alt

উপ-সম্পাদকীয়

নেতানিয়াহুর এক ভ্রান্ত কৌশলের মুখোমুখি ইসরায়েল

এম এ হোসাইন

: বৃহস্পতিবার, ০৭ আগস্ট ২০২৫

আগস্ট ২০২৫-এর শুরুর দিকে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু গাজা সংকটকে নতুন এক ভয়াবহ উচ্চতায় নিয়ে গেছেন। তাহলো তিনি গাজা উপত্যকার সম্পূর্ণ সামরিক দখলের পরিকল্পনা সাজিয়েছেন। এই পদক্ষেপকে তিনি ব্যাখ্যা করেছেন হামাসকে নিশ্চিহ্ন করা, জিম্মিদের উদ্ধারে সহায়তা করা এবং ইসরায়েলি নিরাপত্তা নিশ্চিত করার প্রয়াস হিসেবে। কিন্তু বাস্তবে এটি শুধু সহিংসতার মাত্রাকেই বাড়াবে না, বরং তার রাজনৈতিক কল্পনাশক্তির দেউলিয়াত্বও প্রকাশ করেছে।

নেতানিয়াহুর পরিকল্পনা কেবল সামরিক নয়, এটি এক রাজনৈতিক বার্তা। এবং ইতিহাস আমাদের বলে, শক্তির মাধ্যমে দেওয়া এই ধরনের বার্তা সংশ্লিষ্ট অঞ্চলকে আরও অস্থিতিশীল করে তোলে, শান্তিপূর্ণ নয়। ভবিষ্যতে এই দখল কার্যক্রমকে সমাধান নয়, বরং একটি নৈতিক ও কৌশলগত বিপর্যয়ের সূচক হিসেবেই দেখা হবে।

ইসরায়েল ইতোমধ্যেই গাজার প্রায় ৭৫ শতাংশ অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ করছে। এখন লক্ষ্য, বাকি অংশও দখল করা, যার মধ্যে রয়েছে শরণার্থী শিবির ও ঘনবসতিপূর্ণ বেসামরিক এলাকা। হামাসকে পরাজিত করা ও অবশিষ্ট জিম্মিদের মুক্ত করাই যদিও ঘোষিত লক্ষ্য, কিন্তু বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া যেন মরিয়া এক চেষ্টার প্রতিচ্ছবি। সেনাপ্রধানকে বরখাস্তের হুমকি দিয়ে নেতানিয়াহু যেন শুধু হামাসের বিপক্ষে নয়, বরং নিজের প্রতিরক্ষা কাঠামোর কৌশলগত উদ্বেগকেও প্রত্যাখ্যান করছেন।

গাজার ওপর ইসরায়েলের পূর্বের অভিযানের (যেমন ২০০৮ সালের ‘অপারেশন কাস্ট লেড’ থেকে শুরু করে ২০১৪ সালের ‘অপারেশন প্রোটেকটিভ এজ’) একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা হলো: গাজা নিয়ন্ত্রণ মানেই শান্তি নয়। সমস্যা ভৌগোলিক নয়, বরং নৈতিক বৈধতা ও জনগণের মতামতকে ঘিরে।

অক্টোবর ২০২৩-এ হামাসের হাতে অপহৃত বেসামরিক জিম্মিদের ট্র্যাজেডি অবশ্যই গুরুত্ব পায়। কিন্তু আলোচনার পথ ছেড়ে সামরিক অভিযান চালানো, বিশেষত তাদের উদ্ধারের নামে, এক ধরনের আত্মবিরোধিতা। গোয়েন্দা তথ্য বলছে, ৫০ নিখোঁজ জিম্মির মধ্যে মাত্র ২০ জনের বেঁচে থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। এখন পূর্ণাঙ্গ হামলা চালিয়ে তাদেরই মৃত্যুর ঝুঁকি বাড়ানো হবে এক নৈতিক বিভ্রান্তি।

এরচেয়েও বিপজ্জনক হলো, এই সামরিক মোড় কূটনৈতিক প্রচেষ্টাকে ধ্বংস করবে। শুধু হামাসের সঙ্গে নয়, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গেও ইসরায়েলের সম্পর্ক আজ ভঙ্গুর। যুক্তরাষ্ট্র-সমর্থিত যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব নেতানিয়াহুর গোয়ার্তমির কারণে ভেঙে পড়েছে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের মৌন অনুমোদনও ইঙ্গিত দেয় যে, ওয়াশিংটন প্রকাশ্যে রাজনৈতিক সমাধান চাইলেও, গোপনে রক্তপাতের অনুমোদন দিচ্ছে।

আজকের গাজার কথা মানেই হলো এক মানবিক বিপর্যয়ের প্রতিচ্ছবি। বেসামরিক হতাহত সংখ্যা বেড়েছে, দুর্ভিক্ষ ছড়িয়ে পড়েছে, পানি, বিদ্যুৎ ও চিকিৎসাসেবার মতো মৌলিক সেবাগুলো ভেঙে পড়েছে। জাতিসংঘ ও মানবাধিকার সংগঠনগুলো সতর্ক করেছেÑইসরায়েলের কৌশল যৌথ শাস্তির সীমা লঙ্ঘনের আশঙ্কা তৈরি করছে।

আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনে, কোনো দখলদার রাষ্ট্রের দায়িত্ব নাগরিকদের রক্ষা করা। কিন্তু গাজার অবরোধ, বোমাবর্ষণ ও পূর্ণ দখল যেন সুরক্ষা তো নয়ই, বরং আধিপত্যবাদ কিংবা সাম্রাজ্যবাদেরই প্রতিচ্ছবি। আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী অবরোধকেও যুদ্ধাপরাধ হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে, বিশেষত যখন শিশুরা অপুষ্টিতে মারা যাচ্ছে, হাসপাতালগুলোকে ভেঙে ফেলা হচ্ছে।

আন্তর্জাতিক বৈচারিক আদালত ইতোমধ্যেই ইসরায়েলকে গণহত্যা-সদৃশ কর্মকা- থেকে বিরত থাকতে বলেছে। নেতানিয়াহুর তাতে কর্ণপাত করার কোন ইচ্ছেই দেখা যায়নি। তবে নিশ্চিতভাবে বলা যায়, তার সরকার ফিলিস্তিনিদের দুর্দশার প্রতি চরম উদাসীন।

ইসরায়েলের কিছু রাজনৈতিক নেতা গাজার কিছু অংশ দখল করে রাখা কিংবা স্থায়ী সামরিক শাসনের প্রস্তাব দিয়েছেন। এটি কোনো নিরাপত্তানীতির অংশ নয়। এটি হলো উপনিবেশবাদ এবং তা প্রতিরক্ষার ছদ্মবেশে। একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র কীভাবে নাগরিক অধিকার, রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্ব ছাড়াই দীর্ঘমেয়াদে বেসামরিক জনগণের ওপর সামরিক শাসন চাপিয়ে দিতে পারে? এটি এক নৈতিক বিপর্যয় ও কৌশলগত আত্মহত্যা সামিল।

এমন নীতিতে দুই-রাষ্ট্র সমাধানের প্রতিশ্রুতিও প্রশ্নবিদ্ধ হয়, যা দীর্ঘদিন ধরেই কেবল কথার ফুলঝুরি ছাড়া কিছুই হয়নি। যুদ্ধ-পরবর্তী গাজার শাসনব্যবস্থা নিয়ে কোনো বাস্তব পরিকল্পনা এখনো দেয়া হয়নি। এই নীরবতা এক অন্ধকার ভবিষ্যতের ইঙ্গিত, যা স্থায়ী দখলদারিত্বের সেই বিভ্রম, যেখানে মনে করা হচ্ছে গাজার মানুষ হঠাৎ উধাও হয়ে যাবে।

আঞ্চলিক প্রতিক্রিয়াও নেতিবাচক। মিসর, ঐতিহাসিকভাবে এক স্থিতিশীল প্রতিবেশী, গাজা থেকে শরণার্থী গ্রহণে সম্পূর্ণ অনিচ্ছা জানিয়েছে। তাদের মতে ইসরায়েলের এ ধরনের প্রচেষ্টা জাতিগত নির্মূলের সামিল। জর্ডান আশঙ্কা করছে, ইসরায়েল পশ্চিম তীর থেকেও ফিলিস্তিনিদের উৎখাত করতে পারে, যা জর্ডানের স্থিতিশীলতাকে হুমকির মুখে ফেলবে।

সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাত, যারা একসময় আব্রাহাম চুক্তির আওতায় ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে আগ্রহী ছিল, এখন স্পষ্ট বলেছেÑফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠনে বাস্তব অগ্রগতি ছাড়া স্বাভাবিকীকরণ অসম্ভব। যুদ্ধ সেই সম্ভাবনাকে নৎসাত করে দিয়েছে এবং সঙ্গত কারণেই।

আন্তর্জাতিক আইন, যদিও অনেক সময় রাষ্ট্রীয় স্বার্থের মুখে উপেক্ষিত হয়, তবুও এটি বর্বরতার বিরুদ্ধে শেষ কিছু প্রতিরোধের একটি। দখলদার রাষ্ট্র হিসেবে ইসরায়েল জেনেভা কনভেনশন অনুসরনে বাধ্য। অনাহারকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার, বেসামরিক অবকাঠামোতে বোমাবর্ষণ, জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুতি; এসবই যুদ্ধাপরাধ হিসেবে বিবেচিত।

সমালোচনা সহজ, কিন্তু বিকল্প কল্পনা করা কঠিন। তবুও, সমাধান সম্ভব। তা শুরু হতে পারে অবিলম্বে যুদ্ধবিরতির মধ্য দিয়ে, এবং কূটনীতির পুনঃতৎপরতার মাধ্যমে। শুধু জিম্মি উদ্ধার নয়, স্থায়ী রাজনৈতিক সমঝোতার জন্য সংলাপ জরুরি। এর সঙ্গে দরকার আন্তর্জাতিক তত্ত্বাবধানে একটি মানবিক করিডোর এবং জাতিসংঘের অধীনে একটি অন্তর্বর্তী শাসনব্যবস্থার মাধ্যমে ফিলিস্তিনি স্বশাসনের পথে অগ্রসর হওয়া।

তবে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন নেতৃত্ব যা ইসরায়েল ও ফিলিস্তিন উভয়ের পক্ষেই প্রয়োজন। যারা সাম্প্রদায়িক স্বার্থ নয়, বরং ন্যায়বিচার ও সহাবস্থানের রাজনীতি বেছে নেবে। নেতানিয়াহু সেই নেতা নন, কারণ তিনি রাজনীতিকে এখন ব্যক্তি স্বার্থ ও চিরস্থায়ী সংঘাতের প্রতিচ্ছবিতে পরিণত করেছেন।

নেতানিয়াহুর এই গাজার পূর্ণ দখল পরিকল্পনা হয়তো ইসরায়েলের একটি গোষ্ঠীর বাহবা কুড়াতে পারে, কিন্তু এটি হবে এক শোষণের জয়, যা নৈতিক অবস্থানকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়। তাছাড়া কূটনৈতিকভাবে ইসরায়েলকে একঘরে করে ফেলবে এবং অন্তহীন এক প্রতিরোধের বীজ বপন করবে। ভয়াবহ ব্যাপার হলো, ফিলিস্তিনিরা দিনদিন বিশ্বাস হারাচ্ছে যে শান্তি সম্ভব, আর সেই শূন্যতায় জন্ম নিচ্ছে সহিংস প্রতিরোধের সংস্কৃতি। এই বিশ্বাস বিষাক্ত। কিন্তু নেতানিয়াহু নিজেই সেই বিষ প্রস্তুত করছেন।

ফিলিস্তিনিদের ভোগান্তি কোনো দূর্ঘটনা নয়। এটি একটি ব্যর্থ কৌশলগত দৃষ্টিভঙ্গির পরিণতি। অগ্রগতির পথ শরণার্থী শিবিরে আরও ট্যাংক চালানোর মধ্যে নয়, বরং মর্যাদা, অধিকার ও সহাবস্থানের ভিত্তিতে একটি রাজনৈতিক রোডম্যাপ পুনরুজ্জীবনের মধ্যেই নিহিত। গাজার ট্র্যাজেডি যুদ্ধ দিয়ে সমাধান হবে নাÑএর সমাধান হবে এই যুদ্ধ বন্ধ করার সাহস দেখানোর মাধ্যমে।

[লেখক : প্রাবন্ধিক]

আসিয়ানে বাংলাদেশের অভিযাত্রা : সম্ভাবনার পথে কূটনৈতিক বাস্তবতা ও রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ

ভাঙছে নদী, গড়ছে দুঃখের গ্রাম

ছবি

গণঅভ্যুত্থান ও গণআকাক্সক্ষা : এক বছরে অর্জনটা কী?

ছবি

ভিন্নমত, ভিন্নপথ এবং প্রান্তজনের স্বপ্ন

আচরণগত অর্থনীতির আয়নায় বাংলাদেশিদের বিদেশযাত্রা

গরিবের ইলিশ শুধুই স্বপ্ন কেন?

চব্বিশের গণঅভ্যুত্থান : বৈষম্য ও স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে জাগরণ

শারীরিক শিক্ষা : সুস্থ ও সচেতন প্রজন্ম গড়ার সম্ভাবনা

জ্ঞানতীর্থের সংকট ও গবেষণাবিমুখ উচ্চশিক্ষা

ছবি

জুলাই অভ্যুত্থান-গাথা : মেঘ থম থম করে

অলৌকিকতা, লৌকিকতা ও বিশ্বাসের বিভ্রান্তি

বিচারপতি গ্রেফতার, শুনানিতে পুলিশের অসহযোগিতা ও কিছু আইনি জিজ্ঞাসা

অপেক্ষার রাজনীতি ও সময়গত বৈষম্য : ঢাকা শহরের প্রেক্ষাপট

বৃক্ষরোপণ হোক পরিবেশ রক্ষার আন্দোলন

আফ্রিকায় রাশিয়ার ভূরাজনৈতিক কৌশল

বিভীষিকাময় দুর্ঘটনা ও করুণ মৃত্যু

কেন এত তরুণ দেশ ছাড়তে চাচ্ছে

রেলওয়ে পরিচালনায় আমলাতন্ত্রের প্রভাব

রম্যগদ্য : ‘গোপালগঞ্জ, বাংলার গোপালগঞ্জ...’

দেশি মাছ রক্ষায় অভয়াশ্রম

আলুর বাজার বিপর্যয় : কৃষকের ভাগ্যে লোকসান

ছবি

নীল নদের পানি নীল নয়

বিশ্ব বাঘ দিবস

ঢাকার কি রিস্ক এনালাইসিস করা আছে?

ছবি

সোনার হরফে লেখা অনন্য শিক্ষকের নাম

পরীক্ষার পর পরীক্ষা, কিন্তু কোথায় মূল্যায়ন ও মূল্যবোধের ভিত্তি?

বৃত্তি পরীক্ষায় কিন্ডারগার্টেন বাদ কেন?

সময়ের স্বৈরতন্ত্র : প্রতীক্ষা, ক্ষমতা ও জীবনের অসমতা

জলবায়ু পরিবর্তন মডেলে গণিতের ব্যবহার

দুর্ঘটনাজনিত দুর্যোগ-পরবর্তী করণীয় কী?

ডেঙ্গু, জিকা আর চিকুনগুনিয়া : একই উৎস, ত্রিমুখী সংকট

কেন থাইল্যান্ড-কম্বোডিয়ার ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি?

দুর্নীতি নির্মূল করা কি সম্ভব?

দরকার মানসম্মত শিক্ষা

ইসরায়েলের যুদ্ধনীতি ও বিশ্ব নিরাপত্তার সংকট

রম্যগদ্য : ‘বেইমান রাইট ব্রাদার্স’

tab

উপ-সম্পাদকীয়

নেতানিয়াহুর এক ভ্রান্ত কৌশলের মুখোমুখি ইসরায়েল

এম এ হোসাইন

বৃহস্পতিবার, ০৭ আগস্ট ২০২৫

আগস্ট ২০২৫-এর শুরুর দিকে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু গাজা সংকটকে নতুন এক ভয়াবহ উচ্চতায় নিয়ে গেছেন। তাহলো তিনি গাজা উপত্যকার সম্পূর্ণ সামরিক দখলের পরিকল্পনা সাজিয়েছেন। এই পদক্ষেপকে তিনি ব্যাখ্যা করেছেন হামাসকে নিশ্চিহ্ন করা, জিম্মিদের উদ্ধারে সহায়তা করা এবং ইসরায়েলি নিরাপত্তা নিশ্চিত করার প্রয়াস হিসেবে। কিন্তু বাস্তবে এটি শুধু সহিংসতার মাত্রাকেই বাড়াবে না, বরং তার রাজনৈতিক কল্পনাশক্তির দেউলিয়াত্বও প্রকাশ করেছে।

নেতানিয়াহুর পরিকল্পনা কেবল সামরিক নয়, এটি এক রাজনৈতিক বার্তা। এবং ইতিহাস আমাদের বলে, শক্তির মাধ্যমে দেওয়া এই ধরনের বার্তা সংশ্লিষ্ট অঞ্চলকে আরও অস্থিতিশীল করে তোলে, শান্তিপূর্ণ নয়। ভবিষ্যতে এই দখল কার্যক্রমকে সমাধান নয়, বরং একটি নৈতিক ও কৌশলগত বিপর্যয়ের সূচক হিসেবেই দেখা হবে।

ইসরায়েল ইতোমধ্যেই গাজার প্রায় ৭৫ শতাংশ অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ করছে। এখন লক্ষ্য, বাকি অংশও দখল করা, যার মধ্যে রয়েছে শরণার্থী শিবির ও ঘনবসতিপূর্ণ বেসামরিক এলাকা। হামাসকে পরাজিত করা ও অবশিষ্ট জিম্মিদের মুক্ত করাই যদিও ঘোষিত লক্ষ্য, কিন্তু বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া যেন মরিয়া এক চেষ্টার প্রতিচ্ছবি। সেনাপ্রধানকে বরখাস্তের হুমকি দিয়ে নেতানিয়াহু যেন শুধু হামাসের বিপক্ষে নয়, বরং নিজের প্রতিরক্ষা কাঠামোর কৌশলগত উদ্বেগকেও প্রত্যাখ্যান করছেন।

গাজার ওপর ইসরায়েলের পূর্বের অভিযানের (যেমন ২০০৮ সালের ‘অপারেশন কাস্ট লেড’ থেকে শুরু করে ২০১৪ সালের ‘অপারেশন প্রোটেকটিভ এজ’) একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা হলো: গাজা নিয়ন্ত্রণ মানেই শান্তি নয়। সমস্যা ভৌগোলিক নয়, বরং নৈতিক বৈধতা ও জনগণের মতামতকে ঘিরে।

অক্টোবর ২০২৩-এ হামাসের হাতে অপহৃত বেসামরিক জিম্মিদের ট্র্যাজেডি অবশ্যই গুরুত্ব পায়। কিন্তু আলোচনার পথ ছেড়ে সামরিক অভিযান চালানো, বিশেষত তাদের উদ্ধারের নামে, এক ধরনের আত্মবিরোধিতা। গোয়েন্দা তথ্য বলছে, ৫০ নিখোঁজ জিম্মির মধ্যে মাত্র ২০ জনের বেঁচে থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। এখন পূর্ণাঙ্গ হামলা চালিয়ে তাদেরই মৃত্যুর ঝুঁকি বাড়ানো হবে এক নৈতিক বিভ্রান্তি।

এরচেয়েও বিপজ্জনক হলো, এই সামরিক মোড় কূটনৈতিক প্রচেষ্টাকে ধ্বংস করবে। শুধু হামাসের সঙ্গে নয়, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গেও ইসরায়েলের সম্পর্ক আজ ভঙ্গুর। যুক্তরাষ্ট্র-সমর্থিত যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব নেতানিয়াহুর গোয়ার্তমির কারণে ভেঙে পড়েছে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের মৌন অনুমোদনও ইঙ্গিত দেয় যে, ওয়াশিংটন প্রকাশ্যে রাজনৈতিক সমাধান চাইলেও, গোপনে রক্তপাতের অনুমোদন দিচ্ছে।

আজকের গাজার কথা মানেই হলো এক মানবিক বিপর্যয়ের প্রতিচ্ছবি। বেসামরিক হতাহত সংখ্যা বেড়েছে, দুর্ভিক্ষ ছড়িয়ে পড়েছে, পানি, বিদ্যুৎ ও চিকিৎসাসেবার মতো মৌলিক সেবাগুলো ভেঙে পড়েছে। জাতিসংঘ ও মানবাধিকার সংগঠনগুলো সতর্ক করেছেÑইসরায়েলের কৌশল যৌথ শাস্তির সীমা লঙ্ঘনের আশঙ্কা তৈরি করছে।

আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনে, কোনো দখলদার রাষ্ট্রের দায়িত্ব নাগরিকদের রক্ষা করা। কিন্তু গাজার অবরোধ, বোমাবর্ষণ ও পূর্ণ দখল যেন সুরক্ষা তো নয়ই, বরং আধিপত্যবাদ কিংবা সাম্রাজ্যবাদেরই প্রতিচ্ছবি। আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী অবরোধকেও যুদ্ধাপরাধ হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে, বিশেষত যখন শিশুরা অপুষ্টিতে মারা যাচ্ছে, হাসপাতালগুলোকে ভেঙে ফেলা হচ্ছে।

আন্তর্জাতিক বৈচারিক আদালত ইতোমধ্যেই ইসরায়েলকে গণহত্যা-সদৃশ কর্মকা- থেকে বিরত থাকতে বলেছে। নেতানিয়াহুর তাতে কর্ণপাত করার কোন ইচ্ছেই দেখা যায়নি। তবে নিশ্চিতভাবে বলা যায়, তার সরকার ফিলিস্তিনিদের দুর্দশার প্রতি চরম উদাসীন।

ইসরায়েলের কিছু রাজনৈতিক নেতা গাজার কিছু অংশ দখল করে রাখা কিংবা স্থায়ী সামরিক শাসনের প্রস্তাব দিয়েছেন। এটি কোনো নিরাপত্তানীতির অংশ নয়। এটি হলো উপনিবেশবাদ এবং তা প্রতিরক্ষার ছদ্মবেশে। একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র কীভাবে নাগরিক অধিকার, রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্ব ছাড়াই দীর্ঘমেয়াদে বেসামরিক জনগণের ওপর সামরিক শাসন চাপিয়ে দিতে পারে? এটি এক নৈতিক বিপর্যয় ও কৌশলগত আত্মহত্যা সামিল।

এমন নীতিতে দুই-রাষ্ট্র সমাধানের প্রতিশ্রুতিও প্রশ্নবিদ্ধ হয়, যা দীর্ঘদিন ধরেই কেবল কথার ফুলঝুরি ছাড়া কিছুই হয়নি। যুদ্ধ-পরবর্তী গাজার শাসনব্যবস্থা নিয়ে কোনো বাস্তব পরিকল্পনা এখনো দেয়া হয়নি। এই নীরবতা এক অন্ধকার ভবিষ্যতের ইঙ্গিত, যা স্থায়ী দখলদারিত্বের সেই বিভ্রম, যেখানে মনে করা হচ্ছে গাজার মানুষ হঠাৎ উধাও হয়ে যাবে।

আঞ্চলিক প্রতিক্রিয়াও নেতিবাচক। মিসর, ঐতিহাসিকভাবে এক স্থিতিশীল প্রতিবেশী, গাজা থেকে শরণার্থী গ্রহণে সম্পূর্ণ অনিচ্ছা জানিয়েছে। তাদের মতে ইসরায়েলের এ ধরনের প্রচেষ্টা জাতিগত নির্মূলের সামিল। জর্ডান আশঙ্কা করছে, ইসরায়েল পশ্চিম তীর থেকেও ফিলিস্তিনিদের উৎখাত করতে পারে, যা জর্ডানের স্থিতিশীলতাকে হুমকির মুখে ফেলবে।

সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাত, যারা একসময় আব্রাহাম চুক্তির আওতায় ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে আগ্রহী ছিল, এখন স্পষ্ট বলেছেÑফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠনে বাস্তব অগ্রগতি ছাড়া স্বাভাবিকীকরণ অসম্ভব। যুদ্ধ সেই সম্ভাবনাকে নৎসাত করে দিয়েছে এবং সঙ্গত কারণেই।

আন্তর্জাতিক আইন, যদিও অনেক সময় রাষ্ট্রীয় স্বার্থের মুখে উপেক্ষিত হয়, তবুও এটি বর্বরতার বিরুদ্ধে শেষ কিছু প্রতিরোধের একটি। দখলদার রাষ্ট্র হিসেবে ইসরায়েল জেনেভা কনভেনশন অনুসরনে বাধ্য। অনাহারকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার, বেসামরিক অবকাঠামোতে বোমাবর্ষণ, জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুতি; এসবই যুদ্ধাপরাধ হিসেবে বিবেচিত।

সমালোচনা সহজ, কিন্তু বিকল্প কল্পনা করা কঠিন। তবুও, সমাধান সম্ভব। তা শুরু হতে পারে অবিলম্বে যুদ্ধবিরতির মধ্য দিয়ে, এবং কূটনীতির পুনঃতৎপরতার মাধ্যমে। শুধু জিম্মি উদ্ধার নয়, স্থায়ী রাজনৈতিক সমঝোতার জন্য সংলাপ জরুরি। এর সঙ্গে দরকার আন্তর্জাতিক তত্ত্বাবধানে একটি মানবিক করিডোর এবং জাতিসংঘের অধীনে একটি অন্তর্বর্তী শাসনব্যবস্থার মাধ্যমে ফিলিস্তিনি স্বশাসনের পথে অগ্রসর হওয়া।

তবে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন নেতৃত্ব যা ইসরায়েল ও ফিলিস্তিন উভয়ের পক্ষেই প্রয়োজন। যারা সাম্প্রদায়িক স্বার্থ নয়, বরং ন্যায়বিচার ও সহাবস্থানের রাজনীতি বেছে নেবে। নেতানিয়াহু সেই নেতা নন, কারণ তিনি রাজনীতিকে এখন ব্যক্তি স্বার্থ ও চিরস্থায়ী সংঘাতের প্রতিচ্ছবিতে পরিণত করেছেন।

নেতানিয়াহুর এই গাজার পূর্ণ দখল পরিকল্পনা হয়তো ইসরায়েলের একটি গোষ্ঠীর বাহবা কুড়াতে পারে, কিন্তু এটি হবে এক শোষণের জয়, যা নৈতিক অবস্থানকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়। তাছাড়া কূটনৈতিকভাবে ইসরায়েলকে একঘরে করে ফেলবে এবং অন্তহীন এক প্রতিরোধের বীজ বপন করবে। ভয়াবহ ব্যাপার হলো, ফিলিস্তিনিরা দিনদিন বিশ্বাস হারাচ্ছে যে শান্তি সম্ভব, আর সেই শূন্যতায় জন্ম নিচ্ছে সহিংস প্রতিরোধের সংস্কৃতি। এই বিশ্বাস বিষাক্ত। কিন্তু নেতানিয়াহু নিজেই সেই বিষ প্রস্তুত করছেন।

ফিলিস্তিনিদের ভোগান্তি কোনো দূর্ঘটনা নয়। এটি একটি ব্যর্থ কৌশলগত দৃষ্টিভঙ্গির পরিণতি। অগ্রগতির পথ শরণার্থী শিবিরে আরও ট্যাংক চালানোর মধ্যে নয়, বরং মর্যাদা, অধিকার ও সহাবস্থানের ভিত্তিতে একটি রাজনৈতিক রোডম্যাপ পুনরুজ্জীবনের মধ্যেই নিহিত। গাজার ট্র্যাজেডি যুদ্ধ দিয়ে সমাধান হবে নাÑএর সমাধান হবে এই যুদ্ধ বন্ধ করার সাহস দেখানোর মাধ্যমে।

[লেখক : প্রাবন্ধিক]

back to top