রেজাউল করিম খোকন
বাংলাদেশে প্রাণিজ আমিষ ও পুষ্টির চাহিদার বড় অংশই আসে মাছ থেকে। মিঠাপানির মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বের তৃতীয়, ইলিশ উৎপাদনে প্রথম এবং তেলাপিয়া উৎপাদনে চতুর্থ স্থানে রয়েছে। দারিদ্র্য বিমোচন, গ্রামীণ অর্থনীতি সচল রাখা, বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন ও পুষ্টি নিরাপত্তায় মৎস্য খাতের অবদান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
মৎস্য উৎপাদনে সাফল্য ও সম্ভাবনা
বাংলাদেশে বর্তমানে বছরে প্রায় ৪৭.৫৯ লাখ মেট্রিক টন মাছ উৎপাদিত হয়। পৃথিবীর ৫২টি দেশে মাছ রপ্তানি হয়ে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হচ্ছে। মৎস্য খাতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রায় দুই কোটি মানুষের কর্মসংস্থান রয়েছে।
বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট ইতোমধ্যে বিলুপ্তপ্রায় ৩৯ প্রজাতির দেশীয় মাছ ফিরিয়ে এনেছে। ময়মনসিংহে ‘লাইভ জিন ব্যাংক’ গড়ে দেশীয় মাছের জেনেটিক সংরক্ষণ করা হচ্ছে। ইলিশ উৎপাদন বৃদ্ধিতে গৃহীত পদক্ষেপের কারণে বাংলাদেশ বৈশ্বিক বাজারে অনন্য অবস্থান তৈরি করেছে।
সরকারি উদ্যোগ ও প্রযুক্তি প্রয়োগ
সরকার মৎস্য উৎপাদন বৃদ্ধির পাশাপাশি এর বহুমুখী ব্যবহারেও গুরুত্ব দিচ্ছেÑ যেমন মাছ থেকে চিপস, কেকসহ বিভিন্ন প্রক্রিয়াজাত পণ্য তৈরি। এর ফলে অভ্যন্তরীণ চাহিদা পূরণের পাশাপাশি রপ্তানির সুযোগ বাড়ছে।
নিরাপদ মাছ উৎপাদনে ইতোমধ্যে মৎস্য পরিদর্শন ও মাননিয়ন্ত্রণ আইন প্রণয়ন করা হয়েছে। সমুদ্র ও অভ্যন্তরীণ জলসীমায় ব্যবহৃত সব নৌযানে যান্ত্রিক পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থা যুক্ত করা হচ্ছে, যা দুর্ঘটনা প্রতিরোধ ও অবৈধ মাছ ধরার ওপর নজরদারি করবে।
আন্তর্জাতিক মানের পরীক্ষাগার স্থাপন করে রপ্তানিযোগ্য মাছের গুণগতমান নিশ্চিত করা হচ্ছে এবং আমদানিকৃত খাদ্য উপাদানও পরীক্ষা করা হচ্ছে, যাতে অস্বাস্থ্যকর উপাদান প্রবেশ না করে।
বিনিয়োগ ও আর্থিক সহায়তার চ্যালেঞ্জ
যদিও উৎপাদনে সাফল্য এসেছে, তবুও মৎস্য খাতে বিনিয়োগ এখনো পর্যাপ্ত নয়। চাষিদের ঋণপ্রাপ্তি নিয়ে সচেতনতার অভাব আছে, ফলে অনেকেই উচ্চ সুদে বেসরকারি উৎস থেকে ঋণ নিতে বাধ্য হন। বাণিজ্যিক ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো এ খাতকে ঝুঁকিপূর্ণ মনে করে বিনিয়োগে অনাগ্রহী।
সরকার পাঙাস, তেলাপিয়া ও কই মাছকে রপ্তানিযোগ্য প্রজাতি হিসেবে চিহ্নিত করেছে এবং এর স্বাদ, রং ও পুষ্টিগুণ বাড়াতে উদ্যোগ নিয়েছে। টেকসই বিনিয়োগের জন্য সরকারি-বেসরকারি সহযোগিতা অপরিহার্য।
