alt

উপ-সম্পাদকীয়

মবের উন্মাদনা ও ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক অধিকার

বাবুল রবিদাস

: রোববার, ১৭ আগস্ট ২০২৫

সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে প্রায়শই ‘মব’ বা উচ্ছৃঙ্খল জনতার হাতে নিরীহ, সাদাসিধে, আলাভোলা মানুষের প্রাণহানির ঘটনা ঘটছে। ইংরেজিতে একে বলা হয় Angry Mob বা Riotous Crowd- অর্থাৎ এমন একদল উত্তেজিত জনতা, যারা আইন নিজের হাতে তুলে নেয়, বিচার করেÑ এমনকি হত্যার মতো জঘন্য অপরাধেও লিপ্ত হয়। শান্তিপূর্ণ জনতার সঙ্গে এদের পার্থক্য হলো, তারা অসংলগ্ন, অবিবেচক এবং উন্মাদ এক শক্তিতে রূপ নেয়। রাজনৈতিক ভাষায় একে বলা হয় Ochlocrazy বা Mob Justice। এ ধরনের অরাজকতা সভ্য সমাজের জন্য গভীর হুমকি।

তারাগঞ্জের নির্মম ঘটনা

সম্প্রতি রংপুর জেলার তারাগঞ্জ উপজেলায় ভ্যানচোর সন্দেহে দুই নিরীহÑরুপলাল দাস ও প্রদীপ দাসÑউচ্ছৃঙ্খল জনতার হাতে নির্মমভাবে নিহত হয়েছেন। ঘটনার বিবরণ হৃদয়বিদারক।

মিঠাপুকুর উপজেলার প্রদীপ দাস নিজের ভ্যান চালিয়ে আত্মীয় রুপলাল দাসের বাড়ি যাচ্ছিলেন। পথে তারা সায়ার ইউনিয়নের বুড়িরহাট এলাকায় পৌঁছালে কিছু লোক ভ্যান থামিয়ে তল্লাশি শুরু করে। ভ্যানে থাকা কয়েকটি প্লাস্টিকের বোতলে স্থানীয় পানীয় পেয়ে তারা গুজব ছড়ায়Ñএটি নাকি চোলাই মদ। মুহূর্তেই উত্তেজিত জনতা তাদের দুজনকে ঘিরে ধরে এবং পিটুনি দিতে থাকে। একপর্যায়ে তাদের স্কুলে নিয়ে যাওয়া হয় এবং বেধড়ক মারধরের ফলে অচেতন হয়ে পড়েন। পুলিশ এসে উদ্ধার করলেও চিকিৎসাধীন অবস্থায় দুজনেই মৃত্যুবরণ করেন।

এ প্রশ্ন জোরালোভাবে সামনে আসেÑযদি তাদের কাছে সত্যিই স্থানীয় পানীয় থাকতেও পারে, তবে কি এজন্য মানুষকে গণপিটুনি দিয়ে হত্যা করা সভ্য সমাজে গ্রহণযোগ্য হতে পারে? আইন ও ন্যায়ের শাসনের দেশে এ ধরনের অমানবিকতা কখনোই সহ্য করা যায় না।

ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক বাস্তবতা

বাংলাদেশে ২৫৫টি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী রয়েছে। এদের মধ্যে ‘রবিদাস’ সম্প্রদায় একটি। ঐতিহ্যগতভাবেই তারা ‘তাড়ি’, ‘হাড়িয়া’ বা ‘পঁচুই’ পান করে থাকে। ব্রিটিশ আমল থেকেই এ পানীয় তাদের জীবনযাত্রার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। সারাদিনের কঠোর পরিশ্রমের পর সন্ধ্যায় কিংবা বিভিন্ন ধর্মীয় ও সামাজিক উৎসবে তারা এ পানীয় ব্যবহার করে থাকে।

এ বাস্তবতা বিবেচনা করেই বাংলাদেশ সরকার ২০১৮ সালে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন প্রণয়ন করে। ওই আইনের ১১(১) ধারা অনুযায়ী, পারমিট ছাড়া কেউ অ্যালকোহল পান করতে পারবে না। তবে উপধারা (২)এ বলা আছেÑমুচি, মেথর, ডোম, চা-শ্রমিক ও ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর জনগণ তাদের ঐতিহ্যগতভাবে প্রচলিত স্থানীয় পানীয় পান করতে পারবেন। অর্থাৎ রবিদাসসহ বিভিন্ন ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর লোকেরা আইনত তাদের প্রথাগত চোলাই মদ বা হাঁড়িয়া পান করতে বাধামুক্ত।

আইন, সংস্কৃতি ও সমাজের দায়

এখানে মূল বিষয় হলো এই ঐতিহ্য ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর সংস্কৃতি, পরিচয় ও জীবনযাত্রার অবিচ্ছেদ্য অংশ। তাদের তৈরি পানীয়কে বিদেশি মাদক বা ক্ষতিকর নেশাজাতীয় দ্রব্যের সঙ্গে এক কাতারে ফেলা যায় না। বাস্তবে দেখা গেছে, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর জনগণ ফেনসিডিল, ইয়াবা, হেরোইন বা কোকেনের মতো সর্বনাশা মাদকের ধারেকাছেও যায় না।

অতএব, তাদের সাংস্কৃতিক অধিকার রক্ষা করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। আইন এই বিষয়টি স্পষ্টভাবে নিশ্চিত করেছে। কিন্তু সাধারণ মানুষ অজ্ঞতার কারণে কিংবা গুজবের বশে অনেক সময় অন্যায়ভাবে তাদের ওপর আঘাত হানে। তারাগঞ্জের ঘটনাটি সেই অজ্ঞতার ভয়াবহ উদাহরণ।

মব জাস্টিস বা উচ্ছৃঙ্খল গণবিচার একটি সভ্য সমাজের জন্য কলঙ্ক। এটি আইনের শাসনকে ভেঙে ফেলে, সমাজে ভীতি ও অরাজকতা সৃষ্টি করে। অন্যদিকে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক অধিকারকে অস্বীকার করা মানে তাদের অস্তিত্বকেই অস্বীকার করা।

অতএব, রাষ্ট্র ও সমাজকে সচেতন হতে হবে। মানুষকে আইন সম্পর্কে জানাতে হবে, গুজব ঠেকাতে হবে এবং আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে। নইলে তারাগঞ্জের মতো ট্র্যাজেডি বারবার ঘটতে থাকবে।

[লেখক : আইনজীবী, জজ কোর্ট, জয়পুরহাট]

বিমানবন্দরে প্রবাসীদের হয়রানি বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ কতদূর?

জীবন থেকে নেয়া শিক্ষাগুলোই এগিয়ে দেয় জীবনকে

রাজনৈতিক কর্মসূচি, যানজট ও আচরণগত অর্থনীতি

সম্পদের অভিশাপ : সিলেটের সাদাপাথরে সংঘাতের সমাজতত্ত্ব ও নীতি-সংকট

নির্বাচন সুষ্ঠু হবে তো

মৎস্যসম্পদ সংরক্ষণ ও টেকসই ব্যবহার জরুরি

ছবি

সাদাপাথরের নীলাভ দেশ : ভোলাগঞ্জের সৌন্দর্য ও সংকট

একাকীত্ব ও সামাজিক বিচ্ছিন্নতার সমাজতত্ত্ব

বেইজিংয়ের সঙ্গে নয়াদিল্লির নতুন ভূরাজনীতি

মব ও জাস্টিস

ইতিহাসকে নতুন করে লেখা এক জগাখিচুড়ি!

নারীর সমঅধিকার : সমাজ পরিবর্তনের চাবিকাঠি

জ্ঞানের মঞ্চ এখন সার্কাস, গবেষণা সেখানে নীরব দর্শক

ছবি

ভরা শ্রাবণে স্বদেশ-ভাবনা

নারীর প্রতি সহিংসতা : বাস্তবতা, আইন ও প্রতিরোধের জরুরি দিকনির্দেশনা

ছাত্র রাজনীতি : নেতৃত্বের হাতেখড়ি নাকি দাসত্বের লেজুড়বৃত্তি?

ছবি

নারীর প্রতি সহিংসতা বন্ধ করতেই হবে

ছবি

উন্নয়ন ও প্রকৃতি

ছবি

কৃষকের চেয়ে বড় উদ্যোক্তা আর কে আছে

ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর শিশুদের শিক্ষাগত ও সামাজিক সমস্যা

ট্রেড ইউনিয়ন ও বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট

সব অর্জনে কৃতিত্ব নিতে নেই

নাগাসাকি দিবস : পারমাণবিক বোমার অপপ্রয়োগ বন্ধ হোক

আদিবাসী অধিকার : দায় ঘোচানোর সুযোগ এসেছে, কাজে লাগাতে হবে রাষ্ট্রকেই

অদৃশ্য আগ্রাসনের বিরুদ্ধে লড়াই : উষ্ণ বাংলাদেশে জলবায়ু-প্রসূত স্বাস্থ্য সংকট

নেতানিয়াহুর এক ভ্রান্ত কৌশলের মুখোমুখি ইসরায়েল

আসিয়ানে বাংলাদেশের অভিযাত্রা : সম্ভাবনার পথে কূটনৈতিক বাস্তবতা ও রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ

ভাঙছে নদী, গড়ছে দুঃখের গ্রাম

ছবি

গণঅভ্যুত্থান ও গণআকাক্সক্ষা : এক বছরে অর্জনটা কী?

ছবি

ভিন্নমত, ভিন্নপথ এবং প্রান্তজনের স্বপ্ন

আচরণগত অর্থনীতির আয়নায় বাংলাদেশিদের বিদেশযাত্রা

গরিবের ইলিশ শুধুই স্বপ্ন কেন?

চব্বিশের গণঅভ্যুত্থান : বৈষম্য ও স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে জাগরণ

শারীরিক শিক্ষা : সুস্থ ও সচেতন প্রজন্ম গড়ার সম্ভাবনা

জ্ঞানতীর্থের সংকট ও গবেষণাবিমুখ উচ্চশিক্ষা

ছবি

জুলাই অভ্যুত্থান-গাথা : মেঘ থম থম করে

tab

উপ-সম্পাদকীয়

মবের উন্মাদনা ও ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক অধিকার

বাবুল রবিদাস

রোববার, ১৭ আগস্ট ২০২৫

সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে প্রায়শই ‘মব’ বা উচ্ছৃঙ্খল জনতার হাতে নিরীহ, সাদাসিধে, আলাভোলা মানুষের প্রাণহানির ঘটনা ঘটছে। ইংরেজিতে একে বলা হয় Angry Mob বা Riotous Crowd- অর্থাৎ এমন একদল উত্তেজিত জনতা, যারা আইন নিজের হাতে তুলে নেয়, বিচার করেÑ এমনকি হত্যার মতো জঘন্য অপরাধেও লিপ্ত হয়। শান্তিপূর্ণ জনতার সঙ্গে এদের পার্থক্য হলো, তারা অসংলগ্ন, অবিবেচক এবং উন্মাদ এক শক্তিতে রূপ নেয়। রাজনৈতিক ভাষায় একে বলা হয় Ochlocrazy বা Mob Justice। এ ধরনের অরাজকতা সভ্য সমাজের জন্য গভীর হুমকি।

তারাগঞ্জের নির্মম ঘটনা

সম্প্রতি রংপুর জেলার তারাগঞ্জ উপজেলায় ভ্যানচোর সন্দেহে দুই নিরীহÑরুপলাল দাস ও প্রদীপ দাসÑউচ্ছৃঙ্খল জনতার হাতে নির্মমভাবে নিহত হয়েছেন। ঘটনার বিবরণ হৃদয়বিদারক।

মিঠাপুকুর উপজেলার প্রদীপ দাস নিজের ভ্যান চালিয়ে আত্মীয় রুপলাল দাসের বাড়ি যাচ্ছিলেন। পথে তারা সায়ার ইউনিয়নের বুড়িরহাট এলাকায় পৌঁছালে কিছু লোক ভ্যান থামিয়ে তল্লাশি শুরু করে। ভ্যানে থাকা কয়েকটি প্লাস্টিকের বোতলে স্থানীয় পানীয় পেয়ে তারা গুজব ছড়ায়Ñএটি নাকি চোলাই মদ। মুহূর্তেই উত্তেজিত জনতা তাদের দুজনকে ঘিরে ধরে এবং পিটুনি দিতে থাকে। একপর্যায়ে তাদের স্কুলে নিয়ে যাওয়া হয় এবং বেধড়ক মারধরের ফলে অচেতন হয়ে পড়েন। পুলিশ এসে উদ্ধার করলেও চিকিৎসাধীন অবস্থায় দুজনেই মৃত্যুবরণ করেন।

এ প্রশ্ন জোরালোভাবে সামনে আসেÑযদি তাদের কাছে সত্যিই স্থানীয় পানীয় থাকতেও পারে, তবে কি এজন্য মানুষকে গণপিটুনি দিয়ে হত্যা করা সভ্য সমাজে গ্রহণযোগ্য হতে পারে? আইন ও ন্যায়ের শাসনের দেশে এ ধরনের অমানবিকতা কখনোই সহ্য করা যায় না।

ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক বাস্তবতা

বাংলাদেশে ২৫৫টি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী রয়েছে। এদের মধ্যে ‘রবিদাস’ সম্প্রদায় একটি। ঐতিহ্যগতভাবেই তারা ‘তাড়ি’, ‘হাড়িয়া’ বা ‘পঁচুই’ পান করে থাকে। ব্রিটিশ আমল থেকেই এ পানীয় তাদের জীবনযাত্রার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। সারাদিনের কঠোর পরিশ্রমের পর সন্ধ্যায় কিংবা বিভিন্ন ধর্মীয় ও সামাজিক উৎসবে তারা এ পানীয় ব্যবহার করে থাকে।

এ বাস্তবতা বিবেচনা করেই বাংলাদেশ সরকার ২০১৮ সালে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন প্রণয়ন করে। ওই আইনের ১১(১) ধারা অনুযায়ী, পারমিট ছাড়া কেউ অ্যালকোহল পান করতে পারবে না। তবে উপধারা (২)এ বলা আছেÑমুচি, মেথর, ডোম, চা-শ্রমিক ও ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর জনগণ তাদের ঐতিহ্যগতভাবে প্রচলিত স্থানীয় পানীয় পান করতে পারবেন। অর্থাৎ রবিদাসসহ বিভিন্ন ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর লোকেরা আইনত তাদের প্রথাগত চোলাই মদ বা হাঁড়িয়া পান করতে বাধামুক্ত।

আইন, সংস্কৃতি ও সমাজের দায়

এখানে মূল বিষয় হলো এই ঐতিহ্য ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর সংস্কৃতি, পরিচয় ও জীবনযাত্রার অবিচ্ছেদ্য অংশ। তাদের তৈরি পানীয়কে বিদেশি মাদক বা ক্ষতিকর নেশাজাতীয় দ্রব্যের সঙ্গে এক কাতারে ফেলা যায় না। বাস্তবে দেখা গেছে, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর জনগণ ফেনসিডিল, ইয়াবা, হেরোইন বা কোকেনের মতো সর্বনাশা মাদকের ধারেকাছেও যায় না।

অতএব, তাদের সাংস্কৃতিক অধিকার রক্ষা করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। আইন এই বিষয়টি স্পষ্টভাবে নিশ্চিত করেছে। কিন্তু সাধারণ মানুষ অজ্ঞতার কারণে কিংবা গুজবের বশে অনেক সময় অন্যায়ভাবে তাদের ওপর আঘাত হানে। তারাগঞ্জের ঘটনাটি সেই অজ্ঞতার ভয়াবহ উদাহরণ।

মব জাস্টিস বা উচ্ছৃঙ্খল গণবিচার একটি সভ্য সমাজের জন্য কলঙ্ক। এটি আইনের শাসনকে ভেঙে ফেলে, সমাজে ভীতি ও অরাজকতা সৃষ্টি করে। অন্যদিকে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক অধিকারকে অস্বীকার করা মানে তাদের অস্তিত্বকেই অস্বীকার করা।

অতএব, রাষ্ট্র ও সমাজকে সচেতন হতে হবে। মানুষকে আইন সম্পর্কে জানাতে হবে, গুজব ঠেকাতে হবে এবং আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে। নইলে তারাগঞ্জের মতো ট্র্যাজেডি বারবার ঘটতে থাকবে।

[লেখক : আইনজীবী, জজ কোর্ট, জয়পুরহাট]

back to top