতে হলে সে সমাজের সামজিক মাধ্যমকে অবশ্যই বিশ্লেষণ করতে হবে। গত বিশ বছর আগেও বিষয়টি এরকম ছিল না, কারণ তথ্য-প্রযুক্তির এরকম অভাবনীয় উন্নয়ন বিশ বছর আগেও বর্তমান সময়ের মতো ছিল না। যে কোন দেশের সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ছবিকে চোখের সামনে নিয়ে আসতে চাইলে অসম্পাদিত সমাজমাধ্যমই ভরসা। সামাজিক মাধ্যমকে সচেতন বুদ্ধিজীবী, বিজ্ঞ যোগাযোগ বিজ্ঞানের প-িতরা অনেক সময় খুব গুরুত্ব দিতে সম্মত হন না। সম্পাদনাহীন গণমানুষের স্বতঃস্ফূর্ত ভাবাবেগকে অনেকেই তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিতে চান। কিন্তু সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম সব মতামত এবং ভৌগোলিক সীমান্তের জটিলতাকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে বিশ্ব গ্রামের ধারণাকে যেভাবে সংহত করে তুলছে, এই কারণে সামাজিকমাধ্যমকে অবজ্ঞা, অবহেলা করে এড়িয়ে যাওয়ার কোন উপায় নেই। বিভিন্ন দেশের রাজনৈতিক সামাজিক সংস্কৃতিকে এখন ইতি এবং নেতিবাচকভাবে সামজিক মাধ্যম নিয়ন্ত্রণ করছে ক্রমশ। বেলাগাম মতামত উপস্থাপনা, নিয়ন্ত্রণহীন পাল্টা মত দিয়ে যুক্তি খ-নের মাধ্যমে এক অদ্ভুত, কৃত্রিম সমাজ গড়ে উঠছে যে সমাজকে আপনি ইচ্ছে করলেও অবজ্ঞা করার উপায় নেই। আপনি পছন্দ না করলেও মানুষের কণ্ঠকে বাতিল করতে পারবেন না। এক অর্থে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম সবার কণ্ঠধ্বনি তুলে ধরে গণতন্ত্রের মৌল বাণীকে কিছুটা হলেও তুলে ধরার চেষ্টা করছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অন্তর থেকে উদ্গীরিত গণ-মানুষের মতামতকে পৃথিবীময় ছড়িয়ে দেয়ার এক অপার সুযোগ সৃষ্টি করেছে।
প্রথম সোশ্যাল মিডিয়া বা সামজিক মাধ্যম কোনটি? এ প্রশ্নের উত্তর দিতে হলে দুটি সাইটের নাম বলতে হয়; প্রথমটি জিওসিটি ও অন্যটি সিক্সডিগ্রি। তবে ১৯৯৭ সালে তৈরি করা সিক্সডিগ্রিস ডটকমকেই অধিকাংশ মানুষ প্রথম সোশ্যাল মিডিয়া হিসেবে বিবেচনা করে। সিক্সডিগ্রিস ব্যবহারকারীরা তাদের কাছের লোকেদের সাইটে নিবন্ধিত করতে পারত এবং তাদের প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় ডিগ্রিÑএভাবে বিভাজন করতে পারত। ২০০১ সালে ফ্রেন্ডস্টার আসে, যার সঙ্গে খুব অল্প দিনের মধ্যেই কয়েক মিলিয়ন ব্যবহারকারী যুক্ত হয়। ২০০২ সালে লিংকডিন প্রতিষ্ঠিত হয়, ক্যারিয়ারের প্রতি মনোযোগী পেশাদারদের এক প্ল্যাটফর্মে নিয়ে আসার উদ্দেশ্য নিয়ে। বর্তমানে এই লিংকডিনে প্রায় ৭৪০ মিলিয়ন লোক প্রতিনিয়ত চাকরি খুঁজছে, চাকরি দিচ্ছে কিংবা নিজের দক্ষতা বৃদ্ধিতে পরস্পরের সঙ্গে যোগাযোগ করছে। ২০০৩ সালে মাইস্পেস আসার পর ২০০৬ সালে এটি হয়ে ওঠে পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি ভিজিট করা সাইট। কিন্তু ২০০৪ সালে প্রতিষ্ঠা পাওয়া ফেইসবুক সব ধরনের সোশ্যাল মিডিয়াকে ছাড়িয়ে গিয়ে নিজের শক্তিশালী অবস্থান তৈরি করে নেয়।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে সহজ করে কীভাবে উপস্থাপন করা যায়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম হলো এমন একটি প্লাটফর্ম যেখানে মানুষ কম্পিউটার, স্মার্টফোন ইত্যাদি যন্ত্রের মাধ্যমে ইন্টারনেটের সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে ভার্চুয়াল কমিউনিটি তৈরি করে এবং ছবি-ভিডিও ও বিভিন্ন তথ্য ভাগ করে নেয়। এছাড়া এসব মাধ্যমগুলোতে স্বাধীনভাবে মতামতও প্রকাশ করার অবারিত সুযোগ থাকে। অতীতে সামাজিক যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম ছিল চিঠি, যার কারণে বিশ্ব সাহিত্যের বড় একটা অংশ দখল করে আছে পত্র সাহিত্য। কিন্তু বর্তমানে সামাজিক যোগাযোগের জন্য বিশ্বগ্রামের নাগরিকরা ব্যবহার করে ফেইসবুক, টুইটারসহ অসংখ্য সোশ্যাল মিডিয়া ওয়েবসাইট। বিশ্বগ্রামের সব নাগরিকের সামাজিক যোগাযোগের সফল মাধ্যম হলো ইন্টারনেট যুক্ত একটি কম্পিউটার, মুঠোফোন।
সামাজিক মাধ্যমকে বিদ্বান মানুষরা খুব গুরুত্বপূর্ণ যোগাযোগমাধ্যম হিসেবে স্বীকৃতি দিতে চান না। দায়িত্বহীন অনেক কথা সামজিক মাধ্যমে আবেগে পরিপূর্ণ হয়ে প্রকাশিত হয় বলে তাদের কাছে এই মাধ্যমটির গুরুত্ব খুব বেশি নেই। সব শ্রেণী, পেশা, বর্ণ, ধর্ম, উদার, রক্ষণশীল, মৌলবাদী, মানবতাবাদীসহ পৃথিবীর সব ধরনের মানুষের মতামত আপনি পাবেন সামাজিক মাধ্যমে। মনে রাখতে হবে প্রতিটি মানুষ অনন্য। এই যে এত মানুষের মতামত স্বতঃস্ফূর্তভাবে সামাজিক মাধ্যমে প্রকাশিত হয়, যেখানে শুধু আবেগ থাকে না, যুক্তি ও ভালোবাসা দিয়ে অনেকে আন্তরিকভাবে তাদের মনোভাব প্রকাশ করে থাকেন। মূল ধারার মাধ্যম থেকে সংখ্যায় বেশি সৃজনশীল লেখা সামজিক মাধ্যমে প্রকাশিত হয়ে থাকে। তবে সৃজনশীলতার মান বিবেচনা দুরূহ।
নীতিবিদ্যায় একটি কথা আছে, একটি ধারাল চাকু যখন একজন দক্ষ শৈল চিকিৎসকের হাতে পড়ে তখন সেই চাকু দিয়ে মানুষের জীবন রক্ষা করা হয়। ওই চাকুটি যখন অসৎ ছিনতাইকারী কিংবা হিংস্র মানুষের হাতে পড়ে তখন চাকুটি জীবন এবং সম্পদের জন্য হুমকি হয়ে পড়ে। চাকুটি দিয়ে জীবন রক্ষার কাজ নীতিবিদ্যার ধারণা অনুযায়ী “নৈতিক” এবং দ্বিতীয় কাজটি নীতিবিদ্যার আলোকে সম্পূর্ণ “অনৈতিক”। সামজিক মাধ্যমকে যদি আমরা এভাবে বিবেচনা করি তাহলে সেটি নির্দোষ চাকুটির মতো। মানুষের নৈতিক, অনৈতিক মানসিক চিন্তার প্রতিফলনের স্থান হিসেবে ব্যবহৃত হয় মাধ্যমটি, মাধ্যমের নিজস্ব কোন উদ্দেশ্যের প্রতিফলন ঘটে না উপস্থাপিত কোন বিষয়ে।
সামাজিক মাধ্যমের প্রতি আমরা যতই নাক-সিঁটকাই না কেনো, যে কোন সমাজ চিন্তকের জন্য সামাজিক মাধ্যম হলো সমাজ বিশ্লেষণের একটি উর্বর ও যথাযথ ক্ষেত্র। মূল ধারার মাধ্যমগুলো এখন কোন না কোনভাবে পক্ষপাতদুষ্টু হয়ে পড়েছে। অর্থাৎ মূলধারার মাধ্যমগুলোর বিষয় বা কন্টেন্ট বিশ্লেষণ করে যুক্তিসংগত উপসংহারে পৌঁছা অসম্ভব নয় তবে বেশ কঠিন। তবে কোন সমাজবিজ্ঞানী যদি সমাজের মানুষের অকৃত্রিম চিন্তা-চেতনার স্বরূপ অন্বেষণ করতে চান তাহলে সামাজিক মাধ্যমকে নিজস্ব প্রক্রিয়ায় বিশ্লেষণ করে উপসংহারে পৌঁছাতে পারবেন বলে সবাই মনে করেন।
বাংলাদেশের মানুষের সামজিক এবং রাজনৈতিক সংস্কৃতির মান নির্ণয় করতে হলে সামজিক মাধ্যমে বিশেষ করে ফেইসবুকে মনোযোগ দিয়ে ডুব দিতে পারলে কিছুটা ধারণা পাওয়া সম্ভব। মূলধারার সংবাদপত্রে কিংবা ইলেক্ট্রনিক চ্যানেলে সাধারণ পাঠকদের মনোভাব প্রকাশের স্থান সীমিত থাকার কারণে হাতের মুঠের ভেতরে থাকা স্বাধীন সামাজিক মাধ্যমে মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে তাদের মনোভাবকে প্রকাশ করে থাকেন। যে কোন বিষয়ে সাধারণ মানুষের মতামত সম্পর্কে অনেকটা ধারণা পাওয়া যায় সামাজিক মাধ্যমে। ওই যে “চাকু”র ব্যবহারের কথা বলা হলো এর মতোই সারা পৃথিবীকে সামাজিক মাধ্যম যেমন বন্ধন সৃষ্টির চেষ্টা করে যাচ্ছে একইভাবে সামাজিক মাধ্যম ঘৃণা, বিদ্বেষ ছড়িয়ে একধরনের তথ্য বিভ্রান্তিরও জন্ম দিচ্ছে।
সামাজিক মাধ্যমের অপার স্বাধীনতার সুযোগ নিয়ে সারা বিশ্বের মতো আমাদের দেশেও গুজব এবং হিংসা সৃষ্টির চেষ্টা চলছে। সহজ, সরল সাধারণ মানুষ এসব গুজবকে বিশ্বাস করে নিজেদের মধ্যে হিংস্র প্রতিদ্বন্দ্বিতায় লিপ্ত হচ্ছেন। এসব গুজব হিংসা সৃষ্টিকারী বার্তা সমাজকে ভারসাম্যহীন এবং অমানবিক করতে সাহয্য করছে। যে কোন বিষয়ের অন্তর্নিহিত কারণ না জেনে মানুষ নিজেদের মতো করে সিদ্ধান্তে পৌঁছে যাচ্ছে। সমাজে মানুষ এক ধরনের বিভ্রম, বিভ্রান্তিতে বসবাস করে সেই পরিবেশকে সঠিক বলে মনে করছে। দড়িকে সাপ ভেবে মানুষ যেমন বিভ্রান্ত হয় একই ভাবে নিরপরাধ মানুষকে অপরাধী ভেবে ভেতরে বিদ্বেষ পুষে রাখে। এরকম বিদ্বেষ কখনো কখনো প্রতিবেশীকে শত্রু হিসেবে বিবেচনা করে। বাংলাদেশে সামজিক মাধ্যমে বিভ্রান্তি ছড়িয়ে মানুষে মানুষে সংঘাত তৈরির মতো পরিবেশও তৈরি করা হচ্ছে ক্রমাগত।
গণতন্ত্রে মতভিন্নতা থাকা খুব স্বাভাবিক। ভিন্ন মতকে গণতন্ত্রের সৌন্দর্য বলে বিবেচনা করা হয়। গণতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেলে একটি সমাজে বসবাসরত মানুষের সহিষ্ণুতা বেড়ে যায়। আমাদেরকে প্রযুক্তি ব্যবহার করতে হবে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গী নিয়ে। সমাজের অভিভাবকরা যদি সামজিক মাধ্যমকে অবজ্ঞা করে, চোখ বন্ধ করে রাখেন তাহলে কিন্তু প্রলয়ের কাছাকাছি গিয়ে সজীব জীবনে ফেরত আসা সম্ভব হবেনা। সামজিক মাধ্যম যেনো সমাজের জঞ্জাল দূর করার হাতিয়ারে পরিণত হয়; এজন্য শুধু সরকার নয় আমাদের নাগরিক সমাজকেও বিচক্ষণতার সঙ্গে এগিয়ে আসতে হবে। সামাজিক মাধ্যম ব্যবহার করে জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চার নিরঙ্কুশ ব্যবহারের মধ্য দিয়ে আমরা যেনো কুসংস্কার থেকে মুক্ত হতে পারি সে চেষ্টায় ব্রতী হতে হবে। আমাদের তরুণ সমাজের ভেতর বাঙালির চিরায়ত মূল্যবোধকে জাগ্রত করা কঠিন কোন কাজ নয়, সামাজিক মাধ্যম ব্যবহার করে সে লক্ষ্য পূরণ করা সম্ভব। জাতীয় ভাবে মানুষের স্বাধীনতা হরণ না করে আমাদের একটি সামগ্রিক পরিকল্পনা প্রণয়ন খুব প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। এই প্রয়োজনীয় কাজটি খুব দ্রুত করা উচিত। শুভস্য শীঘ্রম।
[লেখক : প্রাবন্ধিক ও উন্নয়ন গবেষক]