জোবায়দুর রশীদ
বাংলাদেশে মনোবিজ্ঞান বিষয়ে পড়ালেখা করে সরাসরি মানসিক স্বাস্থ্যসেবা বা চিকিৎসা করার আইনি সত্তা সীমিত ও নির্দিষ্ট কিছু নিয়মের মধ্যে সীমাবদ্ধ। মূল বিষয়গুলো হলোÑ
ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট : যদি কেউ মনোবিজ্ঞানে মাস্টার্সের পর ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিতে বিশেষায়িত মাস্টার্স বা পিএইচডি করে এবং ইন্টার্নশিপ করে, তখন তারা ‘ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট’ হিসেবে কাজ করতে পারেন।
এ ধরনের সাইকোলজিস্টরা কাউন্সেলিং, থেরাপি (যেমন সিবিটি, সাইকোথেরাপি) করতে পারেন। তবে তারা সরাসরি ওষুধ প্রেসক্রাইব করতে পারেন নাÑকারণ ওষুধ দেয়ার অধিকার শুধু চিকিৎসকদের থাকে।
সাইকিয়াট্রিস্ট : সাইকিয়াট্রিস্টরা হচ্ছেন এমবিবিএস পাস করা ডাক্তার, যারা পরবর্তীতে সাইকিয়াট্রিতে (এমডি, এফসিপিএস সাইকিয়াট্রি) বিশেষায়ন করেন। তাদের আইনি অধিকার আছে রোগ নির্ণয় ও ওষুধ প্রেসক্রাইব করার। মনোবিজ্ঞানের শিক্ষার্থী এখানে আসতে পারেন না, যদি না ডাক্তারি ডিগ্রি থাকে।
কাউন্সেলর : মনোবিজ্ঞানে ডিগ্রি থাকলে বা কাউন্সেলিংয়ে বিশেষ কোর্স করলে কাউন্সেলিং সেবা (পরামর্শ, থেরাপি) দেয়া যায়। তবে এটা চিকিৎসা বা ওষুধ ব্যবস্থাপনা হিসেবে ধরা হয় না। বরং ‘কাউন্সেলিং সার্ভিস’ বা ‘থেরাপি’ হিসেবে থাকে।
আইনগত নীতিমালা : বাংলাদেশে ২০১৮ সালে ‘মানসিক স্বাস্থ্য আইন’ পাস হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, নিবন্ধন ছাড়া কেউ নিজেকে মানসিক চিকিৎসক বা মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ দাবি করতে পারবেন না। ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্টদের আলাদাভাবে রেজিস্ট্রেশনের নিয়ম আছে। কাউন্সেলিং বা থেরাপি দিতে হলে সংশ্লিষ্ট অনুমোদিত প্রতিষ্ঠানে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হতে হবে।
সোজা করে বললে মনোবিজ্ঞান বিষয়ে পড়া কেউ চিকিৎসক নন, তবে প্রশিক্ষণ নিয়ে তারা কাউন্সেলিং ও থেরাপি করতে পারেন। ওষুধ বা ডায়াগনসিস করার অধিকার তাদের নেই। ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি বা পরামর্শদান ক্ষেত্রেই তাদের কর্মক্ষেত্র। এই কাজ করার জন্য যথাযথ শিক্ষা, ইন্টার্নশিপ এবং প্রয়োজনে লাইসেন্স বা রেজিস্ট্রেশন থাকা উচিত।
তাহলে ১৮ কোটি মানুষের মন স্বাস্থ্যসেবা পূরণ কিভাবে সম্ভব? পরিসংখ্যান বলছে বাংলাদেশে প্রতি ১০ লাখ মানুষের জন্য মাত্র ০.৪ মনোবিজ্ঞানী আছেন! ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট সংখ্যা ৫০০-৬০০ এর মতো। মনোরোগ চিকিৎসক আছে আনুমানিক ২৫০-৩০০ জনের মতো। অথচ ১৮-২০ কোটি মানুষের ২০%-২৫% মানুষ কোনো না কোনো পর্যায়ে মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যায় ভোগেন। মানে, বিশাল জনসংখ্যার তুলনায় বিশেষজ্ঞদের সংখ্যা নগণ্য। একেকজন বিশেষজ্ঞের দায়িত্ব প্রায় ৩ লাখ মানুষের ওপরে পড়ে, যা সম্পূর্ণ অবাস্তব।
কেন সংকট? মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে সামাজিক কুসংস্কারÑমানুষ মনে করে, মানসিক সমস্যা মানেই পাগল। মানসিক স্বাস্থ্য নীতিমালা খুব দুর্বলভাবে বাস্তবায়িত। প্রশিক্ষিত পেশাদার খুব কমÑইউনিভার্সিটিতে খুব কম জায়গায় ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি পড়ানো হয়। সরকারি বাজেট খুব কমÑস্বাস্থ্য খাতে মোট বাজেটের ১%-এরও কম মানসিক স্বাস্থ্য খাতে যায়। প্রশিক্ষণ এবং লাইসেন্সিং ব্যবস্থা যথেষ্ট শক্তিশালী নয়।
সমাধানের পথ কী হতে পারে? বেসিক কাউন্সেলিং প্রশিক্ষণ নিয়ে বড় আকারে স্কেল-আপ করাÑযাতে অনেক বেশি সাধারণ প্রশিক্ষক মাঠে নামানো যায়। কমিউনিটি-ভিত্তিক প্রোগ্রামÑগ্রাম থেকে শহর পর্যন্ত প্রাথমিক মানসিক সহায়তা প্রশিক্ষণ। টেলি-হেলথ বা অনলাইন কাউন্সেলিং প্ল্যাটফর্ম গড়ে তোলা। স্কুল-কলেজে মানসিক স্বাস্থ্য এডুকেশন বাধ্যতামূলক করা। চিকিৎসকদের সঙ্গে সহযোগিতামূলক কাজ করাÑযেমন সাইকিয়াট্রিস্ট ও সাইকোলজিস্ট একসঙ্গে দলগতভাবে কাজ করবেন। লাইসেন্স ও রেজিস্ট্রেশন সহজ করা প্রশিক্ষিত সাইকোলজিস্টদের জন্য। সচেতনতা বাড়ানোÑযাতে মানুষ মানসিক সমস্যাকে চিকিৎসাযোগ্য রোগ হিসেবে দেখে।
বাস্তব কথা হলো এখন যেভাবে আছে, তাতে রাষ্ট্রীয়ভাবে ও বেসরকারি উদ্যাগে বড় পরিকল্পনা ও বিনিয়োগ ছাড়া মানসিক স্বাস্থ্যসেবায় উন্নতি সম্ভব না। বিশেষজ্ঞ তৈরি, মিড-লেভেল কাউন্সেলর তৈরি ও সাধারণ চিকিৎসকদের ট্রেনিংÑএগুলো একসঙ্গে ঘটাতে হবে।
[ লেখক : নির্বাহী সদস্য, ইউনাইট থিয়েটার ফর সোশ্যাল অ্যাকশন ]
জোবায়দুর রশীদ
বুধবার, ২৩ জুলাই ২০২৫
বাংলাদেশে মনোবিজ্ঞান বিষয়ে পড়ালেখা করে সরাসরি মানসিক স্বাস্থ্যসেবা বা চিকিৎসা করার আইনি সত্তা সীমিত ও নির্দিষ্ট কিছু নিয়মের মধ্যে সীমাবদ্ধ। মূল বিষয়গুলো হলোÑ
ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট : যদি কেউ মনোবিজ্ঞানে মাস্টার্সের পর ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিতে বিশেষায়িত মাস্টার্স বা পিএইচডি করে এবং ইন্টার্নশিপ করে, তখন তারা ‘ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট’ হিসেবে কাজ করতে পারেন।
এ ধরনের সাইকোলজিস্টরা কাউন্সেলিং, থেরাপি (যেমন সিবিটি, সাইকোথেরাপি) করতে পারেন। তবে তারা সরাসরি ওষুধ প্রেসক্রাইব করতে পারেন নাÑকারণ ওষুধ দেয়ার অধিকার শুধু চিকিৎসকদের থাকে।
সাইকিয়াট্রিস্ট : সাইকিয়াট্রিস্টরা হচ্ছেন এমবিবিএস পাস করা ডাক্তার, যারা পরবর্তীতে সাইকিয়াট্রিতে (এমডি, এফসিপিএস সাইকিয়াট্রি) বিশেষায়ন করেন। তাদের আইনি অধিকার আছে রোগ নির্ণয় ও ওষুধ প্রেসক্রাইব করার। মনোবিজ্ঞানের শিক্ষার্থী এখানে আসতে পারেন না, যদি না ডাক্তারি ডিগ্রি থাকে।
কাউন্সেলর : মনোবিজ্ঞানে ডিগ্রি থাকলে বা কাউন্সেলিংয়ে বিশেষ কোর্স করলে কাউন্সেলিং সেবা (পরামর্শ, থেরাপি) দেয়া যায়। তবে এটা চিকিৎসা বা ওষুধ ব্যবস্থাপনা হিসেবে ধরা হয় না। বরং ‘কাউন্সেলিং সার্ভিস’ বা ‘থেরাপি’ হিসেবে থাকে।
আইনগত নীতিমালা : বাংলাদেশে ২০১৮ সালে ‘মানসিক স্বাস্থ্য আইন’ পাস হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, নিবন্ধন ছাড়া কেউ নিজেকে মানসিক চিকিৎসক বা মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ দাবি করতে পারবেন না। ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্টদের আলাদাভাবে রেজিস্ট্রেশনের নিয়ম আছে। কাউন্সেলিং বা থেরাপি দিতে হলে সংশ্লিষ্ট অনুমোদিত প্রতিষ্ঠানে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হতে হবে।
সোজা করে বললে মনোবিজ্ঞান বিষয়ে পড়া কেউ চিকিৎসক নন, তবে প্রশিক্ষণ নিয়ে তারা কাউন্সেলিং ও থেরাপি করতে পারেন। ওষুধ বা ডায়াগনসিস করার অধিকার তাদের নেই। ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি বা পরামর্শদান ক্ষেত্রেই তাদের কর্মক্ষেত্র। এই কাজ করার জন্য যথাযথ শিক্ষা, ইন্টার্নশিপ এবং প্রয়োজনে লাইসেন্স বা রেজিস্ট্রেশন থাকা উচিত।
তাহলে ১৮ কোটি মানুষের মন স্বাস্থ্যসেবা পূরণ কিভাবে সম্ভব? পরিসংখ্যান বলছে বাংলাদেশে প্রতি ১০ লাখ মানুষের জন্য মাত্র ০.৪ মনোবিজ্ঞানী আছেন! ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট সংখ্যা ৫০০-৬০০ এর মতো। মনোরোগ চিকিৎসক আছে আনুমানিক ২৫০-৩০০ জনের মতো। অথচ ১৮-২০ কোটি মানুষের ২০%-২৫% মানুষ কোনো না কোনো পর্যায়ে মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যায় ভোগেন। মানে, বিশাল জনসংখ্যার তুলনায় বিশেষজ্ঞদের সংখ্যা নগণ্য। একেকজন বিশেষজ্ঞের দায়িত্ব প্রায় ৩ লাখ মানুষের ওপরে পড়ে, যা সম্পূর্ণ অবাস্তব।
কেন সংকট? মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে সামাজিক কুসংস্কারÑমানুষ মনে করে, মানসিক সমস্যা মানেই পাগল। মানসিক স্বাস্থ্য নীতিমালা খুব দুর্বলভাবে বাস্তবায়িত। প্রশিক্ষিত পেশাদার খুব কমÑইউনিভার্সিটিতে খুব কম জায়গায় ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি পড়ানো হয়। সরকারি বাজেট খুব কমÑস্বাস্থ্য খাতে মোট বাজেটের ১%-এরও কম মানসিক স্বাস্থ্য খাতে যায়। প্রশিক্ষণ এবং লাইসেন্সিং ব্যবস্থা যথেষ্ট শক্তিশালী নয়।
সমাধানের পথ কী হতে পারে? বেসিক কাউন্সেলিং প্রশিক্ষণ নিয়ে বড় আকারে স্কেল-আপ করাÑযাতে অনেক বেশি সাধারণ প্রশিক্ষক মাঠে নামানো যায়। কমিউনিটি-ভিত্তিক প্রোগ্রামÑগ্রাম থেকে শহর পর্যন্ত প্রাথমিক মানসিক সহায়তা প্রশিক্ষণ। টেলি-হেলথ বা অনলাইন কাউন্সেলিং প্ল্যাটফর্ম গড়ে তোলা। স্কুল-কলেজে মানসিক স্বাস্থ্য এডুকেশন বাধ্যতামূলক করা। চিকিৎসকদের সঙ্গে সহযোগিতামূলক কাজ করাÑযেমন সাইকিয়াট্রিস্ট ও সাইকোলজিস্ট একসঙ্গে দলগতভাবে কাজ করবেন। লাইসেন্স ও রেজিস্ট্রেশন সহজ করা প্রশিক্ষিত সাইকোলজিস্টদের জন্য। সচেতনতা বাড়ানোÑযাতে মানুষ মানসিক সমস্যাকে চিকিৎসাযোগ্য রোগ হিসেবে দেখে।
বাস্তব কথা হলো এখন যেভাবে আছে, তাতে রাষ্ট্রীয়ভাবে ও বেসরকারি উদ্যাগে বড় পরিকল্পনা ও বিনিয়োগ ছাড়া মানসিক স্বাস্থ্যসেবায় উন্নতি সম্ভব না। বিশেষজ্ঞ তৈরি, মিড-লেভেল কাউন্সেলর তৈরি ও সাধারণ চিকিৎসকদের ট্রেনিংÑএগুলো একসঙ্গে ঘটাতে হবে।
[ লেখক : নির্বাহী সদস্য, ইউনাইট থিয়েটার ফর সোশ্যাল অ্যাকশন ]