ফজলে রাব্বি মোহাম্মদ আহ্সান
বিভিন্ন রাজনৈতিক দল বা পেশাজীবী সংগঠন তাদের কর্মসূচিকে ঘিরে ঢাকার রাস্তা বা গুরুত্বপূর্ণ রাস্তাসংলগ্ন উদ্যান দখল করে তাদের কর্মসূচি পালন করে। ফলে এ কর্মসূচিকে ঘিরে তৈরি হয় মহাযানজট। রাজনৈতিক দলগুলোর বা সংগঠনগুলোর এ ধরনের কর্মসূচি, শোভাযাত্রা, আনন্দ মিছিল ইত্যাদিতে সাধারণ মানুষ কষ্ট পাচ্ছেন। ঘণ্টার পর ঘণ্টা গাড়ি এক জায়গায় ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকে। সারা রাস্তা গাড়ি আটকানো!
ঢাকার যানজট একটি জটিল ও বহুমুখী সমস্যা; যা নগর জীবনের প্রায় প্রতিটি দিককে প্রভাবিত করছে। ট্রাফিক পুলিশ যানজট নিরসনে নিরলস চেষ্টা করেন। তাদের দাবিÑ যাতে যাত্রী সাধারণ বা পথচারীরা ভোগান্তিতে না পড়েন!
এ বিষয়ে আচরণগত অর্থনীতির ব্যাখ্যা।
ঢাকার যানজটের সমস্যাটি শুধুমাত্র অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতা বা প্রশাসনিক ব্যর্থতার ফল নয়! এর পেছনে রয়েছে বহুমুখী কারণÑ বাসগুলোর অনিয়ন্ত্রিত চলাচল, নির্ধারিত স্টপেজ না মানা, রিকশা বা অধুনা ব্যাটারিচালিত রিক্সার আধিক্য, সরু রাস্তা বা রাস্তার অপ্রতুলতা যা মোট ভূমির মাত্র ৭-৮%, যা আছে তার আবার ৩০% অবৈধ পার্কিং ও দখলে, ইত্যাদি! এ যানজট সমস্যাটিকে আচরণগত অর্থনীতির দৃষ্টিকোণ থেকে কয়েকটি তত্ত্বের আলোকে ব্যাখ্যা করা হলো :
ঢাকার রাজনৈতিক মিছিলে অংশগ্রহণকারীরা নিজেদের উদ্দেশ্য (আনন্দ বা রাজনৈতিক বার্তা প্রচারে) পূরণে রাস্তা দখল করাকে যুক্তিসঙ্গত মনে করেন। কিন্তু তাদের এই স্বার্থপর সিদ্ধান্ত সমষ্টিগতভাবে যানজট সৃষ্টি করে। যা শেষ পর্যন্ত তাদেরই ক্ষতি করে যেমন- অ্যাম্বুলেন্স দেরি, জ্বালানি নষ্ট, সময়ের অপচয় ইত্যাদি। মানুষের আচরণে ‘স্বার্থপর যুক্তিসঙ্গতা’ তত্ত্ব কাজ করে। প্রতিটি ব্যক্তি নিজের সুবিধা অনুযায়ী কাজ করতে চায়। কিন্তু যখন সবাই একইভাবে আচরণ করে, তখন সামষ্টিক বিপর্যয় নেমে আসে বা সৃষ্টি হয়।
রাজনৈতিক দল বা মিছিলকারীরা ‘বর্তমান’-এ তাদের কর্মসূচির সাফল্যকে অগ্রাধিকার দেয়। কিন্তু যানজটের দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষতি, যেমন- উৎপাদনশীলতা হ্রাস, পরিবেশ দূষণ ইত্যাদিকে উপেক্ষাে করে। মানুষ তাৎক্ষণিক সুবিধাকে ভবিষ্যতের চেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়। এটি ‘হাইপারবোলিক ডিসকাউন্টিং’-এর উদাহরণ।
যখন একটি দল রাস্তা অবরোধ করে, অন্য দল বা ব্যক্তিরাও একই কাজ করে। ‘সবাই করছে, তাহলে আমিও করব’- এ হার্ডিং ইফেক্ট যানজটকে আরও বাড়িয়ে তোলে। মানুষ অন্যদের দেখে আচরণ করতে পছন্দ করে। বিশেষ করে অনিশ্চিত পরিস্থিতিতে।
ট্রাফিক পুলিশ বা প্রশাসন মনে করে যে, তারা যানজট নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে। কিন্তু রাজনৈতিক দলের শক্তি বা জনসাধারণের আচরণের জটিলতা তাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। মানুষের বিশ্বাস যে, তারা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে, কিন্তু বাস্তবে তা সম্ভবপর হয় না; যা নিয়ন্ত্রণের বিভ্রম! এ বিভ্রম প্রশাসনকে প্রতিকারের ব্যর্থ পরিকল্পনা নিতে উদ্বুদ্ধ করে।
