alt

উপ-সম্পাদকীয়

সাদাপাথরের নীলাভ দেশ : ভোলাগঞ্জের সৌন্দর্য ও সংকট

কামরুজ্জামান

: শনিবার, ১৬ আগস্ট ২০২৫
image

লুট হয়ে যাচ্ছে ভোলাগঞ্জের সাদাপাথর

বাংলাদেশ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের দেশ। বাংলাদেশ রূপসী বাংলার দেশ। সুজলা-সুফলা শস্য-শ্যামলা সোনার বাংলার রূপের নেই তো শেষ। কবি জীবনানন্দ দাশ বলেছেনথ ‘আবার আসিবো ফিরে ধান সিঁড়িটির তীরে এই বাংলায়। হয়তো মানুষ নয়, হয়তো বা শঙ্খচিল শালিকের বেশে।’ কবির আবেগ এবং অনুভূতি থেকে পাওয়া যায় দেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এবং ভালোবাসার অপার মেলবন্ধন। কবি গুরু রবীন্দ্রনা বলেছেনÑ ‘অবারিত মাঠ গগণ ললাট চুমে তব পদধূলি, ছায়া সুনিবিড় শান্তির নীড় ছোট ছোট গ্রামগুলি।’

এ দেশের প্রকৃতির এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ হচ্ছেÑ সীমান্ত ঘেরা পাহাড়িয়া এলাকা। পাহাড়ের সৌন্দর্য আর অবিচলতা মানুষকে মুগ্ধ করে। মানুষ দুঃখ কষ্ট ভুলতে, আনন্দ খুঁজতে এবং প্রকৃতিকে কাছে থেকে দেখতে বারবার ছুটে যায় পাহাড়ে।

এ দেশ নদীমাতৃক দেশ। অসংখ্য নদ-নদী জালের মতো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে ও প্রবাহিত হচ্ছে নয়নাভিরাম ধারায়। প্রতিটি নদী এক একটি প্রাকৃতিক সম্পদের আধার। এ দেশের নদী ও মানুষের জীবন একে-অপরের পরিপূরক।

পাহাড়, নদী আর নদীর প্রবাহ বাংলাদেশকে অকৃপণ হাতে দিয়ে যাচ্ছে অফুরন্ত সম্পদ। এই সম্পদ সঠিক ব্যবহার যেমন প্রয়োজন রয়েছে তেমনি প্রয়োজন সঠিক রক্ষণাবেক্ষণ করা।

বাংলাদেশ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের দেশ হওয়ায় পর্যটন শিল্পে যতটুকু সমৃদ্ধ হওয়ার কথা ছিল স্বাধীনতার ৫৪ তম বছরে এসেও সেটা পূরণ হয়নি। পর্যটন শিল্প কেন ডেভেলপড হয়নি তা আমরা সবাই কমবেশি জানি; কিন্তু তারপরও প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট কিছু সম্পদ এবং স্থান আমাদের দেশে রয়েছে যেগুলো পর্যটকদের আকর্ষণ করে। দেশি-বিদেশি পর্যটক আসে দর্শনীয় স্থানগুলো ঘুরে দেখার জন্য।

আমাদের দেশে প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট পর্যটন স্থানগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলোÑ কক্সবাজার, পার্বত্য জেলাÑ রাঙ্গামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ি এবং সিলেট জেলার রাতারগুল, বিছানাকান্দি, ভোলাগঞ্জের সাদাপাথর ইত্যাদি। এছাড়াও খুলনা অঞ্চলের স্রোতজ বনভূমি সুন্দরবন। মধুপুর ও ভাওয়ালগড় এবং মৌলভীবাজার জেলার মাধবকু- ও মালিনীছড়া ইকোপার্ক পর্যটকদের আকর্ষণ করে।

বাংলাদেশের পর্যটন স্থানগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য এবং আকর্ষণীয় স্থান হচ্ছে সিলেট জেলার ভোলাগঞ্জের সাদাপাথর পর্যটন কেন্দ্র। সিলেট জেলা এমনিতেই প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি। এই সৌন্দর্যকে আরও বেশি সুষমাম-িত করে তুলেছে স্বচ্ছ জলের মধ্যে খেলা করা সাদাপাথরসহ নানার রংয়ের পাথরের মিলন মেলা। এসব পাথর উজান থেকে পাহাড়ি ঢল ও বৃষ্টির পানির স্রোতে নেমে আসে।

ভোলাগঞ্জের সাদাপাথর দেশব্যাপী নির্মাণ শিল্পে ব্যাপক চাহিদা রয়েছে; কিন্তু তারচেয়েও বড় কথা হচ্ছেÑ বিভিন্ন রংয়ের বর্ণিল এসব পাথরের রয়েছে প্রাকৃতিক গুরুত্ব। জীববৈচিত্র্য রক্ষায় এই পাথর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছে। অর্থনৈতিক গুরুত্ব বিবেচনায় পর্যটন শিল্পে মুখ্য ভূমিকা রাখছে ভোলাগঞ্জের সাদাপাথর। ভোলাগঞ্জের এই সব পাথর এতো গুরুত্ব কেন তা বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন।

সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার চমৎকার একটি গ্রাম ভোলাগঞ্জ। রোপওয়ে, পাথরকোয়ারি নদী আর পাহাড় মিলে এই ভোলাগঞ্জ। সিলেট শহর থেকে ভোলাগঞ্জের দূরত্ব ৩৩ কিলোমিটার। ধলাই নদী বাংলাদেশ অংশে প্রবেশ করে দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে প্লান্টের চারপাশ ঘুরে আবার একীভূত হয়। কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা সদরের কাছে ধলাই নদী মিলিত হয়েছে পিয়াইন নদীর সাথে। আর এ কারণেই একশ একর আয়তনের রোপওয়েটি পরিণত হয়েছে বিশেষ আকর্ষণীয় স্থানে।

ভারতের তৎকালীন আসাম প্রদেশের রাজধানী শিলংয়ে একসময় লোকজন এ রাস্তা দিয়েই যাতায়াত করতেন। কালের পরিক্রমায় এখানে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে রজ্জুপথ। নাম ভোলাগঞ্জ রোপওয়ে। দেশের সর্ববৃহৎ ভোলাগঞ্জ পাথর কোয়ারির অবস্থানও এ এলাকায়। রোপওয়ে, পাথরকোয়ারি আর পাহাড়ি মনোলোভা দৃশ্য অবলোকনে প্রতিদিনই পর্যটকদের আনাগোনা চলতেই থাকে।

পৃথিবীর সর্বাধিক বৃষ্টিবহুল এলাকা চেরাপুঞ্জির অবস্থান ভারতের পাহাড়ি রাজ্য মেঘালয়ে। ধলাই নদীর উজানে এ রাজ্যের অবস্থান। খাসিয়া জৈন্তিয়া পাহাড় ঘেরা এ রাজ্যের দৃশ্য বড়ই মনোরম। ভোলাগঞ্জের রোপওয়ে এলাকায় অবস্থান করে পাহাড়ি টিলার মনোরম দৃশ্যাবলি অবলোকন করা যায়। বর্ষাকালে চেরাপুঞ্জির বৃষ্টির পানি ধলাই নদীতে পাহাড়ি ঢলের সৃষ্টি করে। গ্রীষ্মকালে অনেকে ধলাই নদীকে মরা নদী হিসাবে অভিহিত করলেও বর্ষাকালে নদীটি ফুলে ফেঁপে উঠে। ধলাই নদীর মনোলোভা রূপ, সবুজ পাহাড় বন্দি এলাকাজুড়ে অজস্র সাদাপাথর, আকাশের নীল ছায়া রেখে যায় পাথরে জমে থাকা স্ফটিক জলে। দূরের পাহাড়গুলোর উপর মেঘের ছড়াছড়ি, সাথে এক দুটো ঝর্ণার গড়িয়ে পড়া জলরাশি, নদীর টলমলে হাঁটু পানির তলায় বালুর গালিচা। চিক চিক করা রূপালী বালু আর ছোট বড় সাদা অসংখ্য পাথর মিলে এ যেন এক পাথরের রাজ্য। প্রকৃতির খেয়ালে গড়া নিখুঁত ছবির মত সুন্দর এই জায়গাটির নাম ভোলাগঞ্জ।

প্রাকৃতিক পরিবেশ রক্ষায় সাদাপাথরের রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। সাদাপাথরগুলো তুলে নেওয়ার ফলে অপূরণীয় ক্ষতি হলো! এখানের পুরো প্রাকৃতিক সিস্টেম ভেঙে পড়বে। এর ফলে দুপাশে প্লাবনের পরিমাণ বাড়বে, ভাঙনের সৃষ্টি হবে এবং পাহাড় থেকে পতিত পানিকে পাহাড়ের পাদদেশে সাংঘাতিকভাবে পলিউটেড (দূষিত) করে ফেলবে। ফলে ওই অঞ্চলে অনেক জায়গায় খাবার পানির যে সরবরাহ হয় তা ব্যাঘাত ঘটবে। এছাড়াও পাথর তুলে নিয়ে যাওয়ার ফলে যে ধ্বংসাত্মক কার্যক্রম হলোÑ এ কারণে প্রকৃতিগতভাবে অন্যান্য ক্ষতিও তৈরি হবে। প্রাকৃতিক পরিবেশের অভিঘাত সৃষ্টি হবে। মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হবে জীববৈচিত্র্য। ক্ষতিগ্রস্ত হলো নয়নাভিরাম সৌন্দর্যের আধার পর্যটন শিল্প। পুরো সিলেট জেলায় এর প্রভাব হবে সুদূরপ্রসারী। ভবিষ্যতে যাতে আর এরকম ঘটনা না ঘটে তার জন্য প্রশাসনিক উদ্যোগ গ্রহণ করা প্রয়োজন। যারা পাথরগুলো সরিয়েছে তাদের আইনের আওতায় আনা প্রয়োজন।

প্রাকৃতিক পরিবেশের স্বাভাবিক অবস্থা বজায় রাখার জন্য, স্বচ্ছ জলের প্রবাহ ধরে রাখার জন্য, ভোলাগঞ্জ ও আশপাশের খাবার পানির সরবরাহ ঠিক রাখার জন্য, মানুষের নিয়মিত কর্মের সংস্থান ধরে রাখার জন্য এবং নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের পর্যটন শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য ভোলাগঞ্জের সাদাপাথরগুলো যথাস্থানে ফিরিয়ে আনা হোক।

[লেখক : সহকারী অধ্যাপক, ভূগোল বিভাগ, মুক্তিযোদ্ধা কলেজ, ভাওয়ালগড়, গাজীপুর]

নির্বাচন সুষ্ঠু হবে তো

মৎস্যসম্পদ সংরক্ষণ ও টেকসই ব্যবহার জরুরি

একাকীত্ব ও সামাজিক বিচ্ছিন্নতার সমাজতত্ত্ব

বেইজিংয়ের সঙ্গে নয়াদিল্লির নতুন ভূরাজনীতি

মব ও জাস্টিস

ইতিহাসকে নতুন করে লেখা এক জগাখিচুড়ি!

নারীর সমঅধিকার : সমাজ পরিবর্তনের চাবিকাঠি

জ্ঞানের মঞ্চ এখন সার্কাস, গবেষণা সেখানে নীরব দর্শক

ছবি

ভরা শ্রাবণে স্বদেশ-ভাবনা

নারীর প্রতি সহিংসতা : বাস্তবতা, আইন ও প্রতিরোধের জরুরি দিকনির্দেশনা

ছাত্র রাজনীতি : নেতৃত্বের হাতেখড়ি নাকি দাসত্বের লেজুড়বৃত্তি?

ছবি

নারীর প্রতি সহিংসতা বন্ধ করতেই হবে

ছবি

উন্নয়ন ও প্রকৃতি

ছবি

কৃষকের চেয়ে বড় উদ্যোক্তা আর কে আছে

ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর শিশুদের শিক্ষাগত ও সামাজিক সমস্যা

ট্রেড ইউনিয়ন ও বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট

সব অর্জনে কৃতিত্ব নিতে নেই

নাগাসাকি দিবস : পারমাণবিক বোমার অপপ্রয়োগ বন্ধ হোক

আদিবাসী অধিকার : দায় ঘোচানোর সুযোগ এসেছে, কাজে লাগাতে হবে রাষ্ট্রকেই

অদৃশ্য আগ্রাসনের বিরুদ্ধে লড়াই : উষ্ণ বাংলাদেশে জলবায়ু-প্রসূত স্বাস্থ্য সংকট

নেতানিয়াহুর এক ভ্রান্ত কৌশলের মুখোমুখি ইসরায়েল

আসিয়ানে বাংলাদেশের অভিযাত্রা : সম্ভাবনার পথে কূটনৈতিক বাস্তবতা ও রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ

ভাঙছে নদী, গড়ছে দুঃখের গ্রাম

ছবি

গণঅভ্যুত্থান ও গণআকাক্সক্ষা : এক বছরে অর্জনটা কী?

ছবি

ভিন্নমত, ভিন্নপথ এবং প্রান্তজনের স্বপ্ন

আচরণগত অর্থনীতির আয়নায় বাংলাদেশিদের বিদেশযাত্রা

গরিবের ইলিশ শুধুই স্বপ্ন কেন?

চব্বিশের গণঅভ্যুত্থান : বৈষম্য ও স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে জাগরণ

শারীরিক শিক্ষা : সুস্থ ও সচেতন প্রজন্ম গড়ার সম্ভাবনা

জ্ঞানতীর্থের সংকট ও গবেষণাবিমুখ উচ্চশিক্ষা

ছবি

জুলাই অভ্যুত্থান-গাথা : মেঘ থম থম করে

অলৌকিকতা, লৌকিকতা ও বিশ্বাসের বিভ্রান্তি

বিচারপতি গ্রেফতার, শুনানিতে পুলিশের অসহযোগিতা ও কিছু আইনি জিজ্ঞাসা

অপেক্ষার রাজনীতি ও সময়গত বৈষম্য : ঢাকা শহরের প্রেক্ষাপট

বৃক্ষরোপণ হোক পরিবেশ রক্ষার আন্দোলন

আফ্রিকায় রাশিয়ার ভূরাজনৈতিক কৌশল

tab

উপ-সম্পাদকীয়

সাদাপাথরের নীলাভ দেশ : ভোলাগঞ্জের সৌন্দর্য ও সংকট

কামরুজ্জামান

image

লুট হয়ে যাচ্ছে ভোলাগঞ্জের সাদাপাথর

শনিবার, ১৬ আগস্ট ২০২৫

বাংলাদেশ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের দেশ। বাংলাদেশ রূপসী বাংলার দেশ। সুজলা-সুফলা শস্য-শ্যামলা সোনার বাংলার রূপের নেই তো শেষ। কবি জীবনানন্দ দাশ বলেছেনথ ‘আবার আসিবো ফিরে ধান সিঁড়িটির তীরে এই বাংলায়। হয়তো মানুষ নয়, হয়তো বা শঙ্খচিল শালিকের বেশে।’ কবির আবেগ এবং অনুভূতি থেকে পাওয়া যায় দেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এবং ভালোবাসার অপার মেলবন্ধন। কবি গুরু রবীন্দ্রনা বলেছেনÑ ‘অবারিত মাঠ গগণ ললাট চুমে তব পদধূলি, ছায়া সুনিবিড় শান্তির নীড় ছোট ছোট গ্রামগুলি।’

এ দেশের প্রকৃতির এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ হচ্ছেÑ সীমান্ত ঘেরা পাহাড়িয়া এলাকা। পাহাড়ের সৌন্দর্য আর অবিচলতা মানুষকে মুগ্ধ করে। মানুষ দুঃখ কষ্ট ভুলতে, আনন্দ খুঁজতে এবং প্রকৃতিকে কাছে থেকে দেখতে বারবার ছুটে যায় পাহাড়ে।

এ দেশ নদীমাতৃক দেশ। অসংখ্য নদ-নদী জালের মতো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে ও প্রবাহিত হচ্ছে নয়নাভিরাম ধারায়। প্রতিটি নদী এক একটি প্রাকৃতিক সম্পদের আধার। এ দেশের নদী ও মানুষের জীবন একে-অপরের পরিপূরক।

পাহাড়, নদী আর নদীর প্রবাহ বাংলাদেশকে অকৃপণ হাতে দিয়ে যাচ্ছে অফুরন্ত সম্পদ। এই সম্পদ সঠিক ব্যবহার যেমন প্রয়োজন রয়েছে তেমনি প্রয়োজন সঠিক রক্ষণাবেক্ষণ করা।

বাংলাদেশ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের দেশ হওয়ায় পর্যটন শিল্পে যতটুকু সমৃদ্ধ হওয়ার কথা ছিল স্বাধীনতার ৫৪ তম বছরে এসেও সেটা পূরণ হয়নি। পর্যটন শিল্প কেন ডেভেলপড হয়নি তা আমরা সবাই কমবেশি জানি; কিন্তু তারপরও প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট কিছু সম্পদ এবং স্থান আমাদের দেশে রয়েছে যেগুলো পর্যটকদের আকর্ষণ করে। দেশি-বিদেশি পর্যটক আসে দর্শনীয় স্থানগুলো ঘুরে দেখার জন্য।

আমাদের দেশে প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট পর্যটন স্থানগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলোÑ কক্সবাজার, পার্বত্য জেলাÑ রাঙ্গামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ি এবং সিলেট জেলার রাতারগুল, বিছানাকান্দি, ভোলাগঞ্জের সাদাপাথর ইত্যাদি। এছাড়াও খুলনা অঞ্চলের স্রোতজ বনভূমি সুন্দরবন। মধুপুর ও ভাওয়ালগড় এবং মৌলভীবাজার জেলার মাধবকু- ও মালিনীছড়া ইকোপার্ক পর্যটকদের আকর্ষণ করে।

বাংলাদেশের পর্যটন স্থানগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য এবং আকর্ষণীয় স্থান হচ্ছে সিলেট জেলার ভোলাগঞ্জের সাদাপাথর পর্যটন কেন্দ্র। সিলেট জেলা এমনিতেই প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি। এই সৌন্দর্যকে আরও বেশি সুষমাম-িত করে তুলেছে স্বচ্ছ জলের মধ্যে খেলা করা সাদাপাথরসহ নানার রংয়ের পাথরের মিলন মেলা। এসব পাথর উজান থেকে পাহাড়ি ঢল ও বৃষ্টির পানির স্রোতে নেমে আসে।

ভোলাগঞ্জের সাদাপাথর দেশব্যাপী নির্মাণ শিল্পে ব্যাপক চাহিদা রয়েছে; কিন্তু তারচেয়েও বড় কথা হচ্ছেÑ বিভিন্ন রংয়ের বর্ণিল এসব পাথরের রয়েছে প্রাকৃতিক গুরুত্ব। জীববৈচিত্র্য রক্ষায় এই পাথর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছে। অর্থনৈতিক গুরুত্ব বিবেচনায় পর্যটন শিল্পে মুখ্য ভূমিকা রাখছে ভোলাগঞ্জের সাদাপাথর। ভোলাগঞ্জের এই সব পাথর এতো গুরুত্ব কেন তা বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন।

সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার চমৎকার একটি গ্রাম ভোলাগঞ্জ। রোপওয়ে, পাথরকোয়ারি নদী আর পাহাড় মিলে এই ভোলাগঞ্জ। সিলেট শহর থেকে ভোলাগঞ্জের দূরত্ব ৩৩ কিলোমিটার। ধলাই নদী বাংলাদেশ অংশে প্রবেশ করে দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে প্লান্টের চারপাশ ঘুরে আবার একীভূত হয়। কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা সদরের কাছে ধলাই নদী মিলিত হয়েছে পিয়াইন নদীর সাথে। আর এ কারণেই একশ একর আয়তনের রোপওয়েটি পরিণত হয়েছে বিশেষ আকর্ষণীয় স্থানে।

ভারতের তৎকালীন আসাম প্রদেশের রাজধানী শিলংয়ে একসময় লোকজন এ রাস্তা দিয়েই যাতায়াত করতেন। কালের পরিক্রমায় এখানে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে রজ্জুপথ। নাম ভোলাগঞ্জ রোপওয়ে। দেশের সর্ববৃহৎ ভোলাগঞ্জ পাথর কোয়ারির অবস্থানও এ এলাকায়। রোপওয়ে, পাথরকোয়ারি আর পাহাড়ি মনোলোভা দৃশ্য অবলোকনে প্রতিদিনই পর্যটকদের আনাগোনা চলতেই থাকে।

পৃথিবীর সর্বাধিক বৃষ্টিবহুল এলাকা চেরাপুঞ্জির অবস্থান ভারতের পাহাড়ি রাজ্য মেঘালয়ে। ধলাই নদীর উজানে এ রাজ্যের অবস্থান। খাসিয়া জৈন্তিয়া পাহাড় ঘেরা এ রাজ্যের দৃশ্য বড়ই মনোরম। ভোলাগঞ্জের রোপওয়ে এলাকায় অবস্থান করে পাহাড়ি টিলার মনোরম দৃশ্যাবলি অবলোকন করা যায়। বর্ষাকালে চেরাপুঞ্জির বৃষ্টির পানি ধলাই নদীতে পাহাড়ি ঢলের সৃষ্টি করে। গ্রীষ্মকালে অনেকে ধলাই নদীকে মরা নদী হিসাবে অভিহিত করলেও বর্ষাকালে নদীটি ফুলে ফেঁপে উঠে। ধলাই নদীর মনোলোভা রূপ, সবুজ পাহাড় বন্দি এলাকাজুড়ে অজস্র সাদাপাথর, আকাশের নীল ছায়া রেখে যায় পাথরে জমে থাকা স্ফটিক জলে। দূরের পাহাড়গুলোর উপর মেঘের ছড়াছড়ি, সাথে এক দুটো ঝর্ণার গড়িয়ে পড়া জলরাশি, নদীর টলমলে হাঁটু পানির তলায় বালুর গালিচা। চিক চিক করা রূপালী বালু আর ছোট বড় সাদা অসংখ্য পাথর মিলে এ যেন এক পাথরের রাজ্য। প্রকৃতির খেয়ালে গড়া নিখুঁত ছবির মত সুন্দর এই জায়গাটির নাম ভোলাগঞ্জ।

প্রাকৃতিক পরিবেশ রক্ষায় সাদাপাথরের রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। সাদাপাথরগুলো তুলে নেওয়ার ফলে অপূরণীয় ক্ষতি হলো! এখানের পুরো প্রাকৃতিক সিস্টেম ভেঙে পড়বে। এর ফলে দুপাশে প্লাবনের পরিমাণ বাড়বে, ভাঙনের সৃষ্টি হবে এবং পাহাড় থেকে পতিত পানিকে পাহাড়ের পাদদেশে সাংঘাতিকভাবে পলিউটেড (দূষিত) করে ফেলবে। ফলে ওই অঞ্চলে অনেক জায়গায় খাবার পানির যে সরবরাহ হয় তা ব্যাঘাত ঘটবে। এছাড়াও পাথর তুলে নিয়ে যাওয়ার ফলে যে ধ্বংসাত্মক কার্যক্রম হলোÑ এ কারণে প্রকৃতিগতভাবে অন্যান্য ক্ষতিও তৈরি হবে। প্রাকৃতিক পরিবেশের অভিঘাত সৃষ্টি হবে। মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হবে জীববৈচিত্র্য। ক্ষতিগ্রস্ত হলো নয়নাভিরাম সৌন্দর্যের আধার পর্যটন শিল্প। পুরো সিলেট জেলায় এর প্রভাব হবে সুদূরপ্রসারী। ভবিষ্যতে যাতে আর এরকম ঘটনা না ঘটে তার জন্য প্রশাসনিক উদ্যোগ গ্রহণ করা প্রয়োজন। যারা পাথরগুলো সরিয়েছে তাদের আইনের আওতায় আনা প্রয়োজন।

প্রাকৃতিক পরিবেশের স্বাভাবিক অবস্থা বজায় রাখার জন্য, স্বচ্ছ জলের প্রবাহ ধরে রাখার জন্য, ভোলাগঞ্জ ও আশপাশের খাবার পানির সরবরাহ ঠিক রাখার জন্য, মানুষের নিয়মিত কর্মের সংস্থান ধরে রাখার জন্য এবং নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের পর্যটন শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য ভোলাগঞ্জের সাদাপাথরগুলো যথাস্থানে ফিরিয়ে আনা হোক।

[লেখক : সহকারী অধ্যাপক, ভূগোল বিভাগ, মুক্তিযোদ্ধা কলেজ, ভাওয়ালগড়, গাজীপুর]

back to top