কামরুজ্জামান
গত ১০ জুলাই দেশব্যাপী একযোগে প্রকাশিত হলো ২০২৫ সালে অনুষ্ঠিত এসএসসি ও সমমান পরীক্ষার ফলাফল। এ বছর সবগুলো শিক্ষা বোর্ডে সম্মিলিত পাসের হার ৬৮.৪৫%। জিপিএ-৫ পেয়েছে ১ লাখ ৩৯ হাজার ৩২ জন শিক্ষার্থী। চলতি বছর এসএসসি পরীক্ষায় ১৩৪টি স্কুলের কেউ পাস করেনি, মোট ফেলের সংখ্যা ৬ লাখ ৬৬০ জন। মোট পরীক্ষার্থী ছিল ১৯ লাখ ৪ হাজার ৮৬ জন। কৃতকার্য হয়েছে ১৩ লাখ ৩ হাজার ৪২৬ জন শিক্ষার্থী।
এবারের এসএসসি পরীক্ষার ফলাফল ভালো হলো, না খারাপ হলো এটি আলোচনা করা অবকাশ রয়েছে নিঃসন্দেহে। তবে যে ১৩৪টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে একজনও পাস করেনি সেসব প্রতিষ্ঠান নিয়ে বিশেষভাবে ভাবা প্রয়োজন। ভাবার ব্যাপার রয়েছে ৬ লাখ ৬৬০ শিক্ষার্থীর অকৃতকার্য হওয়ার বিষয়টিও। তবে এটাও তো সত্যি মানসম্মত শিক্ষার জন্য পরিচ্ছন্ন এবং নিরাপদ পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হওয়াও জরুরি।
এবার ফলাফলে পাসের হার কমেছে, কমেছে জিপিএ-৫ প্রাপ্তির সংখ্যা। জিপিএ-৫ প্রাপ্তির চেয়ে ছাত্রছাত্রীদের মেধা ও জানার পরিসর বাড়াটাও জরুরি। তবে যেসব ছাত্রছাত্রী অকৃতকার্য হয়েছে তার পেছনে কারণ খুঁজে দেখা প্রয়োজন।
এখনকার সময়ের ছেলেমেয়েদের একটা বড় অংশ পড়ালেখা করতে চায় না। এর কারণ হচ্ছেÑ বন্ধু নির্বাচনে ভুল সিদ্ধান্ত। অর্থাৎ আশপাশে যাদের সঙ্গে চলাফেরা করে তাদের বেশির ভাগ দুষ্ট স্বভাবের হয় এবং এরা অল্প বয়সেই রঙিন জীবনের স্বপ্নে বিভোর। এদের আচরণ ও কাজকর্ম হয় একঘেয়ে ও মারমুখী। এরা অসৎ সঙ্গ নিয়ে চলাফেরা করে। এদের চলাফেরার অপরিহার্য অঙ্গ থাকে এন্ড্রয়েড মোবাইল ফোন। সারাদিন পড়ে থাকে ফেইসবুক ও সোশ্যাল মিডিয়ায়। অনেকেই আবার কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যও হয়ে থাকে। সর্বপরি বাবা-মায়ের অতি আদর ও অসচেতনতাও অন্যতম কারণ। এদের সবাই ছাত্র। এরা আমাদের মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শ্রেণীর নিয়মিত ছাত্র হলেও শ্রেণীকক্ষে এরা অনিয়মিত। ক্লাস ঠিকমতো না করার কারণে ফলাফলও এদেরই খারাপ হয় বেশি।
এবারের এসএসসি ও সমমান পরীক্ষায় উত্তরপত্র মূল্যায়নে সহানুভূতি নম্বর দেয়া হয়নি। খাতায় যা লিখেছে সেটা সঠিক মূল্যায়নের মাধ্যমে নম্বর প্রদান করা হয়েছে। ফলাফল তৈরিতে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে মেধা ও প্রকৃত মূল্যায়নকে। যার কারণে পাসের হার কিছুটা হয়তো কমেছে।
ইংরেজি ও গণিত বিষয়ে বরাবরই ছাত্রছাত্রীদের ভয় এবং ভীতি কাজ করে। এবারের ফলাফল বিশ্লষণেও দেখা যায়Ñ ইংরেজি ও গণিত বিষয়ে অকৃতকার্য শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেশি। অকৃতকার্য শিক্ষার্থীদের কিছু অংশ বিজ্ঞানের বিষয়গুলোতে ভালো করতে পারেনি। মাধ্যমিক বেসরকারি স্কুলগুলোতে ইংরেজি ও গণিত বিষয়ে যোগ্য ও মেধাবী শিক্ষকের যেমন ঘাটতি রয়েছে তেমনি বিশেষ ক্লাস, অতিরিক্ত ক্লাস ও তত্ত্বাবধানেও অমনোযোগিতা থেকে যাওয়া অস্বাভাবিক নয়। স্কুল কর্তৃপক্ষ এবং শিক্ষকরা হয়তো প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করে কিন্তু ছাত্রছাত্রী ও অভিভাবকদের অসহযোগিতা ও অমনোযোগিতার এই জন্য দায়ী। টাকার অভাবে অনেক ছাত্রছাত্রীর বিশেষ ক্লাসে পড়ার সুযোগ না নিতে পারাও একটি কারণ। সবমিলিয়ে শেষপর্যন্ত পরীক্ষার ফলাফল অকৃতকার্য হয়তো হয়েছে। যদিও এটা একজন ছাত্রছাত্রী ও অভিভাবকের জন্য অত্যন্ত কষ্টের।
শিক্ষাজীবনের গুরুত্বপূর্ণ স্তর হচ্ছে এসএসসি পরীক্ষা। দীর্ঘ দশ বছর পড়ালেখা করার পর প্রথম একজন শিক্ষার্থী পাবলিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে। পরীক্ষার্থী নিজে, পরিবার ও সমাজ অপেক্ষা করে তার একটি ভালো ফলাফলের জন্য। আর সে ফলাফল যখন খারাপ হয় তখন কষ্টের সীমা থাকে না। এবার এসএসসি পরীক্ষায় যারা অকৃতকার্য হয়েছে তারা হয়তো ঘুরে দাঁড়াবে। পড়ালেখা করার মাধ্যমে আগামীতে হয়তো আরও ভালো ফলাফল অর্জন করবে। এবারের ব্যার্থতাটাকে শক্তি হিসেবে নিয়ে আগামী দিন বেশি করে পরিশ্রমের মাধ্যমে নিজেদের তৈরি করবে। এবং এটাই হওয়া উচিত। একটি কথা আছেÑ ব্যার্থতাই সফলতার চাবিকাঠি। কবিও বলে গেছেন, “একবার না পারিলে দেখ শতবার।” পৃথিবীতে বহু মনিষীর কথা জানি যারা ব্যর্থ হয়ে হয়ে সফল হয়েছেন। শুধু সফল হননি। সফলতার চরম শিখরে পৌঁছে গেছেন।
আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় এবং পাবলিক পরীক্ষার ফলাফলে আরও একটি বিষয় মাথায় রাখা দরকার আর তা হলোÑ আমাদের কোয়ালিটি দরকার নাকি কোয়ান্টিটি দরকার। বাংলাদেশ জনবহুল দেশ। এবার এসএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে প্রায় বিশ লাখ শিক্ষার্থী। বিপুলসংখ্যক এই শিক্ষার্থীর পাসের যেমন প্রয়োজন রয়েছে তেমনি মেধাবী ও মানসম্মত ছাত্রছাত্রী তৈরি করার বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ।
দেশ ও জাতি গঠনে শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। সে শিক্ষা হতে হবে মানসম্মত ও বিজ্ঞানমনস্ক শিক্ষা। বিশ্ব এগিয়ে যাচ্ছে। এগিয়ে যাচ্ছে প্রযুক্তি ও শিক্ষা কারিকুলাম। যুগোপযোগী শিক্ষা ও মেধাবী ছাত্রছাত্রী তৈরি করা এখন সময়ের দাবি। এজন্য প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষায় কিছু বিষয়ের ওপর গুরুত্ব আরোপ করা বিশেষ প্রয়োজন। যেমন-
বেতন স্কেল পরিবর্তন ও বৃদ্ধি : আমাদের দেশে মানুষের সামাজিক মর্যাদা নির্ধারিত হয় আর্থিক মানদ-ে। শিক্ষক সমাজ সবসময়ই অর্থ কষ্টে ভোগে। বিশেষ করে প্রাইমারি ও বেসরকারি এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষকদের জীবনমান কষ্টের। একজন শিক্ষক মাস শেষে যে বেতন পান তা দিয়ে কায়ক্লেশে সংসার পরিচালনা করেন। এটা অত্যন্ত দুঃখজনক। বর্তামান সমাজ ব্যবস্থায় শিক্ষকদের জীবন মানেরও পরিবর্তন প্রয়োজন। আর এর জন্য আলাদা বেতন স্কেল ও বেতন বৃষ্টি হওয়া প্রয়োজন।
মেধাবী ও যোগ্যদের বিশেষ মূল্যায়ন : মেধাবী ও যোগ্যরা শিক্ষকতা পেশায় আসতে চায় না। যারা আসে তারাও থাকতে চায় না কিংবা থাকে না। একমাত্র কারণ হচ্ছেÑ এখানে টাকা কম। আবার প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি ও কূটনীতি মেধাবীদের অনাগ্রহ করে তোলে। শিক্ষার কাক্সিক্ষত অগ্রগতি পেতে হলে অবশ্যই মেধাবী ও যোগ্যদের মূল্যায়ন করতে হবে। মেধাবী ও যোগ্যরা শিক্ষকতা পেশায় আসলে এমনিতেই শিক্ষার আমূল পরিবর্তন হবে।
ইংরেজি ও গণিত বিষয়ে শিক্ষকের সংখ্যা বৃদ্ধি : ইংরেজি বিদেশি ভাষা হওয়ায় আমাদের ছেলেমেয়েদের মধ্যে ইংরেজি ভীতি কাজ করে। আবার গণিত বিষয়ে আগ্রহ কম থাকে। এ দুটো বিষয়ে প্রাথমিকের শুরু থেকে বিষয়ভিত্তিক শিক্ষক দিয়ে পাঠদান করানো উচিত। এক্ষেত্রে প্রথম শ্রেণী থেকে দশম শ্রেণী পর্যন্ত ইংরেজি ও গণিত বিষয়ে পর্যাপ্ত শিক্ষক নিয়োগ দেয়া প্রয়োজন। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে স্কুলগুলোতে সবসময়ই ইংরেজি ও গণিত বিষয়ে শিক্ষকস্বল্পতা পরিলক্ষিত হয়। বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে নেয়া প্রয়োজন এবং প্রয়োজনীয় শিক্ষক নিয়োগ দেয়া প্রয়োজন।
বিজ্ঞান বিষয়ের ওপর জোর দেয়া : বিজ্ঞান শিক্ষার প্রসারের বিষয়ভিত্তিক বিজ্ঞান শিক্ষক নিয়োগ দেয়া প্রয়োজন। প্রয়োজন ব্যবহারিক শিক্ষার ওপর জোর দেয়া। প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিজ্ঞান ল্যাব বাধ্যতামূলক করা উচিত। আমাদের দেশে এমপিওভুক্ত মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোতে প্রয়োজনীয় ল্যাব-সুবিধা নেই বললেই চলে। থাকলেও ল্যাবের যথাযথ ব্যবহার হয় না বলে অভিযোগ রয়েছে।
শ্রেণীকক্ষে ছাত্রছাত্রীদের উপস্থিত নিশ্চিত করা : মাধ্যমিক বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের একটি বড় সমস্যা হচ্ছে ছাত্রছাত্রী উপস্থিতি। নানাবিধ কারণে দেখা যায় শ্রেণীকক্ষে ছাত্রছাত্রীদের উপস্থিতি কম থাকে। কিন্তু অনুপস্থিত এসব ছাত্রছাত্রীও শেষপর্যন্ত এসএসসি ও সমমান পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে। এদের অনেকেই পাস করে যায়। কিন্তু পাস করা আর মেধাবী হওয়া এক বিষয় নয়। পাস করার পাশাপাশি মেধা ও পড়ালেখা সম্পর্কে জ্ঞান রাখাই হচ্ছে একজন ছাত্রের আসল কাজ। শ্রেণীকক্ষে উপস্থিত থাকলে একজন ছাত্রের মেধা বিকশিত হয়। জ্ঞানের পরিসর বাড়ে। শ্রেণীকক্ষে শিক্ষক যে পাঠদান করান তা একজন ছাত্রের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অনুপস্থিত ছাত্র তা মিস করে। ফলে পড়ালেখার ঘাটতি থেকেই যায়। শ্রেণীকক্ষের এই ঘাটতি আর কখনও পূরণ হয় না। তাই ছাত্রছাত্রীদের শ্রেণীকক্ষে উপস্থিত বাড়াতে হবে।
ভালো ফলাফল যেমন প্রয়োজন তেমনি প্রয়োজন মানসম্মত শিক্ষা। আর এই মানসম্মত শিক্ষার জন্য দরকার শিক্ষক সমাজের জীবনমানের পরিবর্তন। আর এর জন্য শিক্ষকদের আলাদা বেতন স্কেল ও মর্যাদা প্রয়োজন। প্রয়োজন যুগোপযোগী শিক্ষা কারিকুলাম, শিক্ষক প্রশিক্ষণ ও মেধার প্রকৃত মূল্যায়ন। এই কাজগুলো করা গেলে নতুন প্রজন্ম বেড়ে উঠবে মেধা ও প্রজ্ঞায়।
[লেখক : সহকারী অধ্যাপক, ভূগোল বিভাগ, মুক্তিযোদ্ধা কলেজ, গাজীপুর]
কামরুজ্জামান
বৃহস্পতিবার, ২৪ জুলাই ২০২৫
গত ১০ জুলাই দেশব্যাপী একযোগে প্রকাশিত হলো ২০২৫ সালে অনুষ্ঠিত এসএসসি ও সমমান পরীক্ষার ফলাফল। এ বছর সবগুলো শিক্ষা বোর্ডে সম্মিলিত পাসের হার ৬৮.৪৫%। জিপিএ-৫ পেয়েছে ১ লাখ ৩৯ হাজার ৩২ জন শিক্ষার্থী। চলতি বছর এসএসসি পরীক্ষায় ১৩৪টি স্কুলের কেউ পাস করেনি, মোট ফেলের সংখ্যা ৬ লাখ ৬৬০ জন। মোট পরীক্ষার্থী ছিল ১৯ লাখ ৪ হাজার ৮৬ জন। কৃতকার্য হয়েছে ১৩ লাখ ৩ হাজার ৪২৬ জন শিক্ষার্থী।
এবারের এসএসসি পরীক্ষার ফলাফল ভালো হলো, না খারাপ হলো এটি আলোচনা করা অবকাশ রয়েছে নিঃসন্দেহে। তবে যে ১৩৪টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে একজনও পাস করেনি সেসব প্রতিষ্ঠান নিয়ে বিশেষভাবে ভাবা প্রয়োজন। ভাবার ব্যাপার রয়েছে ৬ লাখ ৬৬০ শিক্ষার্থীর অকৃতকার্য হওয়ার বিষয়টিও। তবে এটাও তো সত্যি মানসম্মত শিক্ষার জন্য পরিচ্ছন্ন এবং নিরাপদ পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হওয়াও জরুরি।
এবার ফলাফলে পাসের হার কমেছে, কমেছে জিপিএ-৫ প্রাপ্তির সংখ্যা। জিপিএ-৫ প্রাপ্তির চেয়ে ছাত্রছাত্রীদের মেধা ও জানার পরিসর বাড়াটাও জরুরি। তবে যেসব ছাত্রছাত্রী অকৃতকার্য হয়েছে তার পেছনে কারণ খুঁজে দেখা প্রয়োজন।
এখনকার সময়ের ছেলেমেয়েদের একটা বড় অংশ পড়ালেখা করতে চায় না। এর কারণ হচ্ছেÑ বন্ধু নির্বাচনে ভুল সিদ্ধান্ত। অর্থাৎ আশপাশে যাদের সঙ্গে চলাফেরা করে তাদের বেশির ভাগ দুষ্ট স্বভাবের হয় এবং এরা অল্প বয়সেই রঙিন জীবনের স্বপ্নে বিভোর। এদের আচরণ ও কাজকর্ম হয় একঘেয়ে ও মারমুখী। এরা অসৎ সঙ্গ নিয়ে চলাফেরা করে। এদের চলাফেরার অপরিহার্য অঙ্গ থাকে এন্ড্রয়েড মোবাইল ফোন। সারাদিন পড়ে থাকে ফেইসবুক ও সোশ্যাল মিডিয়ায়। অনেকেই আবার কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যও হয়ে থাকে। সর্বপরি বাবা-মায়ের অতি আদর ও অসচেতনতাও অন্যতম কারণ। এদের সবাই ছাত্র। এরা আমাদের মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শ্রেণীর নিয়মিত ছাত্র হলেও শ্রেণীকক্ষে এরা অনিয়মিত। ক্লাস ঠিকমতো না করার কারণে ফলাফলও এদেরই খারাপ হয় বেশি।
এবারের এসএসসি ও সমমান পরীক্ষায় উত্তরপত্র মূল্যায়নে সহানুভূতি নম্বর দেয়া হয়নি। খাতায় যা লিখেছে সেটা সঠিক মূল্যায়নের মাধ্যমে নম্বর প্রদান করা হয়েছে। ফলাফল তৈরিতে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে মেধা ও প্রকৃত মূল্যায়নকে। যার কারণে পাসের হার কিছুটা হয়তো কমেছে।
ইংরেজি ও গণিত বিষয়ে বরাবরই ছাত্রছাত্রীদের ভয় এবং ভীতি কাজ করে। এবারের ফলাফল বিশ্লষণেও দেখা যায়Ñ ইংরেজি ও গণিত বিষয়ে অকৃতকার্য শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেশি। অকৃতকার্য শিক্ষার্থীদের কিছু অংশ বিজ্ঞানের বিষয়গুলোতে ভালো করতে পারেনি। মাধ্যমিক বেসরকারি স্কুলগুলোতে ইংরেজি ও গণিত বিষয়ে যোগ্য ও মেধাবী শিক্ষকের যেমন ঘাটতি রয়েছে তেমনি বিশেষ ক্লাস, অতিরিক্ত ক্লাস ও তত্ত্বাবধানেও অমনোযোগিতা থেকে যাওয়া অস্বাভাবিক নয়। স্কুল কর্তৃপক্ষ এবং শিক্ষকরা হয়তো প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করে কিন্তু ছাত্রছাত্রী ও অভিভাবকদের অসহযোগিতা ও অমনোযোগিতার এই জন্য দায়ী। টাকার অভাবে অনেক ছাত্রছাত্রীর বিশেষ ক্লাসে পড়ার সুযোগ না নিতে পারাও একটি কারণ। সবমিলিয়ে শেষপর্যন্ত পরীক্ষার ফলাফল অকৃতকার্য হয়তো হয়েছে। যদিও এটা একজন ছাত্রছাত্রী ও অভিভাবকের জন্য অত্যন্ত কষ্টের।
শিক্ষাজীবনের গুরুত্বপূর্ণ স্তর হচ্ছে এসএসসি পরীক্ষা। দীর্ঘ দশ বছর পড়ালেখা করার পর প্রথম একজন শিক্ষার্থী পাবলিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে। পরীক্ষার্থী নিজে, পরিবার ও সমাজ অপেক্ষা করে তার একটি ভালো ফলাফলের জন্য। আর সে ফলাফল যখন খারাপ হয় তখন কষ্টের সীমা থাকে না। এবার এসএসসি পরীক্ষায় যারা অকৃতকার্য হয়েছে তারা হয়তো ঘুরে দাঁড়াবে। পড়ালেখা করার মাধ্যমে আগামীতে হয়তো আরও ভালো ফলাফল অর্জন করবে। এবারের ব্যার্থতাটাকে শক্তি হিসেবে নিয়ে আগামী দিন বেশি করে পরিশ্রমের মাধ্যমে নিজেদের তৈরি করবে। এবং এটাই হওয়া উচিত। একটি কথা আছেÑ ব্যার্থতাই সফলতার চাবিকাঠি। কবিও বলে গেছেন, “একবার না পারিলে দেখ শতবার।” পৃথিবীতে বহু মনিষীর কথা জানি যারা ব্যর্থ হয়ে হয়ে সফল হয়েছেন। শুধু সফল হননি। সফলতার চরম শিখরে পৌঁছে গেছেন।
আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় এবং পাবলিক পরীক্ষার ফলাফলে আরও একটি বিষয় মাথায় রাখা দরকার আর তা হলোÑ আমাদের কোয়ালিটি দরকার নাকি কোয়ান্টিটি দরকার। বাংলাদেশ জনবহুল দেশ। এবার এসএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে প্রায় বিশ লাখ শিক্ষার্থী। বিপুলসংখ্যক এই শিক্ষার্থীর পাসের যেমন প্রয়োজন রয়েছে তেমনি মেধাবী ও মানসম্মত ছাত্রছাত্রী তৈরি করার বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ।
দেশ ও জাতি গঠনে শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। সে শিক্ষা হতে হবে মানসম্মত ও বিজ্ঞানমনস্ক শিক্ষা। বিশ্ব এগিয়ে যাচ্ছে। এগিয়ে যাচ্ছে প্রযুক্তি ও শিক্ষা কারিকুলাম। যুগোপযোগী শিক্ষা ও মেধাবী ছাত্রছাত্রী তৈরি করা এখন সময়ের দাবি। এজন্য প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষায় কিছু বিষয়ের ওপর গুরুত্ব আরোপ করা বিশেষ প্রয়োজন। যেমন-
বেতন স্কেল পরিবর্তন ও বৃদ্ধি : আমাদের দেশে মানুষের সামাজিক মর্যাদা নির্ধারিত হয় আর্থিক মানদ-ে। শিক্ষক সমাজ সবসময়ই অর্থ কষ্টে ভোগে। বিশেষ করে প্রাইমারি ও বেসরকারি এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষকদের জীবনমান কষ্টের। একজন শিক্ষক মাস শেষে যে বেতন পান তা দিয়ে কায়ক্লেশে সংসার পরিচালনা করেন। এটা অত্যন্ত দুঃখজনক। বর্তামান সমাজ ব্যবস্থায় শিক্ষকদের জীবন মানেরও পরিবর্তন প্রয়োজন। আর এর জন্য আলাদা বেতন স্কেল ও বেতন বৃষ্টি হওয়া প্রয়োজন।
মেধাবী ও যোগ্যদের বিশেষ মূল্যায়ন : মেধাবী ও যোগ্যরা শিক্ষকতা পেশায় আসতে চায় না। যারা আসে তারাও থাকতে চায় না কিংবা থাকে না। একমাত্র কারণ হচ্ছেÑ এখানে টাকা কম। আবার প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি ও কূটনীতি মেধাবীদের অনাগ্রহ করে তোলে। শিক্ষার কাক্সিক্ষত অগ্রগতি পেতে হলে অবশ্যই মেধাবী ও যোগ্যদের মূল্যায়ন করতে হবে। মেধাবী ও যোগ্যরা শিক্ষকতা পেশায় আসলে এমনিতেই শিক্ষার আমূল পরিবর্তন হবে।
ইংরেজি ও গণিত বিষয়ে শিক্ষকের সংখ্যা বৃদ্ধি : ইংরেজি বিদেশি ভাষা হওয়ায় আমাদের ছেলেমেয়েদের মধ্যে ইংরেজি ভীতি কাজ করে। আবার গণিত বিষয়ে আগ্রহ কম থাকে। এ দুটো বিষয়ে প্রাথমিকের শুরু থেকে বিষয়ভিত্তিক শিক্ষক দিয়ে পাঠদান করানো উচিত। এক্ষেত্রে প্রথম শ্রেণী থেকে দশম শ্রেণী পর্যন্ত ইংরেজি ও গণিত বিষয়ে পর্যাপ্ত শিক্ষক নিয়োগ দেয়া প্রয়োজন। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে স্কুলগুলোতে সবসময়ই ইংরেজি ও গণিত বিষয়ে শিক্ষকস্বল্পতা পরিলক্ষিত হয়। বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে নেয়া প্রয়োজন এবং প্রয়োজনীয় শিক্ষক নিয়োগ দেয়া প্রয়োজন।
বিজ্ঞান বিষয়ের ওপর জোর দেয়া : বিজ্ঞান শিক্ষার প্রসারের বিষয়ভিত্তিক বিজ্ঞান শিক্ষক নিয়োগ দেয়া প্রয়োজন। প্রয়োজন ব্যবহারিক শিক্ষার ওপর জোর দেয়া। প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিজ্ঞান ল্যাব বাধ্যতামূলক করা উচিত। আমাদের দেশে এমপিওভুক্ত মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোতে প্রয়োজনীয় ল্যাব-সুবিধা নেই বললেই চলে। থাকলেও ল্যাবের যথাযথ ব্যবহার হয় না বলে অভিযোগ রয়েছে।
শ্রেণীকক্ষে ছাত্রছাত্রীদের উপস্থিত নিশ্চিত করা : মাধ্যমিক বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের একটি বড় সমস্যা হচ্ছে ছাত্রছাত্রী উপস্থিতি। নানাবিধ কারণে দেখা যায় শ্রেণীকক্ষে ছাত্রছাত্রীদের উপস্থিতি কম থাকে। কিন্তু অনুপস্থিত এসব ছাত্রছাত্রীও শেষপর্যন্ত এসএসসি ও সমমান পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে। এদের অনেকেই পাস করে যায়। কিন্তু পাস করা আর মেধাবী হওয়া এক বিষয় নয়। পাস করার পাশাপাশি মেধা ও পড়ালেখা সম্পর্কে জ্ঞান রাখাই হচ্ছে একজন ছাত্রের আসল কাজ। শ্রেণীকক্ষে উপস্থিত থাকলে একজন ছাত্রের মেধা বিকশিত হয়। জ্ঞানের পরিসর বাড়ে। শ্রেণীকক্ষে শিক্ষক যে পাঠদান করান তা একজন ছাত্রের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অনুপস্থিত ছাত্র তা মিস করে। ফলে পড়ালেখার ঘাটতি থেকেই যায়। শ্রেণীকক্ষের এই ঘাটতি আর কখনও পূরণ হয় না। তাই ছাত্রছাত্রীদের শ্রেণীকক্ষে উপস্থিত বাড়াতে হবে।
ভালো ফলাফল যেমন প্রয়োজন তেমনি প্রয়োজন মানসম্মত শিক্ষা। আর এই মানসম্মত শিক্ষার জন্য দরকার শিক্ষক সমাজের জীবনমানের পরিবর্তন। আর এর জন্য শিক্ষকদের আলাদা বেতন স্কেল ও মর্যাদা প্রয়োজন। প্রয়োজন যুগোপযোগী শিক্ষা কারিকুলাম, শিক্ষক প্রশিক্ষণ ও মেধার প্রকৃত মূল্যায়ন। এই কাজগুলো করা গেলে নতুন প্রজন্ম বেড়ে উঠবে মেধা ও প্রজ্ঞায়।
[লেখক : সহকারী অধ্যাপক, ভূগোল বিভাগ, মুক্তিযোদ্ধা কলেজ, গাজীপুর]