রাজনৈতিক দল বা মিছিলকারীদের জন্য রাস্তা অবরোধের কারণে কোন ধরনের জেল-জরিমানা বা আইনি কোন শাস্তি ভোগ করতে হয় না বা না থাকায় তারা এ কাজ করতে উৎসাহিত হয়। বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে যদি নির্দিষ্ট স্থানে মিছিলের অনুমতি, সময়সূচি দেওয়া হয়, তাহলে যানজট কমতে পারত। তা দুইপক্ষের বিবেচনায় অনুপস্থিত বলেই চাক্ষুস দৃশ্যমান। আচরণগত অর্থনীতি বলছে, প্রণোদনা মানুষের আচরণ বদলাতে সাহায্য করে।
সাধারণ মানুষ বিভিন্ন খাতে ভিন্নভাবে লাভ-ক্ষতি হিসাব করে। যানজটকে সামনে রেখে তারা ‘ঢাকা তো এমনই’ ‘অনিবার্য’ হিসেবে মেনে নিয়ে আলাদা এক মানসিক অবস্থায় অবস্থান করে। এ রেজিগনেশন বা সমর্পণ যানজট সমাধানের চেষ্টাকে দুর্বল করে।
যানজটের ব্যাপ্তি ও প্রভাব :
প্রতিদিন ৪৬ মিনিট যানজটে নষ্ট হলে তার বার্ষিক ক্ষতি ৪০-৫০ হাজার কোটি টাকা। যার দ্বারা প্রতি বছর ১টি পদ্মা সেতুর মত সেতু তৈরি করা সম্ভব। জিডিপি ২.৯% হ্রাস পায়। বায়ুদূষণে শ্বাসকষ্ট, হৃদরোগ, ক্যান্সার, শব্দদূষণে মানসিক চাপ ও শ্রবণক্ষমতা হ্রাস পায়। শিশুদের বুদ্ধিমত্তা বিকাশ বাধাপ্রাপ্ত (সিসার প্রভাব) হয়। শিক্ষার্থীদের দেরিতে গন্তব্যে পৌঁছানো, কর্মজীবীদের উৎপাদনশীলতাও হ্রাস পায়।
সমাধানের জন্য আচরণগত কৌশল :
রাজনৈতিক মিছিলের জন্য নির্দিষ্ট স্থান ও সময় বরাদ্দ করে দেওয়া, যেমন- সোহরাওয়ার্দী উদ্যান। যাতে রাস্তা অবরোধ না হয়।
গণমাধ্যমে যানজটের ক্ষতি সম্পর্কে সচেতনতা বাড়ানো। যাতে মিছিলকারীরা লজ্জা বোধ করে।
রাস্তা অবরোধকারী দলগুলোকে জরিমানা বা রাজনৈতিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত করা।
ট্রাফিক পুলিশকে আরও সক্রিয়ভাবে বিকল্প রুট সুপারিশ করতে বলা। তাদের এআইভিত্তিক আধুনিক শহর ব্যবস্থাপনায় বা মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে রিয়েল-টাইম ট্রাফিক আপডেট দেওয়ার যুগে প্রবেশ করতে হবে।
সিঙ্গাপুর বা জাপানের মডেল অনুসরণ করে গণপরিবহনকে আকর্ষণীয় করে তুলতে হবে।
ট্রাফিক আইন মেনে চলা ও গণপরিবহন ব্যবহারে নাগরিকদের আগ্রহী করে তোলা
উপসংহার :
ঢাকার যানজট শুধু যান প্রকৌশলের সমস্যা নয়। এটি মানুষের আচরণগত ব্যর্থতারও ফল। আচরণগত অর্থনীতির পরকলায় দেখলে বোঝা যায় কিভাবে স্বার্থপর সিদ্ধান্ত, সামাজিক প্রমাণ এবং প্রণোদনার অভাব এ সমস্যাকে জটিল থেকে জটিলতর করে তুলছে। সমাধানের জন্য প্রথাগত পদ্ধতির পাশাপাশি আচরণগত হস্তক্ষেপ প্রয়োজন।
[লেখক : ডেপুটি চিফ (প্লানিং), ঢাকা ওয়াসা]
ফজলে রাব্বি মোহাম্মদ আহ্সান
রোববার, ১৭ আগস্ট ২০২৫
বিভিন্ন রাজনৈতিক দল বা পেশাজীবী সংগঠন তাদের কর্মসূচিকে ঘিরে ঢাকার রাস্তা বা গুরুত্বপূর্ণ রাস্তাসংলগ্ন উদ্যান দখল করে তাদের কর্মসূচি পালন করে। ফলে এ কর্মসূচিকে ঘিরে তৈরি হয় মহাযানজট। রাজনৈতিক দলগুলোর বা সংগঠনগুলোর এ ধরনের কর্মসূচি, শোভাযাত্রা, আনন্দ মিছিল ইত্যাদিতে সাধারণ মানুষ কষ্ট পাচ্ছেন। ঘণ্টার পর ঘণ্টা গাড়ি এক জায়গায় ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকে। সারা রাস্তা গাড়ি আটকানো!
