শুভাশিস ব্যানার্জি শুভ
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ধারাবাহিকতার একপর্যায়ে ১৯৪৫ সালের ৬ আগস্ট মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিমান-বহর সম্পূর্ণ অমানবিকভাবে পারমাণবিক বোমা নিক্ষেপ করে জাপানের হিরোসিমা শহরে। চোখের পলকে ধ্বংস হয় শহরটির সিংহভাগ। প্রাণ হারায় ১৫ হাজার নিরপরাধ নিরীহ বেসামরিক মানুষ। পৃথিবীর ইতিহাসে এ ঘটনার মধ্য দিয়ে সৃষ্টি হয় প্রথম পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের ঘটনা। বর্বোরচিত এ ঘটনার মাত্র ৩ দিন পর অর্থাৎ ৯ আগস্ট একইভাবে মার্কিন যুদ্ধবিমান পারমাণবিক বোমা ফেলে জাপানের আরেকটি শহর নাগাসাকিতে।
বোমাটির বৈজ্ঞানিক নাম দেয়া হয় ‘দি ফ্যাট ম্যান’। পারমাণবিক বোমার আঘাতে ভস্ম হয়ে যায় নাগাসাকি শহরের এক-তৃতীয়াংশ। ৮০ হাজারেরও বেশি নিরাপরাধ নিরীহ মানুষ প্রাণ হারিয়ে বোমার আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যায়। এই ধ্বংসযজ্ঞ এতো বিশাল যে ক্ষয়-ক্ষতির প্রকৃত হিসাব ছিলো প্রায় অসম্ভব। তারপরও হিসাব করে দেখা গেছে নাগাসাকির ঘটনার মৃতের সংখ্যা ছিলো প্রায় ৭৩ হাজার ৮৮৪ জন, আহত ৭৪ হাজার ৯০৯ জন, নিঃস্ব হয় ১ লাখ ২০ হাজার ৮২০ জন আর গৃহ ক্ষতিগ্রস্ত হয় ১৮ হাজার ৪০৯টি।
এসব ক্ষতিগ্রস্ত গৃহের মধ্যে ১১ হাজার ৫৭৮টি পুড়ে ছাই হয়ে যায়। ১ হাজার ৩২৬টি চুরমার হয়ে যায় পুরোপুরি আর ৫ হাজার ৫০৯টি চুরমার হয় আংশিকভাবে। নাগাসাকির তৎকালীন মোট জনসংখ্যা অর্থাৎ ২ লাখ ১০ হাজার মানুষের মধ্যে ১ লাখ ৫০ হাজার মানুষ নিহত ও আহত হয়। গাণিতিক হিসেবে এই সংখ্যা শতকরা ৭১.৪ শতাংশ।
আকস্মিক এবং অকল্পনীয় এই ধ্বংসযজ্ঞের ক্ষেত্রে উদ্ধার কার্যক্রম মূলত তেমন কোন প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি। যারা কোনোভাবে প্রাণে বেঁচে যায় তারাও প্রকৃত চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হয়। কারণ তৎকালীন ডাক্তারদের এ ধরনের বোমার তেজস্ক্রিয়তা সম্পর্কে কোন স্বচ্ছ ধারণা ছিলো না। আর তাই, ঘটনা ঘটার পরও দিনের পর দির ক্রমান্বয়ে মৃতের সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে বাড়তে থাকে। পরবর্তীতে বোমাক্রান্তদের একটি তালিকা তৈরি করা হয়। সেই তালিকা অনুযায়ী তাদের মধ্যে বিতরণ করা হয় ‘স্বাস্থ্য কার্ড’, যার ফলে তারা সবাই আজীবন অবৈতনিক চিকিৎসা পাবে।
এখনো প্রায় ৩০ হাজারের মতো বোমাক্রান্ত কার্ডধারী মানুষ আছে যাদের শরীরে রয়েছে বোমার তেজস্ক্রিয়তার বিষ! পারমাণবিক বোমা নিক্ষেপের দ্বিতীয় এ ঘটনাটি পৃথিবীর ইতিহাসে দ্বিতীয় পারমাণবিক বোমা ব্যবহারের ঘটনা। শুধু জাপানিরা নয়,পৃথিবীর সকল মানুষ এখনো শিউরে ওঠে এই ঘটনার কথা মনে করে বা নতুন করে জেনে।
এই দুটি বোমা হামলার মধ্য দিয়ে সভ্যতার আবিষ্কারে কালিমা লেপন করা হয়, যা বিশ্বব্যাপী এক ঘৃণার ইতিহাস সৃষ্টি করে। দীর্ঘমেয়াদি তেজস্ক্রিয়তার কারণে পরের বেশ কয়েকটি বছর ক্রমাগত মৃত্যুর কোলে শামিল হয় আরো ১ লাখ ৩০ হাজার লোক। এখনো জাপানের অধিবাসী সেই তেজস্ক্রিয়তার মাশুল দিয়ে যাচ্ছেন।
জাপানের হিরোশিমা-নাগাসাকিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আনবিক বোমা হামলার পর পার হয়েছে বহু বছর। প্রতি বছর ৬ ও ৯ আগস্ট ঘুরে ঘুরে আসে। যুক্তরাষ্ট্রের নিমর্মতার কথা জাপানিরা কোনো দিন ভুলতে পারবে না।
আনবিক বোমা লিটল বয়ের ধ্বংসযজ্ঞ এতই নির্মম ছিলো যে, সে দিন এ বোমাটি ২ কিলোমিটারের মধ্যে যতগুলো কাঠের স্থাপনা ছিল সবগুলোকে মাটির সাথে সমতল করে দেয়। সেখানে ৫০০ মিটার বৃত্তের মধ্যে আলিশান দালানগুলো চোখের পলকে নেতিয়ে পড়ে। ৫ বর্গমাইল এলাকা মোটামুটি ছাই এবং ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছিল।
পারমাণবিক শক্তির ওপর নির্ভরতা কমানোর অঙ্গীকার নিয়ে নাগাসাকিতে পারমাণবিক বোমা হামলার বার্ষিকী পালন হয় প্রতি বছর। তেজস্ক্রিয় বিকিরণের ভয়াবহতা আজও বয়ে বেড়াচ্ছেন নাগাসাকির লাখ লাখ মানুষ। আজও সেখানে জন্ম হচ্ছে বিকলাঙ্গ শিশুর। প্রশ্ন জাগে সেই দুঃসহ স্মৃতি বিশ্ব শক্তিধরদের পারমাণবিক শক্তির নির্ভরতা কমিয়ে আনার পথে ফিরিয়ে আনতে পারবে তো?
[লেখক : সংবাদকর্মী]
শুভাশিস ব্যানার্জি শুভ
শনিবার, ০৯ আগস্ট ২০২৫
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ধারাবাহিকতার একপর্যায়ে ১৯৪৫ সালের ৬ আগস্ট মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিমান-বহর সম্পূর্ণ অমানবিকভাবে পারমাণবিক বোমা নিক্ষেপ করে জাপানের হিরোসিমা শহরে। চোখের পলকে ধ্বংস হয় শহরটির সিংহভাগ। প্রাণ হারায় ১৫ হাজার নিরপরাধ নিরীহ বেসামরিক মানুষ। পৃথিবীর ইতিহাসে এ ঘটনার মধ্য দিয়ে সৃষ্টি হয় প্রথম পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের ঘটনা। বর্বোরচিত এ ঘটনার মাত্র ৩ দিন পর অর্থাৎ ৯ আগস্ট একইভাবে মার্কিন যুদ্ধবিমান পারমাণবিক বোমা ফেলে জাপানের আরেকটি শহর নাগাসাকিতে।
বোমাটির বৈজ্ঞানিক নাম দেয়া হয় ‘দি ফ্যাট ম্যান’। পারমাণবিক বোমার আঘাতে ভস্ম হয়ে যায় নাগাসাকি শহরের এক-তৃতীয়াংশ। ৮০ হাজারেরও বেশি নিরাপরাধ নিরীহ মানুষ প্রাণ হারিয়ে বোমার আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যায়। এই ধ্বংসযজ্ঞ এতো বিশাল যে ক্ষয়-ক্ষতির প্রকৃত হিসাব ছিলো প্রায় অসম্ভব। তারপরও হিসাব করে দেখা গেছে নাগাসাকির ঘটনার মৃতের সংখ্যা ছিলো প্রায় ৭৩ হাজার ৮৮৪ জন, আহত ৭৪ হাজার ৯০৯ জন, নিঃস্ব হয় ১ লাখ ২০ হাজার ৮২০ জন আর গৃহ ক্ষতিগ্রস্ত হয় ১৮ হাজার ৪০৯টি।
এসব ক্ষতিগ্রস্ত গৃহের মধ্যে ১১ হাজার ৫৭৮টি পুড়ে ছাই হয়ে যায়। ১ হাজার ৩২৬টি চুরমার হয়ে যায় পুরোপুরি আর ৫ হাজার ৫০৯টি চুরমার হয় আংশিকভাবে। নাগাসাকির তৎকালীন মোট জনসংখ্যা অর্থাৎ ২ লাখ ১০ হাজার মানুষের মধ্যে ১ লাখ ৫০ হাজার মানুষ নিহত ও আহত হয়। গাণিতিক হিসেবে এই সংখ্যা শতকরা ৭১.৪ শতাংশ।
আকস্মিক এবং অকল্পনীয় এই ধ্বংসযজ্ঞের ক্ষেত্রে উদ্ধার কার্যক্রম মূলত তেমন কোন প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি। যারা কোনোভাবে প্রাণে বেঁচে যায় তারাও প্রকৃত চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হয়। কারণ তৎকালীন ডাক্তারদের এ ধরনের বোমার তেজস্ক্রিয়তা সম্পর্কে কোন স্বচ্ছ ধারণা ছিলো না। আর তাই, ঘটনা ঘটার পরও দিনের পর দির ক্রমান্বয়ে মৃতের সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে বাড়তে থাকে। পরবর্তীতে বোমাক্রান্তদের একটি তালিকা তৈরি করা হয়। সেই তালিকা অনুযায়ী তাদের মধ্যে বিতরণ করা হয় ‘স্বাস্থ্য কার্ড’, যার ফলে তারা সবাই আজীবন অবৈতনিক চিকিৎসা পাবে।
এখনো প্রায় ৩০ হাজারের মতো বোমাক্রান্ত কার্ডধারী মানুষ আছে যাদের শরীরে রয়েছে বোমার তেজস্ক্রিয়তার বিষ! পারমাণবিক বোমা নিক্ষেপের দ্বিতীয় এ ঘটনাটি পৃথিবীর ইতিহাসে দ্বিতীয় পারমাণবিক বোমা ব্যবহারের ঘটনা। শুধু জাপানিরা নয়,পৃথিবীর সকল মানুষ এখনো শিউরে ওঠে এই ঘটনার কথা মনে করে বা নতুন করে জেনে।
এই দুটি বোমা হামলার মধ্য দিয়ে সভ্যতার আবিষ্কারে কালিমা লেপন করা হয়, যা বিশ্বব্যাপী এক ঘৃণার ইতিহাস সৃষ্টি করে। দীর্ঘমেয়াদি তেজস্ক্রিয়তার কারণে পরের বেশ কয়েকটি বছর ক্রমাগত মৃত্যুর কোলে শামিল হয় আরো ১ লাখ ৩০ হাজার লোক। এখনো জাপানের অধিবাসী সেই তেজস্ক্রিয়তার মাশুল দিয়ে যাচ্ছেন।
জাপানের হিরোশিমা-নাগাসাকিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আনবিক বোমা হামলার পর পার হয়েছে বহু বছর। প্রতি বছর ৬ ও ৯ আগস্ট ঘুরে ঘুরে আসে। যুক্তরাষ্ট্রের নিমর্মতার কথা জাপানিরা কোনো দিন ভুলতে পারবে না।
আনবিক বোমা লিটল বয়ের ধ্বংসযজ্ঞ এতই নির্মম ছিলো যে, সে দিন এ বোমাটি ২ কিলোমিটারের মধ্যে যতগুলো কাঠের স্থাপনা ছিল সবগুলোকে মাটির সাথে সমতল করে দেয়। সেখানে ৫০০ মিটার বৃত্তের মধ্যে আলিশান দালানগুলো চোখের পলকে নেতিয়ে পড়ে। ৫ বর্গমাইল এলাকা মোটামুটি ছাই এবং ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছিল।
পারমাণবিক শক্তির ওপর নির্ভরতা কমানোর অঙ্গীকার নিয়ে নাগাসাকিতে পারমাণবিক বোমা হামলার বার্ষিকী পালন হয় প্রতি বছর। তেজস্ক্রিয় বিকিরণের ভয়াবহতা আজও বয়ে বেড়াচ্ছেন নাগাসাকির লাখ লাখ মানুষ। আজও সেখানে জন্ম হচ্ছে বিকলাঙ্গ শিশুর। প্রশ্ন জাগে সেই দুঃসহ স্মৃতি বিশ্ব শক্তিধরদের পারমাণবিক শক্তির নির্ভরতা কমিয়ে আনার পথে ফিরিয়ে আনতে পারবে তো?
[লেখক : সংবাদকর্মী]