মিহির কুমার রায়
গত ২ জুন ২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট উপস্থাপন করেন অর্থ উপদেষ্টা। এটি অন্তর্বর্তী সরকারের প্রথম বাজেট। এই বাজেট একইসঙ্গে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের সম্পূরক বাজেট ও ‘অর্থ অধ্যাদেশ ২০২৫’ উপস্থাপন করে। বাজেটটি বর্তমানে জনমত গ্রহণের প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে এবং ২৩ জুনের পর প্রধান উপদেষ্টার সভাপতিত্বে উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে অনুমোদনের পর রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশ আকারে তা ১ জুলাই থেকে কার্যকর হবে।
২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটের আকার নির্ধারণ করা হয়েছে ৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা, যা চলতি অর্থবছরের (২০২৪-২৫) মূল বাজেটের চেয়ে ৭ হাজার কোটি টাকা কম। চলতি বাজেট ছিল ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকা। এটাই প্রথমবার বাজেটের আকার হ্রাস পাচ্ছে। নতুন বাজেটে জিডিপির প্রবৃদ্ধি ৫.৫% এবং মূল্যস্ফীতি ৬.৫% ধরা হয়েছে, যেখানে চলতি বছরে প্রাক্কলন ছিল যথাক্রমে ৬.৫% ও ৬%। সংশোধিত বাজেটে প্রবৃদ্ধি ৫.২৫% ও মূল্যস্ফীতি ৮.৫%।
জিডিপির আকার ধরা হয়েছে ৬২ লাখ ৫৫ হাজার ৫৫৮ কোটি টাকা। প্রতিযোগী দেশগুলোতে বাজেটের আকার জিডিপির ২৫% এর বেশি হলেও আমাদের দেশের বাজেট জিডিপির মাত্র ১৪%।
মাথাপিছু বরাদ্দ কমে দাঁড়িয়েছে ৪৬ হাজার ৪৭০ টাকা, যা আগের তুলনায় ৪৬৬ টাকা কম। তবে মাথাপিছু আয় ১ হাজার ৩৫০ টাকা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৩ হাজার ৪৭০ টাকা। ঘাটতিও মাথাপিছু ১ হাজার ৮১৭ টাকা কমে হয়েছে ১৩ হাজার টাকা।
এবারের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) নির্ধারিত হয়েছে ২ লাখ ৪৫ হাজার ৬০৯ কোটি টাকা। মাথাপিছু এডিপি ১৪ হাজার ৪৪৭ টাকা, যা আগের বছরের তুলনায় ১ হাজার ৪১ টাকা কম।
২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটকে সরকার নিজেই ‘সংকোচনমূলক বাজেট’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ এবং আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল-এর নির্দেশনা অনুযায়ী ‘বেল্ট টাইটেনিং’ নীতির প্রতিফলন স্পষ্ট।
বাজেট কাঠামোয় উৎপাদনশীল ব্যয় বৃদ্ধির কোনো প্রবণতা নেই। এর ফলে ঘোষিত ৬% প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা অর্জন কঠিন হতে পারে।
নতুন বাজেটে রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৫ লাখ ৬৪ হাজার কোটি টাকা (জিডিপির ৯%)। এর মধ্যে এনবিআর ৪ লাখ ৯৯ হাজার কোটি টাকা আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা পাবে। বাকি ৬৫ হাজার কোটি টাকা আসবে অন্যান্য উৎস থেকে।
চলতি অর্থবছরের সম্পূরক বাজেটে রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা হ্রাস করে ৫ লাখ ১৮ হাজার কোটি টাকা করা হয়েছে, যা মূল লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ২৩ হাজার কোটি টাকা কম।
২০২৫-২৬ বাজেটে ঘাটতির পরিমাণ ধরা হয়েছে ২ লাখ ২৬ হাজার কোটি টাকা, যা জিডিপির ৩.৬২ শতাংশ। এর মধ্যে প্রায় ১ লাখ ১ হাজার কোটি টাকা সংগ্রহ করা হবে বৈদেশিক উৎস থেকে এবং বাকি ১ লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকা অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে।
চলতি অর্থবছরের ২১ মে পর্যন্ত ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে সরকারের নিট ঋণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ৬০ হাজার কোটি টাকা, যেখানে জানুয়ারিতে ছিল মাত্র ১৩ হাজার ৫৭১ কোটি টাকা। রাজস্ব ঘাটতি, সঞ্চয়পত্র বিক্রির ধীর গতি ও বৈদেশিক ঋণপ্রবাহ কমে যাওয়াই এর মূল কারণ।
২০২৫-২৬ অর্থবছরের উন্নয়ন বাজেট নির্ধারিত হয়েছে ২ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা; এর মধ্যে পরিবহন ও বিদ্যুৎ খাতে সর্বোচ্চ বরাদ্দÑ৯১ হাজার কোটি টাকার বেশি। পরিবহন ও যোগাযোগ খাতে বরাদ্দ ৫৮ হাজার ৯৭৩ কোটি টাকা, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে বরাদ্দ ৩২ হাজার ৩৯২ কোটি টাকা।
তৃতীয় সর্বোচ্চ বরাদ্দ শিক্ষা খাতেÑ২৮ হাজার ৫৫৭ কোটি টাকা, যা আগের বছরের চেয়ে ২ হাজার ৯৭১ কোটি টাকা কম। চতুর্থ ও পঞ্চম অবস্থানে রয়েছে যথাক্রমে গৃহায়ন এবং স্বাস্থ্য খাত। স্বাস্থ্য খাতের বরাদ্দ কমেছে ২ হাজার ৫৩৪ কোটি টাকা।
এডিপির প্রায় ৭০ শতাংশ বরাদ্দ দেয়া হয়েছে পাঁচটি খাতে: পরিবহন ও যোগাযোগ, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি, শিক্ষা, গৃহায়ন ও কমিউনিটি সুবিধাবলি এবং স্বাস্থ্য। তবে এই পাঁচটি খাতেই ৮% থেকে ২০% পর্যন্ত বরাদ্দ হ্রাস পেয়েছে।
২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেট একদিকে যেমন সংকোচনমূলক ও মন্দার প্রভাব প্রতিফলিত করে, তেমনি কিছু কাঠামোগত বাস্তবতা তুলে ধরে। রাজস্ব আহরণে দুর্বলতা, ঋণনির্ভরতা বৃদ্ধি, সামাজিক খাতে বরাদ্দ হ্রাস, এবং প্রবৃদ্ধি অর্জনের দুর্বল প্রণোদনাÑসব মিলিয়ে এটি একটি প্রতিকূলতা মোকাবিলার বাজেট।
তবে বাজেটের কাঠামোকে যদি গঠনমূলক সংস্কার, স্বচ্ছতা ও অংশগ্রহণমূলক বাস্তবায়নের মাধ্যমে পরিচালিত করা যায়, তবে এই সংকোচনকালও দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতায় অবদান রাখতে পারে।
[লেখক : সাবেক ডিন (ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদ) ও সিন্ডিকেট সদস্য, সিটি ইউনিভার্সিটি, ঢাকা]
মিহির কুমার রায়
শনিবার, ১৪ জুন ২০২৫
গত ২ জুন ২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট উপস্থাপন করেন অর্থ উপদেষ্টা। এটি অন্তর্বর্তী সরকারের প্রথম বাজেট। এই বাজেট একইসঙ্গে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের সম্পূরক বাজেট ও ‘অর্থ অধ্যাদেশ ২০২৫’ উপস্থাপন করে। বাজেটটি বর্তমানে জনমত গ্রহণের প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে এবং ২৩ জুনের পর প্রধান উপদেষ্টার সভাপতিত্বে উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে অনুমোদনের পর রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশ আকারে তা ১ জুলাই থেকে কার্যকর হবে।
২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটের আকার নির্ধারণ করা হয়েছে ৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা, যা চলতি অর্থবছরের (২০২৪-২৫) মূল বাজেটের চেয়ে ৭ হাজার কোটি টাকা কম। চলতি বাজেট ছিল ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকা। এটাই প্রথমবার বাজেটের আকার হ্রাস পাচ্ছে। নতুন বাজেটে জিডিপির প্রবৃদ্ধি ৫.৫% এবং মূল্যস্ফীতি ৬.৫% ধরা হয়েছে, যেখানে চলতি বছরে প্রাক্কলন ছিল যথাক্রমে ৬.৫% ও ৬%। সংশোধিত বাজেটে প্রবৃদ্ধি ৫.২৫% ও মূল্যস্ফীতি ৮.৫%।
জিডিপির আকার ধরা হয়েছে ৬২ লাখ ৫৫ হাজার ৫৫৮ কোটি টাকা। প্রতিযোগী দেশগুলোতে বাজেটের আকার জিডিপির ২৫% এর বেশি হলেও আমাদের দেশের বাজেট জিডিপির মাত্র ১৪%।
মাথাপিছু বরাদ্দ কমে দাঁড়িয়েছে ৪৬ হাজার ৪৭০ টাকা, যা আগের তুলনায় ৪৬৬ টাকা কম। তবে মাথাপিছু আয় ১ হাজার ৩৫০ টাকা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৩ হাজার ৪৭০ টাকা। ঘাটতিও মাথাপিছু ১ হাজার ৮১৭ টাকা কমে হয়েছে ১৩ হাজার টাকা।
