রেজাউল করিম খোকন
প্রশ্ন হলো, কৃষক কিংবা উদ্যোক্তাদের জন্য নীতি ও সহায়ক পরিবেশ কোথায়?
বাংলাদেশের চাষি-কৃষকদের বারোমাস্য দুর্ভোগ, দুর্যোগ ও বিপর্যয় শতাব্দীপ্রাচীন। ‘গোলা ভরা ধান, গোয়াল ভরা গরু’Ñএমন মিথ ঐতিহাসিক কোনো কালপর্বেই খুব একটা প্রমাণ পায়নি; বরং চর্যাপদের ‘হাড়ীত ভাত নাহিঁ নিতি আবেশী’ কিংবা অন্নদা মঙ্গলের ‘আমার সন্তান যেন থাকে দুধে-ভাতে’Ñএর মতো আকুতিই শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে শোনা গেছে। অথচ এই কৃষকের উৎপাদিত ফসলের উদ্বৃত্ত নিয়েই পাল, সেন, খিলজি, মোগলদের শান-শওকত গড়ে উঠেছিল। কৃষকের এই দুর্দশা স্থায়ী রূপ পায় ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক প্রভুদের হাতে চালু হওয়া চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মাধ্যমে। এর ফলে ব্রিটিশ শাসক ও বাংলার কৃষকদের মধ্যে জমিদার, জোতদার, নায়েব, বরকন্দাজের মতো কয়েক স্তরের মধ্যস্বত্বভোগী তৈরি হয়। এদের সবার ‘খাই’ মেটাতে উৎপাদকশ্রেণী কৃষক নিঃস্ব থেকে নিঃস্বতর হয়ে পড়ে।
চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রচলনের পৌনে তিন শতাব্দী পেরিয়ে গেছে। ব্রিটিশ ও পাকিস্তানিদের হাত থেকে দুই দফায় স্বাধীনতা অর্জন করেছি। এ বছর আমরা স্বাধীনতার ৫৪তম বর্ষ উদযাপন করলাম। কিন্তু আমাদের কৃষকরা কি মধ্যস্বত্বভোগীদের সেই ‘চিরস্থায়ী দৌরাত্ম্য’ থেকে কতটা মুক্তি পেয়েছে? এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে মুক্তবাজার অর্থনীতির নামে বাংলাদেশে গড়ে ওঠা ক্রনি ক্যাপিটালিজম বা স্বজনতোষী অর্থনীতি। রাজনৈতিক, প্রশাসনিক কিংবা অন্য কোনো ক্ষমতাতন্ত্রের সঙ্গে যুক্ত একটি অংশের ফুলেফেঁপে ওঠার সব আইন, বিধি ও শর্ত এখানে উপস্থিত। এই ব্যবস্থায় উৎপাদক ও ভোক্তাÑদুজনই সেই সোনার ডিম দেয়া হাঁস। তাদের পেট চিরে ডিম বের করার সব আয়োজনও প্রস্তুত।
আজকাল আমাদের নীতিনির্ধারকদের মধ্যে (প্রকৃতপক্ষে যারা মধ্যস্বত্বভোগী শ্রেণীর প্রতিনিধি) একটি কথা ফ্যাশনে পরিণত হয়েছেÑকৃষিজাত উৎপাদন জিডিপিতে মাত্র ১৪-১৫ শতাংশ অবদান রাখে। কিন্তু বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য বলছে, জিডিপিতে অবদান কম হলেও ৪০ শতাংশ মানুষ এখনো কৃষির ওপর নির্ভরশীল। অর্থাৎ এককভাবে সবচেয়ে বেশি মানুষ এখনো কৃষির সঙ্গে আবদ্ধ। গত কয়েক দশকের বাংলাদেশের অর্জনে কৃষকের ভূমিকা অসামান্য। ধান ও পাটকেন্দ্রিক উৎপাদন থেকে বেরিয়ে এসে কৃষিতে বৈচিত্র্য এনে, নিজস্ব নানা উদ্ভাবনের মাধ্যমে ১৮ কোটি মানুষের খাদ্য ও পুষ্টির জোগান দিয়েছেন তারা। উদ্যোক্তার কথা যদি বলতেই হয়, তাহলে কৃষকদের চেয়ে বড় উদ্যোক্তা আর কে আছে? অথচ উৎপাদিত ফসলের ন্যায্য দাম না পেয়ে, এনজিওর কিস্তির টাকা শোধ করতে না পেরে কেউ কেউ আত্মহত্যার পথও বেছে নিয়েছেন। আবার সেই ফসল দিয়েই মধ্যস্বত্বভোগীরা বিপুল মুনাফা গড়ে তুলছেন।
এখানে বড় প্রশ্ন হলোÑকৃষক কিংবা উদ্যোক্তাদের জন্য নীতি ও সহায়ক পরিবেশ কোথায়? বাংলাদেশে উৎপাদকদের অবস্থা নিয়ে একটি ধারণা প্রচলিত হয়েছেÑ ‘যদি তুমি উৎপাদক হও, তাহলে তুমি শেষ; যদি তুমি বেনিয়া হও, তাহলেই সামনে তোমার দিন।’
ভারতকে নাড়া দেয়া কৃষক আন্দোলনে দেশটির প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি কৃষকদের কাছে করজোড়ে ক্ষমা চেয়ে বিতর্কিত কৃষি বিল থেকে সরে এসেছিলেন। ওই বিলে কৃষকদের বড় করপোরেটদের মর্জির ওপর নির্ভরশীল করে রাখার চেষ্টা ছিল। কৃষকেরা যে ন্যূনতম সহায়ক মূল্য (উৎপাদন খরচ ও মুনাফা) পেয়ে আসছিলেন, তা বাতিল হয়ে যেত। পাঞ্জাব, উত্তর প্রদেশসহ ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের কৃষকরা এক বছরেরও বেশি সময় ধরে শীত, গরম, বৃষ্টিতে ভিজে রাজপথে আন্দোলন করেছেন। তাদের দাবি মেনে নেয় সরকার। বামপন্থী দল, কংগ্রেসসহ বেশির ভাগ বিরোধী দল, ছাত্র, বুদ্ধিজীবী, নারী, সাধারণ মানুষ কৃষকদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। খাবার, ওষুধ, কাপড় দিয়ে সহযোগিতা করেছেন। সেখানে কৃষকদের সমর্থনে অভূতপূর্ব সংহতি তৈরি হয়েছিল।
কিন্তু বাংলাদেশে? রাষ্ট্রীয় পর্যায় থেকে শুরু করে সবখানেই কৃষকরা যেন হাওয়া হয়ে গেছেন। জাতীয় সংসদে তাদের প্রতিনিধি কি থাকে? রাজনৈতিক দলগুলোর কৃষকদের জন্য আলাদা সংগঠন থাকলেও সেখানে কৃষকের প্রতিনিধিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় না। ফলে কৃষকের কণ্ঠস্বর কোথাও শোনা যায় না। তাঁদের প্রত্যাশা জানতে চাইলে কৃষকেরা বলেন, লাভসহ উৎপাদিত ফসলের ন্যায্য মূল্য (সহায়ক দাম) চান, প্রয়োজনের সময় কৃষি ব্যাংক থেকে ঋণ চান। এই চাওয়া কি খুব বেশি?