ঢাকার যানজট একটি জটিল ও বহুমুখী সমস্যা; যা নগর জীবনের প্রায় প্রতিটি দিককে প্রভাবিত করছে। ট্রাফিক পুলিশ যানজট নিরসনে নিরলস চেষ্টা করেন। তাদের দাবিÑ যাতে যাত্রী সাধারণ বা পথচারীরা ভোগান্তিতে না পড়েন!
এ বিষয়ে আচরণগত অর্থনীতির ব্যাখ্যা।
ঢাকার যানজটের সমস্যাটি শুধুমাত্র অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতা বা প্রশাসনিক ব্যর্থতার ফল নয়! এর পেছনে রয়েছে বহুমুখী কারণÑ বাসগুলোর অনিয়ন্ত্রিত চলাচল, নির্ধারিত স্টপেজ না মানা, রিকশা বা অধুনা ব্যাটারিচালিত রিক্সার আধিক্য, সরু রাস্তা বা রাস্তার অপ্রতুলতা যা মোট ভূমির মাত্র ৭-৮%, যা আছে তার আবার ৩০% অবৈধ পার্কিং ও দখলে, ইত্যাদি! এ যানজট সমস্যাটিকে আচরণগত অর্থনীতির দৃষ্টিকোণ থেকে কয়েকটি তত্ত্বের আলোকে ব্যাখ্যা করা হলো :
ঢাকার রাজনৈতিক মিছিলে অংশগ্রহণকারীরা নিজেদের উদ্দেশ্য (আনন্দ বা রাজনৈতিক বার্তা প্রচারে) পূরণে রাস্তা দখল করাকে যুক্তিসঙ্গত মনে করেন। কিন্তু তাদের এই স্বার্থপর সিদ্ধান্ত সমষ্টিগতভাবে যানজট সৃষ্টি করে। যা শেষ পর্যন্ত তাদেরই ক্ষতি করে যেমন- অ্যাম্বুলেন্স দেরি, জ্বালানি নষ্ট, সময়ের অপচয় ইত্যাদি। মানুষের আচরণে ‘স্বার্থপর যুক্তিসঙ্গতা’ তত্ত্ব কাজ করে। প্রতিটি ব্যক্তি নিজের সুবিধা অনুযায়ী কাজ করতে চায়। কিন্তু যখন সবাই একইভাবে আচরণ করে, তখন সামষ্টিক বিপর্যয় নেমে আসে বা সৃষ্টি হয়।
রাজনৈতিক দল বা মিছিলকারীরা ‘বর্তমান’-এ তাদের কর্মসূচির সাফল্যকে অগ্রাধিকার দেয়। কিন্তু যানজটের দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষতি, যেমন- উৎপাদনশীলতা হ্রাস, পরিবেশ দূষণ ইত্যাদিকে উপেক্ষাে করে। মানুষ তাৎক্ষণিক সুবিধাকে ভবিষ্যতের চেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়। এটি ‘হাইপারবোলিক ডিসকাউন্টিং’-এর উদাহরণ।
যখন একটি দল রাস্তা অবরোধ করে, অন্য দল বা ব্যক্তিরাও একই কাজ করে। ‘সবাই করছে, তাহলে আমিও করব’- এ হার্ডিং ইফেক্ট যানজটকে আরও বাড়িয়ে তোলে। মানুষ অন্যদের দেখে আচরণ করতে পছন্দ করে। বিশেষ করে অনিশ্চিত পরিস্থিতিতে।
ট্রাফিক পুলিশ বা প্রশাসন মনে করে যে, তারা যানজট নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে। কিন্তু রাজনৈতিক দলের শক্তি বা জনসাধারণের আচরণের জটিলতা তাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। মানুষের বিশ্বাস যে, তারা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে, কিন্তু বাস্তবে তা সম্ভবপর হয় না; যা নিয়ন্ত্রণের বিভ্রম! এ বিভ্রম প্রশাসনকে প্রতিকারের ব্যর্থ পরিকল্পনা নিতে উদ্বুদ্ধ করে।
রাজনৈতিক দল বা মিছিলকারীদের জন্য রাস্তা অবরোধের কারণে কোন ধরনের জেল-জরিমানা বা আইনি কোন শাস্তি ভোগ করতে হয় না বা না থাকায় তারা এ কাজ করতে উৎসাহিত হয়। বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে যদি নির্দিষ্ট স্থানে মিছিলের অনুমতি, সময়সূচি দেওয়া হয়, তাহলে যানজট কমতে পারত। তা দুইপক্ষের বিবেচনায় অনুপস্থিত বলেই চাক্ষুস দৃশ্যমান। আচরণগত অর্থনীতি বলছে, প্রণোদনা মানুষের আচরণ বদলাতে সাহায্য করে।
সাধারণ মানুষ বিভিন্ন খাতে ভিন্নভাবে লাভ-ক্ষতি হিসাব করে। যানজটকে সামনে রেখে তারা ‘ঢাকা তো এমনই’ ‘অনিবার্য’ হিসেবে মেনে নিয়ে আলাদা এক মানসিক অবস্থায় অবস্থান করে। এ রেজিগনেশন বা সমর্পণ যানজট সমাধানের চেষ্টাকে দুর্বল করে।
যানজটের ব্যাপ্তি ও প্রভাব :
প্রতিদিন ৪৬ মিনিট যানজটে নষ্ট হলে তার বার্ষিক ক্ষতি ৪০-৫০ হাজার কোটি টাকা। যার দ্বারা প্রতি বছর ১টি পদ্মা সেতুর মত সেতু তৈরি করা সম্ভব। জিডিপি ২.৯% হ্রাস পায়। বায়ুদূষণে শ্বাসকষ্ট, হৃদরোগ, ক্যান্সার, শব্দদূষণে মানসিক চাপ ও শ্রবণক্ষমতা হ্রাস পায়। শিশুদের বুদ্ধিমত্তা বিকাশ বাধাপ্রাপ্ত (সিসার প্রভাব) হয়। শিক্ষার্থীদের দেরিতে গন্তব্যে পৌঁছানো, কর্মজীবীদের উৎপাদনশীলতাও হ্রাস পায়।
সমাধানের জন্য আচরণগত কৌশল :
রাজনৈতিক মিছিলের জন্য নির্দিষ্ট স্থান ও সময় বরাদ্দ করে দেওয়া, যেমন- সোহরাওয়ার্দী উদ্যান। যাতে রাস্তা অবরোধ না হয়।
গণমাধ্যমে যানজটের ক্ষতি সম্পর্কে সচেতনতা বাড়ানো। যাতে মিছিলকারীরা লজ্জা বোধ করে।
রাস্তা অবরোধকারী দলগুলোকে জরিমানা বা রাজনৈতিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত করা।
ট্রাফিক পুলিশকে আরও সক্রিয়ভাবে বিকল্প রুট সুপারিশ করতে বলা। তাদের এআইভিত্তিক আধুনিক শহর ব্যবস্থাপনায় বা মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে রিয়েল-টাইম ট্রাফিক আপডেট দেওয়ার যুগে প্রবেশ করতে হবে।
সিঙ্গাপুর বা জাপানের মডেল অনুসরণ করে গণপরিবহনকে আকর্ষণীয় করে তুলতে হবে।
ট্রাফিক আইন মেনে চলা ও গণপরিবহন ব্যবহারে নাগরিকদের আগ্রহী করে তোলা
উপসংহার :
ঢাকার যানজট শুধু যান প্রকৌশলের সমস্যা নয়। এটি মানুষের আচরণগত ব্যর্থতারও ফল। আচরণগত অর্থনীতির পরকলায় দেখলে বোঝা যায় কিভাবে স্বার্থপর সিদ্ধান্ত, সামাজিক প্রমাণ এবং প্রণোদনার অভাব এ সমস্যাকে জটিল থেকে জটিলতর করে তুলছে। সমাধানের জন্য প্রথাগত পদ্ধতির পাশাপাশি আচরণগত হস্তক্ষেপ প্রয়োজন।
[লেখক : ডেপুটি চিফ (প্লানিং), ঢাকা ওয়াসা]