রবীন্দ্র কুমার বকসী
তাজউদ্দীন আহমদ
স্রোতস্বিনী শীতলক্ষ্যার কুল ঘেঁষে অবস্থিত শাল-গজারিবেষ্টিত পাখিডাকা-ছায়াঘেরা শ্যামল-সবুজ একটি গ্রামের নাম দরদরিয়া। গাজীপুর জেলার অন্তর্গত কাপাসিয়া উপজেলার ঐতিহ্যবাহী এই গ্রামে ১৯২৫ সালের ২৩ জুলাই এক শিশু জন্মগ্রহণ করে। মা-বাবা অতি আদর করে শিশুটির নাম রেখেছিলেন তাজউদ্দীন। তাজ শব্দের অর্থ মাথার মুকুট।
সেন্ট গ্রেগরিজ হাই স্কুল থেকে তিনি ১৯৪৪ সালে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় বোর্ডে দ্বাদশ স্থান অধিকার করেন। ১৯৪৮ সালে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় তিনি চতুর্থ হন। পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্সসহ অর্থনীতিতে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন।
রাজনীতিতে অতি ব্যস্ততার কারণে তার পক্ষে এমএ ডিগ্রি অর্জন করা সম্ভব হয়নি। তিনি জেলে থেকে পরীক্ষা দিয়ে আইন শাস্ত্রে স্নাতক হন।
রক্ষণশীল মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেও তিনি মনে প্রাণে ছিলেন আধুনিক ও প্রগতিশীল। স্কুলজীবন থেকেই তাজউদ্দীন রাজনৈতিক ও সামাজিক কর্মকা-ে যুক্ত ছিলেন। স্কুলে পড়াকালীন তিনি স্কাউট ও সিভিল ডিফেন্স আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।
দ্বি-জাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর থেকে ভাষার অধিকার, অর্থনৈতিক মুক্তি এবং সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী সব আন্দোলনে তাজউদ্দীন সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। তিনি রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ছিলেন। ১৯৫৫ সালে তিনি আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সাংস্কৃতিক ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৬২ সালে সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার আন্দোলনে তিনি সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে কারাবরণ করেন।
১৯৬৪ সালে তিনি আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৬৬ সালে ৬ দফা আন্দোলনের অন্যতম রূপকার ছিলেন তাজউদ্দীন আহমদ। তিনি সাংগঠনিক দক্ষতা ও একনিষ্ঠতার গুনে ইতোমধ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের একজন ঘনিষ্ঠ সহযোগী হয়ে ওঠেন। এ বছরই তিনি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।
১৯৭০ সালে পাকিস্তানের সামরিক শাসক ইয়াহিয়ার অধীনে সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। আওয়ামী লীগ পূর্ব বাংলায় ১৬৯ আসনের মধ্যে ১৬৭টি আসনে জয়লাভ করে। তাজউদ্দীন আহমদ তার নির্বাচনী এলাকা কাপাসিয়া থেকে বিপুল ভোটের ব্যবধানে জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন।
১৯৭১ সালের ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) বঙ্গবন্ধু ১০ লক্ষাধিক লোকের সমাবেশে দেশবাসীকে স্বাধীনতা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হওয়ার আহ্বান জানান এবং অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন। তিনি বলেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ তাজউদ্দীন আহমদ অসহযোগ আন্দোলনের সব সাংগঠনিক কার্যক্রম অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে পরিচালনা করেন।
১০ এপ্রিল ১৯৭১ বাংলাদেশের সরকার গঠিত হলে তাজউদ্দীন আহমদ সর্বসম্মতিক্রমে প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। ওইদিন থেকেই বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটি ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’ নামে বিশ্ব মানচিত্রে স্থান করে নেয়। ১০ এপ্রিলকে প্রজাতন্ত্র দিবস হিসেবে পালন করার জন্য বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের পক্ষ থেকে দাবি উঠেছে। কিন্তু দিনটি প্রজাতন্ত্র দিবস হিসেবে পালিত হয় না। ভারত-পাকিস্তানসহ বিভিন্ন দেশে প্রজাতন্ত্র দিবস পালিত হয়।
১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীনসহ মন্ত্রিসভার অন্য সদস্যরা মুজিবনগরে (বৈদ্যনাথতলা) স্থানীয় জনগণ এবং দেশি-বিদেশি সাংবাদিকদের উপস্থিতিতে শপথবাক্য পাঠ করেন।
পলাশীর আম্রকাননে মীর জাফরের বিশ্বাসঘাতকতায় বাঙালির স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হয়েছিল। আবার আড়াইশ বছর পর আম্রকাননে স্বাধীনতার রক্তিম সূর্য উদিত হলো।
তাজউদ্দীন আহমদের জীবনে সবচেয়ে সাফল্য হলো বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক নেতৃত্ব দান করা। তিনি অতি বিচক্ষণতার সঙ্গে ঘরে-বাইরে স্বাধীনতার শত্রুদের মোকাবিলা করে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করেন। মুজিবনগর সরকারের সময় থেকেই মোশতাক এবং তার সহযোগীরা মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে গভীর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিল। ষড়যন্ত্রকারীদের ভূমিকা মনে রেখেই তাজউদ্দীন এবং তার শীর্ষ সহকর্মীদের সফলতা ও ব্যর্থতা মূল্যায়ন করতে হবে।
বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতীয়তার যে বিশাল ক্যানভাস তৈরি করেছেন তাতেই তাজউদ্দীন তার সহকর্মীদের নিয়ে সৃজনশীল সাংগঠনিক তুলির আঁচড়ে টেনে টেনে বাংলাদেশ নামে এক অনবদ্য তৈলচিত্র এঁকেছেন।
তাজউদ্দীন আহমদের প্রজ্ঞা ও বিচক্ষণতা ছিল প্রশ্নাতীত। তিনি খন্দকার মোশতাকের ষড়যন্ত্র টের পেয়ে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে বাংলাদেশ প্রতিনিধি দল থেকে মোশতাককে বাদ দিয়ে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীকে প্রতিনিধি দলের নেতা নির্বাচন করেন।
বাঙালি জাতির পরম সৌভাগ্য যে, তাজউদ্দীন আহমদের মতো একজন দক্ষ, বিচক্ষণ ও ত্যাগী নেতার নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয়েছিল।
নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ নামের এক স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটে। তাজউদ্দীন আহমদ দেশবাসীকে উপহার দিয়েছেন স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। জনতার হাতে তুলে দিয়েছেন ত্রিশ লাখ শহীদের রক্তে রঞ্জিত লাল-সবুজের পতাকা। একজন রাজনৈতিক নেতার জীবনে এর চেয়ে বড় সাফল্য আর কী হতে পারে?
তাজউদ্দীন আহমদের মতো আত্মপ্রচারবিমুখ নেতা রাজনীতির ইতিহাসে বিরল। নিজে কাজ করে কৃতিত্ব দিয়েছেন অন্যকে। তিনি সবসময় নিজেকে পর্দার আড়ালে রেখেছেন। তার মতো নিরহংকারী ও নির্লোভ নেতা সমকালীন রাজনীতিতে খুঁজে পাওয়া কঠিন। তাজুদ্দীনের অভূতপূর্ব সাংগঠনিক দক্ষতা ও মেধা এ দুয়ে মিলেই মুক্তিযুদ্ধের সাফল্য নিশ্চিত হয়েছিল। নানা প্রতিকূলতা সত্ত্বেও তাজউদ্দীন এক আত্মপ্রত্যয়ী জাতির জন্মলগ্নে ধাত্রীর কাজটি সযতেœ সম্পন্ন করেছিলেন।
স্বাধীন বাংলাদেশে যে কটি দিন সরকার প্রধান ছিলেন সেই সময়ে তিনি তার দক্ষতা-দূরদর্শিতা ও পরিপক্কতার সাক্ষর রেখেছিলেন। পরবর্তীকালে অর্থমন্ত্রী হিসেবে সীমিত ক্ষমতার মধ্যেও তিনি স্বদেশি ভাবনার ভাব রেখে গেছেন। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে ১৯৭৪ সালের ২৬ অক্টোবর তাজউদ্দীন মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করেন।
মুজিব-তাজউদ্দীনের রাজনৈতিক বিভাজনে বাংলার রাজনীতির আকাশ কালো মেঘে আচ্ছন্ন হয়ে ওঠে, ষড়যন্ত্রকারীদের চলার পথ প্রশস্ত হয়ে যায়। খন্দকার মোশতাক তার সহযোগীদের নিয়ে স্বাধীনতার ভিত্তিমূলে প্রচ- আঘাত হানার পরিকল্পনা গ্রহণ করে।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ষড়যন্ত্রকারীরা বঙ্গবন্ধুকে তার শিশুপুত্রসহ সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করে। নিজেদের ক্ষমতা নিষ্কণ্টক করার জন্য খুনিরা ৩ নভেম্বর গভীর রাতে জেলখানার অভ্যন্তরে তাজউদ্দীনসহ জাতীয় চার নেতাকে নৃশংসভাবে হত্যা করে পৃথিবীর ইতিহাসে আরেকটি কলঙ্কজনক অধ্যায় সৃষ্টি করে।
তাজউদ্দীন অন্য তিন সহকর্মীরসহ জীবন উৎসর্গ করে বঙ্গবন্ধুর রক্তের ঋণ পরিশোধ করে গেছেন। তাজউদ্দীন সারা জীবন নিজ দল ও বাংলাদেশের প্রতি অনুগত ছিলেন। তিনি নতুন প্রজন্মের জন্য রাজনৈতিক আদর্শের যে ঐতিহ্য ও অপূর্ণ স্বপ্ন রেখে গেছেন নতুন প্রজন্ম তার রাজনৈতিক আদর্শকে হৃদয় ধারণ করে অবশ্যই সেই স্বপ্ন বাস্তবে রূপ দেবে।
তবে অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় যে, জাতীয় কিংবা দলীয়ভাবে কোন সময় তাজউদ্দীনের মত মহান নেতার যথার্থ মূল্যায়ন হয়নি। তাজউদ্দীন বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে এক ট্রাজিক নায়ক। মৃত্যু তাজউদ্দীন আহমদকে মহিমান্বিত করে, নতুন রূপে উদ্ভাসিত হন তিনি। এদেশের রাজনীতিতে তার রেখে যাওয়া কর্ম-ভাবনা আলোর দ্যুতি ছড়ায়। বাঙালির মুক্তি সংগ্রামে তাজউদ্দীন আহমদের অসামান্য অবদান ইতিহাসের পাতায় চির অক্ষয় হয়ে থাকবে।
[লেখক : অবসরপ্রাপ্ত কলেজ শিক্ষক]
রবীন্দ্র কুমার বকসী
তাজউদ্দীন আহমদ
বুধবার, ২৩ জুলাই ২০২৫
স্রোতস্বিনী শীতলক্ষ্যার কুল ঘেঁষে অবস্থিত শাল-গজারিবেষ্টিত পাখিডাকা-ছায়াঘেরা শ্যামল-সবুজ একটি গ্রামের নাম দরদরিয়া। গাজীপুর জেলার অন্তর্গত কাপাসিয়া উপজেলার ঐতিহ্যবাহী এই গ্রামে ১৯২৫ সালের ২৩ জুলাই এক শিশু জন্মগ্রহণ করে। মা-বাবা অতি আদর করে শিশুটির নাম রেখেছিলেন তাজউদ্দীন। তাজ শব্দের অর্থ মাথার মুকুট।
সেন্ট গ্রেগরিজ হাই স্কুল থেকে তিনি ১৯৪৪ সালে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় বোর্ডে দ্বাদশ স্থান অধিকার করেন। ১৯৪৮ সালে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় তিনি চতুর্থ হন। পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্সসহ অর্থনীতিতে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন।
রাজনীতিতে অতি ব্যস্ততার কারণে তার পক্ষে এমএ ডিগ্রি অর্জন করা সম্ভব হয়নি। তিনি জেলে থেকে পরীক্ষা দিয়ে আইন শাস্ত্রে স্নাতক হন।
রক্ষণশীল মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেও তিনি মনে প্রাণে ছিলেন আধুনিক ও প্রগতিশীল। স্কুলজীবন থেকেই তাজউদ্দীন রাজনৈতিক ও সামাজিক কর্মকা-ে যুক্ত ছিলেন। স্কুলে পড়াকালীন তিনি স্কাউট ও সিভিল ডিফেন্স আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।
দ্বি-জাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর থেকে ভাষার অধিকার, অর্থনৈতিক মুক্তি এবং সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী সব আন্দোলনে তাজউদ্দীন সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। তিনি রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ছিলেন। ১৯৫৫ সালে তিনি আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সাংস্কৃতিক ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৬২ সালে সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার আন্দোলনে তিনি সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে কারাবরণ করেন।
১৯৬৪ সালে তিনি আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৬৬ সালে ৬ দফা আন্দোলনের অন্যতম রূপকার ছিলেন তাজউদ্দীন আহমদ। তিনি সাংগঠনিক দক্ষতা ও একনিষ্ঠতার গুনে ইতোমধ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের একজন ঘনিষ্ঠ সহযোগী হয়ে ওঠেন। এ বছরই তিনি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।
১৯৭০ সালে পাকিস্তানের সামরিক শাসক ইয়াহিয়ার অধীনে সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। আওয়ামী লীগ পূর্ব বাংলায় ১৬৯ আসনের মধ্যে ১৬৭টি আসনে জয়লাভ করে। তাজউদ্দীন আহমদ তার নির্বাচনী এলাকা কাপাসিয়া থেকে বিপুল ভোটের ব্যবধানে জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন।
১৯৭১ সালের ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) বঙ্গবন্ধু ১০ লক্ষাধিক লোকের সমাবেশে দেশবাসীকে স্বাধীনতা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হওয়ার আহ্বান জানান এবং অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন। তিনি বলেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ তাজউদ্দীন আহমদ অসহযোগ আন্দোলনের সব সাংগঠনিক কার্যক্রম অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে পরিচালনা করেন।
১০ এপ্রিল ১৯৭১ বাংলাদেশের সরকার গঠিত হলে তাজউদ্দীন আহমদ সর্বসম্মতিক্রমে প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। ওইদিন থেকেই বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটি ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’ নামে বিশ্ব মানচিত্রে স্থান করে নেয়। ১০ এপ্রিলকে প্রজাতন্ত্র দিবস হিসেবে পালন করার জন্য বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের পক্ষ থেকে দাবি উঠেছে। কিন্তু দিনটি প্রজাতন্ত্র দিবস হিসেবে পালিত হয় না। ভারত-পাকিস্তানসহ বিভিন্ন দেশে প্রজাতন্ত্র দিবস পালিত হয়।
১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীনসহ মন্ত্রিসভার অন্য সদস্যরা মুজিবনগরে (বৈদ্যনাথতলা) স্থানীয় জনগণ এবং দেশি-বিদেশি সাংবাদিকদের উপস্থিতিতে শপথবাক্য পাঠ করেন।
পলাশীর আম্রকাননে মীর জাফরের বিশ্বাসঘাতকতায় বাঙালির স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হয়েছিল। আবার আড়াইশ বছর পর আম্রকাননে স্বাধীনতার রক্তিম সূর্য উদিত হলো।
তাজউদ্দীন আহমদের জীবনে সবচেয়ে সাফল্য হলো বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক নেতৃত্ব দান করা। তিনি অতি বিচক্ষণতার সঙ্গে ঘরে-বাইরে স্বাধীনতার শত্রুদের মোকাবিলা করে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করেন। মুজিবনগর সরকারের সময় থেকেই মোশতাক এবং তার সহযোগীরা মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে গভীর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিল। ষড়যন্ত্রকারীদের ভূমিকা মনে রেখেই তাজউদ্দীন এবং তার শীর্ষ সহকর্মীদের সফলতা ও ব্যর্থতা মূল্যায়ন করতে হবে।
বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতীয়তার যে বিশাল ক্যানভাস তৈরি করেছেন তাতেই তাজউদ্দীন তার সহকর্মীদের নিয়ে সৃজনশীল সাংগঠনিক তুলির আঁচড়ে টেনে টেনে বাংলাদেশ নামে এক অনবদ্য তৈলচিত্র এঁকেছেন।
তাজউদ্দীন আহমদের প্রজ্ঞা ও বিচক্ষণতা ছিল প্রশ্নাতীত। তিনি খন্দকার মোশতাকের ষড়যন্ত্র টের পেয়ে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে বাংলাদেশ প্রতিনিধি দল থেকে মোশতাককে বাদ দিয়ে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীকে প্রতিনিধি দলের নেতা নির্বাচন করেন।
বাঙালি জাতির পরম সৌভাগ্য যে, তাজউদ্দীন আহমদের মতো একজন দক্ষ, বিচক্ষণ ও ত্যাগী নেতার নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয়েছিল।
নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ নামের এক স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটে। তাজউদ্দীন আহমদ দেশবাসীকে উপহার দিয়েছেন স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। জনতার হাতে তুলে দিয়েছেন ত্রিশ লাখ শহীদের রক্তে রঞ্জিত লাল-সবুজের পতাকা। একজন রাজনৈতিক নেতার জীবনে এর চেয়ে বড় সাফল্য আর কী হতে পারে?
তাজউদ্দীন আহমদের মতো আত্মপ্রচারবিমুখ নেতা রাজনীতির ইতিহাসে বিরল। নিজে কাজ করে কৃতিত্ব দিয়েছেন অন্যকে। তিনি সবসময় নিজেকে পর্দার আড়ালে রেখেছেন। তার মতো নিরহংকারী ও নির্লোভ নেতা সমকালীন রাজনীতিতে খুঁজে পাওয়া কঠিন। তাজুদ্দীনের অভূতপূর্ব সাংগঠনিক দক্ষতা ও মেধা এ দুয়ে মিলেই মুক্তিযুদ্ধের সাফল্য নিশ্চিত হয়েছিল। নানা প্রতিকূলতা সত্ত্বেও তাজউদ্দীন এক আত্মপ্রত্যয়ী জাতির জন্মলগ্নে ধাত্রীর কাজটি সযতেœ সম্পন্ন করেছিলেন।
স্বাধীন বাংলাদেশে যে কটি দিন সরকার প্রধান ছিলেন সেই সময়ে তিনি তার দক্ষতা-দূরদর্শিতা ও পরিপক্কতার সাক্ষর রেখেছিলেন। পরবর্তীকালে অর্থমন্ত্রী হিসেবে সীমিত ক্ষমতার মধ্যেও তিনি স্বদেশি ভাবনার ভাব রেখে গেছেন। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে ১৯৭৪ সালের ২৬ অক্টোবর তাজউদ্দীন মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করেন।
মুজিব-তাজউদ্দীনের রাজনৈতিক বিভাজনে বাংলার রাজনীতির আকাশ কালো মেঘে আচ্ছন্ন হয়ে ওঠে, ষড়যন্ত্রকারীদের চলার পথ প্রশস্ত হয়ে যায়। খন্দকার মোশতাক তার সহযোগীদের নিয়ে স্বাধীনতার ভিত্তিমূলে প্রচ- আঘাত হানার পরিকল্পনা গ্রহণ করে।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ষড়যন্ত্রকারীরা বঙ্গবন্ধুকে তার শিশুপুত্রসহ সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করে। নিজেদের ক্ষমতা নিষ্কণ্টক করার জন্য খুনিরা ৩ নভেম্বর গভীর রাতে জেলখানার অভ্যন্তরে তাজউদ্দীনসহ জাতীয় চার নেতাকে নৃশংসভাবে হত্যা করে পৃথিবীর ইতিহাসে আরেকটি কলঙ্কজনক অধ্যায় সৃষ্টি করে।
তাজউদ্দীন অন্য তিন সহকর্মীরসহ জীবন উৎসর্গ করে বঙ্গবন্ধুর রক্তের ঋণ পরিশোধ করে গেছেন। তাজউদ্দীন সারা জীবন নিজ দল ও বাংলাদেশের প্রতি অনুগত ছিলেন। তিনি নতুন প্রজন্মের জন্য রাজনৈতিক আদর্শের যে ঐতিহ্য ও অপূর্ণ স্বপ্ন রেখে গেছেন নতুন প্রজন্ম তার রাজনৈতিক আদর্শকে হৃদয় ধারণ করে অবশ্যই সেই স্বপ্ন বাস্তবে রূপ দেবে।
তবে অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় যে, জাতীয় কিংবা দলীয়ভাবে কোন সময় তাজউদ্দীনের মত মহান নেতার যথার্থ মূল্যায়ন হয়নি। তাজউদ্দীন বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে এক ট্রাজিক নায়ক। মৃত্যু তাজউদ্দীন আহমদকে মহিমান্বিত করে, নতুন রূপে উদ্ভাসিত হন তিনি। এদেশের রাজনীতিতে তার রেখে যাওয়া কর্ম-ভাবনা আলোর দ্যুতি ছড়ায়। বাঙালির মুক্তি সংগ্রামে তাজউদ্দীন আহমদের অসামান্য অবদান ইতিহাসের পাতায় চির অক্ষয় হয়ে থাকবে।
[লেখক : অবসরপ্রাপ্ত কলেজ শিক্ষক]