কামরুজ্জামান
নারীর ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করা গেলে নারীর প্রতি সহিংসতা কমিয়ে আনা সম্ভব হবে
যে নারীর গর্ভে তাবত পৃথিবীর সব মানুষের জন্ম সেই নারীর জন্যই নিরাপত্তার প্রয়োজন পড়ে; কিন্তু কেন? কেন হচ্ছে নারী ও কন্যাশিশু নির্যাতন, কেন হচ্ছে ধর্ষণের মতো জঘন্য ঘটনা?
সম্প্রতি একজন নারী ফেসবুকে লিখেছেনÑ ‘হে আল্লাহ আপনি আর পৃথিবীতে কোনো কন্যাসন্তান পাঠাবেন না।’ আরেকজন মেয়ে ফেসবুকে লিখেছেনÑ ‘যদি সমাজে পুরুষ মানুষ না থাকতো তাহলে সে পুরো শহর রাতে ঘুরে কাটাতে পারতো। মুক্তভাবে বাতাস গ্রহণ করতে পারতো, মুক্তভাবে হাঁটতে পারতো।’ অর্থাৎ তার আর পুরুষের প্রয়োজন নেই। এ বিষয়গুলো আমাদের সমাজের জন্য, পুরুষ জাতীর জন্য লজ্জাজনক বিষয়।
বাংলাদেশে বর্তমানে নারী নির্যাতন ও নারীর প্রতি সহিংসতা অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গেছে। বিভিন্ন জায়গায় অনেক ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। মিডিয়ার মাধ্যমে নারী ও শিশু নির্যাতন এবং ধর্ষণের মতো ঘটনার খবর আমরা দেখছি প্রতিদিন।
সম্প্রতি মাগুরা জেলায় ঘটে যাওয়া ঘটনাটি সারা দেশের মানুষের বিবেককে নাড়া দেয়। পত্রিকা থেকে যতটুকু জানা যায়Ñ শিশুটি (৮) মাগুরা জেলার শ্রীপুর উপজেলার একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তৃতীয় শ্রেণির পড়–য়া ছাত্রী। মাগুরা শহরে বোনের বাড়িতে এসে বৃহস্পতিবার দুপুরে ধর্ষণের শিকার হয়।
দেশে কেন বাড়ছে ধর্ষণের মতো জঘন্য ঘটনা। এ সবের কারণ খুঁজে বের করা দরকার। এটি কোনোভাবেই একটি সভ্য সমাজের প্রতিচিত্র হতে পারে না। বর্তমান সময়ে আমাদের দেশ একটি রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্য দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। সরকার চেষ্টা করছে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে। কিন্তু একশ্রেণির অসৎ এবং লোভী মানুষের কারণে আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটছে। এটাকে কেউ কেউ আবার কাজে লাগানোর চেষ্টা করছে। যার ফলে বর্তমান সময়ে ধর্ষণ অনেক বেড়ে গেছে।
এছাড়াও আমাদের দেশে নারীর প্রতি সহিংসতা ও নির্যাতন পদে-পদেই হয়ে থাকে। আমাদের দেশের নারীরা ঘরে নির্যাতিত হয়। খুব আপন মানুষের দ্বারাই নির্যাতনের শিকার হয়। স্বামী, ভাই বাবা এমনকি সন্তানের দ্বারাও নারী শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়। কন্যা শিশু, মেয়ে, নারী অনেকেই নিকটাত্মীয় দ্বারা যৌন নির্যাতনের শিকার হয়। কিন্তু পারিবারিক ও সামাজিক লাজলজ্জা ও মান সম্মানের ভয়ে থেকে যায় অপ্রকাশিত।
আমাদের দেশের নারীরা কর্মক্ষেত্র, গণপরিবহন রাস্তাঘাটে চলাফেরায় শপিং মলে সর্বত্রই কটূক্তি ও যৌন হয়রানির শিকার হয়। এক শ্রেণির বিকৃত মস্তিষ্কের পুরুষ থাকে যারা এ কাজগুলো নীরবে করে যায়। এর মধ্যে যেগুলো মাত্রাতিরিক্ত পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছায় সেগুলো মিডিয়াতে আসে, আসে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নজরে।
দেশের নারীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি যৌন হয়রানির শিকার হয় পিছিয়ে পড়া মেয়েরা। এর মধ্যে বাক ও বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী, দরিদ্র অসহায় ঘরের নারী ও কন্যাশিশু, বস্তিবাসীর নারী ও কন্যা শিশুরাই বেশি।
ধর্ষণ ও নারীর প্রতি সহিংসতা যারা করে তারা বেশির ভাগই অপরাধী। বিভিন্ন অপরাধের সাথে এরা সম্পৃক্ত। যেমন- এরা মাদকাসক্ত, কিশোর গ্যাং, চুরি ও ডাকাতির সাথে সম্পৃক্ত।
ধর্ষণের মতো ঘটনা ঘটে গেলে দেখা যায়- অপরাধী হয় মাদকাসক্ত, নয়তো কিশোর গ্যাং, নয়তো চুরি অথবা ডাকাতির সাথে সম্পৃক্ত। আমাদের সমাজে মাদকের সাথে যারা জড়িত বা যারা মাদকাসক্ত তারা কিছুই মানে না। এদের দ্বারা আমাদের নারী সমাজ সবচেয়ে বেশি নির্যাতনের শিকার হয়।
পর্নোগ্রাফি নারীর প্রতি সহিংসতা বেড়ে যাওয়ার অন্যতম একটি কারণ। এখন তথ্য প্রযুক্তির যুগ। অবাধে দেখানো হয় বিভিন্ন অপরাধ সিরিয়াল। যেগুলো দেখে অনেকই বিপথগামী হয়। কৌশল রপ্ত করে এবং নিজেরা আসক্ত হয়ে পড়ে। বিশেষ করে শিশু ও নারী নির্যাতন রিলেটেড যেসব সিরিয়াল দেখানো হয় সেগুলো ভয়ংকর ক্ষতিকর। এগুলো দেখে দেখেই একশ্রেণীর পুরুষ মানসিক বিকারগ্রস্ত হয় এবং ধর্ষণের মতো ঘটনা ঘটায়।
কন্যা শিশুর প্রতি সচেতনতার অভাব সহিংসতার একটি কারণ। কন্যাশিশু কার সাথে মিশছে, কে তাকে কাছে ডাকছে, কে আদর করার চেষ্টা করছে, কোথায় ঘুমাবে, বেড়াতে নিয়ে গেলে কার সাথে থাকবে ইত্যাদি বিষয়গুলো মনিটরিং করা খুবই প্রয়োজন; কিন্তু আমাদের বাস্তবতা হচ্ছেÑ আমরা এসবে গুরুত্ব কম দেই। এর ফলে ঘটে যায় অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা।
নারীর প্রতি সহিংসতা কমিয়ে আনার জন্য প্রথমেই যেটা প্রয়োজন তা হলো- সচেতনতা বৃদ্ধি। পরিবারের সদস্যদের সচেতন হওয়া প্রয়োজন। কন্যা শিশুকে চোখে চোখে রাখা এবং সমস্যাগুলো সম্পর্কে প্রাথমিক জ্ঞান দিয়ে সচেতন করা। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর আরও বেশি আন্তরিকতা বৃদ্ধি ও আইনের যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করা। প্রয়োজনে আইন সংস্কার করা।
নারী নির্যাতন বন্ধে নারীর অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। নারীর সুশিক্ষা নিশ্চিত করা, নারীকে স্বাবলম্বী করে তোলা, সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করা। নারীকে নারী হিসেবে না দেখে কন্যা, জায়া, জননী হিসেবে দেখা। নারীর ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করতে পারলেই নারীর প্রতি সহিংসতা কমিয়ে আনা সম্ভব। নারীর জন্য নিরাপদ হোক আগামীর পৃথিবী।
[লেখক : সহকারী অধ্যাপক, ভূগোল বিভাগ, মুক্তিযোদ্ধা কলেজ, ভাওয়ালগড়, গাজীপুর]
কামরুজ্জামান
নারীর ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করা গেলে নারীর প্রতি সহিংসতা কমিয়ে আনা সম্ভব হবে
রোববার, ১০ আগস্ট ২০২৫
যে নারীর গর্ভে তাবত পৃথিবীর সব মানুষের জন্ম সেই নারীর জন্যই নিরাপত্তার প্রয়োজন পড়ে; কিন্তু কেন? কেন হচ্ছে নারী ও কন্যাশিশু নির্যাতন, কেন হচ্ছে ধর্ষণের মতো জঘন্য ঘটনা?
সম্প্রতি একজন নারী ফেসবুকে লিখেছেনÑ ‘হে আল্লাহ আপনি আর পৃথিবীতে কোনো কন্যাসন্তান পাঠাবেন না।’ আরেকজন মেয়ে ফেসবুকে লিখেছেনÑ ‘যদি সমাজে পুরুষ মানুষ না থাকতো তাহলে সে পুরো শহর রাতে ঘুরে কাটাতে পারতো। মুক্তভাবে বাতাস গ্রহণ করতে পারতো, মুক্তভাবে হাঁটতে পারতো।’ অর্থাৎ তার আর পুরুষের প্রয়োজন নেই। এ বিষয়গুলো আমাদের সমাজের জন্য, পুরুষ জাতীর জন্য লজ্জাজনক বিষয়।
বাংলাদেশে বর্তমানে নারী নির্যাতন ও নারীর প্রতি সহিংসতা অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গেছে। বিভিন্ন জায়গায় অনেক ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। মিডিয়ার মাধ্যমে নারী ও শিশু নির্যাতন এবং ধর্ষণের মতো ঘটনার খবর আমরা দেখছি প্রতিদিন।
সম্প্রতি মাগুরা জেলায় ঘটে যাওয়া ঘটনাটি সারা দেশের মানুষের বিবেককে নাড়া দেয়। পত্রিকা থেকে যতটুকু জানা যায়Ñ শিশুটি (৮) মাগুরা জেলার শ্রীপুর উপজেলার একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তৃতীয় শ্রেণির পড়–য়া ছাত্রী। মাগুরা শহরে বোনের বাড়িতে এসে বৃহস্পতিবার দুপুরে ধর্ষণের শিকার হয়।
দেশে কেন বাড়ছে ধর্ষণের মতো জঘন্য ঘটনা। এ সবের কারণ খুঁজে বের করা দরকার। এটি কোনোভাবেই একটি সভ্য সমাজের প্রতিচিত্র হতে পারে না। বর্তমান সময়ে আমাদের দেশ একটি রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্য দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। সরকার চেষ্টা করছে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে। কিন্তু একশ্রেণির অসৎ এবং লোভী মানুষের কারণে আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটছে। এটাকে কেউ কেউ আবার কাজে লাগানোর চেষ্টা করছে। যার ফলে বর্তমান সময়ে ধর্ষণ অনেক বেড়ে গেছে।
এছাড়াও আমাদের দেশে নারীর প্রতি সহিংসতা ও নির্যাতন পদে-পদেই হয়ে থাকে। আমাদের দেশের নারীরা ঘরে নির্যাতিত হয়। খুব আপন মানুষের দ্বারাই নির্যাতনের শিকার হয়। স্বামী, ভাই বাবা এমনকি সন্তানের দ্বারাও নারী শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়। কন্যা শিশু, মেয়ে, নারী অনেকেই নিকটাত্মীয় দ্বারা যৌন নির্যাতনের শিকার হয়। কিন্তু পারিবারিক ও সামাজিক লাজলজ্জা ও মান সম্মানের ভয়ে থেকে যায় অপ্রকাশিত।
আমাদের দেশের নারীরা কর্মক্ষেত্র, গণপরিবহন রাস্তাঘাটে চলাফেরায় শপিং মলে সর্বত্রই কটূক্তি ও যৌন হয়রানির শিকার হয়। এক শ্রেণির বিকৃত মস্তিষ্কের পুরুষ থাকে যারা এ কাজগুলো নীরবে করে যায়। এর মধ্যে যেগুলো মাত্রাতিরিক্ত পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছায় সেগুলো মিডিয়াতে আসে, আসে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নজরে।
দেশের নারীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি যৌন হয়রানির শিকার হয় পিছিয়ে পড়া মেয়েরা। এর মধ্যে বাক ও বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী, দরিদ্র অসহায় ঘরের নারী ও কন্যাশিশু, বস্তিবাসীর নারী ও কন্যা শিশুরাই বেশি।
ধর্ষণ ও নারীর প্রতি সহিংসতা যারা করে তারা বেশির ভাগই অপরাধী। বিভিন্ন অপরাধের সাথে এরা সম্পৃক্ত। যেমন- এরা মাদকাসক্ত, কিশোর গ্যাং, চুরি ও ডাকাতির সাথে সম্পৃক্ত।
ধর্ষণের মতো ঘটনা ঘটে গেলে দেখা যায়- অপরাধী হয় মাদকাসক্ত, নয়তো কিশোর গ্যাং, নয়তো চুরি অথবা ডাকাতির সাথে সম্পৃক্ত। আমাদের সমাজে মাদকের সাথে যারা জড়িত বা যারা মাদকাসক্ত তারা কিছুই মানে না। এদের দ্বারা আমাদের নারী সমাজ সবচেয়ে বেশি নির্যাতনের শিকার হয়।
পর্নোগ্রাফি নারীর প্রতি সহিংসতা বেড়ে যাওয়ার অন্যতম একটি কারণ। এখন তথ্য প্রযুক্তির যুগ। অবাধে দেখানো হয় বিভিন্ন অপরাধ সিরিয়াল। যেগুলো দেখে অনেকই বিপথগামী হয়। কৌশল রপ্ত করে এবং নিজেরা আসক্ত হয়ে পড়ে। বিশেষ করে শিশু ও নারী নির্যাতন রিলেটেড যেসব সিরিয়াল দেখানো হয় সেগুলো ভয়ংকর ক্ষতিকর। এগুলো দেখে দেখেই একশ্রেণীর পুরুষ মানসিক বিকারগ্রস্ত হয় এবং ধর্ষণের মতো ঘটনা ঘটায়।
কন্যা শিশুর প্রতি সচেতনতার অভাব সহিংসতার একটি কারণ। কন্যাশিশু কার সাথে মিশছে, কে তাকে কাছে ডাকছে, কে আদর করার চেষ্টা করছে, কোথায় ঘুমাবে, বেড়াতে নিয়ে গেলে কার সাথে থাকবে ইত্যাদি বিষয়গুলো মনিটরিং করা খুবই প্রয়োজন; কিন্তু আমাদের বাস্তবতা হচ্ছেÑ আমরা এসবে গুরুত্ব কম দেই। এর ফলে ঘটে যায় অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা।
নারীর প্রতি সহিংসতা কমিয়ে আনার জন্য প্রথমেই যেটা প্রয়োজন তা হলো- সচেতনতা বৃদ্ধি। পরিবারের সদস্যদের সচেতন হওয়া প্রয়োজন। কন্যা শিশুকে চোখে চোখে রাখা এবং সমস্যাগুলো সম্পর্কে প্রাথমিক জ্ঞান দিয়ে সচেতন করা। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর আরও বেশি আন্তরিকতা বৃদ্ধি ও আইনের যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করা। প্রয়োজনে আইন সংস্কার করা।
নারী নির্যাতন বন্ধে নারীর অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। নারীর সুশিক্ষা নিশ্চিত করা, নারীকে স্বাবলম্বী করে তোলা, সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করা। নারীকে নারী হিসেবে না দেখে কন্যা, জায়া, জননী হিসেবে দেখা। নারীর ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করতে পারলেই নারীর প্রতি সহিংসতা কমিয়ে আনা সম্ভব। নারীর জন্য নিরাপদ হোক আগামীর পৃথিবী।
[লেখক : সহকারী অধ্যাপক, ভূগোল বিভাগ, মুক্তিযোদ্ধা কলেজ, ভাওয়ালগড়, গাজীপুর]