alt

মতামত » উপ-সম্পাদকীয়

ভাঙছে নদী, গড়ছে দুঃখের গ্রাম

জাহিদুল ইসলাম

: বৃহস্পতিবার, ০৭ আগস্ট ২০২৫

বাংলা সাহিত্যের একটি কালজয়ী উপন্যাস ‘পদ্মা নদীর মাঝি’। সেখানে একটি সংলাপ ছিল- “নদী আবার কী? নদী ভালোবাসে, আবার কখনো কখনো ছিন্নভিন্ন করে দেয়!” এই সংলাপে নদীর চিরায়িত দ্বৈত চরিত্র ফুটে উঠেছিল। অদ্বৈত মল্লবর্মণ রচিত কালজয়ী আরেকটি উপন্যাস ‘তিতাস একটি নদীর নাম’। উপন্যাসটি অবলম্বনে ১৯৭৩ সালে পরিচালক ঋত্বিক ঘটক নির্মিত চলচ্চিত্রেও ফুটে উঠেছে নদীভিত্তিক জীবন ও নদীভাঙনের এক মর্মস্পর্শী দলিল। এই উপন্যাসে তিতাস নদী শুধুই একটি নদী নয় এটি হয়ে উঠেছিল সমাজ, সংস্কৃতি, জীবন, মৃত্যু, আশা ও ধ্বংসের এক প্রতীক। বিশেষ করে মালো সম্প্রদায় যারা মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করে তাদের চোখ দিয়ে আমরা দেখতে পাই নদী কীভাবে একদিকে জীবন দেয়, অন্যদিকে আবার নিঃশেষ করে দেয় সবকিছু। উপন্যাসে একটি সংলাপে বলা হয়েছে- “এই নদী আমাদের কেঁদে কেঁদে ডাকে, আবার আমাদের নিঃস্বও করে দেয়।” চলচ্চিত্রে সুবলার বিয়ের সময় নদীতে ডাকাত পড়ে, নৌকা ভেসে যায়, স্বামী হারায় নতুন বউ। পরে সে সমাজচ্যুত হয় সুবলা। এখানে নদীভাঙন শুধু ভৌগোলিক নয়, সামাজিকও। সুবলার মর্মান্তিক অভিব্যক্তি “তিতাস আমার স্বামীকে নেয় নাই, আমার সব লইছে।”

বাংলা সাহিত্যের মতোই প্রতি বছর বর্ষা আসার সঙ্গে বাংলাদেশের নদীগুলো আবারো প্রাণ ফিরিয়ে আনে, কিন্তু এই প্রাণের সঙ্গে নিয়ে আসে ভাঙনের বিভীষিকা। এই বঙ্গীয় ব-দ্বীপ; আমাদের নদীমাতৃক দেশ এই ভাঙ্গা গড়ার মাধ্যমেই গড়ে উঠেছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এই নদী ভাঙনের প্রকোপ বেড়েছে মারাত্মকভাবে। নদীর তীরে বসবাসরত পরিবারের স্বপ্নগুলো হামাগুড়ি খায়, স্কুল, হাসপাতাল, ফসলÑসবকিছু ধ্বংস হয়ে যায়। নদী ভাঙনের ধাক্কায় সব হারিয়ে ফেলে হাজারো মানুষ, তাদের ধ্বংসাবশেষের গ্রাম গড়ে উঠছে, দুঃখের গ্রাম।

প্রশ্ন থেকে যায় এই দেশ কি নদীভাঙনের কোনো স্থায়ী সমাধান খুঁজে পায়নি? প্রতি বছর একই দৃশ্য, একই আর্তনাদ, শুধু চরিত্র বদলায়। পরিবার হারায় মা, সন্তান হারায় পিতা, একটি গ্রামের স্বপ্ন কবর হয়ে যায় পানির তলায়। এসব মানুষদের যন্ত্রণা কোনো পরিসংখ্যান জানে না। তাদের আর্তনাদ ছুঁয়ে না উচ্চকক্ষের এয়ারকন্ডিশনে বসা সিদ্ধান্তপ্রস্তুতকারীদের মন। হয়তো তাদের চোখে এসব গরিব চরবাসীর জীবন এমনিতেই দুর্বল ভাঙলেও কিছু যায় আসে না!

