মতিউর রহমান
যখন বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তন পরিবেশের রূপরেখা পুনর্গঠন করছে, তখন বাংলাদেশ একটি গুরুতর সংকটের সম্মুখীন হয়েছেÑএটি হচ্ছে পরিবেশগত ভঙ্গুরতা ও জনস্বাস্থ্য ঝুঁকির একটি ভয়ঙ্কর সংমিশ্রণ। বৈশ্বিক উষ্ণতার সবচেয়ে নিষ্ক্রিয় এবং নিয়ন্ত্রণহীন পরিণতিগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো বহনকারী কীট এবং জলবাহিত রোগের প্রসার। এ রোগসমূহ এখন বাংলাদেশে ক্রমবর্ধমান হারে আরও ভয়াবহ রূপে এবং পূর্বাভাসহীনভাবে ছড়িয়ে পড়ছে। উপক্রান্তীয় জলবায়ু, ঘন জনসংখ্যা, ভঙ্গুর অবকাঠামো এবং স্থায়ী দারিদ্র্যÑএই সবকিছু মিলে বাংলাদেশকে একটি নিঃশব্দ কিন্তু মারাত্মক স্বাস্থ্য সংকটের প্রজননক্ষেত্রে পরিণত করছে, যার মূল কারণ জলবায়ু পরিবর্তন। এই অদৃশ্য আগ্রাসন কেবল কিছু রোগ নয়, বরং দেশের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও মানবিক স্থিতিশীলতার ওপর গভীর আঘাত হানছে।
বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান এবং পরিবেশগত বৈশিষ্ট্য জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে রোগপ্রবণতাকে বহুগুণে বাড়িয়ে তুলেছে। নিম্নভূমিতে অবস্থিত গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র-মেঘনা বদ্বীপ অঞ্চলটি নিয়মিত মৌসুমি বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, অপ্রত্যাশিত বৃষ্টিপাত এবং সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির মুখোমুখি হচ্ছে। এই পরিবেশগত পরিবর্তনগুলোর কারণে রোগবাহী জীব যেমন মশা বা জলজ ব্যাকটেরিয়ার জীবনচক্র ও বিস্তারের ধরন আমূল বদলে যাচ্ছে। দীর্ঘায়িত বর্ষাকাল ও উষ্ণতর তাপমাত্রা মশার মতো কীটের বংশবিস্তারের জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরি করছে, যার ফলে তারা নতুন নতুন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ছে এবং রোগ সংক্রমণের সময়কাল ও পরিধি বেড়ে যাচ্ছে। এই পরিবর্তনগুলো জীববৈচিত্র্েযর উপরও প্রভাব ফেলছে, যা খাদ্যশৃঙ্খল এবং প্রাকৃতিক নিয়ন্ত্রণের ভারসাম্যকে বিঘিœত করছে। জলবায়ুর এই নতুন ধরনগুলো এক সময়কার স্থানীয় রোগগুলোকে বৈশ্বিক মহামারীর ঝুঁকিতে রূপান্তরিত করছে।
ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া এবং ম্যালেরিয়ার মতো কীটবাহিত রোগের বিস্তার এ বাস্তবতার একটি উদ্বেগজনক চিত্র তুলে ধরেছে। বিশেষত ২০১৯ সালের ডেঙ্গু মহামারীÑ যেখানে শতাধিক মানুষ প্রাণ হারায় এবং হাজার হাজার মানুষ হাসপাতালে ভর্তি হয়Ñবাংলাদেশে এই সংকটের ভয়াবহতা তুলে ধরে। একসময় শুধুমাত্র বর্ষাকালের শহুরে রোগ হিসেবে পরিচিত ডেঙ্গু এখন সারা বছর এবং দেশের গ্রামীণ এলাকায় ছড়িয়ে পড়ছে। উষ্ণ তাপমাত্রা, আর্দ্রতা ও অনিয়মিত বৃষ্টিপাতের ফলে এডিস মশার বিস্তার বাড়ছে। অপরিকল্পিত নগরায়ণ, অপ্রতুল ড্রেনেজ ব্যবস্থা এবং অপরিচ্ছন্ন পানি সংরক্ষণ প্রথা এই সংকটকে আরও গভীরতর করছে। শহরাঞ্চলে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব এখন আর শুধু বর্ষাকালের সীমাবদ্ধ নয়, শীতকালেও এর প্রকোপ দেখা যাচ্ছে, যা জলবায়ু পরিবর্তনের সরাসরি প্রভাবকে নির্দেশ করে। এটি স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থার ওপর একটি নতুন ও অপ্রত্যাশিত চাপ সৃষ্টি করছে।
মালারিয়ার পুনরুত্থানও পরিস্থিতির আরেকটি উদ্বেগজনক দিক। বিশেষত পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী জনগোষ্ঠীÑযারা প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার বাইরেÑতারা আবারও ম্যালেরিয়ার কবলে পড়ছে। উষ্ণ আবহাওয়া এবং বনজ পরিবেশের পরিবর্তনের ফলে অ্যানোফিলিস মশার বিস্তার পাহাড়ি অঞ্চলেও শুরু হয়েছে, যেখানে আগে এ রোগ দেখা যেত না। যদিও গত দুই দশকে ম্যালেরিয়া নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছে, জলবায়ু পরিবর্তন সেই অর্জনগুলোকেই আজ হুমকির মুখে ফেলেছে। পার্বত্য অঞ্চলের দুর্গমতা, সচেতনতার অভাব এবং দুর্বল স্বাস্থ্যসেবা অবকাঠামো পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলছে। এটি কেবল একটি স্বাস্থ্য সমস্যা নয়, এটি আদিবাসী জনগোষ্ঠীর অস্তিত্ব ও জীবনযাত্রার ওপরও একটি গুরুতর হুমকি।
জলবাহিত রোগের ক্রমবর্ধমান বিস্তারও এখন এক জরুরি জনস্বাস্থ্য সংকট। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ঘন ঘন বন্যা, লবণাক্ততা বৃদ্ধি এবং অনুন্নত পানি ও স্যানিটেশন ব্যবস্থা কলেরা, টাইফয়েড, হেপাটাইটিস অ ও ঊ এবং ডায়রিয়ার মতো রোগ ছড়ানোর অনুকূল পরিবেশ তৈরি করেছে। বন্যার সময় পানির উৎসে মলদূষণ ঘটে, স্লাম এলাকায় ড্রেনেজ ব্যবস্থার পতন ঘটে এবং মানুষ বাধ্য হয় দূষিত পানি পান করতে। ২০০৭ সালের সিডর এবং ২০০৯ সালের আইলা উপকূলীয় অঞ্চলের পানিবাহিত রোগে মহামারীর জন্ম দিয়েছিল, যার প্রভাব মাসের পর মাস চলেছিল। পানির উষ্ণতা ও পুষ্টিপদার্থ দূষণ ভিব্রিও কলেরা নামক ব্যাকটেরিয়ার বৃদ্ধির সহায়ক, যা কলেরার কারণ। বিশুদ্ধ পানির অভাব বিশেষত উপকূলীয় এবং চর অঞ্চলে বসবাসকারী মানুষের জন্য একটি নিত্যদিনের সংগ্রামের বিষয়।
এই রোগগুলোতে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে শিশুরা, বৃদ্ধরা, গর্ভবতী নারী ও দরিদ্র জনগোষ্ঠী, যাদের কাছে স্বাস্থ্যসেবা, নিরাপদ পানি ও পরিচ্ছন্নতার ব্যবস্থা সীমিত। প্রত্যেক বর্ষা বা ঘূর্ণিঝড় মৌসুম তাদের কাছে এক নতুন আতঙ্ক নিয়ে আসেÑজীবাণু সংক্রমণের, জ্বরের, বমির এবং মৃত্যুর আশঙ্কার। গ্রামীণ এলাকায় স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রগুলো প্রায়শই দুর্বল, প্রয়োজনীয় সরঞ্জামের অভাব রয়েছে এবং রোগ নির্ণয়ে দেরি হয়, যা মৃত্যুহারের একটি বড় কারণ। শহরের বস্তিগুলোতে ঘনবসতি ও অপরিচ্ছন্নতা রোগ সংক্রমণ আরও বাড়িয়ে দেয়। সামাজিক বৈষম্য এখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, যেখানে দরিদ্ররা জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, কিন্তু তাদের কাছেই সংকট মোকাবেলার জন্য প্রয়োজনীয় সম্পদ সবচেয়ে কম থাকে।
সামাজিক ও অর্থনৈতিক দিক থেকে এই স্বাস্থ্য সংকটের প্রভাব অত্যন্ত গভীর। ঘন ঘন অসুস্থতা ও হাসপাতালে ভর্তি হওয়া পরিবারের আয় কমিয়ে দেয়, চিকিৎসা ব্যয় বাড়ায় এবং শ্রম উৎপাদনশীলতা হ্রাস করে। অসুস্থ শিশুরা স্কুল মিস করে, যার দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়নমূলক প্রভাব পড়ে। স্বাস্থ্য ব্যবস্থা, যা ইতোমধ্যে সীমিত অবকাঠামো ও জনবল নিয়ে কাজ করে, মৌসুমি রোগপ্রবণতায় আরও চাপে পড়ে। ঢাকায় ও চট্টগ্রামে ডেঙ্গুর মৌসুমে হাসপাতালগুলোতে শয্যার সংকট দেখা যায়Ñঅনেক রোগীকে মেঝেতে বা করিডোরে চিকিৎসা নিতে হয়। এ চাপে সরকারও প্রতিরোধমূলক পদক্ষেপ নিতে বা গবেষণায় বিনিয়োগ করতে হিমশিম খায়। এই চক্রটি একটি উন্নয়নশীল দেশের জন্য একটি বড় বাধা, যেখানে স্বাস্থ্য ও অর্থনীতি একে অপরের সাথে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত।
বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক গবেষণাও বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে রোগ বিস্তারের সম্পর্ক তুলে ধরেছে। আইসিডিডিআর,বি’র গবেষণায় দেখা গেছে, উচ্চ তাপমাত্রা ডায়রিয়াজনিত রোগ বৃদ্ধির সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত। একইভাবে আইইডিসিআর ডেঙ্গু ও ম্যালেরিয়ার সংক্রমণ মানচিত্রে স্থানীয় ও মৌসুমি রূপান্তরের তথ্য উপস্থাপন করেছে; কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে, দেশের রোগ পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থা এখনো দুর্বল। অনেক এলাকায় পর্যবেক্ষণ বা দ্রুত রোগ নির্ণয় সম্ভব হয় না। তথ্য ব্যবস্থাপনায় অদক্ষতা এবং সরকারি কাঠামোর জটিলতা দ্রুত প্রতিক্রিয়া প্রদানকে বাধাগ্রস্ত করে। রোগের বিস্তার সম্পর্কে সঠিক এবং সময়োপযোগী তথ্যের অভাব প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থাকে দুর্বল করে দেয় এবং সংকট ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে।
এ সংকট মোকাবেলায় একটি বহুমাত্রিক ও সক্রিয় উদ্যোগ অত্যন্ত প্রয়োজন। জলবায়ু অভিযোজন কৌশলকে জনস্বাস্থ্য পরিকল্পনায় অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। জলবায়ু ও পরিবেশগত তথ্য ব্যবহার করে রোগ পূর্বাভাস মডেল তৈরি, কীট নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির জোরদারকরণ, কমিউনিটি সচেতনতা বৃদ্ধি এবং নিরাপদ পানি ও স্যানিটেশন নিশ্চিত করাÑএই সবকিছুই জরুরি। স্বাস্থ্য ব্যবস্থা হতে হবে জলবায়ু সহনশীল, যাতে রোগ বৃদ্ধির সময় দ্রুত জরুরি সাড়া দেওয়া যায়। গ্রামীণ এলাকাগুলোর প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে দ্রুত পরীক্ষার ব্যবস্থা, প্রশিক্ষিত জনবল এবং রেফারেল সেবা থাকতে হবে। এই ব্যবস্থাগুলো শুধু দুর্যোগের সময় নয়, বরং সারা বছর সচল রাখা প্রয়োজন।
নগর পরিকল্পনাতেও জলবায়ুজনিত স্বাস্থ্য প্রভাবকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। বিশেষত ঢাকার মতো শহরে ড্রেনেজ উন্নয়ন, বস্তি এলাকায় নিরাপদ বাসস্থান, পাইপলাইনে পানি সরবরাহ এবং স্যানিটেশন ব্যবস্থা জরুরি। অনানুষ্ঠানিক বসতির বাসিন্দাদের জন্য স্বাস্থ্য, পরিবেশ ও অবকাঠামো একত্রিত করে পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হবে। উপকূলীয় ও পাহাড়ি এলাকাগুলোতে টেকসই পানি অবকাঠামো, লবণসহনশীল শস্য এবং ভ্রাম্যমাণ স্বাস্থ্যসেবার ব্যবস্থা রাখতে হবে। নগর ও গ্রামীণ এলাকার মধ্যে স্বাস্থ্যসেবার পার্থক্য কমিয়ে আনা জরুরি।
আন্তর্জাতিক অংশীদারিত্ব এই ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। জলবায়ু ও স্বাস্থ্য বিষয়ক বৈশ্বিক সংস্থাগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশকে গবেষণা, দক্ষতা বিনিময় এবং অর্থায়নের ক্ষেত্র তৈরি করতে হবে। গ্রামীণ বা দুর্যোগপ্রবণ এলাকাগুলোতে জলবায়ু বিজ্ঞানী, মহামারিবিদ, এনজিও এবং সরকারি প্রতিষ্ঠান একত্রে কাজ করলে একটি সমন্বিত ব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব হবে। একই সঙ্গে স্বাস্থ্য, জলবায়ু ন্যায়বিচার ও সামাজিক সমতার মধ্যে সম্পর্ক স্থাপন করে শিক্ষা ও গবেষণায় আন্তঃবিষয়ক দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তুলতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তন এখন আর শুধু পরিবেশগত সমস্যা নয়, এটি একটি বৈশ্বিক নিরাপত্তা ও মানব অধিকারের প্রশ্ন।
এছাড়াও স্বাস্থ্য ও জলবায়ু প্রশাসনের রাজনৈতিক অর্থনীতি অনুধাবন করাও জরুরি। পরিবেশগত অবক্ষয়, অপরিকল্পিত নগরায়ণ এবং দুর্যোগ প্রস্তুতির ঘাটতি অনেক সময় নীতিগত ব্যর্থতা ও প্রশাসনিক অবহেলার ফল। জলবায়ু ও স্বাস্থ্য খাতে বিনিয়োগের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। চরাঞ্চল, লবণাক্ত উপকূল, শহরের বস্তিÑএই সবজায়গায় বসবাসরত প্রান্তিক মানুষের কণ্ঠস্বর নীতিনির্ধারণে অন্তর্ভুক্ত না হলে শুধু প্রযুক্তি ও অর্থই যথেষ্ট নয়। নীতি প্রণয়নের ক্ষেত্রে তৃণমূল পর্যায়ের মানুষের অভিজ্ঞতা ও চাহিদাগুলোকে গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন।
জলবায়ুজনিত স্বাস্থ্য সংকট ভবিষ্যতের কোনো কল্পনা নয়Ñএটা বাংলাদেশের বাস্তবতা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বহনকারী কীট ও জলবাহিত রোগের এই অদৃশ্য আগ্রাসন শুধুমাত্র এক পরিবেশগত দুর্বলতার বহিঃপ্রকাশ নয়, এটি সামাজিক অবিচারের একটি প্রতিচ্ছবি। এই সংকট মোকাবেলায় শুধু টিকা, ওষুধ বা মশারি যথেষ্ট নয়Ñএটি প্রয়োজন রাজনৈতিক সদিচ্ছা, দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা এবং সমন্বিত ব্যবস্থার। বিশ্বের উষ্ণতা যত বাড়ছে, তত বাড়ছে রোগের ঝুঁকি এবং মৃত্যুহার। এখনই সময় সজাগ হওয়ার। এখনই সময় স্বাস্থ্যকে জাতীয় উন্নয়নের কেন্দ্রে আনার। কারণ এই লড়াইয়ে কেবল কয়েকজন মানুষের নয়, একটি পুরো জাতির ভবিষ্যৎ ঝুঁকির মুখে।
জলবায়ু-চালিত রোগের অদৃশ্য আগ্রাসন আমাদের সময়ের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ জনস্বাস্থ্য চ্যালেঞ্জ। বাংলাদেশের ভৌগোলিক ও সামাজিক বাস্তবতা এই সংকটকে আরও গভীরতর করেছে। তবে এটিকে মোকাবেলা করা সম্ভবÑযদি আমরা তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ার গ-ি ছাড়িয়ে একটি দীর্ঘমেয়াদি, ন্যায্য ও অন্তর্ভুক্তিমূলক দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করি। জলবায়ু পরিবর্তন এখন আর শুধুমাত্র পরিবেশগত বা অর্থনৈতিক ইস্যু নয়Ñএটি মানব স্বাস্থ্য ও জাতীয় টিকে থাকার এক বিরাট সংকট। আজকের পদক্ষেপই নির্ধারণ করবে আগামী প্রজন্মের ভবিষ্যৎ। এখনই সময় সাহসী ও ন্যায়ভিত্তিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের।
[লেখক : গবেষক ও উন্নয়নকর্মী]
মতিউর রহমান
শনিবার, ০৯ আগস্ট ২০২৫
যখন বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তন পরিবেশের রূপরেখা পুনর্গঠন করছে, তখন বাংলাদেশ একটি গুরুতর সংকটের সম্মুখীন হয়েছেÑএটি হচ্ছে পরিবেশগত ভঙ্গুরতা ও জনস্বাস্থ্য ঝুঁকির একটি ভয়ঙ্কর সংমিশ্রণ। বৈশ্বিক উষ্ণতার সবচেয়ে নিষ্ক্রিয় এবং নিয়ন্ত্রণহীন পরিণতিগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো বহনকারী কীট এবং জলবাহিত রোগের প্রসার। এ রোগসমূহ এখন বাংলাদেশে ক্রমবর্ধমান হারে আরও ভয়াবহ রূপে এবং পূর্বাভাসহীনভাবে ছড়িয়ে পড়ছে। উপক্রান্তীয় জলবায়ু, ঘন জনসংখ্যা, ভঙ্গুর অবকাঠামো এবং স্থায়ী দারিদ্র্যÑএই সবকিছু মিলে বাংলাদেশকে একটি নিঃশব্দ কিন্তু মারাত্মক স্বাস্থ্য সংকটের প্রজননক্ষেত্রে পরিণত করছে, যার মূল কারণ জলবায়ু পরিবর্তন। এই অদৃশ্য আগ্রাসন কেবল কিছু রোগ নয়, বরং দেশের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও মানবিক স্থিতিশীলতার ওপর গভীর আঘাত হানছে।
বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান এবং পরিবেশগত বৈশিষ্ট্য জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে রোগপ্রবণতাকে বহুগুণে বাড়িয়ে তুলেছে। নিম্নভূমিতে অবস্থিত গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র-মেঘনা বদ্বীপ অঞ্চলটি নিয়মিত মৌসুমি বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, অপ্রত্যাশিত বৃষ্টিপাত এবং সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির মুখোমুখি হচ্ছে। এই পরিবেশগত পরিবর্তনগুলোর কারণে রোগবাহী জীব যেমন মশা বা জলজ ব্যাকটেরিয়ার জীবনচক্র ও বিস্তারের ধরন আমূল বদলে যাচ্ছে। দীর্ঘায়িত বর্ষাকাল ও উষ্ণতর তাপমাত্রা মশার মতো কীটের বংশবিস্তারের জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরি করছে, যার ফলে তারা নতুন নতুন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ছে এবং রোগ সংক্রমণের সময়কাল ও পরিধি বেড়ে যাচ্ছে। এই পরিবর্তনগুলো জীববৈচিত্র্েযর উপরও প্রভাব ফেলছে, যা খাদ্যশৃঙ্খল এবং প্রাকৃতিক নিয়ন্ত্রণের ভারসাম্যকে বিঘিœত করছে। জলবায়ুর এই নতুন ধরনগুলো এক সময়কার স্থানীয় রোগগুলোকে বৈশ্বিক মহামারীর ঝুঁকিতে রূপান্তরিত করছে।
ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া এবং ম্যালেরিয়ার মতো কীটবাহিত রোগের বিস্তার এ বাস্তবতার একটি উদ্বেগজনক চিত্র তুলে ধরেছে। বিশেষত ২০১৯ সালের ডেঙ্গু মহামারীÑ যেখানে শতাধিক মানুষ প্রাণ হারায় এবং হাজার হাজার মানুষ হাসপাতালে ভর্তি হয়Ñবাংলাদেশে এই সংকটের ভয়াবহতা তুলে ধরে। একসময় শুধুমাত্র বর্ষাকালের শহুরে রোগ হিসেবে পরিচিত ডেঙ্গু এখন সারা বছর এবং দেশের গ্রামীণ এলাকায় ছড়িয়ে পড়ছে। উষ্ণ তাপমাত্রা, আর্দ্রতা ও অনিয়মিত বৃষ্টিপাতের ফলে এডিস মশার বিস্তার বাড়ছে। অপরিকল্পিত নগরায়ণ, অপ্রতুল ড্রেনেজ ব্যবস্থা এবং অপরিচ্ছন্ন পানি সংরক্ষণ প্রথা এই সংকটকে আরও গভীরতর করছে। শহরাঞ্চলে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব এখন আর শুধু বর্ষাকালের সীমাবদ্ধ নয়, শীতকালেও এর প্রকোপ দেখা যাচ্ছে, যা জলবায়ু পরিবর্তনের সরাসরি প্রভাবকে নির্দেশ করে। এটি স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থার ওপর একটি নতুন ও অপ্রত্যাশিত চাপ সৃষ্টি করছে।
মালারিয়ার পুনরুত্থানও পরিস্থিতির আরেকটি উদ্বেগজনক দিক। বিশেষত পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী জনগোষ্ঠীÑযারা প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার বাইরেÑতারা আবারও ম্যালেরিয়ার কবলে পড়ছে। উষ্ণ আবহাওয়া এবং বনজ পরিবেশের পরিবর্তনের ফলে অ্যানোফিলিস মশার বিস্তার পাহাড়ি অঞ্চলেও শুরু হয়েছে, যেখানে আগে এ রোগ দেখা যেত না। যদিও গত দুই দশকে ম্যালেরিয়া নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছে, জলবায়ু পরিবর্তন সেই অর্জনগুলোকেই আজ হুমকির মুখে ফেলেছে। পার্বত্য অঞ্চলের দুর্গমতা, সচেতনতার অভাব এবং দুর্বল স্বাস্থ্যসেবা অবকাঠামো পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলছে। এটি কেবল একটি স্বাস্থ্য সমস্যা নয়, এটি আদিবাসী জনগোষ্ঠীর অস্তিত্ব ও জীবনযাত্রার ওপরও একটি গুরুতর হুমকি।
জলবাহিত রোগের ক্রমবর্ধমান বিস্তারও এখন এক জরুরি জনস্বাস্থ্য সংকট। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ঘন ঘন বন্যা, লবণাক্ততা বৃদ্ধি এবং অনুন্নত পানি ও স্যানিটেশন ব্যবস্থা কলেরা, টাইফয়েড, হেপাটাইটিস অ ও ঊ এবং ডায়রিয়ার মতো রোগ ছড়ানোর অনুকূল পরিবেশ তৈরি করেছে। বন্যার সময় পানির উৎসে মলদূষণ ঘটে, স্লাম এলাকায় ড্রেনেজ ব্যবস্থার পতন ঘটে এবং মানুষ বাধ্য হয় দূষিত পানি পান করতে। ২০০৭ সালের সিডর এবং ২০০৯ সালের আইলা উপকূলীয় অঞ্চলের পানিবাহিত রোগে মহামারীর জন্ম দিয়েছিল, যার প্রভাব মাসের পর মাস চলেছিল। পানির উষ্ণতা ও পুষ্টিপদার্থ দূষণ ভিব্রিও কলেরা নামক ব্যাকটেরিয়ার বৃদ্ধির সহায়ক, যা কলেরার কারণ। বিশুদ্ধ পানির অভাব বিশেষত উপকূলীয় এবং চর অঞ্চলে বসবাসকারী মানুষের জন্য একটি নিত্যদিনের সংগ্রামের বিষয়।
এই রোগগুলোতে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে শিশুরা, বৃদ্ধরা, গর্ভবতী নারী ও দরিদ্র জনগোষ্ঠী, যাদের কাছে স্বাস্থ্যসেবা, নিরাপদ পানি ও পরিচ্ছন্নতার ব্যবস্থা সীমিত। প্রত্যেক বর্ষা বা ঘূর্ণিঝড় মৌসুম তাদের কাছে এক নতুন আতঙ্ক নিয়ে আসেÑজীবাণু সংক্রমণের, জ্বরের, বমির এবং মৃত্যুর আশঙ্কার। গ্রামীণ এলাকায় স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রগুলো প্রায়শই দুর্বল, প্রয়োজনীয় সরঞ্জামের অভাব রয়েছে এবং রোগ নির্ণয়ে দেরি হয়, যা মৃত্যুহারের একটি বড় কারণ। শহরের বস্তিগুলোতে ঘনবসতি ও অপরিচ্ছন্নতা রোগ সংক্রমণ আরও বাড়িয়ে দেয়। সামাজিক বৈষম্য এখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, যেখানে দরিদ্ররা জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, কিন্তু তাদের কাছেই সংকট মোকাবেলার জন্য প্রয়োজনীয় সম্পদ সবচেয়ে কম থাকে।
সামাজিক ও অর্থনৈতিক দিক থেকে এই স্বাস্থ্য সংকটের প্রভাব অত্যন্ত গভীর। ঘন ঘন অসুস্থতা ও হাসপাতালে ভর্তি হওয়া পরিবারের আয় কমিয়ে দেয়, চিকিৎসা ব্যয় বাড়ায় এবং শ্রম উৎপাদনশীলতা হ্রাস করে। অসুস্থ শিশুরা স্কুল মিস করে, যার দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়নমূলক প্রভাব পড়ে। স্বাস্থ্য ব্যবস্থা, যা ইতোমধ্যে সীমিত অবকাঠামো ও জনবল নিয়ে কাজ করে, মৌসুমি রোগপ্রবণতায় আরও চাপে পড়ে। ঢাকায় ও চট্টগ্রামে ডেঙ্গুর মৌসুমে হাসপাতালগুলোতে শয্যার সংকট দেখা যায়Ñঅনেক রোগীকে মেঝেতে বা করিডোরে চিকিৎসা নিতে হয়। এ চাপে সরকারও প্রতিরোধমূলক পদক্ষেপ নিতে বা গবেষণায় বিনিয়োগ করতে হিমশিম খায়। এই চক্রটি একটি উন্নয়নশীল দেশের জন্য একটি বড় বাধা, যেখানে স্বাস্থ্য ও অর্থনীতি একে অপরের সাথে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত।
বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক গবেষণাও বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে রোগ বিস্তারের সম্পর্ক তুলে ধরেছে। আইসিডিডিআর,বি’র গবেষণায় দেখা গেছে, উচ্চ তাপমাত্রা ডায়রিয়াজনিত রোগ বৃদ্ধির সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত। একইভাবে আইইডিসিআর ডেঙ্গু ও ম্যালেরিয়ার সংক্রমণ মানচিত্রে স্থানীয় ও মৌসুমি রূপান্তরের তথ্য উপস্থাপন করেছে; কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে, দেশের রোগ পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থা এখনো দুর্বল। অনেক এলাকায় পর্যবেক্ষণ বা দ্রুত রোগ নির্ণয় সম্ভব হয় না। তথ্য ব্যবস্থাপনায় অদক্ষতা এবং সরকারি কাঠামোর জটিলতা দ্রুত প্রতিক্রিয়া প্রদানকে বাধাগ্রস্ত করে। রোগের বিস্তার সম্পর্কে সঠিক এবং সময়োপযোগী তথ্যের অভাব প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থাকে দুর্বল করে দেয় এবং সংকট ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে।
এ সংকট মোকাবেলায় একটি বহুমাত্রিক ও সক্রিয় উদ্যোগ অত্যন্ত প্রয়োজন। জলবায়ু অভিযোজন কৌশলকে জনস্বাস্থ্য পরিকল্পনায় অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। জলবায়ু ও পরিবেশগত তথ্য ব্যবহার করে রোগ পূর্বাভাস মডেল তৈরি, কীট নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির জোরদারকরণ, কমিউনিটি সচেতনতা বৃদ্ধি এবং নিরাপদ পানি ও স্যানিটেশন নিশ্চিত করাÑএই সবকিছুই জরুরি। স্বাস্থ্য ব্যবস্থা হতে হবে জলবায়ু সহনশীল, যাতে রোগ বৃদ্ধির সময় দ্রুত জরুরি সাড়া দেওয়া যায়। গ্রামীণ এলাকাগুলোর প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে দ্রুত পরীক্ষার ব্যবস্থা, প্রশিক্ষিত জনবল এবং রেফারেল সেবা থাকতে হবে। এই ব্যবস্থাগুলো শুধু দুর্যোগের সময় নয়, বরং সারা বছর সচল রাখা প্রয়োজন।
নগর পরিকল্পনাতেও জলবায়ুজনিত স্বাস্থ্য প্রভাবকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। বিশেষত ঢাকার মতো শহরে ড্রেনেজ উন্নয়ন, বস্তি এলাকায় নিরাপদ বাসস্থান, পাইপলাইনে পানি সরবরাহ এবং স্যানিটেশন ব্যবস্থা জরুরি। অনানুষ্ঠানিক বসতির বাসিন্দাদের জন্য স্বাস্থ্য, পরিবেশ ও অবকাঠামো একত্রিত করে পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হবে। উপকূলীয় ও পাহাড়ি এলাকাগুলোতে টেকসই পানি অবকাঠামো, লবণসহনশীল শস্য এবং ভ্রাম্যমাণ স্বাস্থ্যসেবার ব্যবস্থা রাখতে হবে। নগর ও গ্রামীণ এলাকার মধ্যে স্বাস্থ্যসেবার পার্থক্য কমিয়ে আনা জরুরি।
আন্তর্জাতিক অংশীদারিত্ব এই ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। জলবায়ু ও স্বাস্থ্য বিষয়ক বৈশ্বিক সংস্থাগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশকে গবেষণা, দক্ষতা বিনিময় এবং অর্থায়নের ক্ষেত্র তৈরি করতে হবে। গ্রামীণ বা দুর্যোগপ্রবণ এলাকাগুলোতে জলবায়ু বিজ্ঞানী, মহামারিবিদ, এনজিও এবং সরকারি প্রতিষ্ঠান একত্রে কাজ করলে একটি সমন্বিত ব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব হবে। একই সঙ্গে স্বাস্থ্য, জলবায়ু ন্যায়বিচার ও সামাজিক সমতার মধ্যে সম্পর্ক স্থাপন করে শিক্ষা ও গবেষণায় আন্তঃবিষয়ক দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তুলতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তন এখন আর শুধু পরিবেশগত সমস্যা নয়, এটি একটি বৈশ্বিক নিরাপত্তা ও মানব অধিকারের প্রশ্ন।
এছাড়াও স্বাস্থ্য ও জলবায়ু প্রশাসনের রাজনৈতিক অর্থনীতি অনুধাবন করাও জরুরি। পরিবেশগত অবক্ষয়, অপরিকল্পিত নগরায়ণ এবং দুর্যোগ প্রস্তুতির ঘাটতি অনেক সময় নীতিগত ব্যর্থতা ও প্রশাসনিক অবহেলার ফল। জলবায়ু ও স্বাস্থ্য খাতে বিনিয়োগের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। চরাঞ্চল, লবণাক্ত উপকূল, শহরের বস্তিÑএই সবজায়গায় বসবাসরত প্রান্তিক মানুষের কণ্ঠস্বর নীতিনির্ধারণে অন্তর্ভুক্ত না হলে শুধু প্রযুক্তি ও অর্থই যথেষ্ট নয়। নীতি প্রণয়নের ক্ষেত্রে তৃণমূল পর্যায়ের মানুষের অভিজ্ঞতা ও চাহিদাগুলোকে গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন।
জলবায়ুজনিত স্বাস্থ্য সংকট ভবিষ্যতের কোনো কল্পনা নয়Ñএটা বাংলাদেশের বাস্তবতা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বহনকারী কীট ও জলবাহিত রোগের এই অদৃশ্য আগ্রাসন শুধুমাত্র এক পরিবেশগত দুর্বলতার বহিঃপ্রকাশ নয়, এটি সামাজিক অবিচারের একটি প্রতিচ্ছবি। এই সংকট মোকাবেলায় শুধু টিকা, ওষুধ বা মশারি যথেষ্ট নয়Ñএটি প্রয়োজন রাজনৈতিক সদিচ্ছা, দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা এবং সমন্বিত ব্যবস্থার। বিশ্বের উষ্ণতা যত বাড়ছে, তত বাড়ছে রোগের ঝুঁকি এবং মৃত্যুহার। এখনই সময় সজাগ হওয়ার। এখনই সময় স্বাস্থ্যকে জাতীয় উন্নয়নের কেন্দ্রে আনার। কারণ এই লড়াইয়ে কেবল কয়েকজন মানুষের নয়, একটি পুরো জাতির ভবিষ্যৎ ঝুঁকির মুখে।
জলবায়ু-চালিত রোগের অদৃশ্য আগ্রাসন আমাদের সময়ের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ জনস্বাস্থ্য চ্যালেঞ্জ। বাংলাদেশের ভৌগোলিক ও সামাজিক বাস্তবতা এই সংকটকে আরও গভীরতর করেছে। তবে এটিকে মোকাবেলা করা সম্ভবÑযদি আমরা তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ার গ-ি ছাড়িয়ে একটি দীর্ঘমেয়াদি, ন্যায্য ও অন্তর্ভুক্তিমূলক দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করি। জলবায়ু পরিবর্তন এখন আর শুধুমাত্র পরিবেশগত বা অর্থনৈতিক ইস্যু নয়Ñএটি মানব স্বাস্থ্য ও জাতীয় টিকে থাকার এক বিরাট সংকট। আজকের পদক্ষেপই নির্ধারণ করবে আগামী প্রজন্মের ভবিষ্যৎ। এখনই সময় সাহসী ও ন্যায়ভিত্তিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের।
[লেখক : গবেষক ও উন্নয়নকর্মী]