সেলিম রানা
চিকিৎসা একটি মহান পেশা। এর মূল উদ্দেশ্যই হলো মানবসেবাÑরোগীর জীবন রক্ষা, আরোগ্য নিশ্চিত করা। চিকিৎসকের কলমের একটিমাত্র স্বাক্ষর জীবন ফিরিয়ে দিতে পারে। আবার সেই একই স্বাক্ষর, যদি অসততার মোড়কে মোড়ানো হয়, রোগীকে ঠেলে দিতে পারে মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, আজকের আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থা ক্রমশই একটি লাভজনক ব্যবসার রূপ নিচ্ছে। ওষুধ কোম্পানির স্বার্থ, বিক্রয় প্রতিনিধিদের প্রভাব এবং চিকিৎসকদের একটি অংশের নৈতিক দুর্বলতা মিলে চিকিৎসাক্ষেত্রে এক গভীর সংকট তৈরি করেছে।
এই পরিস্থিতিতে রোগীর আরোগ্য নয়, বরং কোম্পানির মুনাফা ও চিকিৎসকের ব্যক্তিগত লাভই মুখ্য হয়ে উঠছে। এতে শুধু চিকিৎসাব্যবস্থার ওপর মানুষের আস্থা কমে যাচ্ছে না, কলুষিত হচ্ছে মানবসেবার এক পবিত্র ক্ষেত্র।
সরকারি বা বেসরকারি হাসপাতাল, ডায়াগনস্টিক সেন্টার কিংবা ব্যক্তিগত চেম্বারের সামনে সব সময়ই দেখা যায় একটি পরিচিত চিত্রÑরোগীদের পাশাপাশি অপেক্ষমাণ ওষুধ বিক্রয় প্রতিনিধিরা। তাদের উদ্দেশ্য একটাইÑচিকিৎসকের কাছ থেকে নিজের কোম্পানির ওষুধ ব্যবস্থাপত্রে অন্তর্ভুক্ত করিয়ে নেয়া। রোগীদের দীর্ঘ লাইনের বিপরীতে, এদের প্রবেশাধিকার প্রায় অবারিত।
প্রতিনিধিরা শুধু পণ্য পরিচিতি দিতে আসেন না, বরং উপহারের মাধ্যমে চিকিৎসকদের প্রভাবিত করেন। উপহারের তালিকায় থাকে ছাতা, কম্বল, থালা-বাটি, এমনকি মোবাইল ফোন, ফার্নিচার বা বিদেশ সফরের মতো উচ্চমূল্যের সুবিধাও। বিনিময়ে চিকিৎসকের কাছ থেকে তারা চান নির্দিষ্ট কোম্পানির ওষুধ ব্যবস্থাপত্রে লেখার নিশ্চয়তা।
রোগীর ব্যবস্থাপত্র তার ব্যক্তিগত স্বাস্থ্য তথ্যের গুরুত্বপূর্ণ নথি। অথচ ওষুধ প্রতিনিধিরা অনেক সময় এসব ব্যবস্থাপত্রের ছবি তুলে রাখেন এবং কোম্পানিগুলো সেই ছবি বিশ্লেষণ করে চিকিৎসকের প্রেসক্রিপশন প্রবণতা বুঝে ফেলে। এরপর তাকে আরও বেশি ওষুধ লিখিয়ে নেয়ার কৌশল প্রয়োগ করে। এটা শুধু অনৈতিক নয়, রোগীর গোপনীয়তা লঙ্ঘনের শামিল।
চিকিৎসক ও রোগীর সম্পর্কের ভিত্তি হলো বিশ্বাস। একজন রোগী তার অসুস্থতা গোপন না রেখে চিকিৎসকের কাছে প্রকাশ করেন এই বিশ্বাসে যে, তিনি সবচেয়ে ভালো চিকিৎসা পাবেন। কিন্তু সেই বিশ্বাসকে পুঁজি করে যখন কিছু চিকিৎসক আর্থিক সুবিধা গ্রহণ করে পক্ষপাতদুষ্ট প্রেসক্রিপশন দেন, তখন তা শুধু প্রতারণা নয়, পেশাগত বিশ্বাসঘাতকতাও।
অনেক চিকিৎসক আজ ওষুধ কোম্পানির সঙ্গে মৌখিক বা লিখিত গোপন চুক্তিতে আবদ্ধ। এই চুক্তির মাধ্যমে তারা আর্থিক সুবিধা পানÑকিন্তু তার বিনিময়ে রোগীর স্বার্থ উপেক্ষিত হয়। চিকিৎসা তখন পরিণত হয় এক ধরনের ‘কমিশন বাণিজ্যে’।
এই অনৈতিক চর্চা থেকে মুক্তির উপায় খুঁজতে হবে। কঠোর নিয়ন্ত্রণ ও আইন প্রয়োগ করতে হবে। ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিদের চিকিৎসকদের ওপর প্রভাব কমাতে আইন করতে হবে। চিকিৎসকদের ওষুধ ব্যবস্থাপত্রের পর্যালোচনার জন্য নিরপেক্ষ তদারকি ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানে কোম্পানিভিত্তিক ওষুধ প্রচার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করতে হবে।
চিকিৎসকদের নৈতিক মানোন্নয়ন জরুরি। চিকিৎসা শিক্ষার শুরু থেকেই নৈতিকতা ও পেশাগত সততা বিষয়ক প্রশিক্ষণ বাধ্যতামূলক করতে হবে। শপথ শুধু পাসের সময় নয়, পেশাগত জীবনের প্রতিটি পর্যায়ে স্মরণ করিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা থাকতে হবে।
রোগীদের সচেতনতা বৃদ্ধি করা দরকার। রোগীদের উচিত জানতে চাওয়াÑচিকিৎসক কেন নির্দিষ্ট ওষুধ দিলেন, তার বিকল্প কী, বা ওষুধটির কার্যকারিতা কেমন। এতে যেমন স্বচ্ছতা বাড়বে, তেমনি চিকিৎসকদেরও জবাবদিহি করতে হবে।
চিকিৎসা শুধুই একটি পেশা নয়Ñএটি মানবতার সেবায় নিয়োজিত একটি মহৎ দায়িত্ব। এই পেশায় ব্যক্তিগত লোভ ঢুকলে পুরো সমাজ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। চিকিৎসকদের উচিত মানবসেবাকে প্রাধান্য দেয়া, আর সরকারের উচিত ওষুধ কোম্পানির প্রভাব কমাতে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করা।
রোগী, চিকিৎসক ও রাষ্ট্রÑএই তিন পক্ষ সচেতন হলে, স্বচ্ছতা, নৈতিকতা ও মানবিকতার ভিত্তিতে চিকিৎসাব্যবস্থার প্রতি মানুষের হারিয়ে যাওয়া আস্থা আবার ফিরিয়ে আনা সম্ভব।
[লেখক : গণমাধ্যমকর্মী ]
সেলিম রানা
শনিবার, ১২ জুলাই ২০২৫
চিকিৎসা একটি মহান পেশা। এর মূল উদ্দেশ্যই হলো মানবসেবাÑরোগীর জীবন রক্ষা, আরোগ্য নিশ্চিত করা। চিকিৎসকের কলমের একটিমাত্র স্বাক্ষর জীবন ফিরিয়ে দিতে পারে। আবার সেই একই স্বাক্ষর, যদি অসততার মোড়কে মোড়ানো হয়, রোগীকে ঠেলে দিতে পারে মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, আজকের আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থা ক্রমশই একটি লাভজনক ব্যবসার রূপ নিচ্ছে। ওষুধ কোম্পানির স্বার্থ, বিক্রয় প্রতিনিধিদের প্রভাব এবং চিকিৎসকদের একটি অংশের নৈতিক দুর্বলতা মিলে চিকিৎসাক্ষেত্রে এক গভীর সংকট তৈরি করেছে।
এই পরিস্থিতিতে রোগীর আরোগ্য নয়, বরং কোম্পানির মুনাফা ও চিকিৎসকের ব্যক্তিগত লাভই মুখ্য হয়ে উঠছে। এতে শুধু চিকিৎসাব্যবস্থার ওপর মানুষের আস্থা কমে যাচ্ছে না, কলুষিত হচ্ছে মানবসেবার এক পবিত্র ক্ষেত্র।
সরকারি বা বেসরকারি হাসপাতাল, ডায়াগনস্টিক সেন্টার কিংবা ব্যক্তিগত চেম্বারের সামনে সব সময়ই দেখা যায় একটি পরিচিত চিত্রÑরোগীদের পাশাপাশি অপেক্ষমাণ ওষুধ বিক্রয় প্রতিনিধিরা। তাদের উদ্দেশ্য একটাইÑচিকিৎসকের কাছ থেকে নিজের কোম্পানির ওষুধ ব্যবস্থাপত্রে অন্তর্ভুক্ত করিয়ে নেয়া। রোগীদের দীর্ঘ লাইনের বিপরীতে, এদের প্রবেশাধিকার প্রায় অবারিত।
প্রতিনিধিরা শুধু পণ্য পরিচিতি দিতে আসেন না, বরং উপহারের মাধ্যমে চিকিৎসকদের প্রভাবিত করেন। উপহারের তালিকায় থাকে ছাতা, কম্বল, থালা-বাটি, এমনকি মোবাইল ফোন, ফার্নিচার বা বিদেশ সফরের মতো উচ্চমূল্যের সুবিধাও। বিনিময়ে চিকিৎসকের কাছ থেকে তারা চান নির্দিষ্ট কোম্পানির ওষুধ ব্যবস্থাপত্রে লেখার নিশ্চয়তা।
রোগীর ব্যবস্থাপত্র তার ব্যক্তিগত স্বাস্থ্য তথ্যের গুরুত্বপূর্ণ নথি। অথচ ওষুধ প্রতিনিধিরা অনেক সময় এসব ব্যবস্থাপত্রের ছবি তুলে রাখেন এবং কোম্পানিগুলো সেই ছবি বিশ্লেষণ করে চিকিৎসকের প্রেসক্রিপশন প্রবণতা বুঝে ফেলে। এরপর তাকে আরও বেশি ওষুধ লিখিয়ে নেয়ার কৌশল প্রয়োগ করে। এটা শুধু অনৈতিক নয়, রোগীর গোপনীয়তা লঙ্ঘনের শামিল।
চিকিৎসক ও রোগীর সম্পর্কের ভিত্তি হলো বিশ্বাস। একজন রোগী তার অসুস্থতা গোপন না রেখে চিকিৎসকের কাছে প্রকাশ করেন এই বিশ্বাসে যে, তিনি সবচেয়ে ভালো চিকিৎসা পাবেন। কিন্তু সেই বিশ্বাসকে পুঁজি করে যখন কিছু চিকিৎসক আর্থিক সুবিধা গ্রহণ করে পক্ষপাতদুষ্ট প্রেসক্রিপশন দেন, তখন তা শুধু প্রতারণা নয়, পেশাগত বিশ্বাসঘাতকতাও।
অনেক চিকিৎসক আজ ওষুধ কোম্পানির সঙ্গে মৌখিক বা লিখিত গোপন চুক্তিতে আবদ্ধ। এই চুক্তির মাধ্যমে তারা আর্থিক সুবিধা পানÑকিন্তু তার বিনিময়ে রোগীর স্বার্থ উপেক্ষিত হয়। চিকিৎসা তখন পরিণত হয় এক ধরনের ‘কমিশন বাণিজ্যে’।
এই অনৈতিক চর্চা থেকে মুক্তির উপায় খুঁজতে হবে। কঠোর নিয়ন্ত্রণ ও আইন প্রয়োগ করতে হবে। ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিদের চিকিৎসকদের ওপর প্রভাব কমাতে আইন করতে হবে। চিকিৎসকদের ওষুধ ব্যবস্থাপত্রের পর্যালোচনার জন্য নিরপেক্ষ তদারকি ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানে কোম্পানিভিত্তিক ওষুধ প্রচার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করতে হবে।
চিকিৎসকদের নৈতিক মানোন্নয়ন জরুরি। চিকিৎসা শিক্ষার শুরু থেকেই নৈতিকতা ও পেশাগত সততা বিষয়ক প্রশিক্ষণ বাধ্যতামূলক করতে হবে। শপথ শুধু পাসের সময় নয়, পেশাগত জীবনের প্রতিটি পর্যায়ে স্মরণ করিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা থাকতে হবে।
রোগীদের সচেতনতা বৃদ্ধি করা দরকার। রোগীদের উচিত জানতে চাওয়াÑচিকিৎসক কেন নির্দিষ্ট ওষুধ দিলেন, তার বিকল্প কী, বা ওষুধটির কার্যকারিতা কেমন। এতে যেমন স্বচ্ছতা বাড়বে, তেমনি চিকিৎসকদেরও জবাবদিহি করতে হবে।
চিকিৎসা শুধুই একটি পেশা নয়Ñএটি মানবতার সেবায় নিয়োজিত একটি মহৎ দায়িত্ব। এই পেশায় ব্যক্তিগত লোভ ঢুকলে পুরো সমাজ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। চিকিৎসকদের উচিত মানবসেবাকে প্রাধান্য দেয়া, আর সরকারের উচিত ওষুধ কোম্পানির প্রভাব কমাতে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করা।
রোগী, চিকিৎসক ও রাষ্ট্রÑএই তিন পক্ষ সচেতন হলে, স্বচ্ছতা, নৈতিকতা ও মানবিকতার ভিত্তিতে চিকিৎসাব্যবস্থার প্রতি মানুষের হারিয়ে যাওয়া আস্থা আবার ফিরিয়ে আনা সম্ভব।
[লেখক : গণমাধ্যমকর্মী ]