বাবুল রবিদাস
ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর শিশুদের জন্ম ও বেড়ে ওঠা অন্য সাধারণ শিশুর চেয়ে ভিন্ন পরিবেশে ঘটে, যা তাদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশে গভীর প্রভাব ফেলে। গর্ভাবস্থায় মায়েদের পুষ্টির অভাব, আধুনিক চিকিৎসার অভাব এবং প্রচলিত কুসংস্কারের কারণে গর্ভস্থ শিশুর ওজন ও পুষ্টির মাত্রা অনিয়মিত হয়। অনেক ক্ষেত্রে গর্ভবতী মায়ের কাছ থেকে সুষম খাদ্য বা নিয়মিত চিকিৎসাসেবা না নিয়ে ওঝা বা বৈদ্যের ঝাড়-ফুঁক করানো হয়। এতে শিশুর শারীরিক দুর্বলতা সৃষ্টি হয় এবং তারা জন্মের পর অপুষ্টিতে ভুগে। শিশুর প্রথম কান্না বা অসুস্থতাকে ভূত-প্রেতের ছায়ায় দেখা হয়, ফলে শিশুর পাশে পর্যাপ্ত শারীরিক যতœ না নিয়ে নানা রকম রকম জাদুটোনা ও কুসংস্কারে তাদের দুর্বিষহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়।
এই কুসংস্কারগুলোর মধ্যে রয়েছেÑ ঘরের মধ্যে আগুন জ্বালা, ধূপ-ধোঁয়া দেয়া, জানালায় কাঁটা জাতীয় জিনিস টাঙানো, শিশুকে পশুর চামড়া বা ছেঁড়া কাপড় দিয়ে মুড়িয়ে রাখা, গরম তৈল বা রসুন-পিঁয়াজ মিশিয়ে শরীর মাখানো, এমনকি শিশুর পায়ের কাছে ছুরি, লোহা রাখার মতো অসংগতিপূর্ণ প্রথা। এই সবের ফলে শিশুর শ্বাস-প্রশ্বাসের পরিমাণ কমে যায় এবং তারা ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়ে। এ সময়ে প্রসূতিকে উন্নত ও পুষ্টিকর খাদ্য না দিয়ে বিভিন্ন বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়, যার ফলে মা-শিশু উভয়ের স্বাস্থ্যে সংকট সৃষ্টি হয়।
শিশুর মানসিক ও শারীরিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হওয়ায়, শিশুরা বড় হয়ে বিদ্যালয়ে গেলে ভাষাগত ও সামাজিক সমস্যার মুখোমুখি হয়। তাদের মাতৃভাষায় সীমাবদ্ধ থাকা, নতুন পরিবেশে ভয়, ভীতি এবং সহপাঠীদের অবজ্ঞা ও উপহাসে পড়া তাদের শিক্ষায় আগ্রহ হ্রাস করে। ভাষাগত সমস্যাকে ‘উভয় সংকট’ বলা হয়, যেখানে শিক্ষক ও ছাত্র উভয়ের ভাষায় বোঝাপড়া কম থাকে। এই সংকটের ফলে অনেক আদিবাসী শিশু প্রাথমিক বিদ্যালয়েই শিক্ষাজীবন ত্যাগ করে দেয়।
অর্থনৈতিক দিক থেকেও আদিবাসী পরিবারগুলো দুস্থ। দিনমজুর শ্রমিকরা দিনের আয়ের জন্য পরিশ্রম করতে গিয়ে শিশুদের লেখাপড়ার সুযোগ দিতে পারেন না। অনেক সময় শিশুদের পিঠে বেঁধে মাঠে কাজ করাতে দেখা যায়, যেখানে শিশুর শারীরিক ক্ষতি এবং শিক্ষার অনুপস্থিতি একসঙ্গে চলে। পিতা-মাতার অসচেতনতা, শিক্ষার অভাব এবং সামাজিক অবস্থানের নিম্নতার কারণে শিশুরা প্রয়োজনীয় শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার বাইরে পড়ে যায়।
ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর নেতাদের মধ্যে শিক্ষানীতির ব্যাপারে মতবিরোধ রয়েছে। কেউ বাংলা হরফে শিক্ষার পক্ষে, কেউ রোমান হরফে বা অলচিকি হরফে শিক্ষার পক্ষে। কিন্তু এই বিভাজন একত্রে বসে যুক্তিতর্ক করে সমাধানের পরিবর্তে আদিবাসী শিশুদের ক্ষতি করছে। শিশুদের প্রাথমিক শিক্ষা বাংলা হরফে শুরু করা সবচেয়ে কার্যকর, কারণ বাংলা ভাষা শেখা ও পড়া সহজ ও অধিক পরিচিত। অন্যান্য হরফে শিক্ষা দিলে শিশুদের শিক্ষা গ্রহণে সমস্যা দেখা দেয় যা তাদের পিছিয়ে পড়ার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
শিক্ষার পাশাপাশি আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির শিক্ষা দেয়া এখন অত্যন্ত জরুরি। ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর অধিকাংশ শিশু ও তরুণের এ সুযোগ নেই। প্রযুক্তিগত দক্ষতা না থাকায় তারা আধুনিক জীবনের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। তাই তথ্য প্রযুক্তি শিক্ষা প্রদান এবং আধুনিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা অপরিহার্য। এছাড়া স্কুলের খরচ, পাঠ্যপুস্তক, ক্যালেন্ডার, পেনসিল, পোশাক ইত্যাদির জন্য আর্থিক সহায়তা প্রয়োজন।
অর্থনৈতিক দুরবস্থার কারণে শিশুরা মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারে না। মায়েদের শিক্ষার অভাব পারিবারিক শিক্ষার পরিবেশকেও দুর্বল করে দেয়, যা শিশুর মানসিক ও শারীরিক বিকাশে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। পারিপার্শ্বিকতায় মাদকাসক্তি, নেশা জাতীয় প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা শিশুকে নেতিবাচক পথে পরিচালিত করছে।
সামাজিকভাবে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর প্রতি বৈষম্য, অবজ্ঞা ও ঘৃণার কারণে শিশুদের আত্মবিশ্বাস নষ্ট হয়। তাদের সাথে সহানুভূতিশীল হতে সমাজকে উৎসাহিত করতে হবে। ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর ঐক্য ও নেতাদের দূরদর্শিতার অভাবে শিশুদের ক্ষতি হয়। তাই সব পক্ষের মধ্যে সংলাপ ও সমঝোতার মাধ্যমে শিক্ষানীতির স্থিরতা জরুরি।
ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর শিশুদের সার্বিক উন্নয়নে সরকার ও বেসরকারি সংস্থাগুলোকে একযোগে কাজ করতে হবে। তাদের জন্য পুষ্টি, স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা এবং সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। শিশুরা যাতে বৈষম্য থেকে মুক্ত হয়ে উন্নত জীবনযাপন করতে পারে, সেই দায়িত্ব আমাদের সকলের। শিশুদের সহায়তায় সচেতনতা বৃদ্ধি ও সামাজিক সমর্থন প্রদান করতে সমাজের প্রতিটি স্তরের মানুষকে এগিয়ে আসতে হবে।
[লেখক : আইনজীবী, জজ কোর্ট, জয়পুরহাট]
বাবুল রবিদাস
শনিবার, ০৯ আগস্ট ২০২৫
ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর শিশুদের জন্ম ও বেড়ে ওঠা অন্য সাধারণ শিশুর চেয়ে ভিন্ন পরিবেশে ঘটে, যা তাদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশে গভীর প্রভাব ফেলে। গর্ভাবস্থায় মায়েদের পুষ্টির অভাব, আধুনিক চিকিৎসার অভাব এবং প্রচলিত কুসংস্কারের কারণে গর্ভস্থ শিশুর ওজন ও পুষ্টির মাত্রা অনিয়মিত হয়। অনেক ক্ষেত্রে গর্ভবতী মায়ের কাছ থেকে সুষম খাদ্য বা নিয়মিত চিকিৎসাসেবা না নিয়ে ওঝা বা বৈদ্যের ঝাড়-ফুঁক করানো হয়। এতে শিশুর শারীরিক দুর্বলতা সৃষ্টি হয় এবং তারা জন্মের পর অপুষ্টিতে ভুগে। শিশুর প্রথম কান্না বা অসুস্থতাকে ভূত-প্রেতের ছায়ায় দেখা হয়, ফলে শিশুর পাশে পর্যাপ্ত শারীরিক যতœ না নিয়ে নানা রকম রকম জাদুটোনা ও কুসংস্কারে তাদের দুর্বিষহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়।
এই কুসংস্কারগুলোর মধ্যে রয়েছেÑ ঘরের মধ্যে আগুন জ্বালা, ধূপ-ধোঁয়া দেয়া, জানালায় কাঁটা জাতীয় জিনিস টাঙানো, শিশুকে পশুর চামড়া বা ছেঁড়া কাপড় দিয়ে মুড়িয়ে রাখা, গরম তৈল বা রসুন-পিঁয়াজ মিশিয়ে শরীর মাখানো, এমনকি শিশুর পায়ের কাছে ছুরি, লোহা রাখার মতো অসংগতিপূর্ণ প্রথা। এই সবের ফলে শিশুর শ্বাস-প্রশ্বাসের পরিমাণ কমে যায় এবং তারা ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়ে। এ সময়ে প্রসূতিকে উন্নত ও পুষ্টিকর খাদ্য না দিয়ে বিভিন্ন বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়, যার ফলে মা-শিশু উভয়ের স্বাস্থ্যে সংকট সৃষ্টি হয়।
শিশুর মানসিক ও শারীরিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হওয়ায়, শিশুরা বড় হয়ে বিদ্যালয়ে গেলে ভাষাগত ও সামাজিক সমস্যার মুখোমুখি হয়। তাদের মাতৃভাষায় সীমাবদ্ধ থাকা, নতুন পরিবেশে ভয়, ভীতি এবং সহপাঠীদের অবজ্ঞা ও উপহাসে পড়া তাদের শিক্ষায় আগ্রহ হ্রাস করে। ভাষাগত সমস্যাকে ‘উভয় সংকট’ বলা হয়, যেখানে শিক্ষক ও ছাত্র উভয়ের ভাষায় বোঝাপড়া কম থাকে। এই সংকটের ফলে অনেক আদিবাসী শিশু প্রাথমিক বিদ্যালয়েই শিক্ষাজীবন ত্যাগ করে দেয়।
অর্থনৈতিক দিক থেকেও আদিবাসী পরিবারগুলো দুস্থ। দিনমজুর শ্রমিকরা দিনের আয়ের জন্য পরিশ্রম করতে গিয়ে শিশুদের লেখাপড়ার সুযোগ দিতে পারেন না। অনেক সময় শিশুদের পিঠে বেঁধে মাঠে কাজ করাতে দেখা যায়, যেখানে শিশুর শারীরিক ক্ষতি এবং শিক্ষার অনুপস্থিতি একসঙ্গে চলে। পিতা-মাতার অসচেতনতা, শিক্ষার অভাব এবং সামাজিক অবস্থানের নিম্নতার কারণে শিশুরা প্রয়োজনীয় শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার বাইরে পড়ে যায়।
ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর নেতাদের মধ্যে শিক্ষানীতির ব্যাপারে মতবিরোধ রয়েছে। কেউ বাংলা হরফে শিক্ষার পক্ষে, কেউ রোমান হরফে বা অলচিকি হরফে শিক্ষার পক্ষে। কিন্তু এই বিভাজন একত্রে বসে যুক্তিতর্ক করে সমাধানের পরিবর্তে আদিবাসী শিশুদের ক্ষতি করছে। শিশুদের প্রাথমিক শিক্ষা বাংলা হরফে শুরু করা সবচেয়ে কার্যকর, কারণ বাংলা ভাষা শেখা ও পড়া সহজ ও অধিক পরিচিত। অন্যান্য হরফে শিক্ষা দিলে শিশুদের শিক্ষা গ্রহণে সমস্যা দেখা দেয় যা তাদের পিছিয়ে পড়ার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
শিক্ষার পাশাপাশি আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির শিক্ষা দেয়া এখন অত্যন্ত জরুরি। ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর অধিকাংশ শিশু ও তরুণের এ সুযোগ নেই। প্রযুক্তিগত দক্ষতা না থাকায় তারা আধুনিক জীবনের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। তাই তথ্য প্রযুক্তি শিক্ষা প্রদান এবং আধুনিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা অপরিহার্য। এছাড়া স্কুলের খরচ, পাঠ্যপুস্তক, ক্যালেন্ডার, পেনসিল, পোশাক ইত্যাদির জন্য আর্থিক সহায়তা প্রয়োজন।
অর্থনৈতিক দুরবস্থার কারণে শিশুরা মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারে না। মায়েদের শিক্ষার অভাব পারিবারিক শিক্ষার পরিবেশকেও দুর্বল করে দেয়, যা শিশুর মানসিক ও শারীরিক বিকাশে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। পারিপার্শ্বিকতায় মাদকাসক্তি, নেশা জাতীয় প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা শিশুকে নেতিবাচক পথে পরিচালিত করছে।
সামাজিকভাবে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর প্রতি বৈষম্য, অবজ্ঞা ও ঘৃণার কারণে শিশুদের আত্মবিশ্বাস নষ্ট হয়। তাদের সাথে সহানুভূতিশীল হতে সমাজকে উৎসাহিত করতে হবে। ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর ঐক্য ও নেতাদের দূরদর্শিতার অভাবে শিশুদের ক্ষতি হয়। তাই সব পক্ষের মধ্যে সংলাপ ও সমঝোতার মাধ্যমে শিক্ষানীতির স্থিরতা জরুরি।
ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর শিশুদের সার্বিক উন্নয়নে সরকার ও বেসরকারি সংস্থাগুলোকে একযোগে কাজ করতে হবে। তাদের জন্য পুষ্টি, স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা এবং সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। শিশুরা যাতে বৈষম্য থেকে মুক্ত হয়ে উন্নত জীবনযাপন করতে পারে, সেই দায়িত্ব আমাদের সকলের। শিশুদের সহায়তায় সচেতনতা বৃদ্ধি ও সামাজিক সমর্থন প্রদান করতে সমাজের প্রতিটি স্তরের মানুষকে এগিয়ে আসতে হবে।
[লেখক : আইনজীবী, জজ কোর্ট, জয়পুরহাট]