এবারের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) নির্ধারিত হয়েছে ২ লাখ ৪৫ হাজার ৬০৯ কোটি টাকা। মাথাপিছু এডিপি ১৪ হাজার ৪৪৭ টাকা, যা আগের বছরের তুলনায় ১ হাজার ৪১ টাকা কম।
২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটকে সরকার নিজেই ‘সংকোচনমূলক বাজেট’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ এবং আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল-এর নির্দেশনা অনুযায়ী ‘বেল্ট টাইটেনিং’ নীতির প্রতিফলন স্পষ্ট।
বাজেট কাঠামোয় উৎপাদনশীল ব্যয় বৃদ্ধির কোনো প্রবণতা নেই। এর ফলে ঘোষিত ৬% প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা অর্জন কঠিন হতে পারে।
নতুন বাজেটে রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৫ লাখ ৬৪ হাজার কোটি টাকা (জিডিপির ৯%)। এর মধ্যে এনবিআর ৪ লাখ ৯৯ হাজার কোটি টাকা আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা পাবে। বাকি ৬৫ হাজার কোটি টাকা আসবে অন্যান্য উৎস থেকে।
চলতি অর্থবছরের সম্পূরক বাজেটে রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা হ্রাস করে ৫ লাখ ১৮ হাজার কোটি টাকা করা হয়েছে, যা মূল লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ২৩ হাজার কোটি টাকা কম।
২০২৫-২৬ বাজেটে ঘাটতির পরিমাণ ধরা হয়েছে ২ লাখ ২৬ হাজার কোটি টাকা, যা জিডিপির ৩.৬২ শতাংশ। এর মধ্যে প্রায় ১ লাখ ১ হাজার কোটি টাকা সংগ্রহ করা হবে বৈদেশিক উৎস থেকে এবং বাকি ১ লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকা অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে।
চলতি অর্থবছরের ২১ মে পর্যন্ত ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে সরকারের নিট ঋণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ৬০ হাজার কোটি টাকা, যেখানে জানুয়ারিতে ছিল মাত্র ১৩ হাজার ৫৭১ কোটি টাকা। রাজস্ব ঘাটতি, সঞ্চয়পত্র বিক্রির ধীর গতি ও বৈদেশিক ঋণপ্রবাহ কমে যাওয়াই এর মূল কারণ।
২০২৫-২৬ অর্থবছরের উন্নয়ন বাজেট নির্ধারিত হয়েছে ২ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা; এর মধ্যে পরিবহন ও বিদ্যুৎ খাতে সর্বোচ্চ বরাদ্দÑ৯১ হাজার কোটি টাকার বেশি। পরিবহন ও যোগাযোগ খাতে বরাদ্দ ৫৮ হাজার ৯৭৩ কোটি টাকা, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে বরাদ্দ ৩২ হাজার ৩৯২ কোটি টাকা।
তৃতীয় সর্বোচ্চ বরাদ্দ শিক্ষা খাতেÑ২৮ হাজার ৫৫৭ কোটি টাকা, যা আগের বছরের চেয়ে ২ হাজার ৯৭১ কোটি টাকা কম। চতুর্থ ও পঞ্চম অবস্থানে রয়েছে যথাক্রমে গৃহায়ন এবং স্বাস্থ্য খাত। স্বাস্থ্য খাতের বরাদ্দ কমেছে ২ হাজার ৫৩৪ কোটি টাকা।
এডিপির প্রায় ৭০ শতাংশ বরাদ্দ দেয়া হয়েছে পাঁচটি খাতে: পরিবহন ও যোগাযোগ, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি, শিক্ষা, গৃহায়ন ও কমিউনিটি সুবিধাবলি এবং স্বাস্থ্য। তবে এই পাঁচটি খাতেই ৮% থেকে ২০% পর্যন্ত বরাদ্দ হ্রাস পেয়েছে।
২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেট একদিকে যেমন সংকোচনমূলক ও মন্দার প্রভাব প্রতিফলিত করে, তেমনি কিছু কাঠামোগত বাস্তবতা তুলে ধরে। রাজস্ব আহরণে দুর্বলতা, ঋণনির্ভরতা বৃদ্ধি, সামাজিক খাতে বরাদ্দ হ্রাস, এবং প্রবৃদ্ধি অর্জনের দুর্বল প্রণোদনাÑসব মিলিয়ে এটি একটি প্রতিকূলতা মোকাবিলার বাজেট।
তবে বাজেটের কাঠামোকে যদি গঠনমূলক সংস্কার, স্বচ্ছতা ও অংশগ্রহণমূলক বাস্তবায়নের মাধ্যমে পরিচালিত করা যায়, তবে এই সংকোচনকালও দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতায় অবদান রাখতে পারে।
[লেখক : সাবেক ডিন (ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদ) ও সিন্ডিকেট সদস্য, সিটি ইউনিভার্সিটি, ঢাকা]