ফকর উদ্দিন মানিক
একসময় ছিল, যখন দেশের বুকে জ্ঞানের বাগান ছিল সোনালি আশার আঁকা। সেই বাগানে ফুল ফুটত চিন্তার, ঝরত নতুন স্বপ্নের জোছনা। বাগানের গভীরে প্রবাহিত হতো ঝর্ণাধার মতো সৃষ্টির জল, যা ভাসাত তরুণ বীজেরাÑআলো ছড়ানো বুদ্ধির পাখির মতো। বাগানের পাহাড়িরা ছিলেন জাতির বিবেক, তারা ছিলেন সূর্যের প্রথম আলো, যারা নিঃশব্দে চারা রোপণ করত, গবেষণার মাটিতে জ্ঞানের বীজ বুনত।
কিন্তু আজ? সেই বাগান যেন পরিত্যক্ত, যেখানে ফুলগুলো নরকীয় পলিমারের আবরণে মোড়ানো, যেখানে ঝর্ণার জল বিষাক্ত স্বার্থের স্রোতে মিলেমিশে গেছে। বাগানের কোণে বসে আছেন এক ভয়ের ছায়াপ্রতিমাÑসেই সার্কাসের রিংমাস্টার, যিনি কোনো আলো ছড়ান না, শুধু নিজেকেই দেখাতে ব্যস্ত।
বাগানপালকরা, যারা একসময় আলো ছড়ানো প্রদীপ, আজ তারা কেবল মঞ্চের নীরব ছায়া, যে কোনো সত্যি প্রশ্নের মুখোমুখি হতে পারে না। নবীন বীজেরা? তারা যেন দড়ির উপর হাঁটার অভিনব পায়রা, যারা এক ভুলে মঞ্চ থেকে পড়ে যেতে পারে, কিন্তু ঝুঁকি নিয়ে তারা মঞ্চের কর্তার ব্যানার উঁচু করে, নিজেদের অস্তিত্বের আড়ালে লুকায়।
গবেষণার ঝর্ণাধার? তা আজ নিস্তব্ধ, নিষ্ক্রিয়। যেখানে একসময় জ্ঞানের স্রোত ঝরতো, সেখানে আজ তালা ঝুলছে। বরাদ্দের টাকা আর আসে না গবেষণার কাজে, বরং ব্যয় হয় রঙিন ব্যানার ছাপানো আর কফি টেবিলের আয়োজনে। এমনকি গবেষণাগারগুলো আজ রাজনৈতিক চুক্তির মঞ্চ, যেখানে মেধা হারিয়েছে তার অবস্থান, যেখানে শূন্যতাই এখন রাজত্ব করে।
এখন বুদ্ধির শস্য তুলতে হয় মঞ্চের কর্তার ছায়া থেকে আসা বাতাসে, আর সিভিতে থাকে “অভিবাবকের নির্দেশনায় কাজ করেছি”Ñএই অভিশাপময় বাক্য। আর যদি লেখা থাকে “বিদেশ থেকে পিএইচডি,” তাহলে বিরূপ প্রশ্নের ঝড় ওঠেÑ“আপনি তো চামচা স্রোতের রাজাকে চেনেনই না?”
বুদ্ধির পাহাড়িরা একসময় ছিলেন জাতির বিবেক, আজ তারা জাতির বদলে পার্টির সংগীত গাইতে ব্যস্ত দলীয় সেবক। ক্লাস বাতিল হলেই নবীন পাখিরা খুশি হয়ে লাফ দেয়, কারণ তাদের কাছে সেশনজটই ক্যাম্পাসের একমাত্র ঐতিহ্য। বইয়ের পাতা উল্টানোর চেয়ে তারা বেশি পছন্দ করে কর্তার পেছনে লাঠি হাতে দৌড়ানো।
লাইব্রেরি? আজ সে যেন ধূলিময় পুরনো গ্রন্থাগারের মৃতপ্রায় ছায়া। বইগুলো হারিয়ে গেছে একসময়কার জ্ঞানের গহ্বর থেকে। গবেষণার ল্যাবগুলোতে ঝুলছে তালা, আর নবীন বীজেরা সেখানে নয়, স্বার্থের মঞ্চে ব্যস্ত। মেধা এখন স্লোগানে মিলেমিশে গেছে, যুক্তি হারিয়েছে লাঠির ঝনঝনানিতে।
শিক্ষার মঞ্চে আজ হয় “রিংমাস্টারের স্বপ্ন,” “দলের অবদান” আর “চামচা স্রোতের চেতনা” নিয়ে আলোচনা। প্রকৃত বিজ্ঞান, প্রযুক্তি কিংবা অর্থনীতির সংকট? সেগুলো যেন এক অজানা গ্রহের কথা। গবেষণাপত্রে আজ “কোয়ান্টাম থিওরি” নয়, “রাজনৈতিক স্থিতিশীলতায় ছাত্র সংগঠনের ভূমিকা” শিরোনাম।
নবীন বীজেরা পিএইচডির থিসিসে কপি-পেস্ট করে, কেউ গুগল ট্রান্সলেটে ভরসা করে, আর শেষে লেখেÑ“বিশেষ ধন্যবাদ, রিংমাস্টারের অনুপ্রেরণায়।” অথচ নাম যাদের দেয়া হয়, তারা কখনো স্নাতকোত্তর পর্যন্ত পৌঁছায় না। তবে দোষ তাদের নয়, এটাই আজকের গবেষণার পরিবেশ।
নির্বাচনের মঞ্চ এখন দলের লড়াইয়ের ময়দান, যেখানে গবেষণা থেমে যায়, আর সিন্ডিকেটের করিডোরে পাকা হয় আসন। নিয়োগ বোর্ডে প্রশ্ন হয় নাÑ“আপনার গবেষণার বিষয় কী?” বরং প্রশ্ন হয়Ñ“আপনি কি মঞ্চের কর্তার পরিচিত?”
এটাই জাতির সবচেয়ে করুণ পরিণতিÑশিক্ষা, শান্তি, উন্নতির মন্ত্র হয়ে যায় মিথ্যা প্রতিশ্রুতি। গেটের বাইরে লেখা থাকে “জ্ঞানের বাগান,” কিন্তু ভিতরে বিরাজ করে পচা স্বার্থের দুর্গন্ধ। নবীন বীজদের হাতে বইয়ের বদলে লাঠি, শিক্ষার নক্ষত্রদের হাতে কলম নয়, মঞ্চের কর্তার মোবাইল নম্বর। মেধাবীদের ভাগ্যে ‘পিএস’ হওয়া, আর চাটুকারদের ভাগ্যে অধ্যাপক পদ। মেধার আলো নিভে যায়, গবেষণার মাঠে শক্তির ছায়ার রাজত্ব বেড়ে যায়।
তবুও এই অন্ধকারের মাঝে জ্বলছে কিছু দীপÑকিছু বাগানপালক আজও ক্লাস নেন, গভীর গবেষণায় ডুবে থাকেন। কিছু নবীন বীজ এখনও লাইব্রেরির কোণে বসে প্রশ্ন করে, চিন্তা করে, লিখে। তাদের জন্যই বিশ্বাস রাখা যায়Ñএই মঞ্চে একদিন সত্যিকার জ্ঞানের আলো ফিরে আসবে।
কিন্তু যদি না হয়Ñতাহলে এই বাগান হয়ে উঠবে ইতিহাসের সবচেয়ে করুণ ভাঁড়াল, যেখানে মেধা হারাবে, গবেষণা কবর পাবে, আর মঞ্চের কর্তা থাকবে সার্কাসের চিরস্থায়ী রিংমাস্টার।
[লেখক : সভাপতি, কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগ অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়]
ফকর উদ্দিন মানিক
বুধবার, ১৩ আগস্ট ২০২৫
একসময় ছিল, যখন দেশের বুকে জ্ঞানের বাগান ছিল সোনালি আশার আঁকা। সেই বাগানে ফুল ফুটত চিন্তার, ঝরত নতুন স্বপ্নের জোছনা। বাগানের গভীরে প্রবাহিত হতো ঝর্ণাধার মতো সৃষ্টির জল, যা ভাসাত তরুণ বীজেরাÑআলো ছড়ানো বুদ্ধির পাখির মতো। বাগানের পাহাড়িরা ছিলেন জাতির বিবেক, তারা ছিলেন সূর্যের প্রথম আলো, যারা নিঃশব্দে চারা রোপণ করত, গবেষণার মাটিতে জ্ঞানের বীজ বুনত।
কিন্তু আজ? সেই বাগান যেন পরিত্যক্ত, যেখানে ফুলগুলো নরকীয় পলিমারের আবরণে মোড়ানো, যেখানে ঝর্ণার জল বিষাক্ত স্বার্থের স্রোতে মিলেমিশে গেছে। বাগানের কোণে বসে আছেন এক ভয়ের ছায়াপ্রতিমাÑসেই সার্কাসের রিংমাস্টার, যিনি কোনো আলো ছড়ান না, শুধু নিজেকেই দেখাতে ব্যস্ত।
বাগানপালকরা, যারা একসময় আলো ছড়ানো প্রদীপ, আজ তারা কেবল মঞ্চের নীরব ছায়া, যে কোনো সত্যি প্রশ্নের মুখোমুখি হতে পারে না। নবীন বীজেরা? তারা যেন দড়ির উপর হাঁটার অভিনব পায়রা, যারা এক ভুলে মঞ্চ থেকে পড়ে যেতে পারে, কিন্তু ঝুঁকি নিয়ে তারা মঞ্চের কর্তার ব্যানার উঁচু করে, নিজেদের অস্তিত্বের আড়ালে লুকায়।
গবেষণার ঝর্ণাধার? তা আজ নিস্তব্ধ, নিষ্ক্রিয়। যেখানে একসময় জ্ঞানের স্রোত ঝরতো, সেখানে আজ তালা ঝুলছে। বরাদ্দের টাকা আর আসে না গবেষণার কাজে, বরং ব্যয় হয় রঙিন ব্যানার ছাপানো আর কফি টেবিলের আয়োজনে। এমনকি গবেষণাগারগুলো আজ রাজনৈতিক চুক্তির মঞ্চ, যেখানে মেধা হারিয়েছে তার অবস্থান, যেখানে শূন্যতাই এখন রাজত্ব করে।
এখন বুদ্ধির শস্য তুলতে হয় মঞ্চের কর্তার ছায়া থেকে আসা বাতাসে, আর সিভিতে থাকে “অভিবাবকের নির্দেশনায় কাজ করেছি”Ñএই অভিশাপময় বাক্য। আর যদি লেখা থাকে “বিদেশ থেকে পিএইচডি,” তাহলে বিরূপ প্রশ্নের ঝড় ওঠেÑ“আপনি তো চামচা স্রোতের রাজাকে চেনেনই না?”
বুদ্ধির পাহাড়িরা একসময় ছিলেন জাতির বিবেক, আজ তারা জাতির বদলে পার্টির সংগীত গাইতে ব্যস্ত দলীয় সেবক। ক্লাস বাতিল হলেই নবীন পাখিরা খুশি হয়ে লাফ দেয়, কারণ তাদের কাছে সেশনজটই ক্যাম্পাসের একমাত্র ঐতিহ্য। বইয়ের পাতা উল্টানোর চেয়ে তারা বেশি পছন্দ করে কর্তার পেছনে লাঠি হাতে দৌড়ানো।
লাইব্রেরি? আজ সে যেন ধূলিময় পুরনো গ্রন্থাগারের মৃতপ্রায় ছায়া। বইগুলো হারিয়ে গেছে একসময়কার জ্ঞানের গহ্বর থেকে। গবেষণার ল্যাবগুলোতে ঝুলছে তালা, আর নবীন বীজেরা সেখানে নয়, স্বার্থের মঞ্চে ব্যস্ত। মেধা এখন স্লোগানে মিলেমিশে গেছে, যুক্তি হারিয়েছে লাঠির ঝনঝনানিতে।
শিক্ষার মঞ্চে আজ হয় “রিংমাস্টারের স্বপ্ন,” “দলের অবদান” আর “চামচা স্রোতের চেতনা” নিয়ে আলোচনা। প্রকৃত বিজ্ঞান, প্রযুক্তি কিংবা অর্থনীতির সংকট? সেগুলো যেন এক অজানা গ্রহের কথা। গবেষণাপত্রে আজ “কোয়ান্টাম থিওরি” নয়, “রাজনৈতিক স্থিতিশীলতায় ছাত্র সংগঠনের ভূমিকা” শিরোনাম।
নবীন বীজেরা পিএইচডির থিসিসে কপি-পেস্ট করে, কেউ গুগল ট্রান্সলেটে ভরসা করে, আর শেষে লেখেÑ“বিশেষ ধন্যবাদ, রিংমাস্টারের অনুপ্রেরণায়।” অথচ নাম যাদের দেয়া হয়, তারা কখনো স্নাতকোত্তর পর্যন্ত পৌঁছায় না। তবে দোষ তাদের নয়, এটাই আজকের গবেষণার পরিবেশ।
নির্বাচনের মঞ্চ এখন দলের লড়াইয়ের ময়দান, যেখানে গবেষণা থেমে যায়, আর সিন্ডিকেটের করিডোরে পাকা হয় আসন। নিয়োগ বোর্ডে প্রশ্ন হয় নাÑ“আপনার গবেষণার বিষয় কী?” বরং প্রশ্ন হয়Ñ“আপনি কি মঞ্চের কর্তার পরিচিত?”
এটাই জাতির সবচেয়ে করুণ পরিণতিÑশিক্ষা, শান্তি, উন্নতির মন্ত্র হয়ে যায় মিথ্যা প্রতিশ্রুতি। গেটের বাইরে লেখা থাকে “জ্ঞানের বাগান,” কিন্তু ভিতরে বিরাজ করে পচা স্বার্থের দুর্গন্ধ। নবীন বীজদের হাতে বইয়ের বদলে লাঠি, শিক্ষার নক্ষত্রদের হাতে কলম নয়, মঞ্চের কর্তার মোবাইল নম্বর। মেধাবীদের ভাগ্যে ‘পিএস’ হওয়া, আর চাটুকারদের ভাগ্যে অধ্যাপক পদ। মেধার আলো নিভে যায়, গবেষণার মাঠে শক্তির ছায়ার রাজত্ব বেড়ে যায়।
তবুও এই অন্ধকারের মাঝে জ্বলছে কিছু দীপÑকিছু বাগানপালক আজও ক্লাস নেন, গভীর গবেষণায় ডুবে থাকেন। কিছু নবীন বীজ এখনও লাইব্রেরির কোণে বসে প্রশ্ন করে, চিন্তা করে, লিখে। তাদের জন্যই বিশ্বাস রাখা যায়Ñএই মঞ্চে একদিন সত্যিকার জ্ঞানের আলো ফিরে আসবে।
কিন্তু যদি না হয়Ñতাহলে এই বাগান হয়ে উঠবে ইতিহাসের সবচেয়ে করুণ ভাঁড়াল, যেখানে মেধা হারাবে, গবেষণা কবর পাবে, আর মঞ্চের কর্তা থাকবে সার্কাসের চিরস্থায়ী রিংমাস্টার।
[লেখক : সভাপতি, কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগ অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়]