alt

উপ-সম্পাদকীয়

ডিজিটাল ক্লান্তি ও ‘সর্বক্ষণ সক্রিয়’ সংস্কৃতির শ্রেণীগত রাজনীতি

মতিউর রহমান

: বৃহস্পতিবার, ১৭ জুলাই ২০২৫

বর্তমান ডিজিটাল যুগ কাজ ও বিশ্রামের চিরাচরিত বিভাজনকে ক্রমবর্ধমান হারে অস্পষ্ট করে দিচ্ছে। বিশেষ করে বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের মধ্যবিত্ত তরুণ প্রজন্মের জন্য, প্রযুক্তি যা একসময় স্বাধীনতা ও সম্ভাবনার প্রতীক ছিল, আজ তা এক ক্লান্তিকর, নিরন্তর শ্রমের যন্ত্রে পরিণত হয়েছে। অনলাইন পড়াশোনা, ফ্রিল্যান্সিং গিগ, ডিজিটাল কনটেন্ট তৈরি এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় ‘সর্বক্ষণ সক্রিয়’ (অলওয়েজ অন) থাকার তাগিদÑ এই সবকিছু মিলে তাদের এক ধরনের ডিজিটাল দাসত্বে আটকে ফেলেছে।

প্রযুক্তি যা একসময় ‘স্বাধীনতা’ ও ‘সুযোগ’ হিসেবে ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয়েছিল, আজ তা সার্বক্ষণিক নজরদারির, অদৃশ্য শ্রমের এবং মানসিক শোষণের এক নির্মম বাস্তবতা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। এ রূপান্তর কেবল প্রযুক্তিগত নয়, এটি সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক; যা আমাদের শ্রমের ধারণা, ব্যক্তিগত পরিসর এবং মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর গভীর প্রভাব ফেলছে।

মার্ক্সীয় দৃষ্টিকোণ থেকে ডিজিটাল শ্রম বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, এ প্ল্যাটফর্মভিত্তিক অর্থনীতিতে ব্যবহারকারীরা নিজেদের স্বাধীন ইন্টারনেট ব্যবহারকারী মনে করলেও, তারা আসলে অবিরত শ্রম প্রদান করে চলেছে। তাদের ডেটা, ক্লিক, মনোযোগ, এবং সময়Ñ সবকিছুই একচেটিয়া কর্পোরেট প্ল্যাটফর্মগুলোর জন্য পণ্যে রূপান্তরিত হচ্ছে।

পূর্ববর্তী যুগের কারখানার মজুর যেমন একটি নির্দিষ্ট সময় কারখানায় শ্রম দিত, এখনকার ডিজিটাল কর্মী বা ব্যবহারকারী ২৪ ঘণ্টা এক অদৃশ্য উৎপাদন ব্যবস্থার অংশ। তাদের মনোযোগ, বিশ্রাম, এমনকি বিনোদনও রূপান্তরিত হয়েছে নতুন প্রকারের মুনাফার উৎসে।

এখানে শ্রমের পরিধি কারখানার নির্দিষ্ট সময়সীমা ছাড়িয়ে জীবনযাপনের প্রতিটি মুহূর্তকে গ্রাস করছে। ব্যবহারকারী যখন একটি পোস্ট স্ক্রল করে, একটি বিজ্ঞাপনে ক্লিক করে, বা বন্ধুদের সাথে চ্যাট করে, তখন তার এই প্রতিটি কার্যকলাপ প্ল্যাটফর্মের জন্য ডেটা তৈরি করে, যা বিজ্ঞাপনে ব্যবহৃত হয় বা অ্যালগরিদম উন্নত করে এবং এভাবেই মুনাফা অর্জিত হয়। এটি ‘সর্বাত্মক শ্রম’- এর একটি নতুন রূপ, যেখানে শ্রমের সঙ্গে ব্যক্তিগত জীবন ও অবসর ওতপ্রোতভাবে মিশে যায়।

বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত তরুণ-তরুণীরা এই ডিজিটাল পুঁজিবাদের চক্রে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত। তাদের একটি সাধারণ পরামর্শ দেওয়া হয় : ‘চাকরি না থাকলে স্কিল শেখো, ফ্রিল্যান্স করো, সোশ্যাল মিডিয়ায় নিজের ব্র্যান্ড তৈরি করো।’ কেউ গ্রাফিক ডিজাইন শিখছে, কেউ ওয়েব ডেভেলপমেন্ট, কেউ আবার ইনফ্লুয়েন্সার হওয়ার আশায় প্রতিদিন কনটেন্ট তৈরি করছে। এই কর্মযজ্ঞের কোনো স্থিতি নেই, নেই নিশ্চিত আয়, নেই স্বাস্থ্য সুরক্ষা বা সামাজিক নিরাপত্তা।

ফ্রিল্যান্স প্ল্যাটফর্মগুলোতে তাদের শ্রম আন্তর্জাতিক বাজারে সস্তায় বিক্রি হচ্ছে এবং তীব্র প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার জন্য তাদের সর্বক্ষণ সক্রিয় ও প্রতিক্রিয়াশীল থাকতে হচ্ছে। এটি একটি ‘হাসল কালচার’ তৈরি করেছে, যেখানে বিশ্রামকে অলসতা হিসেবে দেখা হয় এবং নিরন্তর কাজকে সাফল্যের চাবিকাঠি হিসেবে প্রচার করা হয়।

এই সংস্কৃতি তরুণদের মধ্যে অনিরাপদ, অস্থিতিশীল এবং অনিয়মিত আয়ের এক নতুন ক্ষেত্র তৈরি করেছে, যা তাদের ভবিষ্যৎকে আরও অনিশ্চিত করে তুলছে। তারা যেন একটি অদৃশ্য গিগ অর্থনীতির কারাগারে আবদ্ধ, যেখানে স্বাধীনতার নামে তাদের শ্রমের ওপর চূড়ান্ত নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখা হয়। এই সংস্কৃতি শুধু প্রযুক্তিগত নয়, এটি একেবারেই রাজনৈতিক এবং শ্রেণীগত। কারা সর্বক্ষণ ‘অন’ থাকতে পারবে, কারা নির্ভার বিশ্রাম নিতে পারবেÑতা নির্ধারিত হচ্ছে তাদের শ্রেণী ও লিঙ্গভিত্তিক অবস্থানের ওপর।

সচ্ছল পরিবারের সদস্যদের জন্য হয়তো কাজ ও অবসরের একটি সীমারেখা এখনো বিদ্যমান, কিন্তু যারা অনিশ্চিত ভবিষ্যতের ভয় নিয়ে বাঁচছেÑতাদের জন্য প্রতিটি মুহূর্তই একধরনের শ্রম। তাদের কাছে নিষ্ক্রিয় থাকাটা এক ধরনের বিলাসিতা। বিশেষ করে নারীরা, যুবসমাজ, বা প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর তরুণেরাÑতাদের জন্য ডিজিটাল সক্রিয়তা মানে শুধু তীব্র প্রতিযোগিতা নয়, মানে নিরাপত্তাহীনতা, মানে সর্বদা নিজেদের ‘প্রমাণ’ করে চলা যে তারা প্রাসঙ্গিক, যোগ্য ও উৎপাদনক্ষম।

এই গোষ্ঠীগুলোর ওপর ডিজিটাল শ্রমের বোঝা আরও বেশি, কারণ তাদের সমাজে এমনিতেই নানা ধরনের বৈষম্য ও প্রতিকূলতার মুখোমুখি হতে হয়। ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে তাদের উপস্থিতি প্রায়শই যৌন হয়রানি, ট্রলিং, এবং সহিংসতার ঝুঁকি বাড়ায়, যা তাদের জন্য ‘সর্বক্ষণ সক্রিয়’ থাকাকে আরও চ্যালেঞ্জিং করে তোলে। এটি ইন্টারসেকশনালিটির একটি সুস্পষ্ট উদাহরণ, যেখানে একাধিক প্রান্তিক পরিচয় একত্রিত হয়ে ব্যক্তির ওপর শোষণ ও চাপ বাড়িয়ে তোলে।

‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ ধারণার পেছনে রয়েছে একধরনের রোমান্টিসিজমÑযেখানে তরুণ-তরুণীরা ঘরে বসে ডলার আয় করবে, বৈশ্বিক বাজারে নিজেদের জায়গা করে নেবে। এ ধারণা একটি আলোকিত ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখায়; কিন্তু বাস্তবতা হলো : রাত জেগে ক্লায়েন্টের রিপ্লাই, চোখের নিচে কালো দাগ, নির্বিচারে কাজের চাপ, পারিশ্রমিক না পাওয়ার অনিশ্চয়তাÑএই হলো ফ্রিল্যান্স অর্থনীতির প্রতিদিনের তিক্ত অভিজ্ঞতা।

এই শ্রমের কোনো আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি নেই, নেই সঠিক পরিসংখ্যান, নেই কোনো শক্তিশালী সংগঠন। তারা একধরনের নতুন ডিজিটাল মজুর শ্রেণী- যারা মজুরি পায় না, কিন্তু অবিরাম উৎপাদন করে যায়। তাদের শ্রম পুঁজিবাদী ব্যবস্থার জন্য নতুন ধরনের ‘অতিরিক্ত মূল্য’ তৈরি করে, যা প্ল্যাটফর্ম মালিকদের পকেটে যায়। এই শ্রমিকদের কোনো কর্মসংস্থান চুক্তি নেই, নেই শ্রমিক অধিকার এবং তারা বাজারের অস্থিরতার শিকার। এই বাস্তবতা ‘ডিজিটাল বাংলাদেশের’ রোমান্টিক চিত্রকে সম্পূর্ণ ভেঙে দেয়।

কার্ল মার্ক্সের ‘সারপ্লাস ভ্যালু’ তত্ত্ব এখানে নিখুঁতভাবে প্রযোজ্য। প্ল্যাটফর্ম পুঁজিবাদ চিরাচরিত কারখানা তৈরি করে না, বরং ব্যবহারকারীদের সময়, মনোযোগ ও আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করে। এই অর্থনীতিতে তরুণেরা কেবল তাদের স্কিল নয়, নিজেদের চিন্তা, মনোযোগ, সাড়া দেওয়ার ক্ষমতা সব বিক্রি করে। এমনকি বিশ্রামও একটি পণ্য হয়ে উঠেছেÑ ‘সেল্ফ-কেয়ার’ অ্যাপ, ‘ফোকাস বুস্টার’, ‘প্রোডাক্টিভিটি হ্যাক্স’Ñ এগুলো সবই একেকটি নতুন বাজার, যা মূলত মানুষকে আরও উৎপাদনক্ষম করে তোলার উদ্দেশ্যে কাজ করে।

এই প্রক্রিয়াটি মনস্তাত্ত্বিক পুঁজিবাদের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক, যেখানে মানুষের মানসিক অবস্থা এবং সুস্থতাও পুঁজির উপকরণে পরিণত হয়। এই অদৃশ্য শোষণ এতটাই সূক্ষ্ম যে অনেক সময় ব্যবহারকারী নিজেই এটি উপলব্ধি করতে পারে না, বরং ভাবে যে সে নিজের যতœ নিচ্ছে বা উৎপাদনশীলতা বাড়াচ্ছে।

আরও উদ্বেগজনক হলো, এই শোষণকে ‘ক্ষমতায়ন’ হিসেবে প্রচার করা হয়। তরুণদের শেখানো হয় : তুমি নিজেই তোমার ব্র্যান্ড, তুমি ব্যর্থ হলে সেটি তোমারই দোষ।’ মানসিক চাপ? ‘মেডিটেশন করো’। ক্লায়েন্ট পাচ্ছো না? আরও ‘পার্সোনাল ব্র্যান্ডিং’ করো।

এভাবে ব্যক্তিগত সমস্যাকে ব্যক্তির ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে মূল শোষণ কাঠামোকে আড়াল করা হয়। এই হলো প্ল্যাটফর্ম পুঁজিবাদের সবচেয়ে মারাত্মক দিকÑএটি শোষণকে স্বপ্ন হিসেবে বিক্রি করে। এই নব্য-উদারনৈতিক বক্তব্য মানুষকে বিচ্ছিন্ন করে দেয় এবং তাদের কাঠামোগত সমস্যার সমাধান খুঁজতে বাধা দেয়। এটি ‘ব্যক্তিগত ব্যর্থতার আখ্যান’ তৈরি করে, যা সম্মিলিত প্রতিরোধ গড়ে তোলার পথ বন্ধ করে দেয় এবং শোষণমূলক ব্যবস্থাকে আরও শক্তিশালী করে।

তবে এই ব্যাপক শোষণের মুখেও প্রতিরোধ গড়ে উঠছে। বিশ্বব্যাপী তরুণেরা প্রশ্ন তুলছে- এই ক্লান্তিকর ‘হাসল কালচার’ কেন? কেন ডিজিটাল শ্রমের কোনো ন্যায্যতা নেই? বাংলাদেশেও কিছু প্রাথমিক উদ্যোগ দেখা যাচ্ছেÑ ফ্রিল্যান্সারদের সংগঠন, ন্যায্য পারিশ্রমিকের দাবি, মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর সচেতনতা বৃদ্ধির প্রয়াস; কিন্তু এগুলো এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে এবং একটি সুসংগঠিত আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য আরও অনেক পথ বাকি।

আমাদের প্রয়োজন এক ধরনের ‘ক্রিটিক্যাল ডিজিটাল লিটারেসি’- যেখানে কেবল ডিজিটাল দক্ষতা শেখানো হবে না, বরং আরও গভীরভাবে বোঝা হবে: কে এই প্রযুক্তি চালায়? কে লাভবান হয়? কারা পিছিয়ে পড়ে? কেন আমাদের ক্লান্তি ব্যক্তিগত নয়, বরং কাঠামোগত? এই সংস্কৃতি ভাঙতে হলে আমাদের বলতে হবেÑবিশ্রাম অপরাধ নয়, লগ-আউট করাও একধরনের স্বাধীন রাজনৈতিক অবস্থান। এটি কেবল ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত নয়, এটি ডিজিটাল শোষণের বিরুদ্ধে একটি নীরব বিদ্রোহ।

ডিজিটাল ভবিষ্যৎ যেন সুবিচার ও অন্তর্ভুক্তির হয়, তার জন্য দরকার প্রযুক্তির গণতান্ত্রিকীকরণ। দরকার এমন প্ল্যাটফর্ম যেখানে শ্রমিকদের সম্মান ও অধিকার থাকবে, শুধুই ডেটা নয়। না হলে এই ‘সর্বক্ষণ সক্রিয়’ সংস্কৃতি একদিন সম্পূর্ণ প্রজন্মের সৃজনশীলতা, আবেগ ও স্বপ্নকে নিঃশেষ করে ফেলবে।

প্রযুক্তি যদি আমাদের সময়, মনোযোগ ও জীবনের ওপর দখল রেখে চলে, তবে সেটি আর মুক্তি নয়Ñসেটি শোষণের এক নতুন রূপ। তাই সময় এসেছে এই ডিজিটাল ক্লান্তিকে ব্যক্তি সমস্যা নয়, বরং শ্রেণীভিত্তিক রাজনৈতিক প্রশ্ন হিসেবে দেখা এবং এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার। কিভাবে আমরা এই ডিজিটাল ক্লান্তি থেকে মুক্তি পেতে পারি এবং একটি ন্যায়সঙ্গত ডিজিটাল কর্মপরিবেশ তৈরি করতে পারিÑএটিই এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন।

[লেখক : গবেষক ও উন্নয়নকর্মী]

রম্যগদ্য : ‘ব্যাংক, ব্যাংক নয়’

মবতন্ত্রের জয়

ছবি

বোধের স্ফূরণ, না ‘মেটিকুলাস ডিজাইন’?

এসএসসিতে গণিত বিষয়ে ফল বিপর্যয় : কারণ ও উত্তরণের উপায়

দক্ষ মানবসম্পদ ও সমৃদ্ধ গ্রন্থাগার

আফ্রিকায় হঠাৎ কেন যুক্তরাষ্ট্রের ঝোঁক?

ঢাকা মহানগর ও বুড়িগঙ্গা

জামাই মেলা : উৎসব, ঐতিহ্য ও কৃষ্টির রঙিন চিত্রপট

হারিয়ে যাওয়া ক্লাস, কঠোর মূল্যায়ন আর প্রশ্নের জটিলতায় নুয়ে পড়া এক প্রজন্ম

বৈষম্য দূর করে নতুন বাংলাদেশ গড়ে তুলুন

চিকিৎসা যেন বাণিজ্যের হাতিয়ারে পরিণত না হয়

পথশিশু ও বাংলাদেশে সামাজিক চুক্তির ব্যর্থতা

মেগা প্রকল্প : প্রশ্ন হওয়া উচিত স্বচ্ছতা নিয়ে

আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া জরুরি

স্মার্ট দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা : উপগ্রহ চিত্র ও ওয়েবসাইটের অপরিহার্যতা

ক্ষমতা ও জনপ্রশাসন : আমলাতন্ত্রের ছায়াতলে আমজনতা

জনসংখ্যা : সম্পদ না সংকট?

ব্রিকসে নতুন ভূ-রাজনৈতিক ব্যবস্থার উত্থান

রম্যগদ্য : ‘ল্যাংড়া-লুলা, আতুড়-পাতুড়’

আষাঢ়ী পূর্ণিমা : আত্মশুদ্ধির সাধনায় বুদ্ধের অনন্ত আলো

বদলে যাওয়া মাটিতে সাহসী বীজ : জলবায়ুর বিপরীতে বাংলাদেশের কৃষির অভিযোজনগাথা

ছবি

জুলাই অভ্যুত্থান-গাথা : ‘শিকলে নাহি দিব ধরা’

প্রাচীন যৌধেয় জাতি ও তাদের সাম্যবাদী শাসন

গণঅভ্যুত্থান-উত্তর ন্যায়ভিত্তিক রাষ্ট্র বিনির্মাণের স্বপ্ন

টেকসই উন্নয়নের স্বপ্নপূরণে উপগ্রহ চিত্রই চাবিকাঠি

রাবার শিল্প : সংকট, করণীয় ও উত্তরণের দিশা

রম্যগদ্য : দুধ, দই, কলা...

ছবি

কোপার্নিকাস : আলো হয়ে জন্ম নেওয়া বৈপ্লবিক মতবাদের প্রবর্তক

জলবায়ু সংকটে মানবসভ্যতা

টেকসই অর্থনীতির জন্য চাই টেকসই ব্যাংকিং

ডিজিটাল দাসত্ব : মনোযোগ অর্থনীতি ও জ্ঞান পুঁজিবাদে তরুণ প্রজন্মের মননশীলতার অবক্ষয়

অন্তর্বর্তীকালীন সরকার : আস্থা ভঙ্গ ও জবাবদিহিতার সংকট

আসামি এখন নির্বাচন কমিশন

কোথায় হারাল একান্নবর্তী পরিবার?

এই শান্তি কি মহাঝড়ের পূর্বলক্ষণ?

মেগাসিটি : দারিদ্র্য যখন ‘অবাঞ্ছিত বর্জ্য’

tab

উপ-সম্পাদকীয়

ডিজিটাল ক্লান্তি ও ‘সর্বক্ষণ সক্রিয়’ সংস্কৃতির শ্রেণীগত রাজনীতি

মতিউর রহমান

বৃহস্পতিবার, ১৭ জুলাই ২০২৫

বর্তমান ডিজিটাল যুগ কাজ ও বিশ্রামের চিরাচরিত বিভাজনকে ক্রমবর্ধমান হারে অস্পষ্ট করে দিচ্ছে। বিশেষ করে বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের মধ্যবিত্ত তরুণ প্রজন্মের জন্য, প্রযুক্তি যা একসময় স্বাধীনতা ও সম্ভাবনার প্রতীক ছিল, আজ তা এক ক্লান্তিকর, নিরন্তর শ্রমের যন্ত্রে পরিণত হয়েছে। অনলাইন পড়াশোনা, ফ্রিল্যান্সিং গিগ, ডিজিটাল কনটেন্ট তৈরি এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় ‘সর্বক্ষণ সক্রিয়’ (অলওয়েজ অন) থাকার তাগিদÑ এই সবকিছু মিলে তাদের এক ধরনের ডিজিটাল দাসত্বে আটকে ফেলেছে।

প্রযুক্তি যা একসময় ‘স্বাধীনতা’ ও ‘সুযোগ’ হিসেবে ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয়েছিল, আজ তা সার্বক্ষণিক নজরদারির, অদৃশ্য শ্রমের এবং মানসিক শোষণের এক নির্মম বাস্তবতা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। এ রূপান্তর কেবল প্রযুক্তিগত নয়, এটি সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক; যা আমাদের শ্রমের ধারণা, ব্যক্তিগত পরিসর এবং মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর গভীর প্রভাব ফেলছে।

মার্ক্সীয় দৃষ্টিকোণ থেকে ডিজিটাল শ্রম বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, এ প্ল্যাটফর্মভিত্তিক অর্থনীতিতে ব্যবহারকারীরা নিজেদের স্বাধীন ইন্টারনেট ব্যবহারকারী মনে করলেও, তারা আসলে অবিরত শ্রম প্রদান করে চলেছে। তাদের ডেটা, ক্লিক, মনোযোগ, এবং সময়Ñ সবকিছুই একচেটিয়া কর্পোরেট প্ল্যাটফর্মগুলোর জন্য পণ্যে রূপান্তরিত হচ্ছে।

পূর্ববর্তী যুগের কারখানার মজুর যেমন একটি নির্দিষ্ট সময় কারখানায় শ্রম দিত, এখনকার ডিজিটাল কর্মী বা ব্যবহারকারী ২৪ ঘণ্টা এক অদৃশ্য উৎপাদন ব্যবস্থার অংশ। তাদের মনোযোগ, বিশ্রাম, এমনকি বিনোদনও রূপান্তরিত হয়েছে নতুন প্রকারের মুনাফার উৎসে।

এখানে শ্রমের পরিধি কারখানার নির্দিষ্ট সময়সীমা ছাড়িয়ে জীবনযাপনের প্রতিটি মুহূর্তকে গ্রাস করছে। ব্যবহারকারী যখন একটি পোস্ট স্ক্রল করে, একটি বিজ্ঞাপনে ক্লিক করে, বা বন্ধুদের সাথে চ্যাট করে, তখন তার এই প্রতিটি কার্যকলাপ প্ল্যাটফর্মের জন্য ডেটা তৈরি করে, যা বিজ্ঞাপনে ব্যবহৃত হয় বা অ্যালগরিদম উন্নত করে এবং এভাবেই মুনাফা অর্জিত হয়। এটি ‘সর্বাত্মক শ্রম’- এর একটি নতুন রূপ, যেখানে শ্রমের সঙ্গে ব্যক্তিগত জীবন ও অবসর ওতপ্রোতভাবে মিশে যায়।

বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত তরুণ-তরুণীরা এই ডিজিটাল পুঁজিবাদের চক্রে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত। তাদের একটি সাধারণ পরামর্শ দেওয়া হয় : ‘চাকরি না থাকলে স্কিল শেখো, ফ্রিল্যান্স করো, সোশ্যাল মিডিয়ায় নিজের ব্র্যান্ড তৈরি করো।’ কেউ গ্রাফিক ডিজাইন শিখছে, কেউ ওয়েব ডেভেলপমেন্ট, কেউ আবার ইনফ্লুয়েন্সার হওয়ার আশায় প্রতিদিন কনটেন্ট তৈরি করছে। এই কর্মযজ্ঞের কোনো স্থিতি নেই, নেই নিশ্চিত আয়, নেই স্বাস্থ্য সুরক্ষা বা সামাজিক নিরাপত্তা।

ফ্রিল্যান্স প্ল্যাটফর্মগুলোতে তাদের শ্রম আন্তর্জাতিক বাজারে সস্তায় বিক্রি হচ্ছে এবং তীব্র প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার জন্য তাদের সর্বক্ষণ সক্রিয় ও প্রতিক্রিয়াশীল থাকতে হচ্ছে। এটি একটি ‘হাসল কালচার’ তৈরি করেছে, যেখানে বিশ্রামকে অলসতা হিসেবে দেখা হয় এবং নিরন্তর কাজকে সাফল্যের চাবিকাঠি হিসেবে প্রচার করা হয়।

এই সংস্কৃতি তরুণদের মধ্যে অনিরাপদ, অস্থিতিশীল এবং অনিয়মিত আয়ের এক নতুন ক্ষেত্র তৈরি করেছে, যা তাদের ভবিষ্যৎকে আরও অনিশ্চিত করে তুলছে। তারা যেন একটি অদৃশ্য গিগ অর্থনীতির কারাগারে আবদ্ধ, যেখানে স্বাধীনতার নামে তাদের শ্রমের ওপর চূড়ান্ত নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখা হয়। এই সংস্কৃতি শুধু প্রযুক্তিগত নয়, এটি একেবারেই রাজনৈতিক এবং শ্রেণীগত। কারা সর্বক্ষণ ‘অন’ থাকতে পারবে, কারা নির্ভার বিশ্রাম নিতে পারবেÑতা নির্ধারিত হচ্ছে তাদের শ্রেণী ও লিঙ্গভিত্তিক অবস্থানের ওপর।

সচ্ছল পরিবারের সদস্যদের জন্য হয়তো কাজ ও অবসরের একটি সীমারেখা এখনো বিদ্যমান, কিন্তু যারা অনিশ্চিত ভবিষ্যতের ভয় নিয়ে বাঁচছেÑতাদের জন্য প্রতিটি মুহূর্তই একধরনের শ্রম। তাদের কাছে নিষ্ক্রিয় থাকাটা এক ধরনের বিলাসিতা। বিশেষ করে নারীরা, যুবসমাজ, বা প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর তরুণেরাÑতাদের জন্য ডিজিটাল সক্রিয়তা মানে শুধু তীব্র প্রতিযোগিতা নয়, মানে নিরাপত্তাহীনতা, মানে সর্বদা নিজেদের ‘প্রমাণ’ করে চলা যে তারা প্রাসঙ্গিক, যোগ্য ও উৎপাদনক্ষম।

এই গোষ্ঠীগুলোর ওপর ডিজিটাল শ্রমের বোঝা আরও বেশি, কারণ তাদের সমাজে এমনিতেই নানা ধরনের বৈষম্য ও প্রতিকূলতার মুখোমুখি হতে হয়। ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে তাদের উপস্থিতি প্রায়শই যৌন হয়রানি, ট্রলিং, এবং সহিংসতার ঝুঁকি বাড়ায়, যা তাদের জন্য ‘সর্বক্ষণ সক্রিয়’ থাকাকে আরও চ্যালেঞ্জিং করে তোলে। এটি ইন্টারসেকশনালিটির একটি সুস্পষ্ট উদাহরণ, যেখানে একাধিক প্রান্তিক পরিচয় একত্রিত হয়ে ব্যক্তির ওপর শোষণ ও চাপ বাড়িয়ে তোলে।

‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ ধারণার পেছনে রয়েছে একধরনের রোমান্টিসিজমÑযেখানে তরুণ-তরুণীরা ঘরে বসে ডলার আয় করবে, বৈশ্বিক বাজারে নিজেদের জায়গা করে নেবে। এ ধারণা একটি আলোকিত ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখায়; কিন্তু বাস্তবতা হলো : রাত জেগে ক্লায়েন্টের রিপ্লাই, চোখের নিচে কালো দাগ, নির্বিচারে কাজের চাপ, পারিশ্রমিক না পাওয়ার অনিশ্চয়তাÑএই হলো ফ্রিল্যান্স অর্থনীতির প্রতিদিনের তিক্ত অভিজ্ঞতা।

এই শ্রমের কোনো আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি নেই, নেই সঠিক পরিসংখ্যান, নেই কোনো শক্তিশালী সংগঠন। তারা একধরনের নতুন ডিজিটাল মজুর শ্রেণী- যারা মজুরি পায় না, কিন্তু অবিরাম উৎপাদন করে যায়। তাদের শ্রম পুঁজিবাদী ব্যবস্থার জন্য নতুন ধরনের ‘অতিরিক্ত মূল্য’ তৈরি করে, যা প্ল্যাটফর্ম মালিকদের পকেটে যায়। এই শ্রমিকদের কোনো কর্মসংস্থান চুক্তি নেই, নেই শ্রমিক অধিকার এবং তারা বাজারের অস্থিরতার শিকার। এই বাস্তবতা ‘ডিজিটাল বাংলাদেশের’ রোমান্টিক চিত্রকে সম্পূর্ণ ভেঙে দেয়।

কার্ল মার্ক্সের ‘সারপ্লাস ভ্যালু’ তত্ত্ব এখানে নিখুঁতভাবে প্রযোজ্য। প্ল্যাটফর্ম পুঁজিবাদ চিরাচরিত কারখানা তৈরি করে না, বরং ব্যবহারকারীদের সময়, মনোযোগ ও আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করে। এই অর্থনীতিতে তরুণেরা কেবল তাদের স্কিল নয়, নিজেদের চিন্তা, মনোযোগ, সাড়া দেওয়ার ক্ষমতা সব বিক্রি করে। এমনকি বিশ্রামও একটি পণ্য হয়ে উঠেছেÑ ‘সেল্ফ-কেয়ার’ অ্যাপ, ‘ফোকাস বুস্টার’, ‘প্রোডাক্টিভিটি হ্যাক্স’Ñ এগুলো সবই একেকটি নতুন বাজার, যা মূলত মানুষকে আরও উৎপাদনক্ষম করে তোলার উদ্দেশ্যে কাজ করে।

এই প্রক্রিয়াটি মনস্তাত্ত্বিক পুঁজিবাদের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক, যেখানে মানুষের মানসিক অবস্থা এবং সুস্থতাও পুঁজির উপকরণে পরিণত হয়। এই অদৃশ্য শোষণ এতটাই সূক্ষ্ম যে অনেক সময় ব্যবহারকারী নিজেই এটি উপলব্ধি করতে পারে না, বরং ভাবে যে সে নিজের যতœ নিচ্ছে বা উৎপাদনশীলতা বাড়াচ্ছে।

আরও উদ্বেগজনক হলো, এই শোষণকে ‘ক্ষমতায়ন’ হিসেবে প্রচার করা হয়। তরুণদের শেখানো হয় : তুমি নিজেই তোমার ব্র্যান্ড, তুমি ব্যর্থ হলে সেটি তোমারই দোষ।’ মানসিক চাপ? ‘মেডিটেশন করো’। ক্লায়েন্ট পাচ্ছো না? আরও ‘পার্সোনাল ব্র্যান্ডিং’ করো।

এভাবে ব্যক্তিগত সমস্যাকে ব্যক্তির ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে মূল শোষণ কাঠামোকে আড়াল করা হয়। এই হলো প্ল্যাটফর্ম পুঁজিবাদের সবচেয়ে মারাত্মক দিকÑএটি শোষণকে স্বপ্ন হিসেবে বিক্রি করে। এই নব্য-উদারনৈতিক বক্তব্য মানুষকে বিচ্ছিন্ন করে দেয় এবং তাদের কাঠামোগত সমস্যার সমাধান খুঁজতে বাধা দেয়। এটি ‘ব্যক্তিগত ব্যর্থতার আখ্যান’ তৈরি করে, যা সম্মিলিত প্রতিরোধ গড়ে তোলার পথ বন্ধ করে দেয় এবং শোষণমূলক ব্যবস্থাকে আরও শক্তিশালী করে।

তবে এই ব্যাপক শোষণের মুখেও প্রতিরোধ গড়ে উঠছে। বিশ্বব্যাপী তরুণেরা প্রশ্ন তুলছে- এই ক্লান্তিকর ‘হাসল কালচার’ কেন? কেন ডিজিটাল শ্রমের কোনো ন্যায্যতা নেই? বাংলাদেশেও কিছু প্রাথমিক উদ্যোগ দেখা যাচ্ছেÑ ফ্রিল্যান্সারদের সংগঠন, ন্যায্য পারিশ্রমিকের দাবি, মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর সচেতনতা বৃদ্ধির প্রয়াস; কিন্তু এগুলো এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে এবং একটি সুসংগঠিত আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য আরও অনেক পথ বাকি।

আমাদের প্রয়োজন এক ধরনের ‘ক্রিটিক্যাল ডিজিটাল লিটারেসি’- যেখানে কেবল ডিজিটাল দক্ষতা শেখানো হবে না, বরং আরও গভীরভাবে বোঝা হবে: কে এই প্রযুক্তি চালায়? কে লাভবান হয়? কারা পিছিয়ে পড়ে? কেন আমাদের ক্লান্তি ব্যক্তিগত নয়, বরং কাঠামোগত? এই সংস্কৃতি ভাঙতে হলে আমাদের বলতে হবেÑবিশ্রাম অপরাধ নয়, লগ-আউট করাও একধরনের স্বাধীন রাজনৈতিক অবস্থান। এটি কেবল ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত নয়, এটি ডিজিটাল শোষণের বিরুদ্ধে একটি নীরব বিদ্রোহ।

ডিজিটাল ভবিষ্যৎ যেন সুবিচার ও অন্তর্ভুক্তির হয়, তার জন্য দরকার প্রযুক্তির গণতান্ত্রিকীকরণ। দরকার এমন প্ল্যাটফর্ম যেখানে শ্রমিকদের সম্মান ও অধিকার থাকবে, শুধুই ডেটা নয়। না হলে এই ‘সর্বক্ষণ সক্রিয়’ সংস্কৃতি একদিন সম্পূর্ণ প্রজন্মের সৃজনশীলতা, আবেগ ও স্বপ্নকে নিঃশেষ করে ফেলবে।

প্রযুক্তি যদি আমাদের সময়, মনোযোগ ও জীবনের ওপর দখল রেখে চলে, তবে সেটি আর মুক্তি নয়Ñসেটি শোষণের এক নতুন রূপ। তাই সময় এসেছে এই ডিজিটাল ক্লান্তিকে ব্যক্তি সমস্যা নয়, বরং শ্রেণীভিত্তিক রাজনৈতিক প্রশ্ন হিসেবে দেখা এবং এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার। কিভাবে আমরা এই ডিজিটাল ক্লান্তি থেকে মুক্তি পেতে পারি এবং একটি ন্যায়সঙ্গত ডিজিটাল কর্মপরিবেশ তৈরি করতে পারিÑএটিই এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন।

[লেখক : গবেষক ও উন্নয়নকর্মী]

back to top