alt

উপ-সম্পাদকীয়

ইসরায়েলের যুদ্ধনীতি ও বিশ্ব নিরাপত্তার সংকট

ফোরকান উদ্দিন আহাম্মদ

: বৃহস্পতিবার, ২৪ জুলাই ২০২৫

২০২৫ সালের ১৬ জুলাই, ইসরায়েল সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কে একটি বিমান হামলা চালায়, যার লক্ষ্য ছিল দেশটির সশস্ত্র বাহিনীর সদর দপ্তর ও প্রেসিডেন্ট প্রাসাদের নিকটবর্তী অঞ্চল। এই হামলায় অন্তত ৩৫ জন সেনা নিহত হন এবং আহত হন আরও ৩০ জনের বেশি মানুষ। ইসরায়েলের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়, সিরিয়ার ভেতরে থাকা দ্রুজ সম্প্রদায়কে রক্ষা ও ইসলামি জঙ্গিবাদ প্রতিরোধের স্বার্থে এ হামলা প্রয়োজনীয় ছিল। তবে সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট এই বক্তব্য প্রত্যাখ্যান করে বলেন, দেশের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব একমাত্র সিরিয়ারই। সামরিক বিশ্লেষকদের ভাষ্য অনুযায়ী, দামেস্ক ও সুয়েইদা অঞ্চলে ইসরায়েলের সাম্প্রতিক বিমান হামলাগুলো কেবল সিরিয়ার সার্বভৌমত্বে হস্তক্ষেপ নয়, বরং এটি গোটা মধ্যপ্রাচ্যের জন্য এক গভীর বিপর্যয় ও আশঙ্কাজনক বার্তা বহন করছে।

এই ধরনের আগ্রাসন শুধু একটি রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সীমাবদ্ধ নয়Ñএটি বৃহত্তর ভূরাজনৈতিক সংঘাতের ইঙ্গিত দেয়, যার প্রতিক্রিয়া লেবানন, ইরান, ইরাক, ইয়েমেনÑ এমনকি উপসাগরীয় দেশগুলোতেও ছড়িয়ে পড়তে পারে। সিরিয়ায় ইসরায়েলের অব্যাহত হামলার ফলে মধ্যপ্রাচ্যের বেশ কয়েকটি আরব রাষ্ট্র, যারা সম্প্রতি ‘আব্রাহাম অ্যাকর্ড’ অনুযায়ী ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের পথে অগ্রসর হচ্ছিল, এখন দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। যেমন- সৌদি আরব ও জর্ডান, যারা ইসরায়েলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলতে চাইছিলÑএখন নিজেদের কূটনৈতিক অবস্থান নিয়ে চিন্তিত। এই সময়ে আরব দেশগুলোর জনগণের মধ্যে ইসরায়েলবিরোধী মনোভাব প্রবল হয়ে উঠেছে।

কারণ এখন কেবল ফিলিস্তিন নয়, সিরিয়ার সাধারণ মানুষও ইসরায়েলের সামরিক আগ্রাসনের শিকার হচ্ছে। মধ্যপ্রাচ্যকে একটি নিয়মিত সংঘাতপূর্ণ অঞ্চল হিসেবে ধরে রাখার কৌশল যেন সচেতনভাবেই বাস্তবায়ন করছে কিছু শক্তি। বিশ্লেষকদের মতে, নেতানিয়াহুর নেতৃত্বাধীন ইসরায়েল সরকার এই ‘চিরস্থায়ী উত্তেজনা’কে একটি রাষ্ট্রীয় কৌশল হিসেবে নিয়েছে, যাতে শান্তির কোনো সম্ভাবনা জন্ম না নেয়। কারণ শান্তি প্রতিষ্ঠিত হলে অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতা ও রাজনৈতিক প্রশ্ন উত্থাপিত হবে, যা ইসরায়েলের জন্য হুমকি তৈরি করতে পারে। এই কৌশলের অন্তর্ভুক্ত হলোÑহামাস ও হিজবুল্লাহর বিরুদ্ধে লড়াইয়ের অজুহাতে সিরিয়ায় হামলা, গাজার জনগণের ওপর জাতিগত নিধন এবং ইরানের পরমাণু কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে পারস্য উপসাগরে উত্তেজনা সৃষ্টি করা।

যদি যুক্তরাষ্ট্র সত্যিই মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি চায়, তাহলে তাকে অবশ্যই ন্যায়বিচারের নীতিতে অটল থাকতে হবে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যখন জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠার জন্য যুক্তরাষ্ট্র অগ্রণী ভূমিকা রাখে, তখন তারা আন্তর্জাতিক আইন ও মানবাধিকারের প্রতি শ্রদ্ধার প্রতিশ্রুতি দেয়। কিন্তু বাস্তবতা হলোÑএই নীতিগুলো কেবল বিরোধীদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হয়, মিত্রদের ক্ষেত্রে নয়। ফিলিস্তিনে গণহত্যা ও যুদ্ধাপরাধ চলছে, অথচ কোনো আন্তর্জাতিক বিচার কার্যক্রম দেখা যাচ্ছে না।

গাজার শিশুদের ওপর ফসফরাস বোমা ব্যবহার করা হচ্ছে, জনসমক্ষে গণহত্যা চলছেÑকিন্তু তবুও আন্তর্জাতিক মহল নীরব। এই নীরবতা একধরনের পরোক্ষ সমর্থন বলেই গণ্য হচ্ছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে ‘দুই রাষ্ট্র সমাধান’ নিয়েও নানা প্রশ্ন উঠছে। এমনকি শান্তি প্রচেষ্টার পক্ষে থাকা ওলমার্টও হতাশ। তিনি মনে করেন, বর্তমান ইসরায়েল সরকার ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে রাজনৈতিক সমঝোতার কোনো ইচ্ছাই রাখে না; বরং, তারা পরিকল্পিতভাবে অধিকৃত ভূখ- বিস্তৃত করে এবং বিশ্বজুড়ে ফিলিস্তিনিদের বিতাড়িত করতে চায়। এসব অপকৌশলের পেছনে রয়েছে আন্তর্জাতিক শক্তির নিঃশব্দ সমর্থন, যা মানবতা ও ন্যায়বিচারের মারাত্মক অবমূল্যায়ন।এই সংকটের প্রভাব শুধু ইসরায়েল-ফিলিস্তিন দ্বন্দ্বে সীমাবদ্ধ নয়।

ইরানের ওপর চালানো সামরিক আক্রমণ গোটা মধ্যপ্রাচ্যকে এক অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দিচ্ছে। সৌদি আরব, লেবানন, ইরাক ও সিরিয়াসহ অন্যান্য রাষ্ট্রও এই অস্থিরতা দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এখন যদি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এবং বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলকে সংযত করতে ব্যর্থ হয়, তাহলে এই সংঘাত এক মারাত্মক যুদ্ধের রূপ নিতে পারে, যার অভিঘাত বৈশ্বিক পরিসরে পড়বে। তাই এই সংকট নিরসনে কেবল বক্তব্য নয়, ইসরায়েলের ওপর বাস্তব কূটনৈতিক চাপ প্রয়োগ করা জরুরি। না হলে শুধু গাজা, ইরান বা ফিলিস্তিন নয়Ñপুরো মধ্যপ্রাচ্য সমস্যাগ্রস্ত থেকে যাবে। যুক্তরাষ্ট্রের উচিত একতরফা বন্ধুত্বের জায়গায় বহুমুখী মানবতা ও ন্যায়বিচারের পক্ষে অবস্থান নেওয়া। নেতানিয়াহুর একচেটিয়া ভূমিকাকে সীমিত না করা গেলে, শুধু এই অঞ্চল নয়, সমগ্র বিশ্বের ভবিষ্যতই বিপদের মুখে পড়বে।

ইসরায়েলি যুদ্ধবিমান ও ক্ষেপণাস্ত্রগুলো মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশের আকাশ পেরিয়ে ইরানে গিয়ে দেশটির সামরিক স্থাপনা ও সেনা কমান্ডারদের অবস্থানে ব্যাপক হামলা চালায়। ইরাকে আগ্রাসন চালিয়ে বুশ ও ব্লেয়ার বিশ্বকে একটি বিপর্যয়ের মূখে ফেলেছিলেন। নেতানিয়য়য়ও একইভাবে বিনা উসকানিতে ইরানে হামলা করে ইতোমধ্যেই অস্থিতিশীল হয়ে পড়া মধ্যপ্রাচ্যকে আরো বেশি অস্থিতিশীলতার মুখে ঠেলে দিয়েছেন। নেতানিয়াহুর দাবি, ইরানে হামলার লক্ষ্য ছিল দেশটির পরমাণু অস্ত্র তৈরির সক্ষমতা অর্জনের সম্ভাবনাকে নস্যাৎ করে দেয়া। ইসরায়েলি বাহিনী ইরানের তিনটি পরমাণু কেন্দ্র নাতাঞ্জ, ইসফাহান ও ফরদ্যেতে হামলা চালিয়ে এগুলোর ব্যাপক ক্ষতি করেছে।

১৯৬৭ সালের আরব যুদ্ধে মাত্র ছয় দিনে মিসর সিরিয়া ওমান এর বিশাল এলাকা দখল নেয়ার সাফল্য ইসরায়েলি সেনাবাহিনীকে দুনিয়ার মানুষের কাছে সত্যিই একটা অলীক শক্তিতে পরিণত করেছিল। সেই সঙ্গে এটাও সত্য, ১৯৪৮ থেকে ১৬৬৭ সাল পর্যন্ত ইসরায়েলি বাহিনী অপ্রতিরোধ্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। কিন্তু ১৯৭৩ সালের যুদ্ধে মিসরের কাছে পরাজয় ইসরায়েলের কল্পনাতীত ধারণা অনেকটা ম্লান হয়ে যায়। তবে ১৯৭৬ সালে ইসরায়েলি কমান্ডোরা রাতের আঁধারে উগান্ডার এন্টবি বিমানবন্দরে আকস্মিক অভিযান চালিয়ে ১০৬ জন জিম্মি উদ্ধারের পর এই বাহিনী আবার আলোচনায় চলে আসে। সে সময় ফিলিস্তিনি প্রতিরোধযোদ্ধারা একটা যাত্রীবাহী বিমান ছিনতাইয়ের পর এন্টনি বিমানবন্দরে অবতরণ করে ১০৬ জন যাত্রীকে জিম্মি করেছিল। ইসরায়েল কমান্ডোদের এই সফল অভিযানটি বিশ্ববাসীকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিল। তারপর সিরিয়া ও ইরাকে আরও কিছু সফল বিমান হামলা ইসরায়েলি বিমান বাহিনীকে শ্রেষ্ঠত্বের শিখরে তুলে দিয়েছিল। কিন্তু ২০০৬ সালে হিজবুল্লার বিরুদ্ধে ৩৪ দিনের যুদ্ধে কোনো সাফল্য অর্জন না করে জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় যুদ্ধবিরতি মেনে নেয়া এবং ২০২৩ সালে ৭ অক্টোবর হামাসযোদ্ধাদের ইসরায়েল অভ্যন্তরের সফল অভিযান এবং বর্তমানে ইরানের ভয়াবহ হামলা ইসরায়েলের বর্তমান নাজুক পরিস্থিতিরই প্রমাণ বহন করছে।

ফিলিস্তিনের সাধারণ মানুষের ওপর চলমান বর্বর হামলা লাখ লাখ নিরীহ মানুষকে মানবাধিকার লঙ্ঘনের মধ্যে ফেলে দিয়েছে। জাতিসংঘ, মানবাধিকার সংস্থাসমূহ এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য দেশগুলোর বিশ্লেষকরা একযোগে বলছেনÑএটি আন্তর্জাতিক আইনের চরম লঙ্ঘন এবং জাতিগত নিধনের আশঙ্কা তৈরি করেছে। এর বিপরীতে, আমেরিকার নীরবতা ও ইসরায়েলের সহিংস আগ্রাসন মধ্যপ্রাচ্যের সমস্যা আরও জটিল ও বিভাজিত করে তুলছে।

ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, ইসরায়েল-ফিলিস্তিন দ্বন্দ্বের একমাত্র কার্যকর সমাধান হলো ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠা, আন্তর্জাতিক আইন মেনে চলা এবং পারস্পরিক রাজনৈতিক সমঝোতা। কিন্তু আমেরিকার দ্বৈত নীতিমালাÑইরানের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া এবং ইসরায়েলের আগ্রাসনকে প্রশ্রয় দেয়াÑসংঘর্ষ নিরসনের পথেই প্রধান বাধা। যতদিন বিশ্বমঞ্চে নির্দিষ্ট পক্ষের অপরাধকে স্বাভাবিক ও অপরিহার্য হিসেবে তুলে ধরা হবে, ততদিন প্রকৃত শান্তি অসম্ভব থাকবে। ইরানের বিপ্লবের পর যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিকূলে থেকে দেশটি এ পর্যন্ত গর্বের সঙ্গে টিকে আছে এবং আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। তবে ইসরাইলি আগ্রাসন ৩য় বিশ্বযুদ্ধের ঝুঁকি নয় কি? এরকমটাই বিভিন্ন বিশ্লেষকদের বিশ্লেষণ থেকে উঠে আসছে।

[লেখক : সাবেক উপ-মহাপরিচালক, বাংলাদেশ আনসার ও ভিডিপিধ]

দরকার মানসম্মত শিক্ষা

রম্যগদ্য : ‘বেইমান রাইট ব্রাদার্স’

মানসিক স্বাস্থ্যসেবা : আইনি কাঠামো, সংকট ও সম্ভাবনার দিক

ছবি

বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক উজ্জ্বল নক্ষত্র

দুর্যোগে অবিবেচকদেরকে কি দায়িত্বশীল ভাবা যায়?

ওয়াসার পদ্মা ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট : এক জীবন্ত বোটানিক্যাল গার্ডেন

রেলপথের দুর্দশা : সমন্বিত পরিকল্পনা না হলে বিপর্যয় অনিবার্য

বিশ্ববিদ্যালয় জ্ঞানচর্চার কেন্দ্র নাকি ক্ষমতার অভ্যন্তরীণ উপনিবেশ?

পিরোজপুরের স্কুলটির ফলাফল বিপর্যয় এবং আচরণগত অর্থনীতির দৃষ্টিকোণ

কোনো শাসকই অপরাজেয় নয়

পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি : বাঙালিকে রুচির দৈন্যে টেনে নামানো হচ্ছে

জনসংখ্যা ও যুবশক্তির চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা

রাষ্ট্রের কাছে স্বাভাবিক মৃত্যুর নিশ্চয়তা চাই

পার্বত্য চট্টগ্রাম : প্রাকৃতিক সম্পদ ও অর্থনৈতিক সম্ভাবনা

ইউরেশিয়ায় তৃতীয় বিকল্প গালফ কূটনীতি

‘বিপ্লবী সংস্কার’ কি সম্ভব

রম্যগদ্য : ‘ব্যাংক, ব্যাংক নয়’

মবতন্ত্রের জয়

ডিজিটাল ক্লান্তি ও ‘সর্বক্ষণ সক্রিয়’ সংস্কৃতির শ্রেণীগত রাজনীতি

ছবি

বোধের স্ফূরণ, না ‘মেটিকুলাস ডিজাইন’?

এসএসসিতে গণিত বিষয়ে ফল বিপর্যয় : কারণ ও উত্তরণের উপায়

দক্ষ মানবসম্পদ ও সমৃদ্ধ গ্রন্থাগার

আফ্রিকায় হঠাৎ কেন যুক্তরাষ্ট্রের ঝোঁক?

ঢাকা মহানগর ও বুড়িগঙ্গা

জামাই মেলা : উৎসব, ঐতিহ্য ও কৃষ্টির রঙিন চিত্রপট

হারিয়ে যাওয়া ক্লাস, কঠোর মূল্যায়ন আর প্রশ্নের জটিলতায় নুয়ে পড়া এক প্রজন্ম

বৈষম্য দূর করে নতুন বাংলাদেশ গড়ে তুলুন

চিকিৎসা যেন বাণিজ্যের হাতিয়ারে পরিণত না হয়

পথশিশু ও বাংলাদেশে সামাজিক চুক্তির ব্যর্থতা

মেগা প্রকল্প : প্রশ্ন হওয়া উচিত স্বচ্ছতা নিয়ে

আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া জরুরি

স্মার্ট দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা : উপগ্রহ চিত্র ও ওয়েবসাইটের অপরিহার্যতা

ক্ষমতা ও জনপ্রশাসন : আমলাতন্ত্রের ছায়াতলে আমজনতা

জনসংখ্যা : সম্পদ না সংকট?

ব্রিকসে নতুন ভূ-রাজনৈতিক ব্যবস্থার উত্থান

রম্যগদ্য : ‘ল্যাংড়া-লুলা, আতুড়-পাতুড়’

tab

উপ-সম্পাদকীয়

ইসরায়েলের যুদ্ধনীতি ও বিশ্ব নিরাপত্তার সংকট

ফোরকান উদ্দিন আহাম্মদ

বৃহস্পতিবার, ২৪ জুলাই ২০২৫

২০২৫ সালের ১৬ জুলাই, ইসরায়েল সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কে একটি বিমান হামলা চালায়, যার লক্ষ্য ছিল দেশটির সশস্ত্র বাহিনীর সদর দপ্তর ও প্রেসিডেন্ট প্রাসাদের নিকটবর্তী অঞ্চল। এই হামলায় অন্তত ৩৫ জন সেনা নিহত হন এবং আহত হন আরও ৩০ জনের বেশি মানুষ। ইসরায়েলের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়, সিরিয়ার ভেতরে থাকা দ্রুজ সম্প্রদায়কে রক্ষা ও ইসলামি জঙ্গিবাদ প্রতিরোধের স্বার্থে এ হামলা প্রয়োজনীয় ছিল। তবে সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট এই বক্তব্য প্রত্যাখ্যান করে বলেন, দেশের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব একমাত্র সিরিয়ারই। সামরিক বিশ্লেষকদের ভাষ্য অনুযায়ী, দামেস্ক ও সুয়েইদা অঞ্চলে ইসরায়েলের সাম্প্রতিক বিমান হামলাগুলো কেবল সিরিয়ার সার্বভৌমত্বে হস্তক্ষেপ নয়, বরং এটি গোটা মধ্যপ্রাচ্যের জন্য এক গভীর বিপর্যয় ও আশঙ্কাজনক বার্তা বহন করছে।

এই ধরনের আগ্রাসন শুধু একটি রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সীমাবদ্ধ নয়Ñএটি বৃহত্তর ভূরাজনৈতিক সংঘাতের ইঙ্গিত দেয়, যার প্রতিক্রিয়া লেবানন, ইরান, ইরাক, ইয়েমেনÑ এমনকি উপসাগরীয় দেশগুলোতেও ছড়িয়ে পড়তে পারে। সিরিয়ায় ইসরায়েলের অব্যাহত হামলার ফলে মধ্যপ্রাচ্যের বেশ কয়েকটি আরব রাষ্ট্র, যারা সম্প্রতি ‘আব্রাহাম অ্যাকর্ড’ অনুযায়ী ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের পথে অগ্রসর হচ্ছিল, এখন দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। যেমন- সৌদি আরব ও জর্ডান, যারা ইসরায়েলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলতে চাইছিলÑএখন নিজেদের কূটনৈতিক অবস্থান নিয়ে চিন্তিত। এই সময়ে আরব দেশগুলোর জনগণের মধ্যে ইসরায়েলবিরোধী মনোভাব প্রবল হয়ে উঠেছে।

কারণ এখন কেবল ফিলিস্তিন নয়, সিরিয়ার সাধারণ মানুষও ইসরায়েলের সামরিক আগ্রাসনের শিকার হচ্ছে। মধ্যপ্রাচ্যকে একটি নিয়মিত সংঘাতপূর্ণ অঞ্চল হিসেবে ধরে রাখার কৌশল যেন সচেতনভাবেই বাস্তবায়ন করছে কিছু শক্তি। বিশ্লেষকদের মতে, নেতানিয়াহুর নেতৃত্বাধীন ইসরায়েল সরকার এই ‘চিরস্থায়ী উত্তেজনা’কে একটি রাষ্ট্রীয় কৌশল হিসেবে নিয়েছে, যাতে শান্তির কোনো সম্ভাবনা জন্ম না নেয়। কারণ শান্তি প্রতিষ্ঠিত হলে অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতা ও রাজনৈতিক প্রশ্ন উত্থাপিত হবে, যা ইসরায়েলের জন্য হুমকি তৈরি করতে পারে। এই কৌশলের অন্তর্ভুক্ত হলোÑহামাস ও হিজবুল্লাহর বিরুদ্ধে লড়াইয়ের অজুহাতে সিরিয়ায় হামলা, গাজার জনগণের ওপর জাতিগত নিধন এবং ইরানের পরমাণু কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে পারস্য উপসাগরে উত্তেজনা সৃষ্টি করা।

যদি যুক্তরাষ্ট্র সত্যিই মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি চায়, তাহলে তাকে অবশ্যই ন্যায়বিচারের নীতিতে অটল থাকতে হবে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যখন জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠার জন্য যুক্তরাষ্ট্র অগ্রণী ভূমিকা রাখে, তখন তারা আন্তর্জাতিক আইন ও মানবাধিকারের প্রতি শ্রদ্ধার প্রতিশ্রুতি দেয়। কিন্তু বাস্তবতা হলোÑএই নীতিগুলো কেবল বিরোধীদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হয়, মিত্রদের ক্ষেত্রে নয়। ফিলিস্তিনে গণহত্যা ও যুদ্ধাপরাধ চলছে, অথচ কোনো আন্তর্জাতিক বিচার কার্যক্রম দেখা যাচ্ছে না।

গাজার শিশুদের ওপর ফসফরাস বোমা ব্যবহার করা হচ্ছে, জনসমক্ষে গণহত্যা চলছেÑকিন্তু তবুও আন্তর্জাতিক মহল নীরব। এই নীরবতা একধরনের পরোক্ষ সমর্থন বলেই গণ্য হচ্ছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে ‘দুই রাষ্ট্র সমাধান’ নিয়েও নানা প্রশ্ন উঠছে। এমনকি শান্তি প্রচেষ্টার পক্ষে থাকা ওলমার্টও হতাশ। তিনি মনে করেন, বর্তমান ইসরায়েল সরকার ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে রাজনৈতিক সমঝোতার কোনো ইচ্ছাই রাখে না; বরং, তারা পরিকল্পিতভাবে অধিকৃত ভূখ- বিস্তৃত করে এবং বিশ্বজুড়ে ফিলিস্তিনিদের বিতাড়িত করতে চায়। এসব অপকৌশলের পেছনে রয়েছে আন্তর্জাতিক শক্তির নিঃশব্দ সমর্থন, যা মানবতা ও ন্যায়বিচারের মারাত্মক অবমূল্যায়ন।এই সংকটের প্রভাব শুধু ইসরায়েল-ফিলিস্তিন দ্বন্দ্বে সীমাবদ্ধ নয়।

ইরানের ওপর চালানো সামরিক আক্রমণ গোটা মধ্যপ্রাচ্যকে এক অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দিচ্ছে। সৌদি আরব, লেবানন, ইরাক ও সিরিয়াসহ অন্যান্য রাষ্ট্রও এই অস্থিরতা দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এখন যদি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এবং বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলকে সংযত করতে ব্যর্থ হয়, তাহলে এই সংঘাত এক মারাত্মক যুদ্ধের রূপ নিতে পারে, যার অভিঘাত বৈশ্বিক পরিসরে পড়বে। তাই এই সংকট নিরসনে কেবল বক্তব্য নয়, ইসরায়েলের ওপর বাস্তব কূটনৈতিক চাপ প্রয়োগ করা জরুরি। না হলে শুধু গাজা, ইরান বা ফিলিস্তিন নয়Ñপুরো মধ্যপ্রাচ্য সমস্যাগ্রস্ত থেকে যাবে। যুক্তরাষ্ট্রের উচিত একতরফা বন্ধুত্বের জায়গায় বহুমুখী মানবতা ও ন্যায়বিচারের পক্ষে অবস্থান নেওয়া। নেতানিয়াহুর একচেটিয়া ভূমিকাকে সীমিত না করা গেলে, শুধু এই অঞ্চল নয়, সমগ্র বিশ্বের ভবিষ্যতই বিপদের মুখে পড়বে।

ইসরায়েলি যুদ্ধবিমান ও ক্ষেপণাস্ত্রগুলো মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশের আকাশ পেরিয়ে ইরানে গিয়ে দেশটির সামরিক স্থাপনা ও সেনা কমান্ডারদের অবস্থানে ব্যাপক হামলা চালায়। ইরাকে আগ্রাসন চালিয়ে বুশ ও ব্লেয়ার বিশ্বকে একটি বিপর্যয়ের মূখে ফেলেছিলেন। নেতানিয়য়য়ও একইভাবে বিনা উসকানিতে ইরানে হামলা করে ইতোমধ্যেই অস্থিতিশীল হয়ে পড়া মধ্যপ্রাচ্যকে আরো বেশি অস্থিতিশীলতার মুখে ঠেলে দিয়েছেন। নেতানিয়াহুর দাবি, ইরানে হামলার লক্ষ্য ছিল দেশটির পরমাণু অস্ত্র তৈরির সক্ষমতা অর্জনের সম্ভাবনাকে নস্যাৎ করে দেয়া। ইসরায়েলি বাহিনী ইরানের তিনটি পরমাণু কেন্দ্র নাতাঞ্জ, ইসফাহান ও ফরদ্যেতে হামলা চালিয়ে এগুলোর ব্যাপক ক্ষতি করেছে।

১৯৬৭ সালের আরব যুদ্ধে মাত্র ছয় দিনে মিসর সিরিয়া ওমান এর বিশাল এলাকা দখল নেয়ার সাফল্য ইসরায়েলি সেনাবাহিনীকে দুনিয়ার মানুষের কাছে সত্যিই একটা অলীক শক্তিতে পরিণত করেছিল। সেই সঙ্গে এটাও সত্য, ১৯৪৮ থেকে ১৬৬৭ সাল পর্যন্ত ইসরায়েলি বাহিনী অপ্রতিরোধ্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। কিন্তু ১৯৭৩ সালের যুদ্ধে মিসরের কাছে পরাজয় ইসরায়েলের কল্পনাতীত ধারণা অনেকটা ম্লান হয়ে যায়। তবে ১৯৭৬ সালে ইসরায়েলি কমান্ডোরা রাতের আঁধারে উগান্ডার এন্টবি বিমানবন্দরে আকস্মিক অভিযান চালিয়ে ১০৬ জন জিম্মি উদ্ধারের পর এই বাহিনী আবার আলোচনায় চলে আসে। সে সময় ফিলিস্তিনি প্রতিরোধযোদ্ধারা একটা যাত্রীবাহী বিমান ছিনতাইয়ের পর এন্টনি বিমানবন্দরে অবতরণ করে ১০৬ জন যাত্রীকে জিম্মি করেছিল। ইসরায়েল কমান্ডোদের এই সফল অভিযানটি বিশ্ববাসীকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিল। তারপর সিরিয়া ও ইরাকে আরও কিছু সফল বিমান হামলা ইসরায়েলি বিমান বাহিনীকে শ্রেষ্ঠত্বের শিখরে তুলে দিয়েছিল। কিন্তু ২০০৬ সালে হিজবুল্লার বিরুদ্ধে ৩৪ দিনের যুদ্ধে কোনো সাফল্য অর্জন না করে জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় যুদ্ধবিরতি মেনে নেয়া এবং ২০২৩ সালে ৭ অক্টোবর হামাসযোদ্ধাদের ইসরায়েল অভ্যন্তরের সফল অভিযান এবং বর্তমানে ইরানের ভয়াবহ হামলা ইসরায়েলের বর্তমান নাজুক পরিস্থিতিরই প্রমাণ বহন করছে।

ফিলিস্তিনের সাধারণ মানুষের ওপর চলমান বর্বর হামলা লাখ লাখ নিরীহ মানুষকে মানবাধিকার লঙ্ঘনের মধ্যে ফেলে দিয়েছে। জাতিসংঘ, মানবাধিকার সংস্থাসমূহ এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য দেশগুলোর বিশ্লেষকরা একযোগে বলছেনÑএটি আন্তর্জাতিক আইনের চরম লঙ্ঘন এবং জাতিগত নিধনের আশঙ্কা তৈরি করেছে। এর বিপরীতে, আমেরিকার নীরবতা ও ইসরায়েলের সহিংস আগ্রাসন মধ্যপ্রাচ্যের সমস্যা আরও জটিল ও বিভাজিত করে তুলছে।

ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, ইসরায়েল-ফিলিস্তিন দ্বন্দ্বের একমাত্র কার্যকর সমাধান হলো ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠা, আন্তর্জাতিক আইন মেনে চলা এবং পারস্পরিক রাজনৈতিক সমঝোতা। কিন্তু আমেরিকার দ্বৈত নীতিমালাÑইরানের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া এবং ইসরায়েলের আগ্রাসনকে প্রশ্রয় দেয়াÑসংঘর্ষ নিরসনের পথেই প্রধান বাধা। যতদিন বিশ্বমঞ্চে নির্দিষ্ট পক্ষের অপরাধকে স্বাভাবিক ও অপরিহার্য হিসেবে তুলে ধরা হবে, ততদিন প্রকৃত শান্তি অসম্ভব থাকবে। ইরানের বিপ্লবের পর যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিকূলে থেকে দেশটি এ পর্যন্ত গর্বের সঙ্গে টিকে আছে এবং আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। তবে ইসরাইলি আগ্রাসন ৩য় বিশ্বযুদ্ধের ঝুঁকি নয় কি? এরকমটাই বিভিন্ন বিশ্লেষকদের বিশ্লেষণ থেকে উঠে আসছে।

[লেখক : সাবেক উপ-মহাপরিচালক, বাংলাদেশ আনসার ও ভিডিপিধ]

back to top