সমুদ্র সম্পদের অপার সম্ভাবনা
বাংলাদেশের সমুদ্রসীমায় বিপুল মৎস্যসম্পদ থাকলেও আহরণ সক্ষমতা সীমিত। বর্তমানে গভীর সমুদ্র থেকে সম্ভাব্য মাছের ১ শতাংশও ধরা যাচ্ছে নাÑআধুনিক জাহাজ, প্রযুক্তি ও দক্ষ জনবল ঘাটতির কারণে।
ব্লু-ইকোনমি কাজে লাগাতে প্রয়োজন আধুনিক ট্রলার, ফ্রিজিং ও প্রক্রিয়াজাতকরণ সুবিধা, সামুদ্রিক মাছ ধরার নৌযানের নিবন্ধন ও মনিটরিং ব্যবস্থা এবং বিদেশি ট্রলারের অবৈধ অনুপ্রবেশ রোধ। শ্রীলঙ্কা, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ডের মতো দেশগুলোর সহায়তায় গভীর সমুদ্রে মাছ আহরণ প্রযুক্তি উন্নয়ন করা যেতে পারে।
দেশীয় প্রজাতি রক্ষার প্রয়োজনীয়তা
এক সময় দেশে ২৬০ প্রজাতির দেশীয় মাছ ছিল, বর্তমানে ৫৪ প্রজাতি বিপন্ন, আর ১৪০ প্রজাতির অস্তিত্ব চোখে পড়ে না। খালবিল ভরাট, শিল্পবর্জ্যে দূষণ, রাসায়নিক কৃষি উপাদান ব্যবহার এবং বিদেশি হাইব্রিড মাছের বাণিজ্যিক চাষ দেশীয় মাছের অস্তিত্বকে হুমকির মুখে ফেলেছে।
দেশীয় মাছ যেমন পাবদা, টেংরা, পুঁটি, কৈ, শোল, বোয়াল, গজার, চিতল ইত্যাদির চাষে সরকারি হ্যাচারি, পোনা বিতরণ, প্রশিক্ষণ ও প্রণোদনা জরুরি। বিদেশি মাছের চাষ নিয়ন্ত্রণ করে দেশীয় মাছের উৎপাদন বাড়াতে হবে।
করণীয় : বিনিয়োগ বৃদ্ধিÑ সরকারি ও বেসরকারি খাতে মৎস্য খাতবান্ধব ঋণনীতি প্রণয়ন। প্রযুক্তি ও অবকাঠামোÑ আধুনিক জাহাজ, প্রক্রিয়াজাতকরণ কেন্দ্র ও হিমাগার স্থাপন। দেশীয় মাছ সংরক্ষণÑ কৃত্রিম প্রজনন, পোনা বিতরণ ও আবাসস্থল পুনরুদ্ধার। সমুদ্রসম্পদ আহরণÑ গভীর সমুদ্রে মাছ ধরার সক্ষমতা বৃদ্ধি ও অবৈধ অনুপ্রবেশ রোধ। প্রশিক্ষণ ও গবেষণাÑ মৎস্যচাষি ও জেলেদের জন্য আধুনিক প্রযুক্তি প্রশিক্ষণ, গবেষণায় বিনিয়োগ। ব্লু-ইকোনমি বাস্তবায়নÑ আন্তর্জাতিক সহযোগিতায় সমুদ্রসম্পদ টেকসইভাবে ব্যবহার।
বাংলাদেশের প্রাচীন প্রবাদÑ ‘মাছেভাতে বাঙালি’ আজও আমাদের সংস্কৃতি ও খাদ্যাভ্যাসে জীবিত। আধুনিক প্রযুক্তি, টেকসই বিনিয়োগ ও পরিবেশবান্ধব নীতি গ্রহণের মাধ্যমে আমরা দেশের মৎস্য খাতকে বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী ও লাভজনক খাতে রূপ দিতে পারি। এতে শুধু অভ্যন্তরীণ চাহিদা পূরণই নয়, বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন, কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে।
[লেখক : অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার]
রেজাউল করিম খোকন
শনিবার, ১৬ আগস্ট ২০২৫
বাংলাদেশে প্রাণিজ আমিষ ও পুষ্টির চাহিদার বড় অংশই আসে মাছ থেকে। মিঠাপানির মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বের তৃতীয়, ইলিশ উৎপাদনে প্রথম এবং তেলাপিয়া উৎপাদনে চতুর্থ স্থানে রয়েছে। দারিদ্র্য বিমোচন, গ্রামীণ অর্থনীতি সচল রাখা, বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন ও পুষ্টি নিরাপত্তায় মৎস্য খাতের অবদান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
মৎস্য উৎপাদনে সাফল্য ও সম্ভাবনা
বাংলাদেশে বর্তমানে বছরে প্রায় ৪৭.৫৯ লাখ মেট্রিক টন মাছ উৎপাদিত হয়। পৃথিবীর ৫২টি দেশে মাছ রপ্তানি হয়ে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হচ্ছে। মৎস্য খাতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রায় দুই কোটি মানুষের কর্মসংস্থান রয়েছে।
বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট ইতোমধ্যে বিলুপ্তপ্রায় ৩৯ প্রজাতির দেশীয় মাছ ফিরিয়ে এনেছে। ময়মনসিংহে ‘লাইভ জিন ব্যাংক’ গড়ে দেশীয় মাছের জেনেটিক সংরক্ষণ করা হচ্ছে। ইলিশ উৎপাদন বৃদ্ধিতে গৃহীত পদক্ষেপের কারণে বাংলাদেশ বৈশ্বিক বাজারে অনন্য অবস্থান তৈরি করেছে।
সরকারি উদ্যোগ ও প্রযুক্তি প্রয়োগ
সরকার মৎস্য উৎপাদন বৃদ্ধির পাশাপাশি এর বহুমুখী ব্যবহারেও গুরুত্ব দিচ্ছেÑ যেমন মাছ থেকে চিপস, কেকসহ বিভিন্ন প্রক্রিয়াজাত পণ্য তৈরি। এর ফলে অভ্যন্তরীণ চাহিদা পূরণের পাশাপাশি রপ্তানির সুযোগ বাড়ছে।
নিরাপদ মাছ উৎপাদনে ইতোমধ্যে মৎস্য পরিদর্শন ও মাননিয়ন্ত্রণ আইন প্রণয়ন করা হয়েছে। সমুদ্র ও অভ্যন্তরীণ জলসীমায় ব্যবহৃত সব নৌযানে যান্ত্রিক পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থা যুক্ত করা হচ্ছে, যা দুর্ঘটনা প্রতিরোধ ও অবৈধ মাছ ধরার ওপর নজরদারি করবে।
আন্তর্জাতিক মানের পরীক্ষাগার স্থাপন করে রপ্তানিযোগ্য মাছের গুণগতমান নিশ্চিত করা হচ্ছে এবং আমদানিকৃত খাদ্য উপাদানও পরীক্ষা করা হচ্ছে, যাতে অস্বাস্থ্যকর উপাদান প্রবেশ না করে।
বিনিয়োগ ও আর্থিক সহায়তার চ্যালেঞ্জ
যদিও উৎপাদনে সাফল্য এসেছে, তবুও মৎস্য খাতে বিনিয়োগ এখনো পর্যাপ্ত নয়। চাষিদের ঋণপ্রাপ্তি নিয়ে সচেতনতার অভাব আছে, ফলে অনেকেই উচ্চ সুদে বেসরকারি উৎস থেকে ঋণ নিতে বাধ্য হন। বাণিজ্যিক ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো এ খাতকে ঝুঁকিপূর্ণ মনে করে বিনিয়োগে অনাগ্রহী।
সরকার পাঙাস, তেলাপিয়া ও কই মাছকে রপ্তানিযোগ্য প্রজাতি হিসেবে চিহ্নিত করেছে এবং এর স্বাদ, রং ও পুষ্টিগুণ বাড়াতে উদ্যোগ নিয়েছে। টেকসই বিনিয়োগের জন্য সরকারি-বেসরকারি সহযোগিতা অপরিহার্য।
সমুদ্র সম্পদের অপার সম্ভাবনা
বাংলাদেশের সমুদ্রসীমায় বিপুল মৎস্যসম্পদ থাকলেও আহরণ সক্ষমতা সীমিত। বর্তমানে গভীর সমুদ্র থেকে সম্ভাব্য মাছের ১ শতাংশও ধরা যাচ্ছে নাÑআধুনিক জাহাজ, প্রযুক্তি ও দক্ষ জনবল ঘাটতির কারণে।
ব্লু-ইকোনমি কাজে লাগাতে প্রয়োজন আধুনিক ট্রলার, ফ্রিজিং ও প্রক্রিয়াজাতকরণ সুবিধা, সামুদ্রিক মাছ ধরার নৌযানের নিবন্ধন ও মনিটরিং ব্যবস্থা এবং বিদেশি ট্রলারের অবৈধ অনুপ্রবেশ রোধ। শ্রীলঙ্কা, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ডের মতো দেশগুলোর সহায়তায় গভীর সমুদ্রে মাছ আহরণ প্রযুক্তি উন্নয়ন করা যেতে পারে।
দেশীয় প্রজাতি রক্ষার প্রয়োজনীয়তা
এক সময় দেশে ২৬০ প্রজাতির দেশীয় মাছ ছিল, বর্তমানে ৫৪ প্রজাতি বিপন্ন, আর ১৪০ প্রজাতির অস্তিত্ব চোখে পড়ে না। খালবিল ভরাট, শিল্পবর্জ্যে দূষণ, রাসায়নিক কৃষি উপাদান ব্যবহার এবং বিদেশি হাইব্রিড মাছের বাণিজ্যিক চাষ দেশীয় মাছের অস্তিত্বকে হুমকির মুখে ফেলেছে।
দেশীয় মাছ যেমন পাবদা, টেংরা, পুঁটি, কৈ, শোল, বোয়াল, গজার, চিতল ইত্যাদির চাষে সরকারি হ্যাচারি, পোনা বিতরণ, প্রশিক্ষণ ও প্রণোদনা জরুরি। বিদেশি মাছের চাষ নিয়ন্ত্রণ করে দেশীয় মাছের উৎপাদন বাড়াতে হবে।
করণীয় : বিনিয়োগ বৃদ্ধিÑ সরকারি ও বেসরকারি খাতে মৎস্য খাতবান্ধব ঋণনীতি প্রণয়ন। প্রযুক্তি ও অবকাঠামোÑ আধুনিক জাহাজ, প্রক্রিয়াজাতকরণ কেন্দ্র ও হিমাগার স্থাপন। দেশীয় মাছ সংরক্ষণÑ কৃত্রিম প্রজনন, পোনা বিতরণ ও আবাসস্থল পুনরুদ্ধার। সমুদ্রসম্পদ আহরণÑ গভীর সমুদ্রে মাছ ধরার সক্ষমতা বৃদ্ধি ও অবৈধ অনুপ্রবেশ রোধ। প্রশিক্ষণ ও গবেষণাÑ মৎস্যচাষি ও জেলেদের জন্য আধুনিক প্রযুক্তি প্রশিক্ষণ, গবেষণায় বিনিয়োগ। ব্লু-ইকোনমি বাস্তবায়নÑ আন্তর্জাতিক সহযোগিতায় সমুদ্রসম্পদ টেকসইভাবে ব্যবহার।
বাংলাদেশের প্রাচীন প্রবাদÑ ‘মাছেভাতে বাঙালি’ আজও আমাদের সংস্কৃতি ও খাদ্যাভ্যাসে জীবিত। আধুনিক প্রযুক্তি, টেকসই বিনিয়োগ ও পরিবেশবান্ধব নীতি গ্রহণের মাধ্যমে আমরা দেশের মৎস্য খাতকে বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী ও লাভজনক খাতে রূপ দিতে পারি। এতে শুধু অভ্যন্তরীণ চাহিদা পূরণই নয়, বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন, কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে।
[লেখক : অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার]