alt

উপ-সম্পাদকীয়

আদিবাসী অধিকার : দায় ঘোচানোর সুযোগ এসেছে, কাজে লাগাতে হবে রাষ্ট্রকেই

রিপন বানাই

: শনিবার, ০৯ আগস্ট ২০২৫

১. আদিবাসী ইস্যুটি নানান কারণেই দেশের জাতীয় ইস্যুগুলোর অন্যতম। জাতিসংঘ থেকে শুরু করে আন্তর্জাতিক নানা ফোরামে আদিবাসীদের অধিকার এখন ব্যাপক আলোচিত। এছাড়া জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে দেশের আদিবাসী অধিকার কর্মীরা নিজেদের অধিকার নিয়ে যথেষ্ট সোচ্চার। ১৯৯৩ সালে জাতিসংঘ কর্তৃক আন্তর্জাতিক আদিবাসী বর্ষ ঘোষণা। তার পরবর্তী ৯ আগস্টকে আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস ঘোষণা।

২০০৭ সালে আদিবাসীদের জন্য জাতিসংঘ ঘোষণাপত্র। ১৯৯৭ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষর। ২০০১ সালে বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম গঠন এবং এরপর প্রতি বছর আদিবাসী দিবস উদযাপন ও আদিবাসীদেও মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার হলে প্রতিবাদ সবমিলিয়ে ইস্যুটি আজকের এই পর্যায়ে এসেছে। অস্বীকার করার উপায় নেই, দীর্ঘ এই পথচলায় মিডিয়ার বন্ধুরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। তৈরি হয়েছে আদিবাসী বান্ধব অনেক বন্ধু। এই তালিকায় দেশের সুশীল সমাজ, বুদ্ধিজীবী, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, আইনজীবীসহ অনেকেই। এমনকি আদিবাসী ইস্যুটি এখন মূল স্রোতের অনেক সচেতন মানুষ অবগত। নিঃসন্দেহে এটা একটা বিরাট ইতিবাচক পরিবর্তন বটে। কিন্তু এতো কিছুর পরেও এটা বলা যায়, আদিবাসী মানুষেরা এখনো চরম বৈষম্যের শিকার।

২. এ দেশের আদিবাসীদের কথা বললেই খুব সাধারণ ভাবে আমরা তাদের দুটি ভাগে ভাগ করতে পারি। তার একটি পাহাড় তথা পার্বত্য তিন জেলায় বসবাসকারী আদিবাসী ও বাকি ৬১টি জেলায় ছরিয়ে ছিটিয়ে থাকা বসবাসকারী আদিবাসী। জনসংখ্যা ও জাতির দিক থেকে এই সমতলের আদিবাসীরা সংখায় বেশি। কিন্তু অধিকার আদায়ের দিক থেকে এই মানুষগুলো পাহাড়ের তুলনায় যোজন যোজন দূরে! শুধু অধিকারের প্রশ্নে নয়, পাহাড় ও সমতলের আদিবাসীদের মধ্যে নানান দিক থেকে রয়েছে পার্থক্য। নেতৃত্ব, রাজনৈতিক সচেতনতা, ভৌগৌলিক অবস্থান, বঞ্চনার মাত্রা ও ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট এসব পার্থক্য এই দুই অঞ্চলের আদিবাসীদের মধ্যে ভিন্নতা তৈরি করেছে। ফলে যৌক্তিক কারনে তাদের রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধাও বিস্তর ফারাক। যেটি স্পষ্ট করে বলা যায়, শুধুমাত্র এই দোহাই দিয়ে একই চাহিদাসম্পন্ন মানুষের জন্য রাষ্ট্রের আলাদা আলাদা ব্যবস্থা গ্রহণযোগ্য নয়। একই রোগের জন্য ডাক্তার আলাদা হলেও ঔষধ ভিন্ন হওয়ার সুযোগ নেই। স্বয়ং রাষ্ট্র কর্তৃক এই বৈষম্য কেবল দৃষ্টিকটু নয় বরং বৈষম্যমূলক ও নাগরিকের প্রতি চরম অবিচার।

৩. পৃথিবীব্যাপী আদিবাসীদের অধিকার বঞ্চিত হবার ইতিহাস প্রায় একই রকম। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম নয়। এমনকি পাহাড় ও সমতলের আদিবাসীদের অনেক বঞ্চনা একই ধরনের। সাংবিধানিক স্বীকৃতি থেকে শুরু করে ভূমি ও বনের ওপর তাদের অধিকার, চাকুরী, শিক্ষা, সংস্কৃতি, রাজনীতি, অর্থনীতি এসব অধিকার থেকে বঞ্চিত যুগের পর যুগ। পাহাড়ের আদিবাসীরা রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় কিছুটা যুক্ত হলেও সমতলের আদিবাসীদের জন্য এখনও এমন কিছু করা হয়নি। রাষ্ট্র দীর্ঘদিন ধরে এই পরিস্কার বৈষম্য জিইয়ে রেখেছে। আমাদের সংবিধান বলছে, রাষ্ট্র তার জনগণের প্রতি কোনো রকম বৈষম্য তৈরি করবে না, করতে পারে না। অথচ দেশের পরতে পরতে রয়েছে এমন বৈষম্য ও অন্যায়। রাষ্ট্রের এমন বৈষম্য সংবিধান পরিপন্থি ও অন্যায্য।

৪. পাহাড়ের মতো সমতলের আদিবাসীরাও এখন অধিকার সচেতন। রাজনৈতিক সচেতনতা ও সম্পৃক্ততা আশাব্যঞ্জক না হলেও ধীরে ধীরে এই আগ্রহ বাড়ছে। তরুণদের মধ্যে অধিকার সচেতনতা বৃদ্ধি পেয়েছে। এসব আশাব্যঞ্জক। তবে সচেতনতা ও সম্পৃক্ততা আরও বহুগুণ বৃদ্ধি করতে হবে। অবশ্য রাষ্ট্রীয় অনুকূল পরিবেশ দরকার। আদিবাসীদের প্রতি রাষ্ট্রের দৃষ্টিভঙ্গি ইতিবাচক হতে হবে। আদিবাসীরা যতোই চেষ্টা করুন, রাষ্ট্র তাদের বিপরীতে থাকলে কখনোই তারা নিজেদের অধিকার ও সক্ষমতা নিশ্চিত করতে পারবে না। একইসাথে এই বৃহৎ জনগোষ্ঠীকে পিছিয়ে রেখে রাষ্ট্র তার কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারবে না। কারণ পেছনে যাকে রাখা হয় সে কেবল পেছনেই টানে! এরপরও যা অধিক গুরুত্বপূর্ণ তা হলো অধিকার আদায়ে নিজেদের আরোও সোচ্চার করা। এটা সকলের জানা যে, অধিকার কেউ কাউকে এমনি এমনি দিয়ে দেয় না, ছিনিয়ে আনতে হয়। আদায় করে নিতে হয়। সেই কাজটি করতে হবে পাহাড় ও সমতলের আদিবাসীদের সকলে একত্রিত হয়ে। বৃহত আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। রাষ্ট্রকে বাধ্য করতে হবে। আমাদের রাষ্ট্র এখনো মানবিক রাষ্ট্র হতে পারেনি তবে অবশ্যই তা হতে হবে। সবাই মিলে একটি মানবিক রাষ্ট্র গঠন করা সম্ভব।

৫. কথায় আছে, সুযোগ বার বার আসে না। হ্যা, কথাটি নানান দিক থেকেই সত্য। হাজার বছরের জীবনমুখী অভিজ্ঞতা থেকে আমরা এই শিক্ষা পেয়েছি। একইভাবে এটাও বলা যায়, সুযোগ হাতছাড়া করলে পরিণামে পস্তাতেও হয়। এমনকি কিছু ক্ষেত্রে এর খেসারত দিতে হয় মারাত্মকভাবে। বলছি আদিবাসীদের অধিকার নিশ্চিত করণের সুযোগের কথা। ১৯৭২ সালে যে ভুল রাষ্ট্র করেছিলো সেটা শোধরানোর সুযোগ তৈরি হয়েছে ২৪ এর গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে। একাত্তরের পরে সদ্য স্বাধীন দেশে সেই সময়ে তৎকালীন গণপরিষদের সদস্য এম এন লারমা বারবার দাবি তুলেছিলেন। তার পরের ইতিহাস আমরা সবাই জানি। ৭২ থেকে ২০২৫ মাঝখানে ৫৪ বছর পেরিয়ে গেলেও সেই সমস্যার সমাধান এখনও হয়নি। সুযোগ আসেনি বিষয়টি এমন নয়। নানা প্রয়োজনে এমনকি রাজনৈতিক দলের ও ব্যক্তির স্বার্থে গত ৫৪ বছরে ১৭ বার সংবিধানের সংশোধন হয়েছে কিন্তু বরাবরের মতো উপেক্ষিত থেকেছে আদিবাসীদের স্বীকৃতির দাবিটি।

৬. এখন প্রশ্ন হলোÑ কেন এমন হলো? উত্তরটি কমবেশি সকলের জানা আছে। উগ্র জাতীয়তাবাদ ও সাম্প্রদায়িক মনোভাব তার অন্যতম প্রধান কারণ। নিপীড়নের শিকার বাঙালি জাতির নিপীড়কের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে বেশিদিন লাগেনি! এক্ষেত্রে দুটি উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। একটি হচ্ছে এই জাতি ৫২-এর ভাষা আন্দোলনে নিজের ভাষার জন্য সংগ্রাম করে জীবন দিয়েছে অথচ সেই জাতি এখন পর্যন্ত দেশের অপরাপর আদিবাসী জনগোষ্ঠীর ভাষার সাংবিধানিক মর্যাদা দিতে ব্যর্থ হয়েছে। দ্বিতীয় উদাহরণটি হচ্ছে জাতিগত নিপীড়ন ও বৈষম্য। ৪৭ পরবর্তী যে জাতিগত বৈষম্য ও নিপীড়নের কারণে ৭১-এর মুক্তি যুদ্ধের অবতরণ হয়েছে সেই জাতি স্বাধীনতা অর্জনের পর নিজেরাই অন্য জাতির উপর শুরু করে নিপীড়ন ও বৈষম্যেও; যা চলমান রয়েছে।

৭. এবার মূল প্রসঙ্গে ফিরে আসা যাক। গত ৫৪ বছর যাবৎ যে ভুল রাষ্ট্র আদিবাসীদের ওপর করেছে তার শোধরানোর সুযোগ তৈরি হয়েছে এবার। বৈষম্য দূর করার যে মূলমন্ত্র নিয়ে গত জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সূচনা হয়েছিল সেই নতুন বাংলাদেশে আদিবাসীদের সাংবিধানিক অধিকার প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে রাষ্ট্র পারে তার ঐতিহাসিক দায় থেকে নিজেকে মুক্ত করতে। আবার পুরনো প্রশ্ন। রাষ্ট্র কি সেটা করবে? অথবা করার মতো পরিস্থিতি আছে কি? প্রশ্ন দুটির উত্তর অজানা। বিগত এক বছরের হিসেব বলছে রাষ্ট্র এবারও সেই একই ভুল পথে হাঁটছে। যার বাস্তব প্রমাণ হলো এই সরকারের বিভিন্ন সংস্কার কমিশনে আদিবাসীদের অন্তর্ভুক্ত না করা। এমনকি গত এক বছরে কোনো ধরনের সংলাপ বা মতামত নেওয়ার জন্য আদিবাসীদের একটিবারের জন্যও ডাকা হয়নি। অতীতের মতো এবারও তারা উপেক্ষিত। তাহলে ফলাফল কী দাঁড়ায়? এই রাষ্ট্র আদিবাসীদের স্বীকার করে না! কিন্তু এটাই শেষ কথা নয়! আমি বিশ্বাস করি আজ নয়তো আগামীকাল রাষ্ট্রকে তার বাস্তবতা মেনে নিতে হবে এবং দেশের আদিবাসী মানুষের স্বীকৃতি দিতে হবে।

৮. গত জুলাই আগস্ট পরবর্তী বাংলাদেশ একটি নতুন সুযোগ ও সম্ভাবনা তৈরি করেছে। বৈষম্যহীন বাংলাদেশ বিনির্মাণে ছাত্র জনতা নিজেদের আত্মত্যাগের মাধ্যমে অপার সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে। পাহাড় ও সমতলের আদিবাসী ছাত্র সমাজ, যুব সমাজ, সংগঠন সর্বোপরি আদিবাসী জনতা একত্রিত হয়ে কাজ করতে হবে। মনে রাখতে হবে, সুযোগ ও সম্ভাবনা বারবার আসে না। সমগ্র বাংলাদেশের জন্য যেমন একটি সুযোগ তৈরি হয়েছে তেমনি আদিবাসীদের জন্যও। এখনই উত্তম সময় নিজেদের অধিকার আদায়ের জন্য কাজ করা। পাহাড় ও সমতলের ছাত্র সমাজ এক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা রাখতে পারে।

তাই আসুন সবাই মিলে নিজেদের অধিকার বুঝে নেই। রাষ্টটি আমাদের তাই নিজেদের অধিকার নিজেদের নিশ্চিত করতে হবে। অন্যকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। দোষ দেওয়া সমাধান নয়, বরং সহযোগিতা সমাধানের উপায় হতে পারে। এই সরকারের মূল কাজ রাষ্ট্রের সংস্কার করা। ৫৪ বছরের ঝঞ্ঝাট বৈষম্য থেকে জনগণকে মুক্ত করা। কাজটি সহজ নয়। আমরা আদিবাসীরা রাষ্ট্র সংস্কারের এই মহৎ কাজে যুক্ত থাকতে চাই। আমাদের ওপর দীর্ঘদিন ধরে চলমান সব বৈষম্যের অবসান চাই। সংবিধানে আমাদের স্বীকৃতি চাই। আদিবাসীদের আত্মপরিচয়ের সংকটের অবসান চাই। সমতলের আদিবাসীদের জন্য মন্ত্রণালয় ও ভূমি কমিশন আইন তৈরির কাজ শুরু হোক। পাহাড়ের বন্ধুদের দীর্ঘ লড়াইয়ের ফসল পার্বত্য চুক্তির বাস্তবায়ন চাই।

সর্বোপরি, আমরা আদিবাসীরা দেশের হুমকি নই, সম্পদ হয়ে অবদান রাখতে চাই। যে সুযোগ ছাত্র-জনতা আত্মত্যাগের বিনিময়ে তৈরি করেছে আমরা যেন সেই সুযোগ অবহেলায় হাতছাড়া না করি। এবার এই সুযোগ হাড়ালে ইতিহাস আমাদেও কাউকে ক্ষমা করবে না! রাষ্ট্র হয়ে উঠুক জনগণের, আদিবাসীদের, সবার! কারণ, দায় যার ঘোচানোর দায়িত্বও তারই।

[লেখক : সদস্য সচিব, সমতল আদিবাসী অধিকার আন্দোলন]

ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর শিশুদের শিক্ষাগত ও সামাজিক সমস্যা

ট্রেড ইউনিয়ন ও বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট

সব অর্জনে কৃতিত্ব নিতে নেই

নাগাসাকি দিবস : পারমাণবিক বোমার অপপ্রয়োগ বন্ধ হোক

অদৃশ্য আগ্রাসনের বিরুদ্ধে লড়াই : উষ্ণ বাংলাদেশে জলবায়ু-প্রসূত স্বাস্থ্য সংকট

নেতানিয়াহুর এক ভ্রান্ত কৌশলের মুখোমুখি ইসরায়েল

আসিয়ানে বাংলাদেশের অভিযাত্রা : সম্ভাবনার পথে কূটনৈতিক বাস্তবতা ও রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ

ভাঙছে নদী, গড়ছে দুঃখের গ্রাম

ছবি

গণঅভ্যুত্থান ও গণআকাক্সক্ষা : এক বছরে অর্জনটা কী?

ছবি

ভিন্নমত, ভিন্নপথ এবং প্রান্তজনের স্বপ্ন

আচরণগত অর্থনীতির আয়নায় বাংলাদেশিদের বিদেশযাত্রা

গরিবের ইলিশ শুধুই স্বপ্ন কেন?

চব্বিশের গণঅভ্যুত্থান : বৈষম্য ও স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে জাগরণ

শারীরিক শিক্ষা : সুস্থ ও সচেতন প্রজন্ম গড়ার সম্ভাবনা

জ্ঞানতীর্থের সংকট ও গবেষণাবিমুখ উচ্চশিক্ষা

ছবি

জুলাই অভ্যুত্থান-গাথা : মেঘ থম থম করে

অলৌকিকতা, লৌকিকতা ও বিশ্বাসের বিভ্রান্তি

বিচারপতি গ্রেফতার, শুনানিতে পুলিশের অসহযোগিতা ও কিছু আইনি জিজ্ঞাসা

অপেক্ষার রাজনীতি ও সময়গত বৈষম্য : ঢাকা শহরের প্রেক্ষাপট

বৃক্ষরোপণ হোক পরিবেশ রক্ষার আন্দোলন

আফ্রিকায় রাশিয়ার ভূরাজনৈতিক কৌশল

বিভীষিকাময় দুর্ঘটনা ও করুণ মৃত্যু

কেন এত তরুণ দেশ ছাড়তে চাচ্ছে

রেলওয়ে পরিচালনায় আমলাতন্ত্রের প্রভাব

রম্যগদ্য : ‘গোপালগঞ্জ, বাংলার গোপালগঞ্জ...’

দেশি মাছ রক্ষায় অভয়াশ্রম

আলুর বাজার বিপর্যয় : কৃষকের ভাগ্যে লোকসান

ছবি

নীল নদের পানি নীল নয়

বিশ্ব বাঘ দিবস

ঢাকার কি রিস্ক এনালাইসিস করা আছে?

ছবি

সোনার হরফে লেখা অনন্য শিক্ষকের নাম

পরীক্ষার পর পরীক্ষা, কিন্তু কোথায় মূল্যায়ন ও মূল্যবোধের ভিত্তি?

বৃত্তি পরীক্ষায় কিন্ডারগার্টেন বাদ কেন?

সময়ের স্বৈরতন্ত্র : প্রতীক্ষা, ক্ষমতা ও জীবনের অসমতা

জলবায়ু পরিবর্তন মডেলে গণিতের ব্যবহার

দুর্ঘটনাজনিত দুর্যোগ-পরবর্তী করণীয় কী?

tab

উপ-সম্পাদকীয়

আদিবাসী অধিকার : দায় ঘোচানোর সুযোগ এসেছে, কাজে লাগাতে হবে রাষ্ট্রকেই

রিপন বানাই

শনিবার, ০৯ আগস্ট ২০২৫

১. আদিবাসী ইস্যুটি নানান কারণেই দেশের জাতীয় ইস্যুগুলোর অন্যতম। জাতিসংঘ থেকে শুরু করে আন্তর্জাতিক নানা ফোরামে আদিবাসীদের অধিকার এখন ব্যাপক আলোচিত। এছাড়া জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে দেশের আদিবাসী অধিকার কর্মীরা নিজেদের অধিকার নিয়ে যথেষ্ট সোচ্চার। ১৯৯৩ সালে জাতিসংঘ কর্তৃক আন্তর্জাতিক আদিবাসী বর্ষ ঘোষণা। তার পরবর্তী ৯ আগস্টকে আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস ঘোষণা।

২০০৭ সালে আদিবাসীদের জন্য জাতিসংঘ ঘোষণাপত্র। ১৯৯৭ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষর। ২০০১ সালে বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম গঠন এবং এরপর প্রতি বছর আদিবাসী দিবস উদযাপন ও আদিবাসীদেও মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার হলে প্রতিবাদ সবমিলিয়ে ইস্যুটি আজকের এই পর্যায়ে এসেছে। অস্বীকার করার উপায় নেই, দীর্ঘ এই পথচলায় মিডিয়ার বন্ধুরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। তৈরি হয়েছে আদিবাসী বান্ধব অনেক বন্ধু। এই তালিকায় দেশের সুশীল সমাজ, বুদ্ধিজীবী, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, আইনজীবীসহ অনেকেই। এমনকি আদিবাসী ইস্যুটি এখন মূল স্রোতের অনেক সচেতন মানুষ অবগত। নিঃসন্দেহে এটা একটা বিরাট ইতিবাচক পরিবর্তন বটে। কিন্তু এতো কিছুর পরেও এটা বলা যায়, আদিবাসী মানুষেরা এখনো চরম বৈষম্যের শিকার।

২. এ দেশের আদিবাসীদের কথা বললেই খুব সাধারণ ভাবে আমরা তাদের দুটি ভাগে ভাগ করতে পারি। তার একটি পাহাড় তথা পার্বত্য তিন জেলায় বসবাসকারী আদিবাসী ও বাকি ৬১টি জেলায় ছরিয়ে ছিটিয়ে থাকা বসবাসকারী আদিবাসী। জনসংখ্যা ও জাতির দিক থেকে এই সমতলের আদিবাসীরা সংখায় বেশি। কিন্তু অধিকার আদায়ের দিক থেকে এই মানুষগুলো পাহাড়ের তুলনায় যোজন যোজন দূরে! শুধু অধিকারের প্রশ্নে নয়, পাহাড় ও সমতলের আদিবাসীদের মধ্যে নানান দিক থেকে রয়েছে পার্থক্য। নেতৃত্ব, রাজনৈতিক সচেতনতা, ভৌগৌলিক অবস্থান, বঞ্চনার মাত্রা ও ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট এসব পার্থক্য এই দুই অঞ্চলের আদিবাসীদের মধ্যে ভিন্নতা তৈরি করেছে। ফলে যৌক্তিক কারনে তাদের রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধাও বিস্তর ফারাক। যেটি স্পষ্ট করে বলা যায়, শুধুমাত্র এই দোহাই দিয়ে একই চাহিদাসম্পন্ন মানুষের জন্য রাষ্ট্রের আলাদা আলাদা ব্যবস্থা গ্রহণযোগ্য নয়। একই রোগের জন্য ডাক্তার আলাদা হলেও ঔষধ ভিন্ন হওয়ার সুযোগ নেই। স্বয়ং রাষ্ট্র কর্তৃক এই বৈষম্য কেবল দৃষ্টিকটু নয় বরং বৈষম্যমূলক ও নাগরিকের প্রতি চরম অবিচার।

৩. পৃথিবীব্যাপী আদিবাসীদের অধিকার বঞ্চিত হবার ইতিহাস প্রায় একই রকম। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম নয়। এমনকি পাহাড় ও সমতলের আদিবাসীদের অনেক বঞ্চনা একই ধরনের। সাংবিধানিক স্বীকৃতি থেকে শুরু করে ভূমি ও বনের ওপর তাদের অধিকার, চাকুরী, শিক্ষা, সংস্কৃতি, রাজনীতি, অর্থনীতি এসব অধিকার থেকে বঞ্চিত যুগের পর যুগ। পাহাড়ের আদিবাসীরা রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় কিছুটা যুক্ত হলেও সমতলের আদিবাসীদের জন্য এখনও এমন কিছু করা হয়নি। রাষ্ট্র দীর্ঘদিন ধরে এই পরিস্কার বৈষম্য জিইয়ে রেখেছে। আমাদের সংবিধান বলছে, রাষ্ট্র তার জনগণের প্রতি কোনো রকম বৈষম্য তৈরি করবে না, করতে পারে না। অথচ দেশের পরতে পরতে রয়েছে এমন বৈষম্য ও অন্যায়। রাষ্ট্রের এমন বৈষম্য সংবিধান পরিপন্থি ও অন্যায্য।

৪. পাহাড়ের মতো সমতলের আদিবাসীরাও এখন অধিকার সচেতন। রাজনৈতিক সচেতনতা ও সম্পৃক্ততা আশাব্যঞ্জক না হলেও ধীরে ধীরে এই আগ্রহ বাড়ছে। তরুণদের মধ্যে অধিকার সচেতনতা বৃদ্ধি পেয়েছে। এসব আশাব্যঞ্জক। তবে সচেতনতা ও সম্পৃক্ততা আরও বহুগুণ বৃদ্ধি করতে হবে। অবশ্য রাষ্ট্রীয় অনুকূল পরিবেশ দরকার। আদিবাসীদের প্রতি রাষ্ট্রের দৃষ্টিভঙ্গি ইতিবাচক হতে হবে। আদিবাসীরা যতোই চেষ্টা করুন, রাষ্ট্র তাদের বিপরীতে থাকলে কখনোই তারা নিজেদের অধিকার ও সক্ষমতা নিশ্চিত করতে পারবে না। একইসাথে এই বৃহৎ জনগোষ্ঠীকে পিছিয়ে রেখে রাষ্ট্র তার কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারবে না। কারণ পেছনে যাকে রাখা হয় সে কেবল পেছনেই টানে! এরপরও যা অধিক গুরুত্বপূর্ণ তা হলো অধিকার আদায়ে নিজেদের আরোও সোচ্চার করা। এটা সকলের জানা যে, অধিকার কেউ কাউকে এমনি এমনি দিয়ে দেয় না, ছিনিয়ে আনতে হয়। আদায় করে নিতে হয়। সেই কাজটি করতে হবে পাহাড় ও সমতলের আদিবাসীদের সকলে একত্রিত হয়ে। বৃহত আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। রাষ্ট্রকে বাধ্য করতে হবে। আমাদের রাষ্ট্র এখনো মানবিক রাষ্ট্র হতে পারেনি তবে অবশ্যই তা হতে হবে। সবাই মিলে একটি মানবিক রাষ্ট্র গঠন করা সম্ভব।

৫. কথায় আছে, সুযোগ বার বার আসে না। হ্যা, কথাটি নানান দিক থেকেই সত্য। হাজার বছরের জীবনমুখী অভিজ্ঞতা থেকে আমরা এই শিক্ষা পেয়েছি। একইভাবে এটাও বলা যায়, সুযোগ হাতছাড়া করলে পরিণামে পস্তাতেও হয়। এমনকি কিছু ক্ষেত্রে এর খেসারত দিতে হয় মারাত্মকভাবে। বলছি আদিবাসীদের অধিকার নিশ্চিত করণের সুযোগের কথা। ১৯৭২ সালে যে ভুল রাষ্ট্র করেছিলো সেটা শোধরানোর সুযোগ তৈরি হয়েছে ২৪ এর গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে। একাত্তরের পরে সদ্য স্বাধীন দেশে সেই সময়ে তৎকালীন গণপরিষদের সদস্য এম এন লারমা বারবার দাবি তুলেছিলেন। তার পরের ইতিহাস আমরা সবাই জানি। ৭২ থেকে ২০২৫ মাঝখানে ৫৪ বছর পেরিয়ে গেলেও সেই সমস্যার সমাধান এখনও হয়নি। সুযোগ আসেনি বিষয়টি এমন নয়। নানা প্রয়োজনে এমনকি রাজনৈতিক দলের ও ব্যক্তির স্বার্থে গত ৫৪ বছরে ১৭ বার সংবিধানের সংশোধন হয়েছে কিন্তু বরাবরের মতো উপেক্ষিত থেকেছে আদিবাসীদের স্বীকৃতির দাবিটি।

৬. এখন প্রশ্ন হলোÑ কেন এমন হলো? উত্তরটি কমবেশি সকলের জানা আছে। উগ্র জাতীয়তাবাদ ও সাম্প্রদায়িক মনোভাব তার অন্যতম প্রধান কারণ। নিপীড়নের শিকার বাঙালি জাতির নিপীড়কের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে বেশিদিন লাগেনি! এক্ষেত্রে দুটি উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। একটি হচ্ছে এই জাতি ৫২-এর ভাষা আন্দোলনে নিজের ভাষার জন্য সংগ্রাম করে জীবন দিয়েছে অথচ সেই জাতি এখন পর্যন্ত দেশের অপরাপর আদিবাসী জনগোষ্ঠীর ভাষার সাংবিধানিক মর্যাদা দিতে ব্যর্থ হয়েছে। দ্বিতীয় উদাহরণটি হচ্ছে জাতিগত নিপীড়ন ও বৈষম্য। ৪৭ পরবর্তী যে জাতিগত বৈষম্য ও নিপীড়নের কারণে ৭১-এর মুক্তি যুদ্ধের অবতরণ হয়েছে সেই জাতি স্বাধীনতা অর্জনের পর নিজেরাই অন্য জাতির উপর শুরু করে নিপীড়ন ও বৈষম্যেও; যা চলমান রয়েছে।

৭. এবার মূল প্রসঙ্গে ফিরে আসা যাক। গত ৫৪ বছর যাবৎ যে ভুল রাষ্ট্র আদিবাসীদের ওপর করেছে তার শোধরানোর সুযোগ তৈরি হয়েছে এবার। বৈষম্য দূর করার যে মূলমন্ত্র নিয়ে গত জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সূচনা হয়েছিল সেই নতুন বাংলাদেশে আদিবাসীদের সাংবিধানিক অধিকার প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে রাষ্ট্র পারে তার ঐতিহাসিক দায় থেকে নিজেকে মুক্ত করতে। আবার পুরনো প্রশ্ন। রাষ্ট্র কি সেটা করবে? অথবা করার মতো পরিস্থিতি আছে কি? প্রশ্ন দুটির উত্তর অজানা। বিগত এক বছরের হিসেব বলছে রাষ্ট্র এবারও সেই একই ভুল পথে হাঁটছে। যার বাস্তব প্রমাণ হলো এই সরকারের বিভিন্ন সংস্কার কমিশনে আদিবাসীদের অন্তর্ভুক্ত না করা। এমনকি গত এক বছরে কোনো ধরনের সংলাপ বা মতামত নেওয়ার জন্য আদিবাসীদের একটিবারের জন্যও ডাকা হয়নি। অতীতের মতো এবারও তারা উপেক্ষিত। তাহলে ফলাফল কী দাঁড়ায়? এই রাষ্ট্র আদিবাসীদের স্বীকার করে না! কিন্তু এটাই শেষ কথা নয়! আমি বিশ্বাস করি আজ নয়তো আগামীকাল রাষ্ট্রকে তার বাস্তবতা মেনে নিতে হবে এবং দেশের আদিবাসী মানুষের স্বীকৃতি দিতে হবে।

৮. গত জুলাই আগস্ট পরবর্তী বাংলাদেশ একটি নতুন সুযোগ ও সম্ভাবনা তৈরি করেছে। বৈষম্যহীন বাংলাদেশ বিনির্মাণে ছাত্র জনতা নিজেদের আত্মত্যাগের মাধ্যমে অপার সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে। পাহাড় ও সমতলের আদিবাসী ছাত্র সমাজ, যুব সমাজ, সংগঠন সর্বোপরি আদিবাসী জনতা একত্রিত হয়ে কাজ করতে হবে। মনে রাখতে হবে, সুযোগ ও সম্ভাবনা বারবার আসে না। সমগ্র বাংলাদেশের জন্য যেমন একটি সুযোগ তৈরি হয়েছে তেমনি আদিবাসীদের জন্যও। এখনই উত্তম সময় নিজেদের অধিকার আদায়ের জন্য কাজ করা। পাহাড় ও সমতলের ছাত্র সমাজ এক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা রাখতে পারে।

তাই আসুন সবাই মিলে নিজেদের অধিকার বুঝে নেই। রাষ্টটি আমাদের তাই নিজেদের অধিকার নিজেদের নিশ্চিত করতে হবে। অন্যকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। দোষ দেওয়া সমাধান নয়, বরং সহযোগিতা সমাধানের উপায় হতে পারে। এই সরকারের মূল কাজ রাষ্ট্রের সংস্কার করা। ৫৪ বছরের ঝঞ্ঝাট বৈষম্য থেকে জনগণকে মুক্ত করা। কাজটি সহজ নয়। আমরা আদিবাসীরা রাষ্ট্র সংস্কারের এই মহৎ কাজে যুক্ত থাকতে চাই। আমাদের ওপর দীর্ঘদিন ধরে চলমান সব বৈষম্যের অবসান চাই। সংবিধানে আমাদের স্বীকৃতি চাই। আদিবাসীদের আত্মপরিচয়ের সংকটের অবসান চাই। সমতলের আদিবাসীদের জন্য মন্ত্রণালয় ও ভূমি কমিশন আইন তৈরির কাজ শুরু হোক। পাহাড়ের বন্ধুদের দীর্ঘ লড়াইয়ের ফসল পার্বত্য চুক্তির বাস্তবায়ন চাই।

সর্বোপরি, আমরা আদিবাসীরা দেশের হুমকি নই, সম্পদ হয়ে অবদান রাখতে চাই। যে সুযোগ ছাত্র-জনতা আত্মত্যাগের বিনিময়ে তৈরি করেছে আমরা যেন সেই সুযোগ অবহেলায় হাতছাড়া না করি। এবার এই সুযোগ হাড়ালে ইতিহাস আমাদেও কাউকে ক্ষমা করবে না! রাষ্ট্র হয়ে উঠুক জনগণের, আদিবাসীদের, সবার! কারণ, দায় যার ঘোচানোর দায়িত্বও তারই।

[লেখক : সদস্য সচিব, সমতল আদিবাসী অধিকার আন্দোলন]

back to top