alt

উপ-সম্পাদকীয়

বোধের স্ফূরণ, না ‘মেটিকুলাস ডিজাইন’?

আনোয়ারুল হক

: বুধবার, ১৬ জুলাই ২০২৫
image

’২৪-এর জুলাই। শ্রাবণের অঝোর ধারার মাঝেই তারুণ্যের জাগরণ

সোশ্যাল মিডিয়ায় ইদানীংয়ের বহুল আলোচিত দুটি শব্দ মেটিকুলাস ডিজাইন। জুলাই অভ্যুত্থানের আগে মেটিকুলাস ডিজাইন নিয়ে কখনও এত আলোচনা নজরে আসেনি। এমনকি আন্দোলনের দিনগুলোতেও এ আলোচনা তেমনটা হয়নি। শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকে বিজিত শক্তি ও তাদের সমর্থকদের দিক থেকে এবং কিছু কিছু রাজনৈতিক বিশ্লেষকের কাছ থেকে বিগত ১১ মাস যাবত আমরা শুনে আসছি “সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা ও ছক মাফিক এক ষড়যন্ত্রমূলক ঘটনাবলির মধ্য দিয়ে সরকার উৎখাত করা হয়েছে। দেশের ‘গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতা’কে ব্যাহত করে অগণতান্ত্রিক শক্তি ও অনির্বাচিত সরকার দেশ পরিচালনা করছে।” তাদের উল্লেখিত এই ‘ষড়যন্ত্র তত্ত্ব’-কেই সংক্ষেপে বলা হচ্ছে আন্দোলনটি ছিল মেটিকুলাসলি ডিজাইনড।

সাধারণভাবে ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় ভুলত্রুটি এবং অন্যায় অপরাধগুলো সহসা চোখে পড়ে না। উপরন্তু ক্ষমতাসীনদের আশপাশে সরকারি প্রশাসন এবং সমাজে নানা বুদ্ধিবৃত্তিক পেশায় নিয়োজিত এত বেশি তোষামোদকারী সমবেত হয়েছিলেন যাদের অবিরাম তেলবাজিতে ক্ষমতাসীনদের এবং বিশেষত সাবেক প্রধানমন্ত্রীর মনে হতো তারা অজেয়। বিবেকের কণ্ঠস্বর হিসেবে প্রবীণ বুদ্ধিজীবী ২-৪ জন, যারা জীবিত ছিলেন তারা সরকারের নানা কর্মকা-ে অস্বস্তিতে থাকলেও তা প্রকাশ করতেন না।

দেড় দশক আগেও এমনটা ছিল না। তখন সরকার সমর্থক বুদ্ধিজীবীরাও সরকারের গণবিরোধী বা অগণতান্ত্রিক কর্মকা-ের সমালোচনা করতেন, সংশোধনের জন্য পরামর্শ দিতেন। কিন্তু ২০০৮ পরবর্তী বাংলাদেশে আর বিবেকের কণ্ঠস্বর শোনা যায়নি। এ পরিস্থিতির জন্য আওয়ামী লীগের পাশাপাশি বিএনপিরও দায় কম নয়। ২০০১ এর নির্বাচনে বিজয় লাভের পর বিএনপি সরকার গঠন করার সময়ে ’৭১ এর যুদ্ধাপরাধী জামায়াত ইসলামীর নেতাদেরকে মন্ত্রিসভায় স্থান করে দেয়ায় এবং ‘২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার পরে হামলাকারীদের প্রতি সরকারের নমনীয়তা দেখে এবং দেশে জঙ্গীবাদ উত্থানের ভীতি থেকে দেশের বুদ্ধিজীবীদের একটা বড় অংশ - “ন্যায় অন্যায় / জানি নে, জানি নে, জানি নে, / শুধু তোমারে জানি” Ñ আওয়ামী লীগের পক্ষে এমন একটা অবস্থান গ্রহণ করেন। বামপন্থার অনুরাগী অনেক বুদ্ধিজীবীও বামপন্থা থেকে মুখ ঘুরিয়ে আওয়ামী লীগের সমর্থকে পরিণত হন।

২০২৪ এর ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার পর থেকে শেখ হাসিনা তার নিজের জীবন শঙ্কা নিয়ে যে ট্রমায় আচ্ছন্ন হন এবং তার সঙ্গে বুদ্ধিজীবীদের সৃষ্ট এই ‘ন্যায়-অন্যায় জানি নে’ পরিস্থিতিতে ২০০৮-এ ক্ষমতা গ্রহণের পর তেকে শাসকগোষ্ঠী ক্রমান্বয়ে স্বৈরাচার ও স্বেচ্ছাচারকে একধরনের ফ্যাসিবাদী প্রবণতার দিকে নিয়ে যায় এবং যে কোনো ন্যায্য প্রতিবাদকে মনে হতে থাকে ষড়যন্ত্র ও মেটিকুলাস ডিজাইন। আর ‘মেটিকুলাস ডিজাইন’ যদি হয়েও থাকে তার ভ্রƒণ সৃষ্টি করেছিল শাসককূল যে কোনো স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবাদের ওপর নিষ্ঠুর দমনপীড়ন চালিয়ে।

২০১৮ সালে স্কুল-কলেজের শিশু-কিশোরদের নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের কথাই ধরা যাক। ওই বছর ২৯ জুলাই শহীদ রমিজউদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের শিক্ষার্থীরা বাসের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে ছিলেন ঢাকা বিমানবন্দর সড়কে কুর্মিটোলা হাসপাতালের সামনে। দুটি বাসের বেপরোয়া প্রতিযোগিতায় বাস ছাত্রছাত্রীদের ওপর দিয়ে চালিয়ে দেয়। কলেজের দুজন শিক্ষার্থী নিহত হন, আহত হন আরো দশজন। ঘটনার পরপরই বিক্ষোভে ফেটে পড়ে শিক্ষার্থীরা। সেই আন্দোলন দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছিল। রাজপথে নেমে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের আন্দোলন ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। সেই বিক্ষোভ শুধু ঢাকাতেই থেমে থাকেনি, ঢাকাসহ সারাদেশের সব স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের মাঝে ছড়িয়ে পড়ে। সব শহরেই হাজার হাজার ছাত্রছাত্রী নেমে আসে রাজপথে। টানা ১১ দিন ধরে চলে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন।

সড়কে নিরাপত্তা নিশ্চিতের দাবিতে বাংলাদেশে এর আগে বিভিন্ন সময় আন্দোলন হলেও ২০১৮ সালের মতো আলোড়ন আর কখনোই হয়নি। শিক্ষার্থীদের দমাতে লাঠিচার্জ, কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ করে পুলিশ। পাশাপাশি তৎকালীন ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের অঙ্গসংগঠন ছাত্রলীগ, যুবলীগের নেতাকর্মীরা শিক্ষার্থীদের ওপর হামলাও চালায়, যা কিনা আন্দোলনের গতিকে আরও তীব্র করে। ধানমন্ডি ঝিগাতলা এলাকায় আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর কার্যালয় থেকে এসে ছাত্রলীগের হেলমেট বাহিনী এই কিশোর-কিশোরীদের ওপর হামলা করল। ছাত্রলীগ-আওয়ামী লীগ নেতারা কি একবারও ভেবে দেখেনি শিশু-কিশোরদের ওপর এই আক্রমণের প্রতিক্রিয়া কত সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলতে পারে। সারাদেশেই কমবেশি এ ধরনের হামলা ছাত্রলীগ করে। রাজনীতির জ্ঞান, সাধারণ বুঝ যে কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে গড়ে ওঠেনি তাদের পক্ষে বুঝে ওঠা কঠিন ছিল, নিরাপদ সড়কের নিরীহ দাবিকে সমর্থন না করে ছাত্রলীগ কেন তাদের আক্রমণ করছে! এ কেমন ছাত্র সংগঠন!

