মতিউর রহমান
প্রাকৃতিক সম্পদকে আমরা সাধারণত উন্নয়নের আশীর্বাদ হিসেবে দেখি। এটি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, অবকাঠামো নির্মাণ ও জাতীয় গৌরব অর্জনের একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হিসেবে বিবেচিত হয়; কিন্তু গ্লোবাল সাউথের বহু দেশের মতো, বাংলাদেশের বাস্তবতায় প্রাকৃতিক সম্পদ প্রায়শই একটি জটিল ও দ্বিমুখী ভূমিকা পালন করে। সঠিক নিয়ন্ত্রণ, স্বচ্ছতা এবং দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ছাড়া যখন সম্পদ উত্তোলন করা হয়, তখন তা দুর্নীতি, পরিবেশের ভয়াবহ ধ্বংস এবং স্থানীয় মানুষের জীবন-জীবিকার অবক্ষয় ডেকে আনে। উন্নয়নের চালিকাশক্তি হওয়ার বদলে এ সম্পদগুলো সংঘাতের উৎসে পরিণত হয়।
সাম্প্রতিক সময়ে সিলেটের সীমান্ত অঞ্চলে সাদাপাথর চুরির ঘটনা এ সমস্যার তীব্রতা আমাদের সামনে তুলে ধরেছে। প্রথম দৃষ্টিতে এটি হয়তো স্থানীয় পর্যায়ের একটি অপরাধ মনে হতে পারে, কিন্তু সমাজতাত্ত্বিকভাবে এটি একটি বৃহত্তর কাঠামোগত সমস্যার প্রতিচ্ছবি। এ সমস্যাটি এক্সট্র্যাকটিভিজম বা সম্পদ-শোষণ মডেল নামে পরিচিত।
সমাজতত্ত্বে এক্সট্র্যাকটিভিজম বলতে এমন একটি অর্থনৈতিক প্রক্রিয়াকে বোঝানো হয়, যেখানে প্রাকৃতিক সম্পদকে বৃহৎ আকারে উত্তোলন করা হয়, যার প্রধান উদ্দেশ্য হলো দ্রুত মুনাফা অর্জন বা রপ্তানি।
এ প্রক্রিয়ায় দীর্ঘমেয়াদি পরিবেশগত, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষতির হিসাব প্রায়শই উপেক্ষা করা হয়। লাতিন আমেরিকার প্রখ্যাত পরিবেশবাদী চিন্তাবিদ এদুয়ার্দো গুদিন্যাস এবং রাজনৈতিক পরিবেশতত্ত্ববিদ মাইকেল ওয়াটস তাদের গবেষণায় দেখিয়েছেন যে, এই এক্সট্র্যাকটিভিজম মডেল কিভাবে সমাজের বৈষম্য বৃদ্ধি করে, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে দুর্বল করে এবং স্থানীয় জনগণের মধ্যে প্রতিরোধ আন্দোলনকে উসকে দেয়।
বাংলাদেশে হয়তো তামা বা তেলের মতো বিশাল খনি নেই, কিন্তু কাঠামোগত দিক থেকে সিলেটের সাদাপাথর চুরির ঘটনা একই ধরনের সমস্যার প্রতি ইঙ্গিত করে। এখানে রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী গোষ্ঠী ও একটি শক্তিশালী অবৈধ নেটওয়ার্কের যোগসাজশে পাথর উত্তোলন করা হচ্ছে। এই কার্যক্রমের ফলে অর্জিত বিপুল মুনাফা সীমিত সংখ্যক মানুষের হাতে যাচ্ছে, অন্যদিকে এর ভয়াবহ পরিবেশগত ও সামাজিক ক্ষতির বোঝা বহন করছে স্থানীয় মানুষ এবং প্রকৃতি। এটি মূলত উন্নয়নের একটি অসম মডেল, যা সমাজের একটি ক্ষুদ্র অংশকে ধনী করে তোলে এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষকে আরও দরিদ্র ও ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থানে ঠেলে দেয়।
সমাজতাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে সিলেটের এ সংকটকে শুধুমাত্র একটি পরিবেশবিরোধী অপরাধ হিসেবে দেখা ভুল হবে। এটি মূলত উন্নয়নের দুটি বিপরীত ধারার মধ্যে একটি গভীর সংঘাত। একদিকে রয়েছে এক্সট্র্যাকটিভিজম; যা প্রাকৃতিক সম্পদকে কেবল অর্থনৈতিক পণ্য হিসেবে দেখে এবং এর বাজারমূল্যের ওপরই বেশি গুরুত্ব দেয়। এই মডেলের মূল উদ্দেশ্য হলো বাজারের চাহিদা মেটানো এবং সর্বোচ্চ মুনাফা অর্জন করা। অন্যদিকে আছে পরিবেশ ন্যায়বিচারের ধারণাÑ যেটি মনে করে প্রাকৃতিক সম্পদের শুধু অর্থনৈতিক মূল্য নেই; এর সাংস্কৃতিক, পরিবেশগত এবং সামাজিক মূল্যও অপরিসীম, যা কোনোভাবেই বাজারের মানদ-ে মাপা সম্ভব নয়।
পরিবেশ ন্যায়বিচার মূলত এ ধারণার ওপর প্রতিষ্ঠিত যে, প্রাকৃতিক সম্পদের সুবিধা এবং এর ক্ষতির প্রভাব সমাজের সব অংশের মধ্যে ন্যায্যভাবে বণ্টিত হওয়া উচিত। গুদিন্যাস তার লেখায় দেখিয়েছেন যে, গ্লোবাল সাউথের দেশগুলোতে এক্সট্র্যাকটিভিজমকে প্রায়ই জাতীয় উন্নয়ন হিসেবে উপস্থাপন করা হয়, কিন্তু বাস্তবে এটি আন্তর্জাতিক বাজারের ওপর দেশের নির্ভরশীলতা বাড়ায় এবং স্থানীয় জনগোষ্ঠীর সক্রিয় অংশগ্রহণকে উপেক্ষা করে। এই মডেল স্থানীয় জনগণের অধিকার ও ঐতিহ্যকে অবহেলা করে, যা তাদের মধ্যে ক্ষোভ ও প্রতিরোধের জন্ম দেয়।
মাইকেল ওয়াটসের রিসোর্স কার্স বা সম্পদের অভিশাপ তত্ত্বও এ প্রসঙ্গে খুবই প্রাসঙ্গিক। তিনি তার গবেষণায় দেখিয়েছেন যে, মূল্যবান প্রাকৃতিক সম্পদ কোনো অঞ্চলের স্থানীয় শাসনব্যবস্থাকে বিকৃত করতে পারে, দুর্নীতিকে উৎসাহিত করতে পারে এবং বহিরাগত শক্তির দখলদারিত্ব বাড়াতে পারে।
সিলেটের পাথর চুরির ক্ষেত্রে আমরা এই একই চক্রের পুনরাবৃত্তি দেখতে পাইÑ রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী ব্যক্তিদের সুরক্ষা, আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর নিষ্ক্রিয়তা এবং স্থানীয় জনগণের অসহায় অবস্থা। এই চক্রটি এমন একটি অকার্যকর শাসনব্যবস্থা তৈরি করে, যেখানে অবৈধ কার্যক্রম অবাধে চলতে থাকে এবং আইনের শাসন দুর্বল হয়ে পড়ে। এই অরাজক পরিস্থিতি স্থানীয় জনগণের মধ্যে রাষ্ট্রের প্রতি আস্থা কমিয়ে দেয় এবং সামাজিক শৃঙ্খলা ভেঙে দেয়।
এই অবৈধ সম্পদ আহরণের সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সিলেটের খাসিয়া, গারো এবং অন্যান্য স্থানীয় সম্প্রদায়, যাদের জীবনযাত্রা ও সংস্কৃতি নদী ও ভূমির সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত। অবৈধ পাথর উত্তোলনের ফলে নদীর তলদেশ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, জীববৈচিত্র্য নষ্ট হচ্ছে এবং নদীভাঙন বৃদ্ধি পাচ্ছে।
এর ফলস্বরূপ, এই জনগোষ্ঠী শুধু তাদের জীবিকা হারাচ্ছে না, বরং বন্যা ও জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকির মুখে পড়ছে। অবৈধ পাথর উত্তোলন নদীর বাস্তুসংস্থানকে সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করে দিচ্ছে, যা মাছের প্রজনন এবং অন্যান্য জলজ প্রাণীর জীবনচক্রকে ব্যাহত করছে। এর ফলে স্থানীয় মৎস্যজীবীরা জীবিকা হারাচ্ছেন এবং খাদ্য সুরক্ষাও হুমকির মুখে পড়ছে। এই স্থানীয় সম্প্রদায়ের জীবন-জীবিকা এবং ঐতিহ্যগত জ্ঞানের অবক্ষয় এক ধরনের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষতি, যা আর্থিক মূল্যে পরিমাপ করা অসম্ভব।
বাংলাদেশের জন্য এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ সতর্কবার্তা। ক্ষুদ্র পরিসরে হলেও অনিয়ন্ত্রিত সম্পদ শোষণ দেশের জলবায়ু সহনশীলতাকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। এটি সামাজিক সংহতিকে ভেঙে দিতে পারে এবং শাসনব্যবস্থার প্রতি মানুষের বিশ্বাসকে দুর্বল করে দিতে পারে।
জলবায়ু পরিবর্তনের মতো একটি বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় যখন দেশের প্রস্তুতি নেওয়া জরুরি, তখন সম্পদ চুরির মতো সমস্যার প্রতি অবহেলা করাটা এক আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত। এ ধরনের শোষণমূলক কার্যক্রম জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে সম্পর্কিত দুর্যোগগুলোকে আরও ভয়াবহ করে তোলে। নদীভাঙন এবং ভূমিধসের মতো ঘটনাগুলো প্রাকৃতিক কারণে ঘটলেও, অবৈধ বালু ও পাথর উত্তোলন সেগুলোকে আরও তীব্র করে তোলে।
এই সংকট থেকে উত্তরণের জন্য এখনই প্রয়োজন একটি শক্তিশালী, সমন্বিত এবং দূরদর্শী নীতি কাঠামো। কেবল কিছু বিচ্ছিন্ন পদক্ষেপ নয়, বরং একটি সামগ্রিক কৌশল গ্রহণ করা জরুরি।
১. আইন প্রয়োগে শূন্য সহনশীলতা : প্রথমেই আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে বিদ্যমান দুর্বলতাগুলোকে দূর করতে হবে। রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত একটি বিশেষ পরিবেশ টাস্কফোর্স গঠন করা যেতে পারে, যাদের হাতে ড্রোন, স্যাটেলাইট ছবি এবং জিপিএস-ভিত্তিক মনিটরিংয়ের মতো আধুনিক প্রযুক্তি থাকবে। এই টাস্কফোর্সকে স্বাধীনভাবে কাজ করার ক্ষমতা দিতে হবে যাতে তারা অপরাধী চক্রকে শনাক্ত করতে এবং তাদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে। এতে অবৈধ কার্যক্রম শনাক্ত করা এবং প্রমাণ সংগ্রহ করা অনেক সহজ হবে, যা অপরাধীদের শাস্তি নিশ্চিত করতে সহায়ক হবে।
২. বিকল্প জীবিকা ও অর্থনৈতিক প্রণোদনা : যারা পাথর উত্তোলনে শ্রমিক হিসেবে কাজ করে, তাদের অনেকেই চরম দারিদ্র্যের কারণে এই ঝুঁকিপূর্ণ পেশায় জড়িত হতে বাধ্য হয়। তাদের এই চক্র থেকে বের করে আনার জন্য বিকল্প জীবিকার ব্যবস্থা করা অপরিহার্য। সিলেটে ইকোট্যুরিজম, টেকসই মৎস্যচাষ ও কমিউনিটি-ভিত্তিক বনায়নের মতো পরিবেশবান্ধব কর্মসূচি চালু করা যেতে পারে, যা স্থানীয় অর্থনীতির একটি টেকসই ভিত্তি তৈরি করবে। এ উদ্যোগগুলো জলবায়ু অভিযোজন পরিকল্পনার সঙ্গে যুক্ত হলে পরিবেশ রক্ষা ও জীবিকাÑদুটোই সুরক্ষিত হবে। এছাড়া সরকার স্বল্প সুদে বা জামানতবিহীন ঋণ প্রদানের মাধ্যমে স্থানীয়দের ছোট ব্যবসা শুরু করতে উৎসাহিত করতে পারে।
৩. যৌথ সম্পদ শাসনব্যবস্থা : সম্পদের ব্যবস্থাপনায় স্থানীয় জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি। নেপালের কমিউনিটি ফরেস্ট্রি বা লাতিন আমেরিকার জলসম্পদ ব্যবস্থাপনার অভিজ্ঞতা থেকে আমরা দেখতে পাই যে, স্থানীয় জনগোষ্ঠীকে যখন সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও লাভের অংশীদার করা হয়, তখন সম্পদ ব্যবস্থাপনা অনেক বেশি টেকসই হয়। সিলেটে স্থানীয় পরিষদকে টেকসই উত্তোলনের কোটা নির্ধারণের অধিকার দেওয়া এবং উত্তোলিত আয়ের একটি অংশ স্থানীয় উন্নয়নে বিনিয়োগ করার ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে। এটি স্থানীয় মানুষের মধ্যে সম্পদের প্রতি মালিকানার অনুভূতি তৈরি করবে এবং অবৈধ উত্তোলন রোধে তাদের সক্রিয়ভাবে অংশ নিতে উৎসাহিত করবে।
৪. স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা : অবৈধ সম্পদ আহরণ সাধারণত গোপনীয়তার সুযোগে ফুলেফেঁপে ওঠে। এই গোপনীয়তা ভেঙে দেওয়ার জন্য উত্তোলনের অনুমতি, পরিবেশগত প্রভাব মূল্যায়ন এবং আইন প্রয়োগের সব তথ্য জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করা অপরিহার্য। একটি জাতীয় রিসোর্স গভর্ন্যান্স সূচক তৈরি করে প্রতি বছর তা প্রকাশ করা যেতে পারে, যা ভালো কাজ করা জেলাগুলোকে পুরস্কৃত করবে এবং দুর্বল পারফরম্যান্স চিহ্নিত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে সাহায্য করবে। এই স্বচ্ছতা জনগণের মধ্যে রাষ্ট্রের প্রতি বিশ্বাস ফিরিয়ে আনবে এবং জবাবদিহিতা নিশ্চিত করবে।
সমাজতত্ত্ব আমাদের শেখায় যে, প্রাকৃতিক সম্পদ নিয়ে সংঘাত কেবল পরিবেশের প্রশ্ন নয়Ñ এটি ক্ষমতা, অধিকার এবং উন্নয়নের দিকনির্দেশনা নিয়ে এক বৃহত্তর লড়াই। সিলেটের সাদা পাথর এই লড়াইয়ের একটি মূর্ত প্রতীক। বাংলাদেশ যদি পরিবেশগত স্থায়িত্ব, স্থানীয় ক্ষমতায়ন এবং জলবায়ু সহনশীলতার মধ্যে একটি কার্যকর ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা করতে পারে, তবে এই সংকটই হতে পারে একটি ইতিবাচক পরিবর্তনের সূচনা। এ সংকটকে যদি অবহেলা করা হয়, তবে এর ক্ষতি কেবল সিলেটেই সীমাবদ্ধ থাকবে নাÑ এটি দেশের সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং পরিবেশগত কাঠামোকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করবে।
এখন আমাদের সামনে প্রশ্নটি স্পষ্টÑ পাথরকে কি আমরা চুরি, ব্যর্থতা ও ধ্বংসের প্রতীক হতে দেব, নাকি তা দিয়ে এমন এক ভবিষ্যৎ নির্মাণ করব যেখানে প্রকৃতি, মানুষ এবং আগামী প্রজন্ম সবাই সুরক্ষিত থাকবে?
