কামরুজ্জামান
বাংলাদেশ একটি জনবহুল দেশ। এখানকার অধিকাংশ মানুষ চিকিৎসাসেবা গ্রহণের জন্য সরকারি হাসপাতালেই ভিড় করে। এর পেছনে দুটি মূল কারণÑসরকারি হাসপাতালেই অভিজ্ঞ ও বিশেষজ্ঞ ডাক্তার বেশি থাকেন এবং এখানে খরচ তুলনামূলকভাবে কম। ঢাকা মেডিকেল কলেজ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ, জাতীয় হৃদরোগ ইন্সটিটিউট, শিশু হাসপাতালসহ দেশের বিভাগীয় শহর, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে সরকারি হাসপাতালগুলোতেই মানুষ চিকিৎসা নিতে আসে।
এসব হাসপাতালের ভিড় দেখে বোঝা যায়, জনগণের প্রথম ভরসা সরকারি হাসপাতাল। তবে এসব হাসপাতালে যারা আসেন, তাদের অধিকাংশই দরিদ্র, নিম্নবিত্ত ও নিম-œমধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ।
অন্যদিকে উচ্চ-মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত শ্রেণির মানুষ চিকিৎসা নেয় বেসরকারি আধুনিক হাসপাতালে। যদিও বেসরকারি হাসপাতালের মান নিয়ে জনমনে প্রশ্ন আছে। রোগ নির্ণয়ে ভুল, অপ্রয়োজনীয় টেস্ট, অতিরিক্ত ফি ইত্যাদি নিয়ে অভিযোগ আছে। তবুও এসব হাসপাতালের ভেতরের ও বাইরের পরিবেশ পরিচ্ছন্ন, যা সরকারি হাসপাতালগুলোর চেয়ে অনেক বেশি স্বাস্থ্যকর।
বর্তমানে দেশে সরকারি মেডিকেল কলেজ রয়েছে ৩৮টি। এর মধ্যে ঢাকা বিভাগে ১০টি, চট্টগ্রামে ৬টি, রাজশাহীতে ৫টি, খুলনায় ৫টি, ময়মনসিংহে ৩টি, সিলেটে ৩টি, রংপুরে ৩টি ও বরিশালে ২টি। বেসরকারি মেডিকেল কলেজ রয়েছে ৭২টি। মোট চিকিৎসা প্রদানকারী হাসপাতাল রয়েছে ৫৮১৬টি (সংখ্যাটি আনুমানিক)। এসব প্রতিষ্ঠানে ২৪ ঘণ্টা সাধারণ মানুষের চিকিৎসা সেবা দেওয়া হয়।
তবে প্রশ্ন হচ্ছেÑ এই হাসপাতালগুলোর ভেতরের ও বাইরের পরিবেশ স্বাস্থ্যসম্মত কি না? বাস্তবতা হলো, অধিকাংশ সরকারি হাসপাতালেই পরিবেশ অত্যন্ত অস্বাস্থ্যকর। এর পেছনে কি পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতার কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেই? নাকি দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিদের গাফিলতি রয়েছে?
সম্প্রতি শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গিয়ে এমন অভিজ্ঞতা হয়েছে। টিকিট কেটে সিরিয়াল নেওয়ার পর দোতলায় কেন্টিনে বসি। চারপাশের দেয়াল, মেঝে ও পরিবেশ দেখে মনে হলো, এখানে বসে খাওয়া তো দূরের কথাÑশুধু বসে থাকাই স্বাস্থ্য ঝুঁকিপূর্ণ।
একজন ফেসবুক ব্যবহারকারী লিখেছেন- ‘সরকারি হাসপাতালগুলোর আগে চিকিৎসা প্রয়োজন।’ এ মন্তব্য বেদনাদায়ক হলেও বাস্তবতার প্রতিচ্ছবি। মানুষ যেখানে সুস্থ হতে আসে, সেই জায়গার পরিবেশ যদি হয় রোগ-জীবাণুতে ভরা, তাহলে তারা যাবে কোথায়?
সরকারি হাসপাতালগুলো পরিচালনায় নিয়োজিত থাকে প্রশাসনিক কর্মকর্তা, পরিচালক, বিসিএস স্বাস্থ্য ক্যাডারের অভিজ্ঞ ডাক্তার, নিরাপত্তা কর্মকর্তা, নার্স, আয়া, পরিচ্ছন্নতাকর্মী, মেডিকেল কলেজ হলে অধ্যক্ষ, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীও। এত লোক থাকা সত্ত্বেও কেন পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা নিশ্চিত হচ্ছে না?
অভিজ্ঞতা বলছে, হাসপাতালগুলোতে একদিনের নয়, বহুদিনের ময়লা জমে থাকে। বিশেষ করে টয়লেট, বাথরুম, বেসিন ভয়াবহ অবস্থা; বেসিন ভাঙা, সাওয়ার নষ্ট, টয়লেট ব্যবহার অনুপযোগী, মলমূত্র জমে থাকা নিয়মিত ঘটনা।
ইমার্জেন্সি বিভাগ, শিশু ওয়ার্ড, নারী ও পুরুষ ওয়ার্ডÑ সবখানেই একই চিত্র। দেয়াল, সিঁড়ি, লিফট, প্রবেশপথে দেখা যায় কফ, থুতু, প্লাস্টিকের প্যাকেট, খাবারের মোড়ক, এমনকি রক্তের দাগ। রোগীর ব্যবহৃত ইনজেকশনের সিরিঞ্জ, স্যালাইন প্যাকেটসহ বিভিন্ন বর্জ্য বাইরে ফেলে রাখা হয়। সেগুলো জমে স্তূপ হয় এবং মশা-মাছি ও রোগ-জীবাণুর আবাসস্থলে পরিণত হয়।
এ অবস্থার পরিবর্তন জরুরি। নিচের পদক্ষেপগুলো নেওয়া যেতে পারেÑ
১. প্রতিদিন পরিচ্ছন্নতা অভিযান চালানো ও মনিটরিং নিশ্চিত করা : সকাল ৭টার আগেই প্রতিদিনের ময়লা পরিষ্কার করতে হবে। পরিচ্ছন্নতার কাজ দায়সারা নয়Ñসচেতনভাবে করতে হবে। স্যাভলন মিশ্রিত পানি দিয়ে মুছে জীবাণুমুক্ত রাখা দরকার।
২. পরিচ্ছন্নতা কর্মীর সংখ্যা বাড়ানো : জনবল কাঠামো শক্তিশালী করতে হবে। এতে অতিরিক্ত খরচ মেটাতে টিকিটের মূল্য ৫ থেকে ১০, ১০ থেকে ২০, ৩০ থেকে ৪০ টাকা করা যেতে পারে।
৩. বর্জ্য ব্যবস্থাপনা উন্নত করা : রোগীর ব্যবহৃত বর্জ্য হাসপাতালের বাইরে না রেখে নির্দিষ্ট দূরের স্থানে ফেলার ব্যবস্থা করতে হবে। ময়লা ফেলার ভাঙাচোরা ডাস্টবিন সরিয়ে নতুন, টেকসই ও মানসম্মত ডাস্টবিন সরবরাহ জরুরি।
স্বাস্থ্য মানুষের অমূল্য সম্পদ। দেশের বিপুল জনগোষ্ঠী এখনও সরকারি হাসপাতালের ওপর নির্ভরশীল। তাই শুধু চিকিৎসার মান নয়, হাসপাতালের পরিবেশও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও স্বাস্থ্যসম্মত হওয়া আবশ্যক। নইলে চিকিৎসা নিতে এসে রোগীরা আরও বড় স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়বে, যা কোনো সভ্য সমাজে কাম্য নয়।
[লেখক : সহকারী অধ্যাপক, ভূগোল বিভাগ, মুক্তিযোদ্ধা কলেজ, গাজীপুর]
কামরুজ্জামান
শনিবার, ১৪ জুন ২০২৫
বাংলাদেশ একটি জনবহুল দেশ। এখানকার অধিকাংশ মানুষ চিকিৎসাসেবা গ্রহণের জন্য সরকারি হাসপাতালেই ভিড় করে। এর পেছনে দুটি মূল কারণÑসরকারি হাসপাতালেই অভিজ্ঞ ও বিশেষজ্ঞ ডাক্তার বেশি থাকেন এবং এখানে খরচ তুলনামূলকভাবে কম। ঢাকা মেডিকেল কলেজ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ, জাতীয় হৃদরোগ ইন্সটিটিউট, শিশু হাসপাতালসহ দেশের বিভাগীয় শহর, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে সরকারি হাসপাতালগুলোতেই মানুষ চিকিৎসা নিতে আসে।
এসব হাসপাতালের ভিড় দেখে বোঝা যায়, জনগণের প্রথম ভরসা সরকারি হাসপাতাল। তবে এসব হাসপাতালে যারা আসেন, তাদের অধিকাংশই দরিদ্র, নিম্নবিত্ত ও নিম-œমধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ।
অন্যদিকে উচ্চ-মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত শ্রেণির মানুষ চিকিৎসা নেয় বেসরকারি আধুনিক হাসপাতালে। যদিও বেসরকারি হাসপাতালের মান নিয়ে জনমনে প্রশ্ন আছে। রোগ নির্ণয়ে ভুল, অপ্রয়োজনীয় টেস্ট, অতিরিক্ত ফি ইত্যাদি নিয়ে অভিযোগ আছে। তবুও এসব হাসপাতালের ভেতরের ও বাইরের পরিবেশ পরিচ্ছন্ন, যা সরকারি হাসপাতালগুলোর চেয়ে অনেক বেশি স্বাস্থ্যকর।
বর্তমানে দেশে সরকারি মেডিকেল কলেজ রয়েছে ৩৮টি। এর মধ্যে ঢাকা বিভাগে ১০টি, চট্টগ্রামে ৬টি, রাজশাহীতে ৫টি, খুলনায় ৫টি, ময়মনসিংহে ৩টি, সিলেটে ৩টি, রংপুরে ৩টি ও বরিশালে ২টি। বেসরকারি মেডিকেল কলেজ রয়েছে ৭২টি। মোট চিকিৎসা প্রদানকারী হাসপাতাল রয়েছে ৫৮১৬টি (সংখ্যাটি আনুমানিক)। এসব প্রতিষ্ঠানে ২৪ ঘণ্টা সাধারণ মানুষের চিকিৎসা সেবা দেওয়া হয়।
তবে প্রশ্ন হচ্ছেÑ এই হাসপাতালগুলোর ভেতরের ও বাইরের পরিবেশ স্বাস্থ্যসম্মত কি না? বাস্তবতা হলো, অধিকাংশ সরকারি হাসপাতালেই পরিবেশ অত্যন্ত অস্বাস্থ্যকর। এর পেছনে কি পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতার কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেই? নাকি দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিদের গাফিলতি রয়েছে?
সম্প্রতি শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গিয়ে এমন অভিজ্ঞতা হয়েছে। টিকিট কেটে সিরিয়াল নেওয়ার পর দোতলায় কেন্টিনে বসি। চারপাশের দেয়াল, মেঝে ও পরিবেশ দেখে মনে হলো, এখানে বসে খাওয়া তো দূরের কথাÑশুধু বসে থাকাই স্বাস্থ্য ঝুঁকিপূর্ণ।
একজন ফেসবুক ব্যবহারকারী লিখেছেন- ‘সরকারি হাসপাতালগুলোর আগে চিকিৎসা প্রয়োজন।’ এ মন্তব্য বেদনাদায়ক হলেও বাস্তবতার প্রতিচ্ছবি। মানুষ যেখানে সুস্থ হতে আসে, সেই জায়গার পরিবেশ যদি হয় রোগ-জীবাণুতে ভরা, তাহলে তারা যাবে কোথায়?
সরকারি হাসপাতালগুলো পরিচালনায় নিয়োজিত থাকে প্রশাসনিক কর্মকর্তা, পরিচালক, বিসিএস স্বাস্থ্য ক্যাডারের অভিজ্ঞ ডাক্তার, নিরাপত্তা কর্মকর্তা, নার্স, আয়া, পরিচ্ছন্নতাকর্মী, মেডিকেল কলেজ হলে অধ্যক্ষ, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীও। এত লোক থাকা সত্ত্বেও কেন পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা নিশ্চিত হচ্ছে না?
অভিজ্ঞতা বলছে, হাসপাতালগুলোতে একদিনের নয়, বহুদিনের ময়লা জমে থাকে। বিশেষ করে টয়লেট, বাথরুম, বেসিন ভয়াবহ অবস্থা; বেসিন ভাঙা, সাওয়ার নষ্ট, টয়লেট ব্যবহার অনুপযোগী, মলমূত্র জমে থাকা নিয়মিত ঘটনা।
ইমার্জেন্সি বিভাগ, শিশু ওয়ার্ড, নারী ও পুরুষ ওয়ার্ডÑ সবখানেই একই চিত্র। দেয়াল, সিঁড়ি, লিফট, প্রবেশপথে দেখা যায় কফ, থুতু, প্লাস্টিকের প্যাকেট, খাবারের মোড়ক, এমনকি রক্তের দাগ। রোগীর ব্যবহৃত ইনজেকশনের সিরিঞ্জ, স্যালাইন প্যাকেটসহ বিভিন্ন বর্জ্য বাইরে ফেলে রাখা হয়। সেগুলো জমে স্তূপ হয় এবং মশা-মাছি ও রোগ-জীবাণুর আবাসস্থলে পরিণত হয়।
এ অবস্থার পরিবর্তন জরুরি। নিচের পদক্ষেপগুলো নেওয়া যেতে পারেÑ
১. প্রতিদিন পরিচ্ছন্নতা অভিযান চালানো ও মনিটরিং নিশ্চিত করা : সকাল ৭টার আগেই প্রতিদিনের ময়লা পরিষ্কার করতে হবে। পরিচ্ছন্নতার কাজ দায়সারা নয়Ñসচেতনভাবে করতে হবে। স্যাভলন মিশ্রিত পানি দিয়ে মুছে জীবাণুমুক্ত রাখা দরকার।
২. পরিচ্ছন্নতা কর্মীর সংখ্যা বাড়ানো : জনবল কাঠামো শক্তিশালী করতে হবে। এতে অতিরিক্ত খরচ মেটাতে টিকিটের মূল্য ৫ থেকে ১০, ১০ থেকে ২০, ৩০ থেকে ৪০ টাকা করা যেতে পারে।
৩. বর্জ্য ব্যবস্থাপনা উন্নত করা : রোগীর ব্যবহৃত বর্জ্য হাসপাতালের বাইরে না রেখে নির্দিষ্ট দূরের স্থানে ফেলার ব্যবস্থা করতে হবে। ময়লা ফেলার ভাঙাচোরা ডাস্টবিন সরিয়ে নতুন, টেকসই ও মানসম্মত ডাস্টবিন সরবরাহ জরুরি।
স্বাস্থ্য মানুষের অমূল্য সম্পদ। দেশের বিপুল জনগোষ্ঠী এখনও সরকারি হাসপাতালের ওপর নির্ভরশীল। তাই শুধু চিকিৎসার মান নয়, হাসপাতালের পরিবেশও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও স্বাস্থ্যসম্মত হওয়া আবশ্যক। নইলে চিকিৎসা নিতে এসে রোগীরা আরও বড় স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়বে, যা কোনো সভ্য সমাজে কাম্য নয়।
[লেখক : সহকারী অধ্যাপক, ভূগোল বিভাগ, মুক্তিযোদ্ধা কলেজ, গাজীপুর]