একবার কি ভেবে দেখেছি, যে শিশুটির স্কুল আজ নদী গিলে খেয়েছে, সে আর কোনোদিন বিদ্যালয়ের চৌকাঠ মাড়াতে পারবে কিনা? কিংবা যে মা সন্তানকে নিয়ে নতুন ঘর তুলেছিল, আজ নদীর গ্রাসে পড়ে সে কোথায় দাঁড়িয়ে কাঁদছে? এসব প্রশ্ন আমাদের নাড়া দেয় না, কারণ আমরা ভাবি, নদী তো সবসময়ই ভাঙে! কিন্তু একটি ঘর ভাঙা মানে কেবল চারটে বাঁশ আর টিনের চালের পতন নয়; ভেঙে পড়ে আশ্রয়, স্বপ্ন, ভবিষ্যতের পথ।এই ভূখ-ের নদীগুলো একসময় ছিল গর্বের, জীবনের চালিকা শক্তি। অথচ এখন তারাই হয়ে উঠেছে নিঃস্বতার প্রতীক। পদ্মা, যমুনা, মেঘনা, তিতাস নাম শুনলেই মমতার ঢেউ বয়ে যেতো, এখন কেবল ভয় হয়। নদী যদি মায়ের মতো হয়, তবে কী করে মা তার সন্তানের মাথা কেটে নেয়? এই প্রশ্ন চিরন্তন হয়ে থেকে যায় ভাঙনের কষ্টে জর্জরিত মানুষদের মনে।

আমরা যে উন্নয়নের গল্প শুনি প্রতিদিন, সেই গল্পের এক প্রান্তে এসব ভাঙা ঘর, ভাঙা স্কুল, ভাঙা হাসপাতালগুলো কখনোই স্থান পায় না। সরকারি কাগজে তারা “অন্তর্বর্তী সমস্যা” তবে বাস্তবের মাটিতে তারা চিরস্থায়ী বেদনার উৎস। নদী যেমন ভাঙে, তেমন গড়ার দায় তো মানুষের। কিন্তু সেখানেই ব্যর্থ আমরা। প্রতিবার গৃহহীন মানুষেরা ‘পুনর্বাসনের প্রতিশ্রুতি’ শুনতে শুনতে জীবনের বাকি পথটাই কেটে দেয় খোলা আকাশের নিচে। বাবুগঞ্জের সেই স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, যেটা নদী গিলে নিয়েছে, তার জন্য কেউ দায় নেন না। ৭০ হাজার মানুষের চিকিৎসাসেবা থমকে যায় এই সংবাদ যেন পাঁচ লাইনের বেশি হতে পারে না কোনো রিপোর্টে! অথচ সেখানে একজন প্রসূতির সন্তান জন্ম নিতে না পারার পেছনে নদী ভাঙন নয়, দায়ী আমরা। কারণ আমরা বেছে নিয়েছি মৌনতা, সিদ্ধান্তহীনতা আর ভুল উন্নয়ন পরিকল্পনা রাজশাহীর স্কুলটির কথা ভাবলে হৃদয় রক্তাক্ত হয়। চতুর্থবারের মতো একই জায়গায় স্কুল গড়েও আবার তা হারিয়ে যাচ্ছে পদ্মার গহ্বরে। এই শিশুরা কিসের জন্য যুদ্ধ করছে? তাদের জন্য তো এই দেশও নিরাপদ নয়, নদীও নয়, ভবিষ্যৎ তো আরও অনিশ্চিত। কতো পরিবার তাদের সন্তানকে পড়াতে চায়, কিন্তু তারা চায় না প্রতিদিন স্কুলে যেতে যেতে নদীর পাড় ধসে পড়ুক।

নদীভাঙনের ক্ষতগুলো শুধু মাটি নয়, মনেও হয়। এসব মানুষের কণ্ঠে কোনো সংবাদমাধ্যম পুরোপুরি জায়গা দেয় না। মনোয়ারা, সকিনা, রাবেয়ার কথা কি আমরা কখনো সত্যিই শুনেছি? তারা নতুন ঘর তোলে, আবার হারায়, তবুও হাল ছাড়ে না। এই হাল না ছাড়া মানুষগুলোই এই দেশের আসল শক্তি। কিন্তু রাষ্ট্র তাদের জন্য কী করেছে? কখনো যখন গভীর রাতে পদ্মার পার ঘেঁষে বাতাসে কান পাতি, মনে হয় নদীর ঢেউগুলোর ভেতর হাজারো কান্না। যেন নদী নিজেই অনুতপ্তÑ“আমার বুকে বেঁচেছিলো কত সুখ, কত ঘর, আজ আমি শুধু দুঃখের বোঝা বই।” নদীকে দোষ দিয়ে লাভ নেই, যদি আমরা তাকে বোঝার চেষ্টা না করি।তবে এই প্রবন্ধ শুধু দুঃখের তালিকা নয়, এটি একটি জাগরণের ডাক। সময় এসেছে শুধু ভাঙন নয়, গড়ার কথাও ভাবার। সময় এসেছে নদীকে শুধু প্রকৃতির রূপ নয়, মানুষের জীবন হিসেবেও দেখার। নয়তো একদিন শুধু নদীই থাকবে, থাকবে না চর, থাকবে না ঘর, থাকবে না গান।

আমাদের এখন স্থায়ী সমাধানের দিকে যেতে হবে। নদীভাঙন বাংলাদেশের জন্য একটি দীর্ঘমেয়াদি প্রাকৃতিক ও মানবিক সংকট। প্রতি বছর হাজার হাজার মানুষ ঘরবাড়ি, জমি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল ও জীবিকার উৎস হারিয়ে পড়ে যায় দুর্বিষহ বাস্তবতার মুখোমুখি। তবে এ সমস্যার নিরসনে কিছু কার্যকর ও দীর্ঘস্থায়ী সমাধান বাস্তবায়ন করা যেতে পারে, যা শুধু অবকাঠামোগত নয়, বরং পরিবেশগত, সামাজিক এবং রাজনৈতিক অঙ্গীকারের সমন্বয়ে হতে হবে।

প্রথমত, নদীভাঙনপ্রবণ এলাকাগুলোর একটি পূর্ণাঙ্গ মানচিত্র তৈরি করতে হবে, যাতে করে সুনির্দিষ্ট ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা নির্ধারণ করা যায়। এই মানচিত্র ভিত্তিক তথ্য দিয়ে স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ে পরিকল্পনা করা সহজ হবে এবং অপ্রয়োজনীয় অবকাঠামো নির্মাণ এড়িয়ে গঠনমূলক প্রকল্প গ্রহণ করা যাবে।

দ্বিতীয়ত, টেকসই নদীতীর রক্ষা বাঁধ নির্মাণ অত্যন্ত জরুরি। কিন্তু সেই বাঁধ হতে হবে প্রকৌশলগতভাবে সঠিক ও পরিবেশবান্ধব। কেবল ইট, সিমেন্ট বা জিও ব্যাগ ব্যবহার করেই কাজ শেষ নয়, নদীর গতি প্রকৃতি বুঝে বাঁধ নির্মাণের পরিকল্পনা করতে হবে, যাতে তা ভাঙন ঠেকানোর পাশাপাশি নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ বজায় রাখতে পারে।

তৃতীয়ত, নদীভাঙন পূর্বাভাস ও সতর্কতা ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে। প্রযুক্তিনির্ভর পূর্বাভাস ব্যবস্থা থাকলে নদীর গতিপথ, পানি বৃদ্ধি, বাঁধ দুর্বলতা ইত্যাদি আগেই জানা যাবে এবং সময়মতো লোকজনকে সরিয়ে নেয়া, সম্পদ রক্ষা করা সহজ হবে।

চতুর্থত, ভাঙনপীড়িত জনগণের জন্য জরুরি ভিত্তিতে কার্যকর পুনর্বাসন ও ক্ষতিপূরণ প্রদান নিশ্চিত করতে হবে। শুধু আশ্রয়কেন্দ্র তৈরি করলেই হবে না; পরিবারগুলোর কর্মসংস্থান, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা ও সামাজিক নিরাপত্তাও দিতে হবে। পুনর্বাসন যেন প্রকৃতপক্ষে জীবনের পুনর্গঠনের সুযোগ হয়।

পঞ্চমত, নদীর ওপর নির্ভরশীল মানুষদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে ‘কমিউনিটিভিত্তিক নদী ব্যবস্থাপনা’ গড়ে তোলা জরুরি। নদী তীরবর্তী মানুষরাই প্রথম ভাঙনের ইঙ্গিত পান, তারা নদী ও চরকে ভালো বোঝেন। তাদের অভিজ্ঞতা ও অংশগ্রহণ ছাড়া কোনো পরিকল্পনা টেকসই হবে না।

ষষ্ঠত, নদী ড্রেজিং বা খনন সঠিক নিয়মে এবং সুনির্দিষ্ট নীতিমালার ভিত্তিতে করা প্রয়োজন। অনেক সময় অপরিকল্পিতভাবে নদী খনন করে ভিন্ন স্থানে ভাঙন ত্বরান্বিত হয়। তাই নদী খননের আগে প্রয়োজন সঠিক হাইড্রোলজিক্যাল ও পরিবেশগত সমীক্ষা।

সপ্তমত, শিক্ষা, গণমাধ্যম ও স্থানীয় প্রশাসনের মাধ্যমে নদীভাঙনের বিষয়টি নিয়ে জনসচেতনতা বাড়াতে হবে। অনেক সময় ভুল ভূমি ব্যবহার, অবৈধ বাঁধ বা নির্মাণ, পলি সঞ্চয়ন নিয়ন্ত্রণহীনভাবে ঘটে বলেই নদী তার স্বাভাবিক পথ বদলে ফেলে এবং তখনই ভয়াবহ ভাঙন শুরু হয়।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো নদীকে শত্রু নয়, এক জীবনদাত্রী বাস্তবতা হিসেবে দেখতে শিখতে হবে। পরিকল্পনা, প্রযুক্তি, রাষ্ট্রীয় সদিচ্ছা এবং মানুষের অংশগ্রহণের মাধ্যমে নদীভাঙন রোধ করা সম্ভব। এটি কোনো এক দিনে সমাধানযোগ্য নয়, বরং একটি ধারাবাহিক ও আন্তঃমন্ত্রণালয়ভিত্তিক কর্মসূচির দাবি রাখে। দীর্ঘমেয়াদে নদী সংরক্ষণ মানেই ভবিষ্যৎ বাংলাদেশকে রক্ষা করা।

[লেখক : শিক্ষক, মানারাত ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল কলেজ, ঢাকা]

জোটের ভোট নাকি ভোটের জোট, কৌশলটা কী?

প্রমাণ তো করতে হবে আমরা হাসিনার চেয়ে ভালো

ছবি

কৃষি ডেটা ব্যবস্থাপনা

যুক্তরাজ্যে ভর্তি স্থগিতের কুয়াশা: তালা লাগলেও চাবি আমাদের হাতে

শিক্ষকদের কর্মবিরতি: পেশাগত নৈতিকতা ও দায়িত্ববোধ

জাতীয় রক্তগ্রুপ নির্ণয় দিবস

জাল সনদপত্রে শিক্ষকতা

সাধারণ চুক্তিগুলোও গোপনীয় কেন

ছবি

শিশুখাদ্যের নিরাপত্তা: জাতির ভবিষ্যৎ সুরক্ষার প্রথম শর্ত

ছবি

ফিনল্যান্ড কেন সুখী দেশ

ছবি

কৃষকের সংকট ও অর্থনীতির ভবিষ্যৎ

আলু চাষের আধুনিক প্রযুক্তি

ই-বর্জ্য: নীরব বিষে দগ্ধ আমাদের ভবিষ্যৎ

ঢাকার জনপরিসর: আর্ভিং গফম্যানের সমাজতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ

আলু চাষের আধুনিক প্রযুক্তি

কলি ফুটিতে চাহে ফোটে না!

কৃষিতে স্মার্ট প্রযুক্তি

রোহিঙ্গা সংকটের টেকসই সমাধানে লোকালাইজেশন অপরিহার্য

আইসিইউ থেকে বাড়ি ফেরা ও খাদের কিনারায় থাকা দেশ

বিচারবহির্ভূত হত্যার দায় কার?

ছবি

ট্রাম্পের ভেনেজুয়েলা কৌশল

অযৌক্তিক দাবি: পেশাগত নৈতিকতার সংকট ও জনপ্রশাসন

সড়ক দুর্ঘটনা এখন জাতীয় সংকট

কেন বাড়ছে দারিদ্র্য?

তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার পুনর্জন্ম

লবণাক্ততায় ডুবছে উপকূল

বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলন ও বাস্তবতা

সড়ক দুর্ঘটনার সমাজতত্ত্ব: আইন প্রয়োগের ব্যর্থতা ও কাঠামোর চক্রাকার পুনরুৎপাদন

ছবি

অস্থির সময় ও অস্থির সমাজের পাঁচালি

ভারতে বামপন্থার পুনর্জাগরণ: ব্যাধি ও প্রতিকার

চিপনির্ভরতা কাটিয়ে চীনের উত্থান

একতার বাতাসে উড়ুক দক্ষিণ এশিয়ার পতাকা

ছবি

স্মরণ: শহীদ ডা. মিলন ও বৈষম্যহীন ব্যবস্থার সংগ্রাম

মনে পুরানো দিনের কথা আসে, মনে আসে, ফিরে আসে...

রাসায়নিক দূষণ ও ক্যান্সারের ঝুঁকি

আছদগঞ্জের শুটকি : অতীতের গৌরব, বর্তমানের দুঃসময়

tab

মতামত » উপ-সম্পাদকীয়

ভাঙছে নদী, গড়ছে দুঃখের গ্রাম

জাহিদুল ইসলাম

বৃহস্পতিবার, ০৭ আগস্ট ২০২৫

বাংলা সাহিত্যের একটি কালজয়ী উপন্যাস ‘পদ্মা নদীর মাঝি’। সেখানে একটি সংলাপ ছিল- “নদী আবার কী? নদী ভালোবাসে, আবার কখনো কখনো ছিন্নভিন্ন করে দেয়!” এই সংলাপে নদীর চিরায়িত দ্বৈত চরিত্র ফুটে উঠেছিল। অদ্বৈত মল্লবর্মণ রচিত কালজয়ী আরেকটি উপন্যাস ‘তিতাস একটি নদীর নাম’। উপন্যাসটি অবলম্বনে ১৯৭৩ সালে পরিচালক ঋত্বিক ঘটক নির্মিত চলচ্চিত্রেও ফুটে উঠেছে নদীভিত্তিক জীবন ও নদীভাঙনের এক মর্মস্পর্শী দলিল। এই উপন্যাসে তিতাস নদী শুধুই একটি নদী নয় এটি হয়ে উঠেছিল সমাজ, সংস্কৃতি, জীবন, মৃত্যু, আশা ও ধ্বংসের এক প্রতীক। বিশেষ করে মালো সম্প্রদায় যারা মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করে তাদের চোখ দিয়ে আমরা দেখতে পাই নদী কীভাবে একদিকে জীবন দেয়, অন্যদিকে আবার নিঃশেষ করে দেয় সবকিছু। উপন্যাসে একটি সংলাপে বলা হয়েছে- “এই নদী আমাদের কেঁদে কেঁদে ডাকে, আবার আমাদের নিঃস্বও করে দেয়।” চলচ্চিত্রে সুবলার বিয়ের সময় নদীতে ডাকাত পড়ে, নৌকা ভেসে যায়, স্বামী হারায় নতুন বউ। পরে সে সমাজচ্যুত হয় সুবলা। এখানে নদীভাঙন শুধু ভৌগোলিক নয়, সামাজিকও। সুবলার মর্মান্তিক অভিব্যক্তি “তিতাস আমার স্বামীকে নেয় নাই, আমার সব লইছে।”

বাংলা সাহিত্যের মতোই প্রতি বছর বর্ষা আসার সঙ্গে বাংলাদেশের নদীগুলো আবারো প্রাণ ফিরিয়ে আনে, কিন্তু এই প্রাণের সঙ্গে নিয়ে আসে ভাঙনের বিভীষিকা। এই বঙ্গীয় ব-দ্বীপ; আমাদের নদীমাতৃক দেশ এই ভাঙ্গা গড়ার মাধ্যমেই গড়ে উঠেছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এই নদী ভাঙনের প্রকোপ বেড়েছে মারাত্মকভাবে। নদীর তীরে বসবাসরত পরিবারের স্বপ্নগুলো হামাগুড়ি খায়, স্কুল, হাসপাতাল, ফসলÑসবকিছু ধ্বংস হয়ে যায়। নদী ভাঙনের ধাক্কায় সব হারিয়ে ফেলে হাজারো মানুষ, তাদের ধ্বংসাবশেষের গ্রাম গড়ে উঠছে, দুঃখের গ্রাম।

প্রশ্ন থেকে যায় এই দেশ কি নদীভাঙনের কোনো স্থায়ী সমাধান খুঁজে পায়নি? প্রতি বছর একই দৃশ্য, একই আর্তনাদ, শুধু চরিত্র বদলায়। পরিবার হারায় মা, সন্তান হারায় পিতা, একটি গ্রামের স্বপ্ন কবর হয়ে যায় পানির তলায়। এসব মানুষদের যন্ত্রণা কোনো পরিসংখ্যান জানে না। তাদের আর্তনাদ ছুঁয়ে না উচ্চকক্ষের এয়ারকন্ডিশনে বসা সিদ্ধান্তপ্রস্তুতকারীদের মন। হয়তো তাদের চোখে এসব গরিব চরবাসীর জীবন এমনিতেই দুর্বল ভাঙলেও কিছু যায় আসে না!

একবার কি ভেবে দেখেছি, যে শিশুটির স্কুল আজ নদী গিলে খেয়েছে, সে আর কোনোদিন বিদ্যালয়ের চৌকাঠ মাড়াতে পারবে কিনা? কিংবা যে মা সন্তানকে নিয়ে নতুন ঘর তুলেছিল, আজ নদীর গ্রাসে পড়ে সে কোথায় দাঁড়িয়ে কাঁদছে? এসব প্রশ্ন আমাদের নাড়া দেয় না, কারণ আমরা ভাবি, নদী তো সবসময়ই ভাঙে! কিন্তু একটি ঘর ভাঙা মানে কেবল চারটে বাঁশ আর টিনের চালের পতন নয়; ভেঙে পড়ে আশ্রয়, স্বপ্ন, ভবিষ্যতের পথ।এই ভূখ-ের নদীগুলো একসময় ছিল গর্বের, জীবনের চালিকা শক্তি। অথচ এখন তারাই হয়ে উঠেছে নিঃস্বতার প্রতীক। পদ্মা, যমুনা, মেঘনা, তিতাস নাম শুনলেই মমতার ঢেউ বয়ে যেতো, এখন কেবল ভয় হয়। নদী যদি মায়ের মতো হয়, তবে কী করে মা তার সন্তানের মাথা কেটে নেয়? এই প্রশ্ন চিরন্তন হয়ে থেকে যায় ভাঙনের কষ্টে জর্জরিত মানুষদের মনে।

আমরা যে উন্নয়নের গল্প শুনি প্রতিদিন, সেই গল্পের এক প্রান্তে এসব ভাঙা ঘর, ভাঙা স্কুল, ভাঙা হাসপাতালগুলো কখনোই স্থান পায় না। সরকারি কাগজে তারা “অন্তর্বর্তী সমস্যা” তবে বাস্তবের মাটিতে তারা চিরস্থায়ী বেদনার উৎস। নদী যেমন ভাঙে, তেমন গড়ার দায় তো মানুষের। কিন্তু সেখানেই ব্যর্থ আমরা। প্রতিবার গৃহহীন মানুষেরা ‘পুনর্বাসনের প্রতিশ্রুতি’ শুনতে শুনতে জীবনের বাকি পথটাই কেটে দেয় খোলা আকাশের নিচে। বাবুগঞ্জের সেই স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, যেটা নদী গিলে নিয়েছে, তার জন্য কেউ দায় নেন না। ৭০ হাজার মানুষের চিকিৎসাসেবা থমকে যায় এই সংবাদ যেন পাঁচ লাইনের বেশি হতে পারে না কোনো রিপোর্টে! অথচ সেখানে একজন প্রসূতির সন্তান জন্ম নিতে না পারার পেছনে নদী ভাঙন নয়, দায়ী আমরা। কারণ আমরা বেছে নিয়েছি মৌনতা, সিদ্ধান্তহীনতা আর ভুল উন্নয়ন পরিকল্পনা রাজশাহীর স্কুলটির কথা ভাবলে হৃদয় রক্তাক্ত হয়। চতুর্থবারের মতো একই জায়গায় স্কুল গড়েও আবার তা হারিয়ে যাচ্ছে পদ্মার গহ্বরে। এই শিশুরা কিসের জন্য যুদ্ধ করছে? তাদের জন্য তো এই দেশও নিরাপদ নয়, নদীও নয়, ভবিষ্যৎ তো আরও অনিশ্চিত। কতো পরিবার তাদের সন্তানকে পড়াতে চায়, কিন্তু তারা চায় না প্রতিদিন স্কুলে যেতে যেতে নদীর পাড় ধসে পড়ুক।

নদীভাঙনের ক্ষতগুলো শুধু মাটি নয়, মনেও হয়। এসব মানুষের কণ্ঠে কোনো সংবাদমাধ্যম পুরোপুরি জায়গা দেয় না। মনোয়ারা, সকিনা, রাবেয়ার কথা কি আমরা কখনো সত্যিই শুনেছি? তারা নতুন ঘর তোলে, আবার হারায়, তবুও হাল ছাড়ে না। এই হাল না ছাড়া মানুষগুলোই এই দেশের আসল শক্তি। কিন্তু রাষ্ট্র তাদের জন্য কী করেছে? কখনো যখন গভীর রাতে পদ্মার পার ঘেঁষে বাতাসে কান পাতি, মনে হয় নদীর ঢেউগুলোর ভেতর হাজারো কান্না। যেন নদী নিজেই অনুতপ্তÑ“আমার বুকে বেঁচেছিলো কত সুখ, কত ঘর, আজ আমি শুধু দুঃখের বোঝা বই।” নদীকে দোষ দিয়ে লাভ নেই, যদি আমরা তাকে বোঝার চেষ্টা না করি।তবে এই প্রবন্ধ শুধু দুঃখের তালিকা নয়, এটি একটি জাগরণের ডাক। সময় এসেছে শুধু ভাঙন নয়, গড়ার কথাও ভাবার। সময় এসেছে নদীকে শুধু প্রকৃতির রূপ নয়, মানুষের জীবন হিসেবেও দেখার। নয়তো একদিন শুধু নদীই থাকবে, থাকবে না চর, থাকবে না ঘর, থাকবে না গান।

আমাদের এখন স্থায়ী সমাধানের দিকে যেতে হবে। নদীভাঙন বাংলাদেশের জন্য একটি দীর্ঘমেয়াদি প্রাকৃতিক ও মানবিক সংকট। প্রতি বছর হাজার হাজার মানুষ ঘরবাড়ি, জমি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল ও জীবিকার উৎস হারিয়ে পড়ে যায় দুর্বিষহ বাস্তবতার মুখোমুখি। তবে এ সমস্যার নিরসনে কিছু কার্যকর ও দীর্ঘস্থায়ী সমাধান বাস্তবায়ন করা যেতে পারে, যা শুধু অবকাঠামোগত নয়, বরং পরিবেশগত, সামাজিক এবং রাজনৈতিক অঙ্গীকারের সমন্বয়ে হতে হবে।

প্রথমত, নদীভাঙনপ্রবণ এলাকাগুলোর একটি পূর্ণাঙ্গ মানচিত্র তৈরি করতে হবে, যাতে করে সুনির্দিষ্ট ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা নির্ধারণ করা যায়। এই মানচিত্র ভিত্তিক তথ্য দিয়ে স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ে পরিকল্পনা করা সহজ হবে এবং অপ্রয়োজনীয় অবকাঠামো নির্মাণ এড়িয়ে গঠনমূলক প্রকল্প গ্রহণ করা যাবে।

দ্বিতীয়ত, টেকসই নদীতীর রক্ষা বাঁধ নির্মাণ অত্যন্ত জরুরি। কিন্তু সেই বাঁধ হতে হবে প্রকৌশলগতভাবে সঠিক ও পরিবেশবান্ধব। কেবল ইট, সিমেন্ট বা জিও ব্যাগ ব্যবহার করেই কাজ শেষ নয়, নদীর গতি প্রকৃতি বুঝে বাঁধ নির্মাণের পরিকল্পনা করতে হবে, যাতে তা ভাঙন ঠেকানোর পাশাপাশি নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ বজায় রাখতে পারে।

তৃতীয়ত, নদীভাঙন পূর্বাভাস ও সতর্কতা ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে। প্রযুক্তিনির্ভর পূর্বাভাস ব্যবস্থা থাকলে নদীর গতিপথ, পানি বৃদ্ধি, বাঁধ দুর্বলতা ইত্যাদি আগেই জানা যাবে এবং সময়মতো লোকজনকে সরিয়ে নেয়া, সম্পদ রক্ষা করা সহজ হবে।

চতুর্থত, ভাঙনপীড়িত জনগণের জন্য জরুরি ভিত্তিতে কার্যকর পুনর্বাসন ও ক্ষতিপূরণ প্রদান নিশ্চিত করতে হবে। শুধু আশ্রয়কেন্দ্র তৈরি করলেই হবে না; পরিবারগুলোর কর্মসংস্থান, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা ও সামাজিক নিরাপত্তাও দিতে হবে। পুনর্বাসন যেন প্রকৃতপক্ষে জীবনের পুনর্গঠনের সুযোগ হয়।

পঞ্চমত, নদীর ওপর নির্ভরশীল মানুষদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে ‘কমিউনিটিভিত্তিক নদী ব্যবস্থাপনা’ গড়ে তোলা জরুরি। নদী তীরবর্তী মানুষরাই প্রথম ভাঙনের ইঙ্গিত পান, তারা নদী ও চরকে ভালো বোঝেন। তাদের অভিজ্ঞতা ও অংশগ্রহণ ছাড়া কোনো পরিকল্পনা টেকসই হবে না।

ষষ্ঠত, নদী ড্রেজিং বা খনন সঠিক নিয়মে এবং সুনির্দিষ্ট নীতিমালার ভিত্তিতে করা প্রয়োজন। অনেক সময় অপরিকল্পিতভাবে নদী খনন করে ভিন্ন স্থানে ভাঙন ত্বরান্বিত হয়। তাই নদী খননের আগে প্রয়োজন সঠিক হাইড্রোলজিক্যাল ও পরিবেশগত সমীক্ষা।

সপ্তমত, শিক্ষা, গণমাধ্যম ও স্থানীয় প্রশাসনের মাধ্যমে নদীভাঙনের বিষয়টি নিয়ে জনসচেতনতা বাড়াতে হবে। অনেক সময় ভুল ভূমি ব্যবহার, অবৈধ বাঁধ বা নির্মাণ, পলি সঞ্চয়ন নিয়ন্ত্রণহীনভাবে ঘটে বলেই নদী তার স্বাভাবিক পথ বদলে ফেলে এবং তখনই ভয়াবহ ভাঙন শুরু হয়।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো নদীকে শত্রু নয়, এক জীবনদাত্রী বাস্তবতা হিসেবে দেখতে শিখতে হবে। পরিকল্পনা, প্রযুক্তি, রাষ্ট্রীয় সদিচ্ছা এবং মানুষের অংশগ্রহণের মাধ্যমে নদীভাঙন রোধ করা সম্ভব। এটি কোনো এক দিনে সমাধানযোগ্য নয়, বরং একটি ধারাবাহিক ও আন্তঃমন্ত্রণালয়ভিত্তিক কর্মসূচির দাবি রাখে। দীর্ঘমেয়াদে নদী সংরক্ষণ মানেই ভবিষ্যৎ বাংলাদেশকে রক্ষা করা।

[লেখক : শিক্ষক, মানারাত ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল কলেজ, ঢাকা]

back to top