alt

উপ-সম্পাদকীয়

এসএসসিতে গণিত বিষয়ে ফল বিপর্যয় : কারণ ও উত্তরণের উপায়

পেয়ার আহম্মেদ

: বুধবার, ১৬ জুলাই ২০২৫

২০২৫ সালের এসএসসি পরীক্ষার ফলাফল আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার এক নির্মম বাস্তবতাকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেÑবিশেষ করে গণিত ও ইংরেজি বিষয়ে আমাদের শিক্ষার ভিত্তি যে কতটা দুর্বল ও নড়বড়ে, তা এখন আর অস্বীকার করার সুযোগ নেই। এই বছরের ফলাফল বিশ্লেষণে দেখা যায়, ১১টি শিক্ষা বোর্ডে গড় পাসের হার গণিতে মাত্র ৭৭.৪৬ শতাংশ, যেখানে বাংলায় এই হার ৯৭.২৭ শতাংশ, রসায়নে ৯৪.৭৬ শতাংশ এবং পদার্থবিজ্ঞানে ৯৪.০২ শতাংশ। বরিশাল বোর্ডে অবস্থা সবচেয়ে করুণÑসেখানে গণিতে ফেল করেছে ৩৫.৩৮ শতাংশ শিক্ষার্থী। ইংরেজিতেও প্রায় একইরকম ভয়াবহ চিত্র। প্রশ্ন জাগেÑকেন এত শিক্ষার্থী গণিতে ফেল করছে? এর পেছনে রয়েছে একাধিক গভীর ও কাঠামোগত সমস্যা, যা আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার মৌলিক দুর্বলতাকে তুলে ধরে।

বাংলাদেশ শিক্ষা-তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরো (ব্যানবেইস) প্রকাশিত তথ্য বলছে, দেশের মাধ্যমিক পর্যায়ের স্কুলগুলোতে ৬৪ হাজার ১৪৭ জন গণিত শিক্ষক রয়েছেন। কিন্তু তাদের মধ্যে মাত্র ১৩.২২ শতাংশ শিক্ষক গণিতে অনার্স বা মাস্টার্স করেছেন। অর্থাৎ, প্রায় ৮৬.৭৮ শতাংশ গণিত শিক্ষকই গণিত বিষয়ে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে অদক্ষ।

ব্যানবেইসের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গণিত শিক্ষকদের মধ্যে ১৮.৭২ শতাংশ পদার্থ-রসায়নের সঙ্গে মিলিয়ে বিএসসি করেছেন, আর ১২.০৭ শতাংশ অন্য বিষয়ের সঙ্গে গণিত নিয়ে বিএসসি করেছেন। সুতরাং, এই পরিস্থিতিতে গণিতে বিশেষজ্ঞ শিক্ষক না থাকায় শিক্ষার্থীরা সঠিকভাবে গণিত শেখার অভিজ্ঞতা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।

গণিতভীতি শুধু মাধ্যমিকে নয়, শুরু হয় প্রাথমিক থেকেই। জাতীয় প্রাথমিক শিক্ষা একাডেমি (নেপ)-এর ২০১৯ সালের এক গবেষণা জানায়, ময়মনসিংহে পরিচালিত এক জরিপে অংশ নেয়া শতভাগ প্রাথমিক শিক্ষক গণিতকে কঠিন বিষয় হিসেবে অভিহিত করেছেন। গবেষণায় দেখা গেছে, সহকারী শিক্ষক থেকে শুরু করে উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা পর্যন্ত সকলেই গণিত শেখাতে কঠিনতা অনুভব করেন।

প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, জরিপে সহকারী শিক্ষক, প্রধান শিক্ষক, সহকারী উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা, ইউআরসি ইনস্ট্রাক্টরসহ মোট ৪০০ জন শিক্ষক-কর্মকর্তা অংশ নেন। জরিপে অংশ নেওয়া সহকারী শিক্ষকদের ১৬ শতাংশ শূন্য থেকে পাঁচ বছর, ১৯ শতাংশ পাঁচ থেকে ১০ বছর, ৩৭ শতাংশ ১০ থেকে ১৫ বছর, ৯ শতাংশ ১৫ থেকে ২০ বছর এবং ১৯ শতাংশ ২০ বছরের বেশি সময় ধরে পাঠদানে নিয়োজিত রয়েছেন। তাদের শতভাগই গণিত বিষয়ে পাঠদানকে কঠিন বলে মত দেন। এটি একটি ভয়াবহ সংকেত, যা ইঙ্গিত দেয়Ñগণিত শেখানোর ভিত্তি আমাদের গোড়া থেকেই দুর্বল।

একসময়ের গর্বিত বিষয় গণিত এখন অনেক শিক্ষার্থীর কাছে আতঙ্ক। সাজেশন-নির্ভর পড়াশোনা, গাইড বই মুখস্থ করে পরীক্ষায় পাসের প্রতিযোগিতা, মৌলিক অনুধাবনের চেয়ে নম্বর নির্ভর মানসিকতাÑএই ভাঙা কাঠামোতেই আমরা ছাত্রদের ঠেলে দিচ্ছি। গণিত যেহেতু বোঝার বিষয়, মুখস্থ করে সফল হওয়া সম্ভব নয়Ñএটাই আমাদের অনুধাবনে আসছে না।

গণিতে ফেলের কারণ:

১. অদক্ষ শিক্ষক নিয়োগ:

বর্তমানে অনেক প্রতিষ্ঠানে ইতিহাস, দর্শন কিংবা সমাজবিজ্ঞানের গ্র্যাজুয়েটদের দিয়ে গণিত পড়ানো হচ্ছে, যা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক। গাইনি ডাক্তার দিয়ে হার্ট সার্জারি করালে যেমন বিপদ, তেমনি বিষয়ভিত্তিক অদক্ষ শিক্ষকের হাতে গণিত পড়ানো এক ধরনের জাতীয় দুর্ভাগ্য।

২. প্রশ্ন প্রণয়নে অদক্ষতা ও মূল্যায়নে ঘাটতি:

শিক্ষকগণ অদক্ষ হলে প্রশ্নপত্র প্রণয়ন ও খাতা মূল্যায়নে অবিচার হবেই। পরীক্ষায় শিক্ষার্থীর মেধার গভীরতা না বুঝে প্রশ্ন প্রণয়ন করা হয় এবং স্পষ্ট জ্ঞান না থাকায় খাতা মূল্যায়নে অবিচার করা হয়।

৩. প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে ভিত্তি দুর্বল:

গণিত শেখার বীজ রোপণ করতে হয় প্রাথমিক স্তর থেকেই। কিন্তু সেখানে পর্যাপ্ত পদ্ধতিগত পরিবর্তন না আনলে উপরের স্তরে ব্যর্থতা অনিবার্য।

গণিতে ফেল মানেই জাতির মেধার অপচয়। কিন্তু গণিতে ফেলের কোনো সুযোগই থাকার কথা নয়, যদি আমরা সঠিক সময়ে, সঠিক পদ্ধতিতে ও সঠিক শিক্ষক দিয়ে শিক্ষা দেই।

আমার দৃষ্টিতে প্রত্যেক শিক্ষার্থীর পক্ষে গণিতে ১০০ নম্বরে ১০০ নম্বর পাওয়া সম্ভব।

উত্তরণের উপায়সমূহ:

১. গণিতের ওপর বি.এসসি., এম.এসসি. ও সম্ভাব্য ক্ষেত্রে পিএইচডি ডিগ্রীধারী বিশেষজ্ঞদের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ প্রদান করা

২. প্রথম শ্রেণি থেকে গণিতে ভিতি দূরীকরণ ও গণিতকে জনপ্রিয় করে তোলার প্রয়োজনীয় রেকমান্ডেশন দেয়া।

৩. সৃজনশীল, উদ্ভাবনী ও বাস্তবমুখী গণিত পাঠক্রম চালু করা

৪. শিক্ষকদের বাধ্যতামূলক গণিতবিষয়ক টিচার্স ট্রেনিং দেয়া

৫. সঠিক খাতা মূল্যায়নের জন্য স্বচ্ছ প্রশিক্ষণ ও স্বয়ংক্রিয় মূল্যায়ন পদ্ধতি চালু

৬.ভার্চুয়াল ও অও সহায়ক গণিত শেখার প্ল্যাটফর্ম তৈরি (বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে)

গণিতে ফেল মানেই জাতির ব্যর্থতা

গণিতে ব্যর্থতা মানেই উন্নয়নের পথে অন্ধকার। এক বিশাল সম্ভাবনাময়ী তরুণ জনগোষ্ঠীর সামনে, ফেলের কারণে অন্ধকার হতাশা নেমে আসছে। কেউ কেউ আত্মহত্যার পথও বেচে নিচ্ছে।

একটি জাতির উন্নতির পেছনে স্টেম অর্থাৎ বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, ইঞ্জিনিয়ারিং ও গণিতÑএই চারটি ক্ষেত্র একটি জাতির জ্ঞানভিত্তিক উন্নয়নের ভিত্তি। আধুনিক বিশ্বের যে সমস্ত দেশ জ্ঞান, প্রযুক্তি ও অর্থনীতিতে নেতৃত্ব দিচ্ছে, তারা প্রত্যেকেই প্রাথমিক থেকেই স্টেম শিক্ষার প্রতি অগ্রাধিকার দিয়েছে। কারণ, স্টেম শিক্ষা শুধু চারটি আলাদা বিষয়ের সমষ্টি নয়, বরং এটি বিশ্লেষণধর্মী চিন্তা, সমস্যা সমাধানের দক্ষতা, সৃজনশীলতা ও উদ্ভাবনী মনোভাব গঠনের এক পূর্ণাঙ্গ কাঠামো।

দেশে স্টেম শিক্ষা নিয়ে আমাদের রয়েছে দীর্ঘদিনের মহাপরিকল্পনা, যা বিগত দিনে সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের কাছে বারবার প্রস্তাবনা দিলেও, অজানা ও অদৃশ্য কারণে সে উদ্যোগ বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি। আমরা সারা দেশের শিক্ষার্থীদের মাঝে স্টিম শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিতে চাই, আমরা শিক্ষার্থীদের গণিতভীতি দূর করতে চাই। সরকার যদি আমাদের স্টেম পরিকল্পনাকে গুরুত্ব দিয়ে বাস্তবায়নে সহায়তা করে, তবে অচিরেই বাংলাদেশে গণিতে শতভাগ সফলতা আসবে, গণিতভীতি ইতিহাসে পরিণত হবে এবং স্টেমনির্ভর একটি উদ্ভাবনী বাংলাদেশ গড়ে উঠবে।

“গণিত ভয়ের নয়, ভালোবাসার বিষয়”

আজ সময় এসেছে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থাকে মুখস্থনির্ভরতা থেকে মুক্ত করে বিশ্লেষণধর্মী শিক্ষায় রূপান্তরের। দেশের স্বনামধন্য গবেষক ও নীতি নির্ধারকরা যদি নেতৃত্বে আসেন, তবে ভবিষ্যতের বাংলাদেশ হবে গণিতে দক্ষ, চিন্তাশীল ও আধুনিক।

[লেখক : অধ্যাপক, গণিত বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়]

রম্যগদ্য : ‘ব্যাংক, ব্যাংক নয়’

মবতন্ত্রের জয়

ডিজিটাল ক্লান্তি ও ‘সর্বক্ষণ সক্রিয়’ সংস্কৃতির শ্রেণীগত রাজনীতি

ছবি

বোধের স্ফূরণ, না ‘মেটিকুলাস ডিজাইন’?

দক্ষ মানবসম্পদ ও সমৃদ্ধ গ্রন্থাগার

আফ্রিকায় হঠাৎ কেন যুক্তরাষ্ট্রের ঝোঁক?

ঢাকা মহানগর ও বুড়িগঙ্গা

জামাই মেলা : উৎসব, ঐতিহ্য ও কৃষ্টির রঙিন চিত্রপট

হারিয়ে যাওয়া ক্লাস, কঠোর মূল্যায়ন আর প্রশ্নের জটিলতায় নুয়ে পড়া এক প্রজন্ম

বৈষম্য দূর করে নতুন বাংলাদেশ গড়ে তুলুন

চিকিৎসা যেন বাণিজ্যের হাতিয়ারে পরিণত না হয়

পথশিশু ও বাংলাদেশে সামাজিক চুক্তির ব্যর্থতা

মেগা প্রকল্প : প্রশ্ন হওয়া উচিত স্বচ্ছতা নিয়ে

আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া জরুরি

স্মার্ট দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা : উপগ্রহ চিত্র ও ওয়েবসাইটের অপরিহার্যতা

ক্ষমতা ও জনপ্রশাসন : আমলাতন্ত্রের ছায়াতলে আমজনতা

জনসংখ্যা : সম্পদ না সংকট?

ব্রিকসে নতুন ভূ-রাজনৈতিক ব্যবস্থার উত্থান

রম্যগদ্য : ‘ল্যাংড়া-লুলা, আতুড়-পাতুড়’

আষাঢ়ী পূর্ণিমা : আত্মশুদ্ধির সাধনায় বুদ্ধের অনন্ত আলো

বদলে যাওয়া মাটিতে সাহসী বীজ : জলবায়ুর বিপরীতে বাংলাদেশের কৃষির অভিযোজনগাথা

ছবি

জুলাই অভ্যুত্থান-গাথা : ‘শিকলে নাহি দিব ধরা’

প্রাচীন যৌধেয় জাতি ও তাদের সাম্যবাদী শাসন

গণঅভ্যুত্থান-উত্তর ন্যায়ভিত্তিক রাষ্ট্র বিনির্মাণের স্বপ্ন

টেকসই উন্নয়নের স্বপ্নপূরণে উপগ্রহ চিত্রই চাবিকাঠি

রাবার শিল্প : সংকট, করণীয় ও উত্তরণের দিশা

রম্যগদ্য : দুধ, দই, কলা...

ছবি

কোপার্নিকাস : আলো হয়ে জন্ম নেওয়া বৈপ্লবিক মতবাদের প্রবর্তক

জলবায়ু সংকটে মানবসভ্যতা

টেকসই অর্থনীতির জন্য চাই টেকসই ব্যাংকিং

ডিজিটাল দাসত্ব : মনোযোগ অর্থনীতি ও জ্ঞান পুঁজিবাদে তরুণ প্রজন্মের মননশীলতার অবক্ষয়

অন্তর্বর্তীকালীন সরকার : আস্থা ভঙ্গ ও জবাবদিহিতার সংকট

আসামি এখন নির্বাচন কমিশন

কোথায় হারাল একান্নবর্তী পরিবার?

এই শান্তি কি মহাঝড়ের পূর্বলক্ষণ?

মেগাসিটি : দারিদ্র্য যখন ‘অবাঞ্ছিত বর্জ্য’

tab

উপ-সম্পাদকীয়

এসএসসিতে গণিত বিষয়ে ফল বিপর্যয় : কারণ ও উত্তরণের উপায়

পেয়ার আহম্মেদ

বুধবার, ১৬ জুলাই ২০২৫

২০২৫ সালের এসএসসি পরীক্ষার ফলাফল আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার এক নির্মম বাস্তবতাকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেÑবিশেষ করে গণিত ও ইংরেজি বিষয়ে আমাদের শিক্ষার ভিত্তি যে কতটা দুর্বল ও নড়বড়ে, তা এখন আর অস্বীকার করার সুযোগ নেই। এই বছরের ফলাফল বিশ্লেষণে দেখা যায়, ১১টি শিক্ষা বোর্ডে গড় পাসের হার গণিতে মাত্র ৭৭.৪৬ শতাংশ, যেখানে বাংলায় এই হার ৯৭.২৭ শতাংশ, রসায়নে ৯৪.৭৬ শতাংশ এবং পদার্থবিজ্ঞানে ৯৪.০২ শতাংশ। বরিশাল বোর্ডে অবস্থা সবচেয়ে করুণÑসেখানে গণিতে ফেল করেছে ৩৫.৩৮ শতাংশ শিক্ষার্থী। ইংরেজিতেও প্রায় একইরকম ভয়াবহ চিত্র। প্রশ্ন জাগেÑকেন এত শিক্ষার্থী গণিতে ফেল করছে? এর পেছনে রয়েছে একাধিক গভীর ও কাঠামোগত সমস্যা, যা আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার মৌলিক দুর্বলতাকে তুলে ধরে।

বাংলাদেশ শিক্ষা-তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরো (ব্যানবেইস) প্রকাশিত তথ্য বলছে, দেশের মাধ্যমিক পর্যায়ের স্কুলগুলোতে ৬৪ হাজার ১৪৭ জন গণিত শিক্ষক রয়েছেন। কিন্তু তাদের মধ্যে মাত্র ১৩.২২ শতাংশ শিক্ষক গণিতে অনার্স বা মাস্টার্স করেছেন। অর্থাৎ, প্রায় ৮৬.৭৮ শতাংশ গণিত শিক্ষকই গণিত বিষয়ে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে অদক্ষ।

ব্যানবেইসের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গণিত শিক্ষকদের মধ্যে ১৮.৭২ শতাংশ পদার্থ-রসায়নের সঙ্গে মিলিয়ে বিএসসি করেছেন, আর ১২.০৭ শতাংশ অন্য বিষয়ের সঙ্গে গণিত নিয়ে বিএসসি করেছেন। সুতরাং, এই পরিস্থিতিতে গণিতে বিশেষজ্ঞ শিক্ষক না থাকায় শিক্ষার্থীরা সঠিকভাবে গণিত শেখার অভিজ্ঞতা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।

গণিতভীতি শুধু মাধ্যমিকে নয়, শুরু হয় প্রাথমিক থেকেই। জাতীয় প্রাথমিক শিক্ষা একাডেমি (নেপ)-এর ২০১৯ সালের এক গবেষণা জানায়, ময়মনসিংহে পরিচালিত এক জরিপে অংশ নেয়া শতভাগ প্রাথমিক শিক্ষক গণিতকে কঠিন বিষয় হিসেবে অভিহিত করেছেন। গবেষণায় দেখা গেছে, সহকারী শিক্ষক থেকে শুরু করে উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা পর্যন্ত সকলেই গণিত শেখাতে কঠিনতা অনুভব করেন।

প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, জরিপে সহকারী শিক্ষক, প্রধান শিক্ষক, সহকারী উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা, ইউআরসি ইনস্ট্রাক্টরসহ মোট ৪০০ জন শিক্ষক-কর্মকর্তা অংশ নেন। জরিপে অংশ নেওয়া সহকারী শিক্ষকদের ১৬ শতাংশ শূন্য থেকে পাঁচ বছর, ১৯ শতাংশ পাঁচ থেকে ১০ বছর, ৩৭ শতাংশ ১০ থেকে ১৫ বছর, ৯ শতাংশ ১৫ থেকে ২০ বছর এবং ১৯ শতাংশ ২০ বছরের বেশি সময় ধরে পাঠদানে নিয়োজিত রয়েছেন। তাদের শতভাগই গণিত বিষয়ে পাঠদানকে কঠিন বলে মত দেন। এটি একটি ভয়াবহ সংকেত, যা ইঙ্গিত দেয়Ñগণিত শেখানোর ভিত্তি আমাদের গোড়া থেকেই দুর্বল।

একসময়ের গর্বিত বিষয় গণিত এখন অনেক শিক্ষার্থীর কাছে আতঙ্ক। সাজেশন-নির্ভর পড়াশোনা, গাইড বই মুখস্থ করে পরীক্ষায় পাসের প্রতিযোগিতা, মৌলিক অনুধাবনের চেয়ে নম্বর নির্ভর মানসিকতাÑএই ভাঙা কাঠামোতেই আমরা ছাত্রদের ঠেলে দিচ্ছি। গণিত যেহেতু বোঝার বিষয়, মুখস্থ করে সফল হওয়া সম্ভব নয়Ñএটাই আমাদের অনুধাবনে আসছে না।

গণিতে ফেলের কারণ:

১. অদক্ষ শিক্ষক নিয়োগ:

বর্তমানে অনেক প্রতিষ্ঠানে ইতিহাস, দর্শন কিংবা সমাজবিজ্ঞানের গ্র্যাজুয়েটদের দিয়ে গণিত পড়ানো হচ্ছে, যা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক। গাইনি ডাক্তার দিয়ে হার্ট সার্জারি করালে যেমন বিপদ, তেমনি বিষয়ভিত্তিক অদক্ষ শিক্ষকের হাতে গণিত পড়ানো এক ধরনের জাতীয় দুর্ভাগ্য।

২. প্রশ্ন প্রণয়নে অদক্ষতা ও মূল্যায়নে ঘাটতি:

শিক্ষকগণ অদক্ষ হলে প্রশ্নপত্র প্রণয়ন ও খাতা মূল্যায়নে অবিচার হবেই। পরীক্ষায় শিক্ষার্থীর মেধার গভীরতা না বুঝে প্রশ্ন প্রণয়ন করা হয় এবং স্পষ্ট জ্ঞান না থাকায় খাতা মূল্যায়নে অবিচার করা হয়।

৩. প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে ভিত্তি দুর্বল:

গণিত শেখার বীজ রোপণ করতে হয় প্রাথমিক স্তর থেকেই। কিন্তু সেখানে পর্যাপ্ত পদ্ধতিগত পরিবর্তন না আনলে উপরের স্তরে ব্যর্থতা অনিবার্য।

গণিতে ফেল মানেই জাতির মেধার অপচয়। কিন্তু গণিতে ফেলের কোনো সুযোগই থাকার কথা নয়, যদি আমরা সঠিক সময়ে, সঠিক পদ্ধতিতে ও সঠিক শিক্ষক দিয়ে শিক্ষা দেই।

আমার দৃষ্টিতে প্রত্যেক শিক্ষার্থীর পক্ষে গণিতে ১০০ নম্বরে ১০০ নম্বর পাওয়া সম্ভব।

উত্তরণের উপায়সমূহ:

১. গণিতের ওপর বি.এসসি., এম.এসসি. ও সম্ভাব্য ক্ষেত্রে পিএইচডি ডিগ্রীধারী বিশেষজ্ঞদের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ প্রদান করা

২. প্রথম শ্রেণি থেকে গণিতে ভিতি দূরীকরণ ও গণিতকে জনপ্রিয় করে তোলার প্রয়োজনীয় রেকমান্ডেশন দেয়া।

৩. সৃজনশীল, উদ্ভাবনী ও বাস্তবমুখী গণিত পাঠক্রম চালু করা

৪. শিক্ষকদের বাধ্যতামূলক গণিতবিষয়ক টিচার্স ট্রেনিং দেয়া

৫. সঠিক খাতা মূল্যায়নের জন্য স্বচ্ছ প্রশিক্ষণ ও স্বয়ংক্রিয় মূল্যায়ন পদ্ধতি চালু

৬.ভার্চুয়াল ও অও সহায়ক গণিত শেখার প্ল্যাটফর্ম তৈরি (বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে)

গণিতে ফেল মানেই জাতির ব্যর্থতা

গণিতে ব্যর্থতা মানেই উন্নয়নের পথে অন্ধকার। এক বিশাল সম্ভাবনাময়ী তরুণ জনগোষ্ঠীর সামনে, ফেলের কারণে অন্ধকার হতাশা নেমে আসছে। কেউ কেউ আত্মহত্যার পথও বেচে নিচ্ছে।

একটি জাতির উন্নতির পেছনে স্টেম অর্থাৎ বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, ইঞ্জিনিয়ারিং ও গণিতÑএই চারটি ক্ষেত্র একটি জাতির জ্ঞানভিত্তিক উন্নয়নের ভিত্তি। আধুনিক বিশ্বের যে সমস্ত দেশ জ্ঞান, প্রযুক্তি ও অর্থনীতিতে নেতৃত্ব দিচ্ছে, তারা প্রত্যেকেই প্রাথমিক থেকেই স্টেম শিক্ষার প্রতি অগ্রাধিকার দিয়েছে। কারণ, স্টেম শিক্ষা শুধু চারটি আলাদা বিষয়ের সমষ্টি নয়, বরং এটি বিশ্লেষণধর্মী চিন্তা, সমস্যা সমাধানের দক্ষতা, সৃজনশীলতা ও উদ্ভাবনী মনোভাব গঠনের এক পূর্ণাঙ্গ কাঠামো।

দেশে স্টেম শিক্ষা নিয়ে আমাদের রয়েছে দীর্ঘদিনের মহাপরিকল্পনা, যা বিগত দিনে সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের কাছে বারবার প্রস্তাবনা দিলেও, অজানা ও অদৃশ্য কারণে সে উদ্যোগ বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি। আমরা সারা দেশের শিক্ষার্থীদের মাঝে স্টিম শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিতে চাই, আমরা শিক্ষার্থীদের গণিতভীতি দূর করতে চাই। সরকার যদি আমাদের স্টেম পরিকল্পনাকে গুরুত্ব দিয়ে বাস্তবায়নে সহায়তা করে, তবে অচিরেই বাংলাদেশে গণিতে শতভাগ সফলতা আসবে, গণিতভীতি ইতিহাসে পরিণত হবে এবং স্টেমনির্ভর একটি উদ্ভাবনী বাংলাদেশ গড়ে উঠবে।

“গণিত ভয়ের নয়, ভালোবাসার বিষয়”

আজ সময় এসেছে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থাকে মুখস্থনির্ভরতা থেকে মুক্ত করে বিশ্লেষণধর্মী শিক্ষায় রূপান্তরের। দেশের স্বনামধন্য গবেষক ও নীতি নির্ধারকরা যদি নেতৃত্বে আসেন, তবে ভবিষ্যতের বাংলাদেশ হবে গণিতে দক্ষ, চিন্তাশীল ও আধুনিক।

[লেখক : অধ্যাপক, গণিত বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়]

back to top