alt

উপ-সম্পাদকীয়

কেন থাইল্যান্ড-কম্বোডিয়ার ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি?

এম এ হোসাইন

: শনিবার, ২৬ জুলাই ২০২৫

সীমানাবিরোধ শুধু ভৌগোলিক সীমারেখা নিয়ে নয় বরং এটি ইতিহাসের ধারাবাহিকতা, স্মৃতির রাজনীতি আর রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তাহীনতার বহিঃপ্রকাশ। ২০২৫ সালের ২৪ জুলাই থাইল্যান্ড ও কাম্বোডিয়ার মধ্যে আবারও রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ শুরু হলো, প্রাচীন খমের-হিন্দু মন্দির প্রাসাত তা মুয়েন থমের কাছে। এই সহিংসতা আমাদের আবার স্মরণ করিয়ে দিল, অমীমাংসিত অতীত বারবার বর্তমানকে রক্তাক্ত করে।

ঘটনার সূত্রপাত হয় একটি ল্যান্ডমাইন বিস্ফোরণে, যেখানে থাই সেনারা আহত হয়। এরপর থাইল্যান্ড বিতর্কিত সীমান্ত অংশে কাঁটাতারের বেড়া বসায়, আর কাম্বোডিয়া একে সরাসরি উসকানি হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করে। কূটনৈতিক বার্তায় উত্তেজনা বাড়তে থাকেÑদুই দেশের রাষ্ট্রদূতদের ডেকে পাঠানো হয়, সীমান্ত বাণিজ্য বন্ধ করে দেয়া হয়, সেনা মোতায়েন বাড়তে থাকে। এর পরিণতিও ছিল অনিবার্য। তোপের গোলা, রকেট হামলা, বিমান থেকে বোমাবর্ষণ, আর মাঝখানে অসহায় সাধারণ মানুষ। থাইল্যান্ডের ১১ জন বেসামরিক নাগরিক ও একজন সেনা নিহত হয়েছেন। কাম্বোডিয়ার ছোড়া রকেটে গ্রামগুলো ধ্বংস হয়ে গেছে, হাজার হাজার মানুষ নিরাপদ আশ্রয়ে পালিয়েছে। পাল্টা হিসেবে থাইল্যান্ড এফ-১৬ যুদ্ধবিমান থেকে হামলা চালিয়েছে। নমপেন দাবি করছে তারা শুধু আত্মরক্ষার জন্য লড়ছে, আর ব্যাংকক বলছে, হামলার সূচনা কাম্বোডিয়ার দিক থেকেই হয়েছে। গল্পের কাঠামো পুরনো, কেবল ভুক্তভোগীরা নতুন।

এটি বিচ্ছিন্ন কোনো সংঘর্ষ নয়। গত মে মাসেও সীমান্তে সংঘর্ষ হয়েছিল, তখন গোপন আলোচনার মাধ্যমে তা সাময়িকভাবে থেমেছিল। এবার সহিংসতা আরও তীব্র, কারণ এবার বিমানবাহিনীও যুক্ত হয়েছে। এটি প্রমাণ করছে দুই দেশের রাজনৈতিক সম্পর্ক বহু বছরের মধ্যে সবচেয়ে নাজুক অবস্থায় পৌঁছেছে।

এই বিরোধের মূল শিকড় ঔপনিবেশিক যুগের মানচিত্রে। থাইল্যান্ড ও কাম্বোডিয়ার সীমান্ত রেখা তাদের হাতে নয়, ফরাসি ও ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তি এঁকেছিল। ফলে রয়ে গেছে অস্পষ্টতা, যা আজ বিস্ফোরণের মতো ফেটে পড়ছে। কাম্বোডিয়াবাসীর কাছে তা মুয়েন থম বা প্রাহ ভিহিয়ার মতো মন্দির কেবল স্থাপত্য নয়, এটি এ্যাঙ্গোকোরীয় সভ্যতার গৌরবময় স্মারক। থাইদের কাছে এগুলো এমন এক সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার, যেটি তারা একসময় প্রভাবিত হয়েছিল। তাই ইতিহাসকে দুই দেশই নিজেদের অহংকার আর ক্ষোভের দৃষ্টিতে দেখে। সমঝোতা মানে বিশ্বাসঘাতকতা, ছাড় দেয়া মানে জাতীয়তাবাদের ক্ষোভ ডেকে আনা।

ইতিহাস এখানে ভয়ংকরভাবে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। ২০১১ সালে প্রাহ ভিহিয়ার মন্দির ঘিরেও একই রকম সংঘর্ষ হয়েছিল, তখন ২৮ জন মারা গিয়েছিল আর হাজার হাজার মানুষ উদ্বাস্তু হয়েছিল। তখন আসিয়ান (দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার আঞ্চলিক সংগঠন) কিছুটা মধ্যস্থতা করে পরিস্থিতি শান্ত করতে পেরেছিল। কিন্তু আজকের আসিয়ান দুর্বল। মিয়ানমারের গৃহযুদ্ধ, দক্ষিণ চীন সাগর বিরোধ আর যুক্তরাষ্ট্র-চীন প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ব্যস্ত সংগঠনটি আর আগের মতো সক্রিয়ভাবে সংকট সামলাতে পারছে না। ঝুঁকি বেড়েছে, কিন্তু মীমাংসার ক্ষমতা কমেছে।

এ সংঘাত কেবল কয়েক কিলোমিটার জঙ্গলের জন্য নয়, এর প্রভাব গোটা অঞ্চলের জন্য ভয়াবহ। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া তার আধুনিক পরিচয় গড়েছে অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও আপেক্ষিক শান্তির ভিত্তিতে। দুই আসিয়ান সদস্যের মধ্যে সীমান্তযুদ্ধ সেই ভাবমূর্তিকে ভেঙে দিতে পারে। এটি আবার প্রমাণ করছেÑ‘আসিয়ান ওয়ে’ বা আপস, সংযম ও অন্তহীন আলোচনার পথ কতটা সীমিত। যদি সহিংসতা দীর্ঘায়িত হয়, তাহলে দুই দেশই নিজেদের প্রতিরক্ষা খাতে বিনিয়োগ বাড়াবে, যা নতুন অস্ত্র প্রতিযোগিতার সূচনা করতে পারে। সীমান্তের সাধারণ মানুষের জীবন, যাদের বাণিজ্য ও পর্যটনের ওপর নির্ভর করে, যা একদম থমকে যাবে।

যেমন সব অমীমাংসিত বিরোধেই হয়ে যা থাকে, বাইরের শক্তিগুলোও এতে হস্তক্ষেপের সুযোগ পাবে। কাম্বোডিয়ার সঙ্গে চীনের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। থাইল্যান্ড যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তা সহযোগী। দীর্ঘমেয়াদি সামরিক উত্তেজনা এই দ্বিপক্ষীয় বিরোধকে সহজেই ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলগত প্রতিযোগিতার অংশে পরিণত করতে পারে। থাইল্যান্ড, কাম্বোডিয়া ও লাওসের সংযোগস্থল ‘এমেরাল্ড ট্রায়াঙ্গেল’ বরাবরই ভূ-রাজনৈতিকভাবে ভঙ্গুর। যদি লাওস নিজেকে হুমকির মুখে দেখে বা কোনো তৃতীয় পক্ষ সক্রিয় হয়, তাহলে সংঘাত দুই দেশের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে।

মানবিক ক্ষতিও বাড়ছে। ইতোমধ্যে ৪০ হাজার মানুষ ঘরছাড়া হয়েছে। গোলাবর্ষণে হাসপাতাল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। শিগগিরই সীমান্ত পেরিয়ে শরণার্থী ঢল নামতে পারে, যেমন মিয়ানমারের গৃহযুদ্ধের পর দেখা গেছে। প্রতিটি সহিংস দিনের পর সীমান্তে এমন ক্ষত তৈরি হচ্ছে, যা কোনো যুদ্ধবিরতিও সহজে সারাতে পারবে না।

প্রশ্ন হলোÑএই অবস্থায় আসিয়ান কোথায়? কাগজে-কলমে আছে শান্তি ও সহযোগিতার নানা চুক্তিÑট্রিটি অব অ্যামিটি অ্যান্ড কো-অপারেশন, আসিয়ান রিজিওনাল ফোরাম, ইনস্টিটিউট ফর পিস অ্যান্ড রিকনসিলিয়েশন। ইন্দোনেশিয়া চাইলে আবারও মধ্যস্থতার ভূমিকা নিতে পারে। কিন্তু আসিয়ানের বড় শক্তিÑসম্মতিনির্ভর, অনাক্রমণাত্মক কূটনীতিÑএখন তার বড় দুর্বলতা। তারা সংলাপের আহ্বান জানাতে পারে, কিন্তু চাপিয়ে দিতে পারে না। যদি থাইল্যান্ড বা কাম্বোডিয়া কেউ একচুলও ছাড় দিতে না চায়, তাহলে আসিয়ান কেবল শালীন ভাষায় ‘সংযমের আহ্বান’ জানাতে পারে, আর গোলাগুলি চলতেই থাকবে।

অবশেষে আসল প্রশ্ন রাজনৈতিক সদিচ্ছার। দীর্ঘ সংঘর্ষ থেকে কোনো দেশই লাভবান হবে না। দুই দেশই পর্যটন ও বাণিজ্যের ওপর নির্ভরশীল। দুই দেশই আসিয়ানের অর্থনৈতিক সংহতির অংশ। তবুও অভ্যন্তরীণ জাতীয়তাবাদী চাপ তাদের আপসে বাধা দিচ্ছে। ব্যাংকক বা নমপেনে এখন নরম হওয়া মানে রাজনৈতিক আত্মহত্যা। তাই সংঘর্ষের অদ্ভুত এক যুক্তি চলেÑকেউ পিছু হটতে পারে না, যদিও শেষ পর্যন্ত উভয় পক্ষই আরও বড় ক্ষতির মুখে পড়ে।

নিষ্ক্রিয়তার দীর্ঘমেয়াদি পরিণতি ভয়াবহ। সীমান্তে সামরিকীকরণ বাড়তে থাকলে পারস্পরিক অবিশ্বাস আরও গভীর হবে, ভবিষ্যতে সীমানা নির্ধারণ কঠিন হয়ে পড়বে। মানবিক বিপর্যয় স্থানীয় জনগোষ্ঠীকে চরম দুর্দশায় ফেলবে। বাণিজ্য বন্ধ হলে আসিয়ানের আঞ্চলিক সংযোগের স্বপ্ন ভেঙে যাবে। আর সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতিতে এই সীমান্তবিরোধ বড় শক্তির ভূ-রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জড়িয়ে গিয়ে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াকে আবার বাইরের স্বার্থের খেলায় পরিণত করবে।

তবুও এ সবকিছু অবশ্যম্ভাবী নয়। ইতিহাস প্রমাণ করে, কঠিন বিরোধও যখন বাস্তববাদী দৃষ্টিভঙ্গি নেয় তখন সমাধানের পথ খুঁজে পাওয়া যায়। ২০১১ সালের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের পরও দুই দেশ আলোচনায় ফিরেছিল। শান্ত সময়গুলোতে থাইল্যান্ড ও কাম্বোডিয়া বাণিজ্য, নিরাপত্তা, এমনকি যৌথ পর্যটন প্রকল্পেও সহযোগিতা করেছে। এখনো কূটনীতির সুযোগ আছেÑযদি দুই সরকার স্বল্পমেয়াদি রাজনৈতিক লাভের চেয়ে দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতির কথা ভাবতে পারে।

ঔপনিবেশিক শক্তির টানা সীমান্ত সর্বদাই ক্ষোভের ঝুঁকি বহন করবে। কিন্তু একবিংশ শতকে অতীতের ক্ষোভ আঁকড়ে থাকা কোনো পক্ষের জন্যই লাভজনক নয়। থাই-কাম্বোডিয়া সীমান্তের প্রাচীন মন্দিরগুলো যতই পবিত্র হোক, সেখানে বসবাসকারী মানুষের প্রয়োজন আধুনিকÑনিরাপত্তা, স্থিতিশীলতা ও সমৃদ্ধি। তারা আবারও গোলাগুলির ছায়ায় একটি প্রজন্ম নষ্ট হতে দিতে চায় না।

জাতীয়তাবাদী হুমকির সময় শেষ। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া আরেকটি জ্বলন্ত সংঘাত সহ্য করতে পারবে না, যখন তার সামনে জলবায়ু সংকট থেকে শুরু করে মহাশক্তির প্রতিযোগিতার মতো বড় চ্যালেঞ্জ দাঁড়িয়ে। এখন প্রয়োজন শান্ত, দৃঢ় কূটনীতিÑবক্তৃতা নয়। এই অঞ্চলের ভবিষ্যৎ শান্তি ও উন্নতির পথে টিকে থাকবে তখনই, যখন প্রতিবেশীরা অতীতের তিক্ততা নয়, প্রজ্ঞার আলোকে সমাধান বেছে নেবে।

[লেখক : প্রাবন্ধিক]

জলবায়ু পরিবর্তন মডেলে গণিতের ব্যবহার

দুর্ঘটনাজনিত দুর্যোগ-পরবর্তী করণীয় কী?

ডেঙ্গু, জিকা আর চিকুনগুনিয়া : একই উৎস, ত্রিমুখী সংকট

দুর্নীতি নির্মূল করা কি সম্ভব?

দরকার মানসম্মত শিক্ষা

ইসরায়েলের যুদ্ধনীতি ও বিশ্ব নিরাপত্তার সংকট

রম্যগদ্য : ‘বেইমান রাইট ব্রাদার্স’

মানসিক স্বাস্থ্যসেবা : আইনি কাঠামো, সংকট ও সম্ভাবনার দিক

ছবি

বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক উজ্জ্বল নক্ষত্র

দুর্যোগে অবিবেচকদেরকে কি দায়িত্বশীল ভাবা যায়?

ওয়াসার পদ্মা ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট : এক জীবন্ত বোটানিক্যাল গার্ডেন

রেলপথের দুর্দশা : সমন্বিত পরিকল্পনা না হলে বিপর্যয় অনিবার্য

বিশ্ববিদ্যালয় জ্ঞানচর্চার কেন্দ্র নাকি ক্ষমতার অভ্যন্তরীণ উপনিবেশ?

পিরোজপুরের স্কুলটির ফলাফল বিপর্যয় এবং আচরণগত অর্থনীতির দৃষ্টিকোণ

কোনো শাসকই অপরাজেয় নয়

পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি : বাঙালিকে রুচির দৈন্যে টেনে নামানো হচ্ছে

জনসংখ্যা ও যুবশক্তির চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা

রাষ্ট্রের কাছে স্বাভাবিক মৃত্যুর নিশ্চয়তা চাই

পার্বত্য চট্টগ্রাম : প্রাকৃতিক সম্পদ ও অর্থনৈতিক সম্ভাবনা

ইউরেশিয়ায় তৃতীয় বিকল্প গালফ কূটনীতি

‘বিপ্লবী সংস্কার’ কি সম্ভব

রম্যগদ্য : ‘ব্যাংক, ব্যাংক নয়’

মবতন্ত্রের জয়

ডিজিটাল ক্লান্তি ও ‘সর্বক্ষণ সক্রিয়’ সংস্কৃতির শ্রেণীগত রাজনীতি

ছবি

বোধের স্ফূরণ, না ‘মেটিকুলাস ডিজাইন’?

এসএসসিতে গণিত বিষয়ে ফল বিপর্যয় : কারণ ও উত্তরণের উপায়

দক্ষ মানবসম্পদ ও সমৃদ্ধ গ্রন্থাগার

আফ্রিকায় হঠাৎ কেন যুক্তরাষ্ট্রের ঝোঁক?

ঢাকা মহানগর ও বুড়িগঙ্গা

জামাই মেলা : উৎসব, ঐতিহ্য ও কৃষ্টির রঙিন চিত্রপট

হারিয়ে যাওয়া ক্লাস, কঠোর মূল্যায়ন আর প্রশ্নের জটিলতায় নুয়ে পড়া এক প্রজন্ম

বৈষম্য দূর করে নতুন বাংলাদেশ গড়ে তুলুন

চিকিৎসা যেন বাণিজ্যের হাতিয়ারে পরিণত না হয়

পথশিশু ও বাংলাদেশে সামাজিক চুক্তির ব্যর্থতা

মেগা প্রকল্প : প্রশ্ন হওয়া উচিত স্বচ্ছতা নিয়ে

আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া জরুরি

tab

উপ-সম্পাদকীয়

কেন থাইল্যান্ড-কম্বোডিয়ার ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি?

এম এ হোসাইন

শনিবার, ২৬ জুলাই ২০২৫

সীমানাবিরোধ শুধু ভৌগোলিক সীমারেখা নিয়ে নয় বরং এটি ইতিহাসের ধারাবাহিকতা, স্মৃতির রাজনীতি আর রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তাহীনতার বহিঃপ্রকাশ। ২০২৫ সালের ২৪ জুলাই থাইল্যান্ড ও কাম্বোডিয়ার মধ্যে আবারও রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ শুরু হলো, প্রাচীন খমের-হিন্দু মন্দির প্রাসাত তা মুয়েন থমের কাছে। এই সহিংসতা আমাদের আবার স্মরণ করিয়ে দিল, অমীমাংসিত অতীত বারবার বর্তমানকে রক্তাক্ত করে।

ঘটনার সূত্রপাত হয় একটি ল্যান্ডমাইন বিস্ফোরণে, যেখানে থাই সেনারা আহত হয়। এরপর থাইল্যান্ড বিতর্কিত সীমান্ত অংশে কাঁটাতারের বেড়া বসায়, আর কাম্বোডিয়া একে সরাসরি উসকানি হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করে। কূটনৈতিক বার্তায় উত্তেজনা বাড়তে থাকেÑদুই দেশের রাষ্ট্রদূতদের ডেকে পাঠানো হয়, সীমান্ত বাণিজ্য বন্ধ করে দেয়া হয়, সেনা মোতায়েন বাড়তে থাকে। এর পরিণতিও ছিল অনিবার্য। তোপের গোলা, রকেট হামলা, বিমান থেকে বোমাবর্ষণ, আর মাঝখানে অসহায় সাধারণ মানুষ। থাইল্যান্ডের ১১ জন বেসামরিক নাগরিক ও একজন সেনা নিহত হয়েছেন। কাম্বোডিয়ার ছোড়া রকেটে গ্রামগুলো ধ্বংস হয়ে গেছে, হাজার হাজার মানুষ নিরাপদ আশ্রয়ে পালিয়েছে। পাল্টা হিসেবে থাইল্যান্ড এফ-১৬ যুদ্ধবিমান থেকে হামলা চালিয়েছে। নমপেন দাবি করছে তারা শুধু আত্মরক্ষার জন্য লড়ছে, আর ব্যাংকক বলছে, হামলার সূচনা কাম্বোডিয়ার দিক থেকেই হয়েছে। গল্পের কাঠামো পুরনো, কেবল ভুক্তভোগীরা নতুন।

এটি বিচ্ছিন্ন কোনো সংঘর্ষ নয়। গত মে মাসেও সীমান্তে সংঘর্ষ হয়েছিল, তখন গোপন আলোচনার মাধ্যমে তা সাময়িকভাবে থেমেছিল। এবার সহিংসতা আরও তীব্র, কারণ এবার বিমানবাহিনীও যুক্ত হয়েছে। এটি প্রমাণ করছে দুই দেশের রাজনৈতিক সম্পর্ক বহু বছরের মধ্যে সবচেয়ে নাজুক অবস্থায় পৌঁছেছে।

এই বিরোধের মূল শিকড় ঔপনিবেশিক যুগের মানচিত্রে। থাইল্যান্ড ও কাম্বোডিয়ার সীমান্ত রেখা তাদের হাতে নয়, ফরাসি ও ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তি এঁকেছিল। ফলে রয়ে গেছে অস্পষ্টতা, যা আজ বিস্ফোরণের মতো ফেটে পড়ছে। কাম্বোডিয়াবাসীর কাছে তা মুয়েন থম বা প্রাহ ভিহিয়ার মতো মন্দির কেবল স্থাপত্য নয়, এটি এ্যাঙ্গোকোরীয় সভ্যতার গৌরবময় স্মারক। থাইদের কাছে এগুলো এমন এক সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার, যেটি তারা একসময় প্রভাবিত হয়েছিল। তাই ইতিহাসকে দুই দেশই নিজেদের অহংকার আর ক্ষোভের দৃষ্টিতে দেখে। সমঝোতা মানে বিশ্বাসঘাতকতা, ছাড় দেয়া মানে জাতীয়তাবাদের ক্ষোভ ডেকে আনা।

ইতিহাস এখানে ভয়ংকরভাবে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। ২০১১ সালে প্রাহ ভিহিয়ার মন্দির ঘিরেও একই রকম সংঘর্ষ হয়েছিল, তখন ২৮ জন মারা গিয়েছিল আর হাজার হাজার মানুষ উদ্বাস্তু হয়েছিল। তখন আসিয়ান (দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার আঞ্চলিক সংগঠন) কিছুটা মধ্যস্থতা করে পরিস্থিতি শান্ত করতে পেরেছিল। কিন্তু আজকের আসিয়ান দুর্বল। মিয়ানমারের গৃহযুদ্ধ, দক্ষিণ চীন সাগর বিরোধ আর যুক্তরাষ্ট্র-চীন প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ব্যস্ত সংগঠনটি আর আগের মতো সক্রিয়ভাবে সংকট সামলাতে পারছে না। ঝুঁকি বেড়েছে, কিন্তু মীমাংসার ক্ষমতা কমেছে।

এ সংঘাত কেবল কয়েক কিলোমিটার জঙ্গলের জন্য নয়, এর প্রভাব গোটা অঞ্চলের জন্য ভয়াবহ। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া তার আধুনিক পরিচয় গড়েছে অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও আপেক্ষিক শান্তির ভিত্তিতে। দুই আসিয়ান সদস্যের মধ্যে সীমান্তযুদ্ধ সেই ভাবমূর্তিকে ভেঙে দিতে পারে। এটি আবার প্রমাণ করছেÑ‘আসিয়ান ওয়ে’ বা আপস, সংযম ও অন্তহীন আলোচনার পথ কতটা সীমিত। যদি সহিংসতা দীর্ঘায়িত হয়, তাহলে দুই দেশই নিজেদের প্রতিরক্ষা খাতে বিনিয়োগ বাড়াবে, যা নতুন অস্ত্র প্রতিযোগিতার সূচনা করতে পারে। সীমান্তের সাধারণ মানুষের জীবন, যাদের বাণিজ্য ও পর্যটনের ওপর নির্ভর করে, যা একদম থমকে যাবে।

যেমন সব অমীমাংসিত বিরোধেই হয়ে যা থাকে, বাইরের শক্তিগুলোও এতে হস্তক্ষেপের সুযোগ পাবে। কাম্বোডিয়ার সঙ্গে চীনের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। থাইল্যান্ড যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তা সহযোগী। দীর্ঘমেয়াদি সামরিক উত্তেজনা এই দ্বিপক্ষীয় বিরোধকে সহজেই ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলগত প্রতিযোগিতার অংশে পরিণত করতে পারে। থাইল্যান্ড, কাম্বোডিয়া ও লাওসের সংযোগস্থল ‘এমেরাল্ড ট্রায়াঙ্গেল’ বরাবরই ভূ-রাজনৈতিকভাবে ভঙ্গুর। যদি লাওস নিজেকে হুমকির মুখে দেখে বা কোনো তৃতীয় পক্ষ সক্রিয় হয়, তাহলে সংঘাত দুই দেশের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে।

মানবিক ক্ষতিও বাড়ছে। ইতোমধ্যে ৪০ হাজার মানুষ ঘরছাড়া হয়েছে। গোলাবর্ষণে হাসপাতাল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। শিগগিরই সীমান্ত পেরিয়ে শরণার্থী ঢল নামতে পারে, যেমন মিয়ানমারের গৃহযুদ্ধের পর দেখা গেছে। প্রতিটি সহিংস দিনের পর সীমান্তে এমন ক্ষত তৈরি হচ্ছে, যা কোনো যুদ্ধবিরতিও সহজে সারাতে পারবে না।

প্রশ্ন হলোÑএই অবস্থায় আসিয়ান কোথায়? কাগজে-কলমে আছে শান্তি ও সহযোগিতার নানা চুক্তিÑট্রিটি অব অ্যামিটি অ্যান্ড কো-অপারেশন, আসিয়ান রিজিওনাল ফোরাম, ইনস্টিটিউট ফর পিস অ্যান্ড রিকনসিলিয়েশন। ইন্দোনেশিয়া চাইলে আবারও মধ্যস্থতার ভূমিকা নিতে পারে। কিন্তু আসিয়ানের বড় শক্তিÑসম্মতিনির্ভর, অনাক্রমণাত্মক কূটনীতিÑএখন তার বড় দুর্বলতা। তারা সংলাপের আহ্বান জানাতে পারে, কিন্তু চাপিয়ে দিতে পারে না। যদি থাইল্যান্ড বা কাম্বোডিয়া কেউ একচুলও ছাড় দিতে না চায়, তাহলে আসিয়ান কেবল শালীন ভাষায় ‘সংযমের আহ্বান’ জানাতে পারে, আর গোলাগুলি চলতেই থাকবে।

অবশেষে আসল প্রশ্ন রাজনৈতিক সদিচ্ছার। দীর্ঘ সংঘর্ষ থেকে কোনো দেশই লাভবান হবে না। দুই দেশই পর্যটন ও বাণিজ্যের ওপর নির্ভরশীল। দুই দেশই আসিয়ানের অর্থনৈতিক সংহতির অংশ। তবুও অভ্যন্তরীণ জাতীয়তাবাদী চাপ তাদের আপসে বাধা দিচ্ছে। ব্যাংকক বা নমপেনে এখন নরম হওয়া মানে রাজনৈতিক আত্মহত্যা। তাই সংঘর্ষের অদ্ভুত এক যুক্তি চলেÑকেউ পিছু হটতে পারে না, যদিও শেষ পর্যন্ত উভয় পক্ষই আরও বড় ক্ষতির মুখে পড়ে।

নিষ্ক্রিয়তার দীর্ঘমেয়াদি পরিণতি ভয়াবহ। সীমান্তে সামরিকীকরণ বাড়তে থাকলে পারস্পরিক অবিশ্বাস আরও গভীর হবে, ভবিষ্যতে সীমানা নির্ধারণ কঠিন হয়ে পড়বে। মানবিক বিপর্যয় স্থানীয় জনগোষ্ঠীকে চরম দুর্দশায় ফেলবে। বাণিজ্য বন্ধ হলে আসিয়ানের আঞ্চলিক সংযোগের স্বপ্ন ভেঙে যাবে। আর সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতিতে এই সীমান্তবিরোধ বড় শক্তির ভূ-রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জড়িয়ে গিয়ে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াকে আবার বাইরের স্বার্থের খেলায় পরিণত করবে।

তবুও এ সবকিছু অবশ্যম্ভাবী নয়। ইতিহাস প্রমাণ করে, কঠিন বিরোধও যখন বাস্তববাদী দৃষ্টিভঙ্গি নেয় তখন সমাধানের পথ খুঁজে পাওয়া যায়। ২০১১ সালের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের পরও দুই দেশ আলোচনায় ফিরেছিল। শান্ত সময়গুলোতে থাইল্যান্ড ও কাম্বোডিয়া বাণিজ্য, নিরাপত্তা, এমনকি যৌথ পর্যটন প্রকল্পেও সহযোগিতা করেছে। এখনো কূটনীতির সুযোগ আছেÑযদি দুই সরকার স্বল্পমেয়াদি রাজনৈতিক লাভের চেয়ে দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতির কথা ভাবতে পারে।

ঔপনিবেশিক শক্তির টানা সীমান্ত সর্বদাই ক্ষোভের ঝুঁকি বহন করবে। কিন্তু একবিংশ শতকে অতীতের ক্ষোভ আঁকড়ে থাকা কোনো পক্ষের জন্যই লাভজনক নয়। থাই-কাম্বোডিয়া সীমান্তের প্রাচীন মন্দিরগুলো যতই পবিত্র হোক, সেখানে বসবাসকারী মানুষের প্রয়োজন আধুনিকÑনিরাপত্তা, স্থিতিশীলতা ও সমৃদ্ধি। তারা আবারও গোলাগুলির ছায়ায় একটি প্রজন্ম নষ্ট হতে দিতে চায় না।

জাতীয়তাবাদী হুমকির সময় শেষ। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া আরেকটি জ্বলন্ত সংঘাত সহ্য করতে পারবে না, যখন তার সামনে জলবায়ু সংকট থেকে শুরু করে মহাশক্তির প্রতিযোগিতার মতো বড় চ্যালেঞ্জ দাঁড়িয়ে। এখন প্রয়োজন শান্ত, দৃঢ় কূটনীতিÑবক্তৃতা নয়। এই অঞ্চলের ভবিষ্যৎ শান্তি ও উন্নতির পথে টিকে থাকবে তখনই, যখন প্রতিবেশীরা অতীতের তিক্ততা নয়, প্রজ্ঞার আলোকে সমাধান বেছে নেবে।

[লেখক : প্রাবন্ধিক]

back to top