মতিউর রহমান
আধুনিক জীবনের এক নীরব, অদৃশ্য সংকটÑএকাকীত্ব ও সামাজিক বিচ্ছিন্নতাÑক্রমশ তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। আপাতদৃষ্টিতে এটি একটি ব্যক্তিগত মানসিক অস্বস্তি বা হতাশার বিষয় মনে হলেও, সমাজতাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে এটি একটি গভীর সামাজিক এবং জনস্বাস্থ্য সংকট। প্রযুক্তির মাধ্যমে আমরা বিশ্বজুড়ে সংযুক্ত থাকার ভ্রম তৈরি করলেও বাস্তবতা হলো আমরা ক্রমশ একে অপরের থেকে দূরে সরে যাচ্ছি।
একাকীত্বকে প্রায়শই মানুষ এক ধরনের ব্যক্তিগত ব্যর্থতা বা মানসিক দুর্বলতা হিসেবে দেখে থাকে; কিন্তু সমাজতাত্ত্বিক ও মনস্তাত্ত্বিক গবেষণায় দেখা গেছে, এটি একটি বিবর্তনীয় প্রক্রিয়া এবং সামাজিক কাঠামোর ফল। মার্কিন সমাজবিজ্ঞানী জন কাসিওপ্পো, যিনি স্নায়ুবিজ্ঞানভিত্তিক সমাজতত্ত্বের অন্যতম পথিকৃৎ, দেখিয়েছেন যে একাকীত্ব হলো মানব মস্তিষ্কের একটি সতর্ক সংকেত। যেমন ক্ষুধা আমাদের খাদ্যের প্রয়োজন সম্পর্কে সচেতন করে, তেমনি একাকীত্ব আমাদের সামাজিক সম্পর্কের ঘাটতি সম্পর্কে অবহিত করে। এই সংকেত আমাদের বলে যে, আমাদের বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় সামাজিক সংযোগের অভাব রয়েছে।
কিন্তু আধুনিক সমাজের কাঠামো এই প্রাকৃতিক সংকেতকে উপেক্ষা করতে বাধ্য করছে। ব্যক্তিকেন্দ্রিকতা, তীব্র প্রতিযোগিতা এবং অর্থনৈতিক সাফল্যের চাপ এমন এক জীবনধারা তৈরি করেছে যেখানে মানুষ তার মৌলিক সামাজিক চাহিদা পূরণের সুযোগ হারাচ্ছে। দীর্ঘ কর্মঘণ্টা, প্রযুক্তিনির্ভর জীবন এবং গতিময় নগর সংস্কৃতি আমাদের গভীর ও অর্থপূর্ণ সম্পর্ক গড়ার পথে বাধা দিচ্ছে। ফলে ব্যক্তি একা হয়েও একা থাকতে বাধ্য হচ্ছে এবং একাকীত্বের এই নীরব মহামারি সমাজে ক্রমশ ছড়িয়ে পড়ছে।
একাকীত্ব কোনো একক কারণে ঘটে না; এর পেছনে রয়েছে আধুনিক সমাজের বিভিন্ন কাঠামোগত ও সাংস্কৃতিক পরিবর্তন। দ্রুত নগরায়ণের ফলে যৌথ পরিবার ভেঙে একক পরিবারে পরিণত হচ্ছে। গ্রামের প্রথাগত সামাজিক বন্ধন ও প্রতিবেশীদের পারস্পরিক নির্ভরতা শহরে প্রায়শই অনুপস্থিত। মানুষ ফ্ল্যাটের ছোট ছোট গ-ির মধ্যে বন্দি হয়ে থাকে, যেখানে প্রতিবেশীর সঙ্গে তার সম্পর্ক হয় যান্ত্রিক বা একেবারেই নেই। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে, উচ্চশিক্ষা বা চাকরির জন্য গ্রামে থেকে শহরে আসা তরুণ-তরুণীরা প্রায়শই এই বিচ্ছিন্নতার শিকার হয়।
ডিজিটাল যুগে প্রযুক্তি আমাদের এক দিকে যেমন বিশ্বজুড়ে মানুষের সঙ্গে সংযুক্ত করেছে, অন্যদিকে তেমনি তা আমাদের মুখোমুখি যোগাযোগের সুযোগ কমিয়ে দিয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম আমাদের ‘ফ্রেন্ডস’ বা ‘ফলোয়ারের’ সংখ্যা বাড়ালেও তা গভীর ও বিশ্বাসযোগ্য সম্পর্কের অভাব পূরণ করতে পারে না। বরং অন্যের জীবনের সফলতার ছবি দেখে অনেক সময় নিজের জীবনে আরও বেশি একাকীত্ব ও হীনমন্যতা বোধ তৈরি হয়। গবেষণা বলছে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অতিরিক্ত সময় কাটানো ব্যবহারকারীরা বিষণœতা ও একাকীত্বে বেশি ভোগেন।
আধুনিক পুঁজিবাদী সমাজ মানুষকে ক্রমাগত আরও বেশি সফল হওয়ার জন্য চাপ দেয়। এই প্রতিযোগিতার সংস্কৃতিতে পারস্পরিক সহযোগিতা ও বিশ্বাস কমে আসে। কর্মজীবনের অতিরিক্ত চাপ এবং দীর্ঘ কর্মঘণ্টা মানুষের ব্যক্তিগত জীবনের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। এতে পারিবারিক সময় কমে আসে, বন্ধুদের সাথে মেলামেশার সুযোগ থাকে না, এবং মানুষ নিজের ভেতরেই নিজেকে গুটিয়ে নেয়।
বাংলাদেশের মতো দেশগুলোতে অভিবাসন একাকীত্বের একটি বড় কারণ। কর্মসংস্থানের জন্য বিদেশে যাওয়া প্রবাসী শ্রমিকদের পরিবারগুলো দীর্ঘমেয়াদি বিচ্ছিন্নতার শিকার হয়। প্রবাসীর স্ত্রী বা স্বামীরা, সন্তানরা এবং বৃদ্ধ বাবা-মায়েরা একাকীত্বে ভোগেন, যা তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর গভীর প্রভাব ফেলে। একই সঙ্গে প্রবাসে থাকা ব্যক্তিরাও ভিন্ন সংস্কৃতি ও পরিবেশে একা থাকার কারণে গভীর একাকীত্বের শিকার হন।
একাকীত্বের প্রভাব কেবল মানসিক স্বাস্থ্যে সীমাবদ্ধ নয়; এটি একটি ভয়াবহ জনস্বাস্থ্য সংকটের জন্ম দিয়েছে। গবেষণায় দেখা গেছে, দীর্ঘস্থায়ী একাকীত্ব বিভিন্ন শারীরিক ও মানসিক রোগের ঝুঁকি বাড়ায়। একাকীত্বকে প্রায়শই হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ এবং স্থূলতার ঝুঁকির সঙ্গে তুলনা করা হয়। একাকী মানুষরা সাধারণত কম সক্রিয় থাকে, অস্বাস্থ্যকর জীবনযাপন করে এবং তাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল হয়। এর ফলে তারা বিভিন্ন রোগে সহজেই আক্রান্ত হয় এবং অকালমৃত্যুর ঝুঁকি বেড়ে যায়।
একাকীত্ব বিষণœতা, উদ্বেগ এবং আত্মহত্যার প্রবণতাকে বহুগুণে বাড়িয়ে তোলে। সামাজিকভাবে বিচ্ছিন্ন মানুষরা হতাশা ও দুশ্চিন্তায় ভোগে, যা তাদের দৈনন্দিন জীবনকে ব্যাহত করে। কোভিড-১৯ মহামারীকালে এর ভয়াবহতা আরও স্পষ্ট হয়েছে, যখন লকডাউনের কারণে মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটেছে এবং আত্মহত্যার হার বেড়েছে।
একাকীত্ব সমাজের বৃহত্তর কাঠামোকেও দুর্বল করে। সামাজিকভাবে বিচ্ছিন্ন মানুষরা সাধারণত নাগরিক জীবন ও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় কম আগ্রহী হয়। পারস্পরিক সহযোগিতা ও সহানুভূতির অভাব সমাজের নৈতিক অবক্ষয় ঘটায়। এর ফলে সমাজে অসহিষ্ণুতা বাড়ে এবং মানুষ ভুল তথ্য বা চরমপন্থি মতাদর্শ দ্বারা প্রভাবিত হতে পারে।
একাকীত্বের সমস্যা বাংলাদেশে নতুন হলেও এটি দ্রুত এক গুরুতর চ্যালেঞ্জে পরিণত হচ্ছে। শহুরে জীবনযাত্রা, পারিবারিক কাঠামোর পরিবর্তন এবং প্রযুক্তির প্রভাব এই সমস্যাকে ত্বরান্বিত করছে। কোভিড-১৯ মহামারীর সময় আমরা এর ভয়াবহতা প্রত্যক্ষ করেছি। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীরা দীর্ঘ সময় ধরে সহপাঠী ও শিক্ষকদের সাথে সরাসরি মেলামেশা থেকে বঞ্চিত হয়েছে, যা তাদের সামাজিক দক্ষতা ও মানসিক স্থিতিকে নষ্ট করেছে।
জুলাই ২০২৪-এর ছাত্র-জনতার আন্দোলনের পরবর্তী রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটও এই সমস্যাকে নতুন মাত্রা দিয়েছে। আন্দোলনের ফলে সৃষ্ট সামাজিক বিভাজন, অবিশ্বাস এবং রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা অনেক মানুষের মধ্যে মানসিক চাপ ও বিচ্ছিন্নতার অনুভূতি বাড়িয়ে দিয়েছে। এই অস্থির পরিস্থিতিতে মানুষ প্রায়শই নিজেদের রাজনৈতিক বা সামাজিক পরিচয় নিয়ে একা বোধ করে, যা একাকীত্বকে আরও গভীর করে তোলে। তরুণ প্রজন্ম যারা এ আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছিল, তাদের অনেকেই এখন ভবিষ্যৎ নিয়ে এক ধরনের অনিশ্চয়তা ও সামাজিক হতাশার শিকার।
একাকীত্ব কোনো ব্যক্তিগত ব্যর্থতা নয়, বরং এটি একটি সামাজিক সমস্যা। তাই এর সমাধানও ব্যক্তিগত স্তরে নয়, বরং সামাজিক ও নীতিগত স্তরে খুঁজতে হবে।
নগর পরিকল্পনায় পরিবর্তন : শহরের পরিকল্পনা এমনভাবে করতে হবে যাতে মানুষ একত্রিত হতে পারে। পাবলিক স্পেস, পার্ক, কমিউনিটি সেন্টার এবং সাংস্কৃতিক কেন্দ্র তৈরি করতে হবে, যা মানুষকে নিজেদের মধ্যে সম্পর্ক গড়ে তুলতে সাহায্য করবে।
নীতি প্রণয়ন : একাকীত্বকে একটি জনস্বাস্থ্য সংকট হিসেবে বিবেচনা করে নীতি প্রণয়ন করতে হবে। উন্নত দেশগুলোর মতো বাংলাদেশেও এই বিষয়ে সচেতনতা বাড়াতে এবং কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।
শিক্ষায় মানসিক স্বাস্থ্য : শিক্ষা ব্যবস্থায় মানসিক স্বাস্থ্য ও সামাজিক সম্পর্কের গুরুত্ব সম্পর্কে শিক্ষা অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। শিক্ষার্থীদের মধ্যে সহমর্মিতা, পারস্পরিক সহযোগিতা এবং সুস্থ সম্পর্ক গড়ার দক্ষতা তৈরি করতে হবে।
প্রযুক্তিকে মানুষের সম্পর্কের বিকল্প হিসেবে নয়, বরং সম্পূরক হিসেবে ব্যবহার করতে হবে। অনলাইন প্ল্যাটফর্মগুলোকে এমনভাবে ডিজাইন করতে হবে যেন তা মানুষের বাস্তব জীবনের সম্পর্কগুলোকে আরও শক্তিশালী করতে পারে, বিচ্ছিন্ন করতে নয়।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, একাকীত্বকে একটি সামাজিক সমস্যা হিসেবে স্বীকার করা এবং এ নিয়ে খোলামেলা আলোচনা করা। মানুষ যেন একাকীত্বকে ব্যক্তিগত দুর্বলতা মনে করে লুকিয়ে না রাখে। পরিবার, বন্ধু এবং সমাজের সবাইকে একে অপরের প্রতি আরও সংবেদনশীল হতে হবে।
একাকীত্ব ও সামাজিক বিচ্ছিন্নতা আধুনিক সমাজের এক নীরব মহামারি। এ সংকটকে যদি আমরা উপেক্ষা করি, তবে এটি শুধু আমাদের ব্যক্তিগত জীবনকেই নয়, আমাদের সমাজ ও সামগ্রিক জনস্বাস্থ্যকেও ক্ষতিগ্রস্ত করবে।
সমাজতত্ত্ব আমাদের দেখায় যে, অর্থনৈতিক উন্নয়ন যেমন একটি সুস্থ সমাজের জন্য অপরিহার্য, তেমনি অর্থবহ সামাজিক সম্পর্কও সমান গুরুত্বপূর্ণ। এ সম্পর্কগুলোকে পুনর্গঠন করার জন্য এখনই পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। নইলে হয়তো একদিন আমরা বুঝতে পারব না কখন আমরা একে অপরের থেকে এতটা দূরে চলে গেছি যে ফেরার পথ আর খুঁজে পাওয়া সম্ভব হবে না।
[লেখক : গবেষক ও উন্নয়নকর্মী]
মতিউর রহমান
শনিবার, ১৬ আগস্ট ২০২৫
আধুনিক জীবনের এক নীরব, অদৃশ্য সংকটÑএকাকীত্ব ও সামাজিক বিচ্ছিন্নতাÑক্রমশ তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। আপাতদৃষ্টিতে এটি একটি ব্যক্তিগত মানসিক অস্বস্তি বা হতাশার বিষয় মনে হলেও, সমাজতাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে এটি একটি গভীর সামাজিক এবং জনস্বাস্থ্য সংকট। প্রযুক্তির মাধ্যমে আমরা বিশ্বজুড়ে সংযুক্ত থাকার ভ্রম তৈরি করলেও বাস্তবতা হলো আমরা ক্রমশ একে অপরের থেকে দূরে সরে যাচ্ছি।
একাকীত্বকে প্রায়শই মানুষ এক ধরনের ব্যক্তিগত ব্যর্থতা বা মানসিক দুর্বলতা হিসেবে দেখে থাকে; কিন্তু সমাজতাত্ত্বিক ও মনস্তাত্ত্বিক গবেষণায় দেখা গেছে, এটি একটি বিবর্তনীয় প্রক্রিয়া এবং সামাজিক কাঠামোর ফল। মার্কিন সমাজবিজ্ঞানী জন কাসিওপ্পো, যিনি স্নায়ুবিজ্ঞানভিত্তিক সমাজতত্ত্বের অন্যতম পথিকৃৎ, দেখিয়েছেন যে একাকীত্ব হলো মানব মস্তিষ্কের একটি সতর্ক সংকেত। যেমন ক্ষুধা আমাদের খাদ্যের প্রয়োজন সম্পর্কে সচেতন করে, তেমনি একাকীত্ব আমাদের সামাজিক সম্পর্কের ঘাটতি সম্পর্কে অবহিত করে। এই সংকেত আমাদের বলে যে, আমাদের বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় সামাজিক সংযোগের অভাব রয়েছে।
কিন্তু আধুনিক সমাজের কাঠামো এই প্রাকৃতিক সংকেতকে উপেক্ষা করতে বাধ্য করছে। ব্যক্তিকেন্দ্রিকতা, তীব্র প্রতিযোগিতা এবং অর্থনৈতিক সাফল্যের চাপ এমন এক জীবনধারা তৈরি করেছে যেখানে মানুষ তার মৌলিক সামাজিক চাহিদা পূরণের সুযোগ হারাচ্ছে। দীর্ঘ কর্মঘণ্টা, প্রযুক্তিনির্ভর জীবন এবং গতিময় নগর সংস্কৃতি আমাদের গভীর ও অর্থপূর্ণ সম্পর্ক গড়ার পথে বাধা দিচ্ছে। ফলে ব্যক্তি একা হয়েও একা থাকতে বাধ্য হচ্ছে এবং একাকীত্বের এই নীরব মহামারি সমাজে ক্রমশ ছড়িয়ে পড়ছে।
একাকীত্ব কোনো একক কারণে ঘটে না; এর পেছনে রয়েছে আধুনিক সমাজের বিভিন্ন কাঠামোগত ও সাংস্কৃতিক পরিবর্তন। দ্রুত নগরায়ণের ফলে যৌথ পরিবার ভেঙে একক পরিবারে পরিণত হচ্ছে। গ্রামের প্রথাগত সামাজিক বন্ধন ও প্রতিবেশীদের পারস্পরিক নির্ভরতা শহরে প্রায়শই অনুপস্থিত। মানুষ ফ্ল্যাটের ছোট ছোট গ-ির মধ্যে বন্দি হয়ে থাকে, যেখানে প্রতিবেশীর সঙ্গে তার সম্পর্ক হয় যান্ত্রিক বা একেবারেই নেই। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে, উচ্চশিক্ষা বা চাকরির জন্য গ্রামে থেকে শহরে আসা তরুণ-তরুণীরা প্রায়শই এই বিচ্ছিন্নতার শিকার হয়।
ডিজিটাল যুগে প্রযুক্তি আমাদের এক দিকে যেমন বিশ্বজুড়ে মানুষের সঙ্গে সংযুক্ত করেছে, অন্যদিকে তেমনি তা আমাদের মুখোমুখি যোগাযোগের সুযোগ কমিয়ে দিয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম আমাদের ‘ফ্রেন্ডস’ বা ‘ফলোয়ারের’ সংখ্যা বাড়ালেও তা গভীর ও বিশ্বাসযোগ্য সম্পর্কের অভাব পূরণ করতে পারে না। বরং অন্যের জীবনের সফলতার ছবি দেখে অনেক সময় নিজের জীবনে আরও বেশি একাকীত্ব ও হীনমন্যতা বোধ তৈরি হয়। গবেষণা বলছে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অতিরিক্ত সময় কাটানো ব্যবহারকারীরা বিষণœতা ও একাকীত্বে বেশি ভোগেন।
আধুনিক পুঁজিবাদী সমাজ মানুষকে ক্রমাগত আরও বেশি সফল হওয়ার জন্য চাপ দেয়। এই প্রতিযোগিতার সংস্কৃতিতে পারস্পরিক সহযোগিতা ও বিশ্বাস কমে আসে। কর্মজীবনের অতিরিক্ত চাপ এবং দীর্ঘ কর্মঘণ্টা মানুষের ব্যক্তিগত জীবনের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। এতে পারিবারিক সময় কমে আসে, বন্ধুদের সাথে মেলামেশার সুযোগ থাকে না, এবং মানুষ নিজের ভেতরেই নিজেকে গুটিয়ে নেয়।
বাংলাদেশের মতো দেশগুলোতে অভিবাসন একাকীত্বের একটি বড় কারণ। কর্মসংস্থানের জন্য বিদেশে যাওয়া প্রবাসী শ্রমিকদের পরিবারগুলো দীর্ঘমেয়াদি বিচ্ছিন্নতার শিকার হয়। প্রবাসীর স্ত্রী বা স্বামীরা, সন্তানরা এবং বৃদ্ধ বাবা-মায়েরা একাকীত্বে ভোগেন, যা তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর গভীর প্রভাব ফেলে। একই সঙ্গে প্রবাসে থাকা ব্যক্তিরাও ভিন্ন সংস্কৃতি ও পরিবেশে একা থাকার কারণে গভীর একাকীত্বের শিকার হন।
একাকীত্বের প্রভাব কেবল মানসিক স্বাস্থ্যে সীমাবদ্ধ নয়; এটি একটি ভয়াবহ জনস্বাস্থ্য সংকটের জন্ম দিয়েছে। গবেষণায় দেখা গেছে, দীর্ঘস্থায়ী একাকীত্ব বিভিন্ন শারীরিক ও মানসিক রোগের ঝুঁকি বাড়ায়। একাকীত্বকে প্রায়শই হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ এবং স্থূলতার ঝুঁকির সঙ্গে তুলনা করা হয়। একাকী মানুষরা সাধারণত কম সক্রিয় থাকে, অস্বাস্থ্যকর জীবনযাপন করে এবং তাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল হয়। এর ফলে তারা বিভিন্ন রোগে সহজেই আক্রান্ত হয় এবং অকালমৃত্যুর ঝুঁকি বেড়ে যায়।
একাকীত্ব বিষণœতা, উদ্বেগ এবং আত্মহত্যার প্রবণতাকে বহুগুণে বাড়িয়ে তোলে। সামাজিকভাবে বিচ্ছিন্ন মানুষরা হতাশা ও দুশ্চিন্তায় ভোগে, যা তাদের দৈনন্দিন জীবনকে ব্যাহত করে। কোভিড-১৯ মহামারীকালে এর ভয়াবহতা আরও স্পষ্ট হয়েছে, যখন লকডাউনের কারণে মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটেছে এবং আত্মহত্যার হার বেড়েছে।
একাকীত্ব সমাজের বৃহত্তর কাঠামোকেও দুর্বল করে। সামাজিকভাবে বিচ্ছিন্ন মানুষরা সাধারণত নাগরিক জীবন ও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় কম আগ্রহী হয়। পারস্পরিক সহযোগিতা ও সহানুভূতির অভাব সমাজের নৈতিক অবক্ষয় ঘটায়। এর ফলে সমাজে অসহিষ্ণুতা বাড়ে এবং মানুষ ভুল তথ্য বা চরমপন্থি মতাদর্শ দ্বারা প্রভাবিত হতে পারে।
একাকীত্বের সমস্যা বাংলাদেশে নতুন হলেও এটি দ্রুত এক গুরুতর চ্যালেঞ্জে পরিণত হচ্ছে। শহুরে জীবনযাত্রা, পারিবারিক কাঠামোর পরিবর্তন এবং প্রযুক্তির প্রভাব এই সমস্যাকে ত্বরান্বিত করছে। কোভিড-১৯ মহামারীর সময় আমরা এর ভয়াবহতা প্রত্যক্ষ করেছি। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীরা দীর্ঘ সময় ধরে সহপাঠী ও শিক্ষকদের সাথে সরাসরি মেলামেশা থেকে বঞ্চিত হয়েছে, যা তাদের সামাজিক দক্ষতা ও মানসিক স্থিতিকে নষ্ট করেছে।
জুলাই ২০২৪-এর ছাত্র-জনতার আন্দোলনের পরবর্তী রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটও এই সমস্যাকে নতুন মাত্রা দিয়েছে। আন্দোলনের ফলে সৃষ্ট সামাজিক বিভাজন, অবিশ্বাস এবং রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা অনেক মানুষের মধ্যে মানসিক চাপ ও বিচ্ছিন্নতার অনুভূতি বাড়িয়ে দিয়েছে। এই অস্থির পরিস্থিতিতে মানুষ প্রায়শই নিজেদের রাজনৈতিক বা সামাজিক পরিচয় নিয়ে একা বোধ করে, যা একাকীত্বকে আরও গভীর করে তোলে। তরুণ প্রজন্ম যারা এ আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছিল, তাদের অনেকেই এখন ভবিষ্যৎ নিয়ে এক ধরনের অনিশ্চয়তা ও সামাজিক হতাশার শিকার।
একাকীত্ব কোনো ব্যক্তিগত ব্যর্থতা নয়, বরং এটি একটি সামাজিক সমস্যা। তাই এর সমাধানও ব্যক্তিগত স্তরে নয়, বরং সামাজিক ও নীতিগত স্তরে খুঁজতে হবে।
নগর পরিকল্পনায় পরিবর্তন : শহরের পরিকল্পনা এমনভাবে করতে হবে যাতে মানুষ একত্রিত হতে পারে। পাবলিক স্পেস, পার্ক, কমিউনিটি সেন্টার এবং সাংস্কৃতিক কেন্দ্র তৈরি করতে হবে, যা মানুষকে নিজেদের মধ্যে সম্পর্ক গড়ে তুলতে সাহায্য করবে।
নীতি প্রণয়ন : একাকীত্বকে একটি জনস্বাস্থ্য সংকট হিসেবে বিবেচনা করে নীতি প্রণয়ন করতে হবে। উন্নত দেশগুলোর মতো বাংলাদেশেও এই বিষয়ে সচেতনতা বাড়াতে এবং কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।
শিক্ষায় মানসিক স্বাস্থ্য : শিক্ষা ব্যবস্থায় মানসিক স্বাস্থ্য ও সামাজিক সম্পর্কের গুরুত্ব সম্পর্কে শিক্ষা অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। শিক্ষার্থীদের মধ্যে সহমর্মিতা, পারস্পরিক সহযোগিতা এবং সুস্থ সম্পর্ক গড়ার দক্ষতা তৈরি করতে হবে।
প্রযুক্তিকে মানুষের সম্পর্কের বিকল্প হিসেবে নয়, বরং সম্পূরক হিসেবে ব্যবহার করতে হবে। অনলাইন প্ল্যাটফর্মগুলোকে এমনভাবে ডিজাইন করতে হবে যেন তা মানুষের বাস্তব জীবনের সম্পর্কগুলোকে আরও শক্তিশালী করতে পারে, বিচ্ছিন্ন করতে নয়।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, একাকীত্বকে একটি সামাজিক সমস্যা হিসেবে স্বীকার করা এবং এ নিয়ে খোলামেলা আলোচনা করা। মানুষ যেন একাকীত্বকে ব্যক্তিগত দুর্বলতা মনে করে লুকিয়ে না রাখে। পরিবার, বন্ধু এবং সমাজের সবাইকে একে অপরের প্রতি আরও সংবেদনশীল হতে হবে।
একাকীত্ব ও সামাজিক বিচ্ছিন্নতা আধুনিক সমাজের এক নীরব মহামারি। এ সংকটকে যদি আমরা উপেক্ষা করি, তবে এটি শুধু আমাদের ব্যক্তিগত জীবনকেই নয়, আমাদের সমাজ ও সামগ্রিক জনস্বাস্থ্যকেও ক্ষতিগ্রস্ত করবে।
সমাজতত্ত্ব আমাদের দেখায় যে, অর্থনৈতিক উন্নয়ন যেমন একটি সুস্থ সমাজের জন্য অপরিহার্য, তেমনি অর্থবহ সামাজিক সম্পর্কও সমান গুরুত্বপূর্ণ। এ সম্পর্কগুলোকে পুনর্গঠন করার জন্য এখনই পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। নইলে হয়তো একদিন আমরা বুঝতে পারব না কখন আমরা একে অপরের থেকে এতটা দূরে চলে গেছি যে ফেরার পথ আর খুঁজে পাওয়া সম্ভব হবে না।
[লেখক : গবেষক ও উন্নয়নকর্মী]