ছাত্রলীগ আওয়ামী লীগ ওই প্রজন্মের মনোজগতে সেদিন যে ক্ষত সৃষ্টি করেছিল যদি বলি সেদিন থেকেই কথিত ‘মেটিকুলাস ডিজাইন’ ক্রিয়াশীল হয়ে ওঠে। ওই সময়ে সারাদেশের প্রতিটি স্কুল-কলেজের অনেক ছাত্রছাত্রী মোবাইল নম্বর, ফেইসবুক ও অন্যান্য সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে পারষ্পরিক যোগাযোগ সূত্র গড়ে তোলে। তারা তাদের অভিজ্ঞতাগুলো সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে ভাগাভাগি করে নেয়। সে দিনের সেই শিশু-কিশোর-কিশোরীরাই কিন্তু ২০২৪Ñ এ কলেজ এবং পাবলিক বা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী ছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয় বা উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আসার পরেও তারা কিন্তু তাদের মতো করে পারষ্পরিক যোগাযোগের মধ্যে ছিলেন। এবং ৬ বছর আগের সেই ক্ষত কিন্তু কখনো শুকায়নি। শুধু হল আর হলের গণরুম দখলে রাখলেই ছাত্রদের বশে রাখা যায় না। নিরাপদ সড়ক আন্দোলন করে আসা শিক্ষার্থী প্রজন্মদের মনোজগতে ছাপ থেকে গেছে ছাত্রলীগ মানে হেলমেট লিগ, হকিস্টিক লিগ। রড, চেনের আঘাতের ক্ষত তাদের শরীর থেকে মুছে গেলেও মন থেকে মুছে যায়নি। তাই যখন সুযোগ এসেছে তারা প্রথম সুযোগেই কথিত ‘মেটিকুলাস ডিজাইন’Ñ এ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়সহ সারাদেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ‘ছাত্রলীগ শূন্য’ করে দিয়েছে। এ ‘ডিজাইন’ বাস্তবায়িত হওয়ার দায় কার? সেই ২০১৮ সালেই ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগ এ দায়ভারে নিজেদেরকে আবদ্ধ করেছে।

২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালে পর পর তিনটি জাতীয় নির্বাচন বিনা ভোট, নৈশভোট ও ড্যামি ভোটের মাধ্যমে অনুষ্ঠিত করে জনগণ থেকে বিচ্ছিন্নতা সৃষ্টির ডিজাইনের দায়িত্বও কি দেশি-বিদেশি চক্রের না আওয়ামী লীগ ও তার নেত্রীর। দীর্ঘ সময় আদালতে মামলা ঝুলিয়ে রেখে নির্বাচনী পুলসিরাত পার হওয়ার পরে আদালতকে সক্রিয় করে যে রায় বের করে আনা হলো এবং যার ভিত্তিতে কোটা আন্দোলনের পুনঃসূচনা হলো এ ডিজাইনেরই বা দায় কার। আর কোটাকে বৈষম্যমুক্ত করার দাবিতে প্রাথমিকভাবে যে নিরীহ আন্দোলন শুরু হলো সেই আন্দোলনের ওপর দলের সাধারণ সম্পাদকের আহ্বানে ছাত্রলীগ যুবলীগের হেলমেট বাহিনীর আক্রমণের এবং আক্রান্ত ছাত্রছাত্রীদের রক্তাক্ত ছবি ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় এবং পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হওয়ার পর সারাদেশে যে লাখো ছাত্রছাত্রী তীব্র আক্রোশে রাস্তায় নেমে এলো এ ‘মেটিকুলাস ডিজাইন’Ñ কার সৃষ্টি। আন্দোলনকারীদের রাজাকারের নাতিপুতি বলে কে বারুদের বিস্ফোরণ ঘটালেন। আর তার পর থেকে তো একের পর এক হত্যাযজ্ঞ। এ আন্দোলনের চরিত্রই পতিত সরকারের নীতি-নির্ধারকরা বুঝতে পারেননি। সন্দেহাতীতভাবে আন্দোলনের নেতৃত্বের মাঝে উগ্র ধর্মান্ধ শক্তি জায়গা করে নিয়েছিল। কিন্তু ছাত্ররা সমন্বয়কদের চেহারা বা রাজনৈতিক বিশ্বাসের খোঁজ রাখে নি এবং রাখার প্রয়োজনও অনুভব করেনি। তারা দাবির ন্যায্যতা ও সরকারের সীমাহীন নৃশংসতা দেখে রাজপথে নেমে এসেছিলেন। আমার তো নিজের চোখে দেখা মেয়ে আন্দোলনে এসেছে, দূরে পানি ও টিফিন হাতে মা বা বাবা দাঁড়িয়ে আছেন। তাঁদের কেউ হয়তোবা আওয়ামী লীগের সমর্থক, আবার কেউ বিএনপির সমর্থক বা অন্য কোন দলের। এটাকে কোন ধরনের ডিজাইন বলবেন! আসলে এ আন্দোলনের একটা নিজস্ব গতি ছিল। প্রত্যেকটা মৃত্যু সে গতিকে বৃদ্ধি করতে করতে চূড়ান্ত জায়গায় নিয়ে গেছে।

জুলাই জাগরণে দলমত নির্বিশেষে যে নাগরিক শক্তির সম্পৃক্ততা ঘটেছিল ক্ষমতার অন্ধত্বে সরকারি নীতি-নির্ধারকরা তা বুঝে উঠতে পারেননি। তারা আজ বলছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নয়, মেটিকুলাস ডিজাইন অনুযায়ী আন্দোলনে যুক্ত থাকা ‘মহল বিশেষ’ প্রাণঘাতী মারণাস্ত্র ব্যবহার করে এ হত্যাকা- সংঘটিত করে বিশেষ পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় প্রায় সব টিভি চ্যানেলেই প্রচারিত ভিডিও ফুটেজ স্পষ্টভাবেই তা বলে না। উপরন্তু ওই সময়ের তথ্য প্রতিমন্ত্রী এ. আরাফাত সরকার পতনের দুদিন আগেও সাংবাদিকদের বললেন, ‘গুলির কী দেখেছেন, আমাদের কাছে যত গুলি আছে, তা তিন বছরেও শেষ হবে না’। অবশ্য এরপরে সরকারের পতন হতে তিন দিনও লাগেনি। এ. আরাফাতের বক্তব্যও কি মেটিকুলাস ডিজাইনের অংশ!

গত ১৫ বছর ধরে বিএনপি কর্মীরা যে প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও দলের সঙ্গে ছিলেন, ২০২৩ সালের শেষার্ধে সব রকম পরিবহন বন্ধ করে দেয়ার পরেও দেশজুড়ে যে বিশাল বিশাল বিক্ষোভ সমাবেশ এবং পরবর্তীতে নির্যাতন নিপীড়নকে মোকাবিলা করে একতরফা নির্বাচনের বিরুদ্ধে যে তীব্র আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন, সেই বিএনপির কর্মীরা ৫ আগস্টের পর থেকে এক দখলদারিত্বের চেহারা নিয়ে আবির্ভূত হলেন। প্রতিদিন খুন জখম লুটতরাজ চাঁদাবাজির যে চিত্র মানুষ দেখছে, তাতে করে আওয়ামী লীগের অনুপস্থিতিতে অনেকটা একচেটিয়া প্রাধান্যের রাজনৈতিক দল বিএনপির জনপ্রিয়তা হ্রাস পাচ্ছে। বিএনপির বহিষ্কার তত্ত্বেও মানুষ বিশ্বাস হারিয়ে মনে করছে, দলের নীতি হচ্ছে চাঁদা আনতে পারলে পুরস্কার, তবে ধরা পড়লে বহিষ্কার। কে জানে বিএনপিও মেটিকুলাস ডিজাইনের শিকার কিনা!

তরুণদের নতুন রাজনৈতিক দল নতুন দিনের মশাল প্রজ্বলনের ঘোষণা দিয়ে আত্মপ্রকাশ করল। একটি বছর আগে রক্ত আর অশ্রুর বিনিময়ে যে লাখো তরুণরা এই শ্রাবণের অঝোর ধারার মাঝে, বসন্তকে ডেকে এনেছিল সে আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়া অনেকেই নতুন দল এনসিপির নেতৃত্বেও আছেন। এই দলে বেশ কিছু সম্ভাবনাময়, রাজনীতিতে কৌশলী, আধুনিকমনষ্ক, চৌকস তরুণ-তরুণী থাকলেও গুটি কতক উদ্ধত নেতার কণ্ঠে পতিত সরকারের নেতাদের কণ্ঠের প্রতিধ্বনি শুনে মানুষ আশায় বুক বাঁধতে পারছে না। নিয়োগ, বদলি, পদোন্নতি বা মামলা বাণিজ্য, থানা থেকে চাঁদাবাজ বা অপরাধীদের জবরদস্তি ছাড়িয়ে আনার মতো কাজে নতুন দল এনসিপির একাংশের অবস্থাও বিএনপির কাছাকাছি। কয়েকজন নেতার এই বয়সেই গাড়ি-বাড়ি ক্ষমতার প্রতি প্রবল আকর্ষণ। দশ মাসে কোটিপতির নাকি ছড়াছড়ি। আবার কয়েকজন শতকোটিপতি হয়েও ধরা খেয়ে আপাতত বহিষ্কৃত। কিন্তু কাউকে জেলে যেতে হয়নি। শান্তিতে নোবেল লরিয়েট ‘নতুন বাংলাদেশে’ যে দল গঠনে এত উৎসাহ জোগালেন তারা এখনো পর্যন্ত একটা প্রেশার গ্রুপের মতোই আছেন। তবে জুলাই মাসজুড়ে দেশব্যাপী তারা যে পদযাত্রা ও গণসংযোগ করছেন তা হয়তোবা বাস্তবতার মাটিতে পা রাখতে তাদের কিছুটা অভিজ্ঞ করবে।

রাজনীতি যে এক দিনের বা শুধু কোনো একটা ঐতিহাসিক সময়ের বিষয় নয়, এক দীর্ঘ প্রক্রিয়া এবং গণসংযোগ ও গণসংগ্রামের মধ্য দিয়ে তা প্রতিষ্ঠা পায়Ñ এই বুঝটার অভাব তরুণ নেতাদের মধ্যে রয়েছে। তারা যে নতুন বন্দোবস্তের কথা বলছেন সে বিষয়ে মানুষের মাঝে মূর্ত কোন ধারণা নেই। আবার রাজনৈতিক ঐকমত্যও নেই। বিমূর্তভাবে মানুষের মনোজগতে বৈষম্যমুক্ত এক গণতান্ত্রিক ও মানবিক সমাজের আকাক্সক্ষা জাগরিত হয়েছিল। আর স্বৈরাচারের পতনের আকাক্সক্ষা ছিল মূর্ত। বিমূর্ত ওই আকাক্সক্ষাকে বাস্তবে রূপ দিতে হলে দীর্ঘ পথ হাঁটতে হবে। এনসিপি কি দীর্ঘ পথ হাঁটতে প্রস্তুত? শুধু তাই নয় তাদের ঘোষিত মধ্যম পন্থার রাজনীতি দিয়েও সে লক্ষ্য অর্জন সম্ভব নয়। পুঁজির শৃঙ্খল আর সাম্রাজ্যবাদী শোষণ শাসন থেকে মুক্তির সংগ্রামে এগিয়ে যেতে কি এনসিপি প্রস্তুত? ওই সংগ্রামে অগ্রসর হতে হলে এনসিপিকে মিত্র পরিবর্তন করতে হবে। জামায়াত হেফাজত আর এবিসিডি পার্টির সঙ্গে মৈত্রী করে আর যাইহোক এ দেশের মেহনতি মানুষকে শোষণ নিপীড়ন বঞ্ছনা থেকে মুক্তির সংগ্রামকে অগ্রসর করা যাবে না। উদার মানবিক মুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠা করা যাবে না। পুরান ঢাকার ঘটনা দেখে না বুঝার তো কারণ নেই যে, এক বছরেই মানুষ সাহস হারিয়ে ফেলেছে। জনসমক্ষে একজন মানুষকে পাথর দিয়ে থেঁতলে হত্যা করা হলো। ভিডিও করল কিন্তু কেউ এগিয়ে এলো না। ক্রোধ আর প্রতিহিংসার যে রাজনীতি ‘নতুন বাংলাদেশে’ অন্তর্বর্তী সরকার আমলের প্রথম থেকেই নতুন রূপে চলছে তা দেখে আশাহত মানুষ আবার নিজেকে গুটিয়ে নিতে শুরু করেছে। সুশাসন আর ন্যায় বিচারের বাইরে যেয়ে যারা ক্রোধ, প্রতিহিংসা চরিতার্থ করছেন তাদের কাছ থেকে যথাযথ সংস্কারের ভরসাও মানুষ পাচ্ছেন না। এ ব্যর্থতার জবাব তো প্রধান উপদেষ্টা ও তার নিয়োগকর্তাদের দিতে হবে। জুলাই অভ্যুত্থান বর্ষ উদযাপনে কোটি কোটি টাকা ব্যায় করে এবং ড্রোন শো আর আলোর ঝলকানি দিয়ে এ ব্যর্থতা ঢাকা যাবে না।

আলোচনা হচ্ছিল মেটিকুলাস ডিজাইন নিয়ে। কিন্তু ধান ভানতে শিবের গীত হয়ে গেল। বাংলাদেশের রাজনীতি ও ক্ষমতা বদলের ঘটনাবলিতে বিদেশি হস্তক্ষেপ নতুন কোনো বিষয় নয়। ১৫ বছর একটানা আওয়ামী লীগের শাসন থাকায় ভারতীয় হস্তক্ষেপ বেশি দৃশ্যমান ছিল। প্রতিটি নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টির প্রতিনিধিদের দেখা যেত ভারতবর্ষে যেয়ে তাদের দলের অবস্থান তুলে ধরতে এবং ভারতীয় অবস্থান জেনে এসে নিজ দলের নীতি-নির্ধারণ করতে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা দুনিয়ার হস্তক্ষেপও কিন্তু অদৃশ্যমান ছিল না। যেমন ঢাকায় তিনবার কূটনীতিকের দায়িত্ব পালনকারী সাবেক মার্কিন কূটনীতিক জন এফ ড্যানিলোভিচ সাম্প্রতিক সময়ে মন্তব্য করেছেন ২০০৭-০৮ সালে এক এগারোর সরকার যে সংস্কারের এজেন্ডা নিয়ে এগোচ্ছিল তা বাদ দিয়ে একটা সময় এসে নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা হস্তান্তরকে অগ্রাধিকার দেয়ার বিষয়টি সমর্থন করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভুল করেছিল। অর্থাৎ মাইনাস টু সংস্কারের পথেই থাকা উচিত ছিল। এবারেও ক্ষমতার পালাবদলে মার্কিনি ইঙ্গিতে শান্তি রক্ষী বাহিনীতে বাংলাদেশের সেনা প্রতিনিধিত্বকে ইস্যু করা হয়েছিল বলে ইতোমধ্যেই জাতিসংঘের কর্মকর্তারা বলেছেন। অর্থাৎ বাংলাদেশের আভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে শুধু ভারতবর্ষ নয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও সরাসরি হস্তক্ষেপ করে আসছে। এ বিষয়ে নতুন দল নিশ্চুপ। করিডোর ও বন্দর নিয়ে পশ্চিমা দুনিয়ার লোলুপ দৃষ্টি এবং পাল্টা শুল্ক আরোপের নামে মার্কিন বাণিজ্য আগ্রাসনের যে ছায়া আমরা দেখতে পাচ্ছি নতুন দল এনসিপি এসব বিষয়েও একেবারেই নিশ্চুপ।

গত বছর এই জুলাই মাসেই যুক্তরাষ্ট্রের টাইম টেলিভিশন চ্যানেলকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান মোজেনা বলেন, ‘বাংলাদেশে নতুন রাজনৈতিক দলের উত্থান ঘটতে পারে’। অবশেষে তা ঘটল তো। কোটা আন্দোলনকে ঘিরে সহিংসতা প্রসঙ্গে মোজেনা বলেন, ‘সম্ভবত নিষেধাজ্ঞাও সহায়ক হতে পারে’। সেই নিষেধাজ্ঞার হুমকিই কি ছিল বাংলাদেশ সেনাবাহিনী থেকে বিদেশে শান্তিরক্ষী পাঠানো স্থগিত করা প্রসঙ্গে! ২০০৬ সালেও এ ধরনের হুমকি ছিল। নতুন দলের উত্থান সম্পর্কে ড্যান মোজেনার উক্তি, আবার তার কিছুদিন পরেই ফিন্যান্সিয়াল টাইমসকে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের দেয়া সাক্ষাৎকারেও ছাত্রদের নতুন দল গঠন সম্পর্কে ইঙ্গিত, সব মিলিয়ে নতুন দল পশ্চিমা-সমর্থিত ভিন্ন একটি রাজনৈতিক শক্তির উত্থান প্রয়াস কিনা সেটা অনেকের মনেই ভাবনার সৃষ্টি করছে।

দেশি-বিদেশি শক্তি ক্ষমতার পরিবর্তনের ফলে তাদের ‘স্টেক’ নিশ্চিত করার জন্য এই ধরনের অস্থির সময়ে নানা ভূমিকা নিয়ে থাকে। এবারে যেমন নিয়েছে, অতীতেও তাই। এসব ঘটনাবলি যেমন জুলাইয়ের মাহাত্ম্যকে কমায় না, মানুষের আত্মদানকেও খাটো করে না। মানুষ সুনির্দিষ্ট কারো ডাকে রাস্তায় নামে নাই। মানুষের মাঝে একনায়কতন্ত্র ও স্বৈরাচার উচ্ছেদের এক অন্তর্নিহিত শক্তি পুন্জিভূত ছিলো। ছাত্ররা যখন সুয়োগ করে দিয়েছে নিজের বোধ থেকেই সে নেমে পড়েছে স্বতঃস্ফূর্তভাবে, মৃত্যু ভয়কে উপেক্ষা করে। যেন সেই জীবনানন্দ দাশের ‘বোধ’। “স্বপ্ন নয়, শান্তি নয়, ভালোবাসা নয়/ হৃদয়ের মাঝে এক বোধ জন্ম লয়।” সোশ্যাল মিডিয়ায় যখন নানা যুক্তি তর্ক দিয়ে মেটিকুলাস ডিজাইন তত্ত্ব হাজির হচ্ছে তখন আমার মত ‘গরুর লেখা মানুষের রচনা’ লেখকের ছোটবেলায় স্কুলে লিখতে দেয়া ভাব সম্প্রসারণ এর কথাই মনে পড়ছে। “আলো বলে, অন্ধকার তুই বড় কালো। অন্ধকার বলে, ভাই তাই তুমি আলো।”Ñ জুলাই জাগরণে কে আলো আর কে কালো!

[লেখক : সাবেক ছাত্র নেতা]

রম্যগদ্য : ‘ব্যাংক, ব্যাংক নয়’

মবতন্ত্রের জয়

ডিজিটাল ক্লান্তি ও ‘সর্বক্ষণ সক্রিয়’ সংস্কৃতির শ্রেণীগত রাজনীতি

এসএসসিতে গণিত বিষয়ে ফল বিপর্যয় : কারণ ও উত্তরণের উপায়

দক্ষ মানবসম্পদ ও সমৃদ্ধ গ্রন্থাগার

আফ্রিকায় হঠাৎ কেন যুক্তরাষ্ট্রের ঝোঁক?

ঢাকা মহানগর ও বুড়িগঙ্গা

জামাই মেলা : উৎসব, ঐতিহ্য ও কৃষ্টির রঙিন চিত্রপট

হারিয়ে যাওয়া ক্লাস, কঠোর মূল্যায়ন আর প্রশ্নের জটিলতায় নুয়ে পড়া এক প্রজন্ম

বৈষম্য দূর করে নতুন বাংলাদেশ গড়ে তুলুন

চিকিৎসা যেন বাণিজ্যের হাতিয়ারে পরিণত না হয়

পথশিশু ও বাংলাদেশে সামাজিক চুক্তির ব্যর্থতা

মেগা প্রকল্প : প্রশ্ন হওয়া উচিত স্বচ্ছতা নিয়ে

আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া জরুরি

স্মার্ট দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা : উপগ্রহ চিত্র ও ওয়েবসাইটের অপরিহার্যতা

ক্ষমতা ও জনপ্রশাসন : আমলাতন্ত্রের ছায়াতলে আমজনতা

জনসংখ্যা : সম্পদ না সংকট?

ব্রিকসে নতুন ভূ-রাজনৈতিক ব্যবস্থার উত্থান

রম্যগদ্য : ‘ল্যাংড়া-লুলা, আতুড়-পাতুড়’

আষাঢ়ী পূর্ণিমা : আত্মশুদ্ধির সাধনায় বুদ্ধের অনন্ত আলো

বদলে যাওয়া মাটিতে সাহসী বীজ : জলবায়ুর বিপরীতে বাংলাদেশের কৃষির অভিযোজনগাথা

ছবি

জুলাই অভ্যুত্থান-গাথা : ‘শিকলে নাহি দিব ধরা’

প্রাচীন যৌধেয় জাতি ও তাদের সাম্যবাদী শাসন

গণঅভ্যুত্থান-উত্তর ন্যায়ভিত্তিক রাষ্ট্র বিনির্মাণের স্বপ্ন

টেকসই উন্নয়নের স্বপ্নপূরণে উপগ্রহ চিত্রই চাবিকাঠি

রাবার শিল্প : সংকট, করণীয় ও উত্তরণের দিশা

রম্যগদ্য : দুধ, দই, কলা...

ছবি

কোপার্নিকাস : আলো হয়ে জন্ম নেওয়া বৈপ্লবিক মতবাদের প্রবর্তক

জলবায়ু সংকটে মানবসভ্যতা

টেকসই অর্থনীতির জন্য চাই টেকসই ব্যাংকিং

ডিজিটাল দাসত্ব : মনোযোগ অর্থনীতি ও জ্ঞান পুঁজিবাদে তরুণ প্রজন্মের মননশীলতার অবক্ষয়

অন্তর্বর্তীকালীন সরকার : আস্থা ভঙ্গ ও জবাবদিহিতার সংকট

আসামি এখন নির্বাচন কমিশন

কোথায় হারাল একান্নবর্তী পরিবার?

এই শান্তি কি মহাঝড়ের পূর্বলক্ষণ?

মেগাসিটি : দারিদ্র্য যখন ‘অবাঞ্ছিত বর্জ্য’

tab

উপ-সম্পাদকীয়

বোধের স্ফূরণ, না ‘মেটিকুলাস ডিজাইন’?

আনোয়ারুল হক

image

’২৪-এর জুলাই। শ্রাবণের অঝোর ধারার মাঝেই তারুণ্যের জাগরণ

বুধবার, ১৬ জুলাই ২০২৫

সোশ্যাল মিডিয়ায় ইদানীংয়ের বহুল আলোচিত দুটি শব্দ মেটিকুলাস ডিজাইন। জুলাই অভ্যুত্থানের আগে মেটিকুলাস ডিজাইন নিয়ে কখনও এত আলোচনা নজরে আসেনি। এমনকি আন্দোলনের দিনগুলোতেও এ আলোচনা তেমনটা হয়নি। শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকে বিজিত শক্তি ও তাদের সমর্থকদের দিক থেকে এবং কিছু কিছু রাজনৈতিক বিশ্লেষকের কাছ থেকে বিগত ১১ মাস যাবত আমরা শুনে আসছি “সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা ও ছক মাফিক এক ষড়যন্ত্রমূলক ঘটনাবলির মধ্য দিয়ে সরকার উৎখাত করা হয়েছে। দেশের ‘গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতা’কে ব্যাহত করে অগণতান্ত্রিক শক্তি ও অনির্বাচিত সরকার দেশ পরিচালনা করছে।” তাদের উল্লেখিত এই ‘ষড়যন্ত্র তত্ত্ব’-কেই সংক্ষেপে বলা হচ্ছে আন্দোলনটি ছিল মেটিকুলাসলি ডিজাইনড।

সাধারণভাবে ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় ভুলত্রুটি এবং অন্যায় অপরাধগুলো সহসা চোখে পড়ে না। উপরন্তু ক্ষমতাসীনদের আশপাশে সরকারি প্রশাসন এবং সমাজে নানা বুদ্ধিবৃত্তিক পেশায় নিয়োজিত এত বেশি তোষামোদকারী সমবেত হয়েছিলেন যাদের অবিরাম তেলবাজিতে ক্ষমতাসীনদের এবং বিশেষত সাবেক প্রধানমন্ত্রীর মনে হতো তারা অজেয়। বিবেকের কণ্ঠস্বর হিসেবে প্রবীণ বুদ্ধিজীবী ২-৪ জন, যারা জীবিত ছিলেন তারা সরকারের নানা কর্মকা-ে অস্বস্তিতে থাকলেও তা প্রকাশ করতেন না।

দেড় দশক আগেও এমনটা ছিল না। তখন সরকার সমর্থক বুদ্ধিজীবীরাও সরকারের গণবিরোধী বা অগণতান্ত্রিক কর্মকা-ের সমালোচনা করতেন, সংশোধনের জন্য পরামর্শ দিতেন। কিন্তু ২০০৮ পরবর্তী বাংলাদেশে আর বিবেকের কণ্ঠস্বর শোনা যায়নি। এ পরিস্থিতির জন্য আওয়ামী লীগের পাশাপাশি বিএনপিরও দায় কম নয়। ২০০১ এর নির্বাচনে বিজয় লাভের পর বিএনপি সরকার গঠন করার সময়ে ’৭১ এর যুদ্ধাপরাধী জামায়াত ইসলামীর নেতাদেরকে মন্ত্রিসভায় স্থান করে দেয়ায় এবং ‘২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার পরে হামলাকারীদের প্রতি সরকারের নমনীয়তা দেখে এবং দেশে জঙ্গীবাদ উত্থানের ভীতি থেকে দেশের বুদ্ধিজীবীদের একটা বড় অংশ - “ন্যায় অন্যায় / জানি নে, জানি নে, জানি নে, / শুধু তোমারে জানি” Ñ আওয়ামী লীগের পক্ষে এমন একটা অবস্থান গ্রহণ করেন। বামপন্থার অনুরাগী অনেক বুদ্ধিজীবীও বামপন্থা থেকে মুখ ঘুরিয়ে আওয়ামী লীগের সমর্থকে পরিণত হন।

২০২৪ এর ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার পর থেকে শেখ হাসিনা তার নিজের জীবন শঙ্কা নিয়ে যে ট্রমায় আচ্ছন্ন হন এবং তার সঙ্গে বুদ্ধিজীবীদের সৃষ্ট এই ‘ন্যায়-অন্যায় জানি নে’ পরিস্থিতিতে ২০০৮-এ ক্ষমতা গ্রহণের পর তেকে শাসকগোষ্ঠী ক্রমান্বয়ে স্বৈরাচার ও স্বেচ্ছাচারকে একধরনের ফ্যাসিবাদী প্রবণতার দিকে নিয়ে যায় এবং যে কোনো ন্যায্য প্রতিবাদকে মনে হতে থাকে ষড়যন্ত্র ও মেটিকুলাস ডিজাইন। আর ‘মেটিকুলাস ডিজাইন’ যদি হয়েও থাকে তার ভ্রƒণ সৃষ্টি করেছিল শাসককূল যে কোনো স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবাদের ওপর নিষ্ঠুর দমনপীড়ন চালিয়ে।

২০১৮ সালে স্কুল-কলেজের শিশু-কিশোরদের নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের কথাই ধরা যাক। ওই বছর ২৯ জুলাই শহীদ রমিজউদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের শিক্ষার্থীরা বাসের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে ছিলেন ঢাকা বিমানবন্দর সড়কে কুর্মিটোলা হাসপাতালের সামনে। দুটি বাসের বেপরোয়া প্রতিযোগিতায় বাস ছাত্রছাত্রীদের ওপর দিয়ে চালিয়ে দেয়। কলেজের দুজন শিক্ষার্থী নিহত হন, আহত হন আরো দশজন। ঘটনার পরপরই বিক্ষোভে ফেটে পড়ে শিক্ষার্থীরা। সেই আন্দোলন দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছিল। রাজপথে নেমে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের আন্দোলন ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। সেই বিক্ষোভ শুধু ঢাকাতেই থেমে থাকেনি, ঢাকাসহ সারাদেশের সব স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের মাঝে ছড়িয়ে পড়ে। সব শহরেই হাজার হাজার ছাত্রছাত্রী নেমে আসে রাজপথে। টানা ১১ দিন ধরে চলে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন।

সড়কে নিরাপত্তা নিশ্চিতের দাবিতে বাংলাদেশে এর আগে বিভিন্ন সময় আন্দোলন হলেও ২০১৮ সালের মতো আলোড়ন আর কখনোই হয়নি। শিক্ষার্থীদের দমাতে লাঠিচার্জ, কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ করে পুলিশ। পাশাপাশি তৎকালীন ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের অঙ্গসংগঠন ছাত্রলীগ, যুবলীগের নেতাকর্মীরা শিক্ষার্থীদের ওপর হামলাও চালায়, যা কিনা আন্দোলনের গতিকে আরও তীব্র করে। ধানমন্ডি ঝিগাতলা এলাকায় আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর কার্যালয় থেকে এসে ছাত্রলীগের হেলমেট বাহিনী এই কিশোর-কিশোরীদের ওপর হামলা করল। ছাত্রলীগ-আওয়ামী লীগ নেতারা কি একবারও ভেবে দেখেনি শিশু-কিশোরদের ওপর এই আক্রমণের প্রতিক্রিয়া কত সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলতে পারে। সারাদেশেই কমবেশি এ ধরনের হামলা ছাত্রলীগ করে। রাজনীতির জ্ঞান, সাধারণ বুঝ যে কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে গড়ে ওঠেনি তাদের পক্ষে বুঝে ওঠা কঠিন ছিল, নিরাপদ সড়কের নিরীহ দাবিকে সমর্থন না করে ছাত্রলীগ কেন তাদের আক্রমণ করছে! এ কেমন ছাত্র সংগঠন!

ছাত্রলীগ আওয়ামী লীগ ওই প্রজন্মের মনোজগতে সেদিন যে ক্ষত সৃষ্টি করেছিল যদি বলি সেদিন থেকেই কথিত ‘মেটিকুলাস ডিজাইন’ ক্রিয়াশীল হয়ে ওঠে। ওই সময়ে সারাদেশের প্রতিটি স্কুল-কলেজের অনেক ছাত্রছাত্রী মোবাইল নম্বর, ফেইসবুক ও অন্যান্য সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে পারষ্পরিক যোগাযোগ সূত্র গড়ে তোলে। তারা তাদের অভিজ্ঞতাগুলো সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে ভাগাভাগি করে নেয়। সে দিনের সেই শিশু-কিশোর-কিশোরীরাই কিন্তু ২০২৪Ñ এ কলেজ এবং পাবলিক বা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী ছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয় বা উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আসার পরেও তারা কিন্তু তাদের মতো করে পারষ্পরিক যোগাযোগের মধ্যে ছিলেন। এবং ৬ বছর আগের সেই ক্ষত কিন্তু কখনো শুকায়নি। শুধু হল আর হলের গণরুম দখলে রাখলেই ছাত্রদের বশে রাখা যায় না। নিরাপদ সড়ক আন্দোলন করে আসা শিক্ষার্থী প্রজন্মদের মনোজগতে ছাপ থেকে গেছে ছাত্রলীগ মানে হেলমেট লিগ, হকিস্টিক লিগ। রড, চেনের আঘাতের ক্ষত তাদের শরীর থেকে মুছে গেলেও মন থেকে মুছে যায়নি। তাই যখন সুযোগ এসেছে তারা প্রথম সুযোগেই কথিত ‘মেটিকুলাস ডিজাইন’Ñ এ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়সহ সারাদেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ‘ছাত্রলীগ শূন্য’ করে দিয়েছে। এ ‘ডিজাইন’ বাস্তবায়িত হওয়ার দায় কার? সেই ২০১৮ সালেই ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগ এ দায়ভারে নিজেদেরকে আবদ্ধ করেছে।

২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালে পর পর তিনটি জাতীয় নির্বাচন বিনা ভোট, নৈশভোট ও ড্যামি ভোটের মাধ্যমে অনুষ্ঠিত করে জনগণ থেকে বিচ্ছিন্নতা সৃষ্টির ডিজাইনের দায়িত্বও কি দেশি-বিদেশি চক্রের না আওয়ামী লীগ ও তার নেত্রীর। দীর্ঘ সময় আদালতে মামলা ঝুলিয়ে রেখে নির্বাচনী পুলসিরাত পার হওয়ার পরে আদালতকে সক্রিয় করে যে রায় বের করে আনা হলো এবং যার ভিত্তিতে কোটা আন্দোলনের পুনঃসূচনা হলো এ ডিজাইনেরই বা দায় কার। আর কোটাকে বৈষম্যমুক্ত করার দাবিতে প্রাথমিকভাবে যে নিরীহ আন্দোলন শুরু হলো সেই আন্দোলনের ওপর দলের সাধারণ সম্পাদকের আহ্বানে ছাত্রলীগ যুবলীগের হেলমেট বাহিনীর আক্রমণের এবং আক্রান্ত ছাত্রছাত্রীদের রক্তাক্ত ছবি ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় এবং পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হওয়ার পর সারাদেশে যে লাখো ছাত্রছাত্রী তীব্র আক্রোশে রাস্তায় নেমে এলো এ ‘মেটিকুলাস ডিজাইন’Ñ কার সৃষ্টি। আন্দোলনকারীদের রাজাকারের নাতিপুতি বলে কে বারুদের বিস্ফোরণ ঘটালেন। আর তার পর থেকে তো একের পর এক হত্যাযজ্ঞ। এ আন্দোলনের চরিত্রই পতিত সরকারের নীতি-নির্ধারকরা বুঝতে পারেননি। সন্দেহাতীতভাবে আন্দোলনের নেতৃত্বের মাঝে উগ্র ধর্মান্ধ শক্তি জায়গা করে নিয়েছিল। কিন্তু ছাত্ররা সমন্বয়কদের চেহারা বা রাজনৈতিক বিশ্বাসের খোঁজ রাখে নি এবং রাখার প্রয়োজনও অনুভব করেনি। তারা দাবির ন্যায্যতা ও সরকারের সীমাহীন নৃশংসতা দেখে রাজপথে নেমে এসেছিলেন। আমার তো নিজের চোখে দেখা মেয়ে আন্দোলনে এসেছে, দূরে পানি ও টিফিন হাতে মা বা বাবা দাঁড়িয়ে আছেন। তাঁদের কেউ হয়তোবা আওয়ামী লীগের সমর্থক, আবার কেউ বিএনপির সমর্থক বা অন্য কোন দলের। এটাকে কোন ধরনের ডিজাইন বলবেন! আসলে এ আন্দোলনের একটা নিজস্ব গতি ছিল। প্রত্যেকটা মৃত্যু সে গতিকে বৃদ্ধি করতে করতে চূড়ান্ত জায়গায় নিয়ে গেছে।

জুলাই জাগরণে দলমত নির্বিশেষে যে নাগরিক শক্তির সম্পৃক্ততা ঘটেছিল ক্ষমতার অন্ধত্বে সরকারি নীতি-নির্ধারকরা তা বুঝে উঠতে পারেননি। তারা আজ বলছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নয়, মেটিকুলাস ডিজাইন অনুযায়ী আন্দোলনে যুক্ত থাকা ‘মহল বিশেষ’ প্রাণঘাতী মারণাস্ত্র ব্যবহার করে এ হত্যাকা- সংঘটিত করে বিশেষ পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় প্রায় সব টিভি চ্যানেলেই প্রচারিত ভিডিও ফুটেজ স্পষ্টভাবেই তা বলে না। উপরন্তু ওই সময়ের তথ্য প্রতিমন্ত্রী এ. আরাফাত সরকার পতনের দুদিন আগেও সাংবাদিকদের বললেন, ‘গুলির কী দেখেছেন, আমাদের কাছে যত গুলি আছে, তা তিন বছরেও শেষ হবে না’। অবশ্য এরপরে সরকারের পতন হতে তিন দিনও লাগেনি। এ. আরাফাতের বক্তব্যও কি মেটিকুলাস ডিজাইনের অংশ!

গত ১৫ বছর ধরে বিএনপি কর্মীরা যে প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও দলের সঙ্গে ছিলেন, ২০২৩ সালের শেষার্ধে সব রকম পরিবহন বন্ধ করে দেয়ার পরেও দেশজুড়ে যে বিশাল বিশাল বিক্ষোভ সমাবেশ এবং পরবর্তীতে নির্যাতন নিপীড়নকে মোকাবিলা করে একতরফা নির্বাচনের বিরুদ্ধে যে তীব্র আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন, সেই বিএনপির কর্মীরা ৫ আগস্টের পর থেকে এক দখলদারিত্বের চেহারা নিয়ে আবির্ভূত হলেন। প্রতিদিন খুন জখম লুটতরাজ চাঁদাবাজির যে চিত্র মানুষ দেখছে, তাতে করে আওয়ামী লীগের অনুপস্থিতিতে অনেকটা একচেটিয়া প্রাধান্যের রাজনৈতিক দল বিএনপির জনপ্রিয়তা হ্রাস পাচ্ছে। বিএনপির বহিষ্কার তত্ত্বেও মানুষ বিশ্বাস হারিয়ে মনে করছে, দলের নীতি হচ্ছে চাঁদা আনতে পারলে পুরস্কার, তবে ধরা পড়লে বহিষ্কার। কে জানে বিএনপিও মেটিকুলাস ডিজাইনের শিকার কিনা!

তরুণদের নতুন রাজনৈতিক দল নতুন দিনের মশাল প্রজ্বলনের ঘোষণা দিয়ে আত্মপ্রকাশ করল। একটি বছর আগে রক্ত আর অশ্রুর বিনিময়ে যে লাখো তরুণরা এই শ্রাবণের অঝোর ধারার মাঝে, বসন্তকে ডেকে এনেছিল সে আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়া অনেকেই নতুন দল এনসিপির নেতৃত্বেও আছেন। এই দলে বেশ কিছু সম্ভাবনাময়, রাজনীতিতে কৌশলী, আধুনিকমনষ্ক, চৌকস তরুণ-তরুণী থাকলেও গুটি কতক উদ্ধত নেতার কণ্ঠে পতিত সরকারের নেতাদের কণ্ঠের প্রতিধ্বনি শুনে মানুষ আশায় বুক বাঁধতে পারছে না। নিয়োগ, বদলি, পদোন্নতি বা মামলা বাণিজ্য, থানা থেকে চাঁদাবাজ বা অপরাধীদের জবরদস্তি ছাড়িয়ে আনার মতো কাজে নতুন দল এনসিপির একাংশের অবস্থাও বিএনপির কাছাকাছি। কয়েকজন নেতার এই বয়সেই গাড়ি-বাড়ি ক্ষমতার প্রতি প্রবল আকর্ষণ। দশ মাসে কোটিপতির নাকি ছড়াছড়ি। আবার কয়েকজন শতকোটিপতি হয়েও ধরা খেয়ে আপাতত বহিষ্কৃত। কিন্তু কাউকে জেলে যেতে হয়নি। শান্তিতে নোবেল লরিয়েট ‘নতুন বাংলাদেশে’ যে দল গঠনে এত উৎসাহ জোগালেন তারা এখনো পর্যন্ত একটা প্রেশার গ্রুপের মতোই আছেন। তবে জুলাই মাসজুড়ে দেশব্যাপী তারা যে পদযাত্রা ও গণসংযোগ করছেন তা হয়তোবা বাস্তবতার মাটিতে পা রাখতে তাদের কিছুটা অভিজ্ঞ করবে।

রাজনীতি যে এক দিনের বা শুধু কোনো একটা ঐতিহাসিক সময়ের বিষয় নয়, এক দীর্ঘ প্রক্রিয়া এবং গণসংযোগ ও গণসংগ্রামের মধ্য দিয়ে তা প্রতিষ্ঠা পায়Ñ এই বুঝটার অভাব তরুণ নেতাদের মধ্যে রয়েছে। তারা যে নতুন বন্দোবস্তের কথা বলছেন সে বিষয়ে মানুষের মাঝে মূর্ত কোন ধারণা নেই। আবার রাজনৈতিক ঐকমত্যও নেই। বিমূর্তভাবে মানুষের মনোজগতে বৈষম্যমুক্ত এক গণতান্ত্রিক ও মানবিক সমাজের আকাক্সক্ষা জাগরিত হয়েছিল। আর স্বৈরাচারের পতনের আকাক্সক্ষা ছিল মূর্ত। বিমূর্ত ওই আকাক্সক্ষাকে বাস্তবে রূপ দিতে হলে দীর্ঘ পথ হাঁটতে হবে। এনসিপি কি দীর্ঘ পথ হাঁটতে প্রস্তুত? শুধু তাই নয় তাদের ঘোষিত মধ্যম পন্থার রাজনীতি দিয়েও সে লক্ষ্য অর্জন সম্ভব নয়। পুঁজির শৃঙ্খল আর সাম্রাজ্যবাদী শোষণ শাসন থেকে মুক্তির সংগ্রামে এগিয়ে যেতে কি এনসিপি প্রস্তুত? ওই সংগ্রামে অগ্রসর হতে হলে এনসিপিকে মিত্র পরিবর্তন করতে হবে। জামায়াত হেফাজত আর এবিসিডি পার্টির সঙ্গে মৈত্রী করে আর যাইহোক এ দেশের মেহনতি মানুষকে শোষণ নিপীড়ন বঞ্ছনা থেকে মুক্তির সংগ্রামকে অগ্রসর করা যাবে না। উদার মানবিক মুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠা করা যাবে না। পুরান ঢাকার ঘটনা দেখে না বুঝার তো কারণ নেই যে, এক বছরেই মানুষ সাহস হারিয়ে ফেলেছে। জনসমক্ষে একজন মানুষকে পাথর দিয়ে থেঁতলে হত্যা করা হলো। ভিডিও করল কিন্তু কেউ এগিয়ে এলো না। ক্রোধ আর প্রতিহিংসার যে রাজনীতি ‘নতুন বাংলাদেশে’ অন্তর্বর্তী সরকার আমলের প্রথম থেকেই নতুন রূপে চলছে তা দেখে আশাহত মানুষ আবার নিজেকে গুটিয়ে নিতে শুরু করেছে। সুশাসন আর ন্যায় বিচারের বাইরে যেয়ে যারা ক্রোধ, প্রতিহিংসা চরিতার্থ করছেন তাদের কাছ থেকে যথাযথ সংস্কারের ভরসাও মানুষ পাচ্ছেন না। এ ব্যর্থতার জবাব তো প্রধান উপদেষ্টা ও তার নিয়োগকর্তাদের দিতে হবে। জুলাই অভ্যুত্থান বর্ষ উদযাপনে কোটি কোটি টাকা ব্যায় করে এবং ড্রোন শো আর আলোর ঝলকানি দিয়ে এ ব্যর্থতা ঢাকা যাবে না।

আলোচনা হচ্ছিল মেটিকুলাস ডিজাইন নিয়ে। কিন্তু ধান ভানতে শিবের গীত হয়ে গেল। বাংলাদেশের রাজনীতি ও ক্ষমতা বদলের ঘটনাবলিতে বিদেশি হস্তক্ষেপ নতুন কোনো বিষয় নয়। ১৫ বছর একটানা আওয়ামী লীগের শাসন থাকায় ভারতীয় হস্তক্ষেপ বেশি দৃশ্যমান ছিল। প্রতিটি নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টির প্রতিনিধিদের দেখা যেত ভারতবর্ষে যেয়ে তাদের দলের অবস্থান তুলে ধরতে এবং ভারতীয় অবস্থান জেনে এসে নিজ দলের নীতি-নির্ধারণ করতে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা দুনিয়ার হস্তক্ষেপও কিন্তু অদৃশ্যমান ছিল না। যেমন ঢাকায় তিনবার কূটনীতিকের দায়িত্ব পালনকারী সাবেক মার্কিন কূটনীতিক জন এফ ড্যানিলোভিচ সাম্প্রতিক সময়ে মন্তব্য করেছেন ২০০৭-০৮ সালে এক এগারোর সরকার যে সংস্কারের এজেন্ডা নিয়ে এগোচ্ছিল তা বাদ দিয়ে একটা সময় এসে নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা হস্তান্তরকে অগ্রাধিকার দেয়ার বিষয়টি সমর্থন করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভুল করেছিল। অর্থাৎ মাইনাস টু সংস্কারের পথেই থাকা উচিত ছিল। এবারেও ক্ষমতার পালাবদলে মার্কিনি ইঙ্গিতে শান্তি রক্ষী বাহিনীতে বাংলাদেশের সেনা প্রতিনিধিত্বকে ইস্যু করা হয়েছিল বলে ইতোমধ্যেই জাতিসংঘের কর্মকর্তারা বলেছেন। অর্থাৎ বাংলাদেশের আভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে শুধু ভারতবর্ষ নয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও সরাসরি হস্তক্ষেপ করে আসছে। এ বিষয়ে নতুন দল নিশ্চুপ। করিডোর ও বন্দর নিয়ে পশ্চিমা দুনিয়ার লোলুপ দৃষ্টি এবং পাল্টা শুল্ক আরোপের নামে মার্কিন বাণিজ্য আগ্রাসনের যে ছায়া আমরা দেখতে পাচ্ছি নতুন দল এনসিপি এসব বিষয়েও একেবারেই নিশ্চুপ।

গত বছর এই জুলাই মাসেই যুক্তরাষ্ট্রের টাইম টেলিভিশন চ্যানেলকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান মোজেনা বলেন, ‘বাংলাদেশে নতুন রাজনৈতিক দলের উত্থান ঘটতে পারে’। অবশেষে তা ঘটল তো। কোটা আন্দোলনকে ঘিরে সহিংসতা প্রসঙ্গে মোজেনা বলেন, ‘সম্ভবত নিষেধাজ্ঞাও সহায়ক হতে পারে’। সেই নিষেধাজ্ঞার হুমকিই কি ছিল বাংলাদেশ সেনাবাহিনী থেকে বিদেশে শান্তিরক্ষী পাঠানো স্থগিত করা প্রসঙ্গে! ২০০৬ সালেও এ ধরনের হুমকি ছিল। নতুন দলের উত্থান সম্পর্কে ড্যান মোজেনার উক্তি, আবার তার কিছুদিন পরেই ফিন্যান্সিয়াল টাইমসকে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের দেয়া সাক্ষাৎকারেও ছাত্রদের নতুন দল গঠন সম্পর্কে ইঙ্গিত, সব মিলিয়ে নতুন দল পশ্চিমা-সমর্থিত ভিন্ন একটি রাজনৈতিক শক্তির উত্থান প্রয়াস কিনা সেটা অনেকের মনেই ভাবনার সৃষ্টি করছে।

দেশি-বিদেশি শক্তি ক্ষমতার পরিবর্তনের ফলে তাদের ‘স্টেক’ নিশ্চিত করার জন্য এই ধরনের অস্থির সময়ে নানা ভূমিকা নিয়ে থাকে। এবারে যেমন নিয়েছে, অতীতেও তাই। এসব ঘটনাবলি যেমন জুলাইয়ের মাহাত্ম্যকে কমায় না, মানুষের আত্মদানকেও খাটো করে না। মানুষ সুনির্দিষ্ট কারো ডাকে রাস্তায় নামে নাই। মানুষের মাঝে একনায়কতন্ত্র ও স্বৈরাচার উচ্ছেদের এক অন্তর্নিহিত শক্তি পুন্জিভূত ছিলো। ছাত্ররা যখন সুয়োগ করে দিয়েছে নিজের বোধ থেকেই সে নেমে পড়েছে স্বতঃস্ফূর্তভাবে, মৃত্যু ভয়কে উপেক্ষা করে। যেন সেই জীবনানন্দ দাশের ‘বোধ’। “স্বপ্ন নয়, শান্তি নয়, ভালোবাসা নয়/ হৃদয়ের মাঝে এক বোধ জন্ম লয়।” সোশ্যাল মিডিয়ায় যখন নানা যুক্তি তর্ক দিয়ে মেটিকুলাস ডিজাইন তত্ত্ব হাজির হচ্ছে তখন আমার মত ‘গরুর লেখা মানুষের রচনা’ লেখকের ছোটবেলায় স্কুলে লিখতে দেয়া ভাব সম্প্রসারণ এর কথাই মনে পড়ছে। “আলো বলে, অন্ধকার তুই বড় কালো। অন্ধকার বলে, ভাই তাই তুমি আলো।”Ñ জুলাই জাগরণে কে আলো আর কে কালো!

[লেখক : সাবেক ছাত্র নেতা]

back to top