জলবায়ু পরিবর্তনের এই সংবেদনশীল দশকে, সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়া কেবল উন্নয়নের প্রশ্ন নয়Ñএটি আমাদের অস্তিত্বের প্রশ্ন। বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে এ সিদ্ধান্তগুলোর ওপর, যেখানে সম্পদ শোষণ নয়, বরং সম্পদের টেকসই ও ন্যায্য ব্যবহারই হবে উন্নয়নের মূল ভিত্তি। এ সিদ্ধান্তের ওপরই নির্ভর করবে আমরা একটি সমৃদ্ধ ও স্থিতিশীল বাংলাদেশ গড়তে পারব কিনা।
[লেখক : গবেষক ও উন্নয়নকর্মী]
মতিউর রহমান
রোববার, ১৭ আগস্ট ২০২৫
প্রাকৃতিক সম্পদকে আমরা সাধারণত উন্নয়নের আশীর্বাদ হিসেবে দেখি। এটি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, অবকাঠামো নির্মাণ ও জাতীয় গৌরব অর্জনের একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হিসেবে বিবেচিত হয়; কিন্তু গ্লোবাল সাউথের বহু দেশের মতো, বাংলাদেশের বাস্তবতায় প্রাকৃতিক সম্পদ প্রায়শই একটি জটিল ও দ্বিমুখী ভূমিকা পালন করে। সঠিক নিয়ন্ত্রণ, স্বচ্ছতা এবং দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ছাড়া যখন সম্পদ উত্তোলন করা হয়, তখন তা দুর্নীতি, পরিবেশের ভয়াবহ ধ্বংস এবং স্থানীয় মানুষের জীবন-জীবিকার অবক্ষয় ডেকে আনে। উন্নয়নের চালিকাশক্তি হওয়ার বদলে এ সম্পদগুলো সংঘাতের উৎসে পরিণত হয়।
সাম্প্রতিক সময়ে সিলেটের সীমান্ত অঞ্চলে সাদাপাথর চুরির ঘটনা এ সমস্যার তীব্রতা আমাদের সামনে তুলে ধরেছে। প্রথম দৃষ্টিতে এটি হয়তো স্থানীয় পর্যায়ের একটি অপরাধ মনে হতে পারে, কিন্তু সমাজতাত্ত্বিকভাবে এটি একটি বৃহত্তর কাঠামোগত সমস্যার প্রতিচ্ছবি। এ সমস্যাটি এক্সট্র্যাকটিভিজম বা সম্পদ-শোষণ মডেল নামে পরিচিত।
সমাজতত্ত্বে এক্সট্র্যাকটিভিজম বলতে এমন একটি অর্থনৈতিক প্রক্রিয়াকে বোঝানো হয়, যেখানে প্রাকৃতিক সম্পদকে বৃহৎ আকারে উত্তোলন করা হয়, যার প্রধান উদ্দেশ্য হলো দ্রুত মুনাফা অর্জন বা রপ্তানি।
এ প্রক্রিয়ায় দীর্ঘমেয়াদি পরিবেশগত, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষতির হিসাব প্রায়শই উপেক্ষা করা হয়। লাতিন আমেরিকার প্রখ্যাত পরিবেশবাদী চিন্তাবিদ এদুয়ার্দো গুদিন্যাস এবং রাজনৈতিক পরিবেশতত্ত্ববিদ মাইকেল ওয়াটস তাদের গবেষণায় দেখিয়েছেন যে, এই এক্সট্র্যাকটিভিজম মডেল কিভাবে সমাজের বৈষম্য বৃদ্ধি করে, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে দুর্বল করে এবং স্থানীয় জনগণের মধ্যে প্রতিরোধ আন্দোলনকে উসকে দেয়।
বাংলাদেশে হয়তো তামা বা তেলের মতো বিশাল খনি নেই, কিন্তু কাঠামোগত দিক থেকে সিলেটের সাদাপাথর চুরির ঘটনা একই ধরনের সমস্যার প্রতি ইঙ্গিত করে। এখানে রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী গোষ্ঠী ও একটি শক্তিশালী অবৈধ নেটওয়ার্কের যোগসাজশে পাথর উত্তোলন করা হচ্ছে। এই কার্যক্রমের ফলে অর্জিত বিপুল মুনাফা সীমিত সংখ্যক মানুষের হাতে যাচ্ছে, অন্যদিকে এর ভয়াবহ পরিবেশগত ও সামাজিক ক্ষতির বোঝা বহন করছে স্থানীয় মানুষ এবং প্রকৃতি। এটি মূলত উন্নয়নের একটি অসম মডেল, যা সমাজের একটি ক্ষুদ্র অংশকে ধনী করে তোলে এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষকে আরও দরিদ্র ও ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থানে ঠেলে দেয়।
সমাজতাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে সিলেটের এ সংকটকে শুধুমাত্র একটি পরিবেশবিরোধী অপরাধ হিসেবে দেখা ভুল হবে। এটি মূলত উন্নয়নের দুটি বিপরীত ধারার মধ্যে একটি গভীর সংঘাত। একদিকে রয়েছে এক্সট্র্যাকটিভিজম; যা প্রাকৃতিক সম্পদকে কেবল অর্থনৈতিক পণ্য হিসেবে দেখে এবং এর বাজারমূল্যের ওপরই বেশি গুরুত্ব দেয়। এই মডেলের মূল উদ্দেশ্য হলো বাজারের চাহিদা মেটানো এবং সর্বোচ্চ মুনাফা অর্জন করা। অন্যদিকে আছে পরিবেশ ন্যায়বিচারের ধারণাÑ যেটি মনে করে প্রাকৃতিক সম্পদের শুধু অর্থনৈতিক মূল্য নেই; এর সাংস্কৃতিক, পরিবেশগত এবং সামাজিক মূল্যও অপরিসীম, যা কোনোভাবেই বাজারের মানদ-ে মাপা সম্ভব নয়।
পরিবেশ ন্যায়বিচার মূলত এ ধারণার ওপর প্রতিষ্ঠিত যে, প্রাকৃতিক সম্পদের সুবিধা এবং এর ক্ষতির প্রভাব সমাজের সব অংশের মধ্যে ন্যায্যভাবে বণ্টিত হওয়া উচিত। গুদিন্যাস তার লেখায় দেখিয়েছেন যে, গ্লোবাল সাউথের দেশগুলোতে এক্সট্র্যাকটিভিজমকে প্রায়ই জাতীয় উন্নয়ন হিসেবে উপস্থাপন করা হয়, কিন্তু বাস্তবে এটি আন্তর্জাতিক বাজারের ওপর দেশের নির্ভরশীলতা বাড়ায় এবং স্থানীয় জনগোষ্ঠীর সক্রিয় অংশগ্রহণকে উপেক্ষা করে। এই মডেল স্থানীয় জনগণের অধিকার ও ঐতিহ্যকে অবহেলা করে, যা তাদের মধ্যে ক্ষোভ ও প্রতিরোধের জন্ম দেয়।
মাইকেল ওয়াটসের রিসোর্স কার্স বা সম্পদের অভিশাপ তত্ত্বও এ প্রসঙ্গে খুবই প্রাসঙ্গিক। তিনি তার গবেষণায় দেখিয়েছেন যে, মূল্যবান প্রাকৃতিক সম্পদ কোনো অঞ্চলের স্থানীয় শাসনব্যবস্থাকে বিকৃত করতে পারে, দুর্নীতিকে উৎসাহিত করতে পারে এবং বহিরাগত শক্তির দখলদারিত্ব বাড়াতে পারে।
সিলেটের পাথর চুরির ক্ষেত্রে আমরা এই একই চক্রের পুনরাবৃত্তি দেখতে পাইÑ রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী ব্যক্তিদের সুরক্ষা, আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর নিষ্ক্রিয়তা এবং স্থানীয় জনগণের অসহায় অবস্থা। এই চক্রটি এমন একটি অকার্যকর শাসনব্যবস্থা তৈরি করে, যেখানে অবৈধ কার্যক্রম অবাধে চলতে থাকে এবং আইনের শাসন দুর্বল হয়ে পড়ে। এই অরাজক পরিস্থিতি স্থানীয় জনগণের মধ্যে রাষ্ট্রের প্রতি আস্থা কমিয়ে দেয় এবং সামাজিক শৃঙ্খলা ভেঙে দেয়।
এই অবৈধ সম্পদ আহরণের সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সিলেটের খাসিয়া, গারো এবং অন্যান্য স্থানীয় সম্প্রদায়, যাদের জীবনযাত্রা ও সংস্কৃতি নদী ও ভূমির সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত। অবৈধ পাথর উত্তোলনের ফলে নদীর তলদেশ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, জীববৈচিত্র্য নষ্ট হচ্ছে এবং নদীভাঙন বৃদ্ধি পাচ্ছে।
এর ফলস্বরূপ, এই জনগোষ্ঠী শুধু তাদের জীবিকা হারাচ্ছে না, বরং বন্যা ও জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকির মুখে পড়ছে। অবৈধ পাথর উত্তোলন নদীর বাস্তুসংস্থানকে সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করে দিচ্ছে, যা মাছের প্রজনন এবং অন্যান্য জলজ প্রাণীর জীবনচক্রকে ব্যাহত করছে। এর ফলে স্থানীয় মৎস্যজীবীরা জীবিকা হারাচ্ছেন এবং খাদ্য সুরক্ষাও হুমকির মুখে পড়ছে। এই স্থানীয় সম্প্রদায়ের জীবন-জীবিকা এবং ঐতিহ্যগত জ্ঞানের অবক্ষয় এক ধরনের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষতি, যা আর্থিক মূল্যে পরিমাপ করা অসম্ভব।
বাংলাদেশের জন্য এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ সতর্কবার্তা। ক্ষুদ্র পরিসরে হলেও অনিয়ন্ত্রিত সম্পদ শোষণ দেশের জলবায়ু সহনশীলতাকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। এটি সামাজিক সংহতিকে ভেঙে দিতে পারে এবং শাসনব্যবস্থার প্রতি মানুষের বিশ্বাসকে দুর্বল করে দিতে পারে।
জলবায়ু পরিবর্তনের মতো একটি বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় যখন দেশের প্রস্তুতি নেওয়া জরুরি, তখন সম্পদ চুরির মতো সমস্যার প্রতি অবহেলা করাটা এক আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত। এ ধরনের শোষণমূলক কার্যক্রম জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে সম্পর্কিত দুর্যোগগুলোকে আরও ভয়াবহ করে তোলে। নদীভাঙন এবং ভূমিধসের মতো ঘটনাগুলো প্রাকৃতিক কারণে ঘটলেও, অবৈধ বালু ও পাথর উত্তোলন সেগুলোকে আরও তীব্র করে তোলে।
এই সংকট থেকে উত্তরণের জন্য এখনই প্রয়োজন একটি শক্তিশালী, সমন্বিত এবং দূরদর্শী নীতি কাঠামো। কেবল কিছু বিচ্ছিন্ন পদক্ষেপ নয়, বরং একটি সামগ্রিক কৌশল গ্রহণ করা জরুরি।
১. আইন প্রয়োগে শূন্য সহনশীলতা : প্রথমেই আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে বিদ্যমান দুর্বলতাগুলোকে দূর করতে হবে। রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত একটি বিশেষ পরিবেশ টাস্কফোর্স গঠন করা যেতে পারে, যাদের হাতে ড্রোন, স্যাটেলাইট ছবি এবং জিপিএস-ভিত্তিক মনিটরিংয়ের মতো আধুনিক প্রযুক্তি থাকবে। এই টাস্কফোর্সকে স্বাধীনভাবে কাজ করার ক্ষমতা দিতে হবে যাতে তারা অপরাধী চক্রকে শনাক্ত করতে এবং তাদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে। এতে অবৈধ কার্যক্রম শনাক্ত করা এবং প্রমাণ সংগ্রহ করা অনেক সহজ হবে, যা অপরাধীদের শাস্তি নিশ্চিত করতে সহায়ক হবে।
২. বিকল্প জীবিকা ও অর্থনৈতিক প্রণোদনা : যারা পাথর উত্তোলনে শ্রমিক হিসেবে কাজ করে, তাদের অনেকেই চরম দারিদ্র্যের কারণে এই ঝুঁকিপূর্ণ পেশায় জড়িত হতে বাধ্য হয়। তাদের এই চক্র থেকে বের করে আনার জন্য বিকল্প জীবিকার ব্যবস্থা করা অপরিহার্য। সিলেটে ইকোট্যুরিজম, টেকসই মৎস্যচাষ ও কমিউনিটি-ভিত্তিক বনায়নের মতো পরিবেশবান্ধব কর্মসূচি চালু করা যেতে পারে, যা স্থানীয় অর্থনীতির একটি টেকসই ভিত্তি তৈরি করবে। এ উদ্যোগগুলো জলবায়ু অভিযোজন পরিকল্পনার সঙ্গে যুক্ত হলে পরিবেশ রক্ষা ও জীবিকাÑদুটোই সুরক্ষিত হবে। এছাড়া সরকার স্বল্প সুদে বা জামানতবিহীন ঋণ প্রদানের মাধ্যমে স্থানীয়দের ছোট ব্যবসা শুরু করতে উৎসাহিত করতে পারে।
৩. যৌথ সম্পদ শাসনব্যবস্থা : সম্পদের ব্যবস্থাপনায় স্থানীয় জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি। নেপালের কমিউনিটি ফরেস্ট্রি বা লাতিন আমেরিকার জলসম্পদ ব্যবস্থাপনার অভিজ্ঞতা থেকে আমরা দেখতে পাই যে, স্থানীয় জনগোষ্ঠীকে যখন সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও লাভের অংশীদার করা হয়, তখন সম্পদ ব্যবস্থাপনা অনেক বেশি টেকসই হয়। সিলেটে স্থানীয় পরিষদকে টেকসই উত্তোলনের কোটা নির্ধারণের অধিকার দেওয়া এবং উত্তোলিত আয়ের একটি অংশ স্থানীয় উন্নয়নে বিনিয়োগ করার ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে। এটি স্থানীয় মানুষের মধ্যে সম্পদের প্রতি মালিকানার অনুভূতি তৈরি করবে এবং অবৈধ উত্তোলন রোধে তাদের সক্রিয়ভাবে অংশ নিতে উৎসাহিত করবে।
৪. স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা : অবৈধ সম্পদ আহরণ সাধারণত গোপনীয়তার সুযোগে ফুলেফেঁপে ওঠে। এই গোপনীয়তা ভেঙে দেওয়ার জন্য উত্তোলনের অনুমতি, পরিবেশগত প্রভাব মূল্যায়ন এবং আইন প্রয়োগের সব তথ্য জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করা অপরিহার্য। একটি জাতীয় রিসোর্স গভর্ন্যান্স সূচক তৈরি করে প্রতি বছর তা প্রকাশ করা যেতে পারে, যা ভালো কাজ করা জেলাগুলোকে পুরস্কৃত করবে এবং দুর্বল পারফরম্যান্স চিহ্নিত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে সাহায্য করবে। এই স্বচ্ছতা জনগণের মধ্যে রাষ্ট্রের প্রতি বিশ্বাস ফিরিয়ে আনবে এবং জবাবদিহিতা নিশ্চিত করবে।
সমাজতত্ত্ব আমাদের শেখায় যে, প্রাকৃতিক সম্পদ নিয়ে সংঘাত কেবল পরিবেশের প্রশ্ন নয়Ñ এটি ক্ষমতা, অধিকার এবং উন্নয়নের দিকনির্দেশনা নিয়ে এক বৃহত্তর লড়াই। সিলেটের সাদা পাথর এই লড়াইয়ের একটি মূর্ত প্রতীক। বাংলাদেশ যদি পরিবেশগত স্থায়িত্ব, স্থানীয় ক্ষমতায়ন এবং জলবায়ু সহনশীলতার মধ্যে একটি কার্যকর ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা করতে পারে, তবে এই সংকটই হতে পারে একটি ইতিবাচক পরিবর্তনের সূচনা। এ সংকটকে যদি অবহেলা করা হয়, তবে এর ক্ষতি কেবল সিলেটেই সীমাবদ্ধ থাকবে নাÑ এটি দেশের সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং পরিবেশগত কাঠামোকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করবে।
এখন আমাদের সামনে প্রশ্নটি স্পষ্টÑ পাথরকে কি আমরা চুরি, ব্যর্থতা ও ধ্বংসের প্রতীক হতে দেব, নাকি তা দিয়ে এমন এক ভবিষ্যৎ নির্মাণ করব যেখানে প্রকৃতি, মানুষ এবং আগামী প্রজন্ম সবাই সুরক্ষিত থাকবে?
জলবায়ু পরিবর্তনের এই সংবেদনশীল দশকে, সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়া কেবল উন্নয়নের প্রশ্ন নয়Ñএটি আমাদের অস্তিত্বের প্রশ্ন। বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে এ সিদ্ধান্তগুলোর ওপর, যেখানে সম্পদ শোষণ নয়, বরং সম্পদের টেকসই ও ন্যায্য ব্যবহারই হবে উন্নয়নের মূল ভিত্তি। এ সিদ্ধান্তের ওপরই নির্ভর করবে আমরা একটি সমৃদ্ধ ও স্থিতিশীল বাংলাদেশ গড়তে পারব কিনা।
[লেখক : গবেষক ও উন্নয়নকর্মী]