গত দেড়-দুই দশকে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে শাকসবজি, ফলমূলসহ কৃষিজাত পণ্যের উৎপাদনে দারুণ বিপ্লব ঘটেছে। বিভিন্ন জেলায় উৎপাদন কয়েক গুণ বেড়েছে। কৃষকের হাত ধরে এগিয়ে গেছে কৃষি। কিন্তু উৎপাদন বাড়লেও মৌসুম ছাড়া বাজারে শাকসবজি, ফলমূল সহজলভ্য হয় না। এক মৌসুমের ফসলের জন্য আরেক মৌসুম পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়। উৎপাদন সূচক ঊর্ধ্বগামী হলেও দামের ক্ষেত্রে আকাশ-পাতাল ব্যবধান দেখা যায়। মৌসুমের শুরুতে যে সবজি ১০০-১৫০ টাকায় বিক্রি হয়, তা নেমে আসে ১০-২০ টাকায়। দাম না পেয়ে ক্ষেতের ফসল ক্ষেতেই পচে যায়। রাগে-ক্ষোভে কৃষকরা অনেক সময় উৎপাদিত শাকসবজি, ফলমূল ফেলে দেন। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হন কৃষক ও ভোক্তা উভয়েই।
কৃষিজাত পণ্য দীর্ঘসময় সংরক্ষণের জন্য পর্যাপ্ত হিমাগার বা সংরক্ষণাগার না থাকায় কৃষকেরা বিপুল ক্ষতির মুখে পড়েন। এই সমস্যা শুধু দেশীয় বাজারেই নয়, রপ্তানির ক্ষেত্রেও বিপর্যয় ডেকে আনে। আন্তর্জাতিক বাজারে আমাদের শাকসবজি, ফলমূলের ভালো চাহিদা থাকলেও সুষ্ঠু পরিকল্পনা ও সরকারি নজরদারির অভাবে রপ্তানিখাতও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। উৎপাদন সূচকের সঙ্গে বাজার বণ্টন, দামের ভারসাম্য ও রপ্তানি নীতি বজায় রাখতে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে আধুনিক হিমাগার ও কৃষিপণ্য সংরক্ষণাগার নির্মাণের দাবি দীর্ঘদিনের।
বিশ্ব খাদ্য সংস্থার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে ফলের বাণিজ্যিক উৎপাদন যে হারে বাড়ছে, তাতে অদূর ভবিষ্যতে অর্থনৈতিক আয়ের বড় অংশ আসবে এই খাত থেকে। বিশেষ করে পার্বত্য জেলাগুলোতে শাকসবজি, ফলমূলের উৎপাদন বেড়েছে। কিন্তু সংরক্ষণের অভাবে উৎপাদকরা অবিশ্বাস্য কম দামে পণ্য বিক্রি করতে বাধ্য হন। ফলে পচনের কারণে মান নষ্ট হয়, আর লোকসান গুনতে হয় কৃষক, ব্যবসায়ী ও রপ্তানিকারকদের।
কৃষি বিপ্লব ঘটেছেÑএতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু নানা অব্যবস্থাপনা ও সুযোগ-সুবিধার অভাবে কৃষকরা এর সুফল থেকে বঞ্চিত। কৃষি বিপ্লবের সুফল যাতে কৃষকরা পায়, তার জন্য যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ জরুরি।
[লেখক : অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার]
রেজাউল করিম খোকন
প্রশ্ন হলো, কৃষক কিংবা উদ্যোক্তাদের জন্য নীতি ও সহায়ক পরিবেশ কোথায়?
রোববার, ১০ আগস্ট ২০২৫
বাংলাদেশের চাষি-কৃষকদের বারোমাস্য দুর্ভোগ, দুর্যোগ ও বিপর্যয় শতাব্দীপ্রাচীন। ‘গোলা ভরা ধান, গোয়াল ভরা গরু’Ñএমন মিথ ঐতিহাসিক কোনো কালপর্বেই খুব একটা প্রমাণ পায়নি; বরং চর্যাপদের ‘হাড়ীত ভাত নাহিঁ নিতি আবেশী’ কিংবা অন্নদা মঙ্গলের ‘আমার সন্তান যেন থাকে দুধে-ভাতে’Ñএর মতো আকুতিই শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে শোনা গেছে। অথচ এই কৃষকের উৎপাদিত ফসলের উদ্বৃত্ত নিয়েই পাল, সেন, খিলজি, মোগলদের শান-শওকত গড়ে উঠেছিল। কৃষকের এই দুর্দশা স্থায়ী রূপ পায় ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক প্রভুদের হাতে চালু হওয়া চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মাধ্যমে। এর ফলে ব্রিটিশ শাসক ও বাংলার কৃষকদের মধ্যে জমিদার, জোতদার, নায়েব, বরকন্দাজের মতো কয়েক স্তরের মধ্যস্বত্বভোগী তৈরি হয়। এদের সবার ‘খাই’ মেটাতে উৎপাদকশ্রেণী কৃষক নিঃস্ব থেকে নিঃস্বতর হয়ে পড়ে।
চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রচলনের পৌনে তিন শতাব্দী পেরিয়ে গেছে। ব্রিটিশ ও পাকিস্তানিদের হাত থেকে দুই দফায় স্বাধীনতা অর্জন করেছি। এ বছর আমরা স্বাধীনতার ৫৪তম বর্ষ উদযাপন করলাম। কিন্তু আমাদের কৃষকরা কি মধ্যস্বত্বভোগীদের সেই ‘চিরস্থায়ী দৌরাত্ম্য’ থেকে কতটা মুক্তি পেয়েছে? এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে মুক্তবাজার অর্থনীতির নামে বাংলাদেশে গড়ে ওঠা ক্রনি ক্যাপিটালিজম বা স্বজনতোষী অর্থনীতি। রাজনৈতিক, প্রশাসনিক কিংবা অন্য কোনো ক্ষমতাতন্ত্রের সঙ্গে যুক্ত একটি অংশের ফুলেফেঁপে ওঠার সব আইন, বিধি ও শর্ত এখানে উপস্থিত। এই ব্যবস্থায় উৎপাদক ও ভোক্তাÑদুজনই সেই সোনার ডিম দেয়া হাঁস। তাদের পেট চিরে ডিম বের করার সব আয়োজনও প্রস্তুত।
আজকাল আমাদের নীতিনির্ধারকদের মধ্যে (প্রকৃতপক্ষে যারা মধ্যস্বত্বভোগী শ্রেণীর প্রতিনিধি) একটি কথা ফ্যাশনে পরিণত হয়েছেÑকৃষিজাত উৎপাদন জিডিপিতে মাত্র ১৪-১৫ শতাংশ অবদান রাখে। কিন্তু বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য বলছে, জিডিপিতে অবদান কম হলেও ৪০ শতাংশ মানুষ এখনো কৃষির ওপর নির্ভরশীল। অর্থাৎ এককভাবে সবচেয়ে বেশি মানুষ এখনো কৃষির সঙ্গে আবদ্ধ। গত কয়েক দশকের বাংলাদেশের অর্জনে কৃষকের ভূমিকা অসামান্য। ধান ও পাটকেন্দ্রিক উৎপাদন থেকে বেরিয়ে এসে কৃষিতে বৈচিত্র্য এনে, নিজস্ব নানা উদ্ভাবনের মাধ্যমে ১৮ কোটি মানুষের খাদ্য ও পুষ্টির জোগান দিয়েছেন তারা। উদ্যোক্তার কথা যদি বলতেই হয়, তাহলে কৃষকদের চেয়ে বড় উদ্যোক্তা আর কে আছে? অথচ উৎপাদিত ফসলের ন্যায্য দাম না পেয়ে, এনজিওর কিস্তির টাকা শোধ করতে না পেরে কেউ কেউ আত্মহত্যার পথও বেছে নিয়েছেন। আবার সেই ফসল দিয়েই মধ্যস্বত্বভোগীরা বিপুল মুনাফা গড়ে তুলছেন।
এখানে বড় প্রশ্ন হলোÑকৃষক কিংবা উদ্যোক্তাদের জন্য নীতি ও সহায়ক পরিবেশ কোথায়? বাংলাদেশে উৎপাদকদের অবস্থা নিয়ে একটি ধারণা প্রচলিত হয়েছেÑ ‘যদি তুমি উৎপাদক হও, তাহলে তুমি শেষ; যদি তুমি বেনিয়া হও, তাহলেই সামনে তোমার দিন।’
ভারতকে নাড়া দেয়া কৃষক আন্দোলনে দেশটির প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি কৃষকদের কাছে করজোড়ে ক্ষমা চেয়ে বিতর্কিত কৃষি বিল থেকে সরে এসেছিলেন। ওই বিলে কৃষকদের বড় করপোরেটদের মর্জির ওপর নির্ভরশীল করে রাখার চেষ্টা ছিল। কৃষকেরা যে ন্যূনতম সহায়ক মূল্য (উৎপাদন খরচ ও মুনাফা) পেয়ে আসছিলেন, তা বাতিল হয়ে যেত। পাঞ্জাব, উত্তর প্রদেশসহ ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের কৃষকরা এক বছরেরও বেশি সময় ধরে শীত, গরম, বৃষ্টিতে ভিজে রাজপথে আন্দোলন করেছেন। তাদের দাবি মেনে নেয় সরকার। বামপন্থী দল, কংগ্রেসসহ বেশির ভাগ বিরোধী দল, ছাত্র, বুদ্ধিজীবী, নারী, সাধারণ মানুষ কৃষকদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। খাবার, ওষুধ, কাপড় দিয়ে সহযোগিতা করেছেন। সেখানে কৃষকদের সমর্থনে অভূতপূর্ব সংহতি তৈরি হয়েছিল।
কিন্তু বাংলাদেশে? রাষ্ট্রীয় পর্যায় থেকে শুরু করে সবখানেই কৃষকরা যেন হাওয়া হয়ে গেছেন। জাতীয় সংসদে তাদের প্রতিনিধি কি থাকে? রাজনৈতিক দলগুলোর কৃষকদের জন্য আলাদা সংগঠন থাকলেও সেখানে কৃষকের প্রতিনিধিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় না। ফলে কৃষকের কণ্ঠস্বর কোথাও শোনা যায় না। তাঁদের প্রত্যাশা জানতে চাইলে কৃষকেরা বলেন, লাভসহ উৎপাদিত ফসলের ন্যায্য মূল্য (সহায়ক দাম) চান, প্রয়োজনের সময় কৃষি ব্যাংক থেকে ঋণ চান। এই চাওয়া কি খুব বেশি?
গত দেড়-দুই দশকে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে শাকসবজি, ফলমূলসহ কৃষিজাত পণ্যের উৎপাদনে দারুণ বিপ্লব ঘটেছে। বিভিন্ন জেলায় উৎপাদন কয়েক গুণ বেড়েছে। কৃষকের হাত ধরে এগিয়ে গেছে কৃষি। কিন্তু উৎপাদন বাড়লেও মৌসুম ছাড়া বাজারে শাকসবজি, ফলমূল সহজলভ্য হয় না। এক মৌসুমের ফসলের জন্য আরেক মৌসুম পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়। উৎপাদন সূচক ঊর্ধ্বগামী হলেও দামের ক্ষেত্রে আকাশ-পাতাল ব্যবধান দেখা যায়। মৌসুমের শুরুতে যে সবজি ১০০-১৫০ টাকায় বিক্রি হয়, তা নেমে আসে ১০-২০ টাকায়। দাম না পেয়ে ক্ষেতের ফসল ক্ষেতেই পচে যায়। রাগে-ক্ষোভে কৃষকরা অনেক সময় উৎপাদিত শাকসবজি, ফলমূল ফেলে দেন। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হন কৃষক ও ভোক্তা উভয়েই।
কৃষিজাত পণ্য দীর্ঘসময় সংরক্ষণের জন্য পর্যাপ্ত হিমাগার বা সংরক্ষণাগার না থাকায় কৃষকেরা বিপুল ক্ষতির মুখে পড়েন। এই সমস্যা শুধু দেশীয় বাজারেই নয়, রপ্তানির ক্ষেত্রেও বিপর্যয় ডেকে আনে। আন্তর্জাতিক বাজারে আমাদের শাকসবজি, ফলমূলের ভালো চাহিদা থাকলেও সুষ্ঠু পরিকল্পনা ও সরকারি নজরদারির অভাবে রপ্তানিখাতও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। উৎপাদন সূচকের সঙ্গে বাজার বণ্টন, দামের ভারসাম্য ও রপ্তানি নীতি বজায় রাখতে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে আধুনিক হিমাগার ও কৃষিপণ্য সংরক্ষণাগার নির্মাণের দাবি দীর্ঘদিনের।
বিশ্ব খাদ্য সংস্থার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে ফলের বাণিজ্যিক উৎপাদন যে হারে বাড়ছে, তাতে অদূর ভবিষ্যতে অর্থনৈতিক আয়ের বড় অংশ আসবে এই খাত থেকে। বিশেষ করে পার্বত্য জেলাগুলোতে শাকসবজি, ফলমূলের উৎপাদন বেড়েছে। কিন্তু সংরক্ষণের অভাবে উৎপাদকরা অবিশ্বাস্য কম দামে পণ্য বিক্রি করতে বাধ্য হন। ফলে পচনের কারণে মান নষ্ট হয়, আর লোকসান গুনতে হয় কৃষক, ব্যবসায়ী ও রপ্তানিকারকদের।
কৃষি বিপ্লব ঘটেছেÑএতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু নানা অব্যবস্থাপনা ও সুযোগ-সুবিধার অভাবে কৃষকরা এর সুফল থেকে বঞ্চিত। কৃষি বিপ্লবের সুফল যাতে কৃষকরা পায়, তার জন্য যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ জরুরি।
[লেখক : অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার]