শেখর ভট্টাচার্য
শ্রাবণের আকাশ আমাদেরকে ডাকছে। সজীব বৃক্ষের শাখা-প্রশাখার ডাক আমরা শুনতে পাচ্ছি না
ভরা শ্রাবণের আকাশ কালো মেঘে ঢাকা, তারপরও শ্রাবণের আকাশের সৌন্দর্য আমাদেরকে কাছে টানে। অঝোর ধারার বৃষ্টির তাল, ছন্দ অতীন্দ্রিয় জগতে টেনে নিয়ে যায়। মানুষ ভিড়ের ভেতরও একা থেকে যায় মানুষ। একা থাকা মানে নিজেকে নিয়ে থাকা। মনের ভেতর তখন শ্রাবণের আকাশ, জলে ভাসা প্রান্তর নিয়ে ভাবনা জাগে। উন্মত্ত বাতাস, গর্জনরত মেঘ, বিদ্যুতের চমক, গাছের ডালপালার ভাঙন এবং বৃষ্টির ঝমঝম শব্দে প্রকৃতি যখন থরথর করে কাঁপে তখনও বাউল মন সুন্দরের সাধনা করে যায়। অন্ধকার রাতের বৃষ্টি, ঘন অরণ্যে স্তব্ধতার সঙ্গেও মানুষের কথা হয়। উন্মত্ত প্রকৃতির সঙ্গে যদি কথা না হতো তাহলে রবীন্দ্রনাথ কী করে বলতে পারেনÑ “শাঙনগগনে ঘোর ঘনঘটা, নিশীথযামিনী রে।/ কুঞ্জপথে, সখি, কৈসে যাওব অবলা কামিনী রে।” ঘোর শ্রাবণ ধারা, ঘন কালো মেঘ অন্ধকার রাত্রি হয়ে নেমে এসে এক ভয়ের চিত্রকল্প তৈরি করে। এরকম দুর্যোগে কুঞ্জপথে সখির প্রেমাতুর হয়ে যাওয়ার নিশ্চয়তা নিয়ে কবির মনে এক অসাধারণ রোমান্টিক ভাবনার উদয় দেখা যায়। প্রকৃতির সব ধরনের রূপের প্রকাশে যে সৌন্দর্য লুকিয়ে থাকে সে ধারণা পেতে আমদের কষ্ট হয় না। মানুষ মূলত সুন্দরের পূজারি। সুন্দরকে মানুষ সত্য হিসেবে জানে। সুন্দর যদি সত্য না হতো মহামতি কিটস তার “অড অন অ্যা গ্রেসার্ন আর্ন” কবিতায় লিখতে পারতেন না “বিউটি ইজ ট্রুথ, ট্রুথ ইজ বিউটি”। সব মানুষই দার্শনিক। তাই সত্য, সুন্দরের খোঁজে এক জীবন কাটিয়ে দেয় মানুষ। এজন্য আমরা সুন্দরকে সরাসরি আহ্বানের কথা শুনতে পাই রবীন্দ্রনাথের সংগীতে। “এসো শ্যামল সুন্দর/ আনো তব তাপ হরা, তৃষা হরা সংগ সুধা/ বিরহিণী চাহিয়া আছে আকাশে।”
জগৎ-সংসারে যদি সুন্দরের সাধনা থাকে তাহলে সত্য মানুষকে ছেড়ে দূরে চলে যেতে পারে না। সত্য সুন্দরের আরাধনা ও উপভোগের জন্য তাই আমাদের শ্রাবণের প্রকৃতির দিকে তাকাতে হয়। আমাদের বড়ই দুর্ভাগ্য। জাগতিক ব্যস্ততা, মোহ, লোভ প্রকৃতির কাছ থেকে আমাদেরকে বিভাজিত করে ফেলছে ক্রমাগত। প্রকৃতির অপার সৌন্দর্যে ডুব দেয়ার সুযোগ থাকলেও লোভ, মোহ, প্রকৃতিবিমুখ কর তোলে। অন্যদিকে প্রকৃতির ধ্বংস ডেকে এনে সে সুযোগকেও আমরা হাতছাড়া করছি ক্রমাগত। তারপরও প্রকৃতির নিয়ম অনুযায়ী শ্রাবণ এসে আমাদের ডাক দিয়ে যায়।
শ্রাবণ আসে জানালার ফাঁক গলে রাজধানী ঢাকা শহরে। নিশীথ অন্ধকারে শ্রাবণের ধারা এসে প্রাণ স্পর্শ করতে পারে না। অন্ধকার রাতে জানালা রুদ্ধ থাকে তাই শ্রাবণ ধারার সুর, ছন্দ শুনতে পাওয়া যায় না। সুর যদি হৃদয় স্পর্শ না করে তাহলে ছন্দ আসবে কোথা থেকে।
সুর ছন্দহীন শ্রাবণ অনেকটা “শুষ্কং কাষ্ঠং” এর মতো। অলস দুপুরে দিনের আলোয় যখন শ্রাবণের ধারা ঝরে পড়ে, তখন স্মৃতিকাতরতা পেয়ে বসে। দূর অতীতের শ্রাবণ এসে ডাক দিয়ে যায়। টিনের চালের শ্রাবণ ধারা ঝখন ঝরতে থাকে চোখে, কানে, মনে তখন রবীন্দ্রনাথ আসেন তার সঙ্গীত নিয়ে। কান পেতে কুড়িয়ে নেই চিরকালের শ্রাবণ সংগীত, “শ্রাবণের ধারার মতো পড়–ক ঝরে, পড়–ক ঝরে/ তোমারি সুরটি আমার মুখের ‘পরে, বুকের ‘পরে।”
আহা এই দহনকালে রবীন্দ্রনাথকে বড় প্রয়োজন। ভরা বাদলের শ্রাবণ দিন যে সৌন্দর্য নিয়ে আসে আমাদের বাংলায় সে সৌন্দর্য কোথায় পাব এই বিশ্বচরাচরে। পৃথিবীর কোথাও এরকম সজীব সতেজ শ্রাবণ নেই, বর্ষাও নেই। কী অসাধারণ বার্তা, “যে শাখায় ফুল ফোটে না, ফল ধরে না একেবারে/ তোমার ওই বাদল-বায়ে দিক জাগায়ে সেই শাখারে।” শ্রাবণ আসে প্রাণ প্রাচুর্য ভরে দিতে প্রকৃতিতে। পত্র, পুষ্প, ফলহীন বৃক্ষকে প্রাণের ছোয়া দিয়ে পরিপূর্ণতা দিতে আসে শ্রাবণধারা। জীবনের যত তৃষ্ণা ক্ষুধা সব মিটিয়ে দেয় শ্রাবণের বিরামহীন ধারা।
স্বচ্ছ জলের থৈ থৈ করা প্রকৃতিকে কি আমরা হারিয়ে ফেলেছি? ছোট বড় শহরে আমরা শ্রাবণকে দখল করেছি, শ্রাবণের ধারাকে বদ্ধ নোংরা খালের ভেতরে আবদ্ধ করে তিলে তিলে আমরা হত্যা করছি।
আমাদের সন্তানরা শ্রাবণের স্পর্শ পেয়ে বেড়ে উঠছে না। প্রকৃতি না ছুয়ে বেড়ে উঠলে অন্তরের গ্লনি কি দূর হয়! ভালোবাসায় পরিপূর্ণ হয় অন্তর। জানি না। প্রকৃতির ছোয়া ছাড়া মানুষ বড় নিষ্ঠুর হয়, হৃদয়ে ভালোবাসার স্থান সীমিত থাকায় মানবিকতা ভর করে না চিন্তায়, বিবেচনায়।
মানুষের রোমান্টিক হওয়ার ধরণ বদলে যাচ্ছ। চন্ডীদাস থেকে রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, শামসুর রাহমান, জীবনানন্দÑ দ্রুত আমাদের কাছ থেকে সরে যাচ্ছেন। তারা সরে যাচ্ছেন কিংবা আমাদের মানবিক চিন্তার গঠন বদলে যাওয়ায় তাদেরকে আমরা দূরে সরিয়ে দিচ্ছি। ভালোবাসা আমাদের পেতে হবে বল প্রয়োগ করে। বল প্রয়োগের ভালোবাসার কাছে আসেন না, চিরকালীন বাঙালির দার্শনিকরা। শ্রাবণের ধারাকে দূরে সরিয়ে সকল সুন্দর, বিনয়কে জীবন থেকে ত্যাগ করে আমরা ভাবছি আমরা এগিয়ে যাব। সুস্থ সংস্কৃতিহীন জাতি কখনো, কোনো কালে এগোতে পারেনি। ভরা শ্রাবণের থৈ থৈ করা সুন্দরের ভেতর আমাদের বাঁচার জন্য তাই রবীন্দ্রনাথকে বড় প্রয়োজন। অন্তরের শুদ্ধতার জন্য মানবিক সমাজ গড়ার জন্য শ্রাবণকে হৃদয়ে ঠাঁই দিতে হবে।
আমাদের সকল জীর্নতা, অমানবিকতা দূর করতে পারে শ্রাবণধারা। যেমন- দার্শনিক রবীন্দ্রনাথ বলেন ঠিক সেভাবে...... “যা-কিছু জীর্ণ আমার, দীর্ণ আমার, জীবনহারা/তাহারি স্তরে স্তরে পড়–ক ঝরে সুরের ধারা।” অহং বোধ, প্রকৃতিবিমুখতা, উদ্ধ্বত আচরণের কাছে পাওয়া যায় না নজরুলকে, রবীন্দ্রনাথকে এমনকী শ্রাবণের অসীম আমেজকেও।
আমাদের পারস্পরিক হিংসা, বিদ্বেষ এবং এর ফলে সৃষ্ট নিষ্ঠুরতার জন্যই কি আমরা প্রকৃতির কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছি ক্রমাগত! একটি বিষয় লক্ষণীয় প্রকৃতি থেকে বিচ্ছেদ বা দূরে সরে যাওয়া যতই বাড়ছে মানুষের সঙ্গে মানুষের বন্ধনও ধীরে ধীরে কমে আসছে। এই বন্ধনহীনতাই সাম্যাজিক ঐক্যকে বিনষ্ট করছে। ভালোবাসা, আন্তরিকতাহীন সমাজে প্রত্যেকে মানুষ নিজের চারদিকে দেয়াল গড়ে বাস করছে। কুঁড়েঘর থেকে রাজ প্রাসাদ, টাকার পাহাড় গড়া, বিলাসী জীবনের জন্য প্রতিযোগিতা পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিচ্ছে। আমরা কী তা বুঝতে পারছি, জানি না। সাময়িক সুখের জন্য সমাজ, দেশ, জাতির দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি ডেকে নিয়ে আসছি আমরা সমষ্টিগতভাবে। একসময় সামাজিক মানুষরা সমস্বরে উচ্চারণ করত “আমরা” এগিয়ে যাব। সাম্প্রতিক সময়ে অনেকেই এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে সমষ্টিগতভাবে “আমরা” বললেও ভেতরে ভেতরে প্রবল প্রতিযোগিতা থাকায় “আমার” এগিয়ে যেতে হবে এবং উদ্দেশ্য সাধনের জন্য হিংস্র, উন্মত্ত হয়ে উঠছেন।
আমাদেরকে ফিরতে হবে শ্রাবণের ভরা নদীর কুলে, বৃষ্টির ফাঁকে ফাঁকে হঠাৎ আলোর ঝলকানির ভেতর নানা রঙের মেঘের বিনুনী বাঁধা আকাশের কোলে। পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর বর্ষার আকাশের দিকে না তাকানো মানুষগুলো বড় দুর্ভাগা। আমাদের এই অভাগা বাংলায় মানুষে মানুষে হানাহানি, পরস্পরকে উপড়ে ফেলার রাজনীতি কি অনন্ত সময় চলতে থাকবে! জাতি হিসেবে আমরা সত্যেকে নির্বাসন দিয়েছি। সত্যের এই নির্বাসনের কারণে আমাদের মধ্যে এত অস্থিরতা, অসহিষ্ণুতা। সমাজবদ্ধ হয়ে ভালোবাসার বন্ধন সৃষ্টি করে বাঁচার অনীহা হলো সত্য, সুন্দরের থেকে বিচ্যুত হওয়া।
আমাদের ফিরতে হবে। শ্রাবণের আকাশ আমাদেরকে ডাকছে। সজীব বৃক্ষের শাখা, প্রশাখার ডাক আমরা শুনতে পাচ্ছি না। প্রকৃতির ডাক শুনতে না পেলে আমরা প্রকৃতির সন্তান হিসেবে মানবিক গুণের মানব সন্তান হতে পারব না এই কোমল সুবর্ণ ভূমির মানুষ প্রকৃতির সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক রেখে এই পর্যন্ত এসেছে। আবারও আমাদেরকে শ্রাবণের ঢেউয়ে উথাল পাথাল বিস্তীর্ন নদীর অস্থির স্রোতের ভেতর দিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। এটিই প্রকৃতির নিয়ম। আমাদেরকে পারতেই হবে। বাঙালি যখন সংহত হয় তখন সব প্রতিকূলতাকে নির্ভয়ে অতিক্রম করতে পারে। শ্মাশ্বত বাঙালির এটিই হলো হাজার বছরের প্রবণতা।
[লেখক : প্রাবন্ধিক ও উন্নয়ন গবেষক]
শেখর ভট্টাচার্য
শ্রাবণের আকাশ আমাদেরকে ডাকছে। সজীব বৃক্ষের শাখা-প্রশাখার ডাক আমরা শুনতে পাচ্ছি না
বুধবার, ১৩ আগস্ট ২০২৫
ভরা শ্রাবণের আকাশ কালো মেঘে ঢাকা, তারপরও শ্রাবণের আকাশের সৌন্দর্য আমাদেরকে কাছে টানে। অঝোর ধারার বৃষ্টির তাল, ছন্দ অতীন্দ্রিয় জগতে টেনে নিয়ে যায়। মানুষ ভিড়ের ভেতরও একা থেকে যায় মানুষ। একা থাকা মানে নিজেকে নিয়ে থাকা। মনের ভেতর তখন শ্রাবণের আকাশ, জলে ভাসা প্রান্তর নিয়ে ভাবনা জাগে। উন্মত্ত বাতাস, গর্জনরত মেঘ, বিদ্যুতের চমক, গাছের ডালপালার ভাঙন এবং বৃষ্টির ঝমঝম শব্দে প্রকৃতি যখন থরথর করে কাঁপে তখনও বাউল মন সুন্দরের সাধনা করে যায়। অন্ধকার রাতের বৃষ্টি, ঘন অরণ্যে স্তব্ধতার সঙ্গেও মানুষের কথা হয়। উন্মত্ত প্রকৃতির সঙ্গে যদি কথা না হতো তাহলে রবীন্দ্রনাথ কী করে বলতে পারেনÑ “শাঙনগগনে ঘোর ঘনঘটা, নিশীথযামিনী রে।/ কুঞ্জপথে, সখি, কৈসে যাওব অবলা কামিনী রে।” ঘোর শ্রাবণ ধারা, ঘন কালো মেঘ অন্ধকার রাত্রি হয়ে নেমে এসে এক ভয়ের চিত্রকল্প তৈরি করে। এরকম দুর্যোগে কুঞ্জপথে সখির প্রেমাতুর হয়ে যাওয়ার নিশ্চয়তা নিয়ে কবির মনে এক অসাধারণ রোমান্টিক ভাবনার উদয় দেখা যায়। প্রকৃতির সব ধরনের রূপের প্রকাশে যে সৌন্দর্য লুকিয়ে থাকে সে ধারণা পেতে আমদের কষ্ট হয় না। মানুষ মূলত সুন্দরের পূজারি। সুন্দরকে মানুষ সত্য হিসেবে জানে। সুন্দর যদি সত্য না হতো মহামতি কিটস তার “অড অন অ্যা গ্রেসার্ন আর্ন” কবিতায় লিখতে পারতেন না “বিউটি ইজ ট্রুথ, ট্রুথ ইজ বিউটি”। সব মানুষই দার্শনিক। তাই সত্য, সুন্দরের খোঁজে এক জীবন কাটিয়ে দেয় মানুষ। এজন্য আমরা সুন্দরকে সরাসরি আহ্বানের কথা শুনতে পাই রবীন্দ্রনাথের সংগীতে। “এসো শ্যামল সুন্দর/ আনো তব তাপ হরা, তৃষা হরা সংগ সুধা/ বিরহিণী চাহিয়া আছে আকাশে।”
জগৎ-সংসারে যদি সুন্দরের সাধনা থাকে তাহলে সত্য মানুষকে ছেড়ে দূরে চলে যেতে পারে না। সত্য সুন্দরের আরাধনা ও উপভোগের জন্য তাই আমাদের শ্রাবণের প্রকৃতির দিকে তাকাতে হয়। আমাদের বড়ই দুর্ভাগ্য। জাগতিক ব্যস্ততা, মোহ, লোভ প্রকৃতির কাছ থেকে আমাদেরকে বিভাজিত করে ফেলছে ক্রমাগত। প্রকৃতির অপার সৌন্দর্যে ডুব দেয়ার সুযোগ থাকলেও লোভ, মোহ, প্রকৃতিবিমুখ কর তোলে। অন্যদিকে প্রকৃতির ধ্বংস ডেকে এনে সে সুযোগকেও আমরা হাতছাড়া করছি ক্রমাগত। তারপরও প্রকৃতির নিয়ম অনুযায়ী শ্রাবণ এসে আমাদের ডাক দিয়ে যায়।
শ্রাবণ আসে জানালার ফাঁক গলে রাজধানী ঢাকা শহরে। নিশীথ অন্ধকারে শ্রাবণের ধারা এসে প্রাণ স্পর্শ করতে পারে না। অন্ধকার রাতে জানালা রুদ্ধ থাকে তাই শ্রাবণ ধারার সুর, ছন্দ শুনতে পাওয়া যায় না। সুর যদি হৃদয় স্পর্শ না করে তাহলে ছন্দ আসবে কোথা থেকে।
সুর ছন্দহীন শ্রাবণ অনেকটা “শুষ্কং কাষ্ঠং” এর মতো। অলস দুপুরে দিনের আলোয় যখন শ্রাবণের ধারা ঝরে পড়ে, তখন স্মৃতিকাতরতা পেয়ে বসে। দূর অতীতের শ্রাবণ এসে ডাক দিয়ে যায়। টিনের চালের শ্রাবণ ধারা ঝখন ঝরতে থাকে চোখে, কানে, মনে তখন রবীন্দ্রনাথ আসেন তার সঙ্গীত নিয়ে। কান পেতে কুড়িয়ে নেই চিরকালের শ্রাবণ সংগীত, “শ্রাবণের ধারার মতো পড়–ক ঝরে, পড়–ক ঝরে/ তোমারি সুরটি আমার মুখের ‘পরে, বুকের ‘পরে।”
আহা এই দহনকালে রবীন্দ্রনাথকে বড় প্রয়োজন। ভরা বাদলের শ্রাবণ দিন যে সৌন্দর্য নিয়ে আসে আমাদের বাংলায় সে সৌন্দর্য কোথায় পাব এই বিশ্বচরাচরে। পৃথিবীর কোথাও এরকম সজীব সতেজ শ্রাবণ নেই, বর্ষাও নেই। কী অসাধারণ বার্তা, “যে শাখায় ফুল ফোটে না, ফল ধরে না একেবারে/ তোমার ওই বাদল-বায়ে দিক জাগায়ে সেই শাখারে।” শ্রাবণ আসে প্রাণ প্রাচুর্য ভরে দিতে প্রকৃতিতে। পত্র, পুষ্প, ফলহীন বৃক্ষকে প্রাণের ছোয়া দিয়ে পরিপূর্ণতা দিতে আসে শ্রাবণধারা। জীবনের যত তৃষ্ণা ক্ষুধা সব মিটিয়ে দেয় শ্রাবণের বিরামহীন ধারা।
স্বচ্ছ জলের থৈ থৈ করা প্রকৃতিকে কি আমরা হারিয়ে ফেলেছি? ছোট বড় শহরে আমরা শ্রাবণকে দখল করেছি, শ্রাবণের ধারাকে বদ্ধ নোংরা খালের ভেতরে আবদ্ধ করে তিলে তিলে আমরা হত্যা করছি।
আমাদের সন্তানরা শ্রাবণের স্পর্শ পেয়ে বেড়ে উঠছে না। প্রকৃতি না ছুয়ে বেড়ে উঠলে অন্তরের গ্লনি কি দূর হয়! ভালোবাসায় পরিপূর্ণ হয় অন্তর। জানি না। প্রকৃতির ছোয়া ছাড়া মানুষ বড় নিষ্ঠুর হয়, হৃদয়ে ভালোবাসার স্থান সীমিত থাকায় মানবিকতা ভর করে না চিন্তায়, বিবেচনায়।
মানুষের রোমান্টিক হওয়ার ধরণ বদলে যাচ্ছ। চন্ডীদাস থেকে রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, শামসুর রাহমান, জীবনানন্দÑ দ্রুত আমাদের কাছ থেকে সরে যাচ্ছেন। তারা সরে যাচ্ছেন কিংবা আমাদের মানবিক চিন্তার গঠন বদলে যাওয়ায় তাদেরকে আমরা দূরে সরিয়ে দিচ্ছি। ভালোবাসা আমাদের পেতে হবে বল প্রয়োগ করে। বল প্রয়োগের ভালোবাসার কাছে আসেন না, চিরকালীন বাঙালির দার্শনিকরা। শ্রাবণের ধারাকে দূরে সরিয়ে সকল সুন্দর, বিনয়কে জীবন থেকে ত্যাগ করে আমরা ভাবছি আমরা এগিয়ে যাব। সুস্থ সংস্কৃতিহীন জাতি কখনো, কোনো কালে এগোতে পারেনি। ভরা শ্রাবণের থৈ থৈ করা সুন্দরের ভেতর আমাদের বাঁচার জন্য তাই রবীন্দ্রনাথকে বড় প্রয়োজন। অন্তরের শুদ্ধতার জন্য মানবিক সমাজ গড়ার জন্য শ্রাবণকে হৃদয়ে ঠাঁই দিতে হবে।
আমাদের সকল জীর্নতা, অমানবিকতা দূর করতে পারে শ্রাবণধারা। যেমন- দার্শনিক রবীন্দ্রনাথ বলেন ঠিক সেভাবে...... “যা-কিছু জীর্ণ আমার, দীর্ণ আমার, জীবনহারা/তাহারি স্তরে স্তরে পড়–ক ঝরে সুরের ধারা।” অহং বোধ, প্রকৃতিবিমুখতা, উদ্ধ্বত আচরণের কাছে পাওয়া যায় না নজরুলকে, রবীন্দ্রনাথকে এমনকী শ্রাবণের অসীম আমেজকেও।
আমাদের পারস্পরিক হিংসা, বিদ্বেষ এবং এর ফলে সৃষ্ট নিষ্ঠুরতার জন্যই কি আমরা প্রকৃতির কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছি ক্রমাগত! একটি বিষয় লক্ষণীয় প্রকৃতি থেকে বিচ্ছেদ বা দূরে সরে যাওয়া যতই বাড়ছে মানুষের সঙ্গে মানুষের বন্ধনও ধীরে ধীরে কমে আসছে। এই বন্ধনহীনতাই সাম্যাজিক ঐক্যকে বিনষ্ট করছে। ভালোবাসা, আন্তরিকতাহীন সমাজে প্রত্যেকে মানুষ নিজের চারদিকে দেয়াল গড়ে বাস করছে। কুঁড়েঘর থেকে রাজ প্রাসাদ, টাকার পাহাড় গড়া, বিলাসী জীবনের জন্য প্রতিযোগিতা পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিচ্ছে। আমরা কী তা বুঝতে পারছি, জানি না। সাময়িক সুখের জন্য সমাজ, দেশ, জাতির দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি ডেকে নিয়ে আসছি আমরা সমষ্টিগতভাবে। একসময় সামাজিক মানুষরা সমস্বরে উচ্চারণ করত “আমরা” এগিয়ে যাব। সাম্প্রতিক সময়ে অনেকেই এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে সমষ্টিগতভাবে “আমরা” বললেও ভেতরে ভেতরে প্রবল প্রতিযোগিতা থাকায় “আমার” এগিয়ে যেতে হবে এবং উদ্দেশ্য সাধনের জন্য হিংস্র, উন্মত্ত হয়ে উঠছেন।
আমাদেরকে ফিরতে হবে শ্রাবণের ভরা নদীর কুলে, বৃষ্টির ফাঁকে ফাঁকে হঠাৎ আলোর ঝলকানির ভেতর নানা রঙের মেঘের বিনুনী বাঁধা আকাশের কোলে। পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর বর্ষার আকাশের দিকে না তাকানো মানুষগুলো বড় দুর্ভাগা। আমাদের এই অভাগা বাংলায় মানুষে মানুষে হানাহানি, পরস্পরকে উপড়ে ফেলার রাজনীতি কি অনন্ত সময় চলতে থাকবে! জাতি হিসেবে আমরা সত্যেকে নির্বাসন দিয়েছি। সত্যের এই নির্বাসনের কারণে আমাদের মধ্যে এত অস্থিরতা, অসহিষ্ণুতা। সমাজবদ্ধ হয়ে ভালোবাসার বন্ধন সৃষ্টি করে বাঁচার অনীহা হলো সত্য, সুন্দরের থেকে বিচ্যুত হওয়া।
আমাদের ফিরতে হবে। শ্রাবণের আকাশ আমাদেরকে ডাকছে। সজীব বৃক্ষের শাখা, প্রশাখার ডাক আমরা শুনতে পাচ্ছি না। প্রকৃতির ডাক শুনতে না পেলে আমরা প্রকৃতির সন্তান হিসেবে মানবিক গুণের মানব সন্তান হতে পারব না এই কোমল সুবর্ণ ভূমির মানুষ প্রকৃতির সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক রেখে এই পর্যন্ত এসেছে। আবারও আমাদেরকে শ্রাবণের ঢেউয়ে উথাল পাথাল বিস্তীর্ন নদীর অস্থির স্রোতের ভেতর দিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। এটিই প্রকৃতির নিয়ম। আমাদেরকে পারতেই হবে। বাঙালি যখন সংহত হয় তখন সব প্রতিকূলতাকে নির্ভয়ে অতিক্রম করতে পারে। শ্মাশ্বত বাঙালির এটিই হলো হাজার বছরের প্রবণতা।
[লেখক : প্রাবন্ধিক ও উন্নয়ন গবেষক]