ইমাদুল হক প্রিন্স
২০২৫ সালের এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষার ফলাফল বাংলাদেশের শিক্ষা ইতিহাসে এক নতুন প্রশ্নের জন্ম দিয়েছেÑশুধু ফলাফল কেন খারাপ হলো, তাই নয়; কেন এই খারাপ ফলাফলের পেছনে এতগুলো কারণ একযোগে কাজ করল?
অনেক শিক্ষার্থীই যখন স্বপ্ন বুনেছিল জিপিএ-৫ পাওয়ার, তখন তারা বাস্তবেই জানত নাÑতাদের ওপর একটি কঠিন মূল্যায়ন ঝরে পড়তে চলেছে। কেউ কেউ হয়তো বলবে, এটি ‘বাস্তবের কাছে ফিরিয়ে আনার ফলাফল’; কিন্তু প্রশ্ন রয়ে যায়Ñতাদের প্রস্তুতি কি যথেষ্ট ছিল? কিংবা প্রস্তুতির সুযোগ তারা আদৌ পেয়েছিল কি?
করোনা মহামারির ধাক্কা, রাজনৈতিক অস্থিরতা, বিদ্যালয়ে পাঠদানের ঘাটতি, প্রশ্নের কঠিনতা এবং এবার উত্তরপত্র মূল্যায়নে কড়াকড়িÑএসবের সম্মিলিত প্রতিচ্ছবি আমরা দেখতে পাচ্ছি এই ফলাফলে। শুধু ফল খারাপ হয়নি, ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে একটি প্রজন্মের আত্মবিশ্বাস। যাদের জীবনের প্রথম বড় পরীক্ষা, তারা আজ যেন ‘সিস্টেমের ভুলের বলি’। এমন বাস্তবতায় আমরা কি তাদের ব্যর্থ বলব, নাকি ব্যর্থ বলব আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থাকেই?
২০২৫ সালের এসএসসি পরীক্ষার ফল খারাপ হওয়ার পেছনে একক কোনো কারণ দায়ী নয়Ñবরং এটি বহুস্তর, বহু মাত্রিক সমস্যার ফল। শিক্ষার্থীরা ছিল মানসিক ও পাঠ্য দুর্বলতায় বিপর্যস্ত, পাঠদান ছিল ক্ষীণ, প্রশ্ন ছিল কঠিন, মূল্যায়ন ছিল কড়া। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় যে বিষয়টি উঠে এসেছে তা হলোÑগত পাঁচ বছরে শিক্ষার্থীরা পূর্ণ শিক্ষাজীবন পায়নি।
করোনাকালীন ক্ষতি : একটি ‘অপূর্ণ শিক্ষা প্রজন্ম’ : ২০২০ সালের মার্চে যখন দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায়, তখন বর্তমানে এসএসসি দেওয়া শিক্ষার্থীরা ষষ্ঠ শ্রেণিতে ছিল। টানা দেড় বছর শিক্ষা কার্যক্রম পুরোপুরি বন্ধ থাকায় তাদের শিক্ষার ভিত্তিটাই দুর্বল হয়ে পড়ে। এরপর দ্বিতীয় দফায় ২০২২ সালের জানুয়ারিতে আবার এক মাস স্কুল বন্ধ থাকে। এত দীর্ঘ সময় অনুপস্থিত ক্লাস শিক্ষার্থীদের ‘বেসিক শিক্ষা’ অর্জনে মারাত্মক অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়।
তাদের শিক্ষাজীবন ছিল এমনÑ ষষ্ঠ শ্রেণি (২০২০) : শিক্ষাবর্ষের মাঝামাঝি ক্লাস বন্ধ। সপ্তম শ্রেণি (২০২১) : সীমিত সময় ক্লাস, অনলাইন অকার্যকর। অষ্টম-নবম শ্রেণি (২০২২-২৩) : পর্যাপ্ত ক্লাস না পেয়ে ‘পড়াশোনায় ফাঁক’। দশম শ্রেণি (২০২৪) : হঠাৎ পূর্ণ সিলেবাসে পরীক্ষা প্রস্তুতির চাপ। অর্থাৎ এই শিক্ষার্থীরা পাঁচ বছরে যেটুকু ক্লাস করার কথা ছিল, তার অর্ধেকেরও কম পেয়েছে। শিক্ষকের সরাসরি দিকনির্দেশনা ছাড়াই একটি প্রজন্মকে পাঠ্যপুস্তক মুখস্থ করে পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে স্থানীয় পর্যায়ে অনলাইন ক্লাস-এর সুযোগ ছিল না, ছিল না পর্যাপ্ত বই ও গাইড ব্যবস্থাও।
কঠিন প্রশ্নের প্রভাব : বিশেষত গণিতে ‘ধস’ : ২০২৫ সালে এসএসসি পরীক্ষার প্রশ্ন ছিল পূর্ণ পাঠ্যসূচির আলোকে এবং অনেক বিষয়ের প্রশ্ন ছিল তুলনামূলক কঠিন। বোর্ড কর্তৃপক্ষ দাবি করলেও প্রশ্ন সহজ ছিল নাÑবিশেষত গণিতে। গণিত এমন একটি বিষয়, যেটি একদিনে শেখা যায় না। এটি চর্চার বিষয়। কিন্তু চর্চার জন্য প্রয়োজন নিয়মিত গাইডেন্স, ক্লাস, সহায়ক উপকরণÑযা এই প্রজন্ম পুরোপুরি পায়নি। ফলে গণিতে পাসের হার কমেছে সব বোর্ডেই। এক বিষয়ের কারণে অনেক শিক্ষার্থীর জিপিএ-৫ হয়নি। গণিতের ফেল ধরেই মোট ফেলের সংখ্যা বেড়ে গেছে।
একজন ছাত্রের ভাষায় : ‘আমরা ম্যাথ খালি বই দেখে পারিনি, কোনো টিচার তো ছিল না ঠিকভাবে পড়ানোর। আর প্রশ্ন আসছে যেমন আইডিয়াল স্কুলের ছাত্রদের জন্য, গ্রামের ছেলেমেয়েরা কিভাবে পারবে?’
উত্তরপত্র মূল্যায়নে ‘কড়াকড়ি’ : সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নমনীয়তা থাকলেও এবার উত্তরপত্র মূল্যায়নে ছিল ‘কড়া মনোভাব’। বোর্ড চেয়ারম্যানের ভাষায়Ñ ‘আমাদের কোনো নির্দেশনা ছিল না নমনীয় হওয়ার। নিরপেক্ষ, মানসম্মতভাবে মূল্যায়ন হয়েছে।’ কিন্তু প্রশ্ন হলোÑ একটি অসম প্রস্তুতিপূর্ণ প্রজন্মকে হঠাৎ কঠোর মূল্যায়নে ফেলে দেওয়া কি ন্যায্য?
গত বছরগুলোতে যেখানে ‘সামঞ্জস্যপূর্ণ নম্বর’ দিয়ে শিক্ষার্থীদের রক্ষা করা হতো, এবার তা হয়নি। ফলে যারা মাঝামাঝি পারফর্ম করেছে, তারাও ফেল করেছে।
বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা অভিযোগ করেছেন : অনেক মূল্যায়নকারী শিক্ষককেও বোর্ড থেকে ‘কড়াকড়ির’ বার্তা দেওয়া হয়। নম্বর দেওয়ার ক্ষেত্রে রেফারেন্স কাঠামো অকার্যকর ছিল। অনেক ক্ষেত্রে উচ্চমানের উত্তরেও নম্বর কম দেওয়া হয়েছে।
রাজনৈতিক অস্থিরতা ও ক্লাসঘাটতি : ২০২৪ ও ২০২৫ সালে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে বহুবার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখা হয়েছে। নির্বাচনকালীন আন্দোলন, অবরোধ, বিক্ষোভ ইত্যাদি সরাসরি শিক্ষার্থীদের ক্লাসে অংশগ্রহণে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। শুধু শহর নয়, মফস্বল ও গ্রামাঞ্চলের স্কুলগুলোতে শিক্ষকেরা সময়মতো আসতে পারতেন না, অনেক বিদ্যালয়ে দিনভর মাত্র ১-২ ক্লাস হতো। এই দীর্ঘ ক্লাসঘাটতির ফলেÑশিক্ষার্থীরা ধারণাভিত্তিক প্রশ্নে দুর্বল হয়ে পড়ে। ব্যাকরণ, গণিত ও বিজ্ঞানে দূর্বলতা বাড়ে। আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলে অনেকে।
মানসিক চাপ ও হতাশা : ফল খারাপ হওয়ায় অনেক শিক্ষার্থীর মধ্যে মানসিক বিপর্যয় তৈরি হয়েছে। ফল ঘোষণার দিন থেকেই দেশব্যাপী সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এমন অসংখ্য শিক্ষার্থীর পোস্ট দেখা গেছেÑ যেখানে তারা কাঁদছে, হতাশ, আত্মবিশ্বাসহীন।
এই পরিস্থিতিতে তাদের পাশে দাঁড়ানোর বদলে সমাজের একটা অংশ বলছেÑ ‘তোমরা ফেইল করেছো, এটা তোমাদের ব্যর্থতা।’ কিন্তু বাস্তবতা বলছে, এটি ছিল এক অসম প্রতিযোগিতা, যেখানে প্রস্তুতির সময় না দিয়েই শিক্ষার্থীদের পারফর্ম করতে বলা হয়েছে।
শিক্ষা ব্যবস্থার কাঠামোগত সংকট : পরীক্ষার ফলাফল খারাপ হওয়া মানে কেবল শিক্ষার্থীদের দুর্বলতা নয়Ñএটি নির্দেশ করে আমাদের পুরো শিক্ষা ব্যবস্থার দুর্বলতা। কিছু উদাহরণÑ শিক্ষকেরা পরীক্ষার আগেই প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ পাননি। সব বোর্ডে মানসম্পন্ন প্রশ্ন তৈরি হয়নি। গ্রামীণ স্কুলগুলোতে এখনো ইন্টারনেট, মাল্টিমিডিয়া ও লাইব্রেরির অভাব। বই পাঠানোর সময়, অনুশীলনের সুযোগ কম।
ভবিষ্যতের পথ : এখন প্রশ্ন হলো, এই সংকট থেকে উত্তরণ সম্ভব কি? সম্ভবÑতবে এর জন্য প্রয়োজন কিছু সুস্পষ্ট, বাস্তবভিত্তিক পদক্ষেপ। নিচে কয়েকটি সুপারিশ উপস্থাপন করা হলো :
শিখন ঘাটতি পূরণে জাতীয় কর্মসূচি : ২০২৫ সালের ফলাফলের আলোকে বিশেষ ‘লার্নিং ক্যাচ-আপ প্রোগ্রাম’ চালু করা জরুরি। অতিরিক্ত কোচিং নয়Ñবিদ্যালয়ভিত্তিক বিনামূল্যে ৎবসবফরধষ পষধংংবং চালু করা। ওঈঞ ব্যবহার করে ‘রিভিশন কোর্স’ পরিচালনা।
মূল্যায়ন পদ্ধতিতে ভারসাম্য : নম্বর প্রদানের ক্ষেত্রে ‘মডারেশন’ বা ‘স্কেলিং’ নীতি বিবেচনায় আনা। উত্তরপত্র মূল্যায়নে শুধু ভুল খোঁজার বদলে শিক্ষার্থীর ধারণা যাচাই। শিক্ষক প্রশিক্ষণে নতুন মূল্যায়ন কৌশল শেখানো।
বোর্ডভিত্তিক বিশ্লেষণ করে অঞ্চলভিত্তিক সমাধান : বরিশাল ও ময়মনসিংহের ফল খারাপ হওয়ায় বিশেষ শিক্ষাভিত্তিক বাজেট বরাদ্দ। শিক্ষক সংকট নিরসনে স্থানীয় নিয়োগ প্রক্রিয়া। শিক্ষা ব্যবস্থায় অঞ্চলভিত্তিক ভিন্ন কৌশল প্রয়োগ।
প্রশ্ন তৈরি ও পরীক্ষা পদ্ধতির সংস্কার : প্রশ্নের মান সহজ, মধ্যম ও কঠিনÑএই তিন স্তরে ভাগ করা। প্রশ্ন তৈরির সময় গ্রাম ও শহরের শিক্ষার্থীদের বাস্তবতা বিবেচনায় আনা। কেবল মুখস্থ নয়Ñধারণাভিত্তিক, সৃজনশীল মূল্যায়ন নিশ্চিত করা।
মনোসামাজিক সহায়তা : ফল খারাপ হওয়ায় হতাশ শিক্ষার্থীদের জন্য স্কুলভিত্তিক কাউন্সেলিং সেবা। মিডিয়া ও সমাজের দায়িত্বশীল ভূমিকাÑফেল মানেই ব্যর্থতা নয় এই বার্তা দেওয়া। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মেন্টরশিপ ও সহানুভূতির পরিবেশ নিশ্চিত করা।
শিক্ষা মানেই শুধু ফল নয়Ñমানবিকতার উন্মেষ : ২০২৫ সালের এসএসসি ফলাফল কেবল একটি পরীক্ষা নয়Ñএটি বাংলাদেশের শিক্ষা বাস্তবতার এক দগদগে প্রতিচ্ছবি। একটি প্রজন্মকে প্রস্তুতির সুযোগ না দিয়ে মূল্যায়ন করা, কঠিন প্রশ্নে দমবন্ধ করে দেওয়া, কড়াকড়ি দিয়ে আত্মবিশ্বাসে আঘাত হানাÑএ সবই আজ প্রশ্নের মুখে ফেলেছে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থাকে।
শিক্ষা মানেই কি কেবল পাশ বা ফেল? না, শিক্ষা মানে একটি মানুষ গড়ে তোলা, একটি আত্মবিশ্বাসী ভবিষ্যৎ নির্মাণ। সেই প্রজন্ম যখন আমরা হারিয়ে ফেলি, তখন ক্ষতি শুধু ব্যক্তিগত নয়Ñজাতিরও। এখনই সময় আত্মসমালোচনার, সময় উন্নয়নের কৌশল খোঁজার। না হলে এই প্রজন্ম শুধু ফলেই ফেল করবে নাÑজীবনের যুদ্ধে হারবে। আমাদের নীতি-নির্ধারকদের উচিত এ ফলাফলকে সতর্ক সংকেত হিসেবে বিবেচনা করে দ্রুত, সুদূরপ্রসারি ও বাস্তবভিত্তিক পদক্ষেপ নেওয়া।
[লেখক : ডেপুটি রেজিস্ট্রার, পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়]
ইমাদুল হক প্রিন্স
সোমবার, ১৪ জুলাই ২০২৫
২০২৫ সালের এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষার ফলাফল বাংলাদেশের শিক্ষা ইতিহাসে এক নতুন প্রশ্নের জন্ম দিয়েছেÑশুধু ফলাফল কেন খারাপ হলো, তাই নয়; কেন এই খারাপ ফলাফলের পেছনে এতগুলো কারণ একযোগে কাজ করল?
অনেক শিক্ষার্থীই যখন স্বপ্ন বুনেছিল জিপিএ-৫ পাওয়ার, তখন তারা বাস্তবেই জানত নাÑতাদের ওপর একটি কঠিন মূল্যায়ন ঝরে পড়তে চলেছে। কেউ কেউ হয়তো বলবে, এটি ‘বাস্তবের কাছে ফিরিয়ে আনার ফলাফল’; কিন্তু প্রশ্ন রয়ে যায়Ñতাদের প্রস্তুতি কি যথেষ্ট ছিল? কিংবা প্রস্তুতির সুযোগ তারা আদৌ পেয়েছিল কি?
করোনা মহামারির ধাক্কা, রাজনৈতিক অস্থিরতা, বিদ্যালয়ে পাঠদানের ঘাটতি, প্রশ্নের কঠিনতা এবং এবার উত্তরপত্র মূল্যায়নে কড়াকড়িÑএসবের সম্মিলিত প্রতিচ্ছবি আমরা দেখতে পাচ্ছি এই ফলাফলে। শুধু ফল খারাপ হয়নি, ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে একটি প্রজন্মের আত্মবিশ্বাস। যাদের জীবনের প্রথম বড় পরীক্ষা, তারা আজ যেন ‘সিস্টেমের ভুলের বলি’। এমন বাস্তবতায় আমরা কি তাদের ব্যর্থ বলব, নাকি ব্যর্থ বলব আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থাকেই?
২০২৫ সালের এসএসসি পরীক্ষার ফল খারাপ হওয়ার পেছনে একক কোনো কারণ দায়ী নয়Ñবরং এটি বহুস্তর, বহু মাত্রিক সমস্যার ফল। শিক্ষার্থীরা ছিল মানসিক ও পাঠ্য দুর্বলতায় বিপর্যস্ত, পাঠদান ছিল ক্ষীণ, প্রশ্ন ছিল কঠিন, মূল্যায়ন ছিল কড়া। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় যে বিষয়টি উঠে এসেছে তা হলোÑগত পাঁচ বছরে শিক্ষার্থীরা পূর্ণ শিক্ষাজীবন পায়নি।
করোনাকালীন ক্ষতি : একটি ‘অপূর্ণ শিক্ষা প্রজন্ম’ : ২০২০ সালের মার্চে যখন দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায়, তখন বর্তমানে এসএসসি দেওয়া শিক্ষার্থীরা ষষ্ঠ শ্রেণিতে ছিল। টানা দেড় বছর শিক্ষা কার্যক্রম পুরোপুরি বন্ধ থাকায় তাদের শিক্ষার ভিত্তিটাই দুর্বল হয়ে পড়ে। এরপর দ্বিতীয় দফায় ২০২২ সালের জানুয়ারিতে আবার এক মাস স্কুল বন্ধ থাকে। এত দীর্ঘ সময় অনুপস্থিত ক্লাস শিক্ষার্থীদের ‘বেসিক শিক্ষা’ অর্জনে মারাত্মক অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়।
তাদের শিক্ষাজীবন ছিল এমনÑ ষষ্ঠ শ্রেণি (২০২০) : শিক্ষাবর্ষের মাঝামাঝি ক্লাস বন্ধ। সপ্তম শ্রেণি (২০২১) : সীমিত সময় ক্লাস, অনলাইন অকার্যকর। অষ্টম-নবম শ্রেণি (২০২২-২৩) : পর্যাপ্ত ক্লাস না পেয়ে ‘পড়াশোনায় ফাঁক’। দশম শ্রেণি (২০২৪) : হঠাৎ পূর্ণ সিলেবাসে পরীক্ষা প্রস্তুতির চাপ। অর্থাৎ এই শিক্ষার্থীরা পাঁচ বছরে যেটুকু ক্লাস করার কথা ছিল, তার অর্ধেকেরও কম পেয়েছে। শিক্ষকের সরাসরি দিকনির্দেশনা ছাড়াই একটি প্রজন্মকে পাঠ্যপুস্তক মুখস্থ করে পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে স্থানীয় পর্যায়ে অনলাইন ক্লাস-এর সুযোগ ছিল না, ছিল না পর্যাপ্ত বই ও গাইড ব্যবস্থাও।
কঠিন প্রশ্নের প্রভাব : বিশেষত গণিতে ‘ধস’ : ২০২৫ সালে এসএসসি পরীক্ষার প্রশ্ন ছিল পূর্ণ পাঠ্যসূচির আলোকে এবং অনেক বিষয়ের প্রশ্ন ছিল তুলনামূলক কঠিন। বোর্ড কর্তৃপক্ষ দাবি করলেও প্রশ্ন সহজ ছিল নাÑবিশেষত গণিতে। গণিত এমন একটি বিষয়, যেটি একদিনে শেখা যায় না। এটি চর্চার বিষয়। কিন্তু চর্চার জন্য প্রয়োজন নিয়মিত গাইডেন্স, ক্লাস, সহায়ক উপকরণÑযা এই প্রজন্ম পুরোপুরি পায়নি। ফলে গণিতে পাসের হার কমেছে সব বোর্ডেই। এক বিষয়ের কারণে অনেক শিক্ষার্থীর জিপিএ-৫ হয়নি। গণিতের ফেল ধরেই মোট ফেলের সংখ্যা বেড়ে গেছে।
একজন ছাত্রের ভাষায় : ‘আমরা ম্যাথ খালি বই দেখে পারিনি, কোনো টিচার তো ছিল না ঠিকভাবে পড়ানোর। আর প্রশ্ন আসছে যেমন আইডিয়াল স্কুলের ছাত্রদের জন্য, গ্রামের ছেলেমেয়েরা কিভাবে পারবে?’
উত্তরপত্র মূল্যায়নে ‘কড়াকড়ি’ : সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নমনীয়তা থাকলেও এবার উত্তরপত্র মূল্যায়নে ছিল ‘কড়া মনোভাব’। বোর্ড চেয়ারম্যানের ভাষায়Ñ ‘আমাদের কোনো নির্দেশনা ছিল না নমনীয় হওয়ার। নিরপেক্ষ, মানসম্মতভাবে মূল্যায়ন হয়েছে।’ কিন্তু প্রশ্ন হলোÑ একটি অসম প্রস্তুতিপূর্ণ প্রজন্মকে হঠাৎ কঠোর মূল্যায়নে ফেলে দেওয়া কি ন্যায্য?
গত বছরগুলোতে যেখানে ‘সামঞ্জস্যপূর্ণ নম্বর’ দিয়ে শিক্ষার্থীদের রক্ষা করা হতো, এবার তা হয়নি। ফলে যারা মাঝামাঝি পারফর্ম করেছে, তারাও ফেল করেছে।
বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা অভিযোগ করেছেন : অনেক মূল্যায়নকারী শিক্ষককেও বোর্ড থেকে ‘কড়াকড়ির’ বার্তা দেওয়া হয়। নম্বর দেওয়ার ক্ষেত্রে রেফারেন্স কাঠামো অকার্যকর ছিল। অনেক ক্ষেত্রে উচ্চমানের উত্তরেও নম্বর কম দেওয়া হয়েছে।
রাজনৈতিক অস্থিরতা ও ক্লাসঘাটতি : ২০২৪ ও ২০২৫ সালে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে বহুবার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখা হয়েছে। নির্বাচনকালীন আন্দোলন, অবরোধ, বিক্ষোভ ইত্যাদি সরাসরি শিক্ষার্থীদের ক্লাসে অংশগ্রহণে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। শুধু শহর নয়, মফস্বল ও গ্রামাঞ্চলের স্কুলগুলোতে শিক্ষকেরা সময়মতো আসতে পারতেন না, অনেক বিদ্যালয়ে দিনভর মাত্র ১-২ ক্লাস হতো। এই দীর্ঘ ক্লাসঘাটতির ফলেÑশিক্ষার্থীরা ধারণাভিত্তিক প্রশ্নে দুর্বল হয়ে পড়ে। ব্যাকরণ, গণিত ও বিজ্ঞানে দূর্বলতা বাড়ে। আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলে অনেকে।
মানসিক চাপ ও হতাশা : ফল খারাপ হওয়ায় অনেক শিক্ষার্থীর মধ্যে মানসিক বিপর্যয় তৈরি হয়েছে। ফল ঘোষণার দিন থেকেই দেশব্যাপী সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এমন অসংখ্য শিক্ষার্থীর পোস্ট দেখা গেছেÑ যেখানে তারা কাঁদছে, হতাশ, আত্মবিশ্বাসহীন।
এই পরিস্থিতিতে তাদের পাশে দাঁড়ানোর বদলে সমাজের একটা অংশ বলছেÑ ‘তোমরা ফেইল করেছো, এটা তোমাদের ব্যর্থতা।’ কিন্তু বাস্তবতা বলছে, এটি ছিল এক অসম প্রতিযোগিতা, যেখানে প্রস্তুতির সময় না দিয়েই শিক্ষার্থীদের পারফর্ম করতে বলা হয়েছে।
শিক্ষা ব্যবস্থার কাঠামোগত সংকট : পরীক্ষার ফলাফল খারাপ হওয়া মানে কেবল শিক্ষার্থীদের দুর্বলতা নয়Ñএটি নির্দেশ করে আমাদের পুরো শিক্ষা ব্যবস্থার দুর্বলতা। কিছু উদাহরণÑ শিক্ষকেরা পরীক্ষার আগেই প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ পাননি। সব বোর্ডে মানসম্পন্ন প্রশ্ন তৈরি হয়নি। গ্রামীণ স্কুলগুলোতে এখনো ইন্টারনেট, মাল্টিমিডিয়া ও লাইব্রেরির অভাব। বই পাঠানোর সময়, অনুশীলনের সুযোগ কম।
ভবিষ্যতের পথ : এখন প্রশ্ন হলো, এই সংকট থেকে উত্তরণ সম্ভব কি? সম্ভবÑতবে এর জন্য প্রয়োজন কিছু সুস্পষ্ট, বাস্তবভিত্তিক পদক্ষেপ। নিচে কয়েকটি সুপারিশ উপস্থাপন করা হলো :
শিখন ঘাটতি পূরণে জাতীয় কর্মসূচি : ২০২৫ সালের ফলাফলের আলোকে বিশেষ ‘লার্নিং ক্যাচ-আপ প্রোগ্রাম’ চালু করা জরুরি। অতিরিক্ত কোচিং নয়Ñবিদ্যালয়ভিত্তিক বিনামূল্যে ৎবসবফরধষ পষধংংবং চালু করা। ওঈঞ ব্যবহার করে ‘রিভিশন কোর্স’ পরিচালনা।
মূল্যায়ন পদ্ধতিতে ভারসাম্য : নম্বর প্রদানের ক্ষেত্রে ‘মডারেশন’ বা ‘স্কেলিং’ নীতি বিবেচনায় আনা। উত্তরপত্র মূল্যায়নে শুধু ভুল খোঁজার বদলে শিক্ষার্থীর ধারণা যাচাই। শিক্ষক প্রশিক্ষণে নতুন মূল্যায়ন কৌশল শেখানো।
বোর্ডভিত্তিক বিশ্লেষণ করে অঞ্চলভিত্তিক সমাধান : বরিশাল ও ময়মনসিংহের ফল খারাপ হওয়ায় বিশেষ শিক্ষাভিত্তিক বাজেট বরাদ্দ। শিক্ষক সংকট নিরসনে স্থানীয় নিয়োগ প্রক্রিয়া। শিক্ষা ব্যবস্থায় অঞ্চলভিত্তিক ভিন্ন কৌশল প্রয়োগ।
প্রশ্ন তৈরি ও পরীক্ষা পদ্ধতির সংস্কার : প্রশ্নের মান সহজ, মধ্যম ও কঠিনÑএই তিন স্তরে ভাগ করা। প্রশ্ন তৈরির সময় গ্রাম ও শহরের শিক্ষার্থীদের বাস্তবতা বিবেচনায় আনা। কেবল মুখস্থ নয়Ñধারণাভিত্তিক, সৃজনশীল মূল্যায়ন নিশ্চিত করা।
মনোসামাজিক সহায়তা : ফল খারাপ হওয়ায় হতাশ শিক্ষার্থীদের জন্য স্কুলভিত্তিক কাউন্সেলিং সেবা। মিডিয়া ও সমাজের দায়িত্বশীল ভূমিকাÑফেল মানেই ব্যর্থতা নয় এই বার্তা দেওয়া। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মেন্টরশিপ ও সহানুভূতির পরিবেশ নিশ্চিত করা।
শিক্ষা মানেই শুধু ফল নয়Ñমানবিকতার উন্মেষ : ২০২৫ সালের এসএসসি ফলাফল কেবল একটি পরীক্ষা নয়Ñএটি বাংলাদেশের শিক্ষা বাস্তবতার এক দগদগে প্রতিচ্ছবি। একটি প্রজন্মকে প্রস্তুতির সুযোগ না দিয়ে মূল্যায়ন করা, কঠিন প্রশ্নে দমবন্ধ করে দেওয়া, কড়াকড়ি দিয়ে আত্মবিশ্বাসে আঘাত হানাÑএ সবই আজ প্রশ্নের মুখে ফেলেছে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থাকে।
শিক্ষা মানেই কি কেবল পাশ বা ফেল? না, শিক্ষা মানে একটি মানুষ গড়ে তোলা, একটি আত্মবিশ্বাসী ভবিষ্যৎ নির্মাণ। সেই প্রজন্ম যখন আমরা হারিয়ে ফেলি, তখন ক্ষতি শুধু ব্যক্তিগত নয়Ñজাতিরও। এখনই সময় আত্মসমালোচনার, সময় উন্নয়নের কৌশল খোঁজার। না হলে এই প্রজন্ম শুধু ফলেই ফেল করবে নাÑজীবনের যুদ্ধে হারবে। আমাদের নীতি-নির্ধারকদের উচিত এ ফলাফলকে সতর্ক সংকেত হিসেবে বিবেচনা করে দ্রুত, সুদূরপ্রসারি ও বাস্তবভিত্তিক পদক্ষেপ নেওয়া।
[লেখক : ডেপুটি রেজিস্ট্